লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

উমা মণ্ডল

জহর বিষয়ক—

জহরের কাল মুছে গেছে সেই কবে। পুরাণের পৃষ্ঠা থেকে কখনো শুনতে পায়নি কেউই। জীবাশ্মের ছায়া তবু বেঁচে থাকে। লুকোচুরি খেলা। এই দেখা, এই ভ্রম… মরীচিকা পায়ে পায়ে ঘোরে বেখেয়ালে। কুণ্ডের ভাষায় যদি বলা যায় আগুনের আঁচ আছে। সেই যে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি; তুলিরেখা মুখে অবন ঠাকুর। আসলে সে বিষ বিষয়ক শব্দবন্ধে ঘোরে ছিল বহুকাল। নতুন বৌঠান শুধু বলে গেল না কিছুই।

উড়ে উড়ে কথা বলে নিষিদ্ধ রাত্রির। গন্ধ পায় চিতাকাঠ ঘি চামড়া পোড়া আদিমের। বন্য আঁতুড়ের ঘরে জন্ম নেওয়া প্রতিমার চোখ জ্বলে গেছে আগেই; যোনির দ্বারে দারোয়ান বাঁধা। পথে কাঁটাখেত। তবু কালো প্যাঁচা মাংসাশী প্রাণী। তার প্রাণ চাই।
এই ঘণ্টা কি সতর্ক করে???? ঈশ্বরের দূত নর্দমায় বয়ে যায়। পাশে পড়ে থাকা অজন্মা ভ্রূণটি ধর্ষণের অবৈধ প্রমাণ। ওকে জহরের কালে নিয়ে যাও। আর শয়ে শয়ে অবলা বালারা ওদেরও ধরো একসাথে। বাঁধো। ঘাটে ঘাটে প্রদীপের আস্ফালন। এইভাবে পথ ব্যস্ত। রাঙা সূর্য ফুটে আছে পৃথিবীর গায়ে।

যদি ঘাড় ধরে থাকা হাতটাকে আগুনের উৎসবে তুলে দেওয়া যেত বেশ হত। কুণ্ডের কিন্তু পুরুষ বিষয়ক মাংসের চাহিদা আছে পুরাকাল থেকে। একবার জিভে নিয়েই দেখুক। অমৃত মন্থন

বিষবৃক্ষ—

এইসব উপন্যাসে দম্পতির বিছানায় চোরাকাঁটা
চকচক করে
অবকাশ যাপনের অছিলায় ডাক দেয়
খাদের ঈশানকোণে

অশনি এমনই মায়ামৃগ
কস্তুরী নেশায় পথ ডাকে
আরও কাছে, আরও কাছে
পথিকটি এখনও সরল ছকে কাটাচিহ্ন খেলে
বাঁক থেকে বাঁকে যে মৃত্যুর পরওনা নিয়ে
বাটখারা বসে আছে
সেই সংবাদপত্রের পাতা সে পড়ে ওঠেনি
আর্যভট্টের ভক্তটি শুধু সরলরেখায় বিন্দু গুনে চলে

ওগো খই এইভাবে ওড়া ঠিক নয়
পড়েছ যমের পাতা; অবসরে
ঘুম ছিল চোখে…

ফলারের সাদা খই সই পাতিয়েছে লেবু ও লঙ্কার সাথে। ওরা ভাগ্যচক্রে কালো বেড়া দেয়। বেড়ালের এঁটোমাছ নিয়ে ঝোল রাঁধে। তার সাথে রাঁধুনি মশলা। খই তাই উড়ে যায় শোকচিহ্ন নিয়ে

বার বার চিহ্ন আঁকো অবলা আমার
কবে যে খুঁটের ধার খেয়ে গেছে তোতাপাখি…
পাখি শুধু হরিনাম বোঝে; শতবার কর গুনে খাবি খায়
ওদিকে শিকড় হাত লম্বা করে ভিতে
ভূমিকম্প ডেকে আনে

দুর্গা সহায়—


আমি সেই সুর চিনি… বাঁশি থেকে উড়ে আসা পথের গানটি আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে। ফেলে আসা কথা মাত্রা পেয়ে যায়

আশ্বিনের ঢেউ এসে গেল। প্রকৃতিতে শারদীয়া লেখা। কোথা থেকে জন্ম অসুখের আমাকে মনে পড়েছে। গায়ে জ্বর। সামনের খোলা জানলাটি এক পাঠাগার। শব্দগুলি উড়োচিঠি যেন। পড়ে ফেললেই হল। একলা ঘর বলে যে-বাতিস্তম্ভের নাম রাখা, বিদ্যুৎ সংকেত পেয়ে চমকে ওঠে। চোখ স্থির হয়

অন্য একটি চোখের ছায়া পড়ে। সেই ছায়াপথে অদৃশ্যের মায়াগন্ধ। এক অতলের ডাক। মেয়েটির জলে ভরা আয়নাটি কত কথা বলে। হে, নৈঃশব্দ্য…


দুর্গার গায়ে তাপের প্রকোপ বেড়েই চলে; তবু কাশে ভরা রেলপথ হাত তুলে ডাকে। পায়ে যাযাবর খুর বাঁধা। আর সেই চোখ, জলে ভরা সেই চোখ… নৌকা টানে ছলাৎ, ছলাৎ

জল শুধু জল… পোড়ামাটির ঈশ্বর তখন অস্থির। মাটি ধুয়ে যায়, কাঠামোও; কালাশৌচ পার করে পরিবার যাত্রা করে অন্য পথে। তখন ওরা তিনেতে বন্দি। ভিটেতে ‘কাল’ শিকড় পুঁতেছে; সর্পিল চলাফেরা। এইসব দৃশ্যপট, গোরুরগাড়ির ধুন; স্মৃতিময়…

কিন্তু সেই চোখ, জলে ভরা চোখ; দরজায় হাত রেখে ঠায়… মাটি ডাকে, ছড়া কাটা মাটি; এই ভিটে প্রদীপের সলতে তখনও নামিয়ে রাখেনি।


প্রকৃতি এখন আশ্বিনের দরজায়। কাঠামোয় মৃন্ময়ীর চোখ আঁকা হয়ে গেছে। মেঘগুলো চালচিত্র তৈরি করে একতারা সুরে। ওদের পালকে নক্ষত্রের সংসার। আমার গায়ে জ্বর। সামনের জানলায় ইতিহাস, বর্তমান… পাশে পড়ে ওষুধের ছেঁড়া নামগুলো; চোখ স্থির। হয়তো কাশের ভেলা দেখছে কিংবা রেলপথ, টানা রেলপথ…

বিন্দুতে আরম্ভ, বিন্দুতে সমাপ্তি; সব একাকার… অনন্তের পথে, লন্ঠনের আলো, জ্বর রাত; বিশল্যকরণী… বাঁশি বেজে যায়। জলে ভরা চোখ থেকে গভীরের ডুব; মায়াপথ। তল থেকে চিন্ময়ী আলোককণা সংকেত পাঠায়। দুর্গারা এখনও ত্রিশুলের শব্দ ভুলে যায়নি পুরোটা। চোখ বন্ধ হয়ে আসে; ঘুম চিরঘুম। দরজাটা বন্ধ আছে।
হে, নৈঃশব্দ্য… দুর্গা সহায়

 

Facebook Comments

পছন্দের বই