লেখক নয় , লেখাই মূলধন

লোকজ উৎসব

ভাস্বতী রায়

নন্দোৎসব: দধিকাদো ও পুরাতন রাজবংশী সংস্কৃতির অবক্ষেপ

করতোয়া নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা খ্রিস্টাব্দ পূর্বের প্রাচীন সাম্রাজ্য পৌণ্ড্রবর্ধন ও কামরূপের অন্যতম আদি বাসিন্দা হল রাজবংশী। সুপ্রাচীন ও কঠোর সামাজিক ব্যবস্থা্র নিগড়ে গড়া কৃষিজীবী এই সমাজে উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম। ধর্মপ্রাণ রাজবংশী সমাজের সমস্ত উৎসবে অনুষ্ঠানে জড়িয়ে আছে বেদ পুরাণের আখ্যান কিংবা রাজবংশী লোকপুরাণের কোনো ‘কিচ্ছা’। সমস্ত উৎসব তাই ঈশ্বরকে স্মরণ রেখে। প্রবীণ মানুষদের কাছে শুনে সেইসব আখ্যান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহন করে চলেছে রাজবংশী সমাজ। দীর্ঘকাল ধরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই শ্রুতি কাহিনিগুলোর মাধ্যমে রাজবংশী সমাজে এই উৎসবগুলোর তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়।

পাশাপাশি বসবাসকারী নানা উপজাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে রাজবংশী সংস্কৃতির আদানপ্রদান ও সর্বোপরি বিশ্বায়নের (গ্লোবালাইজেশন) প্রভাবে উৎসব অনুষ্ঠানগুলো তাৎপর্য হারাচ্ছে। আবার কোথাও নবকলেবরে পালিত হচ্ছে কোনো উৎসব। কোথাও-বা বিকৃতি হচ্ছে। বস্তুত বর্তমান সময়ে উৎসবগুলোর অস্তিত্ব সংকটে। তেমনই এক উৎসব হল নন্দোৎসব। বৈষ্ণব মতবাদে দীক্ষিত রাজবংশী পরিবারে এই উৎসব পৃথক গুরুত্ব বহন করলেও সমগ্র রাজবংশী সমাজ এই উৎসবে মেতে ওঠে। এই উৎসবের আগাগোড়া বাৎসল্যভাবের প্রাধান্য দেখা যায়।

জন্মাষ্টমীর পরের দিনের অনুষ্ঠান, রাজবংশীরা যাকে বলে ‘দধিকাদো’। এই দুই দিনের অনুষ্ঠান একযোগে ‘নন্দোৎসব’ বলে অভিহিত হয়। রাজবংশী সমাজে বিশ্বাস, যে, পিতা ও পুত্রকে একযোগে এই উৎসব পালন করা উচিত। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম উপলক্ষে হয় জন্মাষ্টমী। এই দিন ‘বত্ত’ (ব্রত > বত্ত) থাকা হয়। দিনে উপবাসে থেকে পূজা অর্চনা শেষে নিশি যাপন পালন করা হয়। এইসময় কৃষ্ণের বাল্যলীলাকে সামনে রেখে নানান ভক্তিমূলক গান পরিবেশিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তরশতনাম, কৃষ্ণজন্মের নানান ‘কিচ্ছা’ (আখ্যান) বর্ণনা করা হয়। এর পরদিন, অর্থাৎ, নবমীর দিন আনন্দ উৎসব। এই দিন রাজবংশী সমাজে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বছরের অন্যতম আনন্দ উৎসব এই দিন। এই দিন পালনের ক্ষেত্রে রাজবংশী সমাজে বৈচিত্রের শেষ নেই। রাজবংশী সমাজে এই দিনটিকে বলা হয় ‘দধিকাদো’। এই দিনে দধি অর্থাৎ, দই বিশেষ ভূমিকা পালন করে সমস্ত ক্ষেত্রে। সারাদিন নানান উৎসবে ও আনন্দে ভরে থাকে ছোটো থেকে বড়ো সকলে। কয়েকটি পর্যায়ে অনুষ্ঠানগুলি সমাপন হয়।

ধর্মীয় কারণবশত কিংবা রাজবংশী সমাজ কৃষিপ্রধান হওয়ার জন্য বিশেষত এই দিনে গোরু ও গোয়ালঘরের পরিচর্যা করা হয়। সকালে গোয়ালীঘর বা গোশালা পরিষ্কার করে ধুয়ে-মুছে গোরু বাছুরদের স্নান করিয়ে রাখা হয়। আবার এই ভাদ্র মাসটি রাজবংশী সমাজে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নানান সংস্কারে, প্রবাদে প্রবচনে ভাদ্র মাসের গুরুত্ব উঠে এসেছে। এইসময় সাধারণত কৃষি সংক্রান্ত কাজ বিশেষ থাকে না। সময়ের বেশ আগেই (ধান বোনা) ‘রোয়া গারা’ শেষ হয়ে যায়। পাট ছোলা, ধোওয়া ও শুকোনোর কাজও সমাপ্ত কিংবা একেবারে শেষের পর্যায়ে। তাই কৃষি যন্ত্রগুলো ধুয়ে শুকিয়ে তুলে রাখা হয়। রাজবংশী মতে এই সময় কৃষিকাজ বাদ দিতে হয়। রাজবংশী প্রবাদ অনুযায়ী ‘ভাদরের তের, হাল কিসসি ছাড়ো’।

ভাদ্র মাসে নববধূ যায় ‘নাইওর’-এ, অর্থাৎ, পিত্রালয়ে। এই যাওয়াকে বলে ‘ভাদরকাটানি’। আবার রাজবংশী লোকপুরাণ মতে ভাদ্র মাসে হয় ‘সিং-এর বিয়াও।’ ‘সিং’ বিয়ে করতে যায় দক্ষিণ দেশে। সিংয়ের সঙ্গে ‘বোঝা উভা’, অর্থাৎ, তল্পিবাহক হিসেবে যায় সমস্ত পক্ষীকুল। বিশেষত ‘ঢাডো সারো’ ও ‘ত্যাল সারো’ (দুই প্রজাতির শালিক পাখি)। আবার রাজবংশী বিশ্বাস মতে ‘ভাদই সাতাও’, অর্থাৎ, ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে যে-বৃষ্টিপাত হয় তাতেই শীতকালের সূচনা। ফলে এই দিন গোরু বাছুরকে স্নান করানোর প্রথা বেশ পুরোনো।

এরপর হয় নন্দোৎসবের মূল অনুষ্ঠানের সূচনা।

সবার প্রথমে হয় স্নান উৎসব। বাড়িতে বাল গোপালের বিগ্রহে দধি দুগ্ধে স্নান করানো হয়। এরপর নানা উপচারে পূজা ও ভোগ হয়। নিরামিষ ভোগে থাকে বিশেষত ‘ঢ্যাপের চালের নাড়ু মলা’ (শাপলা ফুলের বীজ থেকে একপ্রকার চাল হয়) ‘বজ্রার নাড়ু’ (একধরনের বৃহৎ আকারের ভুট্টা) ও তালের রসের তৈরি নানা পদ। এর মধ্যে অন্যতম হল তালের নাড়ু, মালপোয়া, মণ্ডা, তালের পাতিজরা, তালের খিরসা আর সিন্নি। ভোগ নিবেদন হয়ে গেলে শুরু হয় ‘দধিকাদো’ খেলা।

মন্দির প্রাঙ্গনে এই খেলার সূচনা হয়। এই খেলার আসরের এককোণে একটি ছোটো মাটির ঢিপি স্থাপন করা হয়। কেউ কেউ এর ওপরে গোপালের বিগ্রহ স্থাপন করে। দুধ জল দিয়ে এই স্থানে ফল, দই, খই দিয়ে পূজা করা হয় তিনজোড়া ফল আর একজোড়া কড়িকে। তেল ও সিঁদুর দিয়ে মঙ্গল চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়। সেই স্থানে চতুষ্কোণ বা গোলাকার করে বিশাল এক অঞ্চলের মাটি কেটে নরম করে রাখা হয়। পুজো হয়ে গেলে ঐ নরম মাটিতে পঞ্চগব্য (দুধ, দধি, ঘৃত, গোময়, গোমূত্র) ঢেলে খানিকটা কাদা বানানো হয়। একে বলে ‘কাদো দেওয়া’। আগে থেকে এনে রাখা জল ঢেলে সম্পূর্ণ অংশটিকে কাদা করা হয়। ‘মারেয়া’ (সংকল্পকারী) বা গৃহকর্তা এর পর ‘খেলানটি’ বা ‘খেলাটু’, অর্থাৎ, খেলোয়াড়দের হাতে খেলার সামগ্রী ফলগুলো তুলে দেয়। এই অনুষ্ঠানকে বলে ‘কাদো ছাড়ি দেওয়া’। এরপর শুরু হয় নানান প্রকার খেলা। তবে শুরুটা হয় ‘নাইকোল খেলা’ দিয়ে।

উৎসর্গীকৃত নারকেল জোড়ার একটি নিয়ে প্রথম খেলা শুরু করতে হয়। কাদো খেলা বা নাইকোল খেলা দিয়ে কাদো খেলার প্রথম সূচনা হয়। খেলায় মেয়েরা সমস্ত জোগান দিলেও এই খেলা মূলত পুরুষ ও বালকেদের। একটি নারকেলকে ঘিরে শুরু হয় দুই পক্ষের মল্লযুদ্ধ। সঙ্গে শুরু হয় ঢাক ও ‘করকা’-র বাদ্য। একজন নারকেলটি চার হাতে পায়ে আঁকড়ে ধরে আর অপরজন সেটাকে তার হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে দর্শক যে-কোনো একটি পক্ষ নেয়। প্রয়োজনে জুটি বেঁধে খেলায় অবতীর্ণ হয়। সকলে প্রবল উৎসাহে এই খেলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে মেতে থাকে।

অপাদমস্তক কাদায় গড়াগড়ি করে খেলা হয়। ক্রমাগাত জল ঢেলে কাদার পিচ্ছিলতা বজায় রাখা হয়। মল্লযুদ্ধের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষ নিয়ে শুরু হয় বাজি ধরা। এইভাবে নারকেল, ‘জম্বুরা’ (বাতাবি লেবু), পানিকুমরা বা পুর (চালকুমড়ো) নিয়ে মল্লযুদ্ধ হয়। এরপরে হয় কড়ি খেলা। এক প্রতিযোগীর হাতের মুঠোতে ধরা থাকে দু-টি কড়ি। তার মুঠো থেকে সেটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে প্রতিপক্ষজন। এছাড়া ঐ কাঁদায় অনেকে লাউ বা কুমড়োর বীজ ছড়িয়ে দেয়। কে কতগুলো সংগ্রহ করতে পারে তারও প্রতিযোগিতা হয়।

দধিভাণ্ড একটি সমবেত খেলা। ‘নাইকোল খেলা’-র মতো প্রতিযোগিতা নেই এতে। খুব উঁচু দু-টি গাছের মাঝে একটি দড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। সেই দড়ি থেকে ঝুলতে থাকে একটি ‘হাণ্ডি’ (হাড়ি)। সেই হাণ্ডিকে পেড়ে আনতে হয় বা ভাঙতে হয়। একের কাঁধে অপরজন দাঁড়িয়ে মনুষের পিরামিড বানিয়ে ঐ উচ্চতায় পৌঁছুতে হয়। এই পিরামিড বানিয়ে ওপরে ওঠার পদ্ধতিকে বলে ‘কলোর গছ’ (কলা গাছ)।

চিত্র ঋণ : গনেশ মান মুখিয়া

বাঁশের খেলায় একটি বাঁশের ‘ঝিক মাঠে’, অর্থাৎ, ডাল-পালা ভালোভাবে কেটে তাতে তেল জল দিয়ে পিচ্ছিল করা হয়। সেই বাসের মাথায় উঠে পেরে আনতে হয়ে ওপরে বাঁধা পুরস্কার।

এছাড়াও আরও নানা ধরনের খেলা হয়।

এই অনুষ্ঠানে মাদক দ্রব্য সম্পূর্ণরূপে বর্জিত। বড়োদের খেলা শেষে ছোটো শিশুদের নামিয়ে দেওয়া হয় ঐ কাঁদায়। তারা আপন মনে কিছুক্ষণ কাঁদায় খেলে। মায়েরা দাঁড়িয়ে শিশুর খেলা দেখে। এরপর একের পর এক খেলা চলতে থাকে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত। সমস্ত রাজবংশী পুরুষেরা এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারে। অংশগ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। ‘বেলা’ (সূর্য অর্থে) যেতে শুরু করলে খেলা শেষ হয় ঐ তিনজোড়া ফল ‘গতান’ দেওয়ার মাধ্যমে, অর্থাৎ, ঐ তিন জোড়া ফল ও একজোড়া কড়ি ‘মারেয়া’-র হাতে ফেরত দিতে হয়। নারকেলগুলোকে প্রসাদ হিসেবে রাখা হয়। চালকুমড়ো গুলোকে প্রসাদ হিসেবে রান্না করা হয়। এরপর খেলোয়াড়রা সবাই স্নান করে এসে প্রথমে ঐ নারকেলের ‘পাকা প্রসাদ’ গ্রহণ করে। খেলোয়াড়দের প্রসাদ গ্রহণ হয়ে গেলে নিমন্ত্রিত ও প্রতিবেশী সকলে প্রসাদ গ্রহণ করে। সবশেষে গৃহকর্তা। পরদিন ‘শিতলি সেবা’ ও নিয়মভঙ্গ।

চিত্র ঋণ : সুমিত সা

নানা কারণে এই প্রাচীন ধর্মীয় উৎসবগুলো বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে। এর নানাবিধ কারণ আছে। বর্তমানে নিষ্ঠার পরিবর্তে প্রতিযোগিতা, বাজি ধরা, আকর্ষণীয় পুরষ্কার এই উৎসবগুলোর অনেকটা অংশজুড়ে আছে। পুরোনো নিয়মগুলির বহু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই পরিবর্তন কতটা ভালো, না, বিকৃত হচ্ছে— সে-প্রসঙ্গে বিতর্ক আছে। তবে এই পরিবর্তন বা সংকটের সম্ভাব্য কিছু কারণ আলোচনা করছি।

যেমন—

১) বিশ্বায়নের প্রভাবে ভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে, বিশেষত টিভি, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ভিন্ন ধারার সংস্কৃতির সংস্পর্শে রাজবংশী সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।

২) কৃষিপ্রধাণ রাজবংশী সমাজ পূর্বে কৃষিকর্ম ও গো-পালন ছাড়া অন্য জীবিকার সাথে যুক্ত ছিল না। ফলে কৃষিকাজের দিনপঞ্জির সাথে উৎসবগুলোর যোগসূত্র ছিল গভীর। কিন্তু, বর্তমানে বিভিন্ন জীবিকা, ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে একপ্রকার ছন্দপতন ঘটেছে।

৩) বর্তমান রাজবংশী সমাজের সেই পরম্পরাগত রীতিকে অনুসরণের জন্য সামাজিক নিয়ম ও কঠোরতা আর নেই। ফলে নন্দোৎসবের মতো উৎসব তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে তা স্বাভাবিক।

সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। প্রতিবেশীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান সজীব সংস্কৃতির লক্ষণ। রাজবংশী সংস্কৃতিও এই ধারা বজায় রেখেছে। রাজবংশী সমাজে বরাবর রক্ষণশীলতার পরিবর্তে আদানপ্রদানের মনোভাব স্পষ্ট। নন্দোৎসব তাই বিলুপ্ত নাও হতে পারে। কে জানে হয়তো নবকলেবরে আরও মুখর হয়ে উঠতে পারে।

Facebook Comments

পছন্দের বই