লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

যশোধরা রায়চৌধুরী

১ নভেম্বর রাত্রির কবিতা


কোনো কোনো রাতে হঠাৎ ফিরে আসে সেই জাগরণ
কোনো কোনো রাতে , নিদ্রাহারা , আমি পাই সেই চেতনা
ভাস্বর হয়ে ওঠার মুহূর্ত আর প্রাসাদোপম
কোনো এক মূর্খ আত্মকেন্দ্রিকতার ভেঙে পড়ার মুহূর্ত
এক সাথে মিলে মিশে যায়

ঘুমহীনতা এক অসুখ।
ভাস্বরতা এক সুখ।
আমি ত চেতন!! আহা, আমি কি চেতন।

তার দু-তিন ঘণ্টা পরে অবশ্যই
শুধু ঘুমের ওষুধ চেয়ে ক্রন্দনরোল ওঠে আমার।


কোনো কোনো রাতে ইন্দ্রিয় সব সতর্ক হয়ে ওঠে
বাতাসে বারুদের গন্ধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে
যাপনের মধ্যে সমস্ত ছেনালি স্পষ্ট হয়ে ওঠে
মিথ্যা হয়ে ওঠে প্রকট

কোনো কোনো রাতে বাতাস স্বচ্ছ হয়ে ওঠে
প্রখর হয়ে ওঠে ঘ্রাণ
পোড়া পোড়া গন্ধ পাই
জানালায় চোখ ঠেকালে দেখতে পাই বাইরে
অন্ধকারেও নড়াচড়া করছে কারা

এই তীব্র বোধ নিয়ে এখন আমি কি করি
মগজের অক্সিজেন মাত্রা ছাড়া হয়ে গেলে কোনো কোনো রাতে
আমরা জেগে উঠি এবং জেগে থাকি এবং জানতে পারি
অনেক কিছু জানতে পারি
অনেক কিছু বুঝতে পারি


কোনো কোনো রাতে
আমরা জানতে পারি
যে, জীবনের অধিকাংশ সমস্যার কোনো সমাধান নেই।
আমরা খবরের কাগজে দেখেছি
ফ্লাইওভারের তলায় কুড়িয়ে পাওয়া মানুষের মুখ
যার কোনো পরিচয় নেই
যাকে বলি একটি নম্বরযুক্ত শবদেহ

কোনো কোনো রাতে
সমস্ত ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে
সমস্ত নশ্বরতা নম্বরযুক্ত হয়ে যায় আমার কাছে


এইসব রাতেই
আমি স্পষ্ট দেখি
আমরা কী করতে চাইছি আর কী করতে চলেছি
আমরা একটি পিছল রাস্তায় হামাগুড়ি দিচ্ছি
শিরদাঁড়ার বিনিময়মূল্যে বেঁচে আছি
আমরা খাড়াই বেয়ে উঠেছি
শুধু নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে চাইছি যাতে ফসকে না পড়ে যাই
আমরা শুধু আছি
সমাধানহীন সমস্যার সমাধানের জন্য
একরকমের অভ্যাসবশত হাত-পা নাড়তে নাড়তে

কোনো কোনো রাতে
আমি জানতে পেরেছি
পরতের পর পরত খুলে
একটার পর একটা নতুন গল্প আমরা দেখতে পাবো
প্রতিটি মিথ্যার পেছনে আছে আরও একটি মিথ্যা
সেই মিথ্যার পর্দার পেছনে আছে আরো একটি মিথ্যা।

সবার পিছনে আছে আরো একটি সত্য
স্পষ্ট জানতে যারা পারে,
তারা চিরতরে বধির ও অন্ধ হয়ে যায়
কেননা তারা জেনেছে
একটা সরু সুতোর ওপর কীভাবে রয়েছে সব
এই দুলছে মৃত্যুর দিকে
তো ওই দুলছে বেঁচে থাকার দিকে।


কোন কোন রাতে আমি নিজেই খুব স্বচ্ছ হয়ে গেছি
এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়িয়েছি প্রেতাত্মার মত
এবং জানতে পেরেছি যে আমার সমস্ত মিথ্যাচরণ
আসলে নিজেকে বাঁচানোর জন্য

আমি জেনেছি যে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী দুটি পৃথিবী
চিরতরে ভাগ হয়ে গেছে
একদল রাস্তায় বসে পুরনো কাগজ নিয়ে আগুন জ্বলে এবং হাত গরম করে
তারা সভ্যতায় বিশ্বাস করে না
তারা সাম্য এবং সুবিচারে বিশ্বাসী নয়
তাদের উদ্ধার করতে হবে বলে
আরেক দল বেরিয়েছে বুলডোজার নিয়ে

তারা বন্ধ ঘরে থাকে
তাদের জানালায় নেই কোনো কাগজ আটকানো
তাদের ছিদ্রহীন ঘরে
গুনগুন করে মেশিন
তারা সকাল থেকে বিকেল
হাত সেঁকে নেয়
নিজেদের অনিবার্য ক্ষমতার আগুনে
কাঠ কুড়িয়ে আনতে হয় না তাদের
জল ভরে আনতে হয় না, অনেক দূর থেকে

তাই তারা বিশ্বাস করে এবং বিশ্বাসকে বিশ্বাস করে
এবং অবিশ্বাসীদের
বিশ্বাসে ফেরাবে বলে
অন্যায়কারীদের ন্যায় ফেরাবে বলে
তারা মস্ত মস্ত সব ধজা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে
যুদ্ধজয়ের জন্য

জয়ীদের সঙ্গে
এবং বিজিতদের সঙ্গে
কী কী হয় এবং কী কী হবে
কোনো কোনো রাতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়ে যাই।

সেই দিন আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে

কিন্তু সেই দিন আমি সবচেয়ে বেশি জীবিত বোধ করি।

Facebook Comments

পছন্দের বই