উত্তরপুরুষ, তুমি
হরপ্পা
একটি সভ্যতা মরে যেভাবে, আত্মীয়স্বজনহীন, স্মরণ-অনুষ্ঠান ছাড়াই—
ঠিক তেমন মরে পড়ে আছে একটি রোঁয়া ওঠা শালিখ।
নির্জনে পচে যাচ্ছে একটি মৃতদেহ যার ইতিহাস আমরা জানি না
এই দৃশ্য দেখে নিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে জীবন
আকাশে চক্কর কাটছে খিদে
আর তুমি তালা খুলে ঢুকে পড়ছ এমন একটি শহরে
যার কোনো কাব্যগ্রন্থ নেই
একটি সভ্যতা যেভাবে মরে, স্মৃতি ছাড়া, গান ছাড়া, কাব্য ছাড়া—
সেভাবেই মরে পড়ে আছে একটি শালিখ।
মেঘের ওপর থেকে গোঁত্তা খেয়ে নেমে আসছে চিল ও শকুন
***
দূরত্ব
উপসর্গহীন অসুখের মতো, যদি কেউ আসে, আমি দরজা খুলব না
সমস্ত অক্ষরের ভিতর হাওয়া, যেন হেস্তনেস্ত করে ফেলতে হবে
ছোঁয়াচ এড়িয়ে দূর থেকে দেখব বসন্তের হাওয়ায় তোমার মাথার চুল উড়ছে
উপসর্গহীন, আমি ডাকব না তোমায়, সাড়াও দেব না আমি আর
যক্ষিণী যেমন থাকে কৃষ্ণের বাঁশি শুনেও একাকী পাথর
কোনো ছিদ্র রাখিনি আমি, বিশ্বাস করো, কোনো পর্দা উড়িয়েই
তুমি আর আমায় বিশ্বদর্শন করাতে পারবে না এখন
প্রাচীন একটি পাখি শুধু উড়ে এসে বসবে আমার জানলায়
মেঘদূতের মতো, যখন বৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই আর
***
একেকটি বাড়ি দেখলেই…
একেকটি বাড়ি দেখলেই মনে পড়ে যায় আমাদেরও ফিরে যাওয়ার কথা ছিল
সেই কবে বেরিয়ে পড়েছি, —কত পাথর ঝরনা হল, কত মাঠ ধানক্ষেত
কত সভ্যতাকে পোষ মানালাম আমরা, —রক্ত আর বীজ ছড়িয়ে দিলাম কত
কত শ্লোক কত মহাকাব্য হল, ধর্মগ্রন্থ লিখলাম, তৈরি হল অস্ত্র
মৃত্যুর সঙ্গে এক গোপন বোঝাপড়া হল আমাদের
তবু মাঝেমাঝেই মনে পড়ে যায়, আমাদেরও ফিরে যাওয়ার কথা ছিল
একেকটি বাড়ি দেখলেই, যার পাশ দিয়ে চলে গেছে গত শতাব্দীর রেললাইন
পুকুরের জলে ছায়া পড়েছে একঝাঁক উড়ে যাওয়ার
***
চৌকাঠ
বৃষ্টির ভিতরে দৌড়ে যাওয়া যে রাস্তা নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবে, জীবন তার মতো।
আশ্চর্য এক শৈশব যা ফুরোয় না কখনোই, যেন শেষ কথা বলে যাবে বলে
আয়ু ও সময়ের সঙ্গে হেস্তনেস্ত করছে, কে কত পায় আর কাকে কত দেওয়া বাকি,—
এমন বৃষ্টির দিনে শঙ্খ ঘোষ মনে পড়ে না, এমন দুঃখের দিনেও না
জল কমে আসছে শরীরের, নোনা হাওয়ায় মনে পড়ছে কত মাঝি দিগন্তে নোঙর ফেলেছেন
মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে রামধনু রঙের মৃত্যু
একটি প্রেমের কবিতা লেখা হল না আজও, যার দুঃখ থেকে খসে পড়ে চোখ
ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখো হে জীবন, বৃষ্টির ভিতর, তোমার সমস্ত অপেক্ষার মধ্যে
জ্বলে উঠছে একটি প্রদীপ, —যখন কেউ আসার কথা নেই
এক দরজা থেকে আরেক দরজার দিকে ছুটে চলেছে যাজ্ঞসেনী হাওয়া
***
নিষিদ্ধ
ওই রাস্তায় তোমার প্রবেশাধিকার নেই, ওই জানলার দিকে তুমি তাকাতে পার না
মৃত্যু এসে বসে আছে রকে, দু-ঠোঙা খিদে নিয়ে, পাশাপাশি ঘুরছে কিছু মাছি ও কুকুর
ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হবে না, এই ব’লে বাড়ির দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে
অনেকদিন হল; অনেকদিন কোনো বাড়ির দেওয়ালে থমথম করে না পোস্টার
আমাদের কবিতায় কোনো রবীন্দ্রনাথ নেই আর, মাঝেমাঝে ডাকঘর খোলা হয়
হারমোনিয়াম বাজে, টাকার মধ্যে কত যে শ্বাসকষ্ট শোনা যায় তুমি বোঝ না—
মনে হয় শূন্য একটা গলির ভিতর দিয়ে হেঁটে গেল মিলিটারি বুটের আওয়াজ
একে গান বলো তুমি? ভালোবাসা ততটুকুই, যে মন দিয়ে তুমি প্রদীপ জ্বালাও,
জলে ভাসিয়ে দেবে বলে। জল সব বোঝে। জলে মুখ দেখ না তবুও;
ওই রাস্তায় তোমার প্রবেশাধিকার নেই, ওই জানলার দিকে তুমি তাকাতে পার না।
11 replies on “হিন্দোল ভট্টাচার্যের গুচ্ছকবিতা”
প্রতিটি কবিতা খুব ভালো লাগল। মনে হল সমকাল ছুঁয়ে আছে আবহমানের কবিতা।
বস্তুত এই গুচ্ছর একটি থেকে অপরটি একটি বৃত্তাকার যাত্রা, যা শুরু হয় মিথিক্যাল কিছু নামকে মূল শব্দ করে ফেলার অনায়াস দক্ষতা দিয়ে আর এসে মেশে কবিতার পূর্ণ সংজ্ঞায় ।
অনবদ্য সব কবিতা।।
এক শব্দে অনবদ্য।য
দূরত্ব আর নিষিদ্ধ দুটো অসামান্য কবিতা।
আমার নমস্কার রইল।
হরপ্পা , চৌকাঠ , নিষিদ্ধ অসামান্য । বাহ! বাহ!
প্রতিটি কবিতাই অনবদ্য ।
অসাধারণ লেখা…
খুব ভাল লাগল। প্রতিটি কবিতাই একেকটা ভাস্কর্য।
বেশ ভালো লাগলো কবিতাগুলো। শুভ হোক
প্রতিটি কবিতা বার পাঁচেক করে পড়তে বাধ্য হলাম। আগামীতেও আবার ফিরে আসব এই কবিতা গুলির কাছে।
লেখাগুলো যেন মন, প্রাণ…মায় হাত পা… আমার জল দিয়ে আঁকা শরীর স্পর্শ করলো ! কলকাতার মত একটা ‘গ্রামে’ বসে এরকম লেখা অত্যন্ত কঠিন ।