লেখক নয় , লেখাই মূলধন

নীহারুল ইসলামের গল্প

খোদার মর্জি

সিলেপচিতে হাত ধোওয়াতে গিয়ে সামান্য একটু হাতে হাত ছোঁয়া। নসিবুনের মগজে যেন কারেন্টের শক লাগে। শরীরে শিহরণ খেলে যায়। লজ্জা পায়। হাত কেঁপে ওঠে। হাতে ধরা জগ থেকে পানি ছলকে পড়ে দস্তরখানায়। দস্তরখানা ভিজে যায়। তবু মেঘ কেটে বেরোনো রোদের মতো মনটা চনমন করে ওঠে।

এই প্রথম মরদকে নসিবুনের মনে পড়ে না। বদলে ভালো করে মৌলবিসাহেবকে দেখবার ইচ্ছে হয়। সে দেরি করে না, মৌলবিসাহেবের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। ঘন কালো দাড়িগোঁফের আড়ালে মৌলবিসাহেবের মুখে অদ্ভূত ফর্সা সৌন্দর্য আবিষ্কার করে। আচমকা মৌলবিসাহেবকে তার ভালো লেগে যায়। রান্নাশালে শাশুড়ি তার ইন্তেজার করে, খেয়াল থাকে না। যেন মৌলবি নয়, সে তার স্বামীকেই খাওয়াচ্ছে! যেন তার মনের আরমান পূরণ হচ্ছে।

বাপের গাঁয়ে নসিবুন অন্য একজন মৌলবিসাহেবকে দেখেছিল। দেখেছিল কী, রোজ সকালবেলা সেই মৌলবিসাহেবের কাছে তাকে বাড়ির নির্দেশে আরবি পড়তে যেতে হত। বুজুর্গ মানুষ ছিলেন। ‘বেটি’ বলে ডাকতেন। মক্তব আর মসজিদই ছিল লোকটির ঘরবাড়ি। আসল ঘরবাড়ি ছিল কি ছিল না, কেউ জানত না। থাকলেও কখন বাড়ি যেত আর কখন বাড়ি থেকে আসত তাও টের পেত না কেউ। কারো বাড়িতে জায়গীর খেতো না। নিজেই নিজের রান্না করে খেতো মক্তবের বারান্দায়। বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি এসে যেদিন নসিবুন শাশুড়ির মুখে শুনল, গাঁয়ের ঈমাম নতুন মৌলবিসাহেব তাদের বাড়িতে জায়গীর খেতে আসবে, সেই মৌলবিসাহেবকে তার মনে পড়েছিল। কিন্তু এই মৌলবিসাহেব যখন আজ জোহরের নামাজের পর গলা খাঁকারি দিয়ে বাড়িতে এসে ঢুকল, শাশুড়ি বিছাবুনি পাটি বিছিয়ে দস্তরখানা পেতে বসতে দিয়েছিল। রান্নাশালে বসে আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখছিল সব। আশ্চর্য না হয়ে পারেনি। মৌলবিসাহেব একেবারে তাগড়া জোয়ান! আড়ালে লুকিয়ে ছিল তবু আড়ষ্টতায় জড়সড় হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে স্বামী থাকলে তাও না হয় কথা ছিল। কিন্তু সে তো তাকে নিকা করে ফেলে রেখে চলে গেছে ভিনদেশে। রোজগারের ধান্ধায়। কেরালা না চেন্নাই! ট্রেনে চরে যেতে দু-দিন দু-রাত সময় লাগে নাকি! আসতেও ওই একই সময়। এক মাস না দু-মাস আগে ফরম ভরে সেই ট্রেনের টিকিট কাটতে হয়। সেই ট্রেনের টিকিট সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় না। এইসব গল্প সে রাতের বেলা শোনে স্বামীর মুখ থেকে। মোবাইল মারফৎ। কানে স্বামীর কন্ঠ শুনতে পেলেও শরীর স্বামী-শরীরের ছোঁয়া পায় না। শরীর আনচান করে। মন খারাপ হয়ে যায়। ভাগ্যিস আজ শাশুড়ি তাকে জোর করে মৌলবিসাহেবের খিদমত করতে পাঠিয়েছিল! তাই মৌলবিসাহেবের হাতে তার হাতের ছোঁয়া লাগে। তার মন-খারাপ ভালো হয়ে যায়। মৌলবিসাহেবকে খাওয়াতে ভালো লাগে। একবার, দু-বার, তিনবার বারেগী ভাত বড় চামচে করে তুলে দেয় মৌলবিসাহেবের থালায়। সেই সঙ্গে ডাব্বুতে করে গরুর গোস্ত। মৌলবিসাহেব ‘না’ করে না, তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে যায়।

চিত্র: বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়

সপ্তাহে একদিন মৌলবিসাহেব বাড়িতে জায়গীর খেতে আসবে। গোরুর গোস্ত না হলে চলে কী করে? নাটাতলার মুস্তাকিম নিম ডালের দাঁতন কাটা ছেড়ে আজকাল রোজদিন একটা করে গোরু জভাই করছে। একেবারে নগদানগদি বিক্রি। দেড়শো টাকা কেজি। কিছুই পড়ে থাকে না। সূর্য ওঠার আগেই গোস্ত তো গোস্ত, ঠ্যাং-খুর-ভুঁড়ি সব বিক্রি হয়ে যায়। তাই ফজরের আজানের আগে শাশুড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে গোস্ত নিয়ে এসে তাকে সেই গল্প করেছিল। নসিবুনের এখন সেই গল্প মনে পড়ে। এবং সে লক্ষ করে মৌলবিসাহেব থালা পরিষ্কার করে চেটেপুটে খেয়ে তৃপ্তির ঠেকুর তুলছে।

এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে ঝড়ের বেগে গ্রামে একটা রটনা রটে গেল। তুফানী বেওয়ার বেটাবহুর সঙ্গে নাকি গাঁয়ের নতুন মৌলবিসাহেবের ঘুষুরমুষুর চলছে! কেউ কেউ অবিশ্বাস করলেও বেশিরভাগ মানুষ রটনাটা বিশ্বাস করে বসল। তাদের যুক্তি বিয়ের পর পরই যখন তুফানী বেওয়ার বেটা গাজলা ওরফে গাজল সেখ কামে চলে গেছে বিদ্যাশ তখন তার যুবতী বউ অমন ভরা শরীর নিয়ে সতী থাকে কী করে?

নসিবুন পোড়ামারি গাঁয়ের মেয়ে। পোড়ামারির বিলের ডুবসাঁতার-চিৎসাঁতার কেটে সে সিয়ানী হয়েছে। তাই তার অমন ভরা শরীর! কালো বরণ দীঘল চুল! পিঠ-পাছা ঢেকে রাখে। আর গায়ের রং? পোড়ামারির বিলের পানিতে পঁচানো পাটের রং হয় যেমন, ঠিক তেমনি। পোড়ামারির বিলের পানিতে পচানো পাট বাজারে বটম পাটের দামে ভালো ঘরে বিক্রি হয়। ভালো ঘর বলতে পীতামবাবুর আড়ত। কিংবা নজরুল বিশ্বাসের গুদাম! নসিবুনেরও সেরকম ঘর পাওয়া উচিত ছিল। অথচ সেখানে সে পেল তুফানী বেওয়ার ঘর। নশিব সেদিক থেকে তার খারাপই বলতে হয়। এরকম যুক্তি-অযুক্তিতে বউ হয়ে আসার দিন থেকে নসিবুন গ্রামের চ্যাংড়া মহলে যথারীতি আলোচনার বিষয়। আধ-বুড়ো, বুড়োরাও যে তাকে পুকুরঘাটে কিংবা কলতলায় আড় চোখে দেখে না, কসম কেটে কেউ বলতে পারবে না। তাহলে এমন রটনায় গ্রামে যে একটা তুফান উঠবে তাতে আশ্চর্য কী?

না, কেউ আশ্চর্য হয় না। আশ্চর্য হয় শুধু গ্রামের মাতব্বররা। তারা ব্যাপারটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারে না। সেটা নসিবুনের ভরা শরীরের কারণে না দেশ-দুনিয়া সত্যি সত্যিই গোল্লায় গেল বলে! বলা খুব মুশকিল। তবে শেষপর্যন্ত তাদের মনে আল্লা-রসুলের ভয় জাগে।

একদিন রাত্রে সাত্তার মোড়লের বৈঠকখানায় তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসে। একে গ্রামের মোড়ল তার ওপর সাত্তার সদ্য পঞ্চায়েতের মেম্বার হয়েছে। সেই কারণে তার নতুন করে তৈরি বৈঠকখানাটা এখন সবার পছন্দের। সেখানেই আলোচনা করে ঠিক হয় যে, আগামীকাল জুম্মাবার আছে। আগামীকাল জুম্মার নামাজের পর ব্যাপারটা সরাসরি মৌলবিসাহেবকেই জিজ্ঞেস করা হবে। দায়িত্ব পড়ে সর্দার রশিদ মিঞার ওপর। গ্রামে সেই যখন একমাত্র বুজুর্গ মানুষ। তাছাড়া মৌলবিসাহেব নাকি তার কী রকম ভাইরা বেটা লাগে! তার সুপারিশেই মৌলবিসাহেব এই গ্রামে ঈমাম হয়ে এসেছে। সাত্তার মোড়ল মৌলবিসাহেবের ঈমামভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছে পর্যন্ত। সঙ্গত কারণেই রশিদ মিঞা তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তার ওপর সে যখন গাঁয়ের সর্দার। দায়িত্ব নিয়ে সে নিজের বাড়ি ফিরে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ কী মনে করে এই রাতেই তার মৌলবিসাহেবের সঙ্গে দেখা করবার বাসনা জাগে। মনের বাসনাকে সে কোনোদিন অবহেলা করেনি। তাহলে আজ কীভাবে করবে? আপন-মর্জির বাদশা সে! অগত্যা মৌলবিসাহেবের কাছে যাবে বলে নিজের বাড়ির পথ ছেড়ে মসজিদের পথ ধরে। মৌলবিসাহেব থাকে মসজিদের পাশে মক্তবেরই একটা ঘরে। রশিদ মিঞা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য সেই ঘরের দরজায় গিয়ে ডাক দেয়, মৌলবি আছ নাকি? সবাই মৌলবিসাহেব বললেও সে শুধু ‘মৌলবি’ সম্বোধন করে। ভাইরাবেটা বলে কথা! অধিকার তো তার আছেই।

ডাক দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ইন্তেজার করে রশিদ মিঞা। কিন্তু ঘর থেকে কোনো সাড়া আসে না। অথচ সে দেখছে বন্ধ ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে। বন্ধ জানালা-দরজার পাল্লার ফাঁকফোকর বেয়ে ঘরের আলো বাইরে চুঁইয়ে পড়ছে। তাহলে কি মৌলবি ঘুমিয়ে পড়েছে?

রশিদ মিঞা আর ইন্তেজার করতে পারে না, দরজায় ঠেলা মারে। দরজা হাট করে খুলে যায়। কিন্তু মৌলবি তো দূর, রশিদ মিঞা ঘরে একটাও মশা-মাখির চিহ্ন খুঁজে পায় না। ঘর একেবারে ফাঁকা। তবে মৌলবির শরীরের আতরের গন্ধটাকে নাকে অনুভব করে।

তাহলে শরীরের গন্ধ ফেলে এই রাতের আঁধারে মৌলবি কোথায় গেল? পায়খানায়! পায়খানা ফিরতে যাওয়া মানে তো সেই গ্রাম ছেড়ে বাহান্ন বিঘার মাঠ। জালসা করে চাঁদা তুলে মসজিদের পাশে মক্তবের একটা ঘর, সেই সঙ্গে মৌলবি-র থাকার একটা ঘর তৈয়ার করা গেছে! কিন্তু পায়খানাটা এখনও করতে পারেনি। তবে খোদার মর্জি হলে সামনের জালসায় যে টাকা উঠবে তাতে মক্তবের আর একটা ঘর, সঙ্গে পায়খানাটাও তৈয়ার হয়ে যাবে। কিন্তু গ্রামের সর্দার হিসাবে এখন তার ভাবনা সেটা নয়। বরং সে ভাবে তুফানী বেওয়ার বেটাবহু সঙ্গে মৌলবির রটনা নিয়ে। ঘটনা কি তাহলে সত্যি?

আচমকায় তার মনের খটকা সত্যের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে যেন! এতক্ষণ নিজের সঙ্গে নিজে দু-একটা যা কথা বোলচাল করছিল তাও বন্ধ হয়ে যায়। আর সে মৌলবির ঘরের দরজা ছেড়ে কী ভাবতে ভাবতে বাড়ির রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। যদিও সে নিজের বাড়ি গিয়ে পৌঁছায় না, পৌঁছায় তুফানী বেওয়ার বাড়ির বন্ধ দরজায়। আচ্ছা আকাম তো! নিজেই নিজেকে বলে ওঠে রশিদ মিঞা। তারপর আবার নিজেই নিজেকে ধমকায়, এক্কেবারে চুপ থাকবা মিঞা! ‘রা’ কাড়বা না। পারলে নিঃশ্বাসও বন্ধ রাখিও সুদ্দ্যা। আজ শালা রটনার শ্যাষ দেখ্যা ছাড়ব।

একেবারে গ্রামের শেষ মাথায় তুফানী বেওয়ার বাড়িটা। বাড়ি তো নয়, একেবারে ছবি! হঠাৎ রশিদ মিঞার খুব করে মনে পড়ে এই বাড়িটাকে, যখন বাড়িটা ছবি ছিল না, সামান্য একটা কুঁড়েঘর ছিল। যৌবনে সেই কুঁড়েঘরটাই ছিল তার বৃন্দাবন। ছেলেবেলায় শোনা তসুর গানে রাধা-কেষ্টর প্রেম-কাহিনি তখন তার রক্তে উদোম মাচিয়ে ফিরছে। সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত তার সময় কাটছে সেই কুঁড়েঘরে। তারও আগে একদিন সকালে সে দেখেছিল তাদের বৈঠকবাড়ির দরজায় একজন পুরুষ আর একটা শিশুকে সঙ্গে করে একজন যুবতী বউকে দাঁড়িয়ে থাকতে। পুরুষটা কঙ্কালসার। শিশুটাকে মানুষের শিশু বলে মনে হয় না। অথচ যুবতী বউটা! থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছিল, কী ব্যাপার? যুবতী বউটা বলেছিল, লদীর ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে এস্যা ভিড়েছি বাবু আপনার দূয়ারে। শুন্যাছি আপনার দিলে খুব রহম! তা যদি মাথা গুঁজবার এট্টু জাগা দিতেন?

রশিদ মিঞার চোখে তখন ভেসে উঠেছিল ‘লদী’। মানে তাদের পদ্মা নদী। খান্দুয়াকে খাওয়ার পর সেখালিপুরের সামনে থেকে বাঁয়ে মোড় ঘুরে যে সোজা ঢুকে গেছে বাংলাদেশের গোদাগাড়ি ঘাট বরাবর! নদীটা পারেও বটে! সারাবছর ঢোড়া সাপ হয়ে থাকে। অথচ বর্ষা এলেই খরিস হয়ে ওঠে। সামনে যা পাই তা-ই সংহার করে। বাংলাদেশ না ইন্ডিয়া, বাছবিচার করে না। সেই নদীর কথা ভেবে দিলে রহম এসেছিল তার। কিন্তু জায়গা দেওয়ার সে কে? জায়গা তো তার বাপ বাশির মিঞার। আর বাশির মিঞা তখন বেঁচে। তবে ভাগ্য ভালো, বাশির মিঞা তখনই মাঠ ঘুরে ফসল দেখে এসে দাঁড়িয়েছিল বৈঠকবাড়ির দরজায়। মন ভালো ছিল। মেয়েটার দুরবস্থা দেখে একটা জায়গা দিয়েছিল। এটাই সেই জায়গা। একটি কাঁঠাল গাছ ছিল। গাছটি এখনও আছে। তবে জায়গাটা আর তাদের নেই। তুফানীর মরদ রেজাবুল তার বাপের পরে তার গেরস্থিতে খেটে রেজিস্ট্রি নিয়েছিল। সে আপত্তি করেনি। নিজে রেজিস্ট্রি দিয়েছিল ভগবানগোলার রেজিস্ট্রি অফিসে রেজাবুলকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে। আপত্তি করেনি কারণ, সে তখন টের পাচ্ছিল নিজের বয়সকে। ময়া থেকে বিয়ে করে আনা মিনারাকে অস্বীকার করলেও কলা গাছের মতো বেড়ে ওঠা নিজের বালবাচ্চাদের অস্বীকার করতে পারছিল না।

যাইহোক, খোদার মর্জিতে সেই জায়গায় আজ বহুদিন পর এসে দাঁড়িয়েছে রশিদ মিঞা। যদিও কেন এসেছে? সে-কথা এখন তার মনে নেই। আকাশে ইঁদুর খাওয়া অর্ধেকটা চাঁদ আছে। তার কুটি কুটি জ্যোৎস্না ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুনিয়াজাহানে। ওতেই সে দেখছে তুফানী বেওয়ার ছবির মতো বাড়ি আর ওই কাঁঠাল গাছটিকে। শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে গাছটি কত বড়ো হয়েছে! কত কাঁঠাল ঝুলে আছে! সেই সঙ্গে কত বদল ঘটে গেছে বাড়িটার! বেটা গাজল সেখ বিদ্যাশে রাজমিস্ত্রীর কাম করে মেলা টাকা কামাই করে এনে সেদিনের সেই কুঁড়ে ঘরটাকে ছবির বাড়ির মতো একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে! তাহলে কি তুফানীও বদলে গেছে? কতদিন যে চোখে দেখেনি!

রশিদ মিঞার আচমকা লোভ হয়, তার একসময়ের ‘রাধা’-কে দেখার? তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। সে এগিয়ে যায়। তবে সদর দরজার দিকে নয়, কান্টার দিকে। কান্টার দিকটা আশ্চর্য রকম ভাবে সাফসুতরো। আগের মতো ঝোপ-জঙ্গল নেই। তার বদলে আছে নানারকম ফুলের গাছ। কত গাছে ফুল ফুটে আছে। সুবাস ছড়াচ্ছে। তবে বাড়ির জানালা-দরজা এমনভাবে বন্ধ যে ভেতর থেকে কোনো রকম আলো চুইয়ে পড়ছে না বাইরে। অথচ ফুলের সুবাসের ভেতর মৌলবির শরীরে মাখা আতরের গন্ধটাও ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। সেই গন্ধ তার নাকেও এসে লাগছে। আর, তার শ্বাসপ্রশ্বাস জোর থেকে আরও জোরদার হচ্ছে।

রশিদ মিঞা কান্টায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, সরে আসে। তখনই কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, ‘ভয় লাগছে নাকি মিঞা?’
‘কই না তো?’
‘তবে যে তুমার অমন হায়নিঃশ্বাস পড়ছে!’
কে জিজ্ঞেস করে? সঙ্গে তো কেউ নেই! কেউ থাকলে বরং এই সুযোগে সে তার নিজের মনের কথা তাকে খুলে বলে খানিকটা হালকা হতে পারত! অগত্যা আবার চুপ মেরে যায়। কিন্তু সে চুপ মেরে থাকলেও তার শ্বাসপ্রশ্বাসকে কিছুতেই বাগে রাখতে পারছে না। শ্বাসপ্রশ্বাস যেন তার নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রথম যেদিন রাতের অন্ধকারে ওই কাঁঠালতলায় তুফানীর ইন্তেজার করছিল, সেদিন তার ঠিক এরকম অবস্থা হয়েছিল। তখন জায়গাটা ভ্যাটপিটুলি আর ভূতরাজের জঙ্গলে ছয়লাপ ছিল। কিন্তু এখন একেবারে তার মাথার মতোই সাফসুতরো। না হলে ওই জঙ্গলই হয়তো আজ এতদিন পর তাকে দেখে ছোটোলোকদের মতো জিজ্ঞেস করত, করত কী ওই তো করছে, ‘কেমুন আছেন মিঞাসাহেব? আইজকাইল আপনার টিকি দেখা যায় না। ঝড় তো আপনি ছিলেনই, পেলেন তুফানীকে। যৌবনটা আপনার ভালোই কাটল। তবে আপনার ভাগ্য ভালো বুলতে হবে। তুফানীর বদলে আয়লা-লাইলা যদি আসত আপনার জীবনে, আপনার কী যে করত বলা খুব কঠিন! তাও কী করে যে ওই তুফানীকে আপনি এতদিন ভুলে থাকলেন?’

সত্যি সেদিক থেকে তার ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কিন্তু তাকে এমন কথা কে বললে? ভ্যাটপিটুলি আর ভূতরাজের জঙ্গলটা তো আজ আর নেই! তবে বুড়ো কাঁঠালগাছটি আছে। তুফানীর সঙ্গে তার সবকিছুর সাক্ষী ওই গাছ! রাতের পর রাত তুফানীর সঙ্গে তার মনের কথা, মুখের কথা, শরীরের কথার একমাত্র সাক্ষী। এখন কাছে পেয়ে গাছটি যদি তাকে সেই পুরনো কথা জিজ্ঞেস করে?

রশিদ মিঞা গাছটির সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। আবার প্রশ্ন ভেসে আসে, ‘কী ভাবছো মিঞা?’

কাঁঠালগাছ সত্যিই তাকে প্রশ্ন করে বসে। রশিদ মিঞা চমকায় না। জীবনে সে ওই একবারই চমকে ছিল একটা বিড়ালের ‘ম্যাঁও’ শব্দ শুনে। যেদিন তুফানীর জন্য প্রথম ইন্তেজার করছিল ওই গাছতলার জঙ্গলে। আর বিড়ালটা ওই গাছে পাখির ডিম কিংবা বাচ্চার লোভে উঠেছিল। তার উপস্থিতি টের পেয়ে ‘ম্যাঁও’ শব্দ করে পালিয়ে গেছিল। কিন্তু আজ আর তার চমকানোর বয়স নয়। এটা সে জানে বলেই উত্তর করে, ‘কী ভাববো? এই বয়সে ভাববার কী আর কিছু আছে?’
‘তবে যে দূরে সরে যেছো। কাছে এসো।’

রশিদ মিঞা এগিয়ে আসে। কাঁঠালগাছ তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগে সে গাছটিকেই একটা কথা জিজ্ঞেস করবে, ভাবে। কিন্তু তার আগেই গাছটি আবার প্রশ্ন করে বসে, ‘একটা কথা বুলতো মিঞা!’
‘কী কথা?’
‘রেজাবুল হামার ডালে লটকে জান দিয়াছিল ক্যানে?’
‘সব খোদার মর্জি। তাঁর মর্জির কাছে তুই কে আর হামিই বা কে!’
‘খোদার মর্জি! তুমার কূনু মর্জি ছিল না?’
‘সে-কথা হামি জানবো কী কর্যাম? সেটা তো তোরই ভালো জানবার কথা?’
‘হামার জানবার কথা! হামি তো একটা গাছ। হামি আবার জানব কী কর্যার?’
‘তুই গাছ! তুই কিছু জানিস না? তোর যে হারঘের মুতোন জান আছে তা কী হামি জানিস না ভেব্যাছিস?’
‘জানবা না কেনে? তুমি হল্যা বাশির মিঞার শিক্ষতি ছেল্যা। চার কি পাঁচ মান পর্যন্ত লেখাপড়া কর্যাকছিল্যা! তারপর কী যে হল তুমার, বইপত্তর লিয়ে ইস্কুলের সুমায়টুকুন তুমি এসে বসে থাকতা হামার ডালে। আর তুমার বাপ, তুমারঘের গেরস্থির কামকাজের লোকজন কামকাজ ছেড়ে তুমাকে ধুড়ে বেড়াইতো দুনিয়াজাহানে। সেই থেক্যা হামি তুমাকে জানি। তুমি হল্যা আপন-মর্জির বাদশা! তবে হামার জানার কথা যখুন বুললা তাহলে শুনো- সেবছর তুমি রেজাবুলকে দায়িত্ব দিয়াছিলা তুমারঘের লিচুর বাগানের। তুমার লিচুর বাগান দেখভালের খাস লোক নেষের সেবার আচমকা ব্যারামে পড়্যাছিল। ছ্যাচায় ব্যারামে পড়্যাছিল না মিছা, নাকি সেটাও ছিল কেষ্টঠাকুরের মুতোন তুমার লীলা, সেকথা হামি বুলতে পারব না। তবে রেতের পর রেত বাগানে শুকনা বাঁশের মাচানে শুতে থাকতে থাকতে বিবি তুফানীকে রেজাবুলের খুব মুনে পড়্যাছিল। সে ওই রেতের আঁধারেই বিবির কাছে এস্যাছিল তুমার বাগান পাহারা ছেড়্যা। কিন্তুক কপালের দোষ! বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল্যা তুমি।’
‘কেনে, হামি আবার বাধা হয়ে দাঁড়ালাম কী কর্যা ?’
‘কী কর্যা , এখুনো বুঝতে পারছ না?’
‘বুঝতে পারলে জানতে চাহিব কেনে?’
‘তাহলে শুনো। ধরো— তুমার ঘর, তুমার বিছানা, তুমার বিবি, সব তুমারই আছে। খালি তুমি নাই। তুমার জায়গায় অন্য কে

হু তুমার ঘরে তুমার বিছানায় তুমার বিবির সুথে শুতে আছে, নিজের চোখে এসব দেখলে তুমি কী করবা?’
তাইতো কী করবে? রশিদ মিঞা কাঁঠালগাছটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করে। ভাবতে ভাবতে কী ভাবছিল একসময় সেটাই ভুলে যায়। তখন সে কাঁঠালগাছের ডালে ডালে কাঁঠাল নয়, হাজারে হাজারে মানুষকে ঝুলে থাকতে দেখে। তাদের মধ্যে রেজাবুলকে ঝুলে থাকতে দেখে। শুধু কি রেজাবুল? রেজাবুলের বেটা গাজলকেও ঝুলতে দেখে। বাতাসে আতরের গন্ধ ছড়িয়ে মৌলবিকেও ঝুলতে দেখে একটা টিঙটিঙ্গে ডালে। যে-কোনো সময় ওই ডালটা ভেঙে পড়তে পারে! কিন্তু না, সে ভয় পায় না। তবে নিজেকে যখন দেখে গাছটির সবচেয়ে শক্তপোক্ত একটা ডালে ঝুলে থাকতে, তার খুব ভয় করে। খোদার মর্জির ওপর সে আর আস্থা রাখতে পারে না।

Facebook Comments

পছন্দের বই