লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অগ্রন্থিত গদ্য : শিশুসাহিত্য প্রসঙ্গে

উৎপলকুমার বসু

 

কোথায় যেন পড়েছিল— বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। বহু অর্থহীন প্রবচনের মতো এরও আছে যুক্তিহীন অবিস্মরণীয়তা। এভাবে আমরা চমৎকার উপায়ে সমাজকে চিরদিনের মতো,  ছকে ফেলে, ভাগ করে দিতে পারি— জেলেরা জলে সুন্দর, ধোপারা সাইকেলের পিছনে বা শত্রুরা কারাগারে সুন্দর, নাগরিকতা ধর্মতলায়। হেন সৌন্দর্যবোধ ব্যতিক্রমকে অগ্রাহ্য করে। সঠিক ব্যতিক্রম-চিন্তা মাথায় না থাকার ফলে আকাশ থেকে খসে পড়া বহু আকর্ষণীয় ঘুড়ি আমরা শেষ পর্যন্ত ধরতে পারিনি। শুধু গতিবিক্রম এর জন্য দায়ী নয়, এর পিছনে ছিল ভুল জ্যামিতি জ্ঞান, ভুল উচ্চতা নির্ণয় এবং গ্রামের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছেলেটি, যে একইসঙ্গে ছিল বায়ুবিজ্ঞানী ও হঠকারী, মসজিদ হইতে পতনের ফলে যে ভবিতব্যতার দেখা পেয়েছিল— তাহলে তার সম্বন্ধে বলতে হয়, সে ছিল ছাদের সুন্দর। মুঙ্গেরের ভূমিকম্প অবশ্য মুঙ্গেরে সুন্দর বলা চলে না।

অনুরূপ, ব্যতিক্রমী একটি তালিকা যদি তৈরি করি তবে দেখা যাবে কত-না ভুল ধারণা আমরা বাস্তুসাপের মতো পুষে আসছি যেমন, আমরা ভাবি শিশুদের জন্য, কিশোরদের উপকারার্থে একটি বিশেষ ধরনের সাহিত্য আছে বুঝি, যার নাম শিশুসাহিত্য। অতীতে যে রামায়ণ মহাভারত বুড়ো-বুড়িরা শুনত, তাই বালকের বা বালিকার পক্ষে ছিল পর্যাপ্ত। যে-নিসর্গের সঙ্গে চিরদিন প্রাপ্ত বয়স্করা যুদ্ধ ও মৈত্রী ঘোষণা করেছিল— ওরা তারই রণক্ষেত্রে অকুতোভয়ে ঘোরাফেরা করেছে। তার আলাদা জগৎ তৈরি করার প্রয়োজন হয়নি— কারণ, আলাদা জগৎ বলে কিছু নেই। যেমন, নেই বিশেষ সাহিত্য— শিশুসাহিত্য বা মহিলা সাহিত্য বা রেল কর্মচারীদের জন্য সাহিত্য।

শিশু সাহিত্য আসলে এক মরালিটি বোধ থেকে জাত শিল্প প্রচেষ্টা। এবং ভিক্টোরিয়ান আমলে এর বহুল প্রচার ঘটে। পাপবোধ বুঝি পাপের চেয়েও দুর্বল। তাই ভিক্টোরিয়ান দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গেই ‘শিশুসাহিত্য’ নামে এক সুনীতি প্রচার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। লিউইস ক্যারল গোপনে কিশোরীদের ফটোগ্রাফ তুলতেন সদ্য আবিষ্কৃত একটি বিস্ময়কর যন্ত্রের সাহায্যে যার নাম ক্যামেরা। তাঁর ডায়েরি এবং সমসায়িকদের চিঠিপত্র থেকে জানা গেল এই অকৃতদার, স্বল্পবাক্ অধ্যাপকের ঘরে ‘লজেন্স টফি’-র লোভে বালিকাদের আনাগোনা ছিল। অপর দিকে তাঁরই রচিত শিশুসাহিত্যে— যা মনোমোহন কাব্যের মতো উদার, জটিলতাময় ও উন্মুখর— সেই ভিক্টোরিয়ান যুগেরই নীতিসঞ্চান দেখতে পাই। ব্রহ্মা সুকুমার রায় সে-ধারার প্রচলন ঘটালেন আমাদের সাহিত্যে।

আজ মনে পড়ে, প্রবাসী বা ভারতবর্ষে একদা যে-কাহিনিগুলি ছাপা হত তা ছিল আকর্ষণীয়। কিন্তু, অর্ধনগ্না মহিলাদের ছবিগুলির কথা ভুলিনি। আমাদের যে সেনসুরালিটি তৈরি হয়েছিল— তাতে উভয়েরই অকৃপণ হস্তক্ষেপ ছিল। বুঝি-বা মনে হয়েছিল দূর আজমিড় পাহাড়ের মতো কোনো এক রহস্যময় উপত্যকায় ওই স্বপ্নময়ীদের সন্ধ্যাজল থেকে উঠে আসা।

শিশুসাহিত্যের আশ্চর্য ও অফুরন্ত প্রকাশ ঘটেছিল ওই ভিক্টোরিয়ান আমলে। অধুনালুপ্ত ‘বয়েজ ওন বুক’ জাতীয় কিশোর পত্রিকার এক্ষেত্রে উল্লেখ প্রয়োজন। আধুনিক কমিক‍্স— এর আদি রূপ এবং সামাজিকতা দেখা যায় এই সংগ্রহগুলিতে। সেকালের অরণ্যদেব ছিলেন শ্বেতাঙ্গ, অসমসাহসী এবং প্রায়শ আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযানরত। তিনি বশংদ আফ্রিকানদের ত্রাণকর্তা— কিন্তু বিদ্রোহীদের যম। এই ঔপনিবেশিক আদর্শ পুরুষের আরেকটি রূপ দেখতে পাই পরবর্তীকালে টার্জান চরিত্রে এবং ফিল্মজগতে মূক পশুদের সাহায্যে সে, শ্বেতাঙ্গদের উপকারার্থে, কত-না অসম্ভব সম্ভব করেছে। সে-ও কিন্তু বর্ণবৈষম্যবাদী। চীন-বিরোধী ‘ফু-মান্-চু’ গল্পগুলিতে ছিল ওই জাতির বিরুদ্ধে অবজ্ঞা, ঘৃণা ও অপপ্রচার। গোয়েন্দা শার্লক হোমসের হাতে ধরা-পড়া দুষ্কৃতকারীরা তো প্রায়ই স্বীকার করত যে, তাদের অভিনব কর্মপদ্ধতির নৃশংসতা আসলে ভারতীয় নেটিভদের কাছে শেখা। সাহেব-বালকদের যে-ঔপনিবেশিকতা শিক্ষা দেওয়া হত— তার প্রথম পাঠ ছিল তথাকথিত অ্যাডভেঞ্চারে।

অপরের কাছ থেকে গ্রহণ করায় আমরা, বাঙালিরা, বড়োই অপরিনামদর্শী। তাই বাংলা সাহিত্যে চালু হল ওই কাহিনিগুলির জাতিবর্ণ নির্বিশেষ অনুকরণ।

আজ এগুলি ফেলে দেওয়ার সময় এসেছে। শিশুসাহিত্য বা কিশোর সাহিত্য রচনার জন্য আর আমাদের বুড়ো-খোকা সাজার প্রয়োজন নেই। বড়োদের সাহিত্যে যে-আধুনিকতা, যে-সমসমায়িকতা প্রকাশ পেয়েছে তারই জ্যোতির্বিকাশ ঘটুক আজ যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাদের চোখের উপর। তাদের যেন আমরা খোলাখুলি বলতে পারি বাঘ দেখে ভয় পেয়ো না— তাকে সহজেই পুরোনো অস্ত্রে মারা যায়। কিন্তু সমাজের যারা অহরহ ক্ষতি করে চলেছে, যারা ভণ্ড, যারা শোষণবাদী, তাদের মারার জন্য নব নব হাতিয়ার তোমরা কল্পনাপ্রবণতার সাহায্যে তৈরি করে নাও।

ঋণ:
মহাযুদ্ধের ঘোড়া। প্রথম সংকলন, মে-জুন ১৯৭৮। সম্পা. দীপান্বিতা রায়।
(দাহপত্রের ফাইল থেকে)

Facebook Comments

পছন্দের বই