লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শিবাশিস দত্তের স্মৃতিগদ্য

স্কুলজীবনেই যাকে আধুনিক মনের মানুষ বলে জেনেছিলাম 

প্রাবন্ধিক, বাংলা ভাষার সাহিত্যের ক্রিটিক পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হলেন। তিনি ছিলেন পাকা হাতের সমালোচক। তাঁকে চিনতাম নৈহাটির সেই স্কুলজীবন থেকে। আমাদের বাংলা ক্লাস নিতেন। পরবর্তীতে তাঁকে নিয়মিত ব্রিজ পেরিয়ে নৈহাটি ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজে আসতে দেখতাম, তখন তিনি কলেজ-শিক্ষক। তাঁর পোশাক, পথচলা, ধারালো দৃষ্টি, কথা বলার ঢং— সবই আমাদের কাছে ছিল আকর্ষণের বিষয়বস্তু। মনে মনে ভেবে নিতাম— যেন সাহিত্য জগতের উত্তমকুমার। গ্রাম্য স্বভাবের লোকজনেরা পার্থবাবুকে আঁতেল বলে  ঠাট্টা করতেন বটে, কিন্তু  সে আঁতলামিতেই আমরা জীবনভাবনার দিশা পেতাম। স্মার্টনেস কথাটা নিয়ে তখন আমরা প্রায় লোফালুফি খেলার স্বভাবে মজে থাকতাম। স্মার্ট কথার ব্যাখ্যা জানতাম না। উত্তমকুমার বলতে বুঝতাম স্মার্টনেস। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ তখনও পড়িনি, স্টাইল আর ফ্যাশনের পার্থক্য জানব কেমন করে? তবে বেশভূষা কিংবা চালচলন বুদ্ধিদীপ্ত হলে তাকে স্মার্ট  ভেবে নিতাম। পার্থবাবু ছিলেন আমাদের চোখে স্মার্ট ভদ্রলোক। নাগরিক মন আর মননকে কেমন করে গড়ে তুলতে হয়, তা জানাবোঝার আগ্রহ গড়ে উঠছিল তাঁকে দেখেই — পার্থবাবু আমাদের মনের সে দৃষ্টিটা একটু একটু করে জাগিয়ে তুলেছিলেন। বলা যায়, এক জীবনবীক্ষা গড়ে তোলার প্রেরণা মিলত তার কাছ থেকে। একদিন বলেই ফেললেন, running after mission— এ স্বভাবের মানুষ দেখা যায় না আজকাল। কথায়  থাকত একধরনের ঝাঁকুনি— যা আমাদের প্রশ্নাতুর করে তুলত। ঈদের পরদিন ফোনে জিজ্ঞাসা করলাম: কেমন আছেন? কুশল জানাবার পর জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল কী করলে, ঈদ পালন করেছ? শহুরে সংকীর্ণ মনকে প্রশ্ন করতেন এমন নানা কথায়। একদিন বললেন, খবরের কাগজ পড়ো, কোন কাগজ? আমি দু-তিনটি কাগজের কথা বললাম। বললেন, আমি তো The Hindu পড়ি। এ কাগজটা পরলে গোটা দেশের কথা জানা যায়। কলকাতা সম্পর্কে এক ধরনের অস্বস্তি বয়ে বেড়াতেন, সে কথা বোঝাতে প্রায়ই বলতেন, না, যাই না… কী আছে ওখানে? কলকাতা মফস্বলের সাহিত্য সংস্কৃতি শাসন করে— এ এক আপত্তিকর বিষয়, নৈহাটিকে তার মতো করে দাঁড়াতে হবে, কলকাতানির্ভর হয়ে থাকাটা অগৌরবের— এমন কথাই হয়তো বোঝাতে চাইতেন তিনি। ক্ষমতার কেন্দ্রিকতাকে অমান্য করার ঝোঁকটাই ছিল প্রবল। স্হানমাহাত্ম্য বোঝাতে নয়, নৈহাটি যে সাহিত্যচেতনায় পিছিয়ে নেই সে কথাকে প্রতিষ্ঠা দেবার কথা ভাবতেন তিনি। সমরেশ বসুর লেখালেখির দিনগুলোতে তার প্রমাণও রেখেছিলেন । ‘বিবর’ একটি ক্লাসিক উপন্যাস— সগর্বে এ কথা লিখেছিলেন পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়— কমিউনিস্ট তাবড়রা অনেকেই, যখন অনেকেই ‘বিবর’ উপন্যাসকে অশ্লীল ভেবে নিয়েছিলেন। সাহিত্য সংস্কৃতির আড্ডায় মশগুল থাকতে ভালোবাসতেন তিনি। নৈহাটি সিনে ক্লাব ছিল তাঁর  আড্ডার ঠেক। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, বছরভর হাজির থাকতেন সে আড্ডায়। আজকালকার হিসেবি মনের আড্ডাবাজরা এর মর্ম বুঝবেন না। প্রচারলোলুপরা কেমন করে বুঝবেন কেন এবং কোন উপায়ে তিনি  পাণ্ডিত্যের বড়াই ভুলে  প্রজ্ঞাকে ধারণ করার কৌশল রপ্ত করেছিলেন? সাহিত্য বেচে খাওয়ার যে দিনকাল আমরা লক্ষ করি, নামযশের তাগিদে ছক-কষে লেখালেখি কিংবা সাহিত্যের আসরে ঘুরঘুর করবার যে প্রবণতা, পার্থবাবু এসব জীবনে  আমল দেননি। মাস্টারমশাই মনের যে প্রতিপত্তি— ছাত্রমনের দুর্বলতা ভাঙিয়ে যা গড়ে তোলেন কেউ কেউ, তা গড়ে তোলা দূরে থাক, ছাত্ররা হয়ে  উঠেছিল তাঁর বন্ধুজন। নতুন লেখালেখির জগতে বিচরণ করছেন, গল্প বা উপন্যাস লিখে তিনি পার্থবাবুর কাছে হয়তো হাজির হয়েছেন— আপনি কী দু-কলম লিখবেন আমার লেখা প্রসঙ্গে? —এমন আবদার বা নিবেদন শুনিয়েছেন হয়তো, তেমন লেখককে ফিরিয়ে দেননি পার্থবাবু। নতুন লেখকদের মনে লেখার আগ্রহ তৈরি করে দিতে সমালোচনা লিখে দিতেন, কখনো মুখে বলতেন। এমন বেগার খাটনি তিনি  মাথা পেতে নিতে জানতেন। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন সেরা উৎসাহক। নতুনদের কে  ভালো গল্প বা উপন্যাস লিখছেন সে খবর সংগ্রহ করতাম তাঁর কাছ থেকে। ফেমাস লেখকের লেখা নিয়ে অহরহ কথা বলি আমরা, অনামীদের কথা কজন ভাবি? পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কম-পরিচিত লেখকদের উৎসাহ যুগিয়েছেন। এ বড়ো সহজ কাজ নয়। নিজের মতকে স্পষ্ট হাজির করতে জানতেন। তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধের কয়েকটি লাইন পড়া যাক :

…’নানা কারণে মার্কসবাদের মানবিক মুখটি আড়াল হয়ে গেছে— মার্কসীয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে ঘোষিত যে-সব দেশ আমলাতন্ত্র, পার্টিতন্ত্র ও রাষ্ট্রতন্ত্রে এক জড়তার কাঠামো গড়ে তুলেছিল তার ভেঙে পড়াকে তাই মার্কসবাদের ভেঙে পড়া বলে মনে হচ্ছে।…’

শুনেছি শেষের দিনগুলোতে পার্থবাবু কিছুটা একাকিত্বের কবলে পীড়িত হয়েছিলেন। এ এক মননজাত অবসাদ, চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই এ অবসাদকে আত্মগত করে মননের নতুন দিশা খোঁজেন।

Facebook Comments

পছন্দের বই