লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

প্রথম পর্ব

‘রজনীগন্ধা’ ও ভবিষ্যতের স্মৃতি

তিনটি বিস্ময়কর ‘ড্যাস’ চিহ্নের সামনে বেশ কয়েকদিন বসেছিলাম। বারবার ঘুরে ফিরে চলে এসেছিলাম তাদের কাছে, অমোঘ স্পেস তৈরি করে সে-তিনটি ড্যাস যেন এক অন্তর্নাট্যকে পরিস্ফুট করবার জন্য মঞ্চ নির্মাণ করে দিচ্ছে সচেতনভাবে। জীবনানন্দ দাশের আট-লাইনের ‘রজনীগন্ধা’ কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছিল এই তিনটি ড্যাস,

‘এখন রজনীগন্ধা— প্রথম— নতুন—
একটি নক্ষত্র শুধু বিকেলের সমস্ত আকাশ;
অন্ধকার ভালো বলে শান্ত পৃথিবীর
আলো নিভে আসে।

অনেক কাজের পরে এইখানে থেমে থাকা ভালো;
রজনীগন্ধার ফুলে মৌমাছির কাছে
কেউ নেই, কিছু নেই, তবু মুখোমুখি
এক আশাতীত ফুল আছে।’

— ‘রজনীগন্ধা’ ও ‘প্রথম’-এই শব্দ দু-টির মাঝে বিস্ময়চিহ্নটি সূচিত করছে রজনীগন্ধার প্রথম হয়ে ফুটে ওঠাকে। কিন্তু সব থেকে রহস্যময় ও মায়াহরিণের মতো ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় ‘প্রথম’ ও ‘নতুন’-এর মাঝে ব্যবহৃত হওয়া বিস্ময়চিহ্নটি। যা প্রথম তা অনিবার্যভাবেই নতুন… প্রথমের পর ‘নতুন’ শব্দটির পুণঃব্যবহারের আদৌ কি কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে? এই লজিক্যালিটি অতিক্রম করে তবে কি এই বিস্ময়চিহ্ন আরও বৃহত্তর কোনো সত্যের সন্ধান দিতে চায়? সম্ভাবনাটিকে একেবারেই অস্বীকার করে বাতিল করে দেওয়া যায় না, কারণ, ‘নতুন’ শব্দটির পর আরেকটি ড্যাসের উপস্থিতি। প্রথম ও নতুনের ঈষৎ অ্যম্বিগুয়াস জগৎ থেকে কবি রজনীগন্ধা ও মৌমাছির সরলরৈখিক সম্পর্কের কাছে ফিরে আসবার আগে যেন কিছুটা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু সেখানেও তিনি থিতু থাকছেন না, রজনীগন্ধা ও মৌমাছির বাইনারি অতিক্রম করে জীবনানন্দ অন্ধকার ও ‘ভালো’-র ভিতর ঢুকে পড়ছেন। একটি নক্ষত্র যখন বিকেলের সমস্ত আকাশ হয়ে ফুটে থাকে তখন সেই শান্ত-মেদুর দৃশ্যটি মনোমুগ্ধকর; নক্ষত্রের নিজস্ব আলো আছে। পৃথিবীর নিজস্ব আলো নেই, অন্ধকারের শুশ্রূষার কথা জীবনানন্দের কবিতায় বারংবার উঠে আসে। এখানেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না।

কিন্তু পঞ্চম লাইনে এসে কবি যে-‘থেমে থাকা’-র কথা বলছেন সেটি কার থেমে থাকা? মৌমাছি ও রজনীগন্ধার পৃথিবী-সংলগ্ন এই থেমে থাকা কি তৃতীয় কোনো দর্শকের? নাকি এই থেমে যাওয়া মৌমাছির, যে ফুলে ফুলে ঘুরে দিনের শেষে থেমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাপ্তি ও বিস্তারকে খুঁজে পেয়েছে?

রজনীগন্ধা ফুলে মৌমাছির কাছে কেউ নেই, কিছু নেই। মৌমাছি বা তৃতীয় কোনো দর্শক— যেই হোক— উভয়ের কাছেই বাস্তবের ফুলটিকে অতিক্রম করে ফুটে উঠছে ‘আশাতীত’ ফুল।

এই যে আশাতীত ফুলের সন্ধান পেয়ে যাওয়া তার মূলে রয়ে গেছে এক শূন্যের কাছে বসে আত্মনিয়ন্ত্রিত ‘স্মৃতির নির্মাণ’। আরও স্পষ্ট করে বললে সেটিকে অভিহিত করা যেতে পারে ‘ভবিষ্যৎ স্মৃতির নির্মাণ’ হিসাবে। সেটি মৌমাছি বা তৃতীয় কোনো দর্শক— উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে সত্য।

কারণ দু-ক্ষেত্রেই আশাতীত ফুল হিসাবে যে-রজনীগন্ধা ফুটে উঠেছে তার জন্য অপেক্ষা শুরু হয়েছিল রজনীগন্ধাটির ফুটে ওঠার আগে থেকেই।

শিল্প-সাহিত্যে ‘মেমরি’-কে আশ্রয় করে অজস্র নির্মাণ হয়েছে, মননবিশ্বে মেমরির খেলা করার পদ্ধতি আমাদের কাছে পরিচিত। নস্টালজিয়ার সমনাম হিসাবে অনেকের কাছে গণ্য হয় অতীতচারিতা… সেখানে অনিবার্যভাবে কিছু নির্মাণ ও বিনির্মাণের খেলা ঘটে যায়। কিন্তু ‘ভবিষ্যতের স্মৃতি’-র নির্মাণ কি অসম্ভব অথবা সোনার পাথরবাটি অথবা সোনার পিত্তলমূর্তি?

জীবনানন্দের কবিতাটির প্রথম লাইনটিতে ফিরে গেলে কিন্তু এ সম্ভাবনা অসম্ভব বলে মনে হয় না। পার্থিব রজনীগন্ধা ফুটে ওঠবার আগেই তার জন্য অপেক্ষা শুরু হয়েছিল, তেমনই ঈঙ্গিত রয়েছে অকল্পিত ড্যাস-চিহ্নটির মধ্যে। ‘প্রথম’ শব্দটি… যা রজনীগন্ধার ফুটে ওঠাটিকে নির্দেশ করে… প্রস্ফুটনের মুহূর্ত থেকে সময়-দূরত্ব পায় ওই ‘ড্যাস’-এর কারণে। প্রথম ফুটে ওঠা রজনীগন্ধাটি ‘নতুন’… এই বোধের কাছে পৌঁছাতে যে-সময় প্রয়োজন, দর্শন ও দর্শনকে ছাপিয়ে উঠে একটি ঘটনাকে মেধা মনন বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সত্তার অংশ রূপে গ্রহণ করা, একটি ‘দেখা’-কে ছাপিয়ে উঠে তার আবিষ্কারের জন্য যে-বিস্তার প্রয়োজন… সেখানে শুয়ে রয়েছে আরেকটি ড্যাস। এই অভিজাত ও নির্জন দূরত্বটুকু যে-কোনো শিল্পের প্রাথমিক শর্ত বলেও মনে হয়।

সঙ্গে সঙ্গে কবিতাটির শেষ লাইনে এসে মনে হয়, এক শূন্যের কাছে বসে থাকা দর্শকের ভূমিকা আরেকটি শূন্যের কাছে এসে শেষ হয়ে যায়। একটি শূন্যের ভিতর থেকে ক্রমাগত মূর্ত হয়ে ওঠা ঢেউয়ের মতো ধারণাসমূহকে আরেকটি শূন্যের কাছে নিয়ে গিয়ে উগরে দেওয়া ছাড়া আমাদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এই কবিতাটির শেষের আগের লাইনটি ভা্লো করে পড়লে বোঝা যাবে এক অনাদি শূন্যের দিকে আমাদের তাড়িত করে নিয়ে যাবার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন কবি, ‘কেউ নেই, কিছু নেই, তবু মুখোমুখি…।’ এ শূন্যের কাছে এসে ক্রম-বিলুপ্তির মধ্যে দিয়ে হয়তো মুছে যাবে দ্রষ্টা। থেকে যাবে এক ‘আশাতীত ফুল’।

মেটোনিমি শুধু সাহিত্যে নয়, আমাদের বেঁচে থাকা স্মৃতি নস্টালজিয়া সবকিছুতেই অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি চিহ্নের বদলে আরেকটি চিহ্ন আবিষ্কার করা… একটি চিহ্নের মধ্যে দিয়ে আরেকটি চিহ্নকে সূচিত করা আমাদের স্মৃতির ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

একটি ফুলকে ‘রজনীগন্ধা’ হিসাবে চিহ্নিত করতে আমরা রজনীগন্ধা-নামক এক চিহ্নের আশ্রয় গ্রহণ করেছিলাম প্রথমে। একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হবার পর সেই ফুলটিকে আমরা ‘আশাতীত’ ফুল হিসাবে চিহ্নিত করতে শুরু করলাম। সেই ফুলটি যত না রজনীগন্ধা তার থেকে অনেক বেশি ‘আশাতীত’ এখন।

এই গোটা পদ্ধতিটি সম্পন্ন হয়ে যায় আমাদের স্মৃতির ভিতর।

নীৎশে তাঁর ‘দাস স্পোক জরাথুস্ট্র’-র এক জায়গায় লিখছেন, ‘Everything breaketh, everything is integrated anew, eternally buildeth itself the same house of existence. All things separate, all things again greet one another, eternally true to itself remaineth the ring of existence.’

নীৎশের পাশে জীবনানন্দের এই শান্ত অথচ তীব্র কবিতাটিকে রেখে বারবার পড়লে দেখা যাবে এই চক্রটি সম্পূর্ণ হয়ে যায় আমাদের স্মৃতি ও নস্টালজিয়ার মধ্যে।

আমাদের মিথ সংস্কার বিশ্বাস দর্শনের মধ্যে ঘুরে চলা আদি-চক্র ধারণা সব সময়েই একমুখী। সাইকোলজিক্যাল অ্যারো অফ টাইম আমাদের সব থেকে বেশি বাধা দেয় ভবিষ্যতের স্মৃতি নির্মাণে। কারণ, আমাদের সময় ধারণার তিরটি সব সময়ে সামনের দিকে ছুটে চলা। ঠিক যে-কারণে আমাদের কোনো পার্শ্ব-সময় নেই, ঠিক একই কারণে আমাদের কোনো পার্শ্ব-স্মৃতিও নেই। ফলে আমাদের সব ইউলিসিস সব হোম-কামিং বাড়ি ফেরা অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকা… সবই একমুখীভাবে ফিরে-আসার-পথটির দিকে তাকিয়ে থাকা। অর্জুন আপ্পাদুরাই এই ধারণাটিকে কিছুটা নস্যাৎ করে দিয়ে Arm-chair Nostalgia-র কথা বলেছেন (Nostalgia without lived experience or collective historical memory)। যদিও এই ধারণার মূলে রয়েছে বাণিজ্য-সংলগ্ন কিছু বিষয়।

কিন্তু শুধুই কি অতীত? ভবিষ্যৎ স্মৃতির নির্মাণে এই নস্টাজিয়ার ভুমিকা কতটুকু? প্রতিটি মুহূর্তই তো নস্টালজিয়ার বীজ বপণ করে চলেছে। স্মৃতি ও নস্টালজিয়ার মধ্যে পড়ে থাকা অদৃশ্য রেখাটিকে এক পাশে সরিয়ে রেখে বলা যায়, আমাদের বেঁচে থাকা আমাদের শিল্প আসলে সময়ের সঙ্গে নস্টালজিয়ার সংযোজন ও বিয়োজন। সমষ্টির স্মৃতি অনেক সময়েই ব্যক্তির স্মৃতিকে প্রভাবিত করে, মনন ও প্রজ্ঞার অন্যতম শর্ত হল আত্মনিয়ন্ত্রণের (self direction) মধ্য দিয়ে ব্যক্তির স্মৃতি ও নস্টালজিয়াকে এক দীপশিখার মতো বাঁচিয়ে রাখা। আমাদের সত্তার হয়ে ওঠা ঠিক এভাবেই ভবিষ্যৎ স্মৃতির নির্মাণ।

আমাদের শিল্পের হয়ে ওঠা বা না-হয়ে ওঠাও আসলে ওই ভবিষ্যৎ স্মৃতির নির্মাণ। একজন আত্মনিয়ন্ত্রিত আধুনিক প্রজ্ঞাশাসিত শিল্পী রজনীগন্ধা ফুটে ওঠার আগে যে-কুঁড়ির বাস্তবতা ও প্রায়-শূন্যতা, তার কাছে প্রত্যাশারহিত অবস্থায় বসে থাকেন। কুঁড়ি থেকে রজনীগন্ধার ফুটে ওঠা সব সময়েই সম্ভাব্যতার শর্ত মেনে চলে, ফলে অসম্ভাব্যতার ইশারাও থেকে যায় তার মধ্যে। তখন বিকেলের আকাশ ও নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ নেই। এইসব অনুসারী-উপলব্ধি কোনো শিল্পীর চূড়ান্ত উপলব্ধি হতে পারে না। তিনি অপেক্ষা করে থাকেন, অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা নেমে আসে হয়তো। কালপুরুষ জ্বলে থাকে ও কাল-নারী নামে কোনো কল্পিত নক্ষত্রমণ্ডলী হয়তো পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু ‘কেউ নেই, কিছু নেই’-এর স্তর পেরিয়ে মুখোমুখি এক আশাতীত ফুল আবিষ্কার করা ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজও নেই, তিনি নিয়তি শাসিত… ভয়াবহভাবে ডেস্টিনড।

শুধু বলার কথা এই, এই নিয়তি এই ডেস্টিনি সে নিজে নির্মাণ করে নিয়েছে। এমনকী তাঁর অতীতচারিতাও গুপ্ত-সংগঠনের সন্ত্রাসবাদীর দক্ষতায় সম্পন্ন হওয়া এক পদ্ধতি। ভবিষ্যৎ স্মৃতির নির্মাণ করবার জন্য সে খুঁড়ে চলে একটা টানলে… অন্ধকার শুঁড়িপথ বা হিমশৈলের ফাটল। ব্যক্তিগত সময় ধারণার সঙ্গে ‘নস্টালজিয়া’-র সংযোজন ও বিয়োজনের এক জটিল পদ্ধতির মধ্য সে নির্মাণ করে তার ভবিষ্যতের স্মৃতি। নিছক কাক ও টিয়া-জ্যোতিষীর পৃথিবী থেকে দূরে… কিরোর অমর গ্রন্থমালা ও বাস্তুশাস্ত্রবিশারদের পূর্বানুমান থেকে দূরের এক পৃথিবীতে অবস্থান করে সে-সব শিল্পী। অতিগোপনে… প্রায় সংগোপনেই সম্পন্ন হয় সে-গূঢ় কর্ম।

আমরা সামান্য মানুষ, মাঝে মাঝে কোনো এক রজনীগন্ধার পাশে মৌমাছির ওড়াউড়ি দেখে চমকে উঠি… জীবনানন্দের ‘রজনীগন্ধা’ পাঠের কথা মনে পড়ে… পাঠের নস্টালজিয়া রজনীগন্ধা ও মৌমাছি অতিক্রম করে আমাদের কাছে তুলে ধরে এক আশাতীত ফুলকে।

অতীতের কোনো এক দীর্ঘ দুপুরে নির্মিত হয়েছিল ‘ভবিষ্যতের’ এই স্মৃতি। আমরা কেউ কেউ তাকে এই দর্শন করলাম মাত্র।

Facebook Comments

পছন্দের বই