লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রঘু জাগুলিয়ার প্রবন্ধ

তুমি নীরবতা, সাঁঝের প্রদীপ

নদীর ভাঙা-গড়ার মধ্যে যে-জীবন অন্তর্নিহিত, আবহমান, সেই জীবন নরম ও নিবিড় পলিমাটির চেয়ে যে-আঠালো— মনে হয় সে কোনো ভোরের আলোর মতো অস্পষ্ট, চরের উপর দেখা শামুকখোল পাখিটিকে ভালো লাগার মতন। সুন্দরবনের মানুষের জীবন-জীবিকা ও দ্বীপগুলির অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলি নিয়ে এই সন্দর্ভ। প্রথমে বলি, ভারতের অংশে সুন্দরবনে মূলত ১০২টি দ্বীপের মধ্যে ৫৪টিতে মনুষ্য বসবাস এবং ৪৮টি বাদাবন। এর মধ্যে দু-টি দ্বীপ সমুদ্র গিলে নিয়েছে। প্রত্যেকটি দ্বীপ লোনা জলবেষ্টিত ও কোনোটা হয়তো মাছের ট্রলারগুলির মতো বা কোনোটা একফালি কুমড়ো বা কুমিরের পিঠের মতো। তবে প্রতিটি ব-দ্বীপ এইরকম হওয়ার পিছনে যে বৈজ্ঞানিক যুক্তি দেখানো হয় তার কারণ, বঙ্গোপসাগরের থেকে নদীপথে বয়ে আনা পলি, নুড়ি-বালি এবং ৬ ঘণ্টা জোয়ার ও ৬ ঘণ্টা ভাটায় নদীগর্ভে খালের মাধ্যমে বিপুল স্রোত দিয়ে জলের সর্বক্ষণ অতন্দ্র প্রহরা। কিন্তু যেখানে নদী প্রশস্ত সেখানে নিরন্তর জলের উদ্যমতাই নদীর তলদেশে ব্যাপক ক্ষয়কার্যের প্রধান কারণ। এর ফলে নদী বাধগুলি প্রায়শই ভাঙতে থাকে। আর একটি গূঢ়তর কথা এই যে, সুন্দরবনবাসী নদীর জলের উচ্চতা থেকে ২-৩ ফুট নীচে রোজ অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ঘুমোতে যায়। এই ৫৪টি দ্বীপে সাকুল্যে নদীবাধ ৩৫০০ কিলোমিটারের একটু বেশি আছে। ভাঙাবাধ পুনর্নির্মাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় মাটি বেশিরভাগ সময় সাধারণ চাষির ক্ষেত থেকে বা জলাজমি থেকে নেওয়া হয় বা দ্বীপগুলির কিনারে গাছের গোড়ার মাটি নিয়ে ভরাট করা হয় এবং সত্যিকথা বলতে এইরকম সহজ উপায়ে এর চিকিৎসা করা ঠিক নয়। কারণগুলি হল, এক— কৃষকের জমি থেকে মাটি নিলে সেই মাটি কীভাবে ভরাট করা হবে তা পঞ্চায়েতের গড়িমসির পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, দুই— নদীর পাড়ে গাছের গোড়ার মাটি বা চরের মাটি নিয়ে নদীবাধ গ্রামের ভিতরে সরে গিয়ে করেও তার সমাধান হয় না, তিন— রিং বাধ বা কংক্রিট বাধ একটু স্থায়ী হলেও, বেশ কয়েক বছর পর এই সমস্যার পুনারাবৃত্তি ঘটতে থাকে। সুতরাং, এমন অনিশ্চিত ও আশঙ্কাপূর্ণ মানুষের জীবনের পাশে আমার ব্যক্তিগত মত বলে কিছু নেই। এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ সুন্দরবনবাসীর ভাবনার প্রয়োজন বলে মনে করি এবং আশা রাখি, বিভিন্ন গবেষক ও সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের বিষয়গুলিতে মঙ্গলদৃষ্টি যেন পড়ে। তবে একটি অবলম্বন হল, প্রকৃতির ইচ্ছেকে জানা, তার জন্য প্রতি মুহূর্তে পদ্ধতিগত তথ্য সংগ্রহ করা। এবার এই বাধ গড়ে ওঠার ইতিহাসটা হল, বিট্রিশরা যখন অনাবাসী জমিদারদের হাতে এই সমস্ত বাদাবনে মানুষদের নিয়ে বসতি গড়ে তুলতে বলেছিল, তখন সম্পূর্ণ পরিকল্পনা ছাড়াই সদ্যোজাত দ্বীপগুলিতে মানুষ নিজের ইচ্ছামতন বাধ দিয়েই জঙ্গল কেটে থাকতে শুরু করল। বিপদটা এখানেই ছিল যে, বাদাবনগুলিতে তখনও পলিসঞ্চয়কার্য সম্পূর্ণ হয়নি এবং ভূমিস্তর জলের লেভেলের নীচে চলে যায়। এখন আমরা জানি বিশ্বউষ্ণায়নের ফলে জলের স্বাভাবিক উচ্চতা সমুদ্র তীরবর্তী এইধরনের জলবেষ্টিত স্থলভাগগুলির ক্ষেত্রে সমস্যা দিনে দিনে ক্রমশ অনিশ্চয়তায় পর্যবসিত।

সুন্দরবনের ৪৮টি বাদাবনের সঙ্গে লোকালয়ের কীরকম সম্পর্ক আমরা প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর জানি। আমি একটু বলে নিতে চাইছি অতীতের কয়েকটি কথা, যখন গ্রামগুলির অর্ধেকের বেশি মানুষ নদীতে নৌকা নিয়ে বা বাউতি জাল টানতে বা কাঁকড়া ধরতে যেত। ১৯৯০-এর চারপাশের কথা। নদীতে প্রচুর পরিমাণে মীনের উৎপত্তি হয়, আর মানুষ কাঁচা পয়সার লোভে ২৪ ঘণ্টার জলে পড়ে থাকত। হয়তো কারো মা-বাবা জলে জাল টানছে এবং সেইসঙ্গে ভোররাতে তার ছেলেমেয়ে দু-টি নদীর পাড়ে বসে শুক্তি দিয়ে মীন বেছে তুলছে। শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্যই যে, এইরকম জীবন বেছে নিয়েছিল তাই নয়, মানুষের দীনতা ও অসহায়তা ছিল এর প্রধান কারণ। এমনকী কেউ চাকনে করে মাছ পাড়ায় বা হাটে নিয়ে না বসলে তার পক্ষে সংসার চালানো খুব কষ্টকর হয়ে পড়ত। কাউকে আবার বাড়ি বাড়ি মাছের বিনিময়ে পাঁচশগ্রাম চাল বা দু-তাড়ি পুঁইশাক বাড়ি নিয়ে গিয়ে ফোটাতে হত। নব্বইয়ের পর থেকে ২০০০ সালের প্রথমার্ধেই এই দৃশ্য আমার চোখের সামনে খুব স্বাভাবিক ছিল। এই সময় মানুষের অপরিকল্পিত ও বিধিনিষেধহীন জলসম্পদ ব্যবহার বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী করা যায়। এর মাঝে বলা প্রয়োজন, জল থেকে পর্যাপ্ত মীন ধরে ফিসারির জলে চাষ করা বা বড়ো বড়ো খটির মালিক একতরফা মুনাফা নিয়ে সাধারণ মানুষকে পথে বসিয়ে দিয়েছিল এবং একদিন জল থেকেই এই বিশেষ সম্পদটি সবার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। এবার একদল যখন দেখল জঙ্গলের মাছ ধরা ও মধু কাটার থেকে আরও বেশি পয়সা হয় জঙ্গলের গাছ কাটায়, তখন নির্বিচারে জঙ্গল সাফ করে কাঠ বিক্রি করা শুরু হল। কেউ কেউ হরিণ মারা বাঘ মারার মতো বেআইনি চোরাচালান কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল এবং ধরা পড়ে জেল খাটতে খাটতে তাদের জীবনের অর্ধেক আয়ু চলে যেত। কিন্তু যারা জঙ্গলে বাঘের মুখে, কুমিরের বা কামোটের মুখে বা কাঁকড়া ধরতে গিয়ে প্রাণ হারায়, তাদের সংসারগুলি একপ্রকার অচল ও দুর্দশার অন্তিম সীমান্ত সহ্য করে।

এবার গ্রামগুলির অন্তর্মণ্ডলে যদি আরো গভীরে তাকাই তাহলে দেখব, এখানে জমিগুলিতে বছরে তিন-চারবার ফসল উৎপাদন করা হয়। ১৯৬০-এর পর মানুষ খুব দ্রুত বাদাবনগুলিকে চাষযোগ্য করতে শুরু করল। মাটির লবণাক্ত স্বভাবের কারণেই প্রথম দিকে সমস্ত ফসল হত না বললেই হয়। তবে দীর্ঘদিন মাটির স্তর পরিবর্তনে, ২০০০ সালের প্রথমার্ধে প্রচুর পরিমাণে ধান ও লঙ্কা চাষ হতে শুরু হয়। তাই ফসল বলতে ধান চাষ, লঙ্কা চাষ, সূর্যমুখী, কড়াই, আলু ইত্যাদি। একই জমিতে তিন-চারবার চাষ করলে যে-সমস্যা হয় তা প্রধানত ব্যাপক পরিমাণ মিষ্টি জলের এবং উচ্চ ফলনের জন্য পুরোনো ধানের বীজ বাদ দিয়ে নতুন নতুন বীজ ও ব্যাপক কীটনাশক এবং অসংখ্য স্যালো তৈরি। এর ফলে জমি উর্বরতা হারিয়ে ফেলল বেশিরভাগ এবং মানুষের পানীয় জলের জন্য হাজার ফুটের নলকূপ থেকে কোথাও জল ওঠা সম্পূর্ণ বন্ধ হল অথবা কোথাও বন্ধের মুখে। মানুষ বিংশ শতকের শেষটা ও একবিংশের শুরুতে যেভাবে এখনও যুক্তিহীন-পরিকল্পনাবিহীন চিন্তা নিয়ে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে চলেছে তাতে এইটা স্পষ্ট যে, এই ক্ষয়িষ্ণু দ্বীপগুলির ভবিষ্যৎ অন্ধকার ছিঁড়ে বেরোনোর মুখে দিন দিন আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে একটু প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষার কথা বলি। ছেলেমেয়েরা অধিকাংশই স্কুল শিক্ষকের স্বপ্ন মাথায় নিয়ে পড়াশোনা করে। কারণ, পড়াশোনা করে চাকরির পথ বলতে ওই একটিকেই সকলে জানে। যদিও বর্তমানে মোবাইল, টিভির দৌলতে (এখানে উল্লেখ থাক গত পাঁচ-সাত বছরে বেশিরভাগ গ্রামে কারেন্ট পৌঁছেছে) দেশ-বিদেশের খবর পড়লেও— গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বি.এড নামক ডিগ্রী বা ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য কোনো ডিগ্রী পড়াতেই নিজেদের জায়গাজমি বিক্রি বা বন্দক রাখতে হয়। সেইঅর্থে প্রত্যেক বাড়িতে মাধ্যমিক পাশ ছেলেমেয়ে থাকা সত্ত্বেও, তারা সপরিবারে ভিন রাজ্যে খাটতে চলে যায়, কেন-না এখানে কৃষিকাজ ও তার দেখভালের জন্য প্রত্যহ খরচখরচা বাড়ার জন্য এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানোর জন্য প্রতিটি সংসার থেকে কাউকে না কাউকে বাইরে পড়ে থাকতে হয়। সুন্দরবনে গত কয়েকমাস আগেই বিশিষ্ট সমাজসেবী ও শিক্ষক শ্রী তুষার কাঞ্জিলাল প্রয়াত হয়েছেন। সুন্দরবন যার প্রাণ ও ধ্যানজ্ঞান ছিল এবং খুব পরিচিত তিনি সকলের কাছে ‘মাস্টারমশাই’ নামে। শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হল— “আর একটা বদ্ধমূল ধারণা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে যে, দুনিয়ার তাবৎ জ্ঞানের আড়তদার হচ্ছে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিদ্যাবিক্রয়-কেন্দ্রগুলি। তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ শিক্ষার স্বীকৃতি নেই। গ্রামের দরিদ্রতম মানুষও যে ভাবতে পারেন, নতুন ভাবনার জন্ম দিতে পারেন এবং সে-ভাবনা গ্রহণযোগ্য হতে পারে, এ-ধারণা আমাদের দেশের সমাজের ধারক ও বাহক যাঁরা তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে।” (তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘পথে-প্রান্তরে’ থেকে উদ্ধৃতিটি) তাই পড়াশোনা বা শিক্ষার যে সম্যক সচেতনতা সেটা খুব ভালো নয়। এখনও মানুষ সাপে কামড়ালে বা বিষ খেলে বা জ্বরে ভুল বকলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে ওঝা বা গুনিনের কাছে ছোটে। আর যারা একটু বোঝে তারাও খুব বেশি পথ যেতে পারে না। বড়ো জোর, গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার। এরকম জরুরিকালীন চিকিৎসার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেমন সাপে কাটা, গাছ থেকে পড়া, ইত্যাদি রোগীদের ক্ষেত্রে নদীটুকুও পেরোনো হয় না। তবে গর্ভবতী মায়েদের জন্য কোথাও কোথাও অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও, খারাপ রাস্তার কারণে ভীষণ ঝুঁকির মধ্যে পেশেন্টকে দু-তিনটি দ্বীপ পেরিয়ে ব্লকের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আর কিছু মানুষ আছে, পর্যটন শিল্প দিয়ে নিজেদের সংসার চালায়। শীতের মরসুমে বিভিন্ন লজ ও টুরিস্ট বোটে দিনরাত খাটাখাটনি করে থাকে। এইসময় সজনেখালি বনদপ্তরের অফিস থেকে জঙ্গলে ভ্রমণের পারমিশন পাওয়া যায়। আর রাস্তাঘাট সরকারি যোজনায় তৈরি হলেও, পঞ্চায়েত ও ব্লক অফিসের গড়িমসির কারণে কোনো রাস্তার কাজ দ্রুত এগোয় না। কত কত রাস্তা নদীতে মিশে গেছে তার ঠিক নেই। একবার তৈরি হওয়া রাস্তা পুনঃনির্মাণের জন্য দু-তিনটি ইলেকশন পেরিয়ে যায়।

অদ্যাবধি মানুষের বিবিধ সমস্যা ও জীবনচিত্র একশো ভাগের একভাগ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। এবার সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলির সংস্পর্শে যাওয়া যাক। মাস কয়েক আগে প্রলয়ঙ্কারী আমফান ঘূর্ণিঝড় এখানে যে-পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেমনটি দেখেছিলাম ২০০৯ সালের আইলা ঘূর্ণিঝড়, তার সমতুল্য বললে খুব একটা ভুল হবে না। ঝড়ের পরদিন থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। কোথাও বাধ ভেঙেছে, কোথাও মাটির বাড়ি ভেঙে পড়েছে, কোথাও গাছ ভেঙে বাড়ির চালে পড়ে আছে, কোথাও শ-য়ে শ-য়ে বিঘে ধানচাষের মাঠ নোনাজলে পরিপূর্ণ, কোথাও স্কুলের টিনের চাল উড়ে নদীতে পড়েছে— একাধিক অব্যক্ত দৃশ্য। কয়েকদিন পর তাই বিভিন্ন এনজিওদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ঘরছাড়া মানুষদের বোটে করে নদীপথে দেখতে ছুটলাম। প্রথমে বালি ১ নং দ্বীপ হয়ে পাখিরওলা। সর্বত্র বাঁধে কাজ চলছে সে-সময়। তারপর রাঙাবেলিয়া। সেখানেও প্রায় ৫০০ ফুট নদীবাধ ভেঙে ৩০০টি পরিবার নোনাজলে ডুবে আছে। কোথাও মানুষ রাস্তার উপর পলিথিন বেঁধে দিন কাটাচ্ছে, কোথাও ভাঙাবাড়ি মেরামতের কাজ করছে, কোথাও আবার বাঁধে মাটি দেওয়া হচ্ছে। কিছুটা সময় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে, নদীপথে সাতজেলিয়ায় মানুষজনের বস্তাভরতি মাটি বাঁধে দেওয়া দেখতে দেখতে ছোটোমোল্লাখালি গিয়ে উঠি। ৫ নং, ৮ নং ও ৯ নং গ্রামে বাধ ভেঙে শ-য়ে শ-য়ে ধানের জমি জলে ভেসে গিয়েছে। নয় নং ও আট নং প্রায় ১২০০০ ফুট বাধ সম্পূর্ণ জলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গ্রামের মানুষের কাছে জানতে পারি, তাঁরা গ্রামের স্কুল কালীদাসপুরে ঝড়ের দিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিভিন্ন এনজিও মারফত চাল-ডাল, চিড়ে-মুড়ি, পলিথিন দিয়ে গেলেও তাঁরা বারবার নদী বাধ কংক্রিট ও বাধের বাইরে থেকে দু-শো ফুট প্রশস্থ এরিয়া নিয়ে গাছ লাগানোর আর্জি করছেন। কেউ কেউ প্রতিটি গ্রামে একটি করে ফ্লাডসেন্টার তৈরি করার আর্জি করেছেন। পাশে কুমিরমারী ও মরিচঝাঁপি নদী হয়ে পুনরায় ঝড়ের দাপটে জঙ্গলের লাল হয়ে যাওয়া গাছগুলি দেখে দেখে বাড়ি চলে আসি। ভাবি আইলা দুর্যোগের কথা, ২০০৯ সালের পর কেন্দ্র সরকারের সুন্দরবন বাধ নির্মাণের পিছনে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও, এতদিনে বাধগুলি কেন যে কংক্রিটের গড়ে তোলা হয়নি, তার সদুত্তর পাইনি কোথাও। আইলাতে মোট ৯৮০ কিমি বাধ ভেঙেছিল। এবারের সরকারি রিপোর্ট এখনও চোখে পড়েনি।

আজ থেকে পাঁচবছর আগে সুবল ও তাঁর বন্ধুরা নদীতে মাছ ধরতে যায়। সুবল সর্দার আমাদের প্রতিবেশী। গ্রামের হাট থেকে বাজার করে নৌকায় পিপজাল, কাছিদড়ি, খেবলাজাল, হাঁড়ি নিয়ে ওদের সাতজনের একটি দল মাছ ও মধু সংগ্রহের জন্য প্রায় একসপ্তাহ ধরে জঙ্গলে চলে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দু-দিন বাদেই একজনকে নৌকা থেকে বাঘে তুলে নেয় এবং একজনের ঘাড়ে থাবা মারতে গিয়ে তার এক কান ছিঁড়ে নেয় ও কাধের হাড় ভেঙে দেয়। বাকিরা জঙ্গলে তখন হাঁকাহাঁকি, জলে বৈঠার বাড়ি মেরে অনেকক্ষণ চেঁচামেচি করে গ্রামে চলে আসে। কিন্তু এত কিছুর পর সুবলের মন পড়ে থাকে জঙ্গলে। পরদিন বন্ধুর দেহকে বাঘের ঘাঁটি থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য বোটে করে গ্রাম থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন গ্রামবাসী সমেত পুনরায় জঙ্গলের উদ্দেশ্যে বের হয় এবং যাওয়ার আগে সুবলের বউ ও মা অনেক বারণ সত্ত্বেও, সুবল কারো কথায় কর্ণপাত করেনি। বোট নিয়ে যথারীতি বাইন-গেঁওর খাঁড়ি হয়ে জঙ্গলটির পাশে চলে যায়। সুবল বোট থেকে নেমে পাঁচফুট দূরত্বে হাঁটতে শুরু করে, হাতে মোটা বাঁশের খাদি এবং সুবলের পিছুপিছু আট-দশজন নেমে হাতে লাঠিসোঁটা-সহ জঙ্গলে প্রবেশ করে। বাকিরা বোটে বসে থাকে, ভয়ে জঙ্গলে নামতে চায়নি। এর কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সবাই পড়ি-মরি করে বোটের দিকে ছুটে আসে। সে-সময় কেউ কাউকে কোনো শব্দ বিনিময় করতে পারছিল না এবং এতটাই ভেঙে পড়েছিল সকলে যে, নিরুপায় হয়ে বোট নিয়ে সকলেই গ্রামে ফিরে আসে। সেদিন না তো কেউ সুবলের বন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল, না তো সুবলকে জঙ্গলের পথ থেকে আনা গিয়েছিল। সুবল চলে গিয়েছিল জঙ্গলের যে-পথগুলিতে আর কোনোদিন কেউ যাবে না, সেখানে। এইভাবে জঙ্গলে প্রবেশ সম্পূর্ণ বেআইনি ও একপ্রকার হঠকারিতা। আর এমন অজস্র বাস্তব জীবনের কাহিনি সুন্দরবনের গাঁয়ের ঘরগুলিতে বর্ষাকালের মেঘের মতো ঘোলাটে-কালো হয়ে আছে। কবি মুকুন্দ গায়নের কবিতার মতন…

“একটা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছো তুমি।
না লেখা বর্ষার মতো, চুল এলো করে
বিশ্বাস করবে না তুমি, কাল আমি
এরকম স্বপ্ন দেখেছি তিনবার।
শুধু একটি আকাশমুখো কুকুরের ডাক
সঙ্গে রয়েছে খুব সম্ভবত।”

কবি মুকুন্দ গায়েন একজন বাংলা ভাষার অতি স্বল্পপরিচিত কবি। সমগ্র জীবন ধরেই তিনি সুন্দরবনের দয়াপুর গ্রামে ছিলেন। তাঁর কবিতার মতন এই জল প্রতিধ্বনিময়, কীর্তনের সুরের মতো প্রণয়ী। সুন্দরী গাছগুলির যেমনি বিস্মৃত ভাবমূর্তি, হেতালের ঝোপে ঝোপে যেমনভাবে লেগে থাকে পড়ন্তবেলার আলো, মনে হয় ছিন্নত্বক ফলে ও ছায়ায় ওই তোমার বেদনা-আহত হাসি।
মাঝে মাঝে মনে হয়, যেহেতু সুন্দরবনের প্রতিটি দ্বীপের চাওয়া-পাওয়া সব প্রকৃতির খেয়ালে-ধ্যানে, তাই মানুষ যেন তার প্রতি অবাধ্যচারণ না করে। তা না হলে এই ব্যাপ্তি একদিন চোখের সামনে দিয়ে বিদায় নেবে এবং সুন্দরবন নামটাই অনর্থক হয়ে দাঁড়াবে।

উৎসর্গ: মাস্টারমশাই শ্রী তুষার কাঞ্জিলাল ও কবি মুকুন্দ গায়েন-কে।

কৃতজ্ঞতা: কম্পাস, দক্ষিণের সাঁকো পত্রিকার ২০০৯ সালের বিভিন্ন আলোচনা, যা আমি সে-সময় শেষ পড়েছিলাম। কবি কুণাল বিশ্বাস ও কবি শাশ্বতী সরকার–এর মন্তব্য। বন্ধু বাপ্পা দাস, যে আমাকে ঝড়ের পর সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে এবং কবি সেলিম মণ্ডল, যিনি আমাকে এই লেখাটি লিখতে উৎসাহ দেন।

Facebook Comments

পছন্দের বই