লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

পাথরের ভ্রূণ

পৃথিবীকে উলটো করে ঝুলিয়েছি হিংস্র বাঘটির পাশে। সে অনন্তকাল ধরে বসে আছে সুতোর রাস্তায়। সুতোটি নম্র ভারি। এতকাল না ছিঁড়ে কীভাবে যে ধরে রাখে প্রান্তর, টিলা, বন্যপ্রাণ সব, সেই ভেবে গম্ভীর হয়ে যাই। সহাস্যে বলতে পারি না কোনো শ্লোক। দূরের পাহাড় থেকে নেমে আসে বরফের সিঁড়ি।

আমার উল্লাস আজ ফেলে দিয়ে যাব এই নিঃস্ব জঙ্গলে। যেখানে বৃক্ষের হাতে দু-টুকরো হয়ে পড়ে আছে মানুষ। আকাশ ফেটে গিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। সমস্ত ঝোরার ভেতর থেকে উঠে আসছে পাথরের ভ্রূণ। এমন স্থানের কাছে নতজানু হয়ে ফেলে দিয়ে যাব সব কাঙ্ক্ষিত ভুল।

আমাকে ক্ষমার কোনো প্রশ্ন তুলো না। তার চেয়ে জ্ঞানীর কাছে যাও৷ দেখ কোন কুটির থেকে বেরিয়ে এসে পাখিরা ছড়িয়ে দিচ্ছে বীজ। আগামী ক্ষুধার মাসে তার থেকে জন্ম নেবে শ’য়ে শ’য়ে নগ্ন তলোয়ার।

দাঁত খুব স্থির। হাঁ-এর মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে শূন্যতার রং। একটি গর্জনে কেঁপে ওঠে শিরা। পৃথিবীকে উলটো ঝুলিয়ে রেখে আমি বাঘটির কাছে যাই অপার সান্ত্বনা ছড়িয়ে দিতে।

হাড়ের ধনুক

এল মৃদু ঘ্রাণ সেই ঘৃতকুসুম জানালা পেরিয়ে। আমি সেই বসে আছি সহস্র রোদের মাথায়। কেউ আমাকে স্নান করিয়ে দেবে আজ মধুভাণ্ড ঢেলে। তারপর ধীরে ধীরে নেমে যাব নিজের গভীরে। সেখানে সরল পথে একটি দু-টি হলুদের গাছ। গাছে গাছে টেনে রাখা মাটির চাদর। আমি কি আমাকে দেব গোধূলির বেড়া?

এসো নীচু মেঘ পেরিয়ে। দাও তুলে মন্দ কুঠার। যত আছে ভুলে যাওয়া আঘাতের নীরব কথন, তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। শুধু এক হাওয়া জাল আটকে ধরে যাবতীয় আক্ষরিক ব্যথা।

প্রবল স্নেহের বশে নিজের করোটি শূন্যে তুলে ছুড়ে দিই জোৎস্নার ভেতর। থোকা থোকা গাছপাকা আলো ঝুঁকে পড়ে হাড়ের ধনুকে। তারপর শব্দ, জল। আমার সহজ কথা নিজেই হারাই।

এ-পর্যন্ত পড়ে কেউ থেমে যাবে জানালার ধারে। আমার স্নানের দৃশ্য ক্রমশ গভীর হয়ে চলে যাবে অন্তঃপুরে। বাইরে কিছুই নেই, কেবল হলুদ গাছে দু-খানি পাখির মতো সন্ধ্যা এসে বসে থাকবে হাহাকার করে।

খরগোশের দিনলিপি

জ্বরের নিষেধ মানো হে আমার সামান্য বাঁচা। পঞ্জিকা মতে সে এল কোন চতুর্ভুজ পেরিয়ে— আজ আর জানার উপায় নেই। শুধু তাকে আশ্রয় দাও শরীর কুটিরে। বেড়ে দাও শান্তি একথালা। যেন তার অভাব না থাকে।

জ্বরটি ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে খরগোশের মতো। তাকে দিই ঘাসের বড়ি। ছোলা ভেজানো মিক্সচার। সে খায় আর বেড়ে ওঠে কুটিরের ভেতর। চারিদিকে হুলুস্থূল ফেলে দেয়। কখন যে আমার চুলের মধ্যে বসে অন্যের নাক কামড়ে দিচ্ছে বোঝার আগেই সে আবার চুপ।

আমাকে ম্যাজিশিয়ান ভাবা এবার বন্ধ কর তোমরা। আমার কোনো টুপি নেই, রুমাল নেই। আমি অতি যত্নে এই খরগোশটিকে আমার অন্দরে ধারণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দূরে একটি সাইকেল চলে গেল আলতা বিক্রি করতে করতে। আমার খরগোশকে লাল করার খুব ইচ্ছে কিন্তু সাইকেল আমার ডাকের বাইরে চলে গেছে৷

তবু তোমরা নিষেধ করছ তাই এই ক-টা দিন আমি একটি পালঙ্ক এনেছি। তাতে শুয়ে থাকব আর নিজের সমস্ত ভবিষ্যৎ মুছে ফেলে শুধুমাত্র লিখে যাব খরগোশের দিনলিপি।

ভ্রূকুটি

নির্ণায়ক ফুল, তাকে লিখেছি অনন্ত কারুকথা
কোন পথে পথ আছে, কোন মেঘে মেঘ, ধুলোবালি
যাও বাক্য, যাও, এই শব্দে আর ঘুরো না অযথা
ফুটেছে, এই তো বেশ, তার মধ্যে প্রবণতা ঢালি

আরও ঢালি পূর্ণ পাপ, ঢালি নগ্ন প্রাচীনের মায়া
তাকে কি আদর দেবে? দেবে কোনো শেকড়ের গ্লানি?
শরীরে শরীর ঢেকে যে-মানুষ নিখুঁত, বেহায়া
অন্ধকার খুঁড়ে খুঁড়ে কেউ তার পরিচয় জানি?

না জানা কি অপরাধ? নাকি শুধু নির্ণয়ের ভ্রমে
ক্রমাগত কেটে, ছিঁড়ে পাতাগুলি সাজাই বাতাসে
ফুল, তার আত্মরতি, ফোটার সাথেই বাড়ে, কমে
এবং দেহের ছায়া অতি ধীরে গ্রাহ্য হয়ে আসে

লেখার পরেও থাকে অবিশ্বাস, সন্দেহের ত্রুটি
ফুলেদের পক্ষ নাও, নীচে রাখ জীবন, ভ্রূকুটি

আত্মগোপন

আমি দেখছি, পুরানো কুসুম থেকে তাকিয়ে আছে
আমার গৃহত্যাগী আত্মা
জন্মের সময় যে আমার টুঁটি ধরে নিয়ে গিয়ে ছিল
মৃত গাছেদের জঙ্গলে

পরণে চামড়ার বল্কল জড়িয়ে আমি শুয়ে রইলাম
গাছেদের হাড় পাঁজরার মাঝে
আমার মুখে দুধের বদলে ঝরে পড়ল শুকনো পাতা
ধোয়া জল
আকাশে আঘাত করে বজ্র ফিরে এল মাটিতে

আমার আত্মা সব দেখল আর আমাকে নিরোগ করে
ফিরে গেল লোকালয়ে

আমাকে দেখছে যারা বাজারে, বেশ্যালয়ে
কিংবা পার্টি অফিসে, সে আমি নই
আমার গৃহত্যাগী আত্মা

যেখানে দেখবে কোনো মৃত গাছে
একটি দু-টি নতুন জীবন
বুঝবে তারই আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে আছি আমি

Facebook Comments

পছন্দের বই