লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গদ্য

অনুপম মুখোপাধ্যায়

অমিতাভদা ছিলেন বাংলা কবিতায় এক সংক্রামক ব্যাধি

আমি জীবনে প্রত্যক্ষভাবে একজন কবির সঙ্গেই মিশেছি। একজন কবির সঙ্গেই মুখোমুখি বসে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি। আড্ডা অর্থে পরচর্চা পরনিন্দা নয়। ‘আগন্তুক’ ছবির সেই ভূপর্যটকের ভাষায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের আড্ডা, কথোপকথন। তিনি কবি অমিতাভ মৈত্র। তিনি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ঘাটাল শহরে এসডিও হয়ে এসেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়, মাধ্যম ছিলেন ‘কবিতাপাক্ষিক’ পত্রিকার প্রাণপুরুষ প্রভাত চৌধুরী। আমি প্রভাত চৌধুরীর কাছে অনেক কারণেই কৃতজ্ঞ। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হল তিনি আমার সঙ্গে অমিতাভ মৈত্রের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময়টায় আমি সবেমাত্র কবিতা ছাপতে দেওয়া শুরু করেছি। শুধুমাত্র ‘কবিতাপাক্ষিক’-এই ছাপতে দিতাম। সেই সময়টায় আমার পায়ের তলায় কোনো মাটি ছিল না। সেই সময়টায় আমার শহরে এবং আমার জীবনে অমিতাভ মৈত্রের এসে পড়াটা দৈবপ্রেরিত ছিল বলে আমার মনে হয়।

রোজ সন্ধ্যায় আমাদের কথা হত। যদি না কোনো প্রশাসনিক কাজে উনি অনুপস্থিত থাকতেন। কখনও বাইরে থাকত গ্রীষ্মের গুমোট হাওয়া, কখনও শীতের তীক্ষ্ণ বাতাস, কখনও বর্ষার জলধারা। উনি থাকতেন শিলাবতী নদীর ধারে লম্বা লম্বা গাছে ঘেরা একটা ব্রিটিশ আমলের বাংলোয়। সেটার ভূতুড়ে হিসাবে খ্যাতি আছে। অমিতাভদা বলতেন রাত গভীর হলে ছাদ থেকে কাঁধের উপর কোমল পায়ের স্পর্শ নেমে আসে। অমিতাভদাকে একটা ধারালো ছুরির মতো মনে হত। স্পর্শ করলে হাত কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আশ্চর্য মেধাবী একজন মানুষ। এবং আশ্চর্যরকমের উৎসুক ও তৃষ্ণার্ত। ওঁকে দেখলে মনে হত কোনো এক জলের নেশায় ছটফট করছেন। সেই জল কবিতার হতে পারে। গদ্যের হতে পারে। কিন্তু সেই জল অবশ্যই খুব উঁচু ও দুর্গম কোনো পর্বতের চূড়া বা খুবই গহীন ও বিপজ্জনক উপত্যকার খাঁজে রাখা আছে। কোনো বাঙালির চোখে আমি অমন তৃষ্ণা দেখিনি।
অমিতাভদা যে-কবিতা লিখেছেন তার তুলনা বাংলা কবিতায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ওঁর কবিতার কোনো পূর্বপুরুষ কি আছেন? সুশীল ভৌমিক আর ভাস্কর চক্রবর্তীকে কি ওঁর কবিতার সূত্রে কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? ওঁদের কবিতার উত্তরাধিকার কি আছে অমিতাভদার লেখায়? সম্ভবত আছে। কিন্তু সেভাবেই আছে, যেভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের শরীরে আছে আমার বা আপনার জেনেটিক কোড। উনি এক একক উপস্থিতি বাংলা কবিতায়। এবং বাংলা গদ্যেও। গদ্য আর কবিতাকে কোথায় একই রাখবেন আর কোথায় আলাদা করবেন এই নিয়ে বাংলার চিন্তকরা যখন কাতর, কোথায় যে অমিতাভ মৈত্র মিলিয়ে দিয়ে গেলেন গদ্য আর কবিতাকে তাঁর অদ্ভুত লেখালেখিতে! যেন তিমিমাছ শ্বাস নিতে ভেসে উঠল, আর তার ফোয়ারায় আপনি দেখতে পেলেন কবিতার রামধনু। লেখার পৃথিবীতে গদ্য আর পদ্য যে একই ঘটনা, তার চরম উদাহরণ অমিতাভ মৈত্র।

এই সময়ে দাঁড়িয়ে অমিতাভ মৈত্র পুরোপুরি আন্তর্জাতিক লেখালেখি করেছেন। লেখার জায়গায় ওঁর নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ের তুলনা হয় না। ‘টোটেম ভোজ’ নামক কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতার অহংকার হয়ে থাকবে। শুধু কি তাই? ‘সিআরপিসি ভাষ্য’? ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’? ‘পিয়ানোর সামনে বিকেল’? ‘মৃতরেখা’? উনি আজীবন একটাই কবিতাকে যেন হাজারভাবে লিখেছেন, আর সেই হাজার কবিতার প্রত্যেকটা সত্য হয়ে আছে ওঁর ইচ্ছাকৃত হ্যালুসিনেশনে। বিভ্রমকে যে এত বড়ো শক্তি বানিয়ে নেওয়া যায়, অমিতাভ মৈত্র ছাড়া আর কে পেরেছেন বিশ্বের কবিতায়? আর কিছু অদ্ভুত গদ্য, যেগুলো ওঁর কবিতারই বিকল্প রূপ, যা কেবল উনিই লিখতে পারতেন। হয়ত আর কারও কবিতা নিয়েই কথা বলার সময় দস্তয়েভস্কি বা বর্হেস বা কাহলিল জিব্রানের নাম এসে পড়ে না। উনি অনায়াসে পারতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান নিয়ে কথা বলতে বলতেই সালভাদর দালির ছবির প্রসঙ্গে চলে যেতে। সম্পূর্ণ অ-সম্পর্কিত দুটো ব্যাপারকে মিলিয়ে দিয়ে কী যে আনন্দ পেতেন উনি! ওঁর গদ্যের মধ্যে এই খেলাটা দারুণভাবে আছে। আর আছে কোনোকিছুকে তার নির্দিষ্ট পরিচয় থেকে ছিনিয়ে আনার ম্যাজিক। একটা পেপারওয়েটকেও উনি নিছক একটা কাগজচাপা হিসাবে দেখে স্বস্তি পেতেন না, যতক্ষণ না সেটাকে একটা উল্কার টুকরো বানিয়ে দিচ্ছেন নিজের ভাষা দিয়ে।

আর আছেন অনেক কবি যাঁরা বিভিন্ন সময়ে ওঁর কবিতায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের সম্পর্কে কথা বলার সময় ওঁর চোখে দেখেছি করুণার ঘোর। তাঁরা কেউ কেউ নারী। একজন পুরুষের কাব্যভাষায় নারীদের আচ্ছন্ন হতে আমি কদাচিৎ দেখেছি। অমিতাভ মৈত্র সেটা ঘটাতে পেরেছিলেন। তাঁর ভাষার মধ্যে এক দুর্নিবার সেক্স অ্যাপিল আছে, কিছুটা আজগুবি ও হাস্যকর হলেও এই উক্তি আমি করতে চাই। আর হ্যাঁ, খুবই অপ্রিয় ভঙ্গিতে বলতে চাই, অমিতাভদা ছিলেন বাংলা কবিতায় এক সংক্রামক ব্যাধি। হ্যাঁ, ব্যাধি। অনেক কবিই ওঁর কবিতার ভাষায় আক্রান্ত হয়েছেন। ধ্বংস হয়েছেন। বেরোতে পারেননি। ওই ভাষাও বাংলা কবিতায় এক দুর্ঘটনা। বাংলা কবিতার জল-আলো-বাতাসের সঙ্গে তার লেনদেন একজন বিদেশির। বাংলা কবিতার ইতিহাসে আর ভূগোলে অমিতাভ মৈত্রর হয়তো কোনো আত্মীয় নেই। কিন্তু থেকে গেছে একটা আক্রান্ত কবিদের মিছিল। সৌভাগ্যক্রমে, হয়তো ওঁর খুব কাছাকাছি যাওয়ার ফলেই, আমি ভ্যাকসিনেটেড হয়ে গিয়েছিলাম।

Facebook Comments

পছন্দের বই