লেখক নয় , লেখাই মূলধন

দেবাশিস সাহা

আন্তরিক, আন্তর্জাতিক অমিতাভদা ছিলেন আত্মার আত্মীয়

যখন অমিতাভ মৈত্র পড়লাম, জানলাম। তখন আমার গর্ব হল এবং আনন্দ হল। অমিতাভ মৈত্র একজন আন্তর্জাতিক মানের ও মাপের কবি ও গদ্যকার। আমি গর্বিত। এই কবির সঙ্গে এক শহরেই থাকি।

২০০২ সালে বহরমপুর আসার পর দু-চারটে সাহিত্য অনুষ্ঠানে আলাপ-পরিচয়। ঘনিষ্ঠতা শুরু কবি সুশীল ভৌমিক-এর বাড়িতে। সুশীলদা ও অমিতাভদার সম্পর্ক অনেক গাঢ় ও আন্তরিক ছিল। আমি দু-জনের কাছাকাছি থাকার সুবাদে টের পেয়েছিলাম। সেই কারণে দু-জনের কবিতার রহস্যময়তা ছিল যাপনের অংশ।

অমিতাভদা সরকারি আধিকারিক হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার ছোটো-বড়ো নানা শহরে চাকরি করেছেন। সেখানের কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক বলয়। অমিতাভদা ছিলেন ভীষণ আন্তরিক। অনুজ ও অগ্রজের বই কিনে সংগ্রহ করতেন,পড়তেন এবং মতামত দিতেন। আমার কবিতার বই, ‘দেখা শেখার ইস্কুল’ কিনে নিয়ে প্রতিটি কবিতার পাশে পেনসিল দিয়ে মন্তব্য, পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখে আমাকে উপহার দিলেন। আমি অবাক। চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে দেখছি এক ঋজু মেরুদণ্ড নিয়ে একজন ভালোবাসার মানুষ আমার কাঁধে হাতে দিয়ে এগিয়ে দিচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের সবুজ উঠোনের দিকে। বইটি খুলে দেখে আমি তাজ্জব। প্রতিটি পাতায় আমার কবিতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ যা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে।

২০১২। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেন। মাঝে মাঝে দেখা হত। দেখা হত কখনও প্রেসে, কখনও চায়ের দোকানে কখনও বা সাহিত্যের কোনো অনুষ্ঠানে। দেখা হলেই কথা হত, আডডা হত কবিতা নিয়ে। অমিতাভদা বলতেন, কবিতা লেখায় আত্মবিস্মৃত হতে হবে। নিজের অবস্থান, কাল-পাত্র সব দূরে সরিয়ে লিখতে হবে।

অমিতাভদার কবিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন মনে উঁকি দিত। জিজ্ঞেস করতাম। পিঠে একটা টোকা দিয়ে বলতেন, ও-সব ছাইপাঁশ লিখি, ওগুলো কি কবিতা হয়? তোমরা পড়ো?

নিজের কবিতায় অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, প্রশ্ন রেখে দিতেন। যেন নিজের দিকে আঙুল রেখে কোশ্চেনগুলো করতেন। হেনরি, ক্রিস্টোফার, ম্যাডাম এম নিজেরই অংশ। কবিতা যে অনুভূতির তা বারবার টের পেতাম। পাঠকের ভাবনার জন্য রেখে দিতেন এক সমুদ্র আকাশ। প্রচুর পরিমাণে আন্তর্জাতিক লেখকদের বইপত্র সংগ্রহ করতেন এবং পড়াশোনা করতেন। তার ফসল আমরা পেতাম অমিতাভদার গদ্য ও কবিতায়।

বই কেনা ও পড়া ছিল অমিতাভদার নেশা। আমাদের সম্পাদিত পত্রিকা ছাপাখানার গলির সঙ্গে অমিতাভদার সম্পর্ক ছিল একদম প্রথম থেকেই। স্টল থেকেই নিজে সংগ্রহ করতেন প্রতিটি সংখ্যা। মতামত দিয়ে আমাদের উৎসাহ দিতেন। ২০০৭ সালে ছাপাখানার গলির বিষয় ছিল, এই মুহূর্তে যে-বই পড়ছেন সেই বই নিয়েই লিখুন, স্বভাবতই অমিতাভদাকে বলতেই এককথায় রাজি।
সেই সময়ে উঠে আসছে এক ঝাঁক তরুণ কবি। তার মধ্যে অন্যতম অনুপম মুখোপাধ্যায়। অনুজদের লেখাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়তেন। সেই সংখ্যায় অনুপমের হাইওয়ে নিয়ে লিখলেন এক অসামান্য গদ্য। আমাদের কাগজ সমৃদ্ধ হল। পাঠক সমৃদ্ধ হল।

২০১৫ সালে নাটক সংখ্যায় অমিতাভদা আলোচনা করলেন, Samuel Beckett-এর Waiting for Godot. কী বলব! এক অসাধারণ আলোচনা পাতার পর পাতা জুড়ে। এই সমস্ত লেখা আরও পাঠকের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন।

পরের বছর কাব্যগ্রন্থ আলোচনা সংখ্যায় অমিতাভদা নিজেই নির্বাচন করলেন উল্লেখযোগ্য চারজন কবির চারটি কাব্যগ্রন্থ।
১. নির্বাচিত কবিতা প্রয়াস– অমিতাভ গুপ্ত
২. তাঁবু মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ– সুধীর দত্ত
৩. সম্মোহন পাঠের পিছনে– সমরেন্দ্র দাস
৪. নির্বাচিত কবিতা– নাসের হোসেন

নিজের সংগ্রহ থেকে নিজ উদ্যোগে বইগুলো আলোচনা করলেন। সেই আলোচনায় আমরা ঋদ্ধ হলাম।

Jose Saramago-র Cain উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করলেন আমাদের উপন্যাস আলোচনা সংখ্যায়। এই আলোচনা ভীষণ উচ্চমার্গের। আপামর পাঠকের জন্য অমিতাভ মৈত্র নয়। যে-পাঠক পড়াশোনা করে, অনুসন্ধিৎসু। তাঁদের জন্য অমিতাভদার আলোচনা যেন তৈরি হয়ে থাকে। এইসব আলোচনা সংকলিত হওয়া জরুরি। অমিতাভদা নিজে বই কিনে নিতেন অথচ দেখা হলেই নিজের প্রকাশিত বই লিখে দিতেন, ‘দেবাশিস আমার আত্মার অংশ।’

অমিতাভদা ছিলেন আমাদের আত্মার আত্মীয়। আজ আমরা আত্মীয়হীন, অভিভাবকহীন। এমন আন্তরিক, আন্তর্জাতিক মাপের, মানের মানুষ ও লেখককে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। অমিতাভদার সৃষ্টিকে সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। এই ব্রতে আমিও পাশে আছি।

Facebook Comments

পছন্দের বই