Categories
প্রবন্ধ

জয়ন্ত ঘোষালের প্রবন্ধ

‘এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে’

অন্তর আর বাহির। আশাকরি তাঁর নগ্নতার প্রেক্ষিতটা কেমনভাবে দেখা উচিত কিছুটা বোঝা গেল।

উওমেন স্টাডিস, সোসিওলজি এইসব ডিসিপ্লিনের পোকা মাথায় রেখে লাল দেদের বাক পড়তে গেলে খণ্ড দর্শন হবে। তিনি দল গড়েননি, ভক্তও দলও নন। তিনি মুখে মুখে বাক রচনা করেছেন কিন্তু প্রথাগত ঢং-এ কাব্য লেখেননি। কিন্তু মুখে মুখে যা বলেছেন সেইসব বাকের কাব্য সুষমা বজায় রাখতে একজন সচেতন কবির সৃষ্টির মতোই শব্দের নিপুণ প্রয়োগ করেছেন, ছন্দ বেঁধেছেন। তাঁর বাক গভীর দর্শন ও ভাবের সুতোয় গড়া তবু প্রথাগতভাবে তিনি কবি বলে পরিচিত নন তার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন কবীরও তো দোঁহা বলার কারণে নিছক কবি পরিচয়ে সুখ্যাত নন কিন্তু তাঁর দোঁহা কী কাব্য মাধুর্যহীন? হলে’তো কেবল একজন গুরুর মতাদর্শের দাসত্ব করার কারণেই অনেক আগেই লোকমানসের হৃদয় থেকে ঝরে যেত। লাল দেদ, কবি এবং একজন ইন্টেলেকচুয়ালের সব বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতায় শিশুকাল থেকে একটি নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিনের মধ্যে বড়ো হয়েছেন এবং সেই পরম্পরার টানে সাধিকা হয়েছেন, কিন্তু সেটা ছিল তার জীবনের অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু একজন একাধারে বড়ো কবি ও ইন্টেলেকচুয়াল তো কোনো ডিসিপ্লিনকে নিছক রিপ্রেজেন্ট করে ক্ষান্ত হতে পারেন না, সে-সব বিপ্লবী বা রিফর্মিস্টদের কাজ। এমন মন নিয়ে অনেকেই লাল দেদ, কবীর পড়েন, কিন্তু বিশ্বাসের কাব্যময়তাকে না বুঝে আবোলতাবোল বলেন, লেখেন।

“ইম পাড় লাল্লি ভা’নি তিম হৃদি আঁখ”

লাল্লা যা বলেছে—

“তোমার হৃদকমলে তা আখর চিহ্ন হয়ে আছে”

এরপরে যেটা বলার লাল দেদ গান লেখেনেনি এবং তিনি যে গান গাইতেন এমন কোনো তথ্য কোনো মান্য সংকলনে নেই। অনেক পরে মুখে মুখে চলে আসা তাঁর বাক কাশ্মীরের সুফিয়ানা কালাম-এ গীত হত, তার মানে এই নয় এগুলো গান অথবা লাল দেদ গান গাইতেন। জয়লাল কাউলের কথায়, “কখনো কখন গ্রীয়ারসন বাকগুলোকে, গান বলে উল্লেখ করেছেন। এটা বলা দরকার যে-কোনো পদ এবং সে-প্রেক্ষিতে, বা কোনো টেনে আনা গদ্যাংশও সুর লাগিয়ে গীত হতেই পারে, এবং তা গানে পর্যবসিত হয়, কিন্তু যে-অর্থে নানকের স্তব গুরুবাণী, বা মীরার ভজন বা অন্যান্য ভক্তিবাদী সাধক-কবিদের গান, সেই নিরিখে লাল দেদের বাক গান হিসেবে গীত হবে সেই উদ্দিষ্টের কারণে ‘গান’ নয়। বা বলা যেতে পারে প্রচলিত লোকগান (চকরি) বা কাশ্মীরি ভস্তন গানগুলো যেমন নিজেরাই শিল্পানুগ জিগিরেই গান হয়ে ওঠে, এই বাকগুলো নিজেরাই গান হয়ে ওঠে না। লাল দেদের বাকগুলো প্রধানত ভারী ভাবনার নিগূঢ়তায় আর গভীরতায়, কিন্তু সে-অর্থে সাংগীতিক গুণসম্পন্ন নয়। এগুলো গান হয়ে বিস্ফোট ঘটানোর চেয়ে আমাদের অন্তরের দিকে তাকাতে বলে, বলে চিন্তা করতে আর প্রতিবিম্বিত হতে। যদিও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাকগুলি প্রায়শই আমাদের আতুর অনুভবকে নাড়া দেয়।”

“আমি সাতবার হ্রদটিকে দেখেছি শূন্যে উধাও হয়ে যেতে”

কাশ্মীরি ভাষাকে গড়ে তোলার গড়ার কারিগর হিসেবে, এবং ভাষা ও সাহিত্যে এই দুই ক্ষেত্রে লাল দেদের যা ভূমিকা তার প্রেক্ষিতে আধুনিক কাশ্মীরির জননী হিসেবে লাল দেদকে দাবি করার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। কেবল মাত্র কালানুক্রমে নয়, বরং আধুনিক কাব্যের মেজাজ ও শৈলীর নিরিখে তিনি কাশ্মীরি ভাষার আধুনিক কবিদের মধ্যে প্রথমা। তাঁর কবিতা আধুনিক, কারণ তা জায়মান আজও। বস্তুত তিনি কাশ্মীরিদের, তাঁদের মাতৃভাষাকে এবং গণজন হিসেবে নিজেদের আত্মাকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছেন। লাল দেদের জীবনকালের পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে কাশ্মীরি ভাষা হয়তো সুলতানদের বা সামন্ত প্রভুদের কৃপা পায়নি, হয়তো এটি সরকারি ও উচ্চকোটির ভাষা, ফারসির, দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও একে দাবিয়ে রাখা যায়নি, কারণ, এর পিছনে ছিল গণজনের সমর্থন এবং লালা দেদের বাকের প্রভাবে, সাধারণ কাশ্মীরি লোকেরা, যারা এতদিন নিজেদের মাতৃভাষায় লেখা পদগুলোকে কেবল গুপ্তবিদ্যা মনে রাখার কারণে, অথবা সেইসব গুপ্তবিদ্যাকে ধরে রাখতে, স্মৃতিবৃদ্ধির ব্যবহারিক হিসেবে লিখত, তাদের গভীরতম ভাবনা আর অনুভবকে নিজেদের মাতৃভাষায় ব্যাক্ত করতে, ব্যবহার করতে শুরু করল। সে-কারণেই হিন্দু কী মুসলমান এমন একজনও কাশ্মীরি নেই যার জিভের ডগায় লালা দেদের কোনো-না-কোনো বাককে খুঁজে পাওয়া যাবে না, অথবা এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে না। লালা দেদের বাকেই প্রথমবার কথ্য ও লৌকিক কাশ্মীরি ভাষা ও বুলি, ধর্মীয় বা রাজকার্যের ধরাবাঁধা পথে নয়, ব্যবহৃত হয়েছিল আকাঙ্ক্ষা, অভিজ্ঞতা ভাবনা ও অনুভবকে ব্যক্ত করতে। জয়কাল কাউলের ভাষায়, “উচ্চকোটির সঙ্গে সাধারণের, বিশেষত সাধারণের নিজেদের মধ্যে, যোগাযোগের তিনি নতুন নতুন প্রণালী খুলে দিয়ে ছিলেন। তাঁর গুরুত্ব কেবলমাত্র ঐতিহাসিক নয়। অন্তর্নিহিত কারণ হল, তিনি কাশ্মীরি ভাষার আজও অবধি মান্য অগ্রগণ্য কবিদের একজন হিসেবে রয়ে গেছেন এবং কাশ্মীরি ভাষার এক কারীগর, যা একজন অসাধারণ মৌলিক কবিই পারেন, এমন একজন কবি যাঁর কবিত্ব, স্যার রিচার্ড টেম্পলের ভাষায় ‘বহ্নিমান, পোড়ায় এমন এক ভাবনার রক্তিম আগুন।” আর গ্রীয়ারসনের বিচক্ষণ পর্যবেক্ষণে, লাল দেদের বাক হল, “পূর্বে কেবল যা তত্ত্বে আবদ্ধ ছিল তেমন এক ধর্মের বাস্তবিক অনুশীলন করে দেখানো, প্রাণবন্ত ও চিত্রল ভাষার এক বিবরণে। ভারতবর্ষের অন্যতম অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রণালীর ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনার প্রামাণিকতাকে কায়া দিতে, যা অবশ্যই ভিত্তি গড়ে দেবে, এর অবদান অনন্য। এখানেই আধ্যাত্মিকতার দস্তাবেজ বা প্রমাণ হিসেবে এর স্বাতন্ত্র্য নিহিত, এবং আপনি যদি, একইসঙ্গে কবিতা ও আধ্যাত্মিকতার ব্যবহারিক মূল্যের প্রতি তীব্র অন্বেষী হন, তবে মৌলবী রুমির ভাষায়, নিহিত যা—

“এমন দৃষ্টি দিয়ে, যা বাকের শক্তিকে বৃদ্ধি করে
অনুপ্রাণিত বাক দিয়ে, যা দৃষ্টিকে আরও তীক্ষ্ণ করে।”

এবং এটা আমাদের হৃদয়ের গরাদহীন জানালাগুলো খুলে দেয় আত্মার “পরিরেখাহীন অপরিমেয় দৃশ্যমানতা”-র দিকে।

লাল দেদ কোথায় আলাদা, এটা বুঝতে তাঁর মানস-শিষ্য নুর-উদ-দিন ঋষি বা নুন্দ ঋষির সুরুখ বা বাকের (যা ঋষিনামা বা নুরনামা পুঁথি হিসেবে লিখিত হয় নুন্দ ঋষির মৃত্যুর প্রায় দু-শো বছর পরে, এবং সুফি সাধকদের ক্ষেত্রে এমনটা প্রায়শই হতে দেখা গেছে) সঙ্গে তুলনা করলে দেখব, বিষয়ের দিক থেকে তাঁর সুরুখ ছিল মুখ্যত নীতিমূলক এবং স্বরের দিক থেকে উপদেশমূলক যেখানে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনের অনিত্যতা নিয়ে বলেছেন, বলেছেন এর সুখময়তা নিয়ে এবং মানুষকে আত্মসংযম ও ভক্তি কীভাবে কর্ষণ করতে পারে সে-ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রাজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গি আর বলিষ্ঠ কথনে ঋদ্ধ করেছে ভাষাকে এবং প্রবাদতুল্য হয়ে উঠেছে। রহমান রাহির ভাষায়, “কিন্তু লাল দেদ হলেন আলাদা: এ হল আন্তরকিতার মোহর ছাপ আর রহস্যালোপদ্ধির প্রাবল্য আর কাব্যিক প্রকাশের সত্যতা, যা প্রকাশিত হয়েছে বাগধারার শক্তিতে, এবং ঘরোয়া কিন্তু বাহুল্যবর্জিত বাক্যালংকার আজও অতুলনীয় যা তাঁর বাককে মানুষের মনে ও কাশ্মীরি সাহিত্যে চিরায়ত করেছে… তাঁর বাকে পাই রহস্যময় সত্যের প্রতি এক স্বপ্রত্যয়নকারী প্রগাঢ় চেতনাকে, যা ঈশ্বর-উপলদ্ধিকারী সন্তের পরিচায়ক।” রহমান রাহি, আরও স্পষ্ট তুলনা টেনেছেন তার ভাষায়, “এমনকি শেখ নুর-উদ-দিন’এর বাক, যাকে সুরুখ বলে, ভাবের দিকে ভাসা ভাসা এবং বিষয়বস্তু লাল দেদের বাকের সঙ্গে মেলে, যদিও লালা দেদের বাকের সঙ্গে তুলনীয় নয়। লাল দেদের বাক যাপিত আলিঙ্গন, যেখানে শেখের সুরুখ গতায়ু ছাইয়ের স্ফুলিঙ্গ। উভয়ের প্রেক্ষাপট হয়তো প্রায় এক কিন্তু কাব্যিক ভাষা নির্মাণে, কিছু একটা প্রভাবিত করেছে যা বিরাট পার্থক্য গড়ে দিয়েছে এই দুই রহস্যবাদী কবির। শেখের সুরুখে যতটা নীতিমূলক ততটা জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলে না, তাঁর সুরুখ আমাদের মর্মে আঘাত করে হৃদয়ে আলোড়ন তোলে না। যে-উপমা ও রূপক তিনি ব্যবহার করেছেন তা বিশদকারী ও ব্যাখ্যামূলক কিন্তু যাপিত অভিজ্ঞতার প্রাঞ্জল প্রতীক হয়ে উঠতে পারেনি।” “এর বাইরেও, ছন্দোগত তফাত আছে, লাল দেদের বাকের তুলনায়, সুরুখগুলো অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত ও নির্ভুল, স্পষ্টত ফারসি বাহার (মাত্রিক)-এর ধাঁচায় নির্মিত। লাল দেদের বাকগুলো অনেকখানি নমনীয় ও শিথিল, এবং স্যার গ্রীয়ারসন তাঁর বাকে বাচনভঙ্গির (শ্বাসাঘাতের) ওপর জোর দেওয়াটাকে বুঝতে পেরেছেন, প্রতি প্যারা বা লাইনের ওপর চারবার শ্বাসাঘাত। যদিও লালা দেদের বাকের ক্ষেত্রে যা হয়ছে তা নুন্দ ঋষি বা অন্যদের ক্ষেত্রেও হয়েছে, অর্থাৎ, অনুগামীরা, চারণেরা, নকলনবীশিরা, নুন্দ ঋষির মৃত্যুর সময় থেকে দু-তিনশো বছর গত হবার পরেও যখন সুরুখগুলো নুরনামায় লিখিত হল, সেই একই দূষণ ঘটিয়েছিল। পরিচিত শব্দ দিয়ে মূল শব্দের বদল, এমনকী কখনো আরও ‘উত্তম’ কোনো শব্দ, যেমন, এমনটা একটা শব্দ যা ধর্মীয় গোঁড়ামির পক্ষে বেশি উপযুক্ত, এতে সুরুখটিকে ছন্দের দিক থেকে আরও নির্ভুল করে তোলে, যদিও তা পদটির অন্তর্গতভাবকে উন্নতভাবে প্রকাশ করতে দরকারি ছিল না।

“সুই মাস মে’ লাল্লি কভ পানুনুই বাক”

“আমি, লাল্লা, আমি নিজের বাকের সুরা পান করেছি।”

মানুষ পুরোনো কিছু রাখে না, লাল দেদ প্রাচীন কিন্তু পুরোনো হয়নি, যেমনটা পাহারের গুহার ছবি প্রাচীন কিন্তু পুরোনো হয়নি বলে দেখি, আর এটাই চলমান নতুনত্ব। লাল দেদের কবিতা মধ্যযুগের অন্যান্য ভক্তিবাদী কবিদের বচন বা কবিতা থেকে আলাদা, তিনি কৃষ্ণের বঁধুয়াদের, যেমন দক্ষিণ ভারতের সন্ত অন্ডাল এবং রাজপুতানার রাজকুমারী মীরার প্রেক্ষিতে ছিলেন এক সম্পূর্ণ বিপরীত গোত্রের। তিনি সম্ভবত, আমরা বলতে পারি, সমস্ত ‘স্ত্রী’ ঈশ্বর অন্বেষীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুরুষালী। ভক্তিবাদী কবিতার চেয়ে বরং লালা দেদের অবদান হল আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সংকলনে আর অন্তরদৃষ্টিতে। তিনি লোকজনকে অনায়াসে প্রাপ্ত কোনো ধর্ম দেননি, তিনি যাকে বলে, “অনতিশীল সন্ত-কবি” ছিলেন না। তিনি মধ্যযুগের প্রথম নন বরং প্রাচীন ভারতের সন্তদের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁর বাক অনেকখানি উপনিষদের মতো, ডঃ ভি রাঘবন যেমন বলেছেন, “‘মধ্যযুগের সন্ত-কবিদের’ ভক্তিবাদী গানের মতো নয়, বরং প্রবচনাত্বক এমনকী কখনো বিরল আধ্যাত্মিক পর্যবেক্ষণে অঙ্গীভূত রহস্যপূর্ণ।” লাল দেদের বাক যাপিত আলিঙ্গন, মধ্যযুগের অন্যান্য ভক্তিবাদী সন্তদের প্রেক্ষাপট হয়তো প্রায় এক কিন্তু লাল দেদের কাব্যিক ভাষা নির্মাণে, কিছু একটা প্রভাবিত করেছে যা বিরাট পার্থক্য গড়ে দিয়েছে অন্যান্যদের থেকে। লাল দেদের জীবনের কেন্দ্রীয় ঘটনা হল প্রতিভাস, তার সর্বোত্তম পাওয়া, কিন্তু তিনি সেখানেই থামেন না। তবুও তিনি যেন নিজের সঙ্গে তর্ক জোড়েন, এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে, কিছু একটা আছে, যা আমাদের জানতে হবে। জয়লাল কাউলের ভাষায়, “… তাঁর বাকের ছন্দ অনেক অবিন্যস্ত আর অন্তমিলের বিন্যাস অনেক বেশি অসম। এ-কারণে সম্ভবত অনুমানপূর্বক ঝুঁকি নিয়ে বলা যায় লাল দেদের বাক, এমনি মূলের গঠনেও, কাশ্মীরি ভাষার পুরোনো থেকে নবরূপে রূপান্তরে একটা গুরুত্বপূর্ণ আখর চিহ্ন… নিছক ভাবনা কী মতবাদ বা অভিজ্ঞতা কবিতা নয়। তারা তখনই কবিতা হয়ে ওঠে যখন কবির কল্পনার “শরীরি জোর” থাকে, সেটাই সে-সবকে মূর্ত করে, এবং “আকার দেয়”। এখানে কল্পনা ভিন্ন চেহারায় গভীর আধাত্মিকবোধের শব্দ ও রূপকে আর তাদের দীপ্তিতে একজনের অনুভূত সংবেদনশীলতা দিয়ে প্রকাশিত। এছাড়া অন্য আরেকটা ভাব আছে যা সত্যি। তাঁর বাকগুলো বারে বারে পড়লে, অন্তরে একটা শ্রদ্ধার ভাব উদ্ভুত হয় এবং শোধনের নীরব প্রক্রিয়ায় গহন আত্মোপলব্ধি জায়গা করে নেয়।” সে-কারণেই তাঁর প্রভাব এমন কালোত্তীর্ণ ও সুদূরপ্রসারী, যদিও তিনি কোনো কৌম, উপদল বা সম্প্রদায় গড়েননি, যেখানে তাঁর অগ্রপথিক, মহান শৈব দার্শনিক ও গুরুরা একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন। লাল দেদ এক পৃথক গোত্রের যাঁর কাছে জীবন তার অর্থ হারিয়েছে, আর মৃত্যু হারিয়েছে তার আতঙ্ক। লাল দেদের স্বয়ং এই ব্যাপারে প্রতক্ষ্য উপলব্ধি ছিল, ‘সহজ’, সবকিছুকে নিয়ে, এক সত্তার মধ্যে সার্বিক ঐক্যের একাত্মতা। “তসু না বো না ধ্যায়ে না ধ্যান…” এখানে না সে আছে, না আমি/না, ‘ভঙ্গি চিন্তার’,/না দরকার নেই ধ্যানের,/এমনকী সবকিছুর স্রষ্টাও ভুলে গেছেন।

লাল দেদ সাহিত্যে বা দর্শনে ইচ্ছাকৃত কোনো অবদান হিসেবে বাকগুলো রচনা করেননি, না তিনি গেয়েছিলেন এইসব বাক, না ভক্তিমূলক শ্লোক বা গান কীর্তনের জন্যে কিছু করেছিলেন, যেমনটা করেছিলেন পরবর্তীর সাধক-গায়কেরা। তিনি না ছিলেন ধর্মপ্রচারক বা সংস্কারক। তাঁর বাকগুলো ছিল প্রধানত তাঁর আত্মার প্রসারণ, তাঁর অন্তরের অভিজ্ঞতার এক প্রকাশ, বা কখনো, সেটা যদিও খুবই কম ঘটেছে, তা হল তাঁর চারপাশের বহির্জগতের ঘটমানতা। এ হল আন্তরকিতার মোহর ছাপ আর রহস্যোপলদ্ধির প্রাবল্য আর কাব্যিক প্রকাশের সত্যতা, যা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনন্যসাধারণ বাগধারার শক্তিতে। ঘরোয়া কিন্তু বাহুল্যবর্জিত, এক অতুলনীয় বিভা তাঁর বাককে মানুষের মনে ও কাশ্মীরি সাহিত্যে চিরায়ত করেছে। তিনি শিব ও শক্তিকে দূর থেকে অমৃত সারসের মতো মিলিত হতে দেখেন কিন্তু তিনি সেখানেই থামেন না। প্রকৃতি আর পুরুষ, নাম আর রূপের সদা পরিবর্তনের প্রকাশ আর স্ব-স্থায়ীত্বের নির্লিপ্ততার সাক্ষী হওয়া, সম্পূর্ণ দুটো অসম বাস্তবতা নয়, না অখণ্ড চিৎ নিষ্ক্রিয়। লাল দেদের ‘স্বয়ং’-এর ব্যাপারে প্রতক্ষ্য উপলব্ধি ছিল, ‘সহজ’। সবকিছুকে নিয়ে, এক সত্তার মধ্যে সার্বিক ঐক্যের একাত্মতা। তিনি বলেন—

“তারপর, আমি ভেতরের আলো বাইরে ঝাড়লাম।”

না, লাল দেদ বিতৃষ্ণা থেকে মানব শরীর অন্তর্নিহিত পাপী এবং দুষ্ট এমন কিছু বলেন এবং না তিনি কঠোর সংযম বা শরীরের রিপুদমনের পরামর্শও দেন, বরং বলেন—

“শীত থেকে বাঁচতে কাপড় চাপাও
খুদা নিবৃত্ত করতে খাবার খাও”

তিনি বলেন শরীর আধ্যাত্মিক বিকাশের এক যান, এটা একটা ধর্মাক্ষেত্র, ধর্মের জমিন।

“যখন বেঁচে, তখন তাঁকে দেখতে পাও না
তবে মরার পর তাঁকে দেখবে কেমনে”

অথবা

“এটাই ঈশ্বরের আবাস
আমি দেখেছি তাঁকে আমার নিজের গেহে”
‘এই যে শরীর’ তিনি বলেন, “এর আলো আর দ্যুতি আছে।”

প্রথম পাতা

Categories
প্রবন্ধ

জয়ন্ত ঘোষালের প্রবন্ধ

‘এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে’

“সামসারাস আয়াস তাপসি
বোধা-প্রকাশা লো বুম সহজ”

“এসেছি বসুন্ধরায় এক তপস্বিনী আমি,
‘আমি’-র পথে ‘বোধ’ আলো দেখিয়েছে আমাকে”

লাল দেদের সঙ্গে কিংবদন্তি আর আশ্চর্য গল্পের সহবাস জন্ম থেকেই। পণ্ডিত আনন্দ কাউল (১৮৬৮-১৯৪১), তাঁর জন্ম সম্পর্কিত এমন কিছু অদ্ভুত কিংবদন্তি সংগ্রহ করেছিলেন। যেমন, তাঁর পূর্বজন্মে লাল দেদের বিয়ে হয়েছিল পানদ্রেনথানের জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে, যেখানে তিনি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। সন্তান প্রসবের এগারোতম দিন, কহ্নেথুর অনুষ্ঠানে, তাঁদের পারিবারিক পূজারী সিদ্ধা শ্রীকান্তকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই শিশুটা আমার কে?’— ‘কেন?’, সিদ্ধা বলেন, ‘এ তো তোমার ছেলে’।— ‘না’, লাল দেদ বলেন, ‘আমি অতি সম্প্রতি মারা যাব আর মারহম গ্রামে এক বাচ্চা ঘোটকি হয়ে জন্ম নেব, এই এই চিহ্ন নিয়ে। যদি আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর জানতে উৎসুক হন, এক বছর পরে মারহম গ্রামে এসে দেখতে পারেন।’ শ্রীকান্ত সেই গ্রামে গিয়েছিলেন এবং সেখানে সেই চিহ্ন-সংবলিত বাচ্চা ঘোটকির সন্ধানও পান। তাকে প্রশ্ন করতেই, সেই বাচ্চা ঘোটকি তাঁকে বলল যে, সে এখুনি মারা যাবে। সে বলে, আরও ছয় মাস পর ভেজিব্রর গ্রামে কুকুরছানা হয়ে সে জন্ম নেবে আবার, আর তিনি সেখানে গিয়েই তখন তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেতে পারেন। অবিলম্বে, হঠাৎ করে, নিকটবর্তী ঝোপ থেকে একটি বাঘ তীব্র বেগে এসে বাচ্চা ঘোটকিটিকে খেয়ে ফেলে। শ্রীকান্তের উৎসুকতা অত্যন্ত প্রবুদ্ধ হয়ে পড়ায়, তিনি কেবল ভেজিব্রর গ্রামে নয় তাঁকে অনুধাবন করতে যেখানে চিহ্ন-সংবলিত কুকুরছানা দেখতে পাওয়া গেল সেখানে গেলেন আর সেখানে গিয়ে তিনি কুকুরছানাটিকে আবার কোন জন্মে অন্য কোথায় দেখা হবে, এই প্রশ্ন করতে লাগলেন, আর এটা চলল তাঁর ষষ্টজন্ম অবধি। তারপর, সপ্তমবার, লাল দেদের পুনর্জন্ম হল পানদ্রেনথানের সেই একই পরিবারে, যেখানে তিনি প্রসবের এগারোতম দিবসে মারা গিয়েছিলেন। যেখানে বারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হল পাম্পোরের দ্রাঙ্গাবালমহলে বসবাসকারী নিচাভাট নামের ব্রাহ্মণ পরিবারের এক যুবকের সঙ্গে। যে-পাম্পোর হল রাজা অজতপুরার মন্ত্রী পদ্মর (৮১২-৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ) স্থাপন করা প্রাচীন পদমপুর। এটা তখন, যখন তাঁর বাপের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে, বধূবেশী লাল্লা শ্রীকান্তকে ফিসফিসিয়ে বলেন: ‘ছেলেটি আমার কোনো এক পূর্বজন্মে আমার কোলে জন্ম নিয়েছিল, আপনি জানেন সেই আজ এখানে আমার বর।’ শ্রীকান্তের সব মনে পড়ে যায় আর বিস্মিত হয়ে পড়েন।

সন্তবৃত্তের কিংবদন্তিগুলোর সূত্রের খোঁজ পাওয়া অথবা তাদের গুরুত্ব, যদি কিছু থাকে, অনুধাবন করা সবসময় সহজ হয়ে ওঠে না। মৃত্যুর পরে আত্মার দেহান্তরপ্রাপ্তি এবং পুনর্জন্মে লাল দেদ বিশ্বাস করতেন। তাঁর বাকেও নিজের পূর্বজীবনের ঘটনাবলির উল্লেখের নজির আছে। এই নিত্য সময়কালের ধারায় তিনি স্মরণ করেন, তিনি জগতের এবং অন্যান্য সব বিদ্যমান বস্তুর লয় প্রত্যক্ষ করেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের পুনর্গঠনও। আরও অনেক কিংবদন্তি আছে লাল দেদকে নিয়ে, যেমন, শ্রীকান্ত ‘চান্দ্রায়ণ’ নিয়েছিলেন, এ হল চল্লিশ দিনের উপবাস আর রিপু দমনের উগ্র প্রায়শ্চিত্ত। একদিন সকালে লাল্লা তাঁর বাড়ি আসেন এবং জিজ্ঞেস করেন কোথায় ছিলেন তিনি। তিনি ধ্যানে মগ্ন ছিলেন এ-কথা জানার পর, লাল্লা মৃদু বিদ্রূপের সঙ্গে বলেন, ‘হ্যাঁ, দেখছিলাম তার ঘোড়াটা লাথাচ্ছে নন্দমার্গের তৃণভূমিতে।’ সামান্য ভিন্ন আরেকটি মন্তব্য পাওয়া যায়, ‘হ্যাঁ, নন্দমার্গে তার ঘোড়াটাকে নুন খাওয়াচ্ছিল।’ শ্রীকান্ত তার মন্তব্য শুনে অপমানিত বোধ করলেন, কারণ, তাঁর মন সত্যিই উদ্বিগ্ন ছিল এই ভেবে যে, গ্রীষ্মকালে তৃণভূমিতে তাঁর ঘোড়াটাকে অন্য একটা ঘোড়া লাথি মারছে। তারপর লাল দেদ সিদ্ধাকে প্রায়শ্চিত্ত প্রকৃত কেমন হওয়া উচিত তার নমুনা করে দেখান, তিনি মাথার উপর একটা মাটির হাঁড়ি রাখেন আর অন্য একটা হাঁড়ি পায়ের উপর এবং ক্ষীয়মান চাঁদের মতো, তাঁর শরীর ক্ষীয়মান হতে থাকে, পনেরো দিনের দিন ঘোর অমাবস্যায় তাঁর শরীরের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না এক ফোঁটা কম্পমান পারদ ছাড়া, তারপর শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় তাঁর শরীর আবার পূর্ণতা পায় ধীরে ধীরে পূর্ণিমার দিনে। আশ্চর্য হয়ে গুরু জিজ্ঞাসা করেন, ‘হাঁড়ির মধ্যে সর্বদা পারদের মতো তরলটা কী ছিল?’ ‘এটা ছিলাম আমি,’ লাল দেদ উত্তর দেন। অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা মন ও অহম, শরীরের সব উপাঙ্গ কর্তিত করেও আমি কাঁপছিলাম এই ভেবে যে, আমি হয়তো গৃহীত হব না, নিছক আত্মরিপু দমনে কোনো মুক্তি নেই। শেষমেশ ঈশ্বরের কৃপায় তা মেলে। গুরু বুঝতে পারেন শিষ্যা গুরুকে পিছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মুসলিম আখ্যানকার, পীর গুলাম হাসানও এই কাহিনির অন্য এক চেহারা দিয়েছেন। বলা হয় লাল দেদ শুদ্ধাচারি শব্দ আবৃত্তির প্রথাগত ভঙ্গির বদলে রহস্যময় আচার, নফি-ও-ইসবত, (অর্থাৎ, না বা ‘লা ইলাহ’, ও হ্যাঁ বা ‘ইল্ল-লাল-লাহ’), করে তাঁর প্রায়শ্চিত্তের নমুনা এক মুসলিমের কাছে পেশ করেছিলেন।

লাল দেদ ধার্য আচার আর অনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনিয়তা এমনকী বিগ্রহ ও ছবি পুজোকেও ছাপিয়ে গেছিলেন। বস্তুত, মূর্তি পুজো, বলি, তীর্থযাত্রী হয়ে দেবতার থান ও পবিত্র স্থানে যাওয়া, নিছক শাস্ত্র আওড়ানো, উপবাস, বা নির্দিষ্ট আচার, এ-সব বাহ্যিক ক্রিয়া করেই যারা তৃপ্ত হতেন তাদের ভর্ৎসনাও করতেন। আসলে অসার ক্রিয়াকর্মকে গুরুত্ব না দেওয়াটা একজন শৈব যোগিনীর কাছে না ছিল কিছু অধর্ম, না ছিল অস্বাভাবিক। ত্রিক পন্থার গুরু বা আগমরাও এমনটাই বলছেন। যোগী তাঁর প্রাত্যহিক অর্চনা, মন্ত্রোচ্চারণ ও জল ব্যতিরেকেই করেন, তাঁর হোমও জপমালা ছাড়াই, তাঁর ধ্যান এমনি আচারহীন সম্পাদন, ফুল ও আনুষাঙ্গিক জিনিসের পুজো ব্যতিরেকেই তাঁর যজ্ঞ। ত্রিক মতে, মালা জপা কী ঠাকুরের নামোচ্চারণ এবং পুজোর নিমিত্তে শ্লোক আওড়ানো এ-সব নিম্ন স্তরের অর্চনা, আবার হোমে ও পুজোয় নৈবেদ্য চড়ানো আরও নিম্নের থেকেও নিম্ন স্তরের অর্চনা। নিম্ন মেধার লোকের কাছে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান বিগ্রহে অথবা প্রতীক চিহ্নে আর একইরকম নিরর্থক উপবাসের তুচ্ছ মান ও মূল্য। ঈশ্বরকে সাধনা করতে হবে সেই একজনের মতো ভেবে যার হাত পা পেট বা কোনো অঙ্গই নেই, কেবল সচ্চিদানন্দ ও প্রকাশ।

ধর্মের আনুষ্ঠানিক ভক্তির এই অন্তঃসারশূন্যতাকে লাল দেদ তাঁর বাকে এভাবে দেখান—

“হে মূর্খ, প্রকৃত কাজ নিহিত থাকে না
উপবাস বা কী অন্য অনুষ্ঠানিক আচারে
অথবা
মূর্তি নিছক পাথর
মন্দিরও পাথর বৈ কিছু না
মাথা থেকে পা অবধি পাথর।”

একদিন লাল দেদ বড়ো মাটির শঙ্কু আকৃতি (তাগারা) ঘড়ার মধ্যে বসেছিলেন আর মাথায় চাপিয়ে ছিলেন অনুরূপ আরেকটি ঘড়া, আর নিজে ছিলেন এই দুই-এর মধ্যে লুক্কিয়ায়িত। যারাই তাঁকে এমনটা করতে দেখেছিলেন হতভম্ব হয়েছিলেন এবং এর কিছুক্ষণ পরে ওপরের ঘড়াটা সরানো হলে তাঁরা দেখেন সেখানে আর কিচ্ছু নেই আর এই কিবংদন্তি অনুয়ায়ী এইভাবেই তাঁর মহাপ্রস্থান হয়।

লাল দেদ চলে গেলেন, কোনো প্রথাগত পরম্পরা না রেখেই। তাঁর দেহটি যেখানে পোড়ানো বা কবর দেওয়া হয়েছিল সেখানে কোনো সমাধি বা মন্দির অথবা মকবরা কিছুই গড়ে তোলা হয়নি। স্মৃতিচিহ্ন বলতে একটা তরাগ বা জলাশয়, এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা লাল্লা তরাগ বলে পরিচিত ছিল, যেখানে অমরনাথ যাওয়ার পথে পুণ্যার্থীরা ডুবকি দিত।

“মারায়াম না কুনহ তা মারা না কাঁসি
মারা নেচ তা লাসা নেচ”

“আমার কাছে জীবন মৃত্যু সমান
আনন্দে বাঁচা আর আনন্দে মরা
আমি কারোর জন্যে শোকাহত নই,
না শোকাহত কেহ আমার জন্যে।”

আমার গুরু এক নিদান দিয়েছেন কর্মবিধির—

“চোখ না ফিরিয়ে চেয়ে থেকো অন্তরের দিকে,
সেঁটে রেখো অন্তরাত্মায় অটল।”

আমি, লাল্লা, হৃদয়ে নিয়েছি নিদানখানি, নগ্ন তাই জগৎময় আমি নৃত্য করেছি শুরু—

আমাদের পক্ষে লাল দেদের জীবন ও তাঁর বাকের সম্বন্ধে নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন। তাঁর জীবনকাহিনি রহস্যে আর কিবদংন্তির চাদরে ঢাকা, যাদিও আজও নানা কাশ্মীরি প্রবাদে ও লৌকিক বুলিতে এমন কিছু বাক্য পাওয়া যায় যা লাল দেদের জীবন সম্পর্কিত কোনো-না-কোনো কিবদংন্তির সঙ্গে জুড়ে আছে। তাঁর মুখে মুখে বলা বাক বলে যা পরিচিত সে-সবের প্রামাণিকতা নিয়েও নানা দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে।

লালা দেদ, না কিছু লিখে রেখে গেছিলেন, না কেউ স্বকর্ণে শুনে সে-সবের প্রতিলিপি করে রেখেছিলেন। তাঁর সমকালে তো দূর, যে-প্রাচীন কাশ্মীরিতে লাল দেদ বলেছিলেন, তা কখনো কেউ লিখে রেখেছিলেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। যে-কাশ্মীরি ভাষায় লাল দেদের বাকগুলো প্রাপ্ত হয়েছিল তা আধুনিক কাশ্মীরি এবং কালের প্রভাবে, নিরক্ষর চারণ কবিদের বদলে যাওয়া ধর্মীয় আনুগত্যের চাপে, ফারসি শব্দের ভেজালে, হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের পূর্বতন যোগ ও ত্রিক পন্থায় ব্যবহৃত নানা শব্দ ও আচার বিস্মৃত হওয়ায় মূলের শব্দ ও বাক্য অর্থ হারিয়ে ফেলায় প্রাপ্ত বাকগুলো বহু ক্ষেত্রেই মূলের থেকে সরে এসেছিল এবং তাপ্পি বা গোঁজ শব্দ জায়গা করে নিল অনেকখানি, ফলত লাল দেদের বাকের প্রামাণিকতার দ্বন্দ্ব জারিই থাকল, এবং নুন্দ ঋষির ‘নুরনামা’ কী রূপ ভবানীর ‘রহস্যাপদেশা’-য় অন্তর্ভুক্ত অনেক বাকই লালা দেদের বাক বলেও প্রচারিত ও পরিচিত, এমনকী এর উলটোটাও ঘটেছে।

যদিও লালা দেদের পক্ষে কিছু লেখা বা লিখিত কোনো পাণ্ডুলিপি রেখে যাওয়া কোনো অসম্ভব কিছু ছিল না। তিনি লিখতে চাননি, হয়তো এটাই একমাত্র কারণ। উদাহরণস্বরূপ লাল দেদের প্রায় সমকালের শিথিকান্তার মহান্যায়াপক্ষার পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি যেমন পাওয়া গেছে। লালা দেদ না প্রকাশের জন্য কিছু লিখেছেন, না করেছেন বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অবদান রাখার মতো কিছু। বস্তুত, তিনি বাকগুলো শুধু আওড়াতেন এবং সে-সময়ের প্রথানুযায়ী, মুখে মুখে ছড়িয়েছে। এ-সবই আমাদের অনুমান। কেউ, হয়তো লিপিবদ্ধ করেছিলেন সে-সব বাকগুলো ছাড়াও আরও কিছু, অন্য কয়েকটি, যা তিনি হয়তো ঘটনাচক্রে নিজে অথবা অন্যের থেকে শুনেছিলেন। এবং এভাবেই চলেছে যতদিন না এ-সব কথকতার অঙ্গীভূত হয়ে গ্রাম্য ভ্রামণিক চারণদের গানে, এবং পরবর্তীতে আজও কাশ্মীরি ধ্রুপদি সংগীত, সুফিয়ানা কালামে মজলিস-এ-মা’রিফিম, বা সুফি বা আধ্যাত্মিক অন্বেষীদের জমায়েতের শুরুতে পবিত্র আবাহন হিসেবে গীত হতে শুরু করল। এত দুষণ সত্ত্বেও লাল দেদের বাক বেঁচে রয়েছে এবং এর মধ্যেও অন্তত প্রায় শ-দেড়েকের বেশি বাককে লালা দেদের বাক বলে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু কেউ কেউ বলতেই পারেন সেটারই বা কী প্রামাণিকতা?

আমাদের লালা দেদের বাকের অন্তর্গত নিজস্ব প্রমাণাদির কাছে ফিরে আসতে হবে, এর যা কিছু প্রমাণকারী বলো, নিহিত আছে এর ভাষ্যে ও শৈলীতে। তথাপী এরও অনেকানেক সীমাবধ্যতা আছে। রাজরাজাদের উত্থান পতনের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত গ্রাম্য নারী লাল্লার বাকে সমসাময়িক ঘটনাবলীর কোনো ইশারা বা প্রাসঙ্গিক উল্লেখ নেই অথবা না আছে কোনো ঘটনার কোনো সুনির্দিষ্ট দিনাঙ্ক। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ধারণের, জন্য আমাদের কাছে পড়ে রয়েছে শুধু লাল দেদের কিছু রচনাশৈলীর প্রমাণ আর ছন্দ এবং চিন্তার বিন্যাস ও গুনাগুণ, যেভাবে এগুলো কোনো একটা ভাব প্রকাশে সংগঠিত হয়েছিল, এক কথায়, লাল দেদের শৈলীর বিশিষ্টতা। এগুলো আর অন্য কিছু নয়, তাঁর বাক থেকে, অন্যের দ্বারা রচিত বা ভ্রমবশত তাঁর নামে প্রচারিত বা লাল দেদের শৈলীর বৈশিষ্ট্য বহন করে না এমন রচনাগুলো থেকে তফাত করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, কোনো একটি বাক যে সামগ্রিক ছাপ রেখেছে তার বৈশিষ্ট্যগুলোর সামগ্রিকতার বিচারে। যে-কাশ্মীরি সাহিত্যই আমাদের সমকালে পাই না কেন, তার সঙ্গে লাল্লার বাকের পূর্বের ও পরবর্তীর ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক তুলনা করতে গেলে যেটা দরকার তা হল, তাঁর যুগের পূর্বের ও পরের কাশ্মীরি সাহিত্যের নানাবিধ গ্রন্থ পাঠের সক্ষম জ্ঞান, এছাড়া, প্রাচীন কাশ্মীরি ভাষা থেকে ছিঁড়ে আনা টুকরোগুলো যা ত্রিক দর্শনের বিবিধ পুঁথিগুলোর প্রশ্নাবলীগুলোর মধ্যে নিহিত। সন্দেহাতীতভাবে, লাল্লার বাক রচিত হয়েছিল, যাকে সঠিকভাবে বলতে পারি প্রাচীন কাশ্মীরিতে, কিন্তু এগুলো আমাদের কাছে এসেছে যে-ভাষায় তা আশ্চর্যজনকভাবে আধুনিক। এগুলো মুখে মুখে ছড়িয়েছে এবং বদল ঘটেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভাষার বদল ঘটেছে যেমন সেই মোতাবিক। তবু লালা দেদের বাক সমন্ধে স্যার গ্রীয়ারসনের অনুধাবন করেছেন, “লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা এবং গানগুলোর ছন্দময়তা অটুট রেখেছিল বহুসংখ্যক সেকেলে প্রকাশভঙ্গিগুলো। এবং আমি এখানে যুক্ত করতে পারি, এই সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছিল কারণ কিছু পুরুষ ও নারী গুরুশিষ্য পরম্পরার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, সেই সরাসরি সূত্র, অর্থাৎ, গুরু ও শিষ্যের পরম্পরা, বাকগুলোকে স্মৃতিতে সংরক্ষিত করেছিল, তাঁদের প্রাত্যহিক প্রত্যুষের প্রার্থনার অঙ্গ হয়ে, তাদের নিজ-পাঠের। স্পষ্টত, এঁরা, তাঁরা, যাঁরা এগুলোকে সংরক্ষণ করেছিলেন, ধার্মিক যত্নে ও যথার্থতায়, এমনি অনেক শব্দ ও বাক্যবন্ধের অর্থ না বুঝেও, “এবং তাদের সেই শততা ছিল, বিরত ছিলেন, বাকগুলোকে বোধগম্য করার জন্য কোনো অনুমানমূলক সংশোধন থেকে।” এ-কারণেই স্যার গ্রীয়ারসন বলেন, “এই ধরনের সরংক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে লিখিত পাণ্ডুলিপির চেয়েও বেশি মূল্যবান।”

লাল দেদ নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই উলঙ্গ হয়ে ঘুরতেন এমন একটা প্রসঙ্গকে সামনে রেখে আলোচনা করাটা একটা খারাপ সংস্কার। শুনেছি উলঙ্গিনীর গান বলে একটি গানের সিডিও বেরিয়েছে। এভাবে লাল দেদকে দাগানো অনুচিত বলে মনে করি, কেন-না লাল দেদের বাকগুলোর কাব্যগুণ বিচার করতে গেলে, প্রাচীন ভারতীয় কবিতার ছন্দকে চিনতে হবে, বুঝতে হবে যিনি বলেছেন, তাঁর মেধা ও মননকে, জানতে হবে তাঁর সময়কালীন ইতিহাস ও বাকগুলির সঙ্গে অদ্বৈতবাদী ত্রিকপন্থা শৈবসাধনার ‘প্রতি-অভি-জ্ঞান’-এর ধারণার সম্পর্ককে, যে-ধারা পুষ্ট হয়েছিল কাশ্মীরি শৈব তন্ত্রের বিখ্যাত দার্শনিক অভিনবগুপ্তের দ্বারা। আবার বুঝতে হবে, লাল দেদের বাকের কাব্য মাধুর্য ও গভীর দার্শনিক বোধ কেমন করে সুফি সিলসিলা ‘ঋষি পন্থা’-র বিশিষ্ট সাধক নুর-উদ-দিন ঋষি ও সামগ্রিকভাবে ঋষি সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছিল। সে-সব বুঝেই এগোতে হবে। সেখানে তাঁর পোশাক নিয়ে কাব্য আলোচনা শুরু হলে একধরনের শহুরে সাবঅর্ল্টান-স্টাডিসের চেহারা নেয়, ফলত সাহিত্য আলোচনা যে-পথে হওয়া দরকার সে-পথ হারিয়ে যায়। ভারতের শৈব সাধনার নানা ধারা সমন্ধে যাঁরা কিছুমাত্র খবর রাখেন তাঁরা জানেন লাল দেদ বা আক্কা মহাদেবীরা নগ্ন ছিলেন বা নগ্ন হয়ে ঘুরতেন এটা একটা তথ্য মাত্র না হলেও, সেইসব কাব্যধারার রসাস্বাদনের জন্য মূল বিচার্য বিষয় নয়। একটি ইংরাজি সংকলনও আছে ন্যাকেড সেইন্ট, এরকম নামে। এতে একটা ওপর ওপর দেখানো সহানুভূতি তৈরি করার চেষ্টা চলে, যে-সবের ধার ধারতেন না লাল দেদ। কিংবদন্তিগুলোর নির্যাস নিয়ে বাকগুলো পড়তে হবে কোন পূর্বনির্ধারিত কোনো মতবাদের তোয়াক্কা না করেই। প্রথাগত ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করেছে শৈব পন্থাগুলো, দার্শনিক বিতণ্ডা করেছে, খারিজ হয়েছে সমকালের ব্রাহ্মণ্যবাদী ইতিবৃত্তে বা সন্তবৃত্তে। আনন্দ কাউলের অনুবাদ ও টীকা থেকে দেখতে পাই তিনি সুলতানদের ক্ষমতার বলে ইসলামীকরণের নিমিত্তে নতুন ধর্মান্তরিতদের দিয়ে চরবৃত্তি করানোকেও কটাক্ষ করেছেন। দুই ধর্মের প্রথাগত মেইন্সট্রিম তাই তাঁকে শতকে পর শতক নাকচ করেছে। লাল দেদের সেই নগ্নতা, নিয়ে মানী গবেষক জয়লাল কাউল কি লিখেছেন দেখি— “একটা কিংবদন্তি গড়ে ওঠে, এবং নাছোড় হয়ে থাকে যে, তিনি ঘুরে বেড়ান নগ্ন হয়ে, নৃত্য করে, গান গেয়ে পরমানন্দ ক্ষিপ্ততায়, যেমন করতেন পুরাণের হিব্রু নবি আর তুলনামূলকভাবে এখনকার দরবেশরা, যে তিনি ঘুরে বেড়াতেন প্রায় নগ্ন হয়ে। সেটা সত্য হতেই পারে কিন্তু তিনি যে দরবেশদের মতন ঘূর্ণনাচ নেচে বেড়াতেন, এটা এমন এক প্রতিবেদন যে, কাশ্মীরি শব্দ নৎসুনের সঙ্গে যায় না। শব্দটা বোঝায়, কোনো কোনো প্রসঙ্গে নৃত্য করা, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার হয় উদ্দেশ্যবিহীনভাবে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে ঘুরে বেড়ানো বোঝাতে; বাকের প্রেক্ষিতে পরের অর্থটাই বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাঁর কাছে বেশি মূল্যবান ছিল যে, তাঁর অন্তরাত্মার জন্য তিনি আর নিজের বহিরাবরণের দিকে ফিরে তাকাবেন না। সেই জন্যই তাঁর কিছুই মনে হবে না, যদি তিনি নগ্ন হয়েই চলে যান যেদিকে খেয়াল তাঁকে নিয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে কী-ই-বা আছে নৃত্য করার? যার জন্য তিনি অন্তরের দিকে চেয়ে থাকবেন? এটা ঠিক প্রত্যয়জনিতও নয়। পরে সত্যিই একটা সময় আসে যখন তাঁর নৃত্যের সেই প্রেক্ষিত তৈরি হয়ে যায়। “পরমানন্দে ঈশ্বরের সঙ্গে বিত্তবিনিময়ের”: মে’ সে’ তা পানাস দ্যুতুম শোহ। কিন্তু তখনও সেটা আসেনি, সে-সময় আসেনি। তখনও অবধি তাঁর গুরুর বাণী, আত্মজ্ঞান অর্জন করতে পার্থিব এই জগৎকে হারিয়ে ফেলতে হবে, যা ছিল তাঁর কাছে এক বেদনাদায়ক ‘সব হারানোর ফোসকা (রাভান তভ’ল)”। গ্রিয়ারসন যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন তেমন ভাবাটা ভাষার ওপরে জুলুমই হবে অতিশয়। উপরন্তু, এই শ্লোকের কল্যাণেই এর পর থেকে পাম্পোরের পদ্মাবতী লাল দেদ (লাল ঠাকুরমা) বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন তাঁর পেটের নীচ দিকের থলথলে ভাবের জন্য, যা ঢিলে হয়ে তাঁর তলপেটের নিম্নাংশের ওপরে ঝুলে থাকত। তাঁর নামের বিষয়ে এই তথ্য মেনে নেওয়া যদিও খুব কঠিন। বা, সাম্প্রতিক কিছু লেখকের যেমন অনুমান, লাল্লা লীলা বা লোল শব্দদ্বয়ের অপভ্রংশ। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পক্ষে এমন ভাবনা অন্যায্য। লাল্লা, মনে হয়, প্রাচীনকালে ব্যবহৃত একটা নাম। আর, খুব সম্ভবত এটা ছিল তাঁর কুমারী নাম। তিনি এই নাম ব্যবহার করতেন তাঁর নিজের সম্বন্ধে বলার সময়, এই নামটা তিনি ব্যবহার করেছেন নিজেকে উল্লেখ করার সময়। যেমন, যখন তাঁর বন্ধুদের তিনি বলেছেন, “লালি নালাবথ সালি না যানহ”, যেখানে নিজেকে বললেন, লালি, (লাল্লাকে), সে-সময় লক্ষ করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন, একজন গৃহবধূ, ‘পরিব্রাজক তপস্বিনী’ নন। তাছাড়াও, নিজের বাকে নিজেকে যখন উল্লেখ করেছেন, তিনি এই একই নাম, লাল (বা লালি, লা’লি, যেটা কাশ্মীরি ব্যাকরণে অন্য আরেক রূপ) ব্যবহার করেছেন, আর এই নাম তাঁর ১৮৪টি বাকে অন্ততঃপক্ষে ২১বার উচ্চারিত হয়েছে, ১০৯টি গ্রিয়ারসনের, ৭৫টি আনন্দ কাউলের। শব্দচর্চায় এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মূল কাশ্মীরি ভাষায় লাল বা লাল্লা-র উচ্চারণ প্রায় অভিন্ন।”

শেষ পাতা

Categories
প্রবন্ধ

অলক রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আশ্চর্য সমন্বয় মাইহার ব্যান্ড

ভারতীয় সংগীতের প্রতিটি অলিগলি আলাউদ্দিনের শ্রুতিতে উজ্জ্বল তো ছিলই। তার সঙ্গে তিনি মিশিয়ে ছিলেন বাংলার লোকায়ত মেজাজকে। বাংলার মাঠ ঘাট এমনকী ফুটপাথেও তো তাঁর কেটেছে বহু বিনিদ্র রাত। এছাড়াও ছিল প্রত্যক্ষভাবে ব্যান্ডে বাজানোর অভিজ্ঞতা। দেশি ও বিদেশি যন্ত্রে। হাবু দত্তর থিয়েটারে বিভিন্ন দেশি যন্ত্রের বাজানোর অভ্যাস, ফোর্ট উলিয়ামের এক সাহেবের কাছে বেহালায় নিখুঁত পশ্চিমী হার্মনির শিক্ষা, উজির খাঁর থিয়েটার দলে পার্শ্বসংগীত সংযোজনার দায়িত্ব— এ-সবই চলছিল শাস্ত্রীয় গানবাজনা অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গেই। সে-অভিজ্ঞতা মাইহার ব্যান্ডে আশীর্বাদ হয়ে গেল। সারাজীবন ঘুরেছেনও প্রচুর। দেশের বাইরে অনেক জায়গায়। ভলগা নদীর পাড়ে বসে বেঁধেছিলেন ‘ভলগা ধুন’। সুরের সেই নিরীক্ষা অসামান্য। পাশাপাশি ‘কাফি ধুন’ (ওয়েস্টার্ন)— শুনতে কিছুটা সোনার পাথরবাটি মনে হলেও জ্যাজ-এর রিদম আর কাফির আরোহণ-অবরোহণের কাটাকাটি সুরানুলেপন— এতেই চমৎকার বৃন্দাবাদন। আসলে পাশ্চাত্য হার্মনিকে অত্মস্থ করতে আলাউদ্দিনের সময় লাগেনি বেশি। ‘দেশ’ রাগটিকে দুইভাবে ভাবলেন আলাউদ্দিন। প্রথমে ছয় মাত্রার সাধারণ দাদরায় কোমল বা শান্ত ছবি। এবং সেই অনুযায়ী সম্মিলিত বৃন্দবাদনে খানিক নমিত স্বরানুশীলন। তারপরে তার চেহারা অন্য। একই সরগমে ঝোড়ো ‘দেশ’। এ-হেন অভিজ্ঞতা অনেকের কাছেই আনকোরা। নিরীহ সব দেশি যন্ত্রে আমাদের অভ্যস্ত শ্রবণ একক যন্ত্রসংগীত শুনতেই শিখেছে কেবল। ব্যান্ড বা অর্কেস্ট্রা বলতে সাধারণভাবে এখন বোঝায় বিপুল গ্র্যাঞ্জারকে। রিলায়েন্স কাপ বা সাফ গেমসে কত যন্ত্রীর সহযোগিতায়, সর্বাধুনিক স্টুডিওতে কত লক্ষ টাকার বিনিময়ে কী মহৎ সৃষ্টি সম্ভব হল, সে নিয়ে কাগজে স্কুপ রিপোর্টিং-এর ছড়াছড়ি। তাদের পাশে মাইহার ব্যান্ডের জায়গা না হওয়ারই কথা।

একদিক থেকে তা বোধহয় ভালোই হল। বাংলার কীর্তনের অমন বিশ্বাসযোগ্য সমবেত রূপ এমন সান্তুর, অনুভূতিকে উসকে দেওয়া প্রসন্নতায় শোনাতে পারতেন কি তাহলে মাইহার ব্যান্ডের সদস্যরা? অ-প্রচারেই ওঁদের গৌরব। ‘সখি বহে গেল বেলা’-র আকর সংগীত বাংলা পুরাতনীর ‘উঠিতে যুবতী বসিতে যুবতী’। তাকে বন্দিশ করেই এই কম্পোজিশন। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত যে-নলতরঙ্গ বিপুল বিক্রমে ঝড়ের গতিতে দেখিয়েছে তার সাধ্যের নমুনা, এই মধ্যলয়ের দাদরা কম্পোজিশনে তার ভূমিকা তখন কেবলমাত্র মন্দিরায়। আশ্চর্য মমতায় কতিপয় মধ্যপ্রদেশীয় যুবক কীর্তনের মূল মেজাজের উজ্জ্বল উদ্ধারে নেমে পড়েছে যেন। চেলোর গাম্ভীর্যের পাশাপাশি সেতার, সরোদ আর বেহালার ক্ষীণ সুর (ইচ্ছে করেই আঙুলে তার চেপে ধরে স্বরকে অর্ধস্ফুট করছিলেন ওরা), প্রায় থেমে আসা তবলার শীতল সৌন্দর্য সুরস্রষ্টার ভাবনা আর শিল্পীদের অধ্যাবসায়ের জ্যান্ত প্রমাণ হচ্ছিল যেন। আর শুনেছি ‘মালকোষ’, ‘মালহূয়া কেদার’, ‘সিংহ’, ‘ইমন’, ‘হেমবেহাগ’। শুধু মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠানেই নয়, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন বা কালীঘাট কালীবাড়ির আয়োজনেও। নিবেদনের মুনশিয়ানায় বাস্তবিকই চমৎকৃত হতে হয়।

অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাকেই ওদের এক-আধজনের সময় সুযোগ মতো পাকড়াও করেছি। রামলাখন পাণ্ডে। চোস্ত ইংরেজি বলেন। কোনো স্কোপ যদি পাওয়া যায়, এই আশায় এটা ওটা প্রশ্ন করতে করতে তাকিয়ে দেখি জুটে গেছে আমার মতো অনেকেই। তাঁদের একজন, আগ্রহের অতিশয্যেই সম্ভবত এগিয়ে দেয় এক নামি ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট। এবং সঙ্গে সঙ্গে— ‘না দাদা, বহুত শুক্রিয়া। আই লাইক দিস ভেরি মাচ’ বলেই জামার পকেট থেকে বের করেন আদি অকৃত্রিম একটি বিড়ি। ভিড় হটিয়ে ওঁকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার পথে মনে হচ্ছিল, এইভাবেই বোধ করি ওঁরা সবরকম প্রলোভন জয় করে স্বস্থানে আছেন আজও। বাবা আলাউদ্দিনের কাছে শিখেছেন পাণ্ডেজি। কিছু স্মৃতিচারণ আশা করছিলাম। স্পষ্ট জানালেন— ‘না ভাই, বলার মতো তেমন কিছু নেই। দেখলেই পালাতাম। অসম্ভব ভয়। আমিও শিখব না, উনিও শেখাবেন’। বলেই পিঠের দিকে নির্দেশ করেন। বহু চড়-কিল আর অপার স্নেহস্পর্শের দাগ সেখানে। কথার মাঝেই হাজির শৈলেন শর্মা। মধ্য-ত্রিশের ছটফটে ব্যক্তিত্ব। ওঁর নলতরঙ্গ বাদনের মতোই। জানালেন— ‘আমার কিন্তু মনে আছে। বাবা প্রথমে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সরোদ। তো, কিছুতেই সুর বেরোয় না। আর যা বেরোয় তাই বেসুরো। বাবা হঠাৎ এমন এক প্রশ্ন করলেন যা শুনে আমার মতো অনেকেই হতবাক। শুনবেন সে-কথা? ওঁর প্রশ্ন ছিল, শরীরে দুধ কোথায় থাকে? লজ্জায় কান-চোখ লাল, তবু মার খাওয়ার ভয়ে নির্দেশ অনুযায়ী দেখাই। ব্যাস, অমনি আমার কানটি ধরে বলেন, মা যেমনভাবে দুধ খাওয়ায় ছেলেকে, হাতে সরোদ নিতে হবে ঠিক সেই ভঙ্গিতে। এই হলেন বাবা’। বেশ গুছিয়ে বলে শৈলেন। ওঁকেই প্রশ্ন করি, আপনারা তো লেখাপড়া শিখেছেন, স্বরলিপি-পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তবে কেন এইসব অমূল্য সুরারোপকে নোটেশনে আনছেন না? ভেবেছিলাম, বেকায়দায় পড়ে যাবেন এ-প্রশ্নে। উলটে আমাকেই ফেলে দিলেন বেকায়দায়। পৃথিবীর প্রধান অর্কেস্ট্রা দলগুলির বিষয়ে সুনিশ্চিত খবর রাখেন ওঁরা। তুলনায় এলেন এইভাবে— ‘বাজানোর পদ্ধতি হল দুটো, একটা অ্যাকটিভিটিস, অপরটি আবহন। নোটেশন-ভিত্তিক বিবিধ ক্রিয়াকলাপে গড়ে ওঠে প্রথমে ধরনের পদ্ধতি। আর আমরা স্মৃতির দরজায় ঘা মেরে সুরকে আবাহন করি। দুইয়ের একটা পার্থক্য থাকবে না? এবার আসি আপনার প্রশ্নের উত্তরে। আমরা সকলেই বাজাতে জানি একাধিক যন্ত্র। মানে, আজ আমি যদি অসুস্থ থাকি, কাল রাম সুমন সেতারব্যাঞ্জো ছেড়ে নলতরঙ্গে এসে ঠিক কাজ চালিয়ে দেবে। এছাড়া, প্রতিদিনের অভ্যাসে কোনোরকম ভুলচুক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পণ্ডিতজিও এ-সবের বিরুদ্ধে। স্বরলিপি একবার হয়ে গেলে কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তার পরিবর্তন বিরাট প্রমাণ হিসাবে পরে গণ্ডগোল বাঁধাতে পারে। তার থেকে আমাদের শ্রুতিই বেশি অথেনটিক; আর সত্যি কথা বলতে কি, এতে মেধা বাড়ে, বাড়ে শ্রদ্ধাবোধ, সংগীতকে সর্বদাই ভালোবাসতে হয়। তাই, বাবার যা কম্পোজিশন ছিল তা আজও অটুট আছে। একটি সরগমও পালটে যায়নি। অনেকে বলেছেন, এর জায়গায় অমুক করলে ভালো শোনাত। আমাদের পণ্ডিতজি বলেন, গীতাকে কেউ পালটাতে পারবে? কেউই নয়। বাবার শেখানো সব কিছুই আমাদের কাছে সাক্ষাৎ গীতা। শত চেষ্টাতে তা পারব না পালটাতে’। চমৎকার কথা বলেন গিরিধারীলালও, অথচ কিছুতেই ওঁর সামনাসামনি হতে পারছি না। কোনোমতে পাওয়া গেল অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ৫৭ হরিশ মুখার্জি রোডে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরেই ধরতে হবে গিরিধারীলালজিকে। খেয়েদেয়ে অনেকে বেড়িয়ে পড়বেন কলকাতা দেখতে। বিশ্রাম নেবেন খালি গিরিধারীলাল। বৃষ্টি মাথায় করে পৌঁছে যাই যথাসময়ে। কিন্তু কোথায় তাঁরা? শুনলাম বাহাদুর খাঁর বাড়ি গিয়েছিলেন সবাই। আর দুপুরে ধ্যানেশ খাঁর ওখানে সকলের নেমন্তন্ন। তবে, গিরিধারীলাল বলে গেছেন, এখুনি ফিরবেন। সুতরাং রকে বসে ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষা। অতঃপর ধ্যানেশ খাঁর বাড়ি থেকে খবর আসে, বাবা আলাউদ্দিনের দুর্লভ ভিডিয়ো দেখছেন ওঁরা। কেউ আসবেননা এখন। বিফল মনোরথ যাকে বলে। কিন্তু জাগছিল বিস্ময়ও। কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছে, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলায় ছোটো-বড়ো যে-কোনো শিল্পীর আগ্রহ ওপার। এখনও খ্যাতিমান গায়ক-বাদকের ছাপার হরফে কাগজের পাতায় নিজের নাম কিংবা ছবি দেখতে কী কাণ্ডই না বাধান! অথচ, মাইহারে এই মানুষগুলি, টিভি-র ক্যামেরা, সংবাদপত্রের শিরোনাম, বিদেশ ভ্রমণ— এ-সব লোভ থেকে মুক্ত আছেন! পরক্ষণেই ভাবি, বাবা আলাউদ্দিনকে দেখেছেন ওঁরা। এর পাশে যাবতীয় আকর্ষণ তো নিতান্তই তুচ্ছ!

সুতরাং পরদিন আবার দৌড়। দুরদর্শন জোগাড় করেছেন মাইহার সরকারের অনুমতি। প্রসাদ স্টুডিয়োতে করে রাখলেন রেকর্ডিং, তিনটি আইটেমের। তাই ন-টার আগেই বেড়িয়ে পড়েছেন ওঁরা। ভবানীপুরের প্রসাদ স্টুডিয়োতে আজ খালি অডিয়ো-রেকর্ডিং। পরে একদিন ছবি তোলা হবে। উপস্থিত অন্য সকলের সঙ্গে হতবাক হয়ে গিয়েছেন খোদ স্টুডিয়ো-কর্তৃপক্ষও। যে-রেকর্ডিং দিন গড়িয়ে সন্ধে পর্যন্ত নিত্যদিন বিরক্তি উৎপাদন করে, তা শেষ কয়ে গেল লাঞ্চের আগেই। রিহার্সাল দরকার হয়নি, একবারের জন্যেও কোনো যন্ত্র ভুল বাজেনি। তাই প্রথম টেকেই ওকে। সামান্য খাওয়া দাওয়া সেরেই ওঁরা ছোটেন গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে। স্বামী লোকেশ্বরানন্দজির ডাকে আজ বিবেকানন্দ হলে ওঁদের বাজনা। সুতরাং গিরিধারীলালকে আজ ছাড়ার প্রশ্ন নেই। আলাউদ্দিনের বাড়ি ‘মদিনামঞ্জরী’-তেই থাকেন উনি। আর তো কেউ দেখার নেই। সাত বছর বয়সে ধরেছিলেন বাবার হাত। তখন ওঁর সঙ্গী রাজা ব্রিজনাথ সিং। বয়সে ব্রিজনাথ অবশ্য অনেক বড়ো। ছিলেন আমাদের তিমিরবরণও। আর কার কার কথা মনে পড়ে? খানিক ঘুরেই বিস্তৃত করি প্রসঙ্গ। একটু যেন ভাবেন, খানিক থামেনও। তারপর— ‘আনোয়ার খাঁ, রামস্বরূপ, ঝুররালাল, দশরথ প্রসাদ… আউর কেউ কোই’। কীভাবে শেখাতেন বাবা? বলতে না বলতে উত্তর— ‘বহুত পিটতা’। তারপরই খানিক লজ্জা পেয়ে বোধহয়— ‘সকলকেই শিখতে হত সবকিছু। রিহার্সাল হত বাবার বাড়িতে। কেউ হয়তো রিহার্সালে ফাঁকি দিয়ে অন্যত্র গিয়েছে, বাবা ঠিক সেখানে হাজির। বাবাকে দেখে সে দৌড় লাগিয়েছে, দৌড়াচ্ছেন বাবাও। তাঁকে ধরে বকে-মেরে, যন্ত্রের সামনে বসিয়ে শেষে আদর। আর খাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সর্বক্ষণই শুধু এই বাজনা। বাবা শেখাতেন গান গেয়ে। আমাদের তা তুলতে হত যন্ত্রে, গলাতেও। না পারলে দেখিয়ে দিতেন যন্ত্রেই। ভোরবেলা নিয়ম করে রোজ শুরু করতাম পরপর ‘আহির ভায়রো’ আর ‘যোগিয়া’ দিয়ে।

অনেকের কাছেই আছে এক বড়ো মাপের ভুল ধারণা, মাইহার ব্যান্ডের মোট সদস্য সংখ্যা না কি আশি-পঁচাশি। সে-প্রসঙ্গ তুলতেই ফোকলা দাঁতে হেসে ফেলেন গিরিধারীলাল। মোট পনেরোজন, ঝুররালালই শুধু আসতে পারেননি। মাইহার সরকারের অবশ্য একটা স্কুল আছে। তবে তার সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক একেবারেই নেই। সরকার ওঁদের দিয়েছেন রিহার্সালের জায়গা। সেখানে অনুশীলন চলে রোজ, সকাল আটটা থেকে এগারোটা। ছুটির দিনেও। যন্ত্র দেন সরকার। ‘শুধু একটা জিনিসই সেই মাপে পাই না আমরা,’ বলছিলেন দুই তবলিয়া। অনুষ্ঠানের টাকায় তাঁদের কোনো অধিকার নেই। ব্যক্তিগতভাবে বাজানোর ক্ষেত্র কম। সারা মাসের পরিশ্রমের বদলে ওঁরা পান গ্রাসাচ্ছাদনের ন্যুনতম ভাতা— সরকারি স্কেলে। ওঁদের দাবি অবশ্য কিছু বেশিই। এ নিয়ে অসন্তোষ যে ক্রমশ দানা বাঁধছে, তা কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।

সেতারব্যাঞ্জোর তার পরীক্ষা করছেন রামসুন্দর চৌরাশিয়া। চন্দ্রসারং সারাঙ্গা— এইসব যন্ত্র নিয়ে কথা চালানোর ইচ্ছে। বললেন— ‘বাহাদুর খাঁর বাবা আয়েত আলী খাঁ মাইহারে গিয়ে বাবাকে উপহার দিলেন ওঁর উদ্ভাবন সেতার-সারোদ। একটিই যন্ত্র। বাবা তাতে লাগালেন চামড়া, দিলেন ব্যাঞ্জোর এফেক্ট। তৈরি হল নতুন যন্ত্র সেতার-ব্যাঞ্জো। প্রথমে বাজাতেন রামস্বরূপ। এখন আমি। ‘হেমন্ত’, ‘হেম বেহাগ’, ‘মরাগ মঞ্জরী’— এ-সবই ছিল বাবার প্রিয়। আমিও শিখেছি ওঁর কাছে’। কোনো বিশেষ ঘটনা? মহাজাতি সদনের কথা আগেই জানি। উনি দিলেন আর এক খবর। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে গুরুপূর্ণিমায় সকলে গিয়েছেন ওঁর বাড়িতে বাজাতে। পাণ্ডেজি (রামলাখন পাণ্ডে) হঠাৎ বলে বসলেন, আমরা ‘মেঘ’ বাজালেই বৃষ্টি হয়। ‘অমনি সকলের ধরাধরি। বেকায়দায় ফেলা যাবে, এমনটাও কেউ কেউ ভেবেছিলেন নিশ্চিত। রোদ আর আকাশের নীলে বৃষ্টি বা মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। মুখ কাঁচুমাচু করে বাজনা সুরু করেছি, অর্ধেকও হয়নি বাজানো। এমন বৃষ্টি নামল যে, ঘরদোর সব বানভাসি। অনুষ্ঠানই চালানো যায়নি।’ কী এর ব্যাখ্যা?

সে-প্রশ্নে বা প্রসঙ্গে যাওয়ার কোনো দরকারও বোধহয় থাকে না। বিশেষত, যারা সামনাসামনি শুনছেন মাইহার ব্যান্ড। প্রচলিত রাগ-রাগিণীর অচেনা বন্দিশের পাশাপাশি মাইহার ব্যান্ডের পাঁচ যুগের যত্নসঞ্চিত যক্ষের ধনে আড়াইশোরও বেশি রাগিণী, যেগুলির সৃষ্টিকর্তা বাবা আলাউদ্দিন। কাজে কাজেই এ-সিদ্ধান্তে আসা বোধহয় অনুচিত হবে না। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য সংগীতকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসে তাদের মধ্যে মিলমিশ খাওয়ানোর সাম্প্রতিক যে-চেষ্টা ক্রমবর্ধমান, তা সার্থকতায় সম্পূর্ণ করে গেছিলেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, তার জন্য গাল বা বগল বাজানোর দরকার পড়েনি। মাইহার ব্যান্ডের এখনকার প্রজন্ম সেই মিশ্রণকে শুদ্ধ এবং অবিকৃত রাখার কাজে দৈনিক মহড়ায় প্রাণপাত করেছেন। আত্মপরিচয়ের গ্লানি ছাপিয়ে সংগীতকেই ওঁরা করে তুলেছেন পরিচয়ের হাতিয়ার। পৃথিবীর গানবাজনার ইতিহাসে এ-উদাহরণ দ্বিতীয়টি মিলবে কি? সেই পরিণাম স্বীকৃতি অবশ্য ওঁরা আজও পাননি। যেমন পাননি বাবা আলাউদ্দিন। আর তাই আলাউদ্দিন খাঁর জন্মের একশো পঁচিশতম বর্ষে সুদূর মাইহার থেকে ছুটে এসে যাঁরা শুনিয়ে গেলেন অবিস্মরণীয় সংগীত, তাঁরা হয়তো দেখেও গেলেন, মহাজাতি সদন অর্ধেক ভরেনি। এই বিস্মৃতির কোনো ক্ষমা নেই।

প্রথম পাতা

Categories
প্রবন্ধ

অলক রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আশ্চর্য সমন্বয় মাইহার ব্যান্ড

‘মালকোষ’ বা ‘কাফি’ আমাদের জানা বা শোনা রাগ। কিন্তু ‘মালকোষ’ কিংবা ‘কাফি’ কতটা ওয়েস্টার্ন? কী এবং কেন? আপাত দৃষ্টিতে যা সোনার পাথরবাটি, সেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সংগীতরসের মূল বার্তায় ঐক্য খুঁজে পেয়েছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। বলা যায়, সৃজনী ইমপ্রোভাইজেশনে নিজস্ব ভাবনায় রাঙিয়ে নিতে পেরেছিলেন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মেলোডি এবং হার্মনিকে। তাই ‘কাফি ওয়েস্টার্ন’ ‘ভল্গা ধুন’— রাগ-রাগিণীর এমন আপাত অশাস্ত্রীয় নামকরণ আজও উৎসাহীর অনিঃশেষ কৌতূহলের কারণ।

গেল শতকের গোড়ার ঘটনা। মাইহারের রাজা ব্রিজনাথ সিং ডেকে পাঠালেন ওঁর সভা-গায়ক এবং গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-কে। মাইহারের সাম্প্রতিক দুর্ভিক্ষে দেশ ছেড়েছেন অনেকে। বাস্তুহারা, পরিচয়হীন কতিপয় শিশু শুধু অনাদরে অনাথ অবস্থায় এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। তাদের দেখবার কেউ নেই। রাজার অনুরোধ, সুর শেখাতে হবে এদের। মানে, নাড়া বাঁধিয়ে জবরদস্তি গানবাজনার পাঠ। জুটে গেল আঠাশটি ছেলে। নিতান্তই কিশোর সব। সংগীত কী এবং কেন, সেটাই জানা নেই অনেকের। ওঁদের বাবা হলেন আলাউদ্দিন। কী যে খেয়াল মাথায় চেপে গেল ওঁর। প্রথমে কোলে বসিয়ে, হাতে ধরে যন্ত্রের প্রাথমিক পাঠ। তারপরে সকলকে একসঙ্গে নিয়ে বাজানো। দলের নামও হল জবরদস্ত। ‘মাইহার ব্যান্ড’। মাইহার ব্যান্ড— এ আবার কী নাম? দুই শব্দের জোড়টি যেন কেমন অসঙ্গত। এ নিয়ে নানা প্রশ্নের সামনেও পড়তে হয়েছে আলাউদ্দিনকে। একবার বলেছিলেন তিমিরবরণ— ‘আসলে, বাবার চিন্তা ছিল একদম আলাদা। অতটুকু সব দামাল ছেলে, লেখা জানে না, পড়া জানে না, তাদের ধরে বেঁধে যদি শুদ্ধ শাস্ত্রীয় গান-বাজনার পাঠ দেওয়া হয়, সে-জবরদস্তি কি তারা শুনবে? বাবা ভাবলেন তাই অন্য পথে। শ্যামও থাকুক, কূলও। সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার ধাঁচে মাইহার ব্যান্ড। আলাপের দিকটা একদম বাদ গেল। উনি মন দিলেন তালের এক-একটি পকড় ধরে সুর রচনায়। ছোটোদের মনের উপযোগী করে শেখাতেন। খুব ভালো বুঝতেন তাদের চাহিদা। প্রথমে বন্দিশটি গলায় তুলে দেওয়া। সকলকেই গাইতে হবে, বাধ্যতামূলকভাবে। সে এক দেখার জিনিস। গলায় উঠলে পরে যন্ত্রের পাঠ। এবং সেখানেই ওঁর দূরদৃষ্টির পরিচয়। সকলকেই সব বাজনা বাজাতে হত। রিহার্সালের সময় সকাল আটটা থেকে। এখনও সে-রেওয়াজ আছে বলে শুনেছি’। শুধু বাজনাই নয়, মাইহার ব্যান্ডের গোড়ার পর্বে গানের ভূমিকাও ছিল। স্বর-সাধনা করতেন আটজন, পাঁচজন হাতে ধরতেন সরোদ, সেতারেও পাঁচজন, একটি করে বাঁশি এবং সানাই, তিনটি তবলা, একজোড়া বেহালা। চেলো, ক্ল্যারিওনেট, স্যাক্সোফোন, ইত্যাদি সবই একটি করে। একটা ব্যাপার আপাত দৃষ্টিতে পরিষ্কার। দু-একটি পাশ্চাত্য যন্ত্র, এমনকী কণ্ঠ ব্যবহারের যে-নিরীক্ষা আলাউদ্দিন করেছিলেন, তা কিন্তু ব্যান্ডের সনাতন ধারণার বিপরীতেই যায়। ধীরে ধীরে অবশ্য সে-ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আজকের ব্যান্ড, দল হিসেবে অনেক সংহত, ছোটোও। সেখানে কণ্ঠের ব্যবহার নেই, অনুপস্থিত অত্যাধুনিক পাশ্চাত্যের যন্ত্রও। এবং সবচাইতে বড়ো কথা, যন্ত্রগুলি সবই প্রায় তার-যন্ত্র। এই অবস্থা অবশ্য একদিনে আসেনি। কয়েক দশকের অবিরাম ও সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনার ফসল তা।

একটু পিছনে ফেরা যাক। ১৯২৬-এ লখনৌর ভাতখণ্ডে সংগীত মহাবিদ্যালয়ে বসল ব্যান্ডের প্রথম আসর। আঠাশটি দুরন্ত বালক তখন রীতিমতো তুখোড় বাজিয়ে। তাঁদের দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন বাবা আলাউদ্দিন। এক-আধ ঘণ্টার কম্পোজিশন মনে রাখতে তাঁদের না দরকার হয় কোনো কন্ডাকটারের, না স্ট্যান্ডে ঝোলানো নোটেশন-বোর্ডের। কাজে কাজেই সংগীতচর্চা স্মৃতিনির্ভর। অধিকাংশেরই অক্ষরজ্ঞান হয়নি। এইভাবে সাত-আট বছর ধরে চলল ঘষামাজা। তারপর একদিন আলাউদ্দিন সকলকে নিয়ে সটান কলকাতায়। ১৯৩৪-এর সেই অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অতঃপর দীর্ঘ বিরতি। ব্যাঙ্গালোর, দিল্লী, বোম্বাই, সার্ক সম্মেলন— হাতে গোনা কয়েকটি অনুষ্ঠানে কেবল অংশগ্রহণ। বাকি ইতিহাস নিরবচ্ছিন্ন অধ্যাবসায়ের।

আর তাই, পাঁচ বছর ‘মদিনা মঞ্জরী’-র ঘরে বাবা আলাউদ্দিনের কাছে শিক্ষাগ্রহণ শেষে কলকাতায় ফিরে তিমিরবরণ সেই আদর্শেই তৈরি করলেন ওঁর ‘ফ্যামিলি অর্কেস্ট্রা’। অমিয়কান্তি, শিবব্রত, ললিতা, সবিতা প্রমুখ ভাইপো-ভাইঝি, ভাগ্নে-ভাগ্নী সমাবেশে তিমিরবরণের পারিবারিক অর্কেস্ট্রা সমাদৃত হয় সারা ভারতবর্ষে। উৎসাহিত হন স্বয়ং উদয় শংকরও। কিন্তু, সে-অন্য কাহিনি। বাবা আলাউদ্দিনের মাইহার ব্যান্ডের ধাঁচে গুণী ছেলে আলী আকবর খাঁ-ও দেশান্তরে গড়ে তুলেছেন এমনই এক সংস্থা। জর্জ রুকার্ট, ভি-জি-যোগ প্রমুখের সাহায্য এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি গড়ে তুললেন ‘দ্য নিউ মাইহার ব্যান্ড’ সংস্থাটি। পশ্চিমী কিছু যন্ত্র এবং কণ্ঠের ব্যবহারে আলী আকবর খাঁ মাইহার ব্যান্ডের আদি রূপটি চালু রাখার যে-পরিকল্পনা নিয়েছেন, তা ডকুমেন্টেশনের কাজে আসবে। আমেরিকায় জনাদশেক ছাত্র এই নিউ মাইহার ব্যান্ডের ক্রমাগত অনুশীলনে তৈরি হয়ে উঠেছেন। এখানেই অবশ্য শেষ নয়। সুইজারল্যান্ডে কেন জুকারম্যানও আশির গোড়ায় তৈরি করলেন ‘বাসেল মাইহার ব্যান্ড’। ভারতীয় সংগীতের বিপুল ঐশ্বর্য এইভাবেই বিদেশের দরবারেও পরম আদরণীয় হয়ে উঠল।

বাহাত্তরে সুরলোকে গেলেন আলাউদ্দিন। ৮০-র গোড়ায় দু-বার; তারপর ফের ৮৭-র নভেম্বরে কলকাতায় এলেন মাইহার ব্যান্ড। উপলক্ষ, বাবা আলাউদ্দিনেরই জন্মের ১২৫ বছর পূর্তি স্মারক উৎসব। তাঁদের ডেকেছেন যথারীতি আলী আকবর কলেজ অব মিউজিক। ১২ নভেম্বর। হাওড়া স্টেশন। সকলেই নামলেন ট্রেন থেকে। কিন্তু কোথায় সেই দু-জন? বলতে না বলতেই কামরার দরজায় এক বৃদ্ধ। ‘ম্যায় হুঁ গিরিধারীলাল’। দেখে আলী আকবর কলেজ অফ মিউজিক-এর নবীন প্রজন্ম আহ্লাদে আটখানা। ১৯৮৪-র সেই ভয়ংকর সুন্দর বৃষ্টির সন্ধ্যাকে যে ওঁরা ভুলতে পারেননি। সে-আলোচনা না হয় পরে। কিন্তু কোথায় গেলেন ঝুররা মহারাজ? না, আসেননি তিনি। আসার জন্য সবরকম চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও শরীরে অনুমতি মেলেনি। তাহলে কে বাজাবেন নলতরঙ্গ? সে-উত্তর অবশ্য মিলেছে যথা সময়েই।

৫৭, হরিশ মুখার্জি রোডের ছিমছাম একতলায় বসে গল্প শোনাচ্ছিলেন শেখর রায়চৌধুরী। মাইহার ব্যান্ডের স্থানীয় ম্যানেজার থেকে কেয়ার-টেকার— সবই তিনি। ব্যান্ডের চোদ্দজন সদস্য ট্রেনের ক্লান্তিতে কিছুটা অবসন্ন। ভাদুয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি আর নিখুঁত নিরামিষ রান্নার গন্ধ ভাসছে। ইতিমধ্যে দু-জন গোঁ ধরেছেন— ‘শেখরবাবু, ভায়োলিন খরিদ করনে হোগা। বহুৎ জরুরত’। ওঁদের থামিয়ে ফের একবার শুরু করেন শেখরবাবু— ‘৮৪-তে মহাজাতি সদনে ওঁদের শেষ আইটেম, রাগ ‘মেঘ’। অনুষ্ঠান শেষ হল; আর আপনাকে কী বলব, বৃষ্টিতে মানুষ সমান জল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে। রিক্‌শা করে একে একে ওঁদের ডেরায় ফেরত পাঠাই। এরই মধ্যে হারিয়ে গেলেন ঐ দু-জন, ঝুররা মহারাজ আর গিরিধারীলাল’। বলেই বেহালার খোঁজে ছোটেন শেখরদা।

ঝুররালাল থেকে ঝুররা মহারাজ— দীর্ঘ প্রস্তুতি ও সাধনার দুই প্রান্ত। সাধারণ রাগের আরোহণ-অবরোহণে যাঁর গা দিয়ে ঘাম ছুটত, সেই ঝুররালালকে আলাউদ্দিন প্রায় সব যন্ত্রেই পারদর্শী করিয়েছিলেন। তিনি আর গিরিধারীলাল— প্রথম আঠাশের মধ্যে বেঁচে আছেন তো মাত্র এই দু-জনই। কত বয়স হল আপনার? জিজ্ঞাসা করি গিরিধারীজিকে। ছিপছিপে, ঋজু অবয়ব। মাথায় গান্ধি টুপি। দৃষ্টি সিধে। মাইহার ব্যান্ডের সকলের ‘পণ্ডিতজি’। কানে বোধহয় ইদানীং শুনছেন একটু কম। দ্বিতীয়বার বলতে হল একগাল হেসে— ‘ইয়াদ নেহি। সত্তর সে কুছ যাদাই হোগা’। কী কী বাজাতে পারেন আপনি? প্রশ্নের পরেই বুঝেছি, একেবারে সাদামাটা মেঠো হয়ে গেল ব্যাপারটা। পণ্ডিতজি বলেননি কিছু। বললেন দলের অন্যান্য সদস্যরা। সব, সব যন্ত্রে সমান অধিকার ওঁর। এখন অবশ্য বসেন দলের মাঝখানে হারমোনিয়াম হাতে। সাধারণ তিন অক্টেভের অতি নিরীহ-দর্শন একখানি যন্ত্র, মাইহার ব্যান্ডের প্রাণ যা।

রামলখন পাণ্ডে (সেতার), সুশীলকুমার শুক্লা (হারমোনিয়াম), রামলখন শর্মা (সরোদ), গুণাকর শামলে (হারমোনিয়াম), বিজয়কুমার শুক্লা (বেহালা), গোকারণ প্রসাদ পাণ্ডে (বেহালা), সুরেশকুমার চতুর্বেদী (এসরাজ), রামসুমন চৌরাশিয়া (সেতারব্যাঞ্জো), অশোককুমার বডোলিয়া (তবলা), বিজয় দেব সিং (চেলো), রামায়ণ প্রসাদ চতুর্বেদী (সেতার), শৈলেন শর্মা (নলতরঙ্গ) এবং গিরিধারীলাল (হারমোনিয়াম)— চোদ্দজন যন্ত্রি। তিনটি হারমোনিয়াম আর একজোড়া তবলা, একটি নলতরঙ্গ। বাদবাকি সব তারের যন্ত্র। ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় মহাজাতি সদনে ওঁদের শুরুর নিবেদন রাগ ‘শ্যামকল্যাণ’। কিন্তু, শ্রোতা ক-জন? বড়োজোর শ-চারেক। এরকম কেন? চমৎকার জবাব দিলেন আলী আকবর কলেজ অব মিউজিকের বর্তমান প্রধান উমা গুহ— ‘বিনি-পয়সার অনুষ্ঠান তো! বাড়ি-বাড়ি গিয়ে কার্ড দিয়ে এসেছি। লোক কেন হবে ভাই?’ বাস্তবিকই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। প্রায় একক চেষ্টায় এই নিয়ে তিনবার মাইহার ব্যান্ডকে উমা গুহ কলকাতায় আনলেন। এবং আনলেন মধ্যপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধ করে। মাইহার ব্যান্ড মধ্যপ্রদেশ কলা পরিষদের পরিচালনাধীন। সরাসরি সরকারি সংস্থা এটি। সুতরাং তাঁদের অনুমতি পাওয়াটা যে কী কঠিন বিষয় তা উমা গুহর থেকে বেশি কেউ জানেন না। সম্পূর্ণ অ-ব্যবসায়িক এই সাংগীতিক দৌড়-ঝাঁপকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন এবং দায় তাই ছিলই। বাস্তবে কী হল? কাগজের বিজ্ঞাপনের জন্য পাওয়া যায়নি স্পনসর, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে অনেকেই আগাগোড়া নিলেন নীরব শ্রোতার ভূমিকা।

রাগ ‘শ্যামকল্যাণ’। চৌতালের আদিতে দুই মাত্রা যোগ করে চোদ্দ মাত্রার আড়া চৌতাল। তাতে সুর বেঁধেছেন আলাউদ্দিন। লয় মধ্য। যুগল তবলার ঠেকা আর বেহালা-সারোদ-সেতারের একমুখী ওঠানামা। বন্দিশটি চমৎকার। মাঝে নলতরঙ্গ। ছোটো-বড়ো বাইশটি বন্দুকের নল। সাধারণ লোহার শিক দিয়ে তাতে ঘা মেরে শুদ্ধ, কড়ি, কোমল অনুষঙ্গ কানে মেপেছিলেন আলাউদ্দিন। ঘষে, মসৃণ করে সুর অনুসারে তা বসানো কাঠের পাটাতনের ওপর। সেখান থেকে আসছে জলতরঙ্গের সুরাভাষ। একটু কড়া, হয়তো কিছুটা ধাতব, সব মিলিয়ে নিখুঁত সুরের উন্মাদনা, যা ব্যান্ডের লয়কে প্রতি মুহূর্তে বাড়িয়ে দিচ্ছে, অথচ বাড়ানোর সেই মুহূর্তটিকে আলাদা করে ধরা যাচ্ছে না। এই যন্ত্রই তাহলে বাজান ঝুররা মহারাজ। শৈলেন শর্মা কিন্তু কখনোই তার অনুপস্থিতি মনে করাচ্ছে না। অনবদ্য ভঙ্গি। দ্রুতলয়ে যখন একের পর এক কঠিন-কঠিন মাত্রায় দুরূহ তেহাইয়ের কাজে ব্যস্ত শিল্পীরা তখন হঠাৎ করেই মনে এল একজন ভারতীয় জুবিন মেহেতার কথা। তার দলে শত জোড়া বেহালা, স্যাক্সোফোন, ড্রাম সেট, পারকাশান, বিবিধ বাঁশি— এ-সবের সামনে আড়াল হয়ে থাকে পাতার পর পাতা নোটেশন। বিশেষ মাইক্রোফোন, বিশেষভাবে তৈরি মঞ্চ এবং বিশেষ প্রবেশমূল্য ছাড়া অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রশ্ন ওঠে না। অথচ এই সাধারণ পোশাকের অতি-অসাধারণ ভারতীয় সংগীতজ্ঞরা শুধুমাত্র শ্রুতিতে ধরে রেখেছেন আলাউদ্দিনের রচনাকে, বংশ পরম্পরায়। এক চুল এদিক ওদিক হয়নি। ওরাই বলছিলেন, অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন এটাসেটা বদল করতে। পণ্ডিতজি অবশ্য সে-পরামর্শ মানেননি। অনুষ্ঠানের পরদিন জানালেন গিরিধারীলালও— ‘দেওয়ার আছে এখনও অনেক কিছু। বয়স হয়েছে, সেটাই ভয়। স্মৃতি তঞ্চকতা করবে না তো?’

শুধু মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠানেই নয়, কালীঘাট কালীবাড়ি-প্রাঙ্গণ, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন— সর্বত্রই শুনে বুঝেছি, ওঁদের পরিবেশনের গায়ে সেঁটে আছে অরিজিনালিটির শিলমোহর। যেমন, ‘পুরিয়া ধানেশ্রী’। মুখ্য যন্ত্র বেহালা, নলতরঙ্গ যেন খানিকটা চাপা। সেরকমই কম্পোজিশন। আর শুধু লয় নয়, তালের পরিবর্তনও প্রতিমুহূর্তে। তিনতালে শুরু, মাঝে হঠাৎই দাদরায় কম্পোজিশনকে আমূল পালটে নেওয়া। আবার শেষ প্রান্তে তিনটি জবরদস্ত তেহাইয়ের সাহায্যে ফের তিনতালে আসা। আর সবই ওঁরা করছিলেন একে-অপরের দিকে না তাকিয়েই। সুরে সামান্যতম বিচ্যুতি নেই। তার প্রশ্নই ওঠে না। হঠাৎই নিখুঁত সরগম শুরু করলেন ওরা, পুরিয়া ধানেশ্রীতেই। যেন স্বরসাধনার প্রথম পাঠ। ক্রমশ ধরা যাচ্ছিল ব্যান্ডের কেন্দ্রীয় কৌশলটিকে।

শেষ পাতা

Categories
প্রবন্ধ

সুজিৎ দে’র প্রবন্ধ

মুর্শিদাবাদের বোলান গান: সাধারণ পরিচয়

বোলানের অন্য রূপটি হল পোড়ো বোলান বা পালা বোলান। বর্তমানে এই বোলানই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে বিবর্তিত হয়েছে। উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক গানই হল এ-ধরনের বোলান। বোলান গাওয়ার কৌশলটাও আগে ছিল একটু অন্যরকম। দলের সব সদস্যরা আসরে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে বোলান পরিবেশন করত। মাঝখানে থাকত বাদক, প্রম্পটার প্রমুখরা। দু-টি সারিতে দাঁড়িয়ে বন্দনা গান গাওয়া হত। প্রম্পটার প্রাধান গায়কের কানে কানে গানের পরবর্তী কলিটি শুনিয়ে দিত। প্রথম সারির গান গাওয়া হলে ওই একই লাইন গাইত পরের সারির সদস্যরা। আর ছিল দোহারী। দু-টি সারির লোকেদের একবার করে গান গাওয়ার পর দলের অন্যান্য সদস্য যারা আসরে বসে থাকত তারা গান ধরত।

মূল গায়কদের বিরতি দেওয়ার জন্যই এই প্রথা। বন্দনা থেকে শুরু করে পালা অংশ, সমাপ্তি গান সবই সংগীতের মধ্য দিয়ে পরিবেশিত হত।

বর্তমানে যে-বোলান পালা প্রচলিত আছে তা পোড়ো বা পালা বোলানের বিবর্তিত রূপ। এর কয়েকটি বিভাগ স্পষ্ট চোখে পড়ে—

১। বন্দনা
২। বোলান পালা
৩। পালার সমাপ্তি সূচক গান
৪। রং পাঁচালী।

বোলান পালা পরিবেশন করার আগে বিভিন্ন দেবতার বন্দনা করা হয়; যে-আসরে বোলান গাওয়া হয় সেখানে প্রকাশ হতে প্রার্থনা জানানো হয়—

“আমরা প্রথম আসরে মাগো করি বন্দনা
বাগবাদিনী বীণাপাণির চরণ দুখানা।
তুমি বিনে বাক্য কহে কোন জনের শক্তি নহে
ব্যাসাদি বাল্মিকী কহে গুণের বর্ণনা।
এস, সিদ্ধিদাতা গণপতি, পিতা যাহার পশুপতি
সিংহপৃষ্ঠে ভগবতীর চরণ দুখানা
এস ইন্দ্র চন্দ্র যম হুতাসন, যত আছেন দেবতাগণ
অরুণ বরুণ ষড়াণন করুন বন্দনা।” [৮]

কিংবা বন্দনা গাওয়া হয় এরকম—

“মঙ্গলময় তুমি শ্রীমধুসূদন
সঁপিলাম এই প্রাণ তব চরণতলে
তব কৃপা পাব বলে
এস মা সরস্বতী করি নতি করি নতি
এই আসরে দয়া করে।” [৯]

বন্দনা গাওয়ার পরেই দর্শকদের জানিয়ে দেওয়া হয় আসরে কোন পালা পরিবেশিত হবে। এই ব্যাপারটাতে এখন অনেকটা যাত্রার ঢং এসে গেছে—

“শ্রী শ্রী ভোলানাথের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আমরা শুরু করতে চলেছি এক সম্পূর্ণ পৌরাণিক বোলান পালা শঙ্খচূর বধ। রচনা গৌর নন্দী। নির্দেশনা সুবল নন্দী, পরিচালনায় বিমান নন্দী। সূধী দর্শকমণ্ডলীর শ্রীচরণধূলি মাথায় নিয়ে শুরু করছি এ বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ পৌরাণিক পালা শঙ্খচূড় বধ।” [১০]

এছাড়া কখনো কখনো অভিনেতাদের নাম ঘোষণা করতেও দেখা যায়।

এরপর শুরু হয় মূল বোলান পালা অর্থাৎ, কাহিনি অংশ। ঐতিহাসিক, পৌরাণিক ও সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে রচিত হয়ে থাকে তা।

বোলান পালা অভিনয়ের সময় যতটা সম্ভব গম্ভীর ও জোড়ালো কণ্ঠস্বরের আশ্রয় নেওয়া হয়। এই কারণেই স্বগতোক্তি প্রাধান্য পায়। চরিত্রের মনের প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ স্পৃহা অথবা তার পরবর্তী কার্যকলাপের প্রকাশ ঘটে সেখানে। এটা গানের মাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়। লোকশিক্ষা বা নীতিশিক্ষা থেকেই যায় বোলানে। যেমন ‘শঙ্খচূড় বধ’ পালায় দর্পে অন্ধ তুলসীর স্বামীকে তুলসী পরনারীর প্রতি লোভ প্রদর্শন করতে বারণ করে। বলে—

“যে পরের নারীকে মায়ের মত দেখে, পরের জিনিসকে মাটির ঢিলা ভাবে, যে সবাইকে আপন ভাবে সেই তো পণ্ডিত।” [১১]

অথবা, চণ্ডাল হয়ে রাজার মন্দিরে পূজা দেওয়ার জন্য যার হাত কেটে দেয় রাজা; সুযোগের পরিস্থিতিতে সেই রাজার দুর্দিনে চণ্ডাল ছেলেটি জাত পাতের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে কথা বলে এবং প্রতিবাদ করে—

“যখন দু-মুঠো ভাতের জন্য মানুষ হাহাকার করে, তখন দুঃখের কথা কেউ শোনে না। ভগবানের কাছে মনের ব্যথা জানায় যখন তখন আপনার জাতভেদ কোথায় থাকে মহারাজা।” [১২]

বোলান পালা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সেই মুহূর্তে আসরে যে-ক-জন কুশীলব উপস্থিত থাকেন তারাই সমাপ্তি গান গেয়ে থাকে। একদিকে যেমন দর্শকদের জানিয়ে দেওয়া হয় বোলান পালা শেষ হয়েছে; তেমনি জানিয়ে দেওয়া হয় ‘বই বলে’ তথা প্রম্পটার, দলপতি, রচনাকারের নাম-সহ দলের ঠিকানা। যেমন ‘শঙ্খচূড় বধ’ পালার সমাপ্তি গানটি এইরকম—

“মোদের বোলান সাঙ্গ করিলাম
তপন নন্দী দলপতি বই বলে বিমান
রাজাপুরে মোদের বাড়ি ঠিকানা দিলাম
কয়েকজনা মিলে মোরা এদল গড়িলাম
মোদের বোলান সাঙ্গ করিলাম।।” [১৩]

এই গান গাওয়ার সময় অভিনেতাদের গোল করে ঘুরে ঘুরে নৃত্য পরিবেশন করতে দেখা যায়। চরিত্রের অবস্থান অনুযায়ী আচরণ এখানে আশা করা বৃথা। এই গানগুলি প্রায় একইরকম হয়ে থাকে। অন্য একটি পালার সমাপ্তি গান এইরকম—

“এখানেতে গান করি সমাধান
মহুলাতে মোদের বাড়ি।
জ্ঞানে অজ্ঞানে গাহি গো বোলান
সবে হয় যে আনাড়ি।
মহুলাতে মোদের বাড়ি।
সুখেনের রচনা করুন গো মার্জনা
হরি নামে যাবে ত্বরী।
মহুলাতে মোদের বাড়ি।” [১৪]

বোলান পালার শেষে হাস্যকৌতুক সমৃদ্ধ আদিরসাত্মক পাঁচালী পরিবেশিত হয়। তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশ্লীল হয়ে ওঠে। খিস্তি, খেউর স্বভাবতই স্থান করে নেয় সেখানে। কিন্তু গ্রামের মাটিতে লালিত, গ্রামের পুথিগতভাবে অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত গ্রামবাসীকে আনন্দ দিতে সাহায্য করে এ-ধরনের পাঁচালী।

বর্তমানকালে শিক্ষার আলোয় আলোকিত একদল মানুষ বোলান দল গঠন করে লোকনাট্যের ধারাটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও রং পাঁচালীর আদি রস থেকে তারা বেরিয়ে আসতে চাইছে। আসরে বোলান পালা পরিবেশন করে দর্শকদের তারা খুব মুগ্ধ করে। কিন্তু ‘মোদের বোলান সাঙ্গ করিলাম’ বলার সাথে সাথে যখন তারা আসর ছাড়তে উদ্যোগী হয়, তখনই দর্শকদের চিৎকার ধ্বনি আসরে আছড়ে পড়ে— ‘রং পাঁচালী, রং পাঁচালী’ তাই ‘না, না’ করেও পার পাওয়া যায় না। কিছু একটা করতেই হয়। লোকনাট্যের একটা অন্যতম ধারা কিন্তু এই রং পাঁচালী। গ্রামীণ প্রহসন বললে খুব ভুল বলা হয় না। নিতান্তই হাস্যরসের সঙ্গে গ্রামীণ জমিদার, পাড়ার মোড়ল প্রভৃতি চরিত্রগুলিকে ব্যঙ্গ করা হয় এখানে। সে-ব্যঙ্গের ভাষায় অবশ্যই থাকে অতিরঞ্জনের সুর।

এবার আসা যাক বোলানের সঙ্গে যুক্ত লোকগুলির কথায়। কোনো তথাকথিত শিক্ষিত লোক বোলান রচনা করেন না। গ্রামেরই কোনো অল্পশিক্ষিত লোক যে সমাজকে খুব কাছ থেকে দেখেছে, পৌরাণিক গল্প শুনে শুনে জেনেছে তিনিই তার আগ্রহ থেকে বোলান রচনা করেন। মূল পাঠের বানান বিভ্রান্তিই বোধ হয় তার বড়ো একটা প্রমাণ।

বোলানের কুশীলব বা শিল্পীরা দক্ষ অভিনেতা নন, অভিনয় এদের পেশা নয়, নেশা। শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষগুলি মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মহড়া শুরু করেন। পারিশ্রমিক যা পায় তার হিসেব করলে পুরোটাই ‘লস’। এরা হয়তো বছরের এগারো মাস লাভ ক্ষতির হিসেব করেই চলে বা চলতে চায়। কিন্তু বোলানের সময় এরা খুশির জোয়ারে ভেসে ভুলে যায় লাভ ক্ষতির পাটিগণিত। সাধারণত পুরুষেরাই অভিনয় করে। তবে ইদানীং মহিলাদের প্রবেশ ঘটলেও তা অবাধ নয়। অন্য কোনো লোকনাট্যের দল (আলকাপ, কৃষ্ণযাত্রা প্রভৃতি) থেকে মহিলাদের ভাড়া করতে হয়। স্বভাবতই পারিশ্রমিক পুষিয়ে নেয় তারা। আর এদের অভিনয় পেশাগত।

প্রম্পটার বোলানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। অল্প কয়েকদিনের মহড়ায় বিশেষ কিছু হয় না। আসরে যেখানে অভিনয় হয় তার এককোনে প্রম্পটার বসে থাকে। বেশ জোড়েই সংলাপ ও গানের কথা বলতে হয়। তা শুনেই শিল্পীরা সংলাপ বলে ও গান করে।

মঞ্চ পরিকল্পনার ব্যাপারটিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বাঁধাধরা সুনির্দিষ্ট মঞ্চ থাকে না বোলানের অভিনয়ের জন্য। মঞ্চসজ্জাও থাকে না কিছুই। শুধু কয়েকটি মাইক্রোফোন ঝোলানো হয় দড়ির সাহায্যে। শিব পূজার মণ্ডপের সামনে এর অভিনয় হয়। দর্শকেরা চারিপাশে সুবিধামতো বসে। মাঝখানে যে-অংশটুকু ফাঁকা থাকে সেখানেই বোলান পরিবেশিত হয়। চারিদিকের একটা দিকেই বোলান দল তথা গায়ক, বাদক, অভিনেতারা বসে থাকে। এটিই তাদের গ্রিনরুম। এক আসর থেকে আর এক আসরে এভাবেই বোলান গান করে মানুষকে আনন্দ দেয় তারা।

পৌরাণিক বা সামাজিক যে-কোনো পালার ভাষায় থাকে আঞ্চলিকতার ছাপ। রচনাকার যথাসম্ভব শুদ্ধ লিখতে চাইলেও কুশীলবরা আঞ্চলিক ভাষাকেই ব্যবহার করে সচেতনভাবেই। যেমন লিখিত পালায় আছে— ‘তুই ছাড়া আমার যে আর কেউ নায়’। [১৫] উচ্চারণে হয়ে যাচ্ছে— ‘তু ছাড়া আমার আর কেউ নাই’। সাধু চলিতের মিশ্রণটিও লক্ষণীয়—

“আমি তোমার অভিশাপ শিরোধার্য করিলাম, তবে আমি তোমায় অভিশাপ দেব না’। [১৬]

শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষগুলি বোলানকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়, বোলান দল গড়ে ওঠে। ক্ষুদ্র, তুচ্ছ বিবাদ এ-সময় মিটে যায়। এক প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা পস্পরের সঙ্গে। হয়তো কোনো বছর নিতাই সাজে মহিমের বৌদি, সারা বছরের জন্য মহিম নিতাইকে বৌদি বলেই ডাকে, সঙ্গে গ্রামের আরও পাঁচজন। রসিকতার সঙ্গে সঙ্গে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বলা বাহুল্য গ্রামের মানুষগুলোও নাওয়া খাওয়া ভুলে বোলান শোনে; আর শেষ হলে অপেক্ষা করে পরের বছরের।

নাগরিক সভ্যতা থেকে বহু দূরে, শহরের প্রান্তসীমার নাগালের বাইরে পল্লির মুক্তাঙ্গনের গীত বোলান গান। মোবাইল আর ইন্টারনেটের যুগের প্রভাব আজ গ্রামেও পড়েছে। তাই বোলান সেখানে অনেকটা মর্যাদা হারিয়েছে। তবে লোকসমাজের বাসিন্দারা আজও প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছে বোলান গানকে টিকিয়ে রাখার। আর এ-জন্যই এত পরিবর্তনের ঘটা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সহযোগিতার অভাব আজ বৃহত্তর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতি গ্রামীণ মানুষগুলির ভালোবাসা না থাকলে এ প্রকার সহযোগিতা সম্ভব নয়। অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত চাষাভুষো লোকগুলোকে মর্যাদা দিতে চায় না উচ্চবিত্তেরা। কিন্তু এরাই বাংলার এরকম এক ঐতিহ্যকে যেভাবে ধরে রাখবার চেষ্টা করছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। লোকসাহিত্যের অঙ্গনে তাই আজও বেঁচে আছে ‘বোলান’। বেঁচে থাকবে যতদিন এই লোকসমাজ থাকবে আর বাঁচবে। তাই তো বিশ্বকবির আবেদন—

“সাহিত্যের ঐক্যতান সংগীত সভায়
একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়।” [১৭]

বলা বাহুল্য লোকসাহিত্যের অঙ্গনে ‘বোলান’ গান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। শুধু চাই গ্রামীণ মানুষগুলির এর প্রতি ভালোবাসা আর সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস। একমুঠো ছাতু আর আধখানা রুটি বা একমুঠো ভাতের সংস্থান এরা নিজেরাই করতে পারে। প্রয়োজন শুধু সম্মান আর মর্যাদা। তাহলেই লোকসংগীত ও লোকনাট্যের বিমিশ্র এই রূপ টিকে থাকবে, পা বাড়াবে যুগ থেকে যুগান্তরের পথে।

তথ্যসূত্র:
১। বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ/ আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা, ড দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত/ প্রথম প্রকাশ-২০০৪/ পৃষ্ঠা-১৭০।
২। তদেব।
৩। তদেব।
৪। তদেব। পৃষ্ঠা-১৭১।
৫। সতীশ কুণ্ডু রচিত ‘ভিখারী ঈশ্বর’ নামক বোলানপালা/ পৃষ্ঠা-৩।
৬। বাংলার লোকসাহিত্য–প্রথম খণ্ড/ আশুতোষ ভট্টাচার্য/ পৃষ্ঠা-৫৯৭।
৭। বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ/ আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা, ডঃ দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত/ প্রথম প্রকাশ-২০০৪/ পৃষ্ঠা-১৭২।
৮। গৌড় নন্দী রচিত ‘শঙ্খচূড় বধ’ বোলান পালা/ পৃষ্ঠা-১।
৯। সতীশ কুণ্ডু রচিত ‘ভিখারী ঈশ্বর’ নামক বোলানপালা/ পৃষ্ঠা-১।
১০। গৌড় নন্দী রচিত ‘শঙ্খচূড় বধ’ বোলান পালা/ পৃষ্ঠা-২।
১১। তদেব/ পৃষ্ঠা-১৫।
১২। সুখেন হাজরা রচিত ‘চণ্ডাল রাজা’ বোলান পালা / পৃষ্ঠা-২২।
১৩। গৌড় নন্দী রচিত ‘শঙ্খচূড় বধ’ বোলান পালা/ পৃষ্ঠা-২৭।
১৪। সুখেন হাজরা রচিত ‘সোনার সংসার’ বোলান পালা / পৃষ্ঠা-৫১।
১৫। তদেব/ পৃষ্ঠা-৮।
১৬। গৌড় নন্দী রচিত ‘শঙ্খচূড় বধ’ বোলান পালা/ পৃষ্ঠা-২৫।
১৭। সঞ্চয়িতা–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ সাহিত্যম/ সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০৩/ পৃষ্ঠা-৬২২।

সহায়ক গ্রন্থ:
১। বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ-ড দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত-আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা।
২। লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞান-তত্ত্ব, পদ্ধতি ও প্রয়োগ-শেখ মকবুল ইসলাম-বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ।
৩। বাংলার লোকসাহিত্য-শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য-প্রথম খণ্ড।
৪। বাংলার লোকসংস্কৃতি-শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য-ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট-ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লি।
৫। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস-সুকুমার সেন-প্রথম খণ্ড।
৬। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত-অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-দ্বিতীয় খণ্ড-মডার্ণ বুক এজেন্সী।

প্রথম পাতা

Categories
অনুবাদ সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

দেবোরা: কেন আপনি রাজি হলেন?
মুরাকামি: তারা আমাকে বলেছিলেন যে আমি ইচ্ছামতো রেকর্ড বেছে নিতে পারি। এবং পঞ্চাশ মিনিট ধরে আমার পছন্দসই কথাবার্তা বলতে পারি। তো আমি ভাবলাম, কেন নয়! বিলি হলিডে থেকে ‘মারুন ৫’ পর্যন্ত সবকিছু থেকে আমি খুব বাছাই সংগীত পরিবেশন করি।

দেবোরা: মনে হয় আপনি একবার বলেছিলেন যে, জাপানে লেখক হওয়া খুব চটকদারি ব্যাপার। ভীষণ প্রকাশ্য জীবিকার প্রেক্ষাপটে আপনি নিজের সাধারণত্বে অবিচল থাকেন। এগুলো আপনি মেলান কীভাবে?

মুরাকামি: সত্যি বলতে শুরুর দিকে জাপানের সাহিত্য জগৎ সম্পর্কে আমি খুব একটা খুশি ছিলাম না। আমি ছিলাম একজন বহিরাগত। একটি কালো মেষ, মূলধারার জাপানি সাহিত্যে অনুপ্রবেশকারী। কিছু লোক বলেছিল যে, আমি জাপানি সাহিত্যে নতুন কণ্ঠ। এবং কিছু লোক আমাকে বাজে বলেছিল। তাই আমি একরকম বিভ্রান্ত ও বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। আমি জানতাম না কী হচ্ছে। আমি ‘ওয়ান্ডারল্যান্ডে এলিস’ এর মতো হয়ে পড়েছিলাম। তাই আমি জাপান থেকে পালিয়ে বিদেশে চলে গেলাম। ইতালি এবং গ্রিসে গিয়ে দুই-তিন বছর কাটালাম। তারপর আমি লিখলাম ‘নরওয়েজিয়ান উড’। জাপানিরা বইটিকে ঘৃণা করেছিল।

দেবোরা: এটা দুই মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল!

মুরাকামি: এত বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও লোকে আমাকে ঘৃণা করেছিল। তাই আবার আমি বিদেশে চলে গেলাম। আমি নিউ জার্সির প্রিন্সটনে গিয়ে উঠেছিলাম। জায়গাটি ছিল বিরক্তিকর। সুন্দর, তবে বিরক্তিকর। তারপরে বোস্টনের টাফট্‌স ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। সেখানকার ফেনওয়ে পার্কটি ভালো ছিল।

দেবোরা: ভূমিকম্প এবং সারিন গ্যাস আক্রমণের পরে আপনি কি আবার জাপানে ফিরে যাওয়ার মন স্থির করলেন?

মুরাকামি: হ্যাঁ। ১৯৯৫ সালে আমি অনুভব করি নিজের দেশে ফিরে এসে মানুষের জন্য কিছু করতে পারি কিনা। দেশের জন্য নয়, জাতির জন্য নয়, সমাজের জন্য নয়, আমার বিশ্বাস ছিল জনগণের প্রতি।

দেবোরা: আপনার কাছে দেশ ও জনগণ, এই দু-টি জিনিসের মধ্যে পার্থক্য কী?

মুরাকামি: মানুষ আমার বই কেনে, দেশ না।

দেবোরা: আপনি কি জাপানি হিসেবে আপনার লেখালেখিকে বিচার করেন না পশ্চিমা সাহিত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন?

মুরাকামি: আমি সেভাবে ভাবি না। আমার গল্প আমারই। এগুলো কোনো বিভাগের বিষয় নয়। তবে আমি জাপানি ভাষায় লিখি এবং আমার চরিত্রগুলো বেশিরভাগই জাপানি। তাই আমি মনে করি আমি একজন জাপানি লেখক। আমি মনে করি আমার লেখার শৈলী অন্যত্র থেকে নেওয়া নয়।

দেবোরা: জাপানে আপনার প্রথম দিকের পাঠকেরা বেশিরভাগই তরুণ ছিলেন। তরুণদের মধ্যে আপনার বিরাট প্রভাব ছিল।

মুরাকামি: হ্যাঁ। এটা খুবই অদ্ভুত। আমি যখন লিখতে শুরু করি আমার পাঠকেরা বিশ বা তিরিশের কোঠায় ছিলেন। এবং চল্লিশ বছর পরে আমার পাঠকেরা বিশ বা তিরিশের কোঠাতেই থেকে গেলেন! ভালো কথা হল আমার প্রথম প্রজন্মের কিছু অনুরাগী এখনও আমার বইগুলি পড়ছেন এবং তাদের ছেলেমেয়েরাও সেগুলি পড়ছে। একই পরিবারের তিন-চারজন একই বই পড়ছেন শুনে আমি খুব আনন্দিত হলাম। আমার এক বন্ধু তার অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের সাথে এমনিতে কথা খুবই কম বলে। কিন্তু জেনে খুব ভালো লেগেছে যে, তারা যখন কথা বলে তখন বিষয় থাকে আমার বই।

দেবোরা: ‘কিলিং কমেন্ডটর’ থেকে থেকে একটা দৃশ্য আমি উদ্ধৃত করতে চাই:

কমেন্ডেটর নিজ হাতের তালু দিয়ে দাড়ি ঘষতে লাগলেন যেন কিছু মনে পড়েছে। “ফ্রানজ কাফকা ঢালু স্থান বেশ পছন্দ করতেন”, সে বলল, “সবধরনের ঢালু স্থান তাকে আকৃষ্ট করত। ঢালের মাঝখানে নির্মিত বাড়িগুলির দিকে চেয়ে থাকতে তিনি পছন্দ করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার পাশে বসে তিনি ওই বাড়িগুলি দেখতেন। কখনোই এতে ক্লান্ত হয়ে উঠতেন না। প্রথমে মাথাটি একদিকে ঝুঁকিয়ে তিনি বসতেন পরে আবার সোজা করে নিতেন। অদ্ভুত মানুষের মতো ছিল তাঁর আচরণ। আপনি কি এটা জানতেন?” ফ্রানজ কাফকা এবং ঢালু স্থান? “না। আমি জানি না”। আমি বললাম। আমি এরকম কখনো শুনিনি। “তবে এটা জানার পর কি কেউ তাঁর কাজের আরো বেশি প্রশংসা করে?”

দেবোরা: উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা যদি আপনার কৌশল জানি যে আপনি ঢালু স্থানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করেন, এতে কি আপনার কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে আমাদের সাহায্য করবে?

মুরাকামি: ফ্রানজ কাফকা ঢালু জায়গা পছন্দ করতেন, এটি মিথ্যা। এটি আমার তৈরি করা। তবে এটা করে কি ভালো করলাম? খুব সম্ভবত ফ্রানজ কাফকা ঢালু জায়গা পছন্দ করতেন।

দেবোরা: এটা সম্ভব।

মুরাকামি: কিছু লোক এই উদ্ধৃতি দেয়। তবে আমি এটি তৈরি করেছিলাম। আমি অনেক কিছুই তৈরি করেছি।

দেবোরা: কল্পকাহিনিতে আপনি এটা তৈরি করতেই পারেন। যদি আমরা জানতে পারি যে আপনি বিড়াল ভালোবাসেন, এটা কি আমাদের আপনার কাজকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে?

মুরাকামি: আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন।

দেবোরা: তিনি আপনাকে চেনেন বলে কি আপনার কাজকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন?

মুরাকামি: আমি জানি না। সে বলে আমি তাঁর প্রিয় লেখক নই। তবে সে সবসময় আমার কাজকে খুব গুরুত্বের সাথে সমালোচনা করে। সে আমার প্রথম পাঠক। সুতরাং আমি যখন লেখা শেষ করে পাণ্ডুলিপিটা তাকে পাঠাই সে পড়ে এবং দু-শো ত্রুটি-সহ ফিরিয়ে দেয়। এই ত্রুটিগুলো আমি খুব অপছন্দ করি। সে বলে, “তোমার এই অংশগুলো পুনরায় লেখা উচিত!”

দেবোরা: তখন আপনি আবার লেখেন?

মুরাকামি: হ্যাঁ। তারপরে সেটা আবার তার কাছে পাঠিয়ে দিই। এবার সে একশোটি ত্রুটি-সহ পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দেয়। আগের থেকে কম ত্রুটি থাকে বলে ভালো লাগে।

প্রথম পাতা

Categories
অনুবাদ সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

দেবোরা: আপনি যখন অনুবাদ করেন, আপনাকে অন্য লেখকদের কণ্ঠস্বর গ্রহণ করতে হয়। আপনাকে এক অর্থে ফিটসগেরাল্ড, চ্যান্ডলার বা শেভার হতে হয়। আপনি যখন নিজের একটি স্টাইল আয়ত্ত করে ফেলেছেন তখন কি এটি একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়?

মুরাকামি: হ্যাঁ। আমি স্কট ফিটসগারেল্ডকে ভালোবাসি। তাঁর অনেকগুলি বই অনুবাদ করেছি। তবে তাঁর শৈলী আমার থেকে অনেকটাই আলাদা, সুন্দর এবং জটিল। তবুও আমি তাঁর লেখা থেকে অনেক কিছু শিখেছি— তাঁর মনোভাব, বিশ্বজগতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। রেমন্ড কার্ভারের শৈলী এবং তাঁর লেখার জগৎ আমার থেকে অনেক আলাদা। তবে আমি তাঁর থেকেও শিখেছি।

দেবোরা: জন শেভারের লেখা বর্তমানে আপনি অনুবাদ করছেন। কেন শেভার?

মুরাকামি: কেন শেভার? আমি বহু বছর ধরে তাঁর ছোটোগল্পগুলি আনন্দের সঙ্গে পড়ে আসছি। তবে শেভার জাপানে জনপ্রিয় নন। এখানে খুব কম লোকই তাঁর লেখা পড়েছে। কারণ, তাঁর শৈলী ভীষণ আমেরিকাপন্থী। আমার ধারণা, উনিশশো পঞ্চাশের দশক এবং এর মাঝামাঝি সময় আর মধ্যবিত্ত শ্রেণিই শুধু তাঁর লেখার উপজীব্য। আমি মনে করি না বেশি জাপানি পাঠক তাঁর লেখা পছন্দ করবে। তবে লেখাগুলো আমি খুবই ভালোবাসি। তাই এটি একধরনের চ্যালেঞ্জ।

দেবোরা: আপনি অন্য লেখকদের থেকে যা যা শেখেন সেগুলি আপনার লেখায় প্রবেশ করলে আপনি বুঝতে পারেন?

মুরাকামি: আমার মনে হয় একটু প্রভাব তো আছেই। আমি যখন লিখতে শুরু করি আমার কোনো পরামর্শদাতা ছিল না। আমার কোনো শিক্ষক ছিল না। আমার কোনো সাহিত্যিক বন্ধু ছিল না। আমার শুধু আমি ছিলাম। তাই আমাকে বই থেকে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে। ছোটোবেলায় আমি বই পড়তে পছন্দ করতাম। বাড়িতে আমি একমাত্র সন্তান ছিলাম। আমার কোনো ভাই বা বোন ছিল না। অবশ্যই আমার কাছে বই এবং বিড়াল ছিল। সংগীত তো অবশ্যই ছিল। আমি খেলাধুলা পছন্দ করতাম না, পড়তে পছন্দ করতাম। কৈশোর বয়সে আমি রাশিয়ান উপন্যাস পড়ি। দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় আমার প্রিয় ছিল। আর এদের বইগুলি থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এমন অনেক সহপাঠী ছিল যারা লেখক হতে চেয়েছিল। তবে আমি বিশ্বাস করতাম না যে, আমার প্রতিভা আছে। তাই আমি একটি জ্যাজ ক্লাব খুলি আর সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি।

দেবোরা: আপনি নিজে কখনো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছিলেন?

মুরাকামি: ছোটোবেলায় আমি পিয়ানো বাজাতাম। তবে এতে আমার বিশেষ প্রতিভা ছিল না। আমার বয়স যখন পনেরো বছর তখন আর্ট ব্লেকি এবং জ্যাজ মাসেঞ্জাররা জাপানে এসেছিলেন। সেই কনসার্টে আমি গিয়েছিলাম। এর আগে আমি জানতাম না, জ্যাজ কী, তবে সেই রাত থেকেই আমি একজন উৎসাহী জ্যাজ ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রেকর্ড সংগ্রহ করে গেছি। আমার স্ত্রী সবসময় অভিযোগ করত। আমার বাড়িতে কত যে জ্যাজ রেকর্ড রয়েছে! তবে আমি লেখার বিষয়ে সংগীত থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। আমি মনে করি এতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে, ছন্দ, সাংগীতিক ঐকতান আর তাৎক্ষণিক উন্নতিকরণ। আমি সাহিত্য থেকে নয়, সংগীত থেকে এই জিনিসগুলি শিখেছি। এবং যখন আমি লিখতে শুরু করি তখন ভাবটা এমন থাকে যেন আমি গান বাজনা করি।

দেবোরা: আপনার মা-বাবা দু-জনেই সাহিত্যের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁরা কি আপনার লেখার সিদ্ধান্ত বিষয়ে খুশি হয়েছিলেন? তাঁরা কি আপনাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে বলেছিলেন?

মুরাকামি: তা আমি মনে করি না। আমি জানি না তারা আমার কাছ থেকে কী আশা করেছিল।

দেবোরা: শেষবার আমরা যখন কথা বলেছিলাম আপনি বলেছিলেন, ৯/১১ বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। কেবল আসল পৃথিবীকেই নয়, আপনি যে পৃথিবী নিয়ে লিখতে চান সেখানেও এই সংকটগুলি প্রভাব ফেলেছিল মনে হয়। আপনি কি মনে করেন যে, জাপানের সুনামি এবং ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয়ের মতো ঘটনাগুলি আপনার কল্পকাহিনিগুলোকে বদলে দিয়েছে?

মুরাকামি: হ্যাঁ। ১৯৯৯ সালে কোবে ভূমিকম্পের পর আমি ‘আফটার কোয়েক’ নামে ছোটোগল্পের একটি সংকলন লিখেছিলাম। আমার মা-বাবার ঘর-সহ পুরো কোবে শহরটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন ম্যাসাচুসেটসে ছিলাম। তারপর চার বছর কাটিয়েছি যুক্তরাজ্যে। বলতে গেলে তখন আমি একপ্রকার প্রবাসীই হয়ে পড়েছিলাম। তবে টিভিতে দেখেছিলাম দৃশ্যগুলো। ঔপন্যাসিক হিসেবে তখন আমি ভাবছিলাম, এই ভূমিকম্প বিষয়ে আমি কী করতে পারতে পারি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি যা করতে পারি তা হল ভূমিকম্পের সময়টায় ঠিক কী হয়েছিল তা শুধু কল্পনা করতে। তাই এটা আমার কাছে কল্পনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি যখন কোনো উপন্যাস লিখি তখন গবেষণা করি না। কারণ, কল্পনা আমার সম্পদ, আমার উপহার। আমি এটি পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাই। ওই একই বছর, এর দুই মাস পরে টোকিওর একটি পাতাল রেল ট্রেনে সারিন-গ্যাস দ্বারা আক্রমণ হয়েছিল। আমি তখন জাপানে ছিলাম না। আমি খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনে এই বিষয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি যা পড়তে চেয়েছিলাম তা ওই লেখায় পাইনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম সত্যি কী ঘটেছিল সেদিন ওই ট্রেনে। ভরতি ট্রেনে গ্যাসের গন্ধ নেওয়ার মতো বাস্তব অবস্থাটা আমি জানতে চেয়েছিলাম। তাই আমি নিজের মতো এই জিনিসগুলি খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি সারিন-গ্যাসে ক্ষতিগ্রস্তদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং তাদের প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছি আসল ঘটনা। তারা আমাকে বলে আসলে কী ঘটেছিল। আমি এই বিষয়গুলি নিয়ে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামে একটি প্রবন্ধধর্মী বই প্রকাশ করি। অন্য কেউ এটা করেনি বলে আমাকেই এটা করতে হয়েছে। তাছাড়া আমার নিজস্ব জিজ্ঞাস্য আর কৌতূহলও ছিল। এই সাক্ষাৎকারগুলি নিতে আমার একবছর সময় লেগেছিল। আমি মনে করি ওই একবছর আমাকে বদলে দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাটা ছিল দারুণ। সেই একবছর আমি কিছুই লিখিনি। আমি কেবল সেই কণ্ঠস্বরগুলো শুনেছি। সেগুলি এখনও আমার মনের মধ্যে আছে। আমি সেই শুদ্ধ স্বরগুলোকে বিশ্বাস করি। ট্রেনে চড়া মানুষগুলো ছিল সাধারণ মানুষ। তারা টোকিয়োর এক সকালে ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই কেউ সারিন গ্যাসে ভরতি প্লাস্টিকের ড্রাম দ্বারা আক্রমণ করে এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন মারা যায়। পরিস্থিতি ছিল এমনই অতিবাস্তবিক। তবে তাদের কণ্ঠস্বর ছিল সাধারণ। আউম শিনরিকো সম্প্রদায়ের মানুষেরা (যারা আক্রমণ করেছিল) সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাঁরা হয়তো এর মাধ্যমে একরকম সত্য বা পরম সত্যের সন্ধান করছিলেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা সাধারণ যাত্রী ছিলেন। আমি শিনরিকো সম্প্রদায়ের মানুষদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁদের কথা আমার মনে ধরেনি।

দেবোরা: গ্যাস আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় আপনি কঠিন সত্যের খোঁজ করেছিলেন, কিন্তু ভূমিকম্পের কথা বলতে গিয়ে আপনি কেন আংশিক কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন?

মুরাকামি: কারণ, কোবে আমার নিজের শহর এবং ঘটনাটা খুবই বেদনার। সেখানে আমার অনেক বন্ধু আছে। আমি যদি এই লোকগুলির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতাম তবে আমি খুব হতাশ হয়ে পড়তাম। কিন্তু কাহিনিতে আমি আমার নিজস্ব জগৎ তৈরি করতে পারি। তাই এটি আমার পক্ষে সহজতর ছিল। সহিংসতা আপনার মন আর শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছুর বিনাশ হয়ে যেতে পারে এর ফলে। ভূমিকম্পের আগে আমরা ভেবেছিলাম ভূমিস্তর খুব শক্তপোক্ত। কিন্তু এখন আর তা নেই। এটা হয়ে উঠতে পারে অস্থির, অনির্দিষ্ট, নরম। আমি হয়তো এটাই লিখতে চেয়েছিলাম।

এরপর ৯/১১, সুনামি-সহ আরও অনেক বিপর্যয় ঘটেছিল। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বিপর্যস্ত মানুষগুলির জন্য আমি কী করতে পারি। উত্তরটা এইরকম যে, আমি শুধু পারি ভালো সাহিত্য রচনা করতে। কারণ, আমি যখন একটি ভালো গল্প লিখি তখন আমরা একে অন্যকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। আপনি যদি পাঠক হন আমি একজন লেখক। আমি আপনাকে চিনি না। তবে সাহিত্যের অন্তর্জগতে আমাদের মধ্যে এক গোপন যোগাযোগের পথ রয়েছে। আমরা অবচেতন পথে একজন অন্যকে বার্তা পাঠাতে পারি। এইভাবে আমি মনে করি অবদান রাখতে পারি।

দেবোরা: আপনি লেখার মাধ্যমে বার্তা পাঠান। কিন্তু আপনি নিজে বার্তা ফিরে পান কী করে?

মুরাকামি: আমি জানি না। একটি উপায় হয়তো আমরা বের করতে পারব।

দেবোরা: ‘কাফকা অন দ্য শোর’ উপন্যাসটি প্রকাশের পর আপনার ওয়েবসাইটে বইটি সম্পর্কে পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। আপনি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছিলেন। আপনি কেন এটা করলেন? শুধু এই বই নিয়ে কেন?

মুরাকামি: আমি পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানতে উৎসুক ছিলাম (২০১৫ সালেও এইরকম করেছিলাম)। সীমিত সময়ের জন্য ছিল এই ব্যবস্থা। তবে আমি অনেকগুলো মেইল পেয়েছিলাম। আমার মনে নেই কতগুলো। ত্রিশ হাজার হবে সম্ভবত। তবে আমি সেগুলো পড়েছি এবং চোখের ক্ষতি করেছি। আমি সম্ভবত তিন হাজারের উত্তর দিয়েছি। খুব পরিশ্রমের ছিল ব্যাপারটা। তবে আমার মনে হয় আমি এটা জানতে পেরেছি যে, কী ধরনের পাঠক আমার বই পড়ছে। এবং আমার লেখা সম্পর্কে তারা কী ভাবছে সে সম্পর্কে আমি একটা অস্পষ্ট ধারণা পেয়েছি। তাদের মধ্যে কিছু বোকা বোকা প্রশ্নও ছিল। একজন আমাকে স্কুইডের কর্ষিকা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। স্কুইডের দশটি কর্ষিকা রয়েছে এবং সে জানতে চেয়েছিল তাদের হাত পা আছে কিনা। তিনি কেন সে এইরকম প্রশ্ন করলেন? আমি উত্তর দিয়েছিলাম এইভাবে: স্কুইডের বিছানার পাশে আপনি দশটা গ্লাভ অথবা দশটা মোজা রেখে দিন। সে যখন জেগে উঠবে তখন হয় গ্লাভ নয়তো মোজা বেছে নেবে। এইভাবে আপনি আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন। আমি অবশ্য জানি না স্কুইড বিছানায় ঘুমায় কিনা। তবে আমি বেশিরভাগ প্রশ্নই উপভোগ করেছিলাম।

দেবোরা: এটা ছিল পাঠকদের সংস্পর্শে থাকার একটা উপায়। আমি জানি যে আপনি জাপানে কোনো অনুষ্ঠান বা সেখানে কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন না। কেন এমন?

মুরাকামি: আমি একজন লেখক। এবং আমার কাছে লেখাই একমাত্র কাজ। আমি একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, লেখালেখি ছাড়া আমি আর কিছুই করব না। তবে সম্প্রতি আমি ডিস্ক-জকির কাজ করছি। টোকিয়োর একটি এফএম রেডিয়ো স্টেশন থেকে আমাকে ডিস্ক-জকির কাজ করতে বলা হয়েছিল। আমি এখন ওই কাজটি করছি।

শেষ পাতা

Categories
অনুবাদ সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

দেবোরা: আপনি বলেছেন যে আপনার প্রথম বই দু-টি লেখা খুব সহজ ছিল। তারপর লেখা কঠিন হয়ে পড়ে। আপনি কীরকম সমস্যার সম্মুখীন হন?

মুরাকামি: আমার প্রথম দুটো বই ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’, ‘পিনবল ১৯৭৩’ লিখতে আমার সহজ মনে হয়েছিল। কিন্তু বইগুলো নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই। এ-দুটো লেখার পর আমি উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠি। তারপর আমি লিখেছিলাম, ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’, আমার প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উপন্যাস (অন্য দু-টি উপন্যাসিকার মতো ছিল)। এটি লিখতে আমার তিন-চার বছরের মতো সময় লেগেছিল। আমার ধারণা, ওই প্রস্রবনের জন্য আমাকে সত্যি একটা গর্ত খুঁড়তে হয়েছিল। সুতরাং, আমি মনে করি ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ আমার কেরিয়ারের প্রকৃত সূচনাবিন্দু ছিল। প্রথম তিন বছর আমি জ্যাজ ক্লাবের মালিক হিসেবে কাজ করার সময় লিখেছিলাম। রাত দুটোয় ক্লাবের কাজ শেষ করে রান্না ঘরের টেবিলে লিখতে বসে যেতাম। এটা ছিল আমার পক্ষে খুব কষ্টের। প্রথম দুটো বইয়ের পর আমি সিদ্ধান্ত নেই যে ক্লাব বিক্রি করে দেব এবং পূর্ণ সময়ের লেখক হব। কিন্তু ক্লাবটি তখন ভালোই চলছিল এবং সবাই আমাকে ওটা বিক্রি করতে বারণ করেছিল। তারপরে আমি লিখতে পারলাম ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’। আমি এই ধরনের একটি বড়ো বই লিখতে চেয়েছিলাম।

দেবোরা: বড়ো বই লেখা সহজ ছিল, না আরও চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠেছিল?

মুরাকামি: আমি যখন ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ লিখছিলাম তখন আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম। কারণ, আমি জানতাম না যে এর পরে কী ঘটবে। পরবর্তী ঘটনা জানার জন্য আমি পরের দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে পারতাম না। আমি পরের পৃষ্ঠাগুলি ওলটাতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরে কোনো পৃষ্ঠা ছিল না, তাদেরকে আমায় লিখতে হয়েছিল।

দেবোরা: আপনার কি এমন কখনো হয়েছে যে, পরে কী ঘটবে তা আপনার অজানা ছিল এবং সেদিন আর লিখতে পারেননি?

মুরাকামি: আমি কখনো রাইটার্স ব্লক অনুভব করিনি। একবার আমি ডেস্কে বসতে পারলে জানি যে পরে কী ঘটবে। আমি লিখতে না চাইলে লিখি না। পত্রিকা সবসময় আমাকে কিছু না কিছু লিখতে বলে এবং আমি প্রতিবারই ‘না’ বলে দেই। আমি যখন লিখতে চাই তখনই লিখি।

দেবোরা: আপনি কি মনে করেন আপনার ঘুমের মধ্যেও প্লটগুলি সক্রিয় থাকে?

মুরাকামি: না, এটা মনে করি না। আমি স্বপ্ন দেখি না। গল্প লেখা আর স্বপ্ন দেখা আলাদা জিনিস। আর আমার কাছে লেখা স্বপ্ন দেখার মতোই। আমি যখন লিখি তখন ইচ্ছা করে স্বপ্ন দেখতে পারি। শুরু করতে পারি আবার থামতেও পারি। এমনকী পরের দিনও সেটা চালিয়ে নিতে পারি। আপনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হয়তো একটি ভালো মাংসের খাবার, একটি ভালো বিয়ার বা একটি সুন্দর মেয়ের স্বপ্ন দেখেন এবং যখন জেগে ওঠেন তখন সব শেষ হয়ে যায়। আমি কিন্তু পরের দিন সেটা চালিয়ে নিতে পারি।

দেবোরা: কয়েক বছর আগে আপনি বলেছিলেন যে, আপনি যখন কোনো উপন্যাস লেখেন তখন কিছু ধারণা বা বাক্যাংশের একটি তালিকা তৈরি করে নেন, যেমন, ‘কথাবলা বানর’ বা ‘সিঁড়িতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া লোক’ প্রভৃতি। আপনি যখন লিখতে বসেন, আপনি বলেছিলেন “প্রতিটা গল্পে অবশ্যই এই তালিকা থেকে দুই বা তিনটি জিনিস থাকতে হবে”। আপনি কি প্রায়শই এভাবে কাজ লেখালেখি করেন?

মুরাকামি: আমি তখন এক সময়ে ছয়টি গল্প লিখেছিলাম। তাই ওই লেখাগুলির সাহায্য নিতে হয়েছিল। উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা দরকার হয় না। আমার চেষ্টা থাকে প্রতিবার নতুন কিছু করা। আমার বেশিরভাগ বই আমি প্রথম পুরুষে লিখেছিলাম। ‘১৯৮৪’ (1Q84)-তে আমি তিনটি চরিত্র প্রথম পুরুষে লিখেছি। এটা আমার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রায়শই আমার গল্পের কথক প্রধান চরিত্রটি এমন একজন ব্যক্তিতে পরিণত হয় যে কিনা আমি হতে পারতাম। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সেটা হয় না। পরিবর্তে পরিণত হয় আমার একধরনের বিকল্পে। অবশ্যই বাস্তবে আমি নিজে অন্য মানুষে পরিণত হতে পারি না। তবে সাহিত্যে আমি যে কেউ হতে পারি। আমি অন্যের জুতোতে পা রাখতে পারি। একে একধরনের থেরাপি বলতে পারেন। আপনি যদি লিখতে পারেন তবে আপনার মধ্যে এমন এক সম্ভাবনা তৈরি হবে যে আপনি স্থির থাকতে পারবেন না, অন্য যে-কেউ হয়ে যেতে পারেন।

দেবোরা: আপনি যখন লিখতে শুরু করেছিলেন সেই একই সময়ে আপনি দৌড়ানোও শুরু করেন। আমি জানি কিছু মানুষ চলতে চলতে আপন মনে লিখতে পছন্দ করেন। হাঁটার ছন্দ তাদের এই কাজে সাহায্য করে। আপনি দৌড়ানোর সময় কখনো লেখার কথা ভেবেছেন?

মুরাকামি: একদম না। আমি দৌড়ানোর সময় শুধু দৌড়াই। তখন আমি মনকে খালি রাখি। দৌড়ানোর সময় আমি কী ভাবি সেই সম্পর্কে আমার কোনো পরিকল্পনা থাকে না। হয়তো কিছুই ভাবি না। তবে আপনি অবশ্যই জানেন যে দীর্ঘ সময় ধরে লিখতে গেলে আপনাকে দৃঢ় হতে হবে। একটি বই লিখে ফেলা এমনিতে কঠিন নয়, তবে অনেক বছর ধরে লেখা চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আপনার একাগ্রতা আর সহনশীলতার শক্তি প্রয়োজন। আমি মাঝে মাঝে খুব আস্বাস্থ্যকর আর অদ্ভুত জিনিস লিখি। আমি মনে করি আপনি অস্বাস্থ্যকর জিনিস লিখতে চাইলে আপনাকে খুব স্বাস্থ্যবান হতে হবে। এটি একটি প্যারাডক্স, তবে সত্যি। বোদল্যেরের মতো কিছু লেখক খুব অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করেছিলেন। তবে আমার মতে সেই দিন আর নেই। এখনকার বিশ্ব খুব কঠোর আর জটিল। এগুলো কাটিয়ে উঠে বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে শক্তপোক্ত হতে হবে। আমি যখন তিরিশ বছর বয়সী তখন আমি লেখা শুরু করেছি। আমার যখন বত্রিশ বা তেত্রিশ বছর বয়স তখন দৌড়তে শুরু করি। আমি প্রতিদিন দৌড়ানো শুরু করলাম। কারণ, এর ফলে কী হয় তা আমি দেখতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয় জীবন একধরনের পরীক্ষাগার, যেখানে আপনি যা কিছু করতে পারেন। এবং শেষ পর্যন্ত এটি আমার পক্ষে লাভদায়ক হয়ে উঠেছিল। আমার শরীর এতে দৃঢ় হয়ে উঠেছিল।

দেবোরা: লেখা দৌড়ানোর মতো একটি নির্জন সাধনা। আপনি একটি জ্যাজ ক্লাবের মালিকের জীবন থেকে লেখায় চলে এসেছিলেন। সেখানে সবসময় আপনার চারপাশে লোকেরা ভিড় করে থাকত। কিন্তু তারপর লেখা আর পড়াশুনায় একদম একা হয়ে থাকতে কি আপনার ভালো লাগত?

মুরাকামি: আমি খুব একটা সামাজিক জীব নই। আমি প্রচুর রেকর্ড এবং সম্ভবত বিড়ালদের সাথে শান্ত জায়গায় একা থাকতে চাই। আর বেসবল খেলা দেখার জন্য কেবল টিভি। ব্যাস, আমি এইটুকুই চাই।

দেবোরা: আপনি একবার বলেছিলেন যে, আপনার জীবনের স্বপ্ন ছিল কূপের তলদেশে বসা। আপনার বেশ কয়েকটি চরিত্র ঠিক তেমনটি করেছে। ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’-এ মেনশিকিও এমন করেছে। কেন?

মুরাকামি: আমি কূপ খুব পছন্দ করি। আমি ফ্রিজ, হাতি এমন অনেক জিনিস পছন্দ করি। আমি যা পছন্দ করি সে-সম্পর্কে লিখে খুব আনন্দ পাই। আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন আমাদের বাড়িতে একটি কূপ ছিল এবং আমি সবসময় সেই কূপটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তাতে আমার কল্পনাশক্তি বেড়ে গিয়েছিল। শুকনো কূপে পড়ে যাওয়া নিয়ে রেমন্ড কার্ভারের একটি ছোটোগল্প আছে। আমি সেই গল্পটি খুব পছন্দ করি।

দেবোরা: আপনি কখনো কোনো কূপের নীচে যাবার চেষ্টা করেছেন?

মুরাকামি: না না। এটা বিপজ্জনক। এটা আমার কল্পনায় ঘটে। তবে আমি গুহাও পছন্দ করি। আমি যখন বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করি, তখন যদি কোনো গুহা দেখি আমি তার মধ্যে প্রবেশ করি। উঁচু স্থান আমার পছন্দ হয় না।

দেবোরা: আপনি উপরে না উঠে নীচে যেতে চান?

মুরাকামি: কেউ বলে এটা অবচেতন মনের একধরনের রূপক। তবে আমি ভূ-গর্ভস্থ বিশ্ব সম্পর্কে খুবই আগ্রহী।

দেবোরা: কয়েক বছর আগে প্যারিস রিভিউ সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন যে, আপনার গল্পের চালিকাশক্তি হল “হারিয়ে যাওয়া এবং অনুসন্ধান এবং খুঁজতে থাকা”। আপনি কি এখনও এতে বিশ্বাস করেন?

মুরাকামি: হ্যাঁ। হারানো কিছুর সন্ধান করা আমার সাহিত্যের খুব গুরুত্বপূর্ণ থিম। আমার চরিত্রগুলো প্রায়শই হারিয়ে গেছে এমন কিছুর সন্ধান করে থাকে। কখনো একটি মেয়ে, কখনো একটি কারণ, কখনো বা এটি একটি উদ্দেশ্য। কিন্তু তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু খোঁজে, যা হারিয়ে গিয়েছিল। তবে সেটা খুঁজে পেলে একরকম হতাশা সৃষ্টি হবে। কেন তা আমি জানি না, তবে কোনো কিছুর অনুসন্ধান আমার গল্পের একধরনের মোটিফ। যদিও এটা কোনো আনন্দদায়ক সমাপ্তি নয়।

দেবোরা: প্রায়শই আপনি যে-পুরুষদের সম্পর্কে লেখেন তারা আবেগগতভাবে বা অস্তিত্বহীন হয়ে কোনোরকমভাবে হারিয়ে যায়। এগুলো পৃথিবীতে খুব একটা হয় বলে মনে হয় না।

মুরাকামি: আপনি অবশ্যই জানেন যে, গল্পের মূল চরিত্র যদি সুখী হয় তবে কোনো গল্প তৈরির সম্ভাবনা থাকে না।

দেবোরা: আপনার উপন্যাসগুলি সাধারণত একটি রহস্যের চারদিকে ঘোরে। কখনো আপনি সেই রহস্যটি সমাধান করেন এবং কখনো সমাধান না করে ছেড়ে দেন। আপনি কি পাঠকদের জন্য বিষয়গুলি উন্মুক্ত রাখতে চান, না আপনি নিজে সমাধান বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন না?

মুরাকামি: আমি যখন কোনো বই প্রকাশ করি মাঝে মাঝে আমার বন্ধুরা ফোন করে জিজ্ঞাসা করে, “এর পরে কী হবে?” আমি বলি, “এখানেই শেষ”। তবে পাঠকেরা এর সিক্যুয়েল আশা করে। ‘১৯৮৪’ (1Q84) প্রকাশিত হবার পর গল্পের পরবর্তীতে কী ঘটবে তার সমস্ত কিছুই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি একটি সিক্যুয়েল লিখতে পারতাম কিন্তু লিখিনি। আমি ভেবেছিলাম এটি ‘জুরাসিক পার্ক ৪’ বা ‘ডাই হার্ড ৮’-এর মতো হতে পারে। তাই আমি সেই গল্পটি কেবল আমার মনের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম এবং এটি আমি খুব উপভোগ করেছি।

দেবোরা: আপনি কি মনে করেন সেটা কখনো লিখবেন?

মুরাকামি: আমি তা মনে করি না। আমি শুধু জানি এটি আমার মনের মধ্যে থাকবে। তেঙ্গোর ষোলো বছরের মেয়ে সিক্যুয়েলের মূল চরিত্র হবে, এটি খুব আকর্ষণীয় গল্প।

দেবোরা: তারপরেও এটা কোনো ‘ডাই হার্ড ৮’ নয়!

মুরাকামি: এবং সেই বইয়ের একটি প্রিক্যুয়েল রয়েছে।

দেবোরা: শুধু আপনার মনের মধ্যে?

মুরাকামি: হ্যাঁ।

দেবোরা: কিছু লেখক প্রতিটি বইয়ে সম্পূর্ণ নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। এবং কিছু লেখক যে পদ্ধতি তার পক্ষে সবচেয়ে ভালো হবে সেটাই চেষ্টা করেন। আপনি কোনটির পক্ষে?

মুরাকামি: কাজুয়ো ইশিগুরোর লেখা আমি পছন্দ করি। সে আমার বন্ধু। যতবারই সে নতুন বই প্রকাশ করে সেটি আগের থেকে আলাদা হয়। এটি খুব আকর্ষণীয় বিষয়। তবে আমার পক্ষে থিম আর মোটিফগুলো এত আলাদা নয়। আমি সিক্যুয়েল লিখতে পছন্দ করি না। তবে বইগুলির পরিমণ্ডল একে-অপরের চেয়ে আলাদা নয়। আমি শুধু একজন ব্যক্তি এবং আমার নির্দিষ্ট উপায় আছে বলে মনে করি। এটা আমি পরিবর্তন করতে পারি না। তবে আমি একই জিনিস বারবার লিখতে চাই না।

দেবোরা: আপনার নিজস্ব শৈলীতে প্রায়শই জটিল বা গভীর কল্পনা থাকে কিন্তু লেখা সেরকম হয় না। বাক্যগুলি বেশ সহজ এবং হালকা। এই বৈপরীত্য কি উদ্দেশ্যমূলক?

মুরাকামি: অনেক লেখক জটিল জটিলতর স্টাইলে তুচ্ছ অগভীর জিনিস লেখেন। আমি চাই কঠিন ও জটিল জিনিসগুলি খুব সহজ শৈলীতে লিখতে, যা পড়া সহজতর এবং আরামদায়ক। এই কঠিন জিনিসগুলি লিখতে গেলে আপনাকে আরও গভীর আর গভীরতর হতে হবে। সুতরাং চল্লিশ বছর ধরে লিখতে লিখতে আমি তার জন্য একটি কৌশল তৈরি করেছি। এটি একটি শারীরিক কৌশলের মতো, কোনো বৌদ্ধিক কৌশল নয়। আমি মনে করি আপনি যদি কোনো কথাসাহিত্যিক হন এবং আপনি যদি খুব বুদ্ধিমান হন তবে আপনি লিখতে পারবেন না। আপনি যদি নির্বোধ হন তাহলেও লিখতে পারবেন না। এর মধ্য থেকে আপনাকে একটা অবস্থান খুঁজে নিতে হবে। এটা খুব কঠিন।

দেবোরা: আপনি কি মনে করেন আপনার লিখনশৈলী অনুবাদে ধরা পড়েছে?

মুরাকামি: হ্যাঁ। কেন জানি না, তবে যখন আমি আমার বইগুলি ইংরেজিতে পড়ি তখন আমার মনে হয়, ওহ্‌, এ তো আমিই! ছন্দ, গদ্যশৈলী একই— প্রায় একই।

দেবোরা: আপনি নিজেই একজন অনুবাদক। আপনি এফ. স্কট ফিটজগারেল্ড, ট্রুম্যান কাপোতে, রেমন্ড চ্যান্ডলার এবং অন্যন্যদের লেখা জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এখন আপনি অনুবাদ করছেন জন শেভারের লেখা। লেখকদের কোন দিকগুলি আপনাকে অনুবাদে প্রণোদিত করে?

মুরাকামি: এটি বলা সহজ। আমি যা পড়তে চাই তা অনুবাদ করি। আমি রেমন্ড চ্যান্ডলারের সমস্ত উপন্যাস অনুবাদ করেছি। আমি তাঁর স্টাইলটি পছন্দ করি। আমি পাঁচ বা ছয়বার ‘দ্য লং গুডবাই’ পড়েছি।

তৃতীয় পাতা

Categories
প্রবন্ধ

সুজিৎ দে’র প্রবন্ধ

মুর্শিদাবাদের বোলান গান: সাধারণ পরিচয়

চৈত্র মাস শেষের দিকে। বছর শেষ হবে। সারা বছর ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষগুলির মনে কীসের এত ফুর্তি! ও শিবের গাজন আসছে। শরতের চারদিন যেমন বাঙালির ঘরের মেয়ে ঘরে ফেরে; চৈত্রের শেষ চারদিন তেমনি বুড়ো শিবের। এই শিবের গাজন আর তাকে কেন্দ্র করে ‘বোলান’ গান পল্লিমায়ের চিরদুঃখী সন্তানগুলিকে মাতিয়ে রাখে এ-সময়।

এমন চিত্র ছিল আগের বছর পর্যন্ত। আর এ-বছর করোনার মৃত্যু ভয়ে কুঁকড়ে আছে তারা। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে জীবন আর জীবিকার তাগিদে আজ তারা অসহায়। একটা একটা করে উৎসবকে ছেড়েছে তারা। মনমরা হয়ে ভাতে মরার দিন যেন সামনে এগিয়ে আসছে। থেমে যাওয়া উৎসবের স্মৃতিচারণায় এই প্রবন্ধের আয়োজন।

বোলান= বোল + আন। যার অর্থ কথা বলা, প্রতিবচন, উত্তর। বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্য যুগের অনেক ক্ষেত্রে ‘বোলান’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়—

“বোলান বুলিতে গেল ময়না বসতি” (রূপরাম চক্রবর্তী/ধর্মমঙ্গল) [১]

“ঘরে গেল্যা না দিয়া বুলান” (কবিকঙ্কণ) [২]

“ডাকিলে বোলান ন দেও” (মনসামঙ্গল/বিজয়গুপ্ত) [৩]

রূপরামের ধর্মমঙ্গলে ‘বোলান’ হল মানসিক ব্রত। কবিকঙ্কণ ও বিজয়গুপ্তের রচনায় ‘বোলান’-এর অর্থ উত্তর-প্রত্যুত্তর বা কথা বলা। নাথপন্থী শৈব যোগী, পশ্চিম ভারতের নিরঞ্জন নাথপন্থী প্রমুখ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বোলান’-এর প্রচার দেখা যায়। ডঃ সুকুমার সেন মহাশয় তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে উত্তর রাঢ়ের মনোহরশাহি পরগণা থেকে একটি ‘বোলান’ গানের নমুনা তুলে এনেছেন—

“যতগুলি বললাম বোলান গো
আরও বলতে পারি
ওস্তাদের নাম অকিঞ্চন
তেঁতুল তলায় বাড়ি
যার বাড়িতে জমি
তোমরা এবার বোলান বল
আমরা এবার বসি।।” [৪]

বর্তমানে মুর্শিদাবাদে যে-বোলান গান প্রচলিত আছে তা মূলত শিবের গাজনকে কেন্দ্র করেই। তবে কখনো কখনো অন্য কোনো অনুষ্ঠান বা মেলায় বোলানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। চৈত্রের শেষ চারদিন যে-শিবের গাজন হয় তার কিছুদিন আগে থেকেই বোলান দলগুলির মধ্যে সাজ সাজ রব ওঠে। তারা তিন-চার দিন ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে বোলান গান করে বেড়ায়। এ হল পালা বোলান। আর এক প্রকার বোলান আছে তাকে বলে ‘সাধলে বোলান’; বা ‘সাজলে বোলান’। শিবের গাজনের বা ধর্মরাজের ভক্তরাই এ-বোলান করে। অন্যদের এ-বোলান করার অধিকার নেই। শিবের গাজন ছাড়াও ‘সর্বমঙ্গলা’ বা ‘শেতলা’ পুজোর সময়ও বোলানের আয়োজন করা হয় অনেক সময়।

সাজলে বোলান ও পালা বোলান উভয়ই প্রচলিত আছে এখন। শিবের ভক্তরা করে সাজলে বোলান। তা মূলত পূজা পদ্ধতির অঙ্গ। আর পালা বোলানে একদিকে যেমন থাকে পালাবন্দী নাটক অন্য দিকে সংগীতের বহুল প্রয়োগ। আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে নারীবেশী পুরুষের চটুল নৃত্য। বন্দনা গান, পালা অভিনয় আর রং পাঁচালির মধ্য দিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করে থাকে কুশীলবরা। গানগুলি অবশ্যই লোকসংগীতের ধারাটিকে বজায় রেখে চলেছে।

বোলান গানকে বলতে হয় আনুষ্ঠিক বা পূজাকেন্দ্রিক লোকসংগীত। পালার প্রয়োজনে গানগুলি লোকসমাজের দ্বারাই রচিত হয়। কোনো একক ব্যক্তির দ্বারা এ-গান রচিত হয় না। দলের বিভিন্ন সদস্যদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক প্রসূত এই গান। গানগুলির প্রচার ও প্রসার ঘটে লোকমুখে। তাই পাঠভেদ লক্ষ করা যায় অনেক ক্ষেত্রেই। সুরে থাকে আঞ্চলিকতার ছোঁয়া। প্রেম, আনন্দ, অভিমান বা চরম দুঃখ প্রকাশে এর প্রয়াগ। ‘ভিখারি ঈশ্বর’ নামক একটি সামাজিক পালায় দাদা ঈশ্বর তার ভাইয়ের বিয়ের আনন্দে গান গাইছেন—

“আজকে আমার ভায়ের বিয়ে খুশীর সীমা নায়
আয়রে তোরা সবাই মিলে আয়রে ছুটে আয়
আনন্দেতে সবাই যখন শাঁক বাজাবে
পালকি এসে ভায়কে আমার নিয়ে যাবে।” [৫]

এর ভাষা নিতান্ত সহজ সরল। আর সুরে আঞ্চলিকতা থাকলেও বাংলা বা হিন্দি সিনেমার গান কিংবা প্রচলিত জনপ্রিয় কোনো গানের সুরকে অনুসরণের চেষ্টা করা হয় লোক আকর্ষণের জন্যই। পদ বা পদসমষ্টির পুনরাবৃত্তি অবশ্যই থাকে গানে। মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং বর্ধমানের কিছু অঞ্চলের লোকসমাজই এ লোকসংগীতের জন্মদাতা ও পৃষ্ঠপোষক।

সামাজিক নানা বিষয়, মনগড়া নানা কাল্পনিক কাহিনির পাশাপাশি পৌরাণিক কাহিনির দেখা মেলে বোলান পালায়। অবশ্যই লোকমুখে প্রচলিত পুরাণ। তাই কোনো গ্রন্থের সাথে এর সত্যতা যাচাই করা অর্বাচীনের কাজ হবে। শিল্প শাসনের বাধা মানে না বোলান। তাই লোকরুচি ও চাহিদা অনুযায়ী এর পরিবর্তন ঘটে চলেছে। নৃত্য এর একটি জরুরি অঙ্গ। সূক্ষ্ম ভাবের প্রকাশ করতে গিয়ে সুনিপুণ অভিনয় সেখানে হয় না। জোড়ালো ও গম্ভীর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সংলাপ ও গান পরিবেশিত হয়। পূজা মণ্ডপের মাঝে একটু জায়গা করে নিয়ে, চারিদিকে দর্শকের উপস্থিতিতে কুশীলবরা অভিনয় করে চলে।

একইসঙ্গে গান ও অভিনয়ের প্রাধান্যে বোলান লোকসংগীত ও লোকনাট্যের বিমিশ্র রূপ হয়ে উঠেছে। গানের মধ্য দিয়েই বোলানের সূচনা, গানের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি। মূল পালার মাঝেও সংগীতের ব্যবহার একটু বেশিই। বোলানের প্রাচীন রূপে সংগীত ছিল প্রধান। সংলাপ ছিল সংগীতের মেলবন্ধনকারী। বর্তমানে সংলাপের প্রাধান্য এলেও সংগীত তার নিজের জায়গাটি ছেড়ে দেয়নি। গীতিপ্রধান এই বোলানকে গীতিনাট্যও বলা যায়—

“বোলান গান গীতি প্রধান রচনা। সেই জন্য ইহাদের গীতিনাট্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে”। [৬]

ধর্মঠাকুর ও শিবের গাজনকে কেন্দ্র করে মূল সন্ন্যাসী গাঁয়ের পথে পথে ঘুরে যে-তর্জা, ছড়া বলে তার নাম বোলান। শিবের গাজনের ভক্তরা তাদের পূজার অঙ্গ হিসেবে লোকের বাড়ি বাড়ি কিংবা তাদের ইষ্ট দেবতার সামনে যে-গান বা ছড়া পরিবেশন করে তাই সাজলে বোলান। ডঃ সুকুমার সেন মনে করেছেন সাজলে বোলানই হল বোলানের আদি রূপ। সাজলে বোলানের একটি নমুনা—

“আরে সাজলে
ধুল ধুল সাজলে ধুল ধুল ধুল
পড়েছে মায়ের পাতা উদম করে চুল।
আরে সাজলে
শ্মশানে গিয়েছিলাম মশানে গিয়েছিলাম
সঙ্গে গিয়েছিল কে ?
কার্তিক গণেশ দুই ভাই সঙ্গে সেজেছে।
আরে সাজলে কাল বাঞ্ছা খেয়েছিল টুকই ভরা মুড়ি
আজ বাছার মুণ্ডু যায় ধুলায় গড়াগড়ি।।
আরে সাজলে
তুই তো মেরা ভাই সাজলে তুই তো মেরা ভাই
তোর সাথে গেলে সাজলে শিব দর্শন পাই।
আরে সাজলে
ভাল বাজালি ঢেকো ভেয়ে
তোর মা আমার মামি…” [৭]

সাজলে বোলান কেবলমাত্র গাজনের ভক্তরাই গাইতে পারে। অন্যদের অধিকার নেই। সাজলে বোলানের রূপটি বেশি পরিবর্তন হয়নি। দেবতাদের উদ্দেশে প্রণাম জানাতে এবং গ্রামবাসীর মঙ্গল কামনায় আজও এ-ধরনের গান গাওয়া হয়।

শেষ পাতা

Categories
সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

[২০০৮ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ‘দি নিউ ইয়র্কার ফেস্টিভ্যাল’-এ হারুকি মুরাকামির সঙ্গে কথপোকথন থেকে এই সাক্ষাৎকার সংকলিত। ‘দি নিউ ইয়র্কার’-এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দেবোরা স্টেইনম্যান।]

মুরাকামি: আমি যখন দশ বছর আগে শেষবারের মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম এবং এই দশ বছরে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। যেমন, এই দশ বছরে আমি দশ বছর বড়ো হয়েছি। এটা খুব গুরুতপূর্ণ বিষয়, অন্তত আমার কাছে। দিনের পর দিন আমি বয়স্ক হয়ে উঠছি আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজেকে কৈশোরের দিনগুলো থেকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। আজকাল আমি ভদ্রলোক হবার চেষ্টা করছি। আপনি জানেন যে, ভদ্রলোক এবং ঔপন্যাসিক একইসঙ্গে হওয়া সহজ নয়। একজন রাজনীতিবিদের একইসঙ্গে ওবামা এবং ট্রাম্প হবার চেষ্টা করার মতো। তবে আমার কাছে ভদ্রলোক ঔপন্যাসিকের সংজ্ঞা আছে। প্রথমত, তিনি যে আয়কর দিয়েছেন সেই বিষয়ে কথা বলেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর প্রাক্তন বান্ধবী বা প্রাক্তন স্ত্রী সম্পর্কে লেখেন না। এবং তৃতীয়ত, তিনি সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ সম্পর্কে ভাবেন না। সুতরাং, দেবোরা, দয়া করে আমাকে এই তিনটি জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন না। আমি সমস্যায় পড়ে যাব।

দেবোরা: আপনি আমার প্রশ্নভাণ্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন। আসলে আমি আপনার অতি সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘কিলিং কমেন্ডোটোর’ দিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম। বইটি এমন এক ব্যক্তির বিষয়ে, যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। সে এক পুরোনো চিত্রশিল্পীর বাড়িতে থাকা শুরু করে। সে যখন সেই বাড়িতে গিয়ে থাকা শুরু করল তখন অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করে। এর মধ্যে একটা হল কিছুটা কূপের মতো দেখতে একটি গর্তের দেখা পাওয়া। আমি ভাবছি আপনি কীভাবে উপন্যাসের এই ভিত্তিটি নির্মাণ করলেন?

মুরাকামি: আপনি জানেন যে এটি একটি বড়ো বই এবং এটা লিখতে আমার দেড় বছর বা তার বেশি সময় লেগেছিল। তবে এটি শুরু হয়েছিল একটি বা দু-টি অনুচ্ছেদ দিয়ে। আমি সেই অনুচ্ছেদগুলো লিখে আমার ডেস্কের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম এবং একসময় ভুলেও গিয়েছিলাম। তারপর, সম্ভবত তিন বা ছয় মাস পরে আমার ধারণা হয় যে, আমি ওই অনুচ্ছেদ্গুলো দিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে পারি। তারপর আমি লিখতে শুরু করি। আমার কোনো পরিকল্পনা বা প্লটও ছিল না। তারপর গল্পটি আমাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেল। যদি আপনার কোনো পরিকল্পনা থাকে, আপনি শুরু করার সময়ে যদি পরিণতি জানেন, উপন্যাস লিখে কোনো আনন্দ নেই। আপনি হয়তো জানেন, কোনো চিত্রশিল্পী চিত্রকর্ম শুরু করার আগে রূপরেখা এঁকে নেয়, তবে আমি তা করি না। আমার কাছে আছে একটি সাদা ক্যানভাস এবং একটি ব্রাশ। তাই দিয়ে আমি ছবি আঁকি।

দেবোরা: উপন্যাসটিতে একটি চরিত্র বা ধারণা আছে, যা মোজার্টের অপেরা ‘ডন জিওভান্নি’ থেকে গড়ে উঠেছে। এই ধারণা বা চরিত্রটি বইয়ের কেন্দ্রে থাকার কারণ কী?

মুরাকামি: সাধারণত আমি আমার বইগুলি শিরোনাম দিয়ে শুরু করি। এই ক্ষেত্রে ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’ শিরোনাম আর প্রথম অনুচ্ছেদটা নিয়ে আমি ভাবলাম যে এগুলি দিয়ে আমি কী ধরনের গল্প লিখতে পারি! জাপানে ‘কমেন্ডেটোর’ বলে কোনো কিছু নেই। তবে আমি এই শিরোনামটির অদ্ভুতুরে মেজাজটি অনুভব করে মনে মনে পুলকিত হয়েছি।

দেবোরা: আপনার কাছে ‘ডন জিওভান্নি’ অপেরা কি গুরুত্বপূর্ণ?

মুরাকামি: চরিত্র আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি সাধারণত মডেল ব্যবহার করি না। আমার কেরিয়ারে একবার মাত্র একটি চরিত্রের জন্য মডেল ব্যবহার করেছি। লোকটি খারাপ ছিল এবং তাকে আমি বেশি পছন্দ করতাম না। ওই লোকটি সম্পর্কে আমি লিখতে চেয়েছিলাম। তবে মাত্র একবার। আমার বইগুলির অন্য সমস্ত চরিত্র আমি শূন্য থেকে তৈরি করেছি। আমি কোনো চরিত্র তৈরি করার পরে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নড়াচড়া করতে থাকে এবং আমাকে তারপর তার চারপাশে ঘোরাফেরা করে তার সাথে কথা বলে যেতে হয়। একজন লেখক হিসেবে যখন আমি লিখি একইসঙ্গে আমার মনে হয় আমি কোনো আকর্ষণীয় বইও পড়ছি। এইভাবে আমি লেখাটি উপভোগ করি।

দেবোরা: আপনি উল্লেখ করেছেন যে, বইটির মূল চরিত্র অপেরার পাশাপাশি অন্যান্য সংগীতও শোনে। প্রায়শই আপনার চরিত্রগুলি দেখি কোনো নির্দিষ্ট ব্যান্ড ও জোনারের সঙ্গীত শুনে থাকে। এগুলি কি আপনাকে লিখতে সাহায্য করে?

মুরাকামি: আমি লেখার সময় গান শুনি। সুতরাং সংগীত খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার লেখায় আসে। কী ধরনের সংগীত এটা নিয়ে আমি বেশি ভাবি না, তবে সংগীত আমার কাছে একধরনের খাদ্য। সংগীত আমাকে লেখার শক্তি যোগায়। তাই আমি প্রায়শই সংগীত সম্পর্কে লিখি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি আমার পছন্দের সংগীত সম্পর্কেই লিখি। আমার স্বাস্থ্যের পক্ষেও এটা মঙ্গলজনক।

দেবোরা: সংগীত কি আপনাকে সুস্থ রাখে?

মুরাকামি: হ্যাঁ, খুব। সংগীত এবং বিড়াল। তারা আমকে প্রচুর সাহায্য করেছে।

দেবোরা: আপনার কাছে কতগুলি বিড়াল আছে?

মুরাকামি: একটাও না। আমি প্রতিদিন সকালে আমার বাড়ির চারপাশে ঘুরতে গেলে তিন-চারটি বিড়াল দেখতে পাই, এরা আমার বন্ধু। আমি তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি এবং তাদেরকে অভিবাদন জানাই। তারা আমার কাছে আসে। আমরা একে-অপরকে খুব ভালোভাবেই চিনি।

দেবোরা: যখন ‘নিউইয়র্কার’ ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’-এর একটি অংশ প্রকাশ করেছে, আমি তখন আপনাকে আপনার কাজের অবাস্তব উপাদানগুলি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, “আমি যখন উপন্যাস লিখি, বাস্তবতা আর অবাস্তবতা একসাথে মিশে যায়। এটা আমার পরিকল্পনা মাফিক নয় এবং লেখার সাথে সাথে আমি এটি অনুসরণ করি। তবে আমি যতই বাস্তবতাকে বাস্তবসম্মতভাবে লেখার চেষ্টা করি ততই অবাস্তব পৃথিবীর উদয় হয়। আমার কাছে উপন্যাস পার্টির মতো। যে-কেউ যোগ দিতে চাইলে দিতে পারেন। এবং যখনই তাঁরা চলে যেতে চাইবেন, যেতে পারেন”। সুতরাং আপনি কীভাবে এই পার্টিতে অতিথি এবং অন্যান্য বিষয়গুলোকে নিয়ে আসেন, অথবা আপনি যখন লিখছেন সেখানে কীভাবে এরা বাধাহীনভাবে আসতে পারে?

মুরাকামি: পাঠকেরা প্রায়শই আমাকে বলে থাকেন যে আমার কাজগুলিতে এমন একটা অবাস্তব জগৎ রয়েছে, যে-জগতে নায়ক অনায়াসেই যায় এবং আসল পৃথিবীতে ফিরেও আসে। তবে আমি সবসময় অবাস্তব বিশ্ব আর বাস্তববাদী বিশ্বের মধ্যে সীমারেখা দেখতে পাই না। সুতরাং, অনেক ক্ষেত্রে তারা মিশে গেছে। আমি মনে করি জাপানে এই অন্য বিশ্ব আমাদের বাস্তব জীবনের কাছাকাছি। এবং আমরা যদি সেই অন্য পৃথিবীতে যেতে চাই সেটা আমাদের পক্ষে অতটা কঠিন হয় না। আমার মনে হয় পশ্চিমা বিশ্বে এটা করা অত সহজ নয়, সেখানে অন্য বিশ্বে যেতে হলে আপনাকে কিছু পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবে জাপানে আপনি যেতে চাইলে সহজেই যেতে পারেন। সুতরাং, আমার গল্পগুলিতে, আপনি যদি কোনো কূপের নীচে যান, দেখতে পাবেন সেখানে একটা অন্য বিশ্ব আছে। এবং আপনি সেখানে দুই বিশ্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পাবেন না।

দেবোরা: অন্য দিকটা সাধারণত অন্ধকারের জায়গা, তাই তো?

মুরাকামি: না-ও হতে পারে। আমার মনে হয় এটা আগ্রহের ব্যাপার। আপনি যদি কোনো দরজার সন্ধান পান এবং সেটা যদি খুলতে সক্ষম হন তবে আপনি সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন। এটি কেবল আগ্রহ থেকেই হতে পারে। ভিতরে কী? সেখানে কী আছে? এই প্রশ্ন করা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। আমি যখন কোনো উপন্যাস লিখি তখন ভোর চারটের দিকে উঠে আমার ডেস্কে গিয়ে লেখা শুরু করি। বাস্তব বিশ্বে এটা ঘটে। আমি আসল কফি পান করি। কিন্তু একবার লেখা শুরু করলে আমি অন্য কোথাও চলে যাই। আমি দরজাটা খুলি, সেখানে যাই এবং সেখানে কী ঘটে দেখতে পাই। আমি জানি না বা জানতে চেষ্টা করি না, এটা বাস্তব না অবাস্তব। যতই আমি লেখার মধ্যে গভীরভাবে ডুবে যাই ততই সেখানে ওদ্ভুত কিছু দেখতে পাই। আমি স্বাভাবিকভাবেই তাদের দেখতে পাই বলে মনে হয়। সেখানে যদি কোনো অন্ধকারও থাকে তবে সেই অন্ধকারের কিছু বার্তা থাকে অবশ্যই। আমি সেই বার্তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। আমি সেই বিশ্বকে ঘুরে দেখি, তার বর্ণনা করি, শেষে আমি ফিরে আসি। এই ফিরে আসাটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ফিরে আসতে না পারেন তবে ভয়ের ব্যাপার। তবে যেহেতু আমি পেশাদার, আমি ফিরে আসতে পারি।

দেবোরা: এবং আপনি ওই জিনিসগুলি সঙ্গে নিয়ে আসেন?

মুরাকামি: না। এটা ভীতিজনক হবে। আমি যেখানেই সব ছেড়ে দেই। আমি যখন লিখি না, আমি খুব সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনের রুটিনটাকে আমি মেনে চলি। আমি খুব সকালে উঠি এবং বেসবল খেলা না থাকলে রাত ন-টার দিকে শুতে যাই। সঙ্গে থাকে আমার দৌড় এবং সাঁতার কাটা। আমি একজন সাধারণ মানুষ, সুতরাং রাস্তায় যখন আমি হেঁটে চলি তখন যদি কেউ বলে, “মিস্টার মুরাকামি, আপনার সাথে দেখা হয়ে খুব ভাল লাগল”, আমি বিব্রত বোধ করি। আমি এমন কিছু না। তাহলে কেন সে আমার সাথে দেখা হওয়ায় খুশি হল? তবে আমি যখন লেখার মধ্যে থাকি তখন অবশ্যই আমি একজন বিশেষ, অন্তত অদ্ভুত মানুষ।

দেবোরা: চল্লিশ বছর আগে, বেসবল খেলার মাঠে আপনি কীভাবে লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন, গল্পটি বহুবার বলেছিলেন। হঠাৎ আপনি ভেবেছিলেন, “আমি একটা উপন্যাস লিখতে পারি”। যদিও এর আগে আপনি লেখার চেষ্টাও করেননি। এবং আপনি আপনার স্মৃতি কথা, “হোয়াট আই টক আবউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং”-এ বলেন, “মনে হয়েছিল আকাশ থেকে কোনো কিছু নেমে এসেছিল এবং সেটা আমি হাতে পেয়েছি”। আমরা ধরে নিতে পারি ওই জিনিসটি ছিল আপনার লেখার ক্ষমতা। সেটা কোথা থেকে এসেছিল বলে আপনার মনে হয়? আর আপনি এত সাধারণ হলে কেন এটা আপনার কাছে এসেছিল?

মুরাকামি: সেটা একধরনের বোধোদয় ছিল বলে মনে হয়। আমি বেসবল পছন্দ করি এবং আমি প্রায়শই বলপার্কে যাই। ১৯৭৮ সালে ঊনত্রিশ বছর বয়সে আমি টোকিয়োর বেসবল পার্কে আমার প্রিয় দল ‘ইয়াকাল্ট স্যালোজ’ (Yakult Swallows)-এর খেলা দেখার জন্য গিয়েছিলাম। সেই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটায় ছিল খেলার উদ্বোধন। আমি খেলাটি দেখছিলাম এবং প্রথম খেলোয়াড় একটি ডাবল মারল এবং সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম যে, আমি লিখতে পারি। তখন প্রচুর বিয়ার পান করেছিলাম বলে কিনা জানি না। তবে তখন আমার মনে হয়েছিল যেন আমার মধ্যে একধরনের বোধের উদয় হয়েছে। এর আগে আমি কিছু লিখিনি। আমি একটি জ্যাজ ক্লাবের মালিক হিসেবে সান্ডুইচ আর ককটেল তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম। আমি খুব ভালো সান্ডুইচ তৈরি করি। তবে সেই খেলার পরে আমি একটা ষ্টেশনারি দোকানে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলাম এবং শুরু করলাম লেখা। তারপর আমি লেখক হয়ে যাই।

দেবোরা: সেটা চল্লিশ বছর আগে। সেই সময় লেখা আপনাকে কীভাবে বদলে দিল?

মুরাকামি: আমি অনেক বদলে গিয়েছিলাম। লেখা শুরু করার সময় আমি লিখতে জানতাম না। আমি খুব অদ্ভুত উপায়ে লিখেছিলাম। তবে পাঠক এটা পছন্দ করেছিল। এখন আমি আমার প্রথম বই ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’-এর জন্য তেমন একটা যত্ন নিই না। তখন আমি লেখা প্রকাশের উপযুক্ত ছিলাম না। বহুবছর আগে টোকিয়োর ট্রেনে বসে আমি একটি বই পড়ছিলাম এবং খুব সুন্দর একটি মেয়ে আমার কাছে এসে বলল, “আপনি মিস্টার মুরাকামি?” “হ্যাঁ, আমি মিস্টার মুরাকামি”। “আমি আপনার বইয়ের বড়ো ফ্যান”। “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ”। “আমি আপনার সমস্ত বই পড়েছি এবং আমি সেগুলো খুব ভালোবাসি”। আমি ধন্যবাদ জানাই। তারপর সে বলেছিল, “আমি আপনার প্রথম বইটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। ওটাই আমার কাছে সেরা”। “ওহ্‌, তুমি তাই মনে করো?” সে বলল, “আপনার লেখা এখন খারাপ হয়ে যাচ্ছে”। এইভাবে আমি সমালোচনায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তবে আমার লেখা আগের থেকে খারাপ হয়ে যাচ্ছে তা মনে করি না। আমি মনে করি সময়ের সাথে সাথে আরও ভালো হচ্ছে আমার লেখা। চল্লিশ বছর ধরে আমি আরও ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছি এবং আমার বিশ্বাস যে, আমি সফল। ট্রেনের সেই মেয়েটি আমাকে জিন কুইল নামে এক জ্যাজ সংগীতকারের কথা মনে করায়। তিনি স্যাক্সোফোন বাজাতেন। উনিশ-শ পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে বিখ্যাত ছিলেন। সেই সময় যে-কোনো স্যাক্সোফোন বাদকের মতো তিনিও চার্লি পার্কার দ্বারা খুব প্রভাবিত ছিলেন। একরাতে তিনি নিউ ইয়র্কের একটি জ্যাজ ক্লাবে বাজাচ্ছিলেন এবং যখন তিনি ব্যান্ডস্ট্যান্ড থেকে নামলেন তখন এক যুবক এসে বলল, “আরে, আপনি তো চার্লি পার্কারের মতো বাজাচ্ছেন!” জিন বললেন, “কী?” “আপনি চার্লি পার্কারের মতো বাজাচ্ছেন!” জিন তখন তাঁর অলটো সাক্সোফোন যন্ত্রটি তার কাছে তুলে বললেন, “এই যে, আপনি চার্লি পার্কারের মতো বাজিয়ে দেখান!” আমি মনে করি, এই গল্পটির তিনটি বিষয় আছে— এক, কারো সমালোচনা করা সহজ। দুই, মৌলিক কিছু তৈরি করা খুব কঠিন। তিন, কিন্তু কারো এটি করা দরকার। আমি চল্লিশ বছর ধরে করে আসছি। এটা আমার কাজ। আমি মনে করি, আমি এমন একজন লোক যে অন্যদের মতো কিছু কাজ করে চলেছে, যেমন নোংরা পরিষ্কার করা বা কর সংগ্রহ করা। সুতরাং, কেউ যদি আমার প্রতি কঠোর হয় তবে আমি আমার যন্ত্রটি তাকে ধরিয়ে বলব, “এই যে, আপনি এটা বাজিয়ে দেখান!”

দ্বিতীয় পাতা