Categories
2021-June-Interview সাক্ষাৎকার

নিত্যব্রত দাস

“যিনি বাস্তবনিষ্ঠ হয়ে লিখতে চান, তাঁর জানা উচিত শব্দ ছাড়া বাস্তব ঘটনা সম্বন্ধে মানুষের কোনো বোধ নেই। …কবিতা, যার হাত নেই, তার হাত ফিরিয়ে দেয়।”

আলাপচারিতায় কমলকুমার দত্ত ও সন্তু দাস

নিত‍্যব্রত দাস— এই নামটির সঙ্গে বাংলা কবিতাজগতের খুব স্বল্প কিছু পাঠকের পরিচয় আছে। অল্প লেখেন, যতটুকু লেখেন তারও বেশিরভাগটা নিজেই বাতিল করেন। ‘দাহপত্র’ ছাড়া আর কোনো পত্রিকায় (দু-একটি ব‍্যতিক্রম ছাড়া) তাঁর লেখা দেখা যায় না। কবিতা ছাড়াও গদ‍্য লিখেছেন, যে-গদ‍্যের সঙ্গে বাংলা আবহমান গদ‍্যের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষটিও লুকিয়ে থাকতেই স্বস্তি বোধ করেন। তাঁকে কোনো মঞ্চে কবিতা পড়তে দেখা যায় না, জোর দিয়েই বলা যায় ভবিষ‍্যতেও দেখা যাবে না। এমনই একজন কবির সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ এখানে রইল, সৌজন‍্যে ‘দাহপত্র’।

কবি বলে নয়, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই ছোটোবেলার বিশেষ ভূমিকা থাকে। আপনার ছোটোবেলার কথা বলুন, কেমন ছিল আপনার বালকবয়স, শৈশবকাল? তার ছায়া কীভাবে পড়ছে এখন? কীভাবে বয়ে বেড়াচ্ছেন?

এই জিজ্ঞাসা একটা অস্পষ্ট বিষয় নিয়ে। আমার তেমন পরিচ্ছন্ন অতীত নেই। পরিচ্ছন্ন অতীত কী, সেটা বর্তমানে এসে বুঝেছি। যদি আমার এমন অতীত থাকত, কোনো ভাইবোন নেই, স্কুলের সহপাঠী কাকা কাকিমা কেউ নেই, নদীর উত্তরের বাঁকে উঁচু পাড়ের ওপরে বসে সারাদিন মাছ ধরতাম, আমাকে কেউ দেখত না। সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে আসতাম। বাড়িতে শুধু ঠাকুমা।

যত বয়স বাড়ত তত উজানে যেতাম, নতুন বাঁকে, টিলার মতো উঁচু পাড়ে, পৃথিবী থেকে দূরে। যদি আমি কথা বলতে না পারতাম, মূক হতাম। মূক হয়ে কথা বলতে পারতাম না, তা নয়। কথা বলতে পেরে মূক হয়ে থাকতাম। একপাল ভেড়া পাহাড়ের গায়ে চরিয়ে বেড়াতাম, যেখানে রাত নামত সেখানে ঘুমিয়ে পড়া। ঘুমের মধ্যে ভেড়ার লোমের গন্ধ আসত। যদি আমি ক্লীব হতাম, নারী বিষয়ে উদাসীন। যদি ক্লীব না হয়েও ক্লীবের মতো নারী বিষয়ে উদাসীন থাকতাম। দিনের আলোর চেয়ে স্বল্প আলোয় একমনে বই পড়াও ছিপ দিয়ে মাছ ধরা।

তেমন অতীত আমার নেই। কোলাহল, বড়ো হতে গিয়ে একের পর এক যুদ্ধ, পরাজয়। পরিচ্ছন্ন অতীত বলতে আজকের মতো জীবন, নির্বিকার, নিশ্চেতন, প্রয়োজনশূন্য। এমন যদি ছোটোবেলা থেকে হতাম। ‘বলাই’ পড়ে একা একা কাঁদতাম। যদি সেই কান্নাকেও ভালোবাসতাম। জেদ করে থাকতাম, বুড়িয়ে যাওয়া গোরুদুটো আমার একার, তাদের ছেড়ে যাব না। যদি কৃষ্ণনগরে না আসতাম গঙ্গা পার হয়ে। বা, কৃষ্ণনগরে নিয়ে যাবার কেউ না থাকত, আমার খেয়াল রাখার কেউ না থাকত। গোরুদুটোকে গাছের পাতা খাওয়াতাম।

সে-সব কিছু হয়নি। আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল নিয়ম। আমার ইচ্ছে নিয়ম হয়ে ওঠেনি। বেড়ে ওঠা, বড়ো হওয়া, ঠিক হওয়া, বেঠিক না হওয়া, ভালো হওয়া। ভালো আমি হইনি, পরিচ্ছন্ন অতীতের স্বপ্ন আমাকে টেনেছে, আমার বর্তমানকে দু-ভাগ করেছে। নষ্ট করেছে। বিষময় করে তুলেছে ভালো হওয়া। এরপর আমি কলোনির টিনের চালায় গরিবদের সঙ্গে জীবন কাটাবার স্বপ্ন দেখি। ইউনিভার্সিটির জীবনে এসে নিজেকে দেখাশুনো না করার স্বাধীনতা অর্জন করি আর নষ্ট হতে থাকি। তিনতলা বাড়ি বানাই, একতলা দোতলা নেই। শূন্যে ঝুলে নেই তিনতলার ঘর।

যেখানে চরিত্রহীন নারী, কুৎসিত নারী, ভালো-মন্দের বিচারশূন্য মানুষ। দু-বেলা খেতে না পাওয়া অপগণ্ডদের দেশ। আমি নষ্ট হইনি নষ্ট হতে গিয়ে। নষ্ট হয়েছি ভালো হতে গিয়ে। প্রথম থেকে নিজের খারাপ হতে চাওয়া, নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকা যদি সমর্থন করতাম, যদি আমাকে দেখার কেউ না থাকত, অনাথ হতাম, বাধা দেবার কেউ না থাকত, আমি গোড়া থেকেই ভালো কী তার প্রশ্ন তুলতাম। নিজের ভালো নিজে নির্বাচন করে নিতাম।

যা ভালো তার সবই ছিল গঙ্গার এপারে। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, সত্যজিৎ, উত্তম, সৌমিত্র। ওই ভালো আমি হতে চাইনি। ধীরে ধীরে আমার অক্ষমতা যখন প্রকট হয়ে ওঠে, তখন ওই ভালোরাও আমাকে আর চায় না, প্রত্যাখ্যান করে। আমার অসুখের ওপর আগ্রহ ছিল ছোটোবেলা থেকে। অসুখ ডেকে আনতে হত না। এমনিই ঘন ঘন আসত। এলে কাঁথা আসত, বারান্দার চৌকিতে শুয়ে থাকা আসত। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি, দিন আপনি গড়িয়ে যাচ্ছে, সূর্য উঠে নেমে যাচ্ছে। রাত হয়ে এলে ঘরে ফেরা সুতির মশারির ভেতরে। জ্বরে বেহুঁশ হয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতাম উজানের জলে। রথের মেলায় হারিয়ে নিরুদ্দেশ হবার সখ ছিল। জীবনে কতবার যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। নিয়ম আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। আর ভয়। এই নিয়ম আমার সর্বনাশ করেছে। ব্যাখ্যা প্রমাণ কারণ অস্বীকার করতে চেয়ে সেগুলোর আয়ত্তে চলে এসেছি। কা-কা বুলি আমার প্রথম।

যে-অতীতটা সত্যি, সেই অতীত ঘষে ঘষে মুছেও গেছে। চেষ্টা করলেও সেগুলোয় আমার অধিকারের ছাপ দেখতে পাই না। কোনো কাহিনি মন দিয়ে পড়ে উঠতে পারি না। জানা মনে হয়, স্বাদ নেই মনে হয়। কী ঘটবে সে-বিষয়ে নির্বিকার। আগে এমন ছিল না। এ এক অস্থায়ী অসুখ যা ক্রমশ স্থায়ী হয়ে এসেছে। আগে তবু পারতাম। তখন ছোটো ছিলাম হাতে অনেক কাজ ছিল। এ, ও ডাকত। মরার মতো ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত শুনতে পেতাম কেউ-না-কেউ ডাকছে। ভেজা জিনিসগুলো শুকিয়ে তোলার কাজ, শুকনো জিনিসগুলো ভিজিয়ে দেওয়া। যেগুলোর রং নেই সেগুলোতে রং বুলোনো, যেগুলোর আছে সেগুলোর ঘষে ঘষে রং তুলে দেওয়া। এই কাজগুলো একসময় অর্থহীন হয় পড়ে। একঢালা বালি দেখলে গর্ত খুঁড়ে তার স্থিতি নষ্ট করা, কিছুক্ষণ পরে গর্তের স্থিতি নষ্ট করে দিতে আবার বুঁজিয়ে দেওয়া— ধীরে ধীরে অর্থহীন হয়ে পড়ে। তখন ব্যস্ত ছিলাম বিপুল সেই কাজগুলোয়। কাছের জিনিস দূরে রেখে আসা, দূরের জিনিস কাছে এনে জড়ো করা একটা কাজ ছিল। দূরের জিনিসগুলো কাছে আনা শেষ হবার আগেই সময় পেরিয়ে যায়। মহীউদ্দিন জানত দূরের জিনিস কাছে না আসার সমস্যা। মহীউদ্দিন পাহাড়ে পৌঁছুতে পারে না— ‘এখনও পৌঁছাই নাই কর্তা, আরও দূরে গেল পেত্নিটা’। আমাদের বাড়িগুলোও ছিল দূর দূর শিমুলগাছের নীচে। শিরীষগাছ পেরিয়ে অনেক দূর গেলে নজরে আসত মাটির কোঠাবাড়ি। বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যা কিছু দেখতাম সব দূরে। অনেক দূর থেকে ধীরে ধীরে রিকশা আসত।

যেখানে থাকতাম সেখানে আমাদের অনেক নাম হয়েছিল। সে-সুনাম রক্ষা করতে পারিনি। আধভাঙা জিনিসগুলো তেমনিই রয়ে গেল। অর্ধেক ঘষে রং তোলা জিনিসগুলো, অর্ধেক ভেজানো, অর্ধেক শুকিয়ে তোলা। আমাদের পরে আর কেউ হাত লাগায়নি। জিনিসগুলো এত ব্যক্তিগত ছিল আমাদের। আসার সময় দরজা আবজে রেখে এসেছি, শেকল দিইনি এই আশায় কেউ-না-কেউ আসবে, আমি আসব। এসে কাজগুলো হাতে নেব।

ছোটোবেলায় তেমন বই ছিল না। পাঠ্য বইয়ের বাইরে পড়ার অনুমতিও ছিল না। আজ নিজের জীবনের কাহিনি মনে করে বলতে সেই সমস্যা হচ্ছে যা গল্প উপন্যাসের কাহিনি পড়তে গিয়ে হয়ে এসেছে। অন্যের লেখা কাহিনি পাঠের মতো পীড়া দিচ্ছে। মনে করতেও চাইছি না। এত ক্লান্ত লাগে যে পারলে নিজের কোনো শৈশব ছিল, কৈশোর ছিল, সে-কথা স্বীকার না করি। সেগুলো আমার নয়, অন্যের, প্রতিপক্ষের। মানুষের অতীত এমনিই তার কঠিন প্রতিপক্ষ।

কাহিনিমূলক গদ্য পড়তে অসুবিধে হবার একটা কারণ হয়তো কাহিনিতে ব্যবহৃত বাক্য, শব্দরা, আর তাদের গঠনশৈলী, বহুব্যবহৃত। পড়ে আর নতুন করে কিছু অনুধাবন হয় না। কাহিনি দিয়ে যে-সত্য উদ্ঘাটন হবার কথা তা দিয়ে আর কিছু উদ্ঘাটিত হয় না। বারোমেসে, প্রত্যাশিত সে-সব কাহিনি। অনেকদিন হল সেই ভাষা, বক্তব্য বেহাল হয়ে আছে, সারাই হয়নি, পরিবর্তন হয়নি। দিনের পর দিন দেখা ছবি দেখতে দেখতে রং উঠে যায়। তাই-বা বলি কী করে। সুপারভাইজারের ল্যান্ড সার্ভেয়ারের সঙ্গে পাতার পর পাতা সংলাপ পড়তে আমার ক্লান্তি আসেনি, ক্যাসেল-এ।

আরও মনে হয় কাহিনি কিছু নিদান দিতে চায়, উপদেশ দেয়, নির্দেশ করে। সেগুলোর আমার কোনো প্রয়োজন নেই। যা হয় হোক। সত্যের জগৎ ওদের থাক, কর্তব্যের জগৎ, আদর্শের জগৎ। আমি যেমন আছি, আদর্শশূন্য দিকশূন্য গন্তব্যশূন্য, তেমনই থাকি। রাজনৈতিক সিস্টেমগুলো যেমন অসার, তেমনই অসার অনুবর্তী এই সমাজটা। ভালো অনেকদিন পেরিয়ে এসেছি। ভালোর সমাজে ভিড় অনেক, অনেক প্রশংসা। রবার্ট ফ্রস্ট-এর একটা লেখা আমি ঘুরিয়ে জয়ন্তকে লিখেছিলাম, ‘অন্যের কথায় যাদের খুব অসন্তোষ, তারা অনর্গল কথা বলে অন্যের সেই কথা চাপা দিয়ে রাখে।’ জানি না যে-কাহিনিমূলক গদ্যের কথা বলছি, সেগুলো এই দোষে দোষী কি না। নিজের কোনো কাজের প্রতি স্পৃহা দেখলে আজ নিজের জন্য কষ্ট হয়, লজ্জা হয়। চাই না আমার এখনও কোনো স্পৃহা অবশিষ্ট থাকে, কোনো আকাঙ্ক্ষা। অপেক্ষা করাটা আমার কাজ। অপেক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা। লাইনে দাঁড়ানোর জন্য আমার জন্য নির্দিষ্ট লাইন। সারাজীবন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে আমার এ-জীবনের কাজ সম্পন্ন হবে।

মিলান কুন্দেরার একটা উপন্যাসের প্রথম দিকে একটা মেয়ে স্টেশনে সুটকেস ফেলে রেখে চলে যায় যার মধ্যে তার নতুন জীবন শুরু করার মতো সম্ভার ছিল। আমি উপন্যাসটা বার কতক পাতা উলটে পড়ার চেষ্টা করে না পেরে শেষে সুটকেসটা নিয়ে সরে আসি। আজও আমার সঙ্গে আছে। আর সেই জনশূন্য স্টেশনে সারা শীতের রাতে একা একটা কালো সুটকেস পড়ে থাকা। যে-সুটকেসে হয়তো একটা মেয়ের পোশাক-আশাক লিপস্টিক, আয়না, পার্স, ফোন নাম্বার লেখা ডায়েরি, একটা টিফিন কৌটো। আমি চার লাইনের বেশি দীর্ঘ কবিতাও পড়ে উঠতে পারি না। কোনো লাইনে যা লেখা অন্য লাইনগুলো তার বিরুদ্ধে যেতে চায়। দীর্ঘ কবিতার বিরুদ্ধে এই মামলা বহুদিন জারি হয়ে আছে। মীমাংসা হলেও এক পক্ষ মানতে নারাজ। লিখেই চলেছেন পাতার পর পাতা।

অনেকগুলো গ্রাম, শহরে ছোটোবেলা কেটেছে। তীর্থস্থানগুলো বালুরঘাট, করণদিঘি, কানকি, ইসলামপুর, রামগঞ্জ, কৃষ্ণনগর। বাবা বদলি হতেন, আমাদের জায়গা বদল হত। জন্মেছিলাম যদিও কোচবিহারের কোনো গ্রামে। এখনও সামান্য মনে পড়ে। পাহাড়ি ঝোরার ধারে পাশাপাশি দুটো কাঠের ঘর। একটা ঘরে সিলিং থেকে ঝোলানো ভুট্টা। সামনে একটা ভুট্টার খেত। উঁচুমতো একটা জমিতে। ওপারে একটা পায়ে হাঁটা রাস্তা। তার ওপারে জঙ্গল। জঙ্গল ভেঙে যেতে হত। মাকে জোঁকের ভয়ে গামবুট পরতে দেখেছি। হাতে লাঠির মাথায় নুনের পুঁটলি। বাহাদুর বলে আমাদের একজন আর্দালি ছিল। মাউথ-অর্গ্যান বাজাত। জন্মস্থানে জীবনের প্রথম দু-আড়াই বছর কেটেছে সম্ভবত। তারপরে বালুরঘাটে আসি ঠাকুমার আয়ত্তে।

তখন থেকে ঘোরাঘুরি শুরু, সঙ্গে অসুখ— জ্বর, মাম্পস, ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি। হাইওয়ে দেখলে বালুরঘাটে যায় ভাবার আনন্দ। বেশিরভাগটা বালুরঘাটে কেটেছে। একটা নদী, নদীর ধার ছিল। ঘাটে ঘাটে নতুন নাম। আমাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল বালুরঘাটে। গোখরো সাপকে গোমা সাপ, ডাহুককে ডাক পাখি বলার দেশ। বৃষ্টিকে সেখানে বৃষ্টি বলত। বছরের বেশিরভাগ বর্ষাকাল। জ্বরে মাটির বারান্দার চৌকিতে শুয়ে আছি, ঠাকুমা শিউলিপাতার রস করছে। হাঁ করে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার পথ্য বার্লি। পৃথিবী বলতেও ছিল ছোটো ওই নদীটা। বালুরঘাট খুব দরিদ্র, অপ্রতুল আধাশহর। মানুষজন রোগা, কালো। বাড়িগুলো টিনের। উঠোনের শিউলি গাছে কম ফুল, ঝাড়ের বাঁশ খুব রোগা বলে খুঁটির কাজে অনুপযুক্ত। এতদিন পরে কেটে ফেলা শিউলি গাছে আজ বেশি ফুল ফোটে।

পাড়ার মুদির দোকান ছিল কালো ছোপধরা, গুড় তামাকের গন্ধ মেশা বাতাসে। বুড়ো দোকানি চৌকিতে বসে হুঁকো খেত। শহরটা ছিল বৃষ্টির আয়ত্তে। শুরু হলে নাগাড়ে এক সপ্তাহ কম করে বৃষ্টি হত। নদী পাড় ভেঙে ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে প্রতি বছরই বন্যা বাধাত। বেশ কয়েকবার বন্যায় ঘর ভেঙেছে। উঠোনের মধ্যে দিয়ে জল বয়ে যেত খরস্রোতে। কোনো এমন সময়ের কথা মনে পড়ে না যখন শহরটা রোদে ঝকঝক করছে। অতীতের সূর্য স্মৃতিতে ভিজে দেয়ালে টাঙানো রং ওঠা সূর্যের ছবি।

শহরটার অনেক গোপন জায়গা ছিল। কেয়াফুল ফুটত। খবর পেতাম কেয়া ফুটেছে। সারা বছর জঙ্গল হয়ে থেকে যখন ফুল ফুটত তখন আমি অনেক দূরে। দেখা হত না। আজও কেয়াফুল আগের মতো টুকি খেলে, আগের মতো হারিয়ে থাকে। রাত হলে নদীটায় তিন চারজন শিশু, কিশোর হাতে বাতি নিয়ে পাড় দিয়ে হাঁটে। ঠান্ডা জলের ওপরে ঘোরে কাঁপা কাঁপা আলোর শিখা। ভাই বোন মিলে আমরা তিন চারজন নদীতে সতরঞ্চি পেতে দখল নেবার চেষ্টা করেছি। চলে আসার পর দখল নেবার সতরঞ্চি ভেসে যায়, বৈঠক ভেস্তে যায়। শুনেছি ডাহুকের মুখে, সে এ-ঘাট ও-ঘাটে রাত হলে খোঁজে মানুষ-ডাকপাখিদের। আমরা ক-জন ভাই-বোন জলেই মানুষ। জলে কেউ মানুষ হয় না, মাছ হয়, ডাহুক হয়, বিসর্জনের প্রদীপের শিখা হয় কাঁপা কাঁপা জলের ওপরে।

এক-একটা কারণ থাকে পিছিয়ে যাবার। একটা কারণ পেছনের আকর্ষণ। আর একটা সামনের দিকের আকর্ষণহীনতা, সামনের সারিতে যাবার উপায়হীনতা। আমার ভালোর দিকে সামনের দিকে যাবার উপায় ছিল না। আমি লাইন দিতে পারতাম না। লাইনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘেমে নেয়ে বেরিয়ে আসতাম। লাইন দিয়ে দাঁড়ানো মানুষ দেখলে মনে হত লাইনের প্রথম দিকটা হেঁটে হেঁটে পেছন দিকে চলে যাচ্ছে। এনসিসি-র লাইনের বাইরে দাঁড়ানো ছড়ি হাতে কর্নেল জরিপ করে হেঁটে যাচ্ছেন সামনে থেকে পেছনে। অতিষ্ঠ হয়ে লাইনের বাইরে চলে যেতাম।

দুর্গাপুজো যে ফুরিয়ে আসছে সেদিন আন্দাজ করিনি। করি কিছুটা বড়ো হবার পর। বড়ো হওয়া মানে ছাড়াছাড়ি হওয়া— নদীর সঙ্গে, অসুখের সঙ্গে। যতদিন জলে ভেজা থাকে ততদিন আসক্তি থাকে, ঘেন্না থাকে, লোভ থাকে, ভয় থাকে। জল শুকিয়ে গেলে শুকনো ফুল চৈত্রের বাতাসে ভেসে মাটিতে মিশে যায়। বড়ো হলে ছায়া বড়ো হয়। দীর্ঘ হয়। বাবা-মা বেশিরভাগ সময় কাছে থাকেননি। কাকা-কাকিমা, ঠাকুমা, বুড়িয়ে আসা দুটো গোরু ছিল। সন্ধ্যের আগেই ঘনিয়ে আসত অন্ধকার। মাদুর ছিল, লণ্ঠন ছিল। চারিদিকের অন্ধকারে এত ভয় মিশে থাকত যে চুম্বকের মতো কাছে টানত লণ্ঠনের শিখা। ক্রমাগত উস্কে জাগিয়ে রাখতাম। বিশ্বটা ছোটো ছিল যা বাড়তে বাড়তে অপরিষ্কার হয়ে এসেছে বয়স বাড়ার সঙ্গে। পরিসীমা দেখা যায় না। একটা বিস্তৃত খাল, বিস্তৃত অন্ধকার। পরিসীমাহীন এই শূন্যে সেই থেকে জলের ফোঁটার মতো সামান্য কিছু, শুকনো একটা কাঠি খুঁজে বেড়িয়েছি আঁকড়ে ধরতে। বিমলা তেমনই একটা জলের ফোঁটা।

এই বালুরঘাটেই তৈরি হচ্ছিল বিমলা। কাচ ছেটানো পুকুরে স্নান করতে আসত। কখন রঙিন কাগজের রিকশায় গাছের আড়াল দিয়ে চলে যেত। বালুরঘাটেই তৈরি হয়েছিল আমারই কবিতার সেই খড়ের চালা। যার বারান্দায় সন্ধ্যের পর পেঁয়াজ কাটতে কাটতে গৃহিনী বঁটি কাত করে বাড়ির পেছন দিয়ে কার ডাক পেয়ে চলে যায়। কুপি চিতার মতো জ্বলে। বা, এ-বাড়িতে সন্ধ্যের সময় চুল বাঁধায় শুকিয়ে যায় ও-বাড়ির রজনিগন্ধা। এইসব নিষিদ্ধতার জন্ম যদিও পরে, কিন্তু এর পটভূমি রচিত হয়েছিল বালুরঘাটের নদীপাড়কে ঘিরেই। এখানেই কোথাও ছিল সেই বৈষ্ণবী। সাদা পোশাক, ভরতি রমণী। আর তার আশ্রম হেমন্তের ধানখেতের মাঝখানে। সেই কবিতাগুলো ছাপাইনি। গড়নের ত্রুটি ছিল।

সন্ধ্যের পর থেকেই পৃথিবী চলে যেত দুরাত্মাদের আয়ত্তে। তাই ঘুম ছিল গাঢ়। টের পেতে দিত না। ‘সুনীতি বুক ডিপো’-র পাশের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাবার আগে নদী পেরুতে হত। শীতকালে বাঁশের সাঁকো, অন্য সময় নৌকোয় পারাপার। ফরাশে এসে দাঁড়াত গুরুচরণের নৌকো। কয়েকবার নৌকোয় উঠতে গিয়ে জলে পড়ে যাই। ভেজা জামাকাপড় পরেই স্কুলে যাই। আজ যেমন আছি তেমনই ছিল আমার শৈশব, কৈশোর, ইউনিভার্সিটির দিনগুলো। পরাজিত, ক্লান্ত। মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া মানে এনকাউন্টার, বোঝাপড়া, অবশ্যম্ভাবী পরাজয় একচেটে।

ভাবি যদি জন্ম থেকেই এমন বয়স্ক হতাম। কম শুনতে পাচ্ছি, কম দেখছি, চলাচল করছি না, বসে আছি বিকেলের বারান্দায়। কেউ গ্রাহ্য করত না, পড়ে থাকতাম আসবাবের মতো। মন নেই, হৃদয় নেই। লাঠি হাতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো মানে চারপাশে জমে উঠতে থাকা এনকাউন্টারগুলো এড়িয়ে সরে যাওয়া। সেই ইউনিভার্সিটির বয়স থেকে আজ অব্দি কোনো পুজো দেখিনি। কলকাতার পুজো কী জানি না। পুজোর দিনগুলোতে মনে হয় ভারত বন্‌ধ, কেউ নেই। একা আছি। হস্টেল ছুটি পড়ায় চার দিন একা তিনতলার জানালায় বসে কাটিয়েছি। সকলের মধ্যে দেখলে আমাকে মনে হয় আমি একা। একা থাকলে মনে হয় সঙ্গে আরও অনেকে, তাদের সঙ্গে দেয়া-নেয়া করছি, আমাকে সজীব দেখাচ্ছে।

কবিতা কখন আক্রমণ করল? আক্রান্ত হবার প্রথম অভিঘাত মনে পড়ে?

কবিতার অসুখের গোড়ায় থাকে শব্দকে, বাক্যকে, পঙ্‌ক্তিকে চিনে ফেলা। চেনা শব্দ, বাক্য দিন দিন অহেতুক, অর্থহীন হয়ে ওঠা। যা বলছি, শুনছি সেগুলো অর্থহীন, সার নেই। তারা আর কিছু বলে না, শোনায় না। নিত্যনতুন শব্দগঠন দিয়ে একই ভাবনাকে নতুন করে, সুখময়, দুঃখময় করে জোগান দেওয়াই কবিতা। তার কোনো জাগতিক মূল্য আছে কি নেই নির্বিচারে। তাই পুরোনো কবিতা কবিতা নয়। আমি পড়িনি কেউ লিখে রেখেছেন, যেদিন পড়ব আমাকে সে শিক্ষিত করে মরে যাবে, তার গঠনশৈলী, শব্দগুলো।

যুগ যুগ ধরে কবিতা লেখা হয়ে থাকলেও এ-কথা ঠিক যে, কবিতা কী সে-কথা কেউই ভালো করে বলতে পারবেন না। একসময় বেশ সুবিধে ছিল যখন পর্ব মেনে লেখা, বা, অন্ত্যমিলের লেখাকে কবিতা বলে ধরা হত। তার অসারতা ফাঁস হবার পর থেকে কবিতার সংজ্ঞা জটিল হয়েছে। হয়েছে গদ্য পদ্য বিভাজনের সমস্যা। কবিতা ধরেছিল যেদিন থেকে আমি সরে যেতে থাকি। ইউনিভার্সিটি থেকে, হস্টেল থেকে। যেদিন থেকে ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে ন্যায্যমূল্যের পৃথিবী। এমন হতে পারে যে, আগে কবিতা এসেছিল, কবিতাই আমাকে সরিয়ে এনেছে। মনে আছে, ড্রয়িং পেপারের উলটোদিকেও পেনসিলে কবিতা লিখেছি। এখন বলতে পারি না কী লিখতাম, কেমন লিখতাম। তবে হাতেখড়ি তখনই। হাঁটা দূরত্বে বালিগঞ্জ লেক। সেখানে গিয়ে বসে থেকেছি লেখার খোঁজে। এই সময়টায় প্রাণপণ খুঁজেছি ইতরদের সমাজ, ইতর হতে চেয়ে। একটা টালির বাড়ির খোঁজ। টালির ঘর, সামনে একফালি ঘাস বিছোনো জমি, একটা টিউবওয়েল, ভাঙা চাতাল। জনমিনিষ্যি নেই। বেড়া দিয়ে ঘেরা, জংলি গাছ দিয়ে। ঘরের চৌকিতে উপুড় হয়ে লেখার অধিকার। আজ শুনি সে নাকি নতুন নয়, আমার একার নয়, সকলেরই একই খোঁজ। এর জন্য বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত যাই। লেখার একটা টেবিলের সন্ধানে।

আমিই শুধু স্বপ্ন দেখে আসছি, আমাকে কেউ যেন দেখতে না পায়। আমার যা দেখার সেগুলো দেখা শেষ, আর দেখার জন্য আমাকে পৃথিবীতে আসতে হবে না।

কবিতা এসেই নেশার মতো চেপে ধরে চারিদিকের জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলতে শুরু করে, মানুষের মুখ অস্পষ্ট করে দেয়। নিত্যনতুন সব জিনিসকে, আপাততুচ্ছ জিনিসকে মূল্যবান করে তোলে। নিজের জীবনের ব্যথা-বেদনা অবশ করে দেয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি। তারপর থেকে পার্থিব যত কাজ করেছি, করেছি অনুপস্থিত থেকে। খুব কম কেউ, বা কেউই নয়, টের পেত আমার অনুপস্থিতি। নিজের বোনা জালে দিনে দিনে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। আবদ্ধ অংশের মধ্যেই ছিল এক বস্তুর সমান শূন্যতা। বনের ভেতর দিয়ে জ্যোৎস্নায় রাস্তা যা গাছের ডাল থেকে বাঁচতে মাথা নীচু করে এদিক-ওদিক কাটিয়ে বন পার হয়ে নদীতে বিছিয়ে যায়, সেই রাস্তা আসলে শূন্য যা বস্তুর সমান। সেই শূন্যের অধিকারী হওয়ার সাধনায় দিন কাটিয়েছি। বোর্হেসের একটা কবিতার শেষ লাইনও এরকম— ‘আমার যা নেই তা দিয়ে গেলাম যে নেই তার হাতে’। সেটা তাঁর মৃত্যু প্রসঙ্গে। আমার জীবিত অবস্থার স্বপ্নের চেয়ে আলাদা।

কবিতার পাশাপাশি আপনি গদ্যও লিখেছেন, লিখছেন। কবিতায় বলা যাচ্ছে না এমন কোনো কারণ রয়েছে গদ্য লেখার পেছনে? এই প্রশ্নের কারণ আপনার গদ্য পাঠকের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা।

আমার কবিতাও পাঠকের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা, ভালো মন্দ যাইহোক, হওয়া উচিত ছিল। আমার গদ্য হয়েছে, বলছেন, সেটাও হওয়া স্বাভাবিক। গদ্য যেমন লিখি তেমনটা আমি চাই না লিখি। তাছাড়া গদ্যগুলো একটার থেকে আর একটা এত আলাদা, বোঝা যায় না তার রকমটা কী। গদ্য কেমন হবে তার একটা ভাসা ভাসা ধারণা এখন তৈরি হয়েছে। যদিও সেটা বিশ্বাস করে উঠতে পারি না, যে-ধারণা তৈরি হচ্ছে সেটা ঠিক কি না। তবে কবিতায় যা লেখা যায় না তাই যে-গদ্যে লিখি সেটা বলার পূর্বশর্ত এই যে, আমি কবিতাই লিখতে চাই তা নয়। গদ্যে যা লিখি, সে-গদ্যেরই বিষয়। কিছু কিছু অংশ কবিতার গায়ে ঘেঁষে যে আসে সেটা গদ্যের দুর্বলতা মনে হয়। আবার এও মনে হয় তেমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। এই প্রশ্নের মধ্যেই হয়তো নিহিত আছে গদ্য আর কবিতার তফাত কী। জাপানি লেখক ওগাওয়া ইয়কো-র লেখায় দেখেছি মাঝেমাঝেই কবিতা ছুঁয়ে যেতে। সেটা গদ্যে উনি ব্যবহারও করেছেন ঠিকভাবে। গদ্যের ক্ষতি হয়নি।

কই আর তেমন লিখেছি। গুটিকতক। লিখছিই-বা কোথায়। একে লেখা বলে না। সামান্য লিখেছিলাম। এখন তাও বন্ধ হয়ে আছে অনেকদিন। লেখক হয়ে ওঠার জন্য যে-নির্জনতা দরকার সেটা অর্জন করে উঠতে পারিনি। এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার কোনো উপায় নেই চেষ্টা করে যাওয়া ছাড়া। লেখা ছাড়া আমার করার কিছু নেই। লিখতে আমাকে হবেই। না লিখলে রেলের কেবিন-এর মতো গায়ে সেঁটে যাবে abandoned। অনেকদিন হল এই অবস্থা। সামনে কোনো মুক্তির উপায় নেই। জীবনের বেশিরভাগ গেল দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে। জিতলাম না।

যা লিখেছি, যেটুকু, সেটুকু বড়োজোর চর্চা। সব লেখাই আসলে চর্চা। লেখা আসলে ধারাবাহিক অনুশীলন। লেখ, কাট, ফেলে দাও। কোনো লেখা একদিন দু-দিনের বেশি শান্তি দেয় না। আমি নিজের গদ্য নিজে সমর্থন করি না। যেমন করি না গল্প উপন্যাস বলে এতদিন যেসব ছাপা হয়ে আসছে সেগুলো। পাঠকের কাছে যেগুলো পৌঁছোচ্ছে। যে গদ্য আমি লিখেছি তার উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। পরে আজ দেখছি সেগুলো ঠিকভাবে হয়নি। ঠিক উপায় সেটা নয়। ঠিক কী উপায়, তার একটা আবছা ধারণা তৈরি হয়েছে। তেমন করে লিখে উঠতে পারিনি এখনও। তবে এটা ঠিকই যে, যা লিখেছি, যেভাবে লিখেছি, সেটা ঠিক ছিল না। যেমন যেভাবে লেখা হয়ে এসেছে এতদিন, সেটা একেবারেই ঠিক ছিল না। স্বপ্ন দেখি আমি সেই গদ্য লিখে উঠতে পারছি। লিখছি, কাটছি, টাইপ করছি, প্রিন্ট করছি। ফেলে দিচ্ছি। এই স্বপ্নটা বাস্তবে হয়ে ওঠা খুব শক্ত। যেখানে যেতে চাই সেই জায়গাটা আদৌ আছে কি না, থাকলেও স্থায়ীভাবে আছে কি না, এই চোখ দিয়ে দেখতে পাব কি না। জায়গাটা আছে সেই বিশ্বাস নিয়ে খুঁজছি, জায়গাটা আছে সেই বিশ্বাসও খুঁজছি।

“রাস্তায় যেতে যেতে বহুদিন আগের বন্ধু, কলেজ জীবনের, সুহাসের সঙ্গে দেখা হয়। ওর পার্ট ওয়ানে অনার্স কাটা যাবার পর থেকে ওর সঙ্গে কারও বিশেষ দেখা হয়নি। কলেজই ছেড়ে দেয় একসময়। সকলের কাছেই সুহাস অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাতে ওর নিজেরও ভূমিকা ছিল। ও নিজেও আরও অস্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছিল নিজেকে। ততদিনে জিনিসের দাম বেড়েছে, সবজির রং ওঠা। দেশটা গ্রীষ্মপ্রধান হয়ে উঠেছে। সেই সুহাসের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মুখোমুখি। চিনতে পেরে প্রবল উৎসাহে এগিয়ে আসে সুহাস। আমি গাছের নীচে সরে দাঁড়াই। ও কিছু বলার আগে ‘মা আর নেই’ কথাটা বলতে গিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে মুখে বাধে”। এই কথাগুলো বলা কবিতার এক্তিয়ারে পড়ে না। আমি একথা কবিতায় বলতে না পেরে গদ্যে লিখতাম তা নয়। এটা গদ্যেরই বিষয়। আমি আমার আগের গদ্য পড়তে পারি না। বানানো মনে হয়। পুরোনো কবিতা, অন্ধকারবয়সি, লকডাউন, লকডাউন ২ থেকে তবু পারি এখনও। এই লেখাগুলো এখনও পরিত্যক্ত বলে মনে হয় না।

আমার গদ্য পাঠকের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা, সেটা হয়তো ঠিকই। কিন্তু এতে বোঝা যায় না, সেই অভিজ্ঞতাটা কেমন। কেউ কেউ প্রশংসা করেন। সেই প্রশংসা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। প্রায় কেউই যে পড়েন না, এতে আমার সুবিধেই হয়। যতদিন কারো চোখে না পড়ে, ততদিনে লেখাগুলো আরও শুধরে নিতে পারি। এরকম করতে করতেই একসময় লেখা থেমে যাবে। অপ্রস্তুত লেখাগুলো পড়ে থাকবে। তাদের হয়ে বলার, সংশোধনের কেউ আর পেছনে থাকবে না।

কবিতার জন্ম ও মৃত্যু সম্বন্ধে আপনার ধারণা জানতে চাই।

কবিতার জন্ম সম্বন্ধে ধারণা, কোনো কিছু সম্বন্ধে ধারণাই বড়োজোর সম্ভাবনামূলক। কী করে কবিতা জন্ম নেয় সেটা জানা যায় না। কেউই জানতে পারে না। মনের মধ্যে কীভাবে তৈরি হয়ে ছিল, কোনো সামনে ঘটা ঘটনাকে আশ্রয় করে শব্দরূপ পেয়ে কবিতায় আসে, সেটা জানা যায় না। কোনো একটা বিশেষ কবিতা হঠাৎ করেও লেখা হয়ে যায়। পরে পড়ে দেখা গেল মনে হচ্ছে সে ভিনদেশি। আমার লেখাই নয়, গভীর ভালো লাগার জন্ম দিয়েছে। অনেক কবিতা আসলে অনেক কিছু নয়, সামান্য কিছু। হাতে গুনতি কয়েকটা জিনিস। একটা কবিতা তাই আগের কবিতা থেকে নতুন শুধু ভঙ্গিতে, নয়তো আরও সংক্ষিপ্ততায়। বাড়ির পেছনের বকুল গাছে সুলতার ওড়না গলায় আত্মহত্যা নতুন কিছু নয়। যদি কবিতায় সার্থকভাবে আসতে হয়, নতুনভাবে গড়ে নিতে হবে। আমরা চিরকাল পেছনে ফেলে আসা জিনিসগুলো খুঁজছি। কবিতা কিছু এনে দিচ্ছে, ছুঁইয়ে দিচ্ছে। সে দিচ্ছে সকলকেই। যারাই ঠিক লিখছেন। অটোয় যেতে যেতে মাথায় এসেছিল, ‘ধ্যান চেয়ে, বস্তু চেয়ে, ছায়া চেয়ে, গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত’। কিছু চোখে পড়েছিল বলেও হয়তো নয়। এক বিচিত্র রসায়নে তৈরি হয়ে ছিল ভেতরে।

কবিতার মৃত্যু কিন্তু সুনিশ্চিত। জন্মের পর থেকেই তার মরে যাবার তোড়জোড়। মরেও যায় সঙ্গে সঙ্গেই। পৃথিবীর প্রতিটা পাওনাই তাই। সন্তানের কাঁধে হাত দিলেও স্পর্শ মরে যায়, হাত সরিয়ে নিতে হয়। হাত বুলোতে হয়। তার অর্থ বিভিন্ন নতুন স্পর্শবিন্দু ছোঁয়া, বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করা। কবিতার মৃত্যু হয় কবিতাটা মাথায় পৌঁছোনোর পর থেকে। সব ক-টা আঙ্গিক একে একে উপলব্ধ হবার পর। তাই নতুন কবিতা।

কবিতার ক্ষেত্রে আপনার পূর্বসূরী কে বা কারা? এবং কেন?

আমার সম্ভবত কোনো পূর্বসূরী নেই। ঠিক বলতে পারি না। তবে রবীন্দ্রনাথ পড়িনি পাঠ্য বইয়ের বাইরে। খুব কম পড়েছি। পাঠ্য বইটাও মন দিয়ে পড়িনি। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ থেকে গেছেন গানের আড়ালে। ‘শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে’-র আড়ালে। কিছুকাল কাফকার ডায়েরি পড়েছিলাম। খাপছাড়াভাবে। চোদ্দো সালটায় পড়েছিলাম ওঁর তিনটে উপন্যাস। ট্রায়াল, আমেরিকা, আর ক্যাসেল। ট্রায়াল যদিও আগেও পড়েছি বাংলা অনুবাদে। তাহলেও এটা বলা কি ঠিক হবে যে ওঁরা আমার পূর্বসূরী? বা, উনি আমার পূর্বসূরী? আমার ‘প্রসন্ন হাতি’, ‘অশুভ মোমবাতি’ পড়লে এখন বুঝতে পারি সে-অর্থে ওগুলোর কোনো পূর্বসূরী নেই। এত আনকোরা, কাঁচা। পরে যে শুধরে শুধরে আসছি তার পেছনে থাকে আগের লেখা। তারাই পূর্বসূরী হয়ে দাঁড়ায়। সেটা সকলের ক্ষেত্রেই ঘটে। নিজের আগের লেখা তাকে শিক্ষিত করে। আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। তবে আমার বিষয়টা একটু আলাদা এই জন্য যে, আমাকে বাংলা সাহিত্যের কেউ দীক্ষা দেয়নি। নিইওনি, পাইওনি।

আমি ভূমেনদার হয়ে জীবনানন্দের কবিতার খাতা অনেক ঘেঁটেছি। ন্যাশনাল লাইব্রেরি গিয়ে মাইক্রোফিল্ম থেকে খাতায় লিখে এনেছি। বাড়িতে টাইপ করেছি। সেই সুবাদে ওঁর অনেক লেখার সঙ্গে সম্যক পরিচয় হয়। কারো কবিতা পরপর পড়লে মনে হয় একইরকম, উলটেপালটে লেখা। আসলে তা নয়। ওঁর অনেক আবিষ্কার। নিজে সৃষ্টি করেছেন। যার ছায়ায় আজকের বাংলা কবিতা। হয়তো আমারও। আমি পনেরোটা খাতা থেকে কপি করেছিলাম। পরের দিকে ওঁর লেখা কিছুটা পালটাতে দেখেছি। কবিতা মুখের কথার কবিতা হয়ে উঠছিল। কবিতায় উনি খুবই ব্যক্তিত্ববান। আমি বিশ্বাস করি প্রতিভা বলতে যে-সব গুণের সমষ্টি বোঝায়, তার মধ্যে ব্যক্তিত্ব, সততা, এই দুটো জিনিসও পড়ে। অঁরি মিশো, ব়্যাঁবো, রেনে শ— এঁদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ছিল যা কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে। জীবনানন্দেরও। জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকলেও আমার পূর্বসুরী সে-কথা টের পাইনি। যুক্তি বলে আমাদের সকলের লেখার গোড়ায় জীবনানন্দ। আমি কবিতায় এসেছি আড়াআড়ি, নিজের মতো, নিজের সময়ে।

আপনার অনেক কবিতাতেই বাক্যগঠন এমন, মনে হয় অনুবাদ কবিতা পড়ছি।

অনুবাদ কবিতার গড়ন হয়তো নির্ভর করে মূল ভাষার গড়নের ওপর। যদি কেউ সেই গড়ন রেখে দেন, বাংলার মতো করে পালটে না নেন। অনুবাদ কবিতা বলতে মূলত ইংরেজি থেকে অনুবাদই বোঝানো হয়ে থাকবে। ওই ভাষা থেকে অনুবাদই বাংলায় বেশি হয়। এই প্রশ্নের সঙ্গে তেমন কিছু কবিতার উল্লেখ করলে ভালো হত। না হলে বোঝা মুশকিল হবে অবাঙালি কী ধরন রয়ে গেছে। ফরাসি কবি রেনে শ-এর কবিতার গড়ন লক্ষ করলে দেখা যায়, তাঁর কবিতার মূলেই আছে তাঁর বাক্যের গঠন। সিধে বাংলামাফিক করে নিলে কবিতাটাই মরে যায়। সেটা কোনো ভাষার বৈশিষ্ট্য নয়। কবির বৈশিষ্ট্য। জানি না তেমন আমার কবিতায় কোথায় আছে। তবে এটা ঠিক বাংলা, ইংরেজি কোনো ভাষাই তেমন আয়ত্তে নেই। কাজ চালানোর মতো জানি। কিছু কবিতা আমার ইংরেজিতে লেখা। পরে অনুবাদ করে বাংলায় ছাপিয়েছি। কিছু কবিতা এখনও পড়েই আছে ইংরেজিতে যা মনোমতো অনুবাদ করে উঠতে পারিনি। মনোমতো অনুবাদ না করে উঠতে পারারই কথা। পারলে আগেই বাংলায় লিখতাম। তবে আমার বিশ্বাস, যেগুলো প্রথমে ইংরেজিতে লেখা, সেগুলোর এই দোষ হয়নি। যদি হয়ে থাকে তবে পাঠককে বলতে হবে সুধী পাঠক। তবে সেটার সম্ভাবনা খুবই কম।

সর্বজ্ঞ বলছিল, নদী পেরোতে গেলে আগে ভাষা পেরোতে হয়, ধ্বনি পেরোতে হয়, পার হতে হয় উচ্চারণ করা ঠোঁট, উচ্চারণ না করা ঠোঁটের নিথরতা, চোখের ভাষা। তাহলে নদী পার হওয়া যায়। সকলের নদী, নিজস্ব নদী। ভাষা না পার হলে, ধ্বনি পার হতে না পারলে, টেলিগ্রাফিক কোডের মতো খটাখট শব্দ কানে আসে। নদী পেরোনো অধরা থেকে যায়।

আপনার কবিতায় অনস্তিত্বের অস্তিত্ব, অনুপস্থিতের উপস্থিতির বিষয়ে এক ধরনের ঝোঁক লক্ষ করা যায়। সে-বিষয়ে কিছু বলুন।

বাড়িয়ে লেখা, যা নেই তা লেখা, সেটা কবিতার প্রয়োজন। মানুষ মুখে যা বলে সেটাই বাস্তব। আমরা মুখে বাক্যগঠন করে যা বলি। বলার পরে গড়ে ওঠে, সত্যি হয়ে ওঠে। বাস্তব ঘটনা তাকে অনুসরণ করে। The flowering hawthorn was my first alphabet, এ-কথা যিনি লিখেছেন, তিনি জানেন সেটা সত্যি নয়। কোনো ফুল কারো বর্ণমালার প্রথম বর্ণ হতে পারে না। কিন্তু লেখাটার পরে হয়। উনি সত্যি করে নেন। যে পড়েন তার কাছেও ফুটন্ত ফুল তার বর্ণমালার প্রথম বর্ণ হয়ে ওঠে। যিনি বাস্তবনিষ্ঠ হয়ে লিখতে চান, তার জানা উচিত শব্দ ছাড়া বাস্তব ঘটনা সম্বন্ধে মানুষের কোনো বোধ নেই। Wittgenstein কোথাও লিখেছিলেন, You learned the concept of pain when you learned language. ভাষায় বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য হয়তো বিপুল সমুদ্রকে একটা বোতামে বন্দি করা যাতে সে বোধগম্য হয়, নাড়াঘাঁটা করা যায়। নিয়ে যাওয়া যায় চামচে করে। কবিতার উদ্দেশ্যও তাই, শব্দের মতো। কবিতা যার হাত নেই, তার হাত ফিরিয়ে দেয়। মিলান কুন্দেরা লিখেছিলেন, our unappeased yearning to return হল নস্টালজিয়া। কবিতা সেইখানে ফিরিয়ে আনে। বাস্তব অবাস্তবের ধার ধারে না। আমি মাকে ভালোবাসি, এটা বলার পরে যা অনুভব তৈরি হয়, তার সঙ্গে বাস্তবের মাকে ভালোবাসার কোনো মিল নেই। অন্য কোনো বাস্তবও নেই। বাক্য যা বলেছে সেটাই ভালোবাসা, ততটুকু। আমাদের দুঃখ বেদনার মূলেও আছে শব্দ ব্যবহারের দৈন্য। যদি আমার ছেলেবেলা এক কি দু-কথায় বর্ণনা করতে পারতাম, অনেক ব্যথার উপশম ঘটাত। পেরে উঠি না, যতক্ষণ পেরে উঠি না, সে কুয়াশা রচনা করে ব্যথা দিতে থাকে। যত কবিতা তত বেদনামুক্তি। কবিতা যত তৈরি হয়, তা মানুষের অদেখা বেদনার কণামাত্রও নয়।

কিন্তু একটা জিনিস অপরিষ্কার থেকে যায় যে, প্রশ্নকর্তার কাছে কি জিনিসটা সত্যিই খুব অভিনব, নতুন? আমিই শুধু করি? ‘হারিয়ে যাওয়া কালো সুটকেসটা পড়ে আছে যেখানে, ইচ্ছে করে হারিয়ে গিয়ে সেখানে চুপ করে বসে থাকি’।— এই লাইন কি কবিতায় নতুন, এটুকু অবাস্তবতা? সে তো প্রায় সকলের লেখাতেই থাকে। কবিতাকে না লেখার জন্য ধরে বেঁধে রাখাও যায় না। সে বাদামি রঙের চিল দেখে লিখবেই, ‘সোনালি ডানার চিল’।

এটা ঠিক যে, অন্য বিষয়ের মতো আমি এক্ষত্রেও ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না স্বপক্ষের যুক্তি। মানুষ ভাবতে চায়, সেই ভাবনার শক্তি নিহিত থাকে নিজেরই মধ্যে। ফলে ভেবে উঠতে পারে না। নিজেকে সে সারাজীবন দেখতেও পায় না (Still, it may be that man wants to think, but cannot. — Heidegger)।

একটি কবিতা লেখা হবার পরে কতটা কাটাছেঁড়া করেন? কবিতাটি পত্রিকায় ছাপা হবার পরে যখন কবিতার বইয়ে যায় তখনও পালটে যেতে থাকে? কবিতার বই প্রকাশ পাবার পর কি নিশ্চিন্ত বোধ করেন?

কবিতা খুবই নশ্বর। আকারে, প্রকারে, আয়তনে, শব্দ ব্যবহারে। শেষ যেখানে ছাপা হয়েছে সেখানে বসেও সন্দেহের চোখে তাকায়। এপাশ ওপাশ দেখে, অন্যখানে সরে বসতে চায়। এর একটা কারণ কবিতায় সত্যিই উপস্থিত কোনো উন্নতির সুযোগ। আর একটা কারণ হয়তো, তার সেভাবে আর উন্নতির সম্ভাবনা নেই, কিন্তু বসে বসে তার বয়স হয়ে মলিন হয়ে যাওয়া। হয় তখন তাকে পরিত্যাগ করো, প্রকাশককে ডেকে বলো এটা আমার লেখা নয়, কিংবা সুযোগ থাকলে লুকিয়ে ফেল যেখানে ছাপা হয়ে আছে সেখান থেকে।

কিছু কবিতা অবশ্য একবার লেখার পর আর পালটায় না। ‘বিশ্ব যেমন নীরব, আমি যদি সরব হতাম সে-নীরবতার অন্তর্ভূত!’ বা ‘নারী আসলে রক্তমাংসের আবরণের নীচে গভীর গন্ধের পেটিকোট’। তেমন কবিতা।

যদিও এটা কোনো প্রোটোকল কি না জানি না, অনেক কবিই কবিতা একবার যেভাবে ছাপা হয় আর পালটান না দেখেছি। পত্রিকা থেকে বই, বই থেকে সংকলন। তাঁদের স্বপক্ষের একটা যুক্তি, যা লিখেছ তার দিকে ফিরে না তাকিয়ে নতুন লেখা লেখ। পুরোনো নিয়ে সময় নষ্ট করো না। এই যুক্তির স্বপক্ষে আমি তদবির করতে পারি না। পরবর্তীকালে মন যাতে খারাপ না হয় তার জন্য কবিতা টাইপ করে এক বছর ফেলে রাখার যুক্তি আমার কাছে বেশি সাবলীল মনে হয়।

ছাপা হবার আগে বিস্তর কাটাছেঁড়া সে তো আছেই। আমার একটা conversion rate বার করলে হয়তো জানা যেত যে, প্রতি একশোটা কবিতা থেকে একটা কবিতা শেষ অব্দি ছাপার ঘরে পৌঁছোয়। এটা অবশ্য একেবারেই অসম্ভব কিছু নয়। একটা বই, ধরুন চার ফর্মার, তৈরি হতে স্বাভাবিক সময় নেওয়া উচিত দু-বছর। সেখানে আমার গত একবছরে বই হয়েই বেরিয়েছে চারটে। এতে নিজের কবিতার প্রতি সুবিচার করা হয় না।

আমরা এতক্ষণ যে-প্রশ্নগুলো করেছি, তার প্রত্যুত্তরে আপনি যা যা বললেন, সেগুলোর যদি মূল্যায়ন করেন।

এতক্ষণ করা প্রশ্নগুলো সম্বন্ধে বললে বলতে হয় কোনো প্রশ্নই যেন করেননি, প্রত্যুত্তরে আমিও যেন কিছু বলিনি। এড়িয়ে গেছি। যে-আমি অতি সাধারণ, আটপৌরে, সেটা সযত্নে এড়িয়ে গেলাম। যা লিখলাম উত্তরের অছিলায় সেগুলো আমার নয় অন্য কারো, অন্য কেউ তার অধিকারী। আমি সে-সব নিজের বলে স্বপ্ন দেখেছি। এটা হতেই হত। এরকমই হয়। আমাদের ইতিহাসের ওপরে সামান্য অধিকারও আমাদের নেই। যে-ইতিহাস বিবৃত, তা শুধু স্বপ্ন। এই জীবনটা যেমন জীবনের বিজ্ঞাপন, আগাগোড়া মিথ্যে প্রবঞ্চনা, তেমনই। যা বললাম সেগুলো অসত্য, কিন্তু ভুল নয়। মিথ্যেও সম্ভবত নয়। যে-অধিকার আমি কায়েম করেছি, তার কিছু অন্যায়, কিছু ভুল। বাকি সব সত্যি, ঠিক। এও ঠিক যা আমি এড়িয়ে গেলাম, বললাম না, সেগুলো ফুটে রইল ছত্রে ছত্রে, ধরিয়ে দিয়ে গেল। আমি আরও একবার ধরা পড়ে গেলাম। হানি হল আমার সযত্ন-লালিত সম্মানের।

আপনাদের প্রশ্ন এক অর্থে নির্দোষ। কিছু খোলসা করতে চায়নি। আমি ধরা দিই, চায়নি। ডিঙির যতটুকু জলে ডুবে থাকে ততটুকু গভীরতাই আপনাদের প্রশ্নে। চায়নি আরও গভীরে ঢুকে খুঁজে বার করে জলের নীচের ভাঙা শাঁখা, খেলনাপাতি। সেগুলো পড়ে থেকেছে আপনারা আঘাত করেননি। বৈঠা আর জলের আঘাতের নরম কোলাহলই শেষে রয়ে গেল, বোঝা গেল না আকাশে চিল উড়তে উড়তে মাটির মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে নীচে ছড়িয়ে পড়ার ভয় পারস্পরিক ছিল কি না।

নিজে কিছু বলুন।

বলছি। হাত থেকে জল কিছুতে মোছে না। মুছে আসি।

পুরুষ মানুষের জীবনে একজন গাছরমণী প্রয়োজন হয়। দরজার বাইরে শুয়ে থাকবে, নিজের দাবি আর ভবিষ্যৎ বিষয়ে চিন্তাশূন্য, পুরুষের নাক ডাকার মতো কন্ঠস্বর, পা ফেলে হাঁটার সময় যে মাড়িয়ে যায়, যে একা খায়, একা ঘুমোয়, হাই তোলে, কখনো স্নান করে, গায়ে কচ্ছপের গন্ধ। এ-জীবনটায় আমার আনুকূল্য অনেক, প্রতিকূলতা কম ছিল। গাছরমণীর হদিস না পাওয়ার আনুকূল্য, নদীর থেকে কখনো দূরে বাস না করার আনুকূল্য, ভাঙা টিউবওয়েলের পাশে খালি বালতি নিয়ে বসে থাকার আনুকূল্য, অনর্গল সুখের হাসির, মুখের হাসির জলের মতো বয়ে যাওয়ার, নিজের দুঃখে কাতর হয়ে কান্নার সৌভাগ্য, যখন তেমন দুঃখ থাকে না, কান্না দিয়ে কষ্টের নির্মাণ করার, আয়নার সঙ্গলাভের আনুকূল্য। আর, প্রতিকূলতার মধ্যে শুধু চিরকাল নদীর পাশে বাস করার প্রতিকূলতা। নিজেকে রক্ষা করার বিষয়ে আমার নিষ্ক্রিয়তায় আমি কৃতজ্ঞ। জীবনে বেঁচে থাকার অছিলায় যে আনুকূল্য গ্রহণ করার কথা, সেগুলো নেবার অস্বীকারে। আমি আরও কৃতজ্ঞ এইজন্য যে, অনেক আগে আমি ঘোষণা করেছি, আমি বেঁচে নেই, যা সম্পত্তিই থেকে থাকুক আমার, সেগুলোর হয় মূল্য নেই, বা সে-সব অনিশ্চিত মূল্যের। তাই সে-সব ধূলিসাৎ করে বাতাসে মিশে যাচ্ছি।

ছোটোবেলায় আমার বোন মারা যাবার পর বোন যা-যা ভালোবাসত মা সেসব ছেড়ে দেন। মা আর জীবনে রসগোল্লা খাননি, আম খাননি। সারাজীবন সাদা শাড়ি পরেছেন। আমি সেই অভিজ্ঞতার জ্ঞান দিয়ে গঠিত। মাসের প্রথম সপ্তাহ পার হবার পর মায়ের কাছে রুমাল কেনার টাকা চাইলেও মা বলতেন, ‘পরের মাসে কিনিস, বাবা’— এই সংলাপ দিয়ে। আটাকলের পেছনের দেয়ালে ঋতুর পর ঋতু পড়ে থাকা প্রতিমার চালার জলে শিশিরে ভিজে নষ্ট হতে থাকা দিয়ে। এইসব অভিজ্ঞতার অনিশ্চিত মাটি দিয়ে তৈরি। ঋতু পালটে বর্ষা আসে। পাড়ার রাস্তার ধারে কালো কুকুর মরে পড়ে থাকে। গন্ধ হচ্ছে দেখে কয়েকজন মিলে কুকুরটা ফেলে দিয়ে আসে ভাগাড়ে। কিছুদিন পর পাড়ায় বিয়ের আসর বসে। যারা কুকুর ফেলতে গেছিল, তারা কালো চাদর গায়ে সার বেঁধে খেতে বসে হাত ধুয়ে। আমি এই অভিজ্ঞতা দিয়ে গঠিত।

বাড়ি থেকে সকালবেলা বেরিয়ে এসেছি। সেটা আমার ব্যর্থতা। ডান দিকে কাঠের দোকান। একটা লোক কাঠ কাটছে, পেরেক পুঁতছে। সেটা আমার আর একটা ব্যর্থতা। বাঁ-দিকের ফাঁকা জমিটা শুনছি বিক্রি হয়ে গেছে। জঙ্গল সাফাই হচ্ছে। বাড়ি তৈরি হবে। সেটা আমার ব্যর্থতা। দু-জন লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে সেটা আমার ব্যর্থতা ভেবে ভয়ে তাদের দিকে তাকাইনি। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে চলেছে সেগুলো সব আমার ব্যর্থতা, কোনো কাজ আমাকে নেয়নি। মানুষের বড়ো হয়ে ওঠা, নামি হয়ে ওঠা, ছোটো হয়ে যাওয়া, কোনো কিছুর সঙ্গে আমি থাকিনি।

এতসবের পরে তাও যা পেয়েছি তা যথেষ্টর চেয়ে বেশি। বাজারে মাছ কাটা বড়ো বড়ো বঁটিগুলো দিনের পর দিন ব্যবহার হয়ে ক্ষয়ে যেতে দেখেছি। বছরের পর বছর ধরে বঁটিগুলো দিয়ে জলজ প্রাণী হত্যা হয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার অছিলায়। জালে ধরা পড়ার সময় তারা হয়তো তখন শ্যাওলা খুঁজছে, জলের ভেতরে পোকামাকড় খুঁজছে, বা, আরও কোনো স্বগোত্রীয় প্রাণকে খুঁজছে। আমাকে তেমন কেউ ধরে নিয়ে যায়নি। আলো-হাওয়ায় বেঁচে আছি ঘরের মধ্যে নিজের ঘর তৈরি করে। মাকড়সার ছবি এঁকে। আমার বাড়ি ফেরার ঠিকানা আছে। একটা জানালা আছে। এক বিষয় ফুরোনোর পর আর এক বিষয় নিয়ে বেঁচে থাকা আছে। নিজেকে বার বার পালটে নেবার অধিকার আছে। হোক না আমার অতীত অপরিচ্ছন্ন, অপরিষ্কার, সকলের মতো। কোনো বৈশিষ্ট্য না-ই থাক।

সারা সকাল তোমাকে দেখিনি বলার মতো সম্পর্ক যদি নাও থাকে, যদি অলিগলি দিয়ে লুকিয়ে যেতে গিয়ে বার বার দেখা হয়ে যায় যার ভয়ে গলিতে ঢুকেছি তার সঙ্গে, যদি মনে থাকে অন্ধকারেও মাথাব্যথার অনুভব হয়, তবুও আমার যা পেয়েছি সে-সব গ্রহণ করার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে, পরম ভক্তির সঙ্গে। যা পাইনি তার জন্য আক্ষেপ করার কথা নয়। আক্ষেপে সেই বস্তু মেলে না। যা মেলার কথা, পাওনা যা, তার হানি হয়। কম করে মেলে। যতগুলো কবিতা আমি লিখেছি ততগুলো নবীন দেশের আমি মালিক। যার কোনোটায় আমি বাস করি না। বাস করি আমার মালিকানার শেষ দেশ থেকে নতুন আর এক অনাবিষ্কৃত দেশে যাবার রাস্তায়।

যদি এমন হত, একটা মানুষের পরিচয় শুধু তার খুঁতটুকু, সেটুকুই তার অবশিষ্ট থাকে, দৃশ্যমান অংশটা শুধু তার খুঁত, তাকে যতটুকু দেখা যায় সেটুকু তার যা নেই তার সমষ্টি, তাহলে আমি তাই। ‘অলোক সেন-এর বাড়ির দরজা খুললে দেখা যায় অলোক সেন চেয়ারে ঠায় বসে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। দরজা বন্ধ থাকলে চেয়ার ফাঁকা, অলোক সেন সেখানে নেই।’

কোথাও যাবার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা হাঁটতে হয়। বাসে উঠতে হয়। বাস থেকে নেমে অটো ধরতে হয়। অটো থেকে নেমে পায়ে হেঁটে পৌঁছোবার ঠিক আগে অনুতাপ আসে। কেন এলাম। কেন গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম না, জিরিয়ে নিতাম গাছের মতো। নীচ দিয়ে যেত হাতবদল করা সম্ভার, অন্ধকার হলে কেউ নীচে বসে মালা বিক্রি করত। প্রতিটা যাত্রা আমার এক-একটা বক্তব্য, এক-একটা অভিমত। প্রতিটা অভিমত একটা করে যাত্রা। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। সেই অভিমত শেষ মুহূর্তে পালটে যেতে চায়। কোথাও পৌঁছে প্রতিবার মাথা নীচু করে ঘরে ঢুকি। এখন সাক্ষাৎকারের শেষে এসে যা যা এতক্ষণ বলেছি সেগুলোর ভার বয়ে, সেগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে মাথা নীচু করেই চলে গেলাম।

নিত্যব্রত দাসের নির্বাচিত কবিতা

*
এ যদি খেলার সংসার হয়, এখনও
একটু সামনে এসে দূরেই দাঁড়াও, এখনও
তোমাকে সোনার সংসার ডাকে, প্রতিদিন
এক-একবার নতুন, আরও নতুন, আমার
অজ্ঞাত প্রশ্নের অজ্ঞাত জবাব হও

এখনও না-দেখা রুপোর শেকল, না দেখা
খোঁড়ার গলি, এখনও পরিমাণমতো ভেঙে
আড়ালে দাঁড়িয়ে ভাঙো…

*
এত শান্ত হয়ে আছে তবু এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আমার
অন্ধকার হয়ে এল চোখ, ঘেমে উঠল হাতের তালু।
দেখা দিতে বারণ করেছিলাম স্পষ্ট করে, এলে মানা করেছিলাম জানাতে,
বলেছিলাম দুর্গম কোনো দেশে বা অনভিপ্রেত কোনো
সন্ধ্যায় না যায় যেন, কেউ না আনে মৃত ফোটোগ্রাফারের ফোটো
আমার কাছে, শরীরে কাটার চিহ্ন যেন না থাকে কোথাও, চোখে
কাজল পরার বা না পরার স্পষ্টতা। সবে চোখ মুছেছে, না থাকে যেন
তারও চিহ্ন সদ্যফোটা হাসিমুখে, যেন খানিকটা জন্মায় অতীতে,
এদিকের ভাষা পায় খানিকটা। অর্ধেক পাওয়া জন্ম বাকি অর্ধেক অজন্ম
সংহার করে এসে, বলেছিলাম বিকেলবেলা।

*
পাশের ফ্ল্যাটের গঙ্গা মারা গেল কয়েক বছর হল,
মেঝেতে অনেকদিন ছড়িয়ে রইল ভিজে গঙ্গার পা, তার জলের বালতি,
নোংরা শায়ার লেস, কোলাপ‌‌্সিব্ ল গেটে আটকে। তার আধখাওয়া
হাওয়াইয়ে পরপুরুষের পা গলিয়ে থাকার লোভ জানাজানি
হয়ে গেল চার মুখে।

ও বেঁচে থাকতে টুকটুক শব্দ বন্ধ দরজার পেছনে ঘুরত,
সে কি ছিল দেশলাই জ্বেলে আলো জ্বালাবার ?
আসলে সে কি নিরন্তর বৃষ্টি ছিল, আচার অনাচারের, কূল অকূলের
নিরন্তর যুদ্ধের অবৈধ স্মৃতি, এক শতাব্দী পরে ফাঁকা ঘরের দরজা খোলার
খাঁ-খাঁ করা মোমবাতির আগুনের সূচনা?

*
ক্ষমা কোথায় অনেকদিন খবর পাই না
আগে দেখতাম ক্ষমা সামনে দিয়ে গেল কয়েকবার,
ফিরে এল। এখন দেখি না।
এখন ক্ষমা বিশেষ কোথাও যায় না, ফেরেও না।
মেঘ করে মিশে থাকে আশেপাশে। আঁচড়ে দিয়েছ কেউ
পানপাতার মুখটা, থমকে গেছে বিদ্যুৎ চমকানো।

কলসি নেই বললে শুনি কলসিতে ঘরঘর শব্দে জল ভরে
নদী নেই বললে ঘোর বন্যায় কলসি নেই, ঘড়া নেই বলে
চারিদিকে রব তুলে অতীব ভয়াল বেগে ছুটে যায় নদী।

জ্যোৎস্নার নদীতে তখন ক্ষমা গান গাইতে গাইতে বেয়ে
যায়— ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই।

*
দ্বিধা এসে থেকে থেকে ফিরে গেছে একবার,
ফুটিয়ে গেছে নিজের নাম যেখানে একেলা বসেছিল এসে।
এতদিনে ঢেকেও গেছে কিছুটা প্রতীক্ষার ঘামে।
দ্বিধা দ্বিতীয়বার আসবে কোনো একদিন, তার পরেও হয়তো
আসবে অনেকবার। একসময় আর আসবে না দ্বিধা।

তখনও আমাকে থাকতেই হবে বসে, মাটিতে যেখানে গুনগুন
করে গেছে মাছি, কখন সেখানে দ্বিধা আসে। বসে থাকতে হবে যখন,
ততদিনে স্পষ্ট হয়েছে যে দ্বিধা এসেছিল, আর কেউ আসেনি,
আসবে না, দ্বিধাই শেষ এসেছিল আমার কাছে। দ্বিধাদের কারো সঙ্গে
আমার দেখা হয়নি বেশি আলোয় চিমনি ভেঙেছিল।

*
এই সকালের পেছনে রাত ছিল নিশ্চয়ই; কাল রাতে কোথায়
ছিলাম! মনে পড়ে, রাত দুটোর সময়, তখন শিয়ালদায়,
বৃষ্টির ফোঁটা নিয়ন আলোয় এসে অন্ধকারে চলে যাবার ফাঁকে উঁচু
বাতি ঘুরিয়ে দেখছিলাম শহর কলকাতা। শহরটা দ্বিতীয়বার ঘুমিয়ে
পড়ার পর বিডন স্ট্রিট দিয়ে কালো একটা ছাগল ছিপছিপে বৃষ্টিতে
ভিজতে ভিজতে হাঁটছিল। ফিরছিল, না কি শুধু হাঁটছিল!

*
কাল সারারাত আমার বুকের বোতাম নিশানা করে ছিল এক হাত
ছোটো জানালাটা। কেউ নাশ করে না আমাকে, বুক ভরে থাকে বরং
পরিত্রাতার নিঃশ্বাসে। যে-হত্যা মৃত্যুর চেয়ে আদিম, আমাকে শাসায়।
আমার চেয়ে প্রবীণ তালা বন্ধ করে রাখে।
*
নিশাচরের মতো আছি সারাদিন, মহী, একটু ভালোবাসিস
আমাকে। ক্ষমা করিস গঙ্গাকে, যে, ছেঁড়া কাপড়গুলোর নিবৃত্তি
হল না। গোপন করিস না, এই দাঁতের পাটি কার। কে ক্ষয়
করেছে লাল গোলাপ, কে হীন করেছে তাকে দামে শৈবালে,
কে দিয়েছে তাকে অন্তিমের মর্যাদা। বলে দিস, এক কপর্দকও
অবশিষ্ট নেই আর, যা দিয়ে নিজের জামাকাপড় কিনি।

*
আবার গিঁট খুলেছি, এসো, এই মহিলাটিই অসভ্য সেই বিমলা।
কোন মাঠের টিকিট কেটেছে লুকিয়ে, আমাকে জাগিয়ে রেখে কখন
হারানো আংটির খোঁজে চলে যাবে কোন মোগলসরাই, টের পাব না
এক ঘুমে কত মাঠ, চরাচর, গিঁট খুলে এই জেগে থাকায়
কত ঘুম মৃত্যুর মতো গভীর।

*
আমি ভাড়া নিয়েছিলাম একটা জন্মদিন, একটা সময়কাল।
আর, একটা চড়ুইয়ের পুর্ণ মালিকানা চেয়ে উচ্ছেদ হয়েছি
সেই বিপাশায়, যে এ-সবের মালিক ছিল।

*
নিজের ভিটে, শহর সিউড়ির ওপর দিয়ে যাবার সময়
প্রতিবার জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে যাই, ‘আমি নেই’,
কে মুছে দিচ্ছে শুকনো শালপাতা দিয়ে ঘষে। বাস
পার হয়ে যাচ্ছে, কে আঁকছে গরম পিচের গন্ধ, জানালায়
বাড়ানো মানুষের মুছতে থাকা মুখ।

*
না, আর ছুঁতে এসো না, এখানে যে নেই। দেখো, আলনায় আছে
পাঁচটা আঙুল রাখা।— কী রঙের বৃষ্টি পড়ে, কার বাসার, কোন বিশ্বে
মলিন দেখায় চাঁদ, কোথায় দেখায় গভীর সে-গর্ত!
যাও, রাত কোরো না, ফিরে যাও বরং।

এক কি দু-মুঠো ঘাস, এক কি দু-শব্দের বিরোধিতা, বাসনে শব্দের
আপত্তি, হারিয়ে যাওয়া তোমার গায়ের এক কি দু-দিনের গন্ধ,
এসবের সংস্রবের জ্যোৎস্নায় মাখন কাটবে অনেকদিন। খেয়াল রেখো
সে যেন না কাটে। শেষ দু-এক বছরের নীরবতার স্নিগ্ধতা উড়ে বেড়াক বাতাসে,
যে ক-টা আঙুল ভিজল, যে-যে রঙের বৃষ্টি!
বোধ হয় ট্রেন ছাড়ল। যাই, বইতে শুরু করল গঙ্গা।

*
নারী আসলে রক্তমাংসের শরীরের আবরণের নীচে
গভীর গন্ধের পেটিকোট।

*
অর্ধেক অন্ধকার কী জানো খোটো মিঞা, অর্ধেক প্রশ্ন কী?
অর্ধেক সময় আধখানা মুসলমান, একবেলা আসা, একবেলা
না-আসা অন্ধকার থানার পাশে, ফুল ছেঁড়ার সময় কেঁপে ওঠা
অর্ধেক মেঘ? অর্ধেক সময় দোতলার জানালার পাশে শিরীষগাছের
নীচে সাইকেল খোটো মিঞার?— অর্ধেক খোটো মিঞা কী জানো?

*
নেমপ্লেট বাড়ির, অতিদূর জনহীন এক স্টেশন।

*
১৩৭৬ সালের পঞ্জিকার হলুদ পাতায় কান পাতলে শুনি সে
আগের ছিয়াত্তরেও এমনিই বিবর্ণ ছিল, এমনিই পোকায় কাটা দাগ,
এত কাগজের গুঁড়ো। জলপাইবাগানের মাটিতে ঘোড়ায় টানা
গাড়ির চাকার এমনিই নিঃশেষ। জলপাইফলের স্বাদে মিশে থাকা
একই মর্গের গন্ধ। এমনিই দেয়ালে হেলানো বহু বছরের সাইকেলের
ফাটা টায়ারে মাটির দাগ। যারা নেই পঞ্জিকার পাতা ঘিরে
তাদের বাটিতে চুমুক দেবার শব্দ এমনিই।
*
কে জানে দ্বিতীয় বাড়ির ভেতরে অবস্থান ছিল প্রথম বাড়ির।
বাড়ি ছেড়ে এসে আজ দেখি জানালা খোলা, আলো পড়েছে
বিছানায়। সিঙ্কের কল চুপ করে আস্তে আস্তে জলের ফোঁটা ফেলে।
সাদা শনের চুল মাথায় বুড়ি দু-হাত ছড়িয়ে ধেয়ে আসত।
কে জানত সে বুড়ি ছিল না, সমুদ্র ছিল, পেছনে ঠিক ধেয়ে এসেছে
বৃষ্টির ফোঁটা। ফেনায় ভেসেছে হাতাখুন্তি, কাঠের হাতল, প্রথম
বাড়ির সাক্ষী। আজ এ-বাড়ির পাঁচিলে ছায়া রেখে গেল রোদ,
সুদর্শনার চোখ হেলান দিয়ে আছে।

*
মেঘকে আঘাত করে বৃষ্টি, আকাশকে ফাঁকা নীল করে দেয়,
ক্ষতি করে মেঘে মহিষ-হাঁটা সিঁড়ির। গাছের ডালকে মেরে ফেলে
ফুল ফোটা। তোমাকে শুধু মনে পড়লেও ক্ষতি হয়
তোমার জানালায় আনমনে তাকিয়ে থাকার।

*
চল্লিশটা কবিতা লেখার জন্য হাটে হাটে চল্লিশজন বর খুঁজে
একজনও স্ত্রী মেলেনি।

*
প্রতিবার বিমলার সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় রাস্তায়
একের-পর-এক মাঠ পড়ে। লেভেল ক্রসিং পার হতে হয়,
সামনে দিয়ে ট্রেন পার হবার সময় অন্য পাশে রাত নেমে যায়।
বিমলা্র বাড়িতে যাবার রাস্তায় সার দিয়ে বসে নকল চাবি বানায়
হারানো চাবির মিস্ত্রি, বিহারি দেহাতিরা।

*
খালি হাতে ফিরে যাবার দুঃখ ছাড়া
অন্য কোনো দুঃখ কোনোদিনই ছিল না।

*
কুড়ি বছর পিছিয়ে থাকা আমার জানালায় আবছা করে লেখা
১৯৯৯। কাকার জানালা আরও পেছনে, ১৯১৫। বিমলার জানালা
দু-শতাব্দী পিছিয়ে, ১৭১৭, কাঠের ফ্রেমের ওপরে ৭ সংখ্যা মোছা
মোছা। রিকশাওয়ালার ঘর নেই, শুধু রাস্তা। বয়স নেই, শুধু
কিলোমিটার। কাঠে সংখ্যা খোদাইয়ের শব্দ, পায়ে
সংখ্যা মোছার গতি।

*
কুড়ি বছর পিছিয়ে থাকা আমার জানালায় আবছা করে লেখা
১৯৯৯। কাকার জানালা আরও পেছনে, ১৯১৫। বিমলার জানালা
দু-শতাব্দী পিছিয়ে, ১৭১৭, কাঠের ফ্রেমের ওপরে ৭ সংখ্যা মোছা
মোছা। রিকশাওয়ালার ঘর নেই, শুধু রাস্তা। বয়স নেই, শুধু
কিলোমিটার। কাঠে সংখ্যা খোদাইয়ের শব্দ, পায়ে
সংখ্যা মোছার গতি।

*
একটা ঘানি ছিল এখানে, কার্নিশে ছিল ডিশ-অ্যান্টেনা,
ডাঁই করা বিচুলির ঢিবি ছিল উঠোনের পাশে। আমগাছের
নীচের অন্ধকারে অশ্রু-সামলানো এক-যুগ ছিল সঞ্চিত।
থাকা-না-থাকার হেতু ছিল— বিশ্বাস হয় না।
*
ট্রেনগুলো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাবার সময়
বহু অন্ধকার গুহা পার হয়ে আসে।

*
কোনো নারীর পক্ষে কুপি হাতে ঘর ছেড়ে চলে গিয়ে
ঘর শূন্য করে তোলা সম্ভব নয়।

প্রকাশিত কবিতার বই

অশুভ মোমবাতি (২০১৫, দাহপত্র)
ইনস্টাগ্রামের বাড়ি (২০১৭, দাহপত্র)
অন্ধকারবয়সি (২০১৯, আক্ষরিক)
নানা রঙের কাঠের হাত (২০২০, শুধু বিঘে দুই)
লকডাউন ১, ২ (ইপাব) (২০২০, আক্ষরিক)
মমিদের রাস্তায় (ইপাব) (২০২১, আক্ষরিক)

Categories
2021-May-Interview সাক্ষাৎকার

হিরণ মিত্র

“চিত্র আমাকে রচনা করেছে, আমি চিত্র রচনা করিনি”

আলাপচারিতায় রণজিৎ অধিকারী

কথা শুরুর আগের কথা:

শিল্পী হিরণ মিত্রের সঙ্গে যে আমি যে-কোনো সময় যে-কোনো একটা কথা পেড়েই আলোচনা শুরু করে দিতে পারি, এ-প্রশ্রয় তিনিই আমাকে দিয়েছেন। এত এত কথা বলেছেন আমার সঙ্গে, তা সব এখানে রাখলে মহাভারত হয়ে যাবে। একটা পাঠযোগ্য কথোপকথন তৈরি করার অন্য সমস্যাও আছে। হিরণ মিত্রের মধ্যে থাকা অনেকগুলো হিরণ, তাদের একসঙ্গে ধরব কী করে?… যিনি পোর্ট্রেট করেন আর নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন যিনি, “উষ্ণ আলোয়ানের পাশে” লেখেন যে-কবি আর ‘আরবানিয়া’-র সৃষ্টিগুলি যাঁর… তাঁরা কি একজন হতে পারেন? ধরুন, শিল্প সাহিত্য-বিষয়ক অজস্র গদ্য লিখেছেন যিনি আর রাত জেগে অন্ধকারে পাগলের মতো রেখার পর রেখার জন্ম দিচ্ছেন যিনি… তাঁরা? তাঁরা সবাই মিলে একজন হিরণ?— এর উত্তর পাওয়া সোজা নয়। হিরণ মিত্র এমন একজন শিল্পী, যিনি আধুনিকতাবাদের গণ্ডি পেরিয়ে উত্তর-আধুনিক ধারণাগুলিকে আত্মস্থ করে নির্মাণ করে নিয়েছেন এক নিজস্ব জগৎ, যে-জগৎ রূপ-অরূপ রেখা ছায়া শূন্যতা দেখা-না-দেখা গতি ও গতিহীনতা দিয়ে গড়া… সংগীত আর জ্যামিতি বিষয়ে সম্যক ধারণা না থাকলে তাঁর চিত্রের সঙ্গে কোনো ক্রিয়ায় অংশ নেওয়া অসম্ভব। সেই হিরণকে আমি আমার সমূহ সীমাবদ্ধতা দিয়ে ধরবার চেষ্টা করেছি।

এতজন এত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাঁর, তাই নতুন করে নেওয়া কোনো সাক্ষাৎকারে পুনরাবৃত্তি থাকা স্বাভাবিক হয়তো। কিন্তু আমি এখানে খুব সচেতনভাবে চেষ্টা করেছি এমন কিছু সংলাপ এখানে রাখার, যা আগের কোনো কথোপকথনে নেই। এমন কিছু নতুন প্রসঙ্গে কথা বলেছি আমরা, যেগুলি তথাকথিত শিল্প-সমঝদারদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা কথা বলার সময় শিল্পের সীমানা মানিনি, স্বভাবতই আলোচনা ক্যানভাস পেরিয়ে আর্ট, আর্টের ধারণা, রূপ আর রূপাতীত জগৎ, নাটক ও যৌনতা… ইত্যাদি নানা বিষয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

কথা তো চলতেই থাকে তাঁর সঙ্গে, চলতে থাকবে। সামনে বসে, তাঁর কাজ দেখতে দেখতে কিংবা দূরভাষে…।

এমনও হয়েছে, তাঁর লেখা পড়তে পড়তে, তাঁর তৈরি করা নাট্যমঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা ফাইন আর্টস একাডেমিতে তাঁর কোনো প্রদর্শনী দেখে… একা একাই আমি তাঁর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছি। রাস্তায় হাঁটছি কিন্তু টের পেয়েছি যে, আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোনো বিশেষ ছবিতে ব্যবহৃত তাঁর তীব্র লাল রং।

একবার উত্তম মঞ্চে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল, ওই নাটকের মঞ্চনির্দেশনায় ছিলেন হিরণ মিত্র… আগেও একবার দেখেছি নাটকটি কিন্তু মঞ্চনির্মাণের তাৎপর্য যেন ধরতে পারলাম দ্বিতীয়বার দেখার পর, নাটক শেষ হওয়ার পরও বেরোতে ভুলে গেলাম, একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ… যেন মঞ্চটাই আমার সামনে অভিনয় করে চলেছে কোনো কলাকুশলী না-রেখেই। মঞ্চের নানা বিন্যাস আর রেখার কাজগুলো নানা মুদ্রায় আমার সামনে হাজির হচ্ছে। এই জাদুখেলা দেখাবার লোক তো একজনই… শিল্পী হিরণ মিত্র। তাঁর মঞ্চনির্দেশনায় ‘ফ্যাতাডু’, ‘আলতাফ গোম্‌স’, ‘রাজা লিয়র’ নাটকগুলি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এ-কথা মানবেন।

বালক বয়সে গুস্তাভ কুর্বের আঁকা ‘অরিজিন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ চিত্রটি দেখে পিকাসো প্রায় পাগল হয়ে গেছিলেন, আমরা ওই বয়সে পাগল হওয়ার অমন সুযোগ পাইনি, এই মধ্যযৌবনে হিরণ মিত্রের নগ্নিকা সিরিজের অসামান্য কাজগুলো দেখতে দেখতে আমার পাগল হতে ইচ্ছে করে। তাঁর নগ্নিকাদের এত ভঙ্গি, এত বিভঙ্গ তাদের শরীরের এত মুদ্রা! মুহূর্তে মুহূর্তে যেন তাদের রূপ ও আকার বদলে যেতে থাকে।

একটি চিত্রে যোনিলোমগুলো যেন বাষ্পের মতো উন্মুখ হয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে, তারা যেন শরীরে লেগে নেই, উড়ে যেতে চাইছে।

আবার একটি প্রসৃত আকারের যোনির দুই পাশের অববাহিকায় নেমে এসেছে গুল্ম, এ তো বিদেশীয় হতে পারে না তবে কি এ-দেশীয়, কোনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর!

পরের কথোপকথনের জন্য আরও অনেক প্রসঙ্গ তোলা থাকল, হয়তো একটা গোটা দুপুর অপেক্ষা করে আছে, কিংবা রোদ নেমে আসা শান্ত কোনো বিকেলে আবার তাঁর স্টুডিয়ো লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াব দু-জনে, তেরছা একটা রোদের টুকরো এসে পড়বে সেই লিপিগুলোর গায়ে, যাদের পাঠোদ্ধার হবে না কখনো কিন্তু অনায়াসে রোদে আর লিপিতে সংলাপ রচিত হয়ে চলবে। জানি যে, সেই অলীক কথোপকথন কখনোই লিখে উঠতে পারব না।

রণজিৎ অধিকারী: ‘জীবনের উৎসব’ লেখায় আপনি বলেছেন, “ছবি আঁকাটা আমার কাছে উৎসবের মতো”—এই যে উৎসব শব্দটি শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলেন, এর ফলে এই শব্দের তাৎপর্যটাই কি বদলে গেল না?

হিরণ মিত্র: উৎসব। সাধারণভাবে মানুষ সামাজিক। উৎসবে সমাজ কথাটা আসে। কিন্তু আমি একাকী মানুষ, আমার তেমন কোনো সমাজ নেই। কল্পিত অবস্থান আছে। উৎসব একপ্রকার জীবনকে উপভোগ করার, প্রতিটা মুহূর্তকে আলোকিত করার অথবা গভীর অন্ধকারকে আবিষ্কার করার …। উৎসব সবসময়ই যৌথতার কথা বলে। আমিও প্রতিফলিত হই, নিজেই নিজের আবিষ্কারে। কিন্তু নার্সিসাস নই। একসময় এই বদনাম আমার ছিল, সে-কথা ভুল বোঝার বা ভুল ব্যাখ্যা করার বদনাম, আজও হয়তো আছে। এ মোহিত হওয়া নয়। মনের কত কত হাজারো কুঠি আছে, সব কি আমরা ভ্রমণ করতে পারি, এক জীবনে তা অসম্ভব। তাই এই ‘উৎসব’কে আবিষ্কার করি। চিত্র রচনাও এক উৎসব, মৃত্যুও তাই— জীবন যেমন।

রণজিৎ: আপনি লিখেছেন, “রেখা থেকে রেখার জন্ম হয়”— এর মানে দাঁড়ায় একটা চিত্র বা ছবিতে তা পূর্বপরিকল্পিত নয়, মানে আঁকতে আঁকতে এগিয়ে যাওয়া? একটু যদি স্পষ্ট করেন।

হিরণ মিত্র: এই “রেখা থেকে রেখার জন্ম হয়”, এটা একধরনের ক্রমাগত বা ক্রমিক ধারায় চলনের কথা। আমি একটা রেখা টানলাম, সাদা কাগজে… সেই চলনের যেমন পূর্ব-পরিকল্পনা নেই, তেমনি সেই রেখা, তাকে প্রত্যক্ষ করার মুহূর্তে একটা বিদ্যুৎচমকের মতো চকিতে আরও আরও রূপ ও রেখা ভিড় করে ওঠে। তারা যেন ওই রেখার গর্ভ থেকে উঠে আসা আর্তি। আমি বিস্মিত হই। আরও কৌতূহলী হয়ে উঠি। এগিয়ে যাই…। রূপ তাই আমাকে নির্মাণ করে, অথবা বলা যায় দু-জন দু-জনের পরিপূরক। এই ক্রিয়া চলতেই থাকে, একসময় বিরামও ঘটে। তখন সরে যাই ওই নির্মাণ থেকে।

রণজিৎ: আপনি নানা সময়ে এই কথাটি বলেছেন যে, চলতে চলতে আঁকা, আঁকতে আঁকতে ভাবা… এর মধ্যে আমরা একটা নতুন ধরন দেখতে পাচ্ছি, একটা নতুন ভাবনা। একটু যদি বলেন...

হিরণ: এটি একটি বিচিত্র ক্রিয়া— এই চলতে চলতে আঁকা, আঁকতে আঁকতে ভাবা। ষাটের দশকের শেষ পর্বে, আমার মধ্যে একধরনের শিল্প-বিচ্ছিন্নতা আসে। মানে, চারপাশের শিল্পচর্চা বা  অগ্রজ শিল্পীদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিই। শিল্পীরা ভাবে, আমি নানা ব্যক্তিগত কারণে বা ব্যর্থ হয়ে এই শিল্প-ভূখণ্ড ত্যাগ করেছি। বিষয়টা তাদের বোধগম্য হওয়া সেদিনও সম্ভব ছিল না, আজও নেই।

আমি তো আসলে ভিন্ন এক শিল্পদর্শনের খোঁজে ছিলাম, যে-ধরনের শিল্প-অভ্যাস আমার মধ্যে গড়ে উঠেছিল ইতিমধ্যেই, অগ্রজদের পাশে থেকে অর্থাৎ তার আগে দীর্ঘ পনেরো বছর তাদের সঙ্গ পেয়েছি, সেই ‘সঙ্গ’-তে আমি ক্লান্তি বোধ করতে থাকি। আমি সন্ধান করি… ভারতের বৃহৎ ব্যাপ্ত লোকজীবন— বাউল, দরবেশ, ফকির, নাচিয়ে-গাইয়ে-বাজিয়েদের, যারা শুধু মনোরঞ্জন করে না, তাদের আছে এক ভিন্ন শিল্পের ধরন। তারা বাইরে এক রূপ ধরে থাকে, আর ভেতরে জমিয়ে রাখে অফুরন্ত এক প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তিকে আমরা তথাকথিত শিল্পীরা চিহ্নিত করতে পারিনি। আমাদের কলা-সমালোচকেরা ধরতে পারেননি। এমনকী এই প্রাণশক্তির উৎস বিষয়টিই তাঁদের কাছে অপরিচিত আজও।

এই লোকজীবন কিন্তু চলমান, তাই তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমিও চলমান হলাম। নাচের সঙ্গে… রচনা… নাচের মধ্য দিয়েই অনুভব করলাম। নাচতে নাচতে আঁকা অভ্যাস করলাম। আমাদের পাশ্চাত্য ও পূর্বী শিল্পশিক্ষায় স্থির থাকা, মনস্ক থাকা, শারীরিকভাবে খুবই জরুরি শিক্ষা।… রেখা রিক্ত হয়ে যাবে, অনিয়ন্ত্রিত রেখার জন্ম হবে। তুলির চলন বিক্ষিপ্ত ও অবিন্যস্ত হবে। এইসব প্রাচীন ধারণা এই চলনের ঠিক বিপরীতে থাকে। অনেক জড়তা কাটাতে হয়েছে। সমালোচনা শুনতে হয়েছে, আজও হয়।

তখনও আমি আমেরিকান অ্যাকশন পেইন্টার জ্যাকশন পোলককে ততটা গভীরে জানতাম না বা চর্চা করিনি। কিন্তু তাঁর অপ্রত্যক্ষ প্রভাব যেন আমার উপর পড়ল। আমার সহযোগী বাউল ও ছৌ নাচিয়েরা উৎসাহ দিল। ধ্রুপদী নাচিয়েরাও অংশ নিল, এমনকী সংগীতজ্ঞরাও…।

এই চলমানতার সাথে ভাবনার চলমানতাও যুক্ত হল, ফলে ভাবনা এবার গতি পেল। দুরন্ত রেখার জন্ম হল।

ক্যালিগ্রাফিক অ্যাবস্ট্রাকশন আখ্যা দেওয়া হল একে। অক্ষরচর্চা আরও একটা বিষয় হয়ে উঠল।

রণজিৎ: একজন সাধারণ কবি হিসেবে আমার মনে হয়, জড়জগৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আর বিমূর্ত শিল্পের মধ্যে কোথাও যেন একটা নিবিড় যোগ আছে, একজন শিল্পী হিসেবে এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

হিরণ: বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একটি তত্ত্ব ও সত্য অমোঘ, তা হল স্বর্ণচ্ছেদ বা গোল্ডেন সেকশন— এ একটি চূড়ান্ত তত্ত্ব। প্রকৃতি সৃষ্টি হয়েছে, ব্রহ্মাণ্ড তৈরি হয়েছে, তার চলমানতা, ভারসাম্য, আকর্ষণ, বিকর্ষণ সবই এই নিয়মে বাঁধা। আমরা শিল্পীরাও অজান্তে তার মধ্যে চলমান, এটা কোনো বাধা নয়, এটা কোনো আরোপিত নিয়ম বা শৃঙ্খলা নয়, এ নিজের নিয়মে নিজের মধ্যেই সম্পূর্ণ। ফুল, পদ্ম, মাকড়সার জাল, গ্যালাক্সি… সবই ছন্দে নির্মিত।

একে আবিষ্কার ও সমর্পণে শুধুমাত্র আমাদের মুক্তি ঘটে। আমরা তথাকথিত শৃঙ্খলে বদ্ধ নই। আবার যেহেতু এই পরিচালক তাই মুক্ত ভাবনাও আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য দেয়।

এতে জ্যামিতি আছে, আবার জ্যামিতিকে পাশ কাটিয়ে নতুন প্রতিপাদ্য নির্মাণও আছে।

রণজিৎ: আপনার চিত্রকলা প্রসঙ্গে দু-জন শিল্পীর চিত্রকর্ম বিষয়ে জানতে চাইব— পল ক্লি, কাঁদিনস্কি… আপনি কীভাবে এঁদের মূল্যায়ন করেন?

হিরণ: পল ক্লি ও কাঁদিনস্কি। দু-দেশের দুই শিল্পী। একজন জার্মান আর অন্যজন রাশিয়ান। দু-জনের ভাবনা-বিষয়ও ভিন্ন, সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। কিন্তু কোনো আপাত বিরোধ নেই। ক্লি ও কাঁদিনস্কি যৌবনে অর্থাৎ ষাটের দশকে খুবই প্রভাব ফেলেছিলেন। তাঁদের সম্বন্ধে বলতে গেলে একটু দীর্ঘই হয়ে যায় কথা। পল ক্লি-র ‘পল ক্লি অন মডার্ন আর্ট’ বইটি খুবই উৎসাহ দেয়। ছোটো ছোটো কথা, লেখা, দার্শনিক প্রকাশ। চিত্রের দর্শন যে একটি প্রধান উপাদান ক্লি-ই আমাকে শেখান। যেমন, “From the root the sap flows to the artist, flows through him, flows to his eye. Thus he stands as the trunk of the tree.” (Paul Klee)

দেখা ও তাকানোর তফাত ঘটে গেল। কাঁদিনস্কি শেখালেন জ্যামিতি। আকারের সাথে আকারের আন্তর্সম্পর্ক। সংগীতের মতো, তারা ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। মূর্ছনা রচনা করছে। দৃশ্যেরও ধ্বনি আছে, তা কাঁদিনস্কি দেখালেন। আমরা দেখার চেয়ে শুনলাম বেশি। আগে এমনটা ঘটেনি। যুবক বয়স, আবিষ্কারের নেশা,… বুঁদ হয়ে গেলাম শিল্পচর্চায়। আমার চর্চা চিরকালই খুব গভীর ও আত্মস্থ… এ নিয়ে বেশি বলা আমার ইচ্ছে নয়। কেউ প্রশ্ন করেনি, তাই জানানোরও বালাই ছিল না। আমার চারপাশের শিল্পীদের সঙ্গে বরাবরই আমার যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ। তাঁরা কী ভাবছেন আমাকে নিয়ে, তাও জানি না। আমার লেখাও তাঁরা পড়েন না, হয়তো ভাবেন পড়ার কিছুই নেই…

ফলে অস্বাভাবিক ও আলটপকা মন্তব্য করেন। নানাভাবে অবজ্ঞা করতে চান, এড়িয়ে যান, হয়তো আমার কাজ দেখেন কিন্তু না-দেখার ভান করেন…।

রণজিৎ: কিছু দিন ধরেই আমরা দেখছি, আপনি ধারাবাহিকভাবে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে এক-একটা সিরিজ আঁকছেন যেমন বেনারস, পিকাসো, চ্যাপলিন ইত্যাদি। এই ধরনের স্টাডির অভিমুখটা কী থাকে?

হিরণ: এই তিনটি নাম একসঙ্গে বলা ঠিক হবে না। বেনারস, পিকাসো, চ্যাপলিন… এক নিঃশ্বাসে বলার মতো নয়।

বেনারসে আমি অল্প কিছু দিন কাটিয়েছি, সে অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আবার ‘ব্যক্তিগত’ এই শিরোনামে কিছু শিল্পীকে নিয়ে আমি একধরনের লেখা ও আঁকায় সম্প্রতি ব্যস্ত আছি। ‘ব্যক্তিগত চ্যাপলিন’ প্রকাশিত, এর পর দু-টির কাজ প্রায় সমাপ্ত—‘ব্যক্তিগত পিকাসো’ ও ‘ব্যক্তিগত দালি’। কাজ করছি ‘ব্যক্তিগত হুসেন’ নিয়েও। এই কাজগুলির মজা হচ্ছে, এঁরা আমার কাছে শিল্পী হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছেন না। যদিও তাঁরা মূলত চিত্রশিল্পী, তা সত্ত্বেও এখানে আমার কাছে ধরা দিচ্ছেন অভিনেতা হিসেবে। তবে তাঁরা কি শিল্পরচনায় অভিনয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন!— না, তাও নয়। তাঁদের চিত্ররচনা, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে অভিনয় একটা বিশেষ প্রকাশভঙ্গি হিসেবে চলে আসছে। যেন এক-এক জাদুকর, ভেল্কি দেখাচ্ছেন… বিষয়টি বেশ বিস্তৃত। স্থানভিত্তিক যে-ধারাবাহিকগুলিতে আমি অংশ নিই— তার অবস্থান এর চেয়ে ভিন্ন। সেখানে একটা স্থানই বলিষ্ঠ চরিত্র হয়ে ওঠে। জনপদ, মানুষজন… তার ঐতিহ্য অদ্ভুত এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।

রণজিৎ: আপনার চিত্রে একটা বিষয় খুব দেখা যায় যে— দৃশ্যের চলমানতা। জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত আঁকার এই বিশেষ ধরন। এই প্রক্রিয়াটা কীভাবে মস্তিষ্ক থেকে তুলিতে উঠে আসে?

হিরণ: তিন নম্বর প্রশ্নের উত্তরে চলমানতা নিয়ে কিছুটা বলেছি। দৃশ্যের চলমানতা আমার শরীর ও মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে নিয়েছে। রক্ত সঞ্চালনের মতো তা প্রবাহিত হয়। ক্রমাগত সারাদিন ও রাত্রি… আমি সর্বক্ষণ সচল থাকি। আমি আক্ষরিক অর্থেই ২৪×৭-এর শিল্পী, সেই অভ্যাসের শিল্পী। এমনকী নিদ্রিত অবস্থাতেও আমি কর্মরত থাকি। স্বপ্নে… ঘুম ভেঙে উঠে স্বপ্নে দেখা ছবিগুলি এঁকে ফেলি। হয়তো বালখিল্যের মতো শোনাবে কিন্তু এ এক বিষম অভ্যাস। ক্রমাগত এই অভ্যাস আমাকে আরও আচ্ছন্ন করে রাখছে। চিত্রে বা শিল্পে চলমানতা আমার চিত্রের মূল সম্পদ। রেখা, রং, তুলির চলন, সবই অস্থির, অনিশ্চিত এবং কৌতূহলী। এখান থেকেই ওই কথাটা উঠে আসে… ছবি আমি আঁকি না, ছবি আমাকে আঁকে, আঁকতেই থাকে। কীভাবে ঘটে যায়! কবি উৎপলকুমার বসু একে বলতেন, ‘অটোমোটর’।

রণজিৎ: এই যে চলমানতা, এটা আপনার নাটকের কাজের ক্ষেত্রে খুব খাপ খায়,… নাট্যমঞ্চে আপনার কাজ নাটকের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক খুলে দিয়েছে। কথাটা হল, এই যে মঞ্চটাকে চলমান করা… এই আইডিয়া কি নাটকে কাজ করতে করতেই এসেছে?

হিরণ: নাটকের মঞ্চনির্মাণের আগে আমি এক বিচিত্র পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছি। ভারতের কোনো মঞ্চশিল্পীই এই পদ্ধতিতে আস্থা রাখেননি, তাঁদের কাছে এটা অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্য। কিন্তু… আমার কাছে ভিন্ন অর্থ নিয়ে এসেছে তা।

যেমন: নাটকের মহড়া চলাকালীন বিভিন্ন স্তরে তার ‘দৃশ্যতথ্য’-কে চিত্রবদ্ধ করে রাখা, ডকুমেন্টেশন যাকে বলে। এই কাজটি খুব দ্রুত ও নানা কৌশল নিয়ে করি আমি। দৃশ্য আঁকতে আঁকতে মঞ্চের ধারণা তৈরি হয়। সমগ্র পদ্ধতিটা একটা সচল ব্যাপার— স্থিরতা নেই, থেমে থাকে না কিছুই, মহড়া নিজের মতো চলতে থাকে, আমার আঁকাও… তারপর সেই আঁকা নিয়ে আলাপ আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ইত্যাদি।

পরিচালক, আলোকশিল্পী, অভিনেতা, অভিনেত্রী… সকলেই অংশ নিতে থাকে, নতুন নতুন দৃশ্যেরও জন্ম হতে থাকে। এই পদ্ধতি ভুল কি ঠিক, ভালো কি মন্দ… সে-সব দীর্ঘ বিতর্কের বিষয় কিন্তু এর কার্যকারিতা থেকেই ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-এর মতো মঞ্চ নির্মিত হয়েছে, ‘দেবী সর্পমস্তা’ হয়েছে, ‘ইটসি বিটসি’ হয়েছে, ‘লিয়ার’ হয়েছে। আমি যে-সব নাটকে মঞ্চের কাজ করেছি, এমনভাবে এই পদ্ধতিতেই করেছি। এটা একটা ভাবনা-প্রক্রিয়াও বটে।

রণজিৎ: আপনার রেখা কখনো কখনো তীব্রভাবে যৌনতার প্রকাশ ঘটায়। অথচ সেভাবে আপনার আঁকা নগ্ন চিত্র সাধারণ দর্শকদের সামনে প্রকাশ পায়নি। একটি রেখাই যে দর্শককে উত্তেজিত করে দিতে পারে, যৌনকাতর করে তুলতে পারে, তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ আছে আপনার কাজে। আসলে যৌনতাকে ভিন্নভাবে দেখা ও দেখানোর চেষ্টা কীভাবে এল আপনার মাথায়?

হিরণ: এখানে একটু জানিয়ে রাখি, আড়ালে আমার নগ্নচিত্রের বিশাল সম্ভার জমা আছে এবং আমি আজও নগ্নচিত্র আঁকার অভ্যাস বজায় রেখেছি। বিস্তারে বলছি না। কিশোর বয়স থেকেই যৌন প্রবণতা বাসা বাঁধে, এ নিয়ে দীর্ঘ লেখা আছে আমার। সাধারণ যৌন কৌতূহল আর শিল্পীর যৌন কৌতূহলে তফাত আছে। আমার সেই অর্থে সমস্ত রঙে রেখায় যৌনতার চলন,… নগ্নতা একটা মাত্র যৌনপ্রকাশ। কামসূত্রের চৌষট্টি কলায় তার নানা প্রকাশ। নগ্নতা, যৌনমিলন… তার সামান্য এক-একটি লক্ষণ… তার থেকে অনেক যৌন চিত্ররচনা— ওই কলার একটি অংশ, তাই এই বিষয়টি খুবই ব্যক্তিগত এবং জটিল।

যৌনতা আমার রক্তে। লেখাগুলো স্বাভাবিক যৌনতার রূপ নিয়ে খোদাই করে যায়। মননে যৌনতা। স্বপ্নে আসে যৌনতা। যৌন অভ্যাস সচল থাকে স্বপ্নে। যৌনতা নিয়ে সমাজে অনেক ট্যাবু, সেইসব ট্যাবু সামলে আমি এই ক্রিয়া চালিয়ে যাই। এখানে তার বিশদ বিবরণ দেওয়া অসম্ভব।

রণজিৎ: চিত্রকলার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটো জগতে আপনার অনায়াস যাতায়াত— উচ্চাঙ্গসংগীত ও কবিতা। এই দুটো জগতের কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে আপনার মননে?

হিরণ: উচ্চাঙ্গসংগীত ও কবিতা। অল্পবয়স থেকেই আমি সংগীতপ্রিয়। ফলে উচ্চাঙ্গসংগীতকে খুব গভীর করে পাই ছাত্রজীবনে। নানা যোগাযোগে তা ঘটে। রাত জেগে সংগীত-সম্মেলন শোনা… আস্তে আস্তে যখন থেকে বিমূর্ততা বাসা বাঁধল মাথার ভেতর, সংগীতের মধ্যে তার রূপ আবিষ্কার করলাম। দিশা দেখাল প্রাচ্য পাশ্চাত্য… দুই ধরনের ধ্রুপদী সংগীত। ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় গড়ে ওঠা বোধে চিত্ররচনায় ঢুকে পড়লাম। বিচিত্র রূপ আবিষ্কার করতে লাগলাম। দেশে বিদেশে, নেশা ধরে গেল। সংগীতের তাল লয় মাত্রা… তার সঙ্গে চিত্ররচনার চলমানতা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল। ঘোর কিছুতেই কাটে না, বাকি জীবন এভাবেই চলবে হয়তো।

সংগীতের নানা ধারা। বাদ্যযন্ত্র, কণ্ঠ… সবই রূপ সৃষ্টি করে। ধ্বনি থেকেই দৃশ্যের জন্ম এই বিশ্বাস ক্রমশই গভীর হতে লাগল। তাকে চর্চায় নিয়ে এলাম। বুঝতে লাগলাম ঠিক কোন মাত্রায় ধ্বনির ক্রিয়াকর্ম দৃশ্যের বাঁকগুলোকে চিহ্নিত করে যাচ্ছে। নৃত্যের ছন্দের সঙ্গে ধ্বনি, নৃত্যের নানা ভঙ্গিমার সঙ্গে রেখার সম্পর্ক…

প্রত্যক্ষ করলাম। এটাই আমার প্রাপ্তি।

কবিতার ধ্বনিও আমাকে আকর্ষণ করে। ভাষা ও ভাব দৃশ্যের নানা কুঠুরিতে ভ্রমণ করায়। ছবি আঁকার ফাঁকে কবিতাই পড়ি। সবসময় মনের সাথে মিলবে এমন নয়। কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করার তাগিদে অনেক কবিতা পড়তে হয়, বার বার পড়তে হয়। পছন্দ অপছন্দকে প্রাধান্য দিই না। কবিদের মধ্যে এই প্রবণতা আছে। বড়ো কবি, ছোটো কবি… ইত্যাদি। আমার কাছে কবিতা একটা বিমূর্ত চলন। আমিও কবিতার দৃশ্য খুঁজতে থাকি। কবিতার বক্তব্যের আড়ালে থাকা কবিকে খুঁজি।

তার বয়স জানি না, পরিচয় জানি না। সে একটি কণ্ঠস্বর মাত্র। এই আড়াল থেকে যার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। এ এক ভিন্ন আবিষ্কার। এমন হতেই পারে, সেই কবি, সেই কবিতা… মানে যার সঙ্গে… যাকে আমি কানেক্ট করছি, সে আমারই নির্মাণ… হতেই পারে মূল কবির ভাবনা আর আমি কবির যে-ভাবনাটা দেখছি, দুটো ভিন্ন রেখা কিংবা সমান্তরাল… তবু্ও এই নির্মাণ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি না। আমার মধ্যে কবিতাপাঠ,… হয়তো সে-পাঠের কোনো বিশেষ ভূমিকা আছে। কবি যেখানে ছন্দ, ভাষা, পঙ্‌ক্তি নিয়ে ব্যস্ত, প্রকাশে ব্যস্ত, আমি সেখানে অপ্রকাশে ব্যস্ত। অপ্রকাশই শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, এই ধারণা আমাকে অদ্ভুত একটা মানসিক স্তরে নিয়ে যায়। এ কবিদেরই অবদান। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। যেহেতু আমি নির্দিষ্ট কোনো মূল্যমানে নিজেকে আটকে রাখি না তাই কবিতার বিচার আমি করতে বসি না। আমি তাই সমস্ত স্তরের কবিদের পাশেই থাকি। কবিতা আমার কাছে একটা চিত্রমাধ্যম। তার মান নয়, মাঝে মাঝে দুর্বল ভাষাপ্রয়োগ আমাকে হতাশ করে ঠিকই। কিন্তু তখনও আমি সেই কবিকে আঘাত করি না… সে তার মতো থাকুক, ভাবুক… এভাবেই হয়তো কোনোদিন তার পরিণতি আসবে।

এভাবেই কবিতার নানা বিচিত্র প্রকাশ, তার ভাব ভাষা ভঙ্গি… আমাকে আচ্ছন্ন রাখে, অনেকটা সংগীতের মতোই। কবিতা পড়তে বড়ো ভালোবাসি, প্রিয় কবির সংখ্যাও কম নয়।

রণজিৎ: শরীরের ভাষা, আকার ইঙ্গিত নিয়ে আপনি অনেক কাজ করেছেন। চিত্রকলার সঙ্গে এই বডি ল্যাঙ্গুয়েজের সম্পর্ক কী? সাধারণ দর্শকদের জন্য যদি একটু সহজভাবে বলেন।

হিরণ: শরীরের ভাষা। মহড়াকক্ষে যখন আমি অভিনেতাদের দেখি… খোলা মাঠে নৃত্যরত কাউকে দেখি কিংবা চলচ্চিত্রে… নৃত্যরত… এ-সবই কিন্তু শরীরী ভাষা। শরীর তার দ্বিভঙ্গে ত্রিভঙ্গে চতুর্ভঙ্গে নানা বিভঙ্গে নানা বার্তা দিয়ে যায়। সেগুলি নৃত্যের প্রয়োজনে বা ছন্দের প্রয়োজনে স্বাভাবিকভাবে আসে ও প্রয়োগ হয়। যখন আমি তাকে আমার চিত্রে, রেখা বা রঙে রূপ দিই অর্থাৎ, প্রয়োগ করি তখন আমার শরীরও নৃত্যরত থাকে… দ্রুত তার চলন। খুবই দ্রুততার সঙ্গে মুহূর্তে তা রচিত হয়। একই সাথে তার ভাষা ভঙ্গি তাল ছন্দ সবই রূপান্তরিত হয়ে যায়। দর্শক যখন ছবিগুলি দেখে, তখন সেও অনুভব করতে পারে নৃত্য-ছন্দের, অভিনয়-ছন্দের, ভাষা-ছন্দের। শরীরী ভাষা একেই বলে, অনুবাদ-ক্রিয়া কতটা গভীর, কতটা মনোযোগী, কতটা সৎ ও নিবিষ্ট তার ওপর নির্ভর করে দর্শকের এই দেখা কতদূর পৌঁছোতে পারে। দর্শক সেই মুহূর্তে পৌঁছে যায়। সে দেখতে পায় ঘটনাটি তার চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে, সে তখন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে।

রণজিৎ: কিছুদিন আগে একটি সংবাদপত্রের লেখায় আপনি ‘কাজের ছন্দ’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। এই ছন্দ আসলে কী? চিত্রকলার সঙ্গে তা কীভাবে যুক্ত?

হিরণ: কাজের ছন্দ— এই কাজের ছন্দ… এটা আমার একটি প্রিয় শব্দবন্ধ। কাজের ছন্দ আসলে দীর্ঘ অভ্যাসে স্বাভাবিক ছন্দ নির্মাণ করে। কোনো আড়ষ্টতা ছাড়াই। তুলি যেন মুহূর্তে ছিটকে বেরোয়, যেভাবে তির ছিটকে যায়। ধনুক থেকে। মন— শরীর— রচনা তিনটে যখন এক সূত্রে বাঁধা পড়ে, তখন এক স্বাভাবিক তাল তৈরি হয়। তাল ও লয়। মনের মধ্যে আঁকা ও না-আঁকার মধ্যে ঢুকে পড়ে। মানে যখন আমি আঁকছি বা যখন আমি আঁকছি না। শব্দ ও নীরবতা। আঁকা অংশ ও শূন্য অংশ।… এ-সবই তাল লয় নির্ভর। দু-টি রেখা নির্দেশ দেয় তাদের মধ্যবর্তী শূন্য অংশ, কতটা শূন্যতাকে ধারণ করবে। এটা বলতে পারো একটা দৃশ্য কথোপকথন। শিল্পের সাথে শিল্পীর সংলাপ। আঁকতে আঁকতে কথা চালাচালি, ভাবের আদানপ্রদান হচ্ছে। কান খাড়া করে দৃশ্যের নির্দেশ শুনতে হচ্ছে। এমনকী তুলিতে তরল রং নেওয়ার সময় হঠাৎ একখাবলা রং পড়ে গেল কাগজে বা ক্যানভাসে। ছবি কথা বলে উঠল,… সেটাও শুনতে হবে,… তাকে অবজ্ঞা করলে কিন্তু কাজের ছন্দ চলে যাবে। কাজের ছন্দ আবার অন্য অর্থেও ছন্দে থাকা, সর্বক্ষণের ছন্দে থাকা। চুপ করে বসে আছি। অন্ধকারে। তখনও ছন্দে আছি। একা। হাঁটছি… তখনও ছন্দের ভেতরেই আছি। আমি… চুম্বনরত… তাও ছন্দে। এই ছন্দকে ধারণ করতে হয়। কথা বলে যাচ্ছি দীর্ঘক্ষণ কিন্তু আমি ছন্দে আছি। এ শরীরের বাইরের অংশ নয়, এ ভিতরের অংশ, এ নিজেই নিজের ছন্দে থাকে, আর কাজের ছন্দেই থাকে।

রণজিৎ: আপনি একটি গদ্যে লিখেছেন যে, দর্শককেও শিল্পী হতে হবে। দর্শকই শিল্পী।… কথাটা শুনতে সহজ মনে হলেও, তত সহজ নয়, ব্যাখ্যার দাবি রাখে। একজন দর্শক সবসময় তো শিল্পী হতে পারে না, তবে কি এটা একটা প্রক্রিয়া?… হয়ে ওঠার? নাকি এক-এক বিশেষ মুহূর্ত তাকে শিল্পী করে তোলে?

হিরণ: দর্শক— শিল্পী? এই কথাটার বহু মাত্রা আছে। যেমন একজন অভিনেতার মধ্যে দর্শক থাকে… তেমন, দৃশ্য-শিল্পের সামনে দাঁড়ালে একজন সংবেদনশীল দর্শক শিল্পী বনে যান। সাধারণ দর্শকেরা, যে-কোনো শিল্প-ক্রিয়া, চিত্র যদি তা গতানুগতিক না হয়, তার পরিচিত কোনো শিল্পী না হন, কিংবা যদি তা খুব প্রচারিত, খ্যাতিমান শিল্পী না হন তবে সাধারণত অনীহা প্রকাশ করেন— এটা স্বাভাবিক। যে-চিত্রকর্মের সঙ্গে কাহিনি যুক্ত হয়ে আছে, তার চাহিদা আছে… অর্থাৎ, মিথ বা গাথা সেই কর্মটিকে মহার্ঘ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে এবং স্বভাবতই অনুধাবনযোগ্য… সেই চিত্রকর্ম প্রসঙ্গে এ-কথা খাটে না, কেন-না বিখ্যাত সেই চিত্রকর্ম বিষয়ে দর্শকের আবেগ বা আগ্রহ অনেকটাই আরোপিত। আবার অপরিচিত কোনো চিত্রকর্মের পাশ দিয়ে অনেক শিক্ষিত দর্শকও অন্যমনস্ক হয়ে হেঁটে যায়, কোনো আগ্রহ দেখায় না।… এ আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। দুই গ্যালারির প্রখ্যাত মালকিনদেরও এমন আচরণ করতে দেখেছি। কিন্তু দর্শক কীভাবে শিল্পী হবেন? শিল্প রচিত হয় দেখার জন্য। এই দেখা বা দর্শন এবং তার আকর্ষণ বহুক্ষেত্রে দর্শককে সম্মোহিত করে। দর্শক যখন কোনো চিত্রকর্মের সামনে দাঁড়ান— এ নিয়ে কবি উৎপলকুমার বসু খুব সুন্দর লিখেছিলেন,… আপনারা পরস্পরের পূর্ব-পরিচিত কিন্তু বহুদিন দেখা হয়নি।

সাধারণভাবে চিত্রকর্ম কোনো শারীরিক কসরত নয়, এ-মনের ছায়ায় ধরা জগৎ, দর্শককে নানাভাবে আহ্বান করে, বহু সময় দর্শক সেই আহ্বান শুনতেও পান। এটা একটা প্রক্রিয়া। খুব সামান্য হলেও যেটা প্রয়োজন, তাহলে শিল্পের প্রতি সহানুভূতি। এই সহানুভূতিই শিল্পকর্মটিকে সজাগ করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। শিল্প সজাগ হলে দর্শকও সজাগ হয়ে ওঠেন। প্রাণস্পন্দন দেখতে পেতে পারেন আপাত মৃত স্থির চিত্রকর্মটিতে।

চিত্রকর্ম চিরকালই নীরব— এই নীরবতা ভাঙে দর্শকই, তারা পরস্পর কথা বলাবলি করে, একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়… একটা বিন্দুতে পৌঁছাতে সাহায্য করে। যে-কোনো চিত্রকর্মই প্রাণশক্তির আধার, অফুরন্ত প্রাণশক্তি তার। দর্শক সেই প্রাণশক্তি, সেই আধারকে পুনর্নির্মাণ করেন যে-কোনো চিত্রকর্মকে।

এই পুনর্নির্মাণই দর্শককে শিল্পী বানিয়ে তোলে। বিমূর্ত চিত্রের বাড়তি সুবিধা— তা দর্শকভাবনার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। দর্শক তাঁর ভাবনায় তা-কে চিহ্নিত করে— রূপ দেয়, ব্যাখ্যা দেয় এবং উপভোগ্য করে তোলে— এখানেই তার সৌন্দর্য। শিল্পী, তার শিল্পের যে-সীমারেখা চিহ্নিত করে রেখেছেন, দর্শক সেই নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করে যান। এটা ঘটে, তার কারণ— শিল্পীর বহুক্ষেত্রে কিছু সংস্কার থাকে, অবচেতনের সংস্কার। দর্শক সাধারণভাবে এই সংস্কার থেকে মুক্ত, যেহেতু তিনি ওই গঠনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নন, তাই তাঁর মনে কোনো ভার থাকে না।

এছাড়া শিল্পী, তাঁর শিল্পকর্মের প্রতি আবেগতাড়িত মায়ায় আবদ্ধ থাকে, দর্শকের সেই আবদ্ধতা নেই, সেই মায়া নেই। দর্শক ভারহীন নির্লিপ্ত মনে শিল্পকর্মকে আবিষ্কার করতে পারেন। তাই শিল্পী-শিল্পী আর দর্শক-শিল্পীতে তফাত ঘটে যায়। তবু্ও কোথাও একটা সংযোগও থাকে। কলাসমালোচকেরা এ-ব্যাপারে বরাবরই একটু পিছিয়ে থাকে… সে তার প্রতিষ্ঠিত অবস্থান নিয়ে সতত ব্যস্ত বলে… চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য বা অন্যান্য শিল্পকর্ম তার কাছে বহু ক্ষেত্রে অধরাই থেকে যায়। সে তাকে ব্যাখ্যা করতে চায়, টীকা যুক্ত করে, নানা তারিকায় তাকে বিদ্ধ করার চেষ্টা করে— এটাই তার প্রাথমিক কর্তব্য বলে সে মনে করে।… এবং ব্যর্থ হয়।

শিল্পী-দর্শকরা সাধারণত অন্য শিল্পীর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকেন না ও এড়িয়ে যেতে ভালোবাসেন… এইসব গুণবিহীন সাধারণ দর্শকই একমাত্র দর্শক-শিল্পী হওয়ার বিরল সম্মান পেয়ে যান, উপভোগ করেন, প্রকৃত মিলন ঘটে তাঁদের মধ্যে। দর্শকই তখন প্রকৃত শিল্পী আখ্যা পেতে পারেন।

রণজিৎ: আমরা যে-কোনো কাজ করার পর বিশ্রাম নিই। পড়তে পড়তে বিশ্রাম নিই, গান গেয়ে যাওয়ার মধ্যেও ক্লান্তি আছে, টানা তবলা বাজানোর সময় নিজেও দেখেছি… দু-তিন ঘণ্টা পরই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। অথচ আপনি বলেন, টানা দীর্ঘক্ষণ ছবি এঁকে যেতে পারেন, এমনকী রাতজুড়ে, অসুস্থ হয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা এঁকেছেন, এমনও ঘটেছে… কীভাবে ঘটে এটা? ক্লান্তিকর মনে হয় না? নাকি উলটোটাই যে, এই জগতের যা কিছু ক্লান্তি তা-র থেকে রিলিফ খুঁজছেন সৃষ্টির মধ্যে? আঁকা কি স্বস্তি এনে দিচ্ছে আপনাকে?

হিরণ: ক্লান্তি ও বিশ্রাম— ক্লান্তি মনের, ক্লান্তি শরীরের। ক্লান্তি একটা ধারণা, ধারণা— কেন-না আমার মনে হল শরীর ও মন দুই-ই বিশ্রাম চাইছে, শ্রম থেকে বিশ্রাম। আমার কাছে শ্রমই বিশ্রাম। শ্রম অর্থাৎ, এখানে শিল্পকর্মের শ্রম… আমাকে আরও শক্তি জোগাচ্ছে, সেই শক্তিই চালিকাশক্তি, তাই বিশ্রামের প্রয়োজন পড়ছে না। পিকাসো একটি অদ্ভুত কথা বলতেন… চোদ্দো-পনেরো ঘণ্টা টানা ছবি আঁকতেন যখন, প্রশ্ন করলে বলতেন, শরীরটাকে স্টুডিয়োর বাইরে রেখে এসেছি,… যেভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলিম তার পাদুকা মসজিদের বাইরে রেখে আসে! আমি ওভাবে বলার সাহস রাখি না বা বলা যায় আমার তেমন কোনো স্টুডিয়ো নেই… নেই কোনো তোরণ, তাই শরীরকে বাইরে রাখার ব্যবস্থাই নেই। আমার কোনো ঘর নেই, আমার কোনো ‘বাইরে’ নেই।

এক রাত্রে ভীষণ অসুস্থ হলাম। বহু দূর দেশে আছি। নানাভাবে বিব্রত। একমাত্র সম্বল, রং তুলি… যা আমাকে নিরাময় করে তুলবে।… বিচিত্র আমার চলন।

কালো কাঠকয়লা দিয়ে সাদা কাগজে আঁচড় টানা শুরু হল। রাতভর। অসম্ভব অসুস্থ অবস্থায়… তবু যেন নিজেকে নিজের সামনে মেলে ধরতে পারছি। এইভাবে ভোরের আগে আগে, শুয়ে পড়লাম আর নতুন একটা কাজ স্বপ্নে শুরু করলাম, সাদা ক্যানভাসে, সাদা রং নিয়ে চিত্ররচনা। সাদায় সাদায় মনের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রশান্তি এল, এমনই প্রশান্তি এল যে… ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর ঘুম। সকালের আলোয় ঘুম ভাঙল।

একটা বিশেষ কারণে শরীরের বিশেষ কিছু অংশে অসহ্য যন্ত্রণা হয়, চলাফেরা ভীষণ কষ্টকর হয়ে ওঠে, কিন্তু সেই অসুস্থতা আমাকে চিত্রের জগতে নিয়ে যায়। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের খোলা ছাদের চিত্র-চত্বরে পৌঁছালাম। বিশাল একটা ক্যানভাস প্রায় প্রস্তুত করা ছিল, তাকে টেনে নামালাম, একাই। শুরু হল দ্বৈরথ, শরীরে তীব্র যন্ত্রণা আর এদিকে রঙে রেখায় জাদুখেলা… কখন যে যন্ত্রণা ভুলে গেলাম!

এত ভালো লাগতে লাগল ওই ব্যথা… ওই যন্ত্রণা! শরীর ও মনকে যেন আদর দিচ্ছে। এর কোনো ব্যাখ্যা হয় না। কোনো যুক্তি কাজ করে না— এর পক্ষে বিপক্ষে। মানুষ যে কতভাবে আর কখন কীভাবে আনন্দ পায়— তা আজও তালিকাভুক্ত করা যায়নি।

রণজিৎ: একজন কবি হিসেবে আমি এমন কল্পনা করি— আসলে আমরা তো জগতের প্রায় কিছুই দেখতে পাই না; না, কথাটা মায়াবাদীদের মতো করে ভাবছি না যে… সব মায়া ইলিউশান। বরং আমার প্রশ্নটি বিজ্ঞাননির্ভর… ব্রহ্মাণ্ডের অধিকাংশই তো ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটার দিয়ে ভরা, তাহলে যা কিছু দেখছি, তা যৎসামান্যই! তবে দৃশ্যরূপ… সবই তো অসম্পূর্ণ! ফর্ম দাঁড়াবে কীভাবে? রূপ কি অসম্পূর্ণ? শিল্পীকে তাই অরূপের খোঁজে যেতে হয়? শিল্পে এই চোখে দেখা অবয়বের গুরুত্ব আদৌ কতখানি?

হিরণ: ডার্ক এনার্জি। না-দেখাকে দেখা। এ এক বিচিত্র প্রয়াস। কী দেখি ও কেন দেখি এ-প্রশ্নের সহজে উত্তর হয় না। সারাজীবন খুঁজে যাওয়া ও বিস্মিত হওয়া শুধু। যে-আকারগুলোকে আমি দেখি বা আঁকি, তা আমার সম্পূর্ণ পূর্ব-অভিজ্ঞতায় থাকে না, কখনো কোনো আভাস হয়তো থাকে। কিন্তু তারা আমার কাছে সেই মুহূর্তে নতুন।… আবার এই আকারগুলো কেন, কী করে? প্রায় উদ্দেশ্যহীন বিচিত্র কিছু আকার… কখনো নারীদেহ, কখনো সর্পিল… কখনো আবার ঘন ঝোপের মতো, কখনো শস্যখেত, কখনো-বা নদীর মতো বয়ে যাওয়া… জীবন, পরিপার্শ্ব… ক্রমাগত মূর্ত হয়েই চলেছে।

অন্ধকার আমার একটা প্রিয় আস্তানা। আশ্রয়। কালো অন্ধকার আমাকে পরিপূর্ণ করে রাখে। একটা ভলিউম— একতাল অন্ধকার— আমার রেখাচর্চার প্রধান উপকরণ।

তেমনভাবে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কালো কাঠকয়লা হাতে ধরা আছে শক্ত করে… আঁচড় কেটে চলেছি সাদা কাগজে। দেখতে বা বুঝতে পারছি। কাগজের সীমানা শুধুমাত্র, সেই সীমানাকে মান্যতা দিয়েই দ্রুত আঁচড়ে কাহিনি বোনা চলছে।

অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছে, কারণ, আমার সৃষ্ট রেখাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, শুধু অনুভব করতে পারছি। রেখার সাথে সাথে মনের মধ্যে এক রেখার জাল বিছানো চলছে। দেখতে পাচ্ছি সব স্পষ্ট। সে-দেখা কালো দেখা… সে-দেখা অন্ধকার-ছোঁয়া দেখা… সে-দেখা রচনা থেকে দূরে চলে যাওয়ার দেখা… সে-দেখায় কোনো মোহ নেই, কারণ, রচনাই নেই শুধু ঘিরে আছে কালো অন্ধকার, কালো অন্ধকারে কালো রেখা কালো অস্তিত্ব নিয়ে অদ্ভুত আনন্দ দিচ্ছে।

এই কালো, এই অন্ধকার, ডার্ক-ম্যাটার কিনা জানি না, ডার্ক-এনার্জি কিনা জানি না, ডার্ক এটুকু জানি। আকার যখন নিজের গতিতে… শুধু অনুভবে… এঁকে চলা হয়, শুধু স্পর্শে সব কিছু বোঝা যায়… তখন তার প্রভাব ভীষণ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে, মনের, মাথার মধ্যে গেঁথে বসে আকার, আকারের অনুপাত আন্তর্সম্পর্ক তখন গৌণ হয়ে যায়… আবার তারা বায়বীয় নয়, ভাসমান নয়, তারা শক্ত মাটিতে প্রথিত।

আকারগুলি মূর্ত অথবা বিমূর্ত— ঠিকঠাক বললে না-মূর্ত! তবু্ও সে অনুপাত হারায় না, ছন্দ হারায় না… তাল লয় কিছুই হারায় না। আসলে সে ধ্বনি হারায় না, ধ্বনি তাকে ছন্দোবদ্ধ করে রাখে কিন্তু কিছুই শোনা যায় না, শুধু অনুভবে ধরা যায়। তাই ব্রহ্মাণ্ডের বেশিরভাগ না-দেখা না-দেখাই থেকে যায় এবং না-দেখানোই ঘটে চলে!

রণজিৎ: আমি কবিতাতেও ব্যর্থভাবে এমন আইডিয়া আনার চেষ্টা করেছি— যে-জগৎ আসলে কতকগুলি বিন্দু ত্রিভুজ বৃত্ত বহুভুজ ইত্যাদি জ্যামিতিক ধারণার সমন্বয় মাত্র! অসংখ্য রেখা ও তাদের মধ্যেকার সংঘর্ষ কাটাকুটিই হল এই জগৎ… এছাড়া আর কী? আমার এই ধারণা আরও স্পষ্ট রূপ পেতে সাহায্য করেছে আপনার সৃষ্ট আরবানিয়া। এটা কতজন লক্ষ করেছেন জানি না, আরবানিয়া একটা এক্সেলেন্ট আর্ট-ওয়ার্ক, একটা জাদু!

হিরণ: জগৎ— একটা জ্যামিতিক অস্তিত্ব। এটা শিল্পীরা, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের শিল্পীরা উনিশ শতক থেকে বলে আসছেন, তাঁদের কাজে কর্মে প্রয়োগও করেছেন।

এটা একটা সামগ্রিক ধারণা। জ্যামিতি এক অর্থে মানুষেরই আবিষ্কার, যদিও তার উৎস প্রকৃতি, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে জ্যামিতি কিন্তু সেই জ্যামিতি আমাদের মনের ও শরীরের উপর কতটা আশ্রয় করে আছে!…

শরীরের বাইরে গিয়ে শরীর দেখতে গেলে— যেহেতু আমরাই মূর্তিমান জ্যামিতি তাই আমাদের সকল কাজই তারই প্রকট রূপ। একে আমরা আলাদা করব কীভাবে?

জ্যামিতি নানাভাবে মিশে থাকে আমাদের চারপাশে। টুকরো টুকরো করে তাকে উপলব্ধি করা যায়। বিশাল আকারে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় বা… বৃত্ত, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ… সব সীমানা নির্দেশ করে আমাদের নিশ্চিন্ত করেছে। সেই আকার যখন চিত্র বা ভাস্কর্যে সরাসরি উপস্থিত হয়, তখন সে ভিতরটাকে বাইরে থেকে দেখতে থাকে। বাইরের যেমন বাইরে আছে, তেমনি ভিতরেরও ভিতর আছে। হেঁয়ালির মতো শুনতে লাগলেও এর মাধুর্য আলাদা। এ সংঘর্ষে পূর্ণ, এ শান্ত, এ ক্রমাগত প্রশ্ন করে, সংশয় প্রকাশ করে… কবিতা বা ছবিতে। কবিতা, অক্ষর ও ধ্বনিনির্ভর, সাধারণত আকারনির্ভর নয়। কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে আকার নির্মিত হয়— বোধের আকার, উপলব্ধির আকার। আকার, আকার পায়। কবিরা হয়তো সাময়িক হলেও সেই আকারে আশ্রয় নেয়। শিল্পীদের অস্তিত্বই আকারসর্বস্ব। সেই আকারের কোনো অর্থ থাক বা না-থাক, আকার থেকে তার মনন রূপ পায়। আকার থেকে জন্ম আকারেই মিলিয়ে যায়। একসময় তার দেহ আকারবিহীন হয়ে ভস্ম হয়ে গেল— রয়ে গেল উপলব্ধির মন। সেই মনের কি কোনো জ্যামিতি নেই? সেও কি তখন জ্যামিতি-বহির্ভূত একটি নিরাকার?… সে তখন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে আশ্রয় নিল। এতকাল সে ছিল একজন ব্যক্তি, এবার থেকে সে বহু হয়ে গেল। বহু মানুষ, বহু মন, বহু অস্তিত্ব… তাকে আকার দিতে লাগল। সে কার কাছে কেমন ছিল! সে অলক্ষ্যে হয়তো এটা উপভোগও করছে! তার এই জীবন, আর ঐ জীবন, যার সেতুও জ্যামিতি, একটা মনের বিস্তৃতি। সে নেই কিন্তু আছে।

আরবানিয়া, মানে শহর, জ্যামিতিক শহর ঘিরে আমার একটি প্রদর্শনী হয়, দু-হাজার বারো সালে, কলকাতায়… নানা বিতর্ক ওঠে, অনেকেই একে গ্রহণ করেনি… এটা তাদের ব্যক্তিগত এক্তিয়ার। আমি খোলা মাঠ, প্রকৃতি… গাছ, পুকুর, ধানখেতের সন্তান মনন আমার খেতে কর্ষণ করে, কর্ষণ করেই যায় ফসলের আশায়। কিন্তু তার পরিণতি হল জ্যামিতিক শহরে— এটা তার বাধ্যতা। বেঁচে থাকার ও বাঁচিয়ে রাখার বাধ্যতা। এই ঘিরে থাকা ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, আয়তক্ষেত্র, বৃত্ত… সবাই অট্টহাস্য করতে লাগল। হাত ধরে ধরে নেচে যেতে লাগল আমাকে ঘিরে। সে কি জীবনের উৎসব, না মৃত্যুর উন্মাদনা? আকারগুলো নাচছে,… আকারগুলো কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট।… আকার অন্ধকারে, আকার আলোতে, আকার কুয়াশায় ঢাকা। একটা পোড়া গন্ধ। ধোঁয়া। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ছে না।… সেও আকার নিচ্ছে, মনের ঘিরে থাকা পর্দায়। ছায়া নড়ছে তাতে, ছায়াবাজি! আমিই তখন আরবানিয়া— আরবানিয়া একটা ধারণা মাত্র, কোনো রচনা নয়।

খাড়াই লেখাগুলো, অরণ্যের মতো ছায়া ও অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উদ্ধত, আমি নত। আরবানিয়া আমাকে ভক্ষণ করছে, আবার উগরে দিচ্ছে। আমি তার লালা, পিত্ত, পূতিগন্ধে ডুবে আছি। আমি ভেসে উঠতে চাইছি, নিশ্বাস নিতে চাইছি। একটা রমণীকণ্ঠ আমাকে দূর থেকে ডাকছে,… হয়তো নাম ধরে, তার সুরেলা কণ্ঠ বাঁশির সুরের মতো আমাকে শান্ত করছে, আশ্বস্ত করছে। আমি আবার স্বপ্নে মজে যাচ্ছি। আমি আরবানিয়া থেকে মুক্তি পেতে চাইছি… কিন্তু জ্যামিতি আমার পিছু ছাড়ছে না।

Categories
অনুবাদ সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

দেবোরা: কেন আপনি রাজি হলেন?
মুরাকামি: তারা আমাকে বলেছিলেন যে আমি ইচ্ছামতো রেকর্ড বেছে নিতে পারি। এবং পঞ্চাশ মিনিট ধরে আমার পছন্দসই কথাবার্তা বলতে পারি। তো আমি ভাবলাম, কেন নয়! বিলি হলিডে থেকে ‘মারুন ৫’ পর্যন্ত সবকিছু থেকে আমি খুব বাছাই সংগীত পরিবেশন করি।

দেবোরা: মনে হয় আপনি একবার বলেছিলেন যে, জাপানে লেখক হওয়া খুব চটকদারি ব্যাপার। ভীষণ প্রকাশ্য জীবিকার প্রেক্ষাপটে আপনি নিজের সাধারণত্বে অবিচল থাকেন। এগুলো আপনি মেলান কীভাবে?

মুরাকামি: সত্যি বলতে শুরুর দিকে জাপানের সাহিত্য জগৎ সম্পর্কে আমি খুব একটা খুশি ছিলাম না। আমি ছিলাম একজন বহিরাগত। একটি কালো মেষ, মূলধারার জাপানি সাহিত্যে অনুপ্রবেশকারী। কিছু লোক বলেছিল যে, আমি জাপানি সাহিত্যে নতুন কণ্ঠ। এবং কিছু লোক আমাকে বাজে বলেছিল। তাই আমি একরকম বিভ্রান্ত ও বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। আমি জানতাম না কী হচ্ছে। আমি ‘ওয়ান্ডারল্যান্ডে এলিস’ এর মতো হয়ে পড়েছিলাম। তাই আমি জাপান থেকে পালিয়ে বিদেশে চলে গেলাম। ইতালি এবং গ্রিসে গিয়ে দুই-তিন বছর কাটালাম। তারপর আমি লিখলাম ‘নরওয়েজিয়ান উড’। জাপানিরা বইটিকে ঘৃণা করেছিল।

দেবোরা: এটা দুই মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল!

মুরাকামি: এত বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও লোকে আমাকে ঘৃণা করেছিল। তাই আবার আমি বিদেশে চলে গেলাম। আমি নিউ জার্সির প্রিন্সটনে গিয়ে উঠেছিলাম। জায়গাটি ছিল বিরক্তিকর। সুন্দর, তবে বিরক্তিকর। তারপরে বোস্টনের টাফট্‌স ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। সেখানকার ফেনওয়ে পার্কটি ভালো ছিল।

দেবোরা: ভূমিকম্প এবং সারিন গ্যাস আক্রমণের পরে আপনি কি আবার জাপানে ফিরে যাওয়ার মন স্থির করলেন?

মুরাকামি: হ্যাঁ। ১৯৯৫ সালে আমি অনুভব করি নিজের দেশে ফিরে এসে মানুষের জন্য কিছু করতে পারি কিনা। দেশের জন্য নয়, জাতির জন্য নয়, সমাজের জন্য নয়, আমার বিশ্বাস ছিল জনগণের প্রতি।

দেবোরা: আপনার কাছে দেশ ও জনগণ, এই দু-টি জিনিসের মধ্যে পার্থক্য কী?

মুরাকামি: মানুষ আমার বই কেনে, দেশ না।

দেবোরা: আপনি কি জাপানি হিসেবে আপনার লেখালেখিকে বিচার করেন না পশ্চিমা সাহিত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন?

মুরাকামি: আমি সেভাবে ভাবি না। আমার গল্প আমারই। এগুলো কোনো বিভাগের বিষয় নয়। তবে আমি জাপানি ভাষায় লিখি এবং আমার চরিত্রগুলো বেশিরভাগই জাপানি। তাই আমি মনে করি আমি একজন জাপানি লেখক। আমি মনে করি আমার লেখার শৈলী অন্যত্র থেকে নেওয়া নয়।

দেবোরা: জাপানে আপনার প্রথম দিকের পাঠকেরা বেশিরভাগই তরুণ ছিলেন। তরুণদের মধ্যে আপনার বিরাট প্রভাব ছিল।

মুরাকামি: হ্যাঁ। এটা খুবই অদ্ভুত। আমি যখন লিখতে শুরু করি আমার পাঠকেরা বিশ বা তিরিশের কোঠায় ছিলেন। এবং চল্লিশ বছর পরে আমার পাঠকেরা বিশ বা তিরিশের কোঠাতেই থেকে গেলেন! ভালো কথা হল আমার প্রথম প্রজন্মের কিছু অনুরাগী এখনও আমার বইগুলি পড়ছেন এবং তাদের ছেলেমেয়েরাও সেগুলি পড়ছে। একই পরিবারের তিন-চারজন একই বই পড়ছেন শুনে আমি খুব আনন্দিত হলাম। আমার এক বন্ধু তার অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের সাথে এমনিতে কথা খুবই কম বলে। কিন্তু জেনে খুব ভালো লেগেছে যে, তারা যখন কথা বলে তখন বিষয় থাকে আমার বই।

দেবোরা: ‘কিলিং কমেন্ডটর’ থেকে থেকে একটা দৃশ্য আমি উদ্ধৃত করতে চাই:

কমেন্ডেটর নিজ হাতের তালু দিয়ে দাড়ি ঘষতে লাগলেন যেন কিছু মনে পড়েছে। “ফ্রানজ কাফকা ঢালু স্থান বেশ পছন্দ করতেন”, সে বলল, “সবধরনের ঢালু স্থান তাকে আকৃষ্ট করত। ঢালের মাঝখানে নির্মিত বাড়িগুলির দিকে চেয়ে থাকতে তিনি পছন্দ করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার পাশে বসে তিনি ওই বাড়িগুলি দেখতেন। কখনোই এতে ক্লান্ত হয়ে উঠতেন না। প্রথমে মাথাটি একদিকে ঝুঁকিয়ে তিনি বসতেন পরে আবার সোজা করে নিতেন। অদ্ভুত মানুষের মতো ছিল তাঁর আচরণ। আপনি কি এটা জানতেন?” ফ্রানজ কাফকা এবং ঢালু স্থান? “না। আমি জানি না”। আমি বললাম। আমি এরকম কখনো শুনিনি। “তবে এটা জানার পর কি কেউ তাঁর কাজের আরো বেশি প্রশংসা করে?”

দেবোরা: উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা যদি আপনার কৌশল জানি যে আপনি ঢালু স্থানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করেন, এতে কি আপনার কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে আমাদের সাহায্য করবে?

মুরাকামি: ফ্রানজ কাফকা ঢালু জায়গা পছন্দ করতেন, এটি মিথ্যা। এটি আমার তৈরি করা। তবে এটা করে কি ভালো করলাম? খুব সম্ভবত ফ্রানজ কাফকা ঢালু জায়গা পছন্দ করতেন।

দেবোরা: এটা সম্ভব।

মুরাকামি: কিছু লোক এই উদ্ধৃতি দেয়। তবে আমি এটি তৈরি করেছিলাম। আমি অনেক কিছুই তৈরি করেছি।

দেবোরা: কল্পকাহিনিতে আপনি এটা তৈরি করতেই পারেন। যদি আমরা জানতে পারি যে আপনি বিড়াল ভালোবাসেন, এটা কি আমাদের আপনার কাজকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে?

মুরাকামি: আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন।

দেবোরা: তিনি আপনাকে চেনেন বলে কি আপনার কাজকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন?

মুরাকামি: আমি জানি না। সে বলে আমি তাঁর প্রিয় লেখক নই। তবে সে সবসময় আমার কাজকে খুব গুরুত্বের সাথে সমালোচনা করে। সে আমার প্রথম পাঠক। সুতরাং আমি যখন লেখা শেষ করে পাণ্ডুলিপিটা তাকে পাঠাই সে পড়ে এবং দু-শো ত্রুটি-সহ ফিরিয়ে দেয়। এই ত্রুটিগুলো আমি খুব অপছন্দ করি। সে বলে, “তোমার এই অংশগুলো পুনরায় লেখা উচিত!”

দেবোরা: তখন আপনি আবার লেখেন?

মুরাকামি: হ্যাঁ। তারপরে সেটা আবার তার কাছে পাঠিয়ে দিই। এবার সে একশোটি ত্রুটি-সহ পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দেয়। আগের থেকে কম ত্রুটি থাকে বলে ভালো লাগে।

প্রথম পাতা

Categories
অনুবাদ সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

দেবোরা: আপনি যখন অনুবাদ করেন, আপনাকে অন্য লেখকদের কণ্ঠস্বর গ্রহণ করতে হয়। আপনাকে এক অর্থে ফিটসগেরাল্ড, চ্যান্ডলার বা শেভার হতে হয়। আপনি যখন নিজের একটি স্টাইল আয়ত্ত করে ফেলেছেন তখন কি এটি একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়?

মুরাকামি: হ্যাঁ। আমি স্কট ফিটসগারেল্ডকে ভালোবাসি। তাঁর অনেকগুলি বই অনুবাদ করেছি। তবে তাঁর শৈলী আমার থেকে অনেকটাই আলাদা, সুন্দর এবং জটিল। তবুও আমি তাঁর লেখা থেকে অনেক কিছু শিখেছি— তাঁর মনোভাব, বিশ্বজগতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। রেমন্ড কার্ভারের শৈলী এবং তাঁর লেখার জগৎ আমার থেকে অনেক আলাদা। তবে আমি তাঁর থেকেও শিখেছি।

দেবোরা: জন শেভারের লেখা বর্তমানে আপনি অনুবাদ করছেন। কেন শেভার?

মুরাকামি: কেন শেভার? আমি বহু বছর ধরে তাঁর ছোটোগল্পগুলি আনন্দের সঙ্গে পড়ে আসছি। তবে শেভার জাপানে জনপ্রিয় নন। এখানে খুব কম লোকই তাঁর লেখা পড়েছে। কারণ, তাঁর শৈলী ভীষণ আমেরিকাপন্থী। আমার ধারণা, উনিশশো পঞ্চাশের দশক এবং এর মাঝামাঝি সময় আর মধ্যবিত্ত শ্রেণিই শুধু তাঁর লেখার উপজীব্য। আমি মনে করি না বেশি জাপানি পাঠক তাঁর লেখা পছন্দ করবে। তবে লেখাগুলো আমি খুবই ভালোবাসি। তাই এটি একধরনের চ্যালেঞ্জ।

দেবোরা: আপনি অন্য লেখকদের থেকে যা যা শেখেন সেগুলি আপনার লেখায় প্রবেশ করলে আপনি বুঝতে পারেন?

মুরাকামি: আমার মনে হয় একটু প্রভাব তো আছেই। আমি যখন লিখতে শুরু করি আমার কোনো পরামর্শদাতা ছিল না। আমার কোনো শিক্ষক ছিল না। আমার কোনো সাহিত্যিক বন্ধু ছিল না। আমার শুধু আমি ছিলাম। তাই আমাকে বই থেকে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে। ছোটোবেলায় আমি বই পড়তে পছন্দ করতাম। বাড়িতে আমি একমাত্র সন্তান ছিলাম। আমার কোনো ভাই বা বোন ছিল না। অবশ্যই আমার কাছে বই এবং বিড়াল ছিল। সংগীত তো অবশ্যই ছিল। আমি খেলাধুলা পছন্দ করতাম না, পড়তে পছন্দ করতাম। কৈশোর বয়সে আমি রাশিয়ান উপন্যাস পড়ি। দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় আমার প্রিয় ছিল। আর এদের বইগুলি থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এমন অনেক সহপাঠী ছিল যারা লেখক হতে চেয়েছিল। তবে আমি বিশ্বাস করতাম না যে, আমার প্রতিভা আছে। তাই আমি একটি জ্যাজ ক্লাব খুলি আর সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি।

দেবোরা: আপনি নিজে কখনো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছিলেন?

মুরাকামি: ছোটোবেলায় আমি পিয়ানো বাজাতাম। তবে এতে আমার বিশেষ প্রতিভা ছিল না। আমার বয়স যখন পনেরো বছর তখন আর্ট ব্লেকি এবং জ্যাজ মাসেঞ্জাররা জাপানে এসেছিলেন। সেই কনসার্টে আমি গিয়েছিলাম। এর আগে আমি জানতাম না, জ্যাজ কী, তবে সেই রাত থেকেই আমি একজন উৎসাহী জ্যাজ ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রেকর্ড সংগ্রহ করে গেছি। আমার স্ত্রী সবসময় অভিযোগ করত। আমার বাড়িতে কত যে জ্যাজ রেকর্ড রয়েছে! তবে আমি লেখার বিষয়ে সংগীত থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। আমি মনে করি এতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে, ছন্দ, সাংগীতিক ঐকতান আর তাৎক্ষণিক উন্নতিকরণ। আমি সাহিত্য থেকে নয়, সংগীত থেকে এই জিনিসগুলি শিখেছি। এবং যখন আমি লিখতে শুরু করি তখন ভাবটা এমন থাকে যেন আমি গান বাজনা করি।

দেবোরা: আপনার মা-বাবা দু-জনেই সাহিত্যের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁরা কি আপনার লেখার সিদ্ধান্ত বিষয়ে খুশি হয়েছিলেন? তাঁরা কি আপনাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে বলেছিলেন?

মুরাকামি: তা আমি মনে করি না। আমি জানি না তারা আমার কাছ থেকে কী আশা করেছিল।

দেবোরা: শেষবার আমরা যখন কথা বলেছিলাম আপনি বলেছিলেন, ৯/১১ বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। কেবল আসল পৃথিবীকেই নয়, আপনি যে পৃথিবী নিয়ে লিখতে চান সেখানেও এই সংকটগুলি প্রভাব ফেলেছিল মনে হয়। আপনি কি মনে করেন যে, জাপানের সুনামি এবং ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয়ের মতো ঘটনাগুলি আপনার কল্পকাহিনিগুলোকে বদলে দিয়েছে?

মুরাকামি: হ্যাঁ। ১৯৯৯ সালে কোবে ভূমিকম্পের পর আমি ‘আফটার কোয়েক’ নামে ছোটোগল্পের একটি সংকলন লিখেছিলাম। আমার মা-বাবার ঘর-সহ পুরো কোবে শহরটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন ম্যাসাচুসেটসে ছিলাম। তারপর চার বছর কাটিয়েছি যুক্তরাজ্যে। বলতে গেলে তখন আমি একপ্রকার প্রবাসীই হয়ে পড়েছিলাম। তবে টিভিতে দেখেছিলাম দৃশ্যগুলো। ঔপন্যাসিক হিসেবে তখন আমি ভাবছিলাম, এই ভূমিকম্প বিষয়ে আমি কী করতে পারতে পারি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি যা করতে পারি তা হল ভূমিকম্পের সময়টায় ঠিক কী হয়েছিল তা শুধু কল্পনা করতে। তাই এটা আমার কাছে কল্পনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি যখন কোনো উপন্যাস লিখি তখন গবেষণা করি না। কারণ, কল্পনা আমার সম্পদ, আমার উপহার। আমি এটি পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাই। ওই একই বছর, এর দুই মাস পরে টোকিওর একটি পাতাল রেল ট্রেনে সারিন-গ্যাস দ্বারা আক্রমণ হয়েছিল। আমি তখন জাপানে ছিলাম না। আমি খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনে এই বিষয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি যা পড়তে চেয়েছিলাম তা ওই লেখায় পাইনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম সত্যি কী ঘটেছিল সেদিন ওই ট্রেনে। ভরতি ট্রেনে গ্যাসের গন্ধ নেওয়ার মতো বাস্তব অবস্থাটা আমি জানতে চেয়েছিলাম। তাই আমি নিজের মতো এই জিনিসগুলি খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি সারিন-গ্যাসে ক্ষতিগ্রস্তদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং তাদের প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছি আসল ঘটনা। তারা আমাকে বলে আসলে কী ঘটেছিল। আমি এই বিষয়গুলি নিয়ে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামে একটি প্রবন্ধধর্মী বই প্রকাশ করি। অন্য কেউ এটা করেনি বলে আমাকেই এটা করতে হয়েছে। তাছাড়া আমার নিজস্ব জিজ্ঞাস্য আর কৌতূহলও ছিল। এই সাক্ষাৎকারগুলি নিতে আমার একবছর সময় লেগেছিল। আমি মনে করি ওই একবছর আমাকে বদলে দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাটা ছিল দারুণ। সেই একবছর আমি কিছুই লিখিনি। আমি কেবল সেই কণ্ঠস্বরগুলো শুনেছি। সেগুলি এখনও আমার মনের মধ্যে আছে। আমি সেই শুদ্ধ স্বরগুলোকে বিশ্বাস করি। ট্রেনে চড়া মানুষগুলো ছিল সাধারণ মানুষ। তারা টোকিয়োর এক সকালে ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই কেউ সারিন গ্যাসে ভরতি প্লাস্টিকের ড্রাম দ্বারা আক্রমণ করে এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন মারা যায়। পরিস্থিতি ছিল এমনই অতিবাস্তবিক। তবে তাদের কণ্ঠস্বর ছিল সাধারণ। আউম শিনরিকো সম্প্রদায়ের মানুষেরা (যারা আক্রমণ করেছিল) সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাঁরা হয়তো এর মাধ্যমে একরকম সত্য বা পরম সত্যের সন্ধান করছিলেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা সাধারণ যাত্রী ছিলেন। আমি শিনরিকো সম্প্রদায়ের মানুষদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁদের কথা আমার মনে ধরেনি।

দেবোরা: গ্যাস আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় আপনি কঠিন সত্যের খোঁজ করেছিলেন, কিন্তু ভূমিকম্পের কথা বলতে গিয়ে আপনি কেন আংশিক কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন?

মুরাকামি: কারণ, কোবে আমার নিজের শহর এবং ঘটনাটা খুবই বেদনার। সেখানে আমার অনেক বন্ধু আছে। আমি যদি এই লোকগুলির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতাম তবে আমি খুব হতাশ হয়ে পড়তাম। কিন্তু কাহিনিতে আমি আমার নিজস্ব জগৎ তৈরি করতে পারি। তাই এটি আমার পক্ষে সহজতর ছিল। সহিংসতা আপনার মন আর শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছুর বিনাশ হয়ে যেতে পারে এর ফলে। ভূমিকম্পের আগে আমরা ভেবেছিলাম ভূমিস্তর খুব শক্তপোক্ত। কিন্তু এখন আর তা নেই। এটা হয়ে উঠতে পারে অস্থির, অনির্দিষ্ট, নরম। আমি হয়তো এটাই লিখতে চেয়েছিলাম।

এরপর ৯/১১, সুনামি-সহ আরও অনেক বিপর্যয় ঘটেছিল। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বিপর্যস্ত মানুষগুলির জন্য আমি কী করতে পারি। উত্তরটা এইরকম যে, আমি শুধু পারি ভালো সাহিত্য রচনা করতে। কারণ, আমি যখন একটি ভালো গল্প লিখি তখন আমরা একে অন্যকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। আপনি যদি পাঠক হন আমি একজন লেখক। আমি আপনাকে চিনি না। তবে সাহিত্যের অন্তর্জগতে আমাদের মধ্যে এক গোপন যোগাযোগের পথ রয়েছে। আমরা অবচেতন পথে একজন অন্যকে বার্তা পাঠাতে পারি। এইভাবে আমি মনে করি অবদান রাখতে পারি।

দেবোরা: আপনি লেখার মাধ্যমে বার্তা পাঠান। কিন্তু আপনি নিজে বার্তা ফিরে পান কী করে?

মুরাকামি: আমি জানি না। একটি উপায় হয়তো আমরা বের করতে পারব।

দেবোরা: ‘কাফকা অন দ্য শোর’ উপন্যাসটি প্রকাশের পর আপনার ওয়েবসাইটে বইটি সম্পর্কে পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। আপনি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছিলেন। আপনি কেন এটা করলেন? শুধু এই বই নিয়ে কেন?

মুরাকামি: আমি পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানতে উৎসুক ছিলাম (২০১৫ সালেও এইরকম করেছিলাম)। সীমিত সময়ের জন্য ছিল এই ব্যবস্থা। তবে আমি অনেকগুলো মেইল পেয়েছিলাম। আমার মনে নেই কতগুলো। ত্রিশ হাজার হবে সম্ভবত। তবে আমি সেগুলো পড়েছি এবং চোখের ক্ষতি করেছি। আমি সম্ভবত তিন হাজারের উত্তর দিয়েছি। খুব পরিশ্রমের ছিল ব্যাপারটা। তবে আমার মনে হয় আমি এটা জানতে পেরেছি যে, কী ধরনের পাঠক আমার বই পড়ছে। এবং আমার লেখা সম্পর্কে তারা কী ভাবছে সে সম্পর্কে আমি একটা অস্পষ্ট ধারণা পেয়েছি। তাদের মধ্যে কিছু বোকা বোকা প্রশ্নও ছিল। একজন আমাকে স্কুইডের কর্ষিকা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। স্কুইডের দশটি কর্ষিকা রয়েছে এবং সে জানতে চেয়েছিল তাদের হাত পা আছে কিনা। তিনি কেন সে এইরকম প্রশ্ন করলেন? আমি উত্তর দিয়েছিলাম এইভাবে: স্কুইডের বিছানার পাশে আপনি দশটা গ্লাভ অথবা দশটা মোজা রেখে দিন। সে যখন জেগে উঠবে তখন হয় গ্লাভ নয়তো মোজা বেছে নেবে। এইভাবে আপনি আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন। আমি অবশ্য জানি না স্কুইড বিছানায় ঘুমায় কিনা। তবে আমি বেশিরভাগ প্রশ্নই উপভোগ করেছিলাম।

দেবোরা: এটা ছিল পাঠকদের সংস্পর্শে থাকার একটা উপায়। আমি জানি যে আপনি জাপানে কোনো অনুষ্ঠান বা সেখানে কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন না। কেন এমন?

মুরাকামি: আমি একজন লেখক। এবং আমার কাছে লেখাই একমাত্র কাজ। আমি একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, লেখালেখি ছাড়া আমি আর কিছুই করব না। তবে সম্প্রতি আমি ডিস্ক-জকির কাজ করছি। টোকিয়োর একটি এফএম রেডিয়ো স্টেশন থেকে আমাকে ডিস্ক-জকির কাজ করতে বলা হয়েছিল। আমি এখন ওই কাজটি করছি।

শেষ পাতা

Categories
অনুবাদ সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

দেবোরা: আপনি বলেছেন যে আপনার প্রথম বই দু-টি লেখা খুব সহজ ছিল। তারপর লেখা কঠিন হয়ে পড়ে। আপনি কীরকম সমস্যার সম্মুখীন হন?

মুরাকামি: আমার প্রথম দুটো বই ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’, ‘পিনবল ১৯৭৩’ লিখতে আমার সহজ মনে হয়েছিল। কিন্তু বইগুলো নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই। এ-দুটো লেখার পর আমি উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠি। তারপর আমি লিখেছিলাম, ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’, আমার প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উপন্যাস (অন্য দু-টি উপন্যাসিকার মতো ছিল)। এটি লিখতে আমার তিন-চার বছরের মতো সময় লেগেছিল। আমার ধারণা, ওই প্রস্রবনের জন্য আমাকে সত্যি একটা গর্ত খুঁড়তে হয়েছিল। সুতরাং, আমি মনে করি ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ আমার কেরিয়ারের প্রকৃত সূচনাবিন্দু ছিল। প্রথম তিন বছর আমি জ্যাজ ক্লাবের মালিক হিসেবে কাজ করার সময় লিখেছিলাম। রাত দুটোয় ক্লাবের কাজ শেষ করে রান্না ঘরের টেবিলে লিখতে বসে যেতাম। এটা ছিল আমার পক্ষে খুব কষ্টের। প্রথম দুটো বইয়ের পর আমি সিদ্ধান্ত নেই যে ক্লাব বিক্রি করে দেব এবং পূর্ণ সময়ের লেখক হব। কিন্তু ক্লাবটি তখন ভালোই চলছিল এবং সবাই আমাকে ওটা বিক্রি করতে বারণ করেছিল। তারপরে আমি লিখতে পারলাম ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’। আমি এই ধরনের একটি বড়ো বই লিখতে চেয়েছিলাম।

দেবোরা: বড়ো বই লেখা সহজ ছিল, না আরও চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠেছিল?

মুরাকামি: আমি যখন ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ লিখছিলাম তখন আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম। কারণ, আমি জানতাম না যে এর পরে কী ঘটবে। পরবর্তী ঘটনা জানার জন্য আমি পরের দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে পারতাম না। আমি পরের পৃষ্ঠাগুলি ওলটাতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরে কোনো পৃষ্ঠা ছিল না, তাদেরকে আমায় লিখতে হয়েছিল।

দেবোরা: আপনার কি এমন কখনো হয়েছে যে, পরে কী ঘটবে তা আপনার অজানা ছিল এবং সেদিন আর লিখতে পারেননি?

মুরাকামি: আমি কখনো রাইটার্স ব্লক অনুভব করিনি। একবার আমি ডেস্কে বসতে পারলে জানি যে পরে কী ঘটবে। আমি লিখতে না চাইলে লিখি না। পত্রিকা সবসময় আমাকে কিছু না কিছু লিখতে বলে এবং আমি প্রতিবারই ‘না’ বলে দেই। আমি যখন লিখতে চাই তখনই লিখি।

দেবোরা: আপনি কি মনে করেন আপনার ঘুমের মধ্যেও প্লটগুলি সক্রিয় থাকে?

মুরাকামি: না, এটা মনে করি না। আমি স্বপ্ন দেখি না। গল্প লেখা আর স্বপ্ন দেখা আলাদা জিনিস। আর আমার কাছে লেখা স্বপ্ন দেখার মতোই। আমি যখন লিখি তখন ইচ্ছা করে স্বপ্ন দেখতে পারি। শুরু করতে পারি আবার থামতেও পারি। এমনকী পরের দিনও সেটা চালিয়ে নিতে পারি। আপনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হয়তো একটি ভালো মাংসের খাবার, একটি ভালো বিয়ার বা একটি সুন্দর মেয়ের স্বপ্ন দেখেন এবং যখন জেগে ওঠেন তখন সব শেষ হয়ে যায়। আমি কিন্তু পরের দিন সেটা চালিয়ে নিতে পারি।

দেবোরা: কয়েক বছর আগে আপনি বলেছিলেন যে, আপনি যখন কোনো উপন্যাস লেখেন তখন কিছু ধারণা বা বাক্যাংশের একটি তালিকা তৈরি করে নেন, যেমন, ‘কথাবলা বানর’ বা ‘সিঁড়িতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া লোক’ প্রভৃতি। আপনি যখন লিখতে বসেন, আপনি বলেছিলেন “প্রতিটা গল্পে অবশ্যই এই তালিকা থেকে দুই বা তিনটি জিনিস থাকতে হবে”। আপনি কি প্রায়শই এভাবে কাজ লেখালেখি করেন?

মুরাকামি: আমি তখন এক সময়ে ছয়টি গল্প লিখেছিলাম। তাই ওই লেখাগুলির সাহায্য নিতে হয়েছিল। উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা দরকার হয় না। আমার চেষ্টা থাকে প্রতিবার নতুন কিছু করা। আমার বেশিরভাগ বই আমি প্রথম পুরুষে লিখেছিলাম। ‘১৯৮৪’ (1Q84)-তে আমি তিনটি চরিত্র প্রথম পুরুষে লিখেছি। এটা আমার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রায়শই আমার গল্পের কথক প্রধান চরিত্রটি এমন একজন ব্যক্তিতে পরিণত হয় যে কিনা আমি হতে পারতাম। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সেটা হয় না। পরিবর্তে পরিণত হয় আমার একধরনের বিকল্পে। অবশ্যই বাস্তবে আমি নিজে অন্য মানুষে পরিণত হতে পারি না। তবে সাহিত্যে আমি যে কেউ হতে পারি। আমি অন্যের জুতোতে পা রাখতে পারি। একে একধরনের থেরাপি বলতে পারেন। আপনি যদি লিখতে পারেন তবে আপনার মধ্যে এমন এক সম্ভাবনা তৈরি হবে যে আপনি স্থির থাকতে পারবেন না, অন্য যে-কেউ হয়ে যেতে পারেন।

দেবোরা: আপনি যখন লিখতে শুরু করেছিলেন সেই একই সময়ে আপনি দৌড়ানোও শুরু করেন। আমি জানি কিছু মানুষ চলতে চলতে আপন মনে লিখতে পছন্দ করেন। হাঁটার ছন্দ তাদের এই কাজে সাহায্য করে। আপনি দৌড়ানোর সময় কখনো লেখার কথা ভেবেছেন?

মুরাকামি: একদম না। আমি দৌড়ানোর সময় শুধু দৌড়াই। তখন আমি মনকে খালি রাখি। দৌড়ানোর সময় আমি কী ভাবি সেই সম্পর্কে আমার কোনো পরিকল্পনা থাকে না। হয়তো কিছুই ভাবি না। তবে আপনি অবশ্যই জানেন যে দীর্ঘ সময় ধরে লিখতে গেলে আপনাকে দৃঢ় হতে হবে। একটি বই লিখে ফেলা এমনিতে কঠিন নয়, তবে অনেক বছর ধরে লেখা চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আপনার একাগ্রতা আর সহনশীলতার শক্তি প্রয়োজন। আমি মাঝে মাঝে খুব আস্বাস্থ্যকর আর অদ্ভুত জিনিস লিখি। আমি মনে করি আপনি অস্বাস্থ্যকর জিনিস লিখতে চাইলে আপনাকে খুব স্বাস্থ্যবান হতে হবে। এটি একটি প্যারাডক্স, তবে সত্যি। বোদল্যেরের মতো কিছু লেখক খুব অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করেছিলেন। তবে আমার মতে সেই দিন আর নেই। এখনকার বিশ্ব খুব কঠোর আর জটিল। এগুলো কাটিয়ে উঠে বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে শক্তপোক্ত হতে হবে। আমি যখন তিরিশ বছর বয়সী তখন আমি লেখা শুরু করেছি। আমার যখন বত্রিশ বা তেত্রিশ বছর বয়স তখন দৌড়তে শুরু করি। আমি প্রতিদিন দৌড়ানো শুরু করলাম। কারণ, এর ফলে কী হয় তা আমি দেখতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয় জীবন একধরনের পরীক্ষাগার, যেখানে আপনি যা কিছু করতে পারেন। এবং শেষ পর্যন্ত এটি আমার পক্ষে লাভদায়ক হয়ে উঠেছিল। আমার শরীর এতে দৃঢ় হয়ে উঠেছিল।

দেবোরা: লেখা দৌড়ানোর মতো একটি নির্জন সাধনা। আপনি একটি জ্যাজ ক্লাবের মালিকের জীবন থেকে লেখায় চলে এসেছিলেন। সেখানে সবসময় আপনার চারপাশে লোকেরা ভিড় করে থাকত। কিন্তু তারপর লেখা আর পড়াশুনায় একদম একা হয়ে থাকতে কি আপনার ভালো লাগত?

মুরাকামি: আমি খুব একটা সামাজিক জীব নই। আমি প্রচুর রেকর্ড এবং সম্ভবত বিড়ালদের সাথে শান্ত জায়গায় একা থাকতে চাই। আর বেসবল খেলা দেখার জন্য কেবল টিভি। ব্যাস, আমি এইটুকুই চাই।

দেবোরা: আপনি একবার বলেছিলেন যে, আপনার জীবনের স্বপ্ন ছিল কূপের তলদেশে বসা। আপনার বেশ কয়েকটি চরিত্র ঠিক তেমনটি করেছে। ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’-এ মেনশিকিও এমন করেছে। কেন?

মুরাকামি: আমি কূপ খুব পছন্দ করি। আমি ফ্রিজ, হাতি এমন অনেক জিনিস পছন্দ করি। আমি যা পছন্দ করি সে-সম্পর্কে লিখে খুব আনন্দ পাই। আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন আমাদের বাড়িতে একটি কূপ ছিল এবং আমি সবসময় সেই কূপটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তাতে আমার কল্পনাশক্তি বেড়ে গিয়েছিল। শুকনো কূপে পড়ে যাওয়া নিয়ে রেমন্ড কার্ভারের একটি ছোটোগল্প আছে। আমি সেই গল্পটি খুব পছন্দ করি।

দেবোরা: আপনি কখনো কোনো কূপের নীচে যাবার চেষ্টা করেছেন?

মুরাকামি: না না। এটা বিপজ্জনক। এটা আমার কল্পনায় ঘটে। তবে আমি গুহাও পছন্দ করি। আমি যখন বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করি, তখন যদি কোনো গুহা দেখি আমি তার মধ্যে প্রবেশ করি। উঁচু স্থান আমার পছন্দ হয় না।

দেবোরা: আপনি উপরে না উঠে নীচে যেতে চান?

মুরাকামি: কেউ বলে এটা অবচেতন মনের একধরনের রূপক। তবে আমি ভূ-গর্ভস্থ বিশ্ব সম্পর্কে খুবই আগ্রহী।

দেবোরা: কয়েক বছর আগে প্যারিস রিভিউ সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন যে, আপনার গল্পের চালিকাশক্তি হল “হারিয়ে যাওয়া এবং অনুসন্ধান এবং খুঁজতে থাকা”। আপনি কি এখনও এতে বিশ্বাস করেন?

মুরাকামি: হ্যাঁ। হারানো কিছুর সন্ধান করা আমার সাহিত্যের খুব গুরুত্বপূর্ণ থিম। আমার চরিত্রগুলো প্রায়শই হারিয়ে গেছে এমন কিছুর সন্ধান করে থাকে। কখনো একটি মেয়ে, কখনো একটি কারণ, কখনো বা এটি একটি উদ্দেশ্য। কিন্তু তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু খোঁজে, যা হারিয়ে গিয়েছিল। তবে সেটা খুঁজে পেলে একরকম হতাশা সৃষ্টি হবে। কেন তা আমি জানি না, তবে কোনো কিছুর অনুসন্ধান আমার গল্পের একধরনের মোটিফ। যদিও এটা কোনো আনন্দদায়ক সমাপ্তি নয়।

দেবোরা: প্রায়শই আপনি যে-পুরুষদের সম্পর্কে লেখেন তারা আবেগগতভাবে বা অস্তিত্বহীন হয়ে কোনোরকমভাবে হারিয়ে যায়। এগুলো পৃথিবীতে খুব একটা হয় বলে মনে হয় না।

মুরাকামি: আপনি অবশ্যই জানেন যে, গল্পের মূল চরিত্র যদি সুখী হয় তবে কোনো গল্প তৈরির সম্ভাবনা থাকে না।

দেবোরা: আপনার উপন্যাসগুলি সাধারণত একটি রহস্যের চারদিকে ঘোরে। কখনো আপনি সেই রহস্যটি সমাধান করেন এবং কখনো সমাধান না করে ছেড়ে দেন। আপনি কি পাঠকদের জন্য বিষয়গুলি উন্মুক্ত রাখতে চান, না আপনি নিজে সমাধান বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন না?

মুরাকামি: আমি যখন কোনো বই প্রকাশ করি মাঝে মাঝে আমার বন্ধুরা ফোন করে জিজ্ঞাসা করে, “এর পরে কী হবে?” আমি বলি, “এখানেই শেষ”। তবে পাঠকেরা এর সিক্যুয়েল আশা করে। ‘১৯৮৪’ (1Q84) প্রকাশিত হবার পর গল্পের পরবর্তীতে কী ঘটবে তার সমস্ত কিছুই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি একটি সিক্যুয়েল লিখতে পারতাম কিন্তু লিখিনি। আমি ভেবেছিলাম এটি ‘জুরাসিক পার্ক ৪’ বা ‘ডাই হার্ড ৮’-এর মতো হতে পারে। তাই আমি সেই গল্পটি কেবল আমার মনের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম এবং এটি আমি খুব উপভোগ করেছি।

দেবোরা: আপনি কি মনে করেন সেটা কখনো লিখবেন?

মুরাকামি: আমি তা মনে করি না। আমি শুধু জানি এটি আমার মনের মধ্যে থাকবে। তেঙ্গোর ষোলো বছরের মেয়ে সিক্যুয়েলের মূল চরিত্র হবে, এটি খুব আকর্ষণীয় গল্প।

দেবোরা: তারপরেও এটা কোনো ‘ডাই হার্ড ৮’ নয়!

মুরাকামি: এবং সেই বইয়ের একটি প্রিক্যুয়েল রয়েছে।

দেবোরা: শুধু আপনার মনের মধ্যে?

মুরাকামি: হ্যাঁ।

দেবোরা: কিছু লেখক প্রতিটি বইয়ে সম্পূর্ণ নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। এবং কিছু লেখক যে পদ্ধতি তার পক্ষে সবচেয়ে ভালো হবে সেটাই চেষ্টা করেন। আপনি কোনটির পক্ষে?

মুরাকামি: কাজুয়ো ইশিগুরোর লেখা আমি পছন্দ করি। সে আমার বন্ধু। যতবারই সে নতুন বই প্রকাশ করে সেটি আগের থেকে আলাদা হয়। এটি খুব আকর্ষণীয় বিষয়। তবে আমার পক্ষে থিম আর মোটিফগুলো এত আলাদা নয়। আমি সিক্যুয়েল লিখতে পছন্দ করি না। তবে বইগুলির পরিমণ্ডল একে-অপরের চেয়ে আলাদা নয়। আমি শুধু একজন ব্যক্তি এবং আমার নির্দিষ্ট উপায় আছে বলে মনে করি। এটা আমি পরিবর্তন করতে পারি না। তবে আমি একই জিনিস বারবার লিখতে চাই না।

দেবোরা: আপনার নিজস্ব শৈলীতে প্রায়শই জটিল বা গভীর কল্পনা থাকে কিন্তু লেখা সেরকম হয় না। বাক্যগুলি বেশ সহজ এবং হালকা। এই বৈপরীত্য কি উদ্দেশ্যমূলক?

মুরাকামি: অনেক লেখক জটিল জটিলতর স্টাইলে তুচ্ছ অগভীর জিনিস লেখেন। আমি চাই কঠিন ও জটিল জিনিসগুলি খুব সহজ শৈলীতে লিখতে, যা পড়া সহজতর এবং আরামদায়ক। এই কঠিন জিনিসগুলি লিখতে গেলে আপনাকে আরও গভীর আর গভীরতর হতে হবে। সুতরাং চল্লিশ বছর ধরে লিখতে লিখতে আমি তার জন্য একটি কৌশল তৈরি করেছি। এটি একটি শারীরিক কৌশলের মতো, কোনো বৌদ্ধিক কৌশল নয়। আমি মনে করি আপনি যদি কোনো কথাসাহিত্যিক হন এবং আপনি যদি খুব বুদ্ধিমান হন তবে আপনি লিখতে পারবেন না। আপনি যদি নির্বোধ হন তাহলেও লিখতে পারবেন না। এর মধ্য থেকে আপনাকে একটা অবস্থান খুঁজে নিতে হবে। এটা খুব কঠিন।

দেবোরা: আপনি কি মনে করেন আপনার লিখনশৈলী অনুবাদে ধরা পড়েছে?

মুরাকামি: হ্যাঁ। কেন জানি না, তবে যখন আমি আমার বইগুলি ইংরেজিতে পড়ি তখন আমার মনে হয়, ওহ্‌, এ তো আমিই! ছন্দ, গদ্যশৈলী একই— প্রায় একই।

দেবোরা: আপনি নিজেই একজন অনুবাদক। আপনি এফ. স্কট ফিটজগারেল্ড, ট্রুম্যান কাপোতে, রেমন্ড চ্যান্ডলার এবং অন্যন্যদের লেখা জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এখন আপনি অনুবাদ করছেন জন শেভারের লেখা। লেখকদের কোন দিকগুলি আপনাকে অনুবাদে প্রণোদিত করে?

মুরাকামি: এটি বলা সহজ। আমি যা পড়তে চাই তা অনুবাদ করি। আমি রেমন্ড চ্যান্ডলারের সমস্ত উপন্যাস অনুবাদ করেছি। আমি তাঁর স্টাইলটি পছন্দ করি। আমি পাঁচ বা ছয়বার ‘দ্য লং গুডবাই’ পড়েছি।

তৃতীয় পাতা

Categories
সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

[২০০৮ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ‘দি নিউ ইয়র্কার ফেস্টিভ্যাল’-এ হারুকি মুরাকামির সঙ্গে কথপোকথন থেকে এই সাক্ষাৎকার সংকলিত। ‘দি নিউ ইয়র্কার’-এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দেবোরা স্টেইনম্যান।]

মুরাকামি: আমি যখন দশ বছর আগে শেষবারের মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম এবং এই দশ বছরে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। যেমন, এই দশ বছরে আমি দশ বছর বড়ো হয়েছি। এটা খুব গুরুতপূর্ণ বিষয়, অন্তত আমার কাছে। দিনের পর দিন আমি বয়স্ক হয়ে উঠছি আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজেকে কৈশোরের দিনগুলো থেকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। আজকাল আমি ভদ্রলোক হবার চেষ্টা করছি। আপনি জানেন যে, ভদ্রলোক এবং ঔপন্যাসিক একইসঙ্গে হওয়া সহজ নয়। একজন রাজনীতিবিদের একইসঙ্গে ওবামা এবং ট্রাম্প হবার চেষ্টা করার মতো। তবে আমার কাছে ভদ্রলোক ঔপন্যাসিকের সংজ্ঞা আছে। প্রথমত, তিনি যে আয়কর দিয়েছেন সেই বিষয়ে কথা বলেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর প্রাক্তন বান্ধবী বা প্রাক্তন স্ত্রী সম্পর্কে লেখেন না। এবং তৃতীয়ত, তিনি সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ সম্পর্কে ভাবেন না। সুতরাং, দেবোরা, দয়া করে আমাকে এই তিনটি জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন না। আমি সমস্যায় পড়ে যাব।

দেবোরা: আপনি আমার প্রশ্নভাণ্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন। আসলে আমি আপনার অতি সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘কিলিং কমেন্ডোটোর’ দিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম। বইটি এমন এক ব্যক্তির বিষয়ে, যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। সে এক পুরোনো চিত্রশিল্পীর বাড়িতে থাকা শুরু করে। সে যখন সেই বাড়িতে গিয়ে থাকা শুরু করল তখন অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করে। এর মধ্যে একটা হল কিছুটা কূপের মতো দেখতে একটি গর্তের দেখা পাওয়া। আমি ভাবছি আপনি কীভাবে উপন্যাসের এই ভিত্তিটি নির্মাণ করলেন?

মুরাকামি: আপনি জানেন যে এটি একটি বড়ো বই এবং এটা লিখতে আমার দেড় বছর বা তার বেশি সময় লেগেছিল। তবে এটি শুরু হয়েছিল একটি বা দু-টি অনুচ্ছেদ দিয়ে। আমি সেই অনুচ্ছেদগুলো লিখে আমার ডেস্কের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম এবং একসময় ভুলেও গিয়েছিলাম। তারপর, সম্ভবত তিন বা ছয় মাস পরে আমার ধারণা হয় যে, আমি ওই অনুচ্ছেদ্গুলো দিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে পারি। তারপর আমি লিখতে শুরু করি। আমার কোনো পরিকল্পনা বা প্লটও ছিল না। তারপর গল্পটি আমাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেল। যদি আপনার কোনো পরিকল্পনা থাকে, আপনি শুরু করার সময়ে যদি পরিণতি জানেন, উপন্যাস লিখে কোনো আনন্দ নেই। আপনি হয়তো জানেন, কোনো চিত্রশিল্পী চিত্রকর্ম শুরু করার আগে রূপরেখা এঁকে নেয়, তবে আমি তা করি না। আমার কাছে আছে একটি সাদা ক্যানভাস এবং একটি ব্রাশ। তাই দিয়ে আমি ছবি আঁকি।

দেবোরা: উপন্যাসটিতে একটি চরিত্র বা ধারণা আছে, যা মোজার্টের অপেরা ‘ডন জিওভান্নি’ থেকে গড়ে উঠেছে। এই ধারণা বা চরিত্রটি বইয়ের কেন্দ্রে থাকার কারণ কী?

মুরাকামি: সাধারণত আমি আমার বইগুলি শিরোনাম দিয়ে শুরু করি। এই ক্ষেত্রে ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’ শিরোনাম আর প্রথম অনুচ্ছেদটা নিয়ে আমি ভাবলাম যে এগুলি দিয়ে আমি কী ধরনের গল্প লিখতে পারি! জাপানে ‘কমেন্ডেটোর’ বলে কোনো কিছু নেই। তবে আমি এই শিরোনামটির অদ্ভুতুরে মেজাজটি অনুভব করে মনে মনে পুলকিত হয়েছি।

দেবোরা: আপনার কাছে ‘ডন জিওভান্নি’ অপেরা কি গুরুত্বপূর্ণ?

মুরাকামি: চরিত্র আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি সাধারণত মডেল ব্যবহার করি না। আমার কেরিয়ারে একবার মাত্র একটি চরিত্রের জন্য মডেল ব্যবহার করেছি। লোকটি খারাপ ছিল এবং তাকে আমি বেশি পছন্দ করতাম না। ওই লোকটি সম্পর্কে আমি লিখতে চেয়েছিলাম। তবে মাত্র একবার। আমার বইগুলির অন্য সমস্ত চরিত্র আমি শূন্য থেকে তৈরি করেছি। আমি কোনো চরিত্র তৈরি করার পরে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নড়াচড়া করতে থাকে এবং আমাকে তারপর তার চারপাশে ঘোরাফেরা করে তার সাথে কথা বলে যেতে হয়। একজন লেখক হিসেবে যখন আমি লিখি একইসঙ্গে আমার মনে হয় আমি কোনো আকর্ষণীয় বইও পড়ছি। এইভাবে আমি লেখাটি উপভোগ করি।

দেবোরা: আপনি উল্লেখ করেছেন যে, বইটির মূল চরিত্র অপেরার পাশাপাশি অন্যান্য সংগীতও শোনে। প্রায়শই আপনার চরিত্রগুলি দেখি কোনো নির্দিষ্ট ব্যান্ড ও জোনারের সঙ্গীত শুনে থাকে। এগুলি কি আপনাকে লিখতে সাহায্য করে?

মুরাকামি: আমি লেখার সময় গান শুনি। সুতরাং সংগীত খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার লেখায় আসে। কী ধরনের সংগীত এটা নিয়ে আমি বেশি ভাবি না, তবে সংগীত আমার কাছে একধরনের খাদ্য। সংগীত আমাকে লেখার শক্তি যোগায়। তাই আমি প্রায়শই সংগীত সম্পর্কে লিখি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি আমার পছন্দের সংগীত সম্পর্কেই লিখি। আমার স্বাস্থ্যের পক্ষেও এটা মঙ্গলজনক।

দেবোরা: সংগীত কি আপনাকে সুস্থ রাখে?

মুরাকামি: হ্যাঁ, খুব। সংগীত এবং বিড়াল। তারা আমকে প্রচুর সাহায্য করেছে।

দেবোরা: আপনার কাছে কতগুলি বিড়াল আছে?

মুরাকামি: একটাও না। আমি প্রতিদিন সকালে আমার বাড়ির চারপাশে ঘুরতে গেলে তিন-চারটি বিড়াল দেখতে পাই, এরা আমার বন্ধু। আমি তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি এবং তাদেরকে অভিবাদন জানাই। তারা আমার কাছে আসে। আমরা একে-অপরকে খুব ভালোভাবেই চিনি।

দেবোরা: যখন ‘নিউইয়র্কার’ ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’-এর একটি অংশ প্রকাশ করেছে, আমি তখন আপনাকে আপনার কাজের অবাস্তব উপাদানগুলি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, “আমি যখন উপন্যাস লিখি, বাস্তবতা আর অবাস্তবতা একসাথে মিশে যায়। এটা আমার পরিকল্পনা মাফিক নয় এবং লেখার সাথে সাথে আমি এটি অনুসরণ করি। তবে আমি যতই বাস্তবতাকে বাস্তবসম্মতভাবে লেখার চেষ্টা করি ততই অবাস্তব পৃথিবীর উদয় হয়। আমার কাছে উপন্যাস পার্টির মতো। যে-কেউ যোগ দিতে চাইলে দিতে পারেন। এবং যখনই তাঁরা চলে যেতে চাইবেন, যেতে পারেন”। সুতরাং আপনি কীভাবে এই পার্টিতে অতিথি এবং অন্যান্য বিষয়গুলোকে নিয়ে আসেন, অথবা আপনি যখন লিখছেন সেখানে কীভাবে এরা বাধাহীনভাবে আসতে পারে?

মুরাকামি: পাঠকেরা প্রায়শই আমাকে বলে থাকেন যে আমার কাজগুলিতে এমন একটা অবাস্তব জগৎ রয়েছে, যে-জগতে নায়ক অনায়াসেই যায় এবং আসল পৃথিবীতে ফিরেও আসে। তবে আমি সবসময় অবাস্তব বিশ্ব আর বাস্তববাদী বিশ্বের মধ্যে সীমারেখা দেখতে পাই না। সুতরাং, অনেক ক্ষেত্রে তারা মিশে গেছে। আমি মনে করি জাপানে এই অন্য বিশ্ব আমাদের বাস্তব জীবনের কাছাকাছি। এবং আমরা যদি সেই অন্য পৃথিবীতে যেতে চাই সেটা আমাদের পক্ষে অতটা কঠিন হয় না। আমার মনে হয় পশ্চিমা বিশ্বে এটা করা অত সহজ নয়, সেখানে অন্য বিশ্বে যেতে হলে আপনাকে কিছু পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবে জাপানে আপনি যেতে চাইলে সহজেই যেতে পারেন। সুতরাং, আমার গল্পগুলিতে, আপনি যদি কোনো কূপের নীচে যান, দেখতে পাবেন সেখানে একটা অন্য বিশ্ব আছে। এবং আপনি সেখানে দুই বিশ্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পাবেন না।

দেবোরা: অন্য দিকটা সাধারণত অন্ধকারের জায়গা, তাই তো?

মুরাকামি: না-ও হতে পারে। আমার মনে হয় এটা আগ্রহের ব্যাপার। আপনি যদি কোনো দরজার সন্ধান পান এবং সেটা যদি খুলতে সক্ষম হন তবে আপনি সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন। এটি কেবল আগ্রহ থেকেই হতে পারে। ভিতরে কী? সেখানে কী আছে? এই প্রশ্ন করা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। আমি যখন কোনো উপন্যাস লিখি তখন ভোর চারটের দিকে উঠে আমার ডেস্কে গিয়ে লেখা শুরু করি। বাস্তব বিশ্বে এটা ঘটে। আমি আসল কফি পান করি। কিন্তু একবার লেখা শুরু করলে আমি অন্য কোথাও চলে যাই। আমি দরজাটা খুলি, সেখানে যাই এবং সেখানে কী ঘটে দেখতে পাই। আমি জানি না বা জানতে চেষ্টা করি না, এটা বাস্তব না অবাস্তব। যতই আমি লেখার মধ্যে গভীরভাবে ডুবে যাই ততই সেখানে ওদ্ভুত কিছু দেখতে পাই। আমি স্বাভাবিকভাবেই তাদের দেখতে পাই বলে মনে হয়। সেখানে যদি কোনো অন্ধকারও থাকে তবে সেই অন্ধকারের কিছু বার্তা থাকে অবশ্যই। আমি সেই বার্তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। আমি সেই বিশ্বকে ঘুরে দেখি, তার বর্ণনা করি, শেষে আমি ফিরে আসি। এই ফিরে আসাটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ফিরে আসতে না পারেন তবে ভয়ের ব্যাপার। তবে যেহেতু আমি পেশাদার, আমি ফিরে আসতে পারি।

দেবোরা: এবং আপনি ওই জিনিসগুলি সঙ্গে নিয়ে আসেন?

মুরাকামি: না। এটা ভীতিজনক হবে। আমি যেখানেই সব ছেড়ে দেই। আমি যখন লিখি না, আমি খুব সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনের রুটিনটাকে আমি মেনে চলি। আমি খুব সকালে উঠি এবং বেসবল খেলা না থাকলে রাত ন-টার দিকে শুতে যাই। সঙ্গে থাকে আমার দৌড় এবং সাঁতার কাটা। আমি একজন সাধারণ মানুষ, সুতরাং রাস্তায় যখন আমি হেঁটে চলি তখন যদি কেউ বলে, “মিস্টার মুরাকামি, আপনার সাথে দেখা হয়ে খুব ভাল লাগল”, আমি বিব্রত বোধ করি। আমি এমন কিছু না। তাহলে কেন সে আমার সাথে দেখা হওয়ায় খুশি হল? তবে আমি যখন লেখার মধ্যে থাকি তখন অবশ্যই আমি একজন বিশেষ, অন্তত অদ্ভুত মানুষ।

দেবোরা: চল্লিশ বছর আগে, বেসবল খেলার মাঠে আপনি কীভাবে লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন, গল্পটি বহুবার বলেছিলেন। হঠাৎ আপনি ভেবেছিলেন, “আমি একটা উপন্যাস লিখতে পারি”। যদিও এর আগে আপনি লেখার চেষ্টাও করেননি। এবং আপনি আপনার স্মৃতি কথা, “হোয়াট আই টক আবউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং”-এ বলেন, “মনে হয়েছিল আকাশ থেকে কোনো কিছু নেমে এসেছিল এবং সেটা আমি হাতে পেয়েছি”। আমরা ধরে নিতে পারি ওই জিনিসটি ছিল আপনার লেখার ক্ষমতা। সেটা কোথা থেকে এসেছিল বলে আপনার মনে হয়? আর আপনি এত সাধারণ হলে কেন এটা আপনার কাছে এসেছিল?

মুরাকামি: সেটা একধরনের বোধোদয় ছিল বলে মনে হয়। আমি বেসবল পছন্দ করি এবং আমি প্রায়শই বলপার্কে যাই। ১৯৭৮ সালে ঊনত্রিশ বছর বয়সে আমি টোকিয়োর বেসবল পার্কে আমার প্রিয় দল ‘ইয়াকাল্ট স্যালোজ’ (Yakult Swallows)-এর খেলা দেখার জন্য গিয়েছিলাম। সেই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটায় ছিল খেলার উদ্বোধন। আমি খেলাটি দেখছিলাম এবং প্রথম খেলোয়াড় একটি ডাবল মারল এবং সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম যে, আমি লিখতে পারি। তখন প্রচুর বিয়ার পান করেছিলাম বলে কিনা জানি না। তবে তখন আমার মনে হয়েছিল যেন আমার মধ্যে একধরনের বোধের উদয় হয়েছে। এর আগে আমি কিছু লিখিনি। আমি একটি জ্যাজ ক্লাবের মালিক হিসেবে সান্ডুইচ আর ককটেল তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম। আমি খুব ভালো সান্ডুইচ তৈরি করি। তবে সেই খেলার পরে আমি একটা ষ্টেশনারি দোকানে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলাম এবং শুরু করলাম লেখা। তারপর আমি লেখক হয়ে যাই।

দেবোরা: সেটা চল্লিশ বছর আগে। সেই সময় লেখা আপনাকে কীভাবে বদলে দিল?

মুরাকামি: আমি অনেক বদলে গিয়েছিলাম। লেখা শুরু করার সময় আমি লিখতে জানতাম না। আমি খুব অদ্ভুত উপায়ে লিখেছিলাম। তবে পাঠক এটা পছন্দ করেছিল। এখন আমি আমার প্রথম বই ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’-এর জন্য তেমন একটা যত্ন নিই না। তখন আমি লেখা প্রকাশের উপযুক্ত ছিলাম না। বহুবছর আগে টোকিয়োর ট্রেনে বসে আমি একটি বই পড়ছিলাম এবং খুব সুন্দর একটি মেয়ে আমার কাছে এসে বলল, “আপনি মিস্টার মুরাকামি?” “হ্যাঁ, আমি মিস্টার মুরাকামি”। “আমি আপনার বইয়ের বড়ো ফ্যান”। “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ”। “আমি আপনার সমস্ত বই পড়েছি এবং আমি সেগুলো খুব ভালোবাসি”। আমি ধন্যবাদ জানাই। তারপর সে বলেছিল, “আমি আপনার প্রথম বইটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। ওটাই আমার কাছে সেরা”। “ওহ্‌, তুমি তাই মনে করো?” সে বলল, “আপনার লেখা এখন খারাপ হয়ে যাচ্ছে”। এইভাবে আমি সমালোচনায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তবে আমার লেখা আগের থেকে খারাপ হয়ে যাচ্ছে তা মনে করি না। আমি মনে করি সময়ের সাথে সাথে আরও ভালো হচ্ছে আমার লেখা। চল্লিশ বছর ধরে আমি আরও ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছি এবং আমার বিশ্বাস যে, আমি সফল। ট্রেনের সেই মেয়েটি আমাকে জিন কুইল নামে এক জ্যাজ সংগীতকারের কথা মনে করায়। তিনি স্যাক্সোফোন বাজাতেন। উনিশ-শ পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে বিখ্যাত ছিলেন। সেই সময় যে-কোনো স্যাক্সোফোন বাদকের মতো তিনিও চার্লি পার্কার দ্বারা খুব প্রভাবিত ছিলেন। একরাতে তিনি নিউ ইয়র্কের একটি জ্যাজ ক্লাবে বাজাচ্ছিলেন এবং যখন তিনি ব্যান্ডস্ট্যান্ড থেকে নামলেন তখন এক যুবক এসে বলল, “আরে, আপনি তো চার্লি পার্কারের মতো বাজাচ্ছেন!” জিন বললেন, “কী?” “আপনি চার্লি পার্কারের মতো বাজাচ্ছেন!” জিন তখন তাঁর অলটো সাক্সোফোন যন্ত্রটি তার কাছে তুলে বললেন, “এই যে, আপনি চার্লি পার্কারের মতো বাজিয়ে দেখান!” আমি মনে করি, এই গল্পটির তিনটি বিষয় আছে— এক, কারো সমালোচনা করা সহজ। দুই, মৌলিক কিছু তৈরি করা খুব কঠিন। তিন, কিন্তু কারো এটি করা দরকার। আমি চল্লিশ বছর ধরে করে আসছি। এটা আমার কাজ। আমি মনে করি, আমি এমন একজন লোক যে অন্যদের মতো কিছু কাজ করে চলেছে, যেমন নোংরা পরিষ্কার করা বা কর সংগ্রহ করা। সুতরাং, কেউ যদি আমার প্রতি কঠোর হয় তবে আমি আমার যন্ত্রটি তাকে ধরিয়ে বলব, “এই যে, আপনি এটা বাজিয়ে দেখান!”

দ্বিতীয় পাতা

Categories
সাক্ষাৎকার

প্রজিত জানার সাক্ষাৎকার

সাদা পাতা, কবিতা ও সময়-চিহ্নেরা

কবি প্রজিত জানার মুখোমুখি হলেন অর্পণ বসু

কবিতার কাছে আবার ফিরে আসার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল?

আটের দশকের মাঝামাঝি সময় পার করে একটু একটু করে হয়তো আবার কবিতার কাছে আমি ফিরে আসতে শুরু করলাম। তা অবশ্য করলাম যথেষ্ট দ্বিধা ও আড়ষ্টতা নিয়েই… এবং নিঃসন্দেহে এটা লক্ষ করলাম যে, ইতিমধ্যে বাংলা কবিতাও আমায় ছেড়ে এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা পথ।

বেশ কিছুটা, তবে অনেকটা বলে আমার মনে হয়নি। এক সময় সেই আড়ষ্টতা কিছুটা কাটতে শুরু করল, আমি ক্রমে অনুভব করলাম দূরত্ব যা তৈরি হয়েছে আমার কাছে তা আর অনতিক্রম্য নয়, দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও আমার পূর্বপ্রস্তুতি ও স্বাভাবিক প্রবণতা সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে আমাকে সাহায্যই করেছিল।

Categories
সাক্ষাৎকার

প্রজিত জানার সাক্ষাৎকার

সাদা পাতা, কবিতা ও সময়-চিহ্নেরা

কবি প্রজিত জানার মুখোমুখি হলেন অর্পণ বসু

Categories
সাক্ষাৎকার

প্রজিত জানার সাক্ষাৎকার

সাদা পাতা, কবিতা ও সময়-চিহ্নেরা

কবি প্রজিত জানার মুখোমুখি হলেন অর্পণ বসু

মোটামুটি আটের দশক থেকেই আপনার লেখালেখির পরিচিতি। আচ্ছা, এই যে বললাম ‘আটের দশক’, এরকম কবিতার দশক ভাগ কি সঙ্গত বলে আপনার মনে হয়?

এটা প্রধানত ব্যবহারিক এবং সম্পূর্ণ হাস্যকর একটা বিভাজন। জীবনানন্দকে তুমি কোন দশকের কবি বলবে? তিরিশের দশকের নিশ্চয়ই। কেননা তিনি তিরিশের দশকে কবিতা লিখতে এসেছেন। কিন্তু তাঁর প্রধান প্রায় সব কবিতাই তো চল্লিশের দশকের। ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘বেলা-অবেলা কালবেলা’-এর প্রায় সব কবিতাই তো চল্লিশের দশকের। তুলনায় তাঁর তিরিশের দশকের অধিকাংশ কবিতা অনেক কম উল্লেখযোগ্য ও দুর্বল… যে জীবনানন্দ দাশের কথা আমরা বলি, যে কারণে বলি, তাঁর ওই সময়ের (তিরিশের দশকের) কবিতা তাঁর প্রতিনিধিত্ব প্রায় করে না বললেই চলে।

একই কথা রিলকে বা পাউন্ডের ক্ষেত্রেও অনেকটাই প্রযোজ্য। তাঁদের সমস্ত প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান কবিতা ৩৫-৪০ বছরের পরে লেখা। রিলকে যদি আঠাশ বা তিরিশ বছর বয়সে মারা যেতেন, আদৌ তাঁকে কেউ মনেই রাখত না। একই কথা সুধীন দত্ত বা সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। অধিকাংশ কবিকেই তাঁর নিজস্ব কবিতার ভাষা বা টেমপ্লেট খুঁজে পেতে এক বা দু-দশক অপেক্ষা করতে হয়। একজন র‍্যাঁবো বা একজন জন কীটস্ ব্যতিক্রম, এমন দু-চারজন ক্ষণজন্মা বড়ো প্রতিভার তুলনায় অপেক্ষাকৃত দীর্ঘজীবী বড়ো প্রতিভার সংখ্যা অনেক বেশি। প্রথম বা দ্বিতীয় গ্রন্থ থেকে আলোড়ন তুলে দেওয়া কবিদের তুলনায়, সাধারণত তৃতীয় ও চতুর্থ বা পঞ্চম গ্রন্থেই উত্তীর্ণ হওয়া প্রধান কবিদের সংখ্যা সারা পৃথিবীতেই একটু বেশি, অর্থাৎ ওই এক-দু’দশকের প্রতীক্ষা এঁদের অধিকাংশকেই করতে হয়েছে নিজস্ব ভাষা বা ‘সিগনেচার’ খুঁজে পেতে! যে কারণে এলিয়ট বা পাউন্ড উনবিংশ শতাব্দীর কোন দশকের কবি, এহেন প্রশ্ন কেউ কখনও করে না, এমনকী তাঁরা তেমন বিখ্যাত হওয়ার আগেও কোনো দীক্ষিত পাঠক বা সমালোচক এ ধরনের প্রশ্ন করেননি।

২০১১ সালে আপনার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রলাপ-সরণি’ বীরেন্দ্র পুরস্কার পায় এই পুরস্কার পেয়ে আপনার কীরকম লেগেছিল? আপনাকে কি পরবর্তী সময়ে তা লিখতে আরও অনুপ্রাণিত করেছিল?

যে পুরস্কারের সঙ্গে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় শক্তিমান কবি ও খাঁটি মানুষের নাম জড়িত, সে পুরস্কার পেতে তো ভালোই লাগার কথা। আমার কাছেও সেটাই প্রধান কারণ ভালো লাগার। তবে আমি নিজেকে যতটুকু জানি, কোনো পুরস্কার আলাদা করে লেখালেখির ব্যাপারে আমাকে কোনো অতিরিক্ত অনুপ্রেরণা দেবে বা দিয়েছিল, এমন আমার মনে হয়নি। বীরেন্দ্র পুরস্কারের ক্ষেত্রেও সে কথা প্রযোজ্য। আমার কাছে কবিতা-যাপন বা লেখালেখি সম্পূর্ণ ভিতরের ব্যাপার। বাইরের কোনও ঘটনা, সেটা পুরস্কারই হোক বা অন্য কিছু… আমাকে খুব প্রবলভাবে আলোড়িত করে না। তবে উৎসাহিত হয়তো কিছুটা করে, সবচেয়ে বেশি যেটা উৎসাহিত করে তা হল পরিণত বা দীক্ষিত পাঠকের ভালো লাগা, পাঠ-মুগ্ধতা বা মনোযোগ। প্রকৃত পাঠকের মনোযোগ আমার কাছে সবসময়ই একটা বড়ো প্রাপ্তি।

কবিতার দীক্ষিত বা প্রকৃত পাঠক কারা?

এটা একটু জটিল একটা বিষয়। যে কোনও কবিতা-‘পড়ুয়াই’ নিঃসন্দেহে কবিতা-‘পাঠক’ নন। কবিতা লেখক মাত্রই কবি নন, কবিতা পাঠক ও কবিতা-পড়ুয়ার মধ্যেও তেমন তফাত আছে। কবিও যেমন কেউ কেউ– সবাই নন; কবিতার পাঠকও তেমন কেউ কেউ– সবাই নন।

আপনি কি দীক্ষিত বা পরিণত পাঠকের জন্যেই কবিতা লেখেন?

আমার মনে হয়, আমি প্রধানত নিজের জন্য, বা নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্যই কবিতা লিখি। দীক্ষিত বা অদীক্ষিত কোনও পাঠকের কথা ভেবে নয়। লেখার টেবিলে আমি একেবারেই একা, নিঃসঙ্গ। সেখানে কোনো পাঠকের চেহারা চোখের সামনে ভাসার কথা নয়। তবে একটি কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পর, লেখকের বোধহয় আর বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই। এরপর তো পুরোটাই পাঠকের আওতায় চলে গেল। আর একজন দীক্ষিত পাঠকের পাঠ তো একটা কবিতাকে নতুন করে রচনা করে, নির্মাণ করে, পুনর্গঠিত করে। অতএব দীক্ষিত পাঠক নিছক কবিতাটিকে ‘পড়েন’ না, তিনি তাঁর পাঠের মধ্য দিয়েই লেখাটিকে নতুন করে ‘লেখেনও’। একজন কবি যদি সত্যিই সেরকম পাঠক পান, তাহলে সেটা তাঁর সৌভাগ্য বলতে হবে।

আপনার কবিতার পাঠক তো এই দীক্ষিত পাঠকরাই?

এখানে একটা কথা বলা দরকার। আমার কবিতা পছন্দ হলেই তিনি দীক্ষিত পাঠক, আর না হলেই তিনি অদীক্ষিত বা অপরিণত, এমন কোনও নির্বোধ ধারণা আমি পোষণ করি না। এ কথা বললাম এই কারণেই যে, এমন অর্বাচীনতা আমি কারো কারো মধ্যে দেখেছি। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো কবি হিসাবেও সুপ্রতিষ্ঠিত।

সত্যি কথা বলতে কি পরিণত পাঠকদের মনোযোগ যেমন আমি পেয়েছি, তেমনি কখনও কখনও ততটা পরিণত নয়, এমন সাধারণ দীক্ষিত পাঠকের মনোযোগও আমার কোনো কোনো কবিতা হয়তো কখনও কখনও পেয়েছে। আবার অন্যদিকে দীক্ষিত পাঠকেরও কেউ কেউ হয়তো কোনও সময় আমার কোনো কবিতা পছন্দ করেননি। এটাই তো হওয়া স্বাভাবিক। অর্থাৎ, একজন পাঠক পরিণত বা অপরিণত, তা নির্ধারিত হওয়া উচিত তাঁর সামগ্রিক কবিতা-বোধ, রসবোধ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে, ব্যক্তিগতভাবে কোনো বিশেষ কবিতার প্রতি তাঁর মুগ্ধতা বা উদাসীনতার নিরিখে নয়।

তবে হ্যাঁ, দীক্ষিত বা শিক্ষিত পাঠকের অনেকের মনোযোগ বা মুগ্ধতা আমি কখনও কখনও পেয়েছি, সেটা আনন্দের ও সৌভাগ্যের, কখনও কখনও এই সীমিত পরিমণ্ডলের বাইরের বৃহত্তর পাঠকেরও একাংশের মনোযোগ পেয়েছি… সেটাও কম আনন্দের নয়।

আপনার কি মনে হয় না বাংলা কবিতায় এই দীক্ষিত পাঠকের সংখ্যা একেবারেই সীমিত?

শুধু বাংলা কবিতা কেন, সারা পৃথিবীর কবিতাতেই দীক্ষিত পাঠকের সংখ্যা সীমিত। এবং ঐতিহাসিকভাবেই এটা শুধু এখন বলে নয়, চিরকালই। কবিতা তো চরিত্রগতভাবে পারফর্মিং আর্ট নয়। আর কবিরাও সিনেমার নায়ক বা এমনকি পার্শ্বচরিত্রের মতো কোনও পাদপ্রদীপের সামনে থাকা আলোকবর্তিকা নন।

কবিতা যবে থেকে সুর (গানের) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে তবে থেকেই তা মূলত পাঠকের, ততটা আর শ্রোতার নয়। সুরের ওপর ভর করে এক বিপুল সংখ্যক শ্রোতা-দর্শকের কাছে পৌঁছনো তো আধুনিক কবিতার কাজ নয়, উদ্দেশ্যও নয়। যে কারণে গানের লিরিক আর কবিতাও এক নয়। অবশ্যই গানের লিরিকও কখনও কখনও স্বতন্ত্রভাবেই, অর্থাৎ সুর নিরপেক্ষভাবে কবিতা হয়ে উঠতে পারে (রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের লিরিকের ক্ষেত্রে সে কথা প্রযোজ্য), কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই। পৃথিবীর বহু শ্রেষ্ঠ গানের লিরিকই স্বতন্ত্রভাবে কবিতা হয়ে উঠতে পারে না, এবং সেটা হয়ে ওঠাটা তার লক্ষ্যের মধ্যেও পড়ে না। তা যেটা বলছিলাম, কবিতা মৌলিক চরিত্রের দিক থেকে পারফর্মিং আর্ট নয়, তা যত না শোনার এবং মঞ্চে উঠে পরিবেশন করার, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাক্তিগতভাবে পড়ার এবং অনুভব করার। নিঃসন্দেহে গদ্য বা গল্প-উপন্যাসের তুলনায় কবিতার পাঠক সংখ্যা ঐতিহাসিকভাবে সব ভাষাতেই সীমিত। এবং এই স্বল্প-সংখ্যক কবিতা পাঠকের মধ্যেও আরও একটা ছোটো অংশকেই দীক্ষিত পাঠক বলা যেতে পারে। এই দীক্ষিত পাঠকেরা নিজেরা কবিতা লিখুন বা না লিখুন, তাঁদের ভাবনা-চিন্তা ও অনুভূতির জগৎটা অনেকটাই একজন কবির মতো বলেই আমার বিশ্বাস।

একটা সময় দেশ, পরিচয়, কৃত্তিবাস প্রভৃতি বহু প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত নানান পত্রিকায় আপনার কবিতা নিয়মিত দেখা যেত। অনেক বছর ধরে তা প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। এর কারণ কী?

কারণ কিছুই নয়। একটা সময় বর্ষীয়ান কবি ও লেখকদের অনেকে এইসব পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এছাড়াও যাঁরা ছিলেন, তাঁরা নামজাদা কবি বা লেখক না হলেও, লেখালেখির প্রতি মুগ্ধতাবোধ তখনও তাঁদের অনেকের মধ্যে যথেষ্টই অবশিষ্ট ছিল। তাঁরা যখন লেখা চাইতেন, তার মধ্যে এমন এক ধরনের আন্তরিকতা বা উদারতার আকর্ষণ থাকত, যে স্বভাব-আলস্য সত্ত্বেও তা অগ্রাহ্য করা আমার পক্ষে বেশ মুশকিল ছিল। ক্ষুদ্রতা কোথাও একেবারে যে ছিল না তা নয়, তবে তা হাতে গোনা যেত। পরবর্তীকালে সবকিছুই অনেকটা বদলে গেল।

বিনা আমন্ত্রণে লেখা পাঠানোর কোনও প্রশ্ন তো ছিলই না। কিন্তু পরবর্তীকালে আহ্বান বা আমন্ত্রণ সত্ত্বেও কোথাও কোথাও লেখা পাঠানোর তাগিদ আমি আর অনুভব করিনি। হয়তো বহু আগে কখনো লিখেছি, কিন্তু পরবর্তীকালে সেই একই পত্রিকায় আর লেখা পাঠানোর ইচ্ছা হয়নি।

এরমধ্যে কোথাও কোথাও অবশ্য, শুধু আলস্য বা তাগিদের অভাব থেকে নয়, সচেতনভাবেই আমি লেখা দিইনি। কারণ, এইসব ‘সম্পাদক’ বা পত্রিকা চালকদের অনেককেই আমার লেখালেখির কোনো লোক বলেই মনে হয়নি। একজন লেখককে তাঁর যোগ্য সম্মান দেওয়ার জন্য যে শিক্ষা বা উদারতা থাকা দরকার, তা এদের মধ্যে আমি দেখতে পাইনি। এতে অবশ্যই তাঁদেরও কিছু যায় আসেনি, এবং আমারও নয়। সৌভাগ্যক্রমে এইসব অনভিপ্রেত আমন্ত্রণের অত্যাচার থেকে আমি এখন অনেকটাই মুক্ত।

প্রথম পাতা

পরিচিতি:

কবি প্রজিত জানার জন্ম ২৯ জুন, ১৯৫৯, কলকাতায়। দুটি গদ্য-আকর সহ তাঁর এযাবৎ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১১ টি। ২০১১ সালে ‘প্রলাপ সরণি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ‘বীরেন্দ্র পুরস্কার’। এছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে নানান বাংলা-ইংরেজী সংবাদপত্র ও পত্রিকায় লিখেছেন কবিতা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক গদ্য।

Categories
সাক্ষাৎকার

প্রজিত জানার সাক্ষাৎকার

সাদা পাতা, কবিতা ও সময়-চিহ্নেরা

কবি প্রজিত জানার মুখোমুখি হলেন অর্পণ বসু

ঠিক কোন সময় আপনার প্রথম কবিতা লেখালেখির শুরু? শুরুর দিনগুলোতে কাদের কবিতা আপনাকে প্রভাবিত করেছিল?

কবিতা লেখার বদভ্যাস আমার মধ্যে দানা বেঁধেছিল বেশ বাল্যকাল থেকেই। প্রথম লেখা স্কুলের (পাঠভবন, কলকাতা) দেওয়াল পত্রিকায়। ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। অতিরিক্ত স্নেহপ্রবণ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশ্রয় ও প্রশংসা আমার বালকোচিত উৎসাহকে একটু বেশি মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে স্কুলের দেওয়াল ও ছাপা পত্রিকায় নিয়মিত লিখতাম। সাহিত্যসভায় কবিতা পড়তাম। সাহিত্য-প্রতিযোগিতায় কবিতা লিখে পুরস্কার-টুরস্কার পেতাম। ওই বয়সে ভালোই লাগত। ক্লাস টেন অবধি সম্ভবত এই পর্ব চলল। বছর পাঁচেক লেখালেখির, কবিতার… একটা প্রবল ঘোরের মধ্যে কেটে গিয়েছিল। তারপরে অবশ্য শুরু হয় এক দীর্ঘ বিচ্ছেদ-পর্ব। সে কাহিনি অন্য। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫-৮৬ অবধি আমি সম্ভবত একটি নতুন লাইনও লিখিনি। যে দু’চারটে লিখেছি— সেগুলো কিছুই হয়নি।