Categories
কবিতা

শাশ্বতী সরকারের কবিতা

প্রবাস


ওই দেখো পড়ে আছে উল্কাখণ্ড, মৃত
অভিকর্ষ হারানোর কিছু নেই তার
ফিরে গেলে মনে হয়
সমস্তই জলপ্রিয়, সবই আজ শোকাকুল
পৃথিবীর মাটি থেকে এইহেতু কিছুটা উপরে ওঠা তার

বৃষ্টি আজ তোমার যাওয়াকে ঘিরে মহৎ হয়েছে


মেঘ শুধু দেবে অবিদ্যার পাঠ, ভুলশেখা
পাঠশালা হতে প্রত্যাগত নীচু মাথা বালকের দল
রোদ্দুরে তোমার মুখ পালংশাকের মতো
তরতাজা, এই দেখে তারা বিরহ শিখেছে

কতকাল কেটে গেল বিরহ অধীন
কেবল জলের দিকে চেয়ে থাকি
কিছু পুণ্যফল— তোমাকে চাওয়ার
ওই দূরে ফড়িংয়ের দেহ থেকে
বিচ্ছুরিত আলো, সে-ও জানে

মহর্ষির ঘর, সরযু নদীর তীর, কালো

Categories
কবিতা

শুভম চক্রবর্তীর কবিতা

অস্তিত্বের কথা

দেওয়ালে, উৎকর্ণ কেউ অপেক্ষায় রত। ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, আর সমূহ বুড়বুড়ি কাটার শব্দ তার শোনা চাই৷ শুনে তিনি জাবর কাটবেন। আঁশে, বিদ্যুতে চলকে চলকে যাবে গণ্ডদেশ। স্থলনহীন অথচ মধুর জাবর কাটার শ্রান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসবে। গোয়ালে বাঁধা এঁড়ে যেন। ক্লান্ত, গাভিন হবে না । হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসস্তূপের ওপর চরে বেড়ানো ভাইবেরাদর সকল। নিউট্রনই মূলত তোমাদের শক্তি। এবং তা থেকেই তো হ্যাঁ আর না-এর প্রোটন, ইলেকট্রন হ’ল হে। অস্বীকার খুব গুরুত্বপূর্ণ যদিও। কিন্তু আমার দেহপটাশ্রিত অস্তিত্ব বুড়বুড়ি কাটছিল, ক্ষণকাল, আর শ্রান্তিতে নিভে আসা আমি শ্রাবণীপূর্ণিমার দোদুল চিদাকাশের দেওয়ালে কান পেতে শুনছিলাম সে বুড়বুড়ির শব্দ। নিভু, অস্তিত্ব ভাবনায় ভীত নিতান্ত বুড়বুড়ি। বৃত্তাকার ডিম্বানু প্লাসেন্টার অন্ধকার রক্তমাখানো স্বস্থানে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। আমার জন্মমুহূর্ত মনে পড়ছে। মুখে চুল গুঁজে শুয়ে থাকা ভদ্রমহিলার হাত-পা ছোঁড়ার দৃশ্য মনে পড়ছে। হাসপাতালের বেডে রক্ত চলকে ওঠা মনে পড়ছে সেদিনের মতো। চাদরে ছোপছোপ রক্ত, আকাশে ছোপছোপ তারাই যেন। দেওয়ালে কান পেতে আছি, বুড়বুড়ির শব্দ আসছে। আমি আমার থেকে আলাদা। আমি আমার থেকে আলাদা নই। আমি আমার থেকে আলাদা।

অযোধ্যার দিকে তাকিয়ে

নিহত শম্বুক পাথরের চাতালে থেঁতলে পড়ে আছে । ইক্ষ্বাকু বংশের সূর্য আপনার, আপনাদের দাবদাহ ছেলেটার সহ্য হ’ল না। পাথরের গায়ে কালো ক্লট ক্লট রক্ত। হাঁদা শম্বুক বোকা শম্বুক তার আরাধনাকে প্রত্যয়িত করতে চেয়েছিল আপনাদের কাছে। সমগ্র আর্যাবর্তের হল্লারব সে তো শোনেনি। সে তো জানে না চিরসময়ের ভেতর কিছুক্ষণ পিছিয়ে শোননদের ধারে ছলছল করছিল আপনার মুখ। যেন প্রতিবিম্ব, যেন তার ভেতর আশফাক বিম্বিত, যেন তার ভেতর ছুঁয়ে ফেলার সুমহৎ পাপে থেঁতলে থেঁতলে মারা হচ্ছে দলিত যুবকদের আর তাদের রক্ত কী শীতল! কী নরম! কী সান্দ্র ! সূর্যাস্তের মতো। সিদ্ধাশ্রম কত দূর প্রভু? আপনাকে সোনা জহরতের চৌদোলায় চড়িয়ে চামর দোলাতে দোলাতে নিয়ে যাবে পেটমোটা ব্রাহ্মণেরা। আর কোনো বনবাস নেই, সীতা নেই, রাবণের চিতা কেউ পেচ্ছাপ ক’রে ঠিক নিভিয়ে দেবে। সূর্যাস্তের দৃশ্যে আমরা দশরথকে আনব, ওঁর মুখে মাঝে মাঝে নিহত দলিতের বাপমায়ের মিশকালো ছায়া ঘনিয়ে তুলব। বেশ হবে। প্লট জমে ক্ষীর। রক্ত থইথই ভারতবর্ষের বুকে কাড়ানাগড়া বাজাতে বাজাতে, আপনার জয়ধ্বনি দিতে দিতে, কাঁদতে কাঁদতে, কাঁদাতে কাঁদাতে এক কলঙ্কিত ধূসরতার দিকে যাব আমরা, রক্ত সাঁতরে সাঁতরে।

Categories
চিত্রকলা

তন্ময় মুখার্জীর চিত্রকলা

নাম : Untitled
মিডিয়াম : Muliti Media
সময় : 2020

১০

Categories
কবিতা

সঞ্চিতা দাসের কবিতা

অঙ্ক

মশারির অনেক ফাঁক থেকে আমি সাদা আকাশকে দেখছি, আকাশ আমাকে উপহার দিয়েছে একখণ্ড মেঘ। মেঘ বলল— তুমি নিজেকে ভাঙো। খানিকটা ভাঙা শুরুতেই আয়নাতে দেখলাম একটা জলকাদার জীবন পড়ে আছে, ওর ভেতর আমি কবে থেকে ডুবে আছি জানি না…! এবং তার মধ্যে ঘিরে আছে কয়েকটি গ্রাম, ছোটো ছোটো টিনের চালার ঘর, দূরে তালগাছ, বাঁশবনের সারি, খোলা মাঠ, সরু পথের দু-পাশে ঘাস হাঁটলে পরে পা ছুঁয়ে মাথা নত করে রাখে, জীবজন্তুর বিষ্ঠা, পশুপাখির কোলাহল, আরও কত কী… গ্রাম আমাকে প্রদীপের নীচের অন্ধকার আর আলোর শতকরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। শহর কংক্রিটের শৌখিন আলো সারারাত জ্বালিয়ে রেখে অঙ্কের লাভ ক্ষতি শেখায়, বোঝাতে চায়। দু-জনেই ডাকছে। ওরা ব্যাকুল হয়ে ডাকছে।

তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে

অনেক দিন ধরেই ভিতরে ভিতরে একটা কামড় চিনচিন করে, ধরা পড়েছে গভীর সমুদ্রে ক্ষয় চলছে, ভারী হয়ে উঠছে বাতাস। অনেক নিঃশ্বাস ফেলার ধাপ থেকে নেমে আসে ভাঙা গল্প, যারা মাটির পাত্রের মতো অবহেলায় পথের দু-পাশে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছে। ওদের চোখের জলের ওপর সত্যের নতদৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে আর চকচক করে জ্বলে উঠল সেই আলো।

অনন্তকাল ধরে অভিশাপের গহ্বরে হাত ডুবিয়ে ভালোবাসা ভেবে একরাশ তেষ্টা নিবারণ করতে করতে এই অবধি আসা… শাবল, কোদাল দিয়ে খুঁড়েও প্রয়োজনের জলোচ্ছ্বাস আসে না!

আসে শুধু একটা ভাঙনের পদধ্বনি… থপ্ থপ্ থপ্।

Categories
কবিতা

সুদীপ্ত মাজির কবিতা

অসমাপ্ত গানের খাতা : ১৮

গানে গানে বজ্রপাত—
এরকমও হয়?

যখন বিকেল ভেঙে সন্ধ্যা হয়!
খুব সন্ধ্যা হয়!

নিজের বাইরে যেতে ভয় করে, ভয় করে খুব!

বাইরে বিদ্যুৎগর্ভ মেঘ নামে
অসি হাতে
সন্ধ্যার সময়!

অসমাপ্ত গানের খাতা : ২০

সুর যাকে স্পর্শ করে গোধূলিতে
জেনো তার ব্রহ্মলাভ হয়

সমুদ্রস্নানে যাওয়া পুত্তলিকা
সন্ধ্যার সময়
বাড়িতে ফেরে না আর
কোজাগরী আলো হয়ে জ্বলে

কার্তিকের মাঠে ঘাটে জেগে থাকা
মানুষের
নির্জন ফসলে…

অসমাপ্ত গানের খাতা : ৩৫

অসীমের থেকে দূরে বসে আছে সীমা।

সুর সে আয়ুধ, যার লম্বচ্ছেদের দ্বারা
দু-জনের সম্পর্ক পরিমাপ করে
সীমা অসীমের যত ঝগড়াঝাটি পরিমাপ চলে।

এই চিররহস্যের ঠিক মাঝখানে একদিন
অনন্তও আবির্ভূত হলে
আরও দ্রবীভূত হয় গান— আর তন্দ্রার ভুবন
ঘেরাবারান্দার মধ্যে আরও কিছু স্বপ্নের আয়ুধ
সংগ্রহ করে যাতে আয়ুষ্কাল কিছু দূরব্যাপী
নতুন পেখম মেলে সঞ্চারী ও আভোগের
                          ডালে বসতে পারে !

Categories
কবিতা

ইন্দ্রনীল ঘোষের কবিতা

বাদল দিনে…

কী সমস্ত মেঘে
কী সমস্ত হরফ বাদলায়…

ইহ দিন কেটে কেটে সুগন্ধি রক্ত জমানো—
রক্ত ইলিশ করে
              আঁশ নড়ে
              কানকো নড়ে
হাল্লা হাকিম পীরে মোহনা ফেটে যায়…

তারপর, বেতার-তরঙ্গটুকু আঁকা
         ছোট্ট বিড়ালটিও আঁকা
দৃশ্য থেকে ক্লান্ত ফিরছে রং…
দু-এক পশলা তেল ফুটছে তখনো
সামান্য নুন লাগছে—
ছেতড়ে থাকা অপরাহ্ণ ডিমে

ভিলেইন

জলে ডুব দিতেই
জল, কুরে কুরে খেয়ে নিল আমার শরীর
হাড়গোড় টুকে লেখা হল
সূর্যাস্তের যৌন অপার

শেষ যেদিন ভিলেইনকে দেখি
মাছ কিনছিলাম বাজারে—
অনেক দূরে স্থির হয়ে আছে শত্রুতা…
পলিপ্যাক নিশপিশ করছে তার চোখে

Categories
কবিতা

অগ্নি রায়ের কবিতা

শ্বাপদকথা


এক মহাকাশ জুড়ে
তোমার মতন কোনো স্পন্দন দেখি।
ভাবি সে আমার ফেলে আসা বাতিল
কোনো রোমন্থন।
তাস পালটে দেখি
সেখানেও রংয়ের গোলাম!
বারান্দার ওপারে হাত নাড়ে উদ্ভট শ্বাপদ।
তবুও,
তোমার মতন কোনো শ্বাপদ দেখি না


তোমাকে পাব বলে
যে যে মাটির কাছে ধর্না দিয়েছি
তার কোনো জরিপ ছিল না।
সব শেষে ফিরে আসি লাল দাগ পেরিয়ে,
ভূমিক্ষয়ের স্মৃতি নিয়ে।
তোমা-বিনা নাশ নাই জেনে
শরীর পাত করে ডেকে ওঠে
রাতের শৃগাল।
হাঁ-মুখ তবু দূরেই থেকে যায়
গিলতে চায় না

Categories
কবিতা

কমলকুমার দত্তের কবিতা

বয়েস সাজিয়ে দিচ্ছে—
কত তার জোগাড়যন্তর
হাড় ঠুনকো করার, পেশি আলগা করার
চামড়া কোঁচকানোর যন্ত্রটা চিনতে পারলাম
ছোটোবেলায় দেখেছি— লন্ড্রিতে ওটা দিয়ে
পাঞ্জাবির হাতা গিলে করত প্রভাতজেঠু
এদিকে রঙের বাটিতে রং মোটে দুটো
সাদা ও ধূসর
বলি— লাল, গোলাপি, বাসন্তী, সবুজ, নীল
এসব লাগে না?
উত্তর দেয় না, একমনে সাজাতে থাকে
সাদা ও ধূসর— তার এই যথাসর্বস্ব দিয়ে
আমি তার নির্দেশমতো হাত মেলে ধরি
পা ছাড়িয়ে দিই
চোখ বন্ধ করি— আর
সি-গ্রিন, স্কাই-ব্লু, ফ্লেমিংগো পিঙ্ক, সিলভার গ্রে, ওয়াইন রেড
ঝাঁপিয়ে পড়ে
কানে কানে বলে— চোখ খুলো না, চোখ বন্ধ করে রাখো।

পথের গন্তব্য যেন বেয়াড়া সন্তান
আজ মুখে মুখে তর্ক করবে
আজ তাকে কিছু দিয়ে ভোলানো যাবে না
পথের নগন্য ফুল— সেও আজ মজা মারবে, বুঝে
আমি গলিপথ ধরি
গলির বাঁ-ধারে মন্টুর চায়ের দোকান
দু-দণ্ড সেখানে বসি, দেখি
দূর থেকে পথের গন্তব্য আসছে, খুঁজছে আমাকে
উঠে পড়ি
আর তো সময় নেই, নিজেকেই বলি
পথ শেষ হল আজ এবারের মতো
এই অনাথ বিকেলে খুঁজে নিতে হবে কানাগলি!

Categories
কবিতা

তথাগত’র কবিতা

বেহাগ, নিখিল ব্যানার্জী

এমন মন্দ্র বেহাগ, সখা, কখনো শুনিনি।
মেঘে মেঘে ঐ বিদ্যুৎ বাজে। সুরের মূর্ছনা এই নবীন আষাঢ়কে
দ্যাখো, ভরা শ্রাবণ করেছে। এ কি সত্য? এ কি ভ্রম?
এ কি তোমার বাড়ির হারিয়ে যাওয়া পথ?

চারদিন হলো আজ বর্ষাকাল, চারদিন হলো নিখিল বেহাগময়, ঘুমের ওষুধ খাইনি।

পূর্বরাগ

তোমাকে দেখার মতো সুখ ত্রিভুবনে নেই।
যে চুল হাওয়ায় ওড়ে তাকে শ্রাবনমেঘে উপমিত করা—
আমি অপারগ কবি। আমার অক্ষমতা তুমি জানো।
ওই ক্ষমাসুন্দর বুক, আমি দূর থেকে দেখি। যেন সুজাতার
হাতে ধরা পায়সের বাটি। আমি ক্লান্ত, শীর্ণ, অচল বুদ্ধ।
তুমি মাথে শাখা হও, শাখাবট, তাতে পাখি হয়ে বোসো।

পাখি তুমি। তোমার সতীন হোক গোলা পায়রা, ঈর্ষায়
ধূসরবর্ণ। তুমি শ্যামা, তন্বী, শিখরদশনা। ও পাড়ার
বাগদিদের মেয়ে। আমি ইস্কুল মাস্টার, কাব্য করি, পাখি
দেখি, কলঘরে একা চান করি। দেওয়ালে জলের ধারায়
তোমার নাম লিখেছি শ্যামা, দু-বেলা হাত পুড়িয়ে রাঁধি।

বর্ষা ও শরৎ

এসো হাত ধরো। যে হাত আষাঢ়ের মেঘ, শ্যামা, তাকে তুমি
দূরে কেন রাখো? জীবনসায়াহ্নে যদি ঝড় ওঠে, বৃষ্টি পড়ে,
চিতা নিভে যায়। মৃত উঠে বসে। এসো, এই মৃতের হাত হাতে তুলে নাও।

আকাশে ডমরু বাজে, তোমার সিঁথিতে রাঙা মেঘ।

বিপ্রলম্ভ

এই অঙ্গহীনতা তুমি। হাজার বছর ধরে আমার চোখের জল
পাথরে পাথরে ঝরে রুদ্রাক্ষ হলো— তুমি তার বকপাতি মালা;
আকাশের অনঙ্গ গলায় দুলেছ। তুমি বাতাস পুষ্পময়, নবমালিকায়
জলের ভৃঙ্গ তুমি, রতিকালে জয়দেব শ্লোক।

ভাগবত পাঠ করি, এক প্রহরে তিনশ এক টাকা।
বাসকসজ্জিকা ওগো, শ্রীরাধার অঙ্গরাগে আমি কার কথা ভাবি?
—ভাগবতে রাধা নেই? ন পাড়ার রাধিকা মণ্ডল?

তোমার তুলনা ঐ চন্দ্রশাখা আকাশমণি গাছ, সতের মাস চাকরিহীন বাবা।

শেষ কবিতা

সমুদ্র জেনেছে। তথাগত, তারও বুঝি জানবার কথা ছিল।
বিদেশি বাণিজ্য নিয়ে উৎসাহ ছিল। প্রাচীন বাঙ্গলার নৌবহর
সে স্বপ্নে দেখেছে, বহুবার। সৌভাগ্য যেন সতী-লক্ষ্মী স্ত্রী হয়ে
দুয়ারে রেখেছিল ব্রতের কলস।

আর পদ্মাবতী ছিল। সকল স্বপ্ন-ঘোরে পদ্মাবতী আসে।
জেলেদের মেয়ে। মাছুনি। আঁশগন্ধ যোনি। তার অভিশাপে
এই সাতমহলা নৌকো ফুটো হলো। উঁয়ে খেলো লাইব্রেরি ঘর।
কবিতার পাতা নিল অমঙ্গল হাওয়া।

দূর গাঁয়ে মাস্টারি করি। অনেক দূরের পথ সমুদ্রবন্দর,
তার সূর্য, তার চন্দ্র, জোয়ার আর ভাটা।

Categories
কবিতা

কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

মুখ

একটা মুখ আমি খুঁজছিলাম যার চোখে লেগে আছে অনন্তের ঘোর। যেহেতু জানি, চোখের ওইটুকু ঘরে ছায়া পড়ে সমস্ত আকাশের, সুদূর নক্ষত্রের। জানি মহাবিশ্বের অপাঠযোগ্য সংকেত ক্রমশ এসে ফিরে যাচ্ছে। একটা মুখ আমি চাইছিলাম যে মুখে লেগে থাকবে নির্জন জলাশয়ের পদ্মঢেউ। কিন্তু একের পর এক চোখে শুধু দেখেছিলাম পাথরের হাহাকার, অন্ধকারের নৌকাডুবি।

অন্ধের শহরে আমি তাই ফিস ফ্রাইয়ের দোকানের সামনে গিয়ে জলের গভীরতা মাপার চেষ্টা করি, জলের ছায়া পড়েছে এমন কয়েকটা মুখ এসে আমায় আলেয়া হ্রদের কথা বলে। আমার নীল রক্ত ছলকে ওঠে ও সেইসব নেশারুর চোখে আগুন পিছলে যায় ।

একটা সাদা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে দেখতে পাই, দেখি নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ফোটন কণার স্রোত যা আমি একদিন দেখেছিলাম সার্কাসের আগুনবমিতে…

অনন্তের ঘোর আমি দেখতে পেয়েছিলাম বস্তুত এক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির চোখে যে একটা বাসের জানলায় বসে দূর দেশে যেতে যেতে প্রাণপণে ভোলার চেষ্টা করছিল তার মেয়ের অশ্রুভরা মুখ

ঘুম

সঙ্গম পরবর্তীকালে তোমার খোলা পিঠ হয়ে যায় আমার ক্যানভাস। বিশাল জলরাশির নীলে একটা জাহাজ ভাসতে ভাসতে নেমে যায়…আমার বিছানায় চারিদিকে সমুদ্রের জল, আলব্যাট্রস উড়ে আসে দিকশূন্যপুরের দিক থেকে

জাহাজের ডেক ধরে তুমি আর আমি দেখছি… সমুদ্রের জলে অজস্র গ্রূপছবি, মরা কাঠ দিয়ে বাঁধানো হাজার হাজার গ্রূপছবি, দূরে ঋতুমতি অসংখ্য নারীরা হাসছে আর ভাসছে

দেখ দেখ বউ এই বিপুল প্রেমের সাগরে ওই যে ভেসে যাচ্ছে জিপিএফ আর মিউচুয়াল ফান্ডের কাগজ দেখ দেখ বউ আমাদের কন্ডোমের ভিতরে ভাসছে সেইসব ইচ্ছে যারা জন্ম নিতে চেয়েছিল… সেইসব জননী যারা যুবতীশরীর থেকে জন্ম নিয়ে হাঁটতে চেয়েছিল দিগন্তের দিকে…

সঙ্গম পরবর্তী ঘুম তোমাকে বলে যায় মানুষ অনেক মৃত্যুর উপরে বেঁচে থাকে। বাঁচাই আসলে এক পিশাচ সাধনা!

মৃত্যু

এমন একটা পত্রিকা যেখানে কখনও লেখা পাঠাইনি নিজের কোনও লেখা প্রকাশিত হবার দূরতম সম্ভাবনাও নেই অথচ সূচিপত্রে তন্নতন্ন করে নিজের নাম খুঁজে বেড়াচ্ছি যদি পাওয়া যায়

একদিন লাইন বাসের মতো চলতে চলতে আমার ঘর পেরিয়ে যেতে থাকলো জনপদ ছোটো গঞ্জ হাটবার… আমার ছেলে খালাসি, সে বলতে থাকল ডাইনে ঠিক ডাইনে ঠিক, আমি ড্রাইভার হঠাৎ পেচ্ছাপ পেল নেমে গেলাম, ঘর দাঁড়িয়ে থাকল অন্ধকার রাস্তায় অত্যল্প আলোয়

হেঁটে যেতে যেতে সুন্দরী বৌদি হঠাৎ একদিন মসজিদ মোড়ে আড়ালে আমাকে টেনে খুলে দিল তার বুক, আমি দেখলাম তার ডান স্তনে আড়াআড়ি একটা সার্জারির দাগ আমি দেখলাম সেই অন্ধকার রাস্তা ধরে আলো জ্বেলে আলো জ্বেলে পেরিয়ে যাচ্ছে রাতে রাতে অসংখ্য ট্রাক… মেয়েমানুষ পাচার হচ্ছে… সীমান্তে গুলির শব্দে চমকে উঠে লুটিয়ে পড়ছে ঘুমিয়ে থাকা পাখিরা

অজস্র গোরুর দল খুরপায়ে ঢুকে পড়ল সন্ধ্যেবেলার শহরে আমার। ট্রাফিক, ব্যাবসায়ী আর আগন্তুকের গালি খেতে খেতে তারা চলতে লাগলো শহরের পেট দিয়ে বুক দিয়ে… এইভাবে তারা এসে পড়ল একটা খালের আর কালভার্টের সামনে—

একহাতে আমার ফুলের গুচ্ছ, অন্যহাতে ঝোলানো রংচঙে প্লাস্টিক পেপারে দুর্গন্ধময় বমি, যদি ফুল দিতে ভুল করে বমি দিয়ে ফেলি জান এই বসন্তদিন কেমন যাবে তোমার

মৃত্যু/দুই

পৃথিবীতে সব কিছুর নামেই একটা দিন থাকে, শুধু মৃত্যুর নামে কোনো দিন নেই , কারণ প্রতিটি দিনই তার একান্ত নিজের। প্রায় প্রতিটি দিনই কারো কারো চলে যাওয়ার দিন। বুকের বেদনা নিয়ে বাল্যবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় আর তারপর স্মৃতিচারণ এক অব্যর্থ অসুখ যা আমাদের মৃত্যুর আঁধার ঘেরা পপলার পাতায় ভরা রাস্তায় নিয়ে চলে। সে একটা হাত তুলে আকাশের দিকে উড়ে যায়। ফলে হাওয়াকে আর শূন্যতাকে প্রশ্ন করতে হয় কত তারিখ আজ।

আপনি কি জানেন মুহূর্তের মৃত্যু হয়? আপনি কি জানেন এই শতাব্দীতে শোকের আয়ু দুই থেকে তিন দিন? আপনি কি জানেন স্যর আপনার সমস্ত অতীত সময় রেখে দিচ্ছে অব্যর্থ এক এক্সটার্নাল হার্ড ডিস্কে? না জানলে এই যে আমাদের কোম্পানির নিজস্ব প্রডাক্ট কিনুন, এর নাম মৃত্যু, এটা গিলতে হয়, আর গিলে ফেললে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে সে আপনাকে নিয়ে যাবে মৃত্যুর পরের পৃথিবীতে। এই গাড়ির ডেলি প্যাসেঞ্জারেরা সবাই আমাকে চেনেন। আমার নাম জীবন।

সত্য

ধরুন একটা ঘরে আপনি থাকেন, কিন্তু আপনি জানেন এই ঘর দলিলে যতই লেখা থাক, সে আপনার নয়, ধরুন সেই ঘরে আপনার সঙ্গে যাঁরা যাঁরা থাকেন ভদ্রভাষায় তাঁদের প্রিয়জন বলা হয় কিন্তু আপনি জানেন সবাই নিজের স্বার্থে আছে, একপ্রকার ধান্দা যদি সঠিক পদ্ধতিতে মুড়ে ফেলা যায় তাহলে তারই নাম হবে সংসার, ধরুন সেই ঘরে আপনার যে ঘরটি আছে, একদিন রাত্রে দেখলেন তার মাথার উপরে ছাদ নেই উন্মুক্ত নক্ষত্রের আকাশ দেখা যাচ্ছে আর কানের কাছে কে যেন বলছে ওহে শরণার্থী শরণার্থী ওহে, ধরুন আপনার নারীটি আপনার প্রতিকৃতি আঁকতে গেলে একটা এটিএম মেশিন এঁকে নেয়, ধরুন আপনার সঙ্গে তার অযৌন জনন, ফুলের মতো শুধু রেণু নিয়ে যায় যে দালাল পতঙ্গ তাকে আপনি ধরতে পারছেন না, ধরুন আপনি জানেন যে আপনার এই অবস্থায় আত্মহত্যা করা নির্বুদ্ধিতা কারণ ওই সিদ্ধান্তটুকুর জন্যে দাঁত পাজিয়ে বসে আছে আপনার প্রিয়জনেরা, তবু আপনি তেতলায় ছাদের কিনারে এসে বারবার দাঁড়াচ্ছেন, আর তখনই ধরুন আচার্য শংকর এসে কানে কানে বলে গেল ইহ জগৎ মিথ্যা আর ধরুন তখনই তাকে বোকাচোদা বলার ইচ্ছে হল আপনার