Categories
প্রবন্ধ

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

কলকাতা শ্রমতালুক

সে-সময়ের কিছু লেখা থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে চার্ণকবাহিনীর ঘাঁটি গাড়ার মুহূর্তে প্রাচীন কলকাতার সম্ভাব্য জনসংখ্যার হিসাব দিয়েছেন কলকাতার প্রথম সেন্সাস ওফিসার শ্রী অতুল কৃষ্ণ রায়। ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা’-র (১৯০১)-এর ১৩০ সংখ্যক পৃষ্ঠায় হলওয়েল সাহেবের ১৯৫২ সালের সংগৃহীত রাজস্বের আনুপাতিক হিসাব করে শ্রী রায় সিদ্ধান্ত নেন যে, কলকাতার আনুমাণিক জনসংখ্যা ছিল— ১৬৯৬ সাল=(৮০৭৩), ১৭০৪ সাল=(৫১৬০০), ১৭০৮ সাল=(১০৮৭০০)। (স্মর্তব্য যে, ব্রিটিশ বয়ান অনুসারে (প্রারম্ভিক) কলকাতা তিনটি গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল)

প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রি বা গ্রামীণ পুঁজি বা ধনবাদী সমাজব্যবস্থার পূর্বসূরি হিসাবে পের্লিন-মেণ্ডেল-মারফানি-ভ্যান বস চিহ্নিত merchant capitalism পর্যায়ের জনবৃদ্ধি, খেটে খাওয়া গরীরগুর্বোর পাশাপাশি অর্থলগ্নিকারী ধনিকশ্রেণির স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের বাস্তবতা-তত্ত্ব-তথ্যকে অস্বীকার করা সম্ভব কি? উইলসন সাহেব বলছেন— ১৭০৪ সালে শহরের জনসংখ্যা ছিল ১৫০০০ আর জমিদার-শাসিত শহরসংলগ্ন এলাকায় ছিল ৩০০০০। (অর্থাৎ, শহরতলি সে-সময়েই জমজমাট। দ্বিগুণ জনসংখ্যা। উইলসন-তত্ত্বে ১৭০৬ সালে জনসংখ্যার হিসেব ছিল যথাক্রমে, ২২০০০ ও ৪১০০০। ১৭০৮-এ হয় ৩১০০০ ও ৩৬২০০ আর ১৭১০-এ ৪১০০০ ও ৮২০০০। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে হ্যামিল্টন অবশ্য বলেছেন যে, ১৭১০-এর কলকাতায় ১২০০০ লোকের বসবাস ছিল। কলকাতার ভারপ্রাপ্ত রাজস্ব সংগ্রাহক হলওয়েল সাহেবের মতে ১৭৫২ সাল নাগাদ কলকাতার জনসখ্যা ছিল চার লক্ষ নয় হাজার (৪০৯০০০)। ঐতিহাসিক সি.এ. বেইলি মনে করেন ১৭২০ সালের কলকাতায় ১২০০০০ (এক লক্ষ কুড়ি হাজার) মানুষ বসবাস করতেন। ‘ten cities that made an empire’ বইতে Tristram Hunt জানান যে— ‘আঠারো শতকের মাঝামাঝি লালদিঘি এলাকায় এক লাখেরও বেশি বাসিন্দার বাসভূমির গর্ব করতে পারত কলকাতা, যার ফলে কেবলমাত্র লন্ডন ছাড়া আর যে-কোনো ব্রিটিশ শহরের থেকে দীর্ঘকায় ছিল। (সুতরাং, জনপ্রাবল্যের দিক থেকেও আমরা (১৭৫০-এ) লন্ডনের সঙ্গে প্রায় একাসনে বসার গরিমা অর্জন করেছিলাম।) অথচ, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নজরে ১৬৯০-এর কলকাতা একটি গণ্ডগ্রাম হয়েই রয়ে গেছে! বিস্ময়জনক। উপরন্তু, রায়সাহেবের ৮০৭৩ হোক অথবা হ্যমিল্টনীয় বারো হাজার কিংবা হলওয়েলীয় চারলাখ— কোনো সংখ্যার পিছনেই ব্রিটিশ শাসনতান্ত্রিক গরিমা-মহিমা-ভঙ্গিমার কণামাত্রও অবকাশ নেই। সিরাজের কলকাতা অভিযানের মূল কারণ ছিল ব্রিটিশ বণিকের যথেচ্ছাচার, দুর্গনির্মাণ। অর্থাৎ, তখনও তারা প্রজা, শাসকপ্রভু নয়। কোম্পানির খাজনা জমা করতে হত তাদের। অর্থ হয়,— ঘরভরা ফসল, কুশলী কর্মক্ষম দু-টি হাতের সুদক্ষ শিল্পসৃজন ও অমেয় পণ্য ভাণ্ডারটিকে ‘বাজারজাত’ করার তীব্র অর্থনৈতিক চাহিদা, বণিকী তাড়না থেকেই কলকাতার জন্ম। অস্যার্থ, ষোড়শ-সপ্তদশ-আঠারো শতকীয় কলকাতা ‘স্বয়ম্ভু’ ছিল।

হান্ট ‘conurbation’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কেম্ব্রিজ অভিধানে শব্দটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে— ‘a city area containing large number of people, formed by various towns growing around and joining together’: উদাহরণ হিসাবে টোকিও, ওসাকা প্রভৃতি উচ্চারিত হয়েছে। সেই সূত্রানুসারে, প্রাথমিক গ্রাম তিনখানি নয় কেবল, পার্শ্ববর্তী শুঁড়া, কলিঙ্গা, মলঙ্গা, চিৎপুর, দখিনদাঁড়ি, উলটোডীঙ্গি, ব্রিজি, মাগুরা, চৌবাঘা, তিলজলা, ট্যাংরা, শালকে-ব্যাঁটরা, ইত্যাদি আরও ৩৮টি শ্রমঠিকানার জীবনস্পন্দনও তো কলকাতার উত্থানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবং ১৭১৭-তেই।

মুরহাউস অবশ্য একটি প্রণিধানযোগ্য স্বীকারোক্তিমূলক মন্তব্য করেছেন যে, কলকাতার লাগোয়া যে-হিন্টারল্যান্ড/পশ্চাৎভূমি রয়েছে, সেটাই এর সম্পদকে সর্বদা আরও বর্ধিত আকার পেতে সহায়তা করেছে। (‘that in the first place provided the excuse for Calcutta being here at all’). অর্থাৎ, এখানে কলকাতা সৃষ্টি হবার প্রধান কারণ তো এইসব অঞ্চলগুলোই। সুতরাং, গ্রাম কলকাতা নয়, কলকাতাকে ঘিরে থাকা বিস্তীর্ণ উপকণ্ঠই হল কলকাতার উত্থানের পিছনে মুখ্য চালিকাশক্তি। কিন্তু এই সাযুজ্য-সহধর্মিতা-সমমর্মিতা কি ১৬৯০-এর পরে শেখা? এ-যুগের গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে ‘মাঝ অষ্টাদশে, এক লক্ষ বাসিন্দা, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ভারতীয়, সেই জনপ্রাবল্যহেতু শহর কলকাতার রূপরেখাটি ফুটে উঠতে শুরু করে।’ অতএব, গার্ডিয়ান অনুযায়ী, ইংরাজ অধিকৃত অঞ্চলটিই কেবল শহর পদবাচ্য আর স্থানীয় জনতা অধ্যুষিত এলাকায় যাঁরা বাস করতেন, যাঁরা উইলসন সাহেবের ভাযায় শুরুতেই ‘দ্বিগুণ’ কিংবা মুরহাউসের ‘হিন্টারল্যান্ড’ তাঁরা ধর্তব্য নন, ব্রাত্য?।

লক্ষণীয় হল ঐতিহাসিক হান্ট ‘এরাউন্ড লালদিঘি’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। ১৭৫০ নাগাদ লালদিঘির আশেপাশেই যদি লক্ষজন বাসিন্দা থাকেন তো সেই সময়ের উপকণ্ঠ যার মধ্যে শিয়ালদহ, বাগমারি, মির্জাপুর, এন্টালি, ধলন্দা ইত্যাদি আরও ৩৮টি গ্রামের বাসিন্দার সংখ্যা আদতে কত ছিল? এ.কে. রায় মহাশয়ের দাখিলা অনুযায়ী ১৭০৬-এর সদ্যভূমিষ্ঠ ‘ব্রিটিশ’ কলকাতায় ৮০০৮টি বাড়ি। উইলসন সাহেবের হিসাবমতো ১৭০৬ সালে ২২০০০ বাসিন্দা। অর্থাৎ, বাড়িপিছু মোটামুটি আড়াইজন বাসিন্দা। ম্যালথাস সাহেবের জনসংখ্যা তত্ত্ব (১৭৯৮) ভূমিষ্ঠ হবার বিরানব্বই বছর আগেই শহর কলকাতায় পরিবার পরিকল্পনার ল্যাবরেটরি স্থাপন করাই কি তবে ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম অবদান? কিংবা, হ্যামিল্টন সাহেবের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী বিচার করলে ৮০০০ বাড়িতে ১২০০০ লোক। অর্থ হয়, বাড়িপিছু গড়ে দেড়জন। গড়ে মাত্র দেড়জন লোক থাকার জন্যে কেন কয়েক হাজার বাড়ি গড়ে উঠবে? ১৬৯৮-এ ব্রিটিশরা জমিদারিত্ব পায়। রায়সাহেব নিজেই দাখিলা দিয়েছেন (এ শর্ট হিস্ট্রি… পৃ-২০৩) যে, প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রিটিশরা তাদের পত্তনিটিকে সুতানুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন, আর ১৬৯৬ সালে বাসস্থান বদল করে পাশের কলকাতা গ্রামটিতে ডেরা বানায়। নিজেরাই যখন থিতু হয়ে বসেনি, তখন অন্যকে বসে পড়ার হুকুমত জারি করেই-বা কী করে? ১৬৯৮-এ কলকাতা ইত্যাদির জাগিরদারি পাওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে কি ৮০০৮টি বাড়ি গড়ে উঠেছিল?

আট বছরে আট হাজার বাসস্থান! বছরপিছু গড়ে এক হাজার, দিনপিছু সাড়ে তিনটি। এতগুলো বাড়ি গড়ে উঠল, সেও এক সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তো বটেই, অথচ এ-ধরনের সামুহিক ক্রিয়াকলাপের বিবরণ সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক তথ্য সহজলভ্য নয় কেন?

১৭০৬-এ তিনটি গ্রামের জমি-জরিপ করায় ব্রিটিশ বাহিনী; সেই জরিপ অনুযায়ী চাঞ্চল্যকর তথ্য হল—
বাজার কলকাতায়— মোট ৪০১ বিঘা এলাকা
ডিহি কলকাতায়— মোট ২৪৮ বিঘা এলাকা
সুতানুটির ১৩৫ বিঘা এলাকা
গোবিন্দপুর ৫৭ বিঘা এলাকা
মোট ৮৪১ বিঘা এলাকা

• অর্থ হয়, নির্মিত বস্ত এলাকার শতকরা (প্রায়) ৪৮ ভাগ অঞ্চল ছিল বাজার-এরিয়ায়।

সুতরাং, বাজার ছিল জীবন-জীবিকা-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান অঙ্গ। বাজার অর্থাৎ, ট্রেডিং বা নিখাদ পণ্য কেনা-বেচা। বাজারে বিক্রি করার জন্য ঘাড়ে করে মাল বয়ে নিয়ে আসতেন খেটে খাওয়া মানুষজন। তাঁরা অবশ্যই সংখ্যায় ‘কয়েকঘর’ অল্প কয়েকজন ছিলেন না। উপরন্তু, বাজার এলাকায় বসতি গড়ে উঠতে পারে না। তাই জনবসতি ছিল সামান্য দূরের ৩৮-টি আধাশহুরে কুটিরগুলোয়, যেখানে তাঁতবস্ত্র বা হস্তশিল্পের বয়ন-বুনট-নির্মাণ হত। সবিশেষ উল্লেখনীয় হল যে, পের্লিন-মেণ্ডেল প্রভৃতি প্রোটো ইন্ডাস্ট্রির প্রবক্তারা সমবেত ঐকতানেই জানিয়েছেন যে, উপনিবেশপূর্ব গ্রামীণ (প্রোটো ইন্ডাস্ট্রিয়াল) অবস্থায়— সে-প্রাশিয়া হোক কিংবা বোহেমিয়া বা ইন্ডিয়া— পরিবারের সবাই মিলে এই ‘পারিবারিক’ কাজে অংশগ্রহণ করত। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক পার্থসারথি প্রসন্ননও জানিয়েছেন যে, দাক্ষিণাত্যে তাঁতি পরিবারের সবাই, ছেলে-মেয়ে-বাড়ির মহিলারা নির্বিশেষে রং লাগানো, সুতো ধোওয়া, সাফ-সাফাই বা সুতোর গুলি পাকানোয় যোগ দেয়।

২) দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এলাকার প্রাচীনত্ব।

রায়সাহেব লিখেছেন যে, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে কালীক্ষেত্র ১২৮০ একর এলাকা জুড়ে পরিব্যাপ্ত ছিল এবং সতেরো শতকে তা হয়ে দাঁড়ায় ১৬৯২ একর। অর্থ হয়, ব্রিটিশবণিক হাজির হওয়ার মোটামুটি পাঁচশো বছর আগে থেকেই অর্থনৈতিক কাজকর্মের যোগান সামাল দিতে কলকাতার কলেবর ৪১২ একর এলাকায় বৃদ্ধি পেয়েছিল। একইসাথে, লক্ষ করার বিষয় হল যে, হুগলিতে ঘাঁটি গাড়ার পর থেকে ইওরোপীয় বনিকেরা ক্রমশ দখিনমুখী হয়ে পড়েছিল। ফরাসি—চন্দননগর, ডাচ— চুঁচুড়া, দিনেমার— শ্রীরামপুর এবং সবশেষে আসরে নামা ব্রিটিশবাহিনী= সুতানুটি। ভৌগোলিক দিক থেকে শতপ্রতিশত নিয়মতান্ত্রিকতা, স্ট্রেট লাইন মেথডিক সেটেলমেন্ট। সামান্য এক রুরাল বাজার, পের্লিনের ভাষায়, ‘rurban–type’ ‘বিকিকিনির হাট, ক্রমে অসামান্য এক গ্লোবাল বাজার হয়ে ওঠে। মোদ্দাকথায়, এ-জাতীয় ‘degree of specialisation’–এ পৌঁছতে মাসকয়েক বা বছরকয়েক নয়, শতাব্দীর শ্রম-মেধা-মনন প্রয়োজন হয়। স্মর্তব্য যে, মুঘল আমলে কলকাতা একটি মহাল বা পরগনা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। সুতরাং, ব্রিটিশ আসার সঙ্গে কলকাতার বাড়িঘর গড়ে ওঠা শুরু হওয়ার আখ্যানটিও অনৈতিহাসিক। পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন।

ষোলো-সতেরো শতকের ভারতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ও অতি দ্রুত কিছু পরিবর্তন ঘটে। সেই পরিবর্তনের মূল বিশেষত্ব হল স্থানীয় স্তরে merchant capitalism-এর উত্থান, যা উপমহাদেশীয় বিস্তার লাভ করে এবং অর্থব্যবস্থা-রাষ্ট্রবাদিতায় গভীর ছাপ রেখেছিল। এরই প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য ও পর্যাপ্ত কাঁচামালের কারণে বাণিজ্যিক হুড়হুজ্জত, চহলপহলের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয় বাংলা। সে-সময়ের ভারতীয় অর্থনৈতিকতার বিষয়ে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ইয়ান সেন্ট জন লিখেছেন— ‘what was the character of this India the British encountered in the 17th and early 18th centuries ? It had, to begin with, a vigorous commercial culture. Market systems were well developed and facilitated active trading links both within India itself and beyond to Persia, Africa, China and the spice Islands (latter day Indonesia)…. Calcutta was the company’s most thriving base. Silk, cotton textiles ,sugar and saltpetre were all purchased by the company from across Bengal and shipped towards London and East Asia. Exports to London alone amounted to £400000 per annum in the 1740’s.’ (p-15) vide ‘the making of the British Raj’ by Ian Saint John… সতেরো বা আঠারো শতকের শুরুর দিকে ভারতে পা দিয়ে ব্রিটিশরা কী দেখেছিলেন? শুরুতেই বলা যায় যে, সেখানে এক জোরদার বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ চালু ছিল। বাজার অর্থনীতি যথেষ্ট উন্নত ছিল যার ফলে ভারতের অন্তর্দেশীয় এলাকায় যেমন সক্রিয় লেনদেন চলত, ঠিক তেমনই বর্হিবাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পারস্যদেশ, চীন, আফ্রিকা আর ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এবং কলিকাতা ছিল সেই কর্মকাণ্ডের কোম্পানির সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী ভিত্তিভূমি। সেন্ট জন একইসাথে দিনক্ষণেরও উল্লেখ রেখে আঠারো শতকের শুরুর দিকের কথা বলেছে। কিন্তু ইতিহাস জানাচ্ছে ১৬৮৮-র গ্লোরিয়াস রেভ্যুলিউশনের পর ভারতে ব্রিটিশ বাণিজ্যের নামমাত্র অস্তিত্ব ছিল। এবং ১৭০৮ সালের পর তা পুনরায় শুরু হয়। সুতরাং, আঠারো শতকের শুরুতেই তো ব্রিটিশবণিকেরা বাণিজ্যকাজে মন দেয়। সেক্ষেত্রে, তৈরি বাণিজ্যকাঠামো-প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য ক্ষেত্র ছাড়াই কি একটি মার্কেন্টাইল কোম্পানির মনপসন্দ জুয়েল=সমৃদ্ধিশালী ভিত্তিভূমি হয়ে উঠতে পারে কি কোনো জায়গা?

সেন্ট জনের ‘জোরদার বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ’ মন্তব্যটিতে বিশেষ নজর দেব। তাঁর মন্তব্যের পাশেই ঠুসে দিতে চাই মুঘল সম্রাট ঔরংজেবের প্রশংসাবাণী। তাঁর কাছে বাংলা ছিল ‘প্রদেশের স্বর্গ’। ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছাড়াও নিকট চীনসমুদ্র থেকে পারস্য-ভূমধ্যসাগর হয়ে প্রায় সমগ্র পশ্চিম ইওরোপে বাংলার বাণিজ্যসম্ভারের রীতিমতো ঈর্ষাজনক চাহিদা ছিল। অতএব, চার্ণকের দ্বি-প্রাহরিক খেয়ালের বশে হঠাৎই এঁদো জলাভূমিতে কিপলিঙেস্কু একটি শহর-নগর হিসাবে ছত্রাকের মতন কলকাতা গজিয়ে ওঠেনি! ব্রিটিশ লেখকেরাই তো মনে করেন কলকাতার জন্ম হয়েছিল কেবল বাণিজ্যের লক্ষ্যে, ব্যবসায়িক স্বার্থে! স্মর্তব্য— Geoffrey Moorehouse— ‘Nothing but commercial greed could possibly have led to such an idiotic decision; that is, to build a city in the marshland of Bengal.’

শেষ পাতা

Categories
প্রবন্ধ

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

কলকাতা শ্রমতালুক

শিল্পবিপ্লব সেই ধারার পরিবর্তন করে দেওয়ার ফলে পণ্যবস্তুর বদলে ভারত থেকে কাঁচামাল যেত ইংল্যান্ডের বাজারে। সোনারূপার পরিবর্তে, ব্রিটিশ পণ্য উপচে পড়ত ভারতীয় বাজারে। এক কথায়, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল ভারতীয় কুটির শিল্পের মধ্যযুগীয়ত্ব। ইংলন্ডীয় শিল্পবিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে ভারতবর্ষে অবশিল্পায়নের মতো এক নিকৃষ্টতম মূলগত ফেরবদল দেখা দিলে শ্রমিক শ্রেণি জীবিকা পরিবর্তনে বাধ্য হয়। স্বনির্ভর আত্মনেপদী রুজিরোজগার থেকে তারা নফরতন্ত্রের শিকার হয়ে যায়।

হিস্টোরিক্যাল অ্যান্ড ইক্লেস্টিকাল স্কেচেস-এ এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়েছে যে, এক টাকায় ২৯১ কিলো চাল পাওয়া যেত সে-সময়ের বাংলায়। সন্দিগ্ধজন বলতেই পারেন এ-সবের সঙ্গে কলকাতার কী সম্পর্ক। তাঁদের বলি যে, সুঠাম দেহবল্লরীর সৌন্দর্য স্থানবিশেষে সুন্দর হয় না। তাগড়া বাইসেপ-ট্রাইসেপ-সিক্‌সপ্যাক— সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর, অথচ কাফ মাসলটি ল্যাকপ্যাকে, কব্জি কাঠিসার— কখনো হয় না কি তেমন? একুশের অধ্যাপিকা বললেন— শহরই ছিল না, শহর বানিয়ে নেবার দরকার ছিল! তবে কি তাঁরা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীও ছিলেন? সুঠাম শরীর সমান মাপেই সুবিন্যস্ত হয়। বাংলা তেমনই ছিল— পোর্তো গ্রান্ডা চাঁটগা-সোনারগাঁও-বাকলা টু হুগলী-মালদা-বর্ধমান। নদী সামীপ্যের কারণে চওড়া জলপথনির্ভর হাইওয়ের কোলে একটি নয়, দু-দু-টি বাজার কিংবা প্রাক্‌-ব্রিটিশ সাতটি নগর-বন্দর গড়ে ওঠা কি যথেষ্ট, যথাযোগ্য প্রমাণ নয়? (বর্ডারহীন), প্রি-মর্ডান যুগে, বিদেশিবাণিজ্য কি বিস্ময়জনক আধুনিকতা নয়? সুশিক্ষিত মানুষ তো বরং ‘ব্রেক্সিট’ করে! (৪০০ বছর আগে) কলকাতা সংলগ্ন দু-দুটো বাজার (বেতড়-সুতানুটি) থাকার প্রয়োজনীয়তা কী বা কেন?

ঐতিহাসিক অনিল কুমার দাস ইংরাজ দূতিয়াল টমাস রো-র নজরে দেখা বাংলায় ব্রিটিশবাণিজ্যের সম্ভাবনা সম্বন্ধে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন (সূত্র: ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেস, সংখ্যা ২৮,১৯৬৬) আমি কেবল কপি-পেস্ট করছি— ‘Sir Thomas Roe returned * that Bengalla should be poore I saw no reason; it feeds the countries with wheate and rise, it sends sugar to all India; hath the finest cloth and pintadoes, musek, civitt and amber, (besides) almost all raretyes from thence by trade from Pegu… the number of Portugalls residing is a good argument for us to seeke it, it is a signe there is good thing…’ পাশাপাশি উল্লেখ রাখব ঐতিহাসিক ওম প্রকাশ সম্পাদিত ‘হাউ ইন্ডিয়া ক্লোদড্‌ দি ওয়ার্ল্ড্‌’ বই থেকে একটি উদ্ধৃতির— ‘John Huyghen van Linschoten noted in his Voyage to the East Indies (1598) a “great traffique into Bengala, Pegu, Sian, and Malacca, and also to India”, adding that “there is excellent faire linnen of Cotton made in Negapatan, Saint Thomas, and Masulepatan, of all colours, and woven with divers sorts of loome workes and figures, verie fine and cunningly wrought, which is much worne in India, and better esteemed then silke, for that is higher prised than silke, because of the finenes and cunning workmanship.” লক্ষণীয় যে উদ্ধৃতিটিতে Bengala ও India পৃথকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। (তারিখ ১৫৯৮) চার্ণক প্রতিষ্ঠিত ডেটলাইনের একশো বছর আগে! (সেক্ষেত্রে, প্রশ্ন তুলব না— এই পৃথকীকরণ কেন?)

আর্লি অ্যানালস-এ শেঠ-বসাকদের গোবিন্দপুর অভিযানের কথা বলেছেন সি আর উইলসন। শেঠ মানে অর্থ, শেঠ মানে পুঁজি, অর্থকরী জ্ঞান, ব্যবসায়িক নো-হাউ। সপ্তগ্রাম থেকে গোবিন্দপুরে, ১৫৫১-য়, মানে চার্ণক চলে আসার দেড়শো বছর আগেই অনাগত-ভবিষ্যতের উজ্জ্বলতম নমুনা হয়ে সপ্তগ্রামের চালু ব্যবসা ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন বণিক! অ-ব্যবসায়িক স্বার্থে কি? কোনোরকম প্ল্যান-পোগ্রাম ছাড়াই? প্রসঙ্গান্তর হলেও এমন মনে করা কি অনুচিত হবে যে, জগৎশেঠের পরিবারও ক্ষুরধার ব্যবসায়িক প্রবৃত্তির তাড়নায় বিদেশির পক্ষ নিয়ে সিরাজ-বিরোধিতায় নেমেছিল এবং সেই বাণিজ্যিক প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের প্রতিফল কী হয়েছিল তা সারা উপমহাদেশ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে যে, ‘প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ সে-সব জায়গাতেই সফল হয়েছে যেখানে আগে থেকেই শিল্পের মজুদগি ছিল, যা মূলধন, ব্যবসায়িক উপলব্ধি আর সংযোগের পটভূমি তৈরিতে সাহায্য করেছিল।

(মিল-মেশিনের যান্ত্রিক নিপুণতা-নির্ভুলতা-নির্ভরযোগ্যতার সূত্রে নয়) কর্মক্ষম দুটো হাতের সাহায্যেই কেবল শিল্পসম্মত এবং বিদেশি বাজারকে আকৃষ্ট করার মতো যে-কোনো পণ্য উৎপাদন করার সব চাইতে আগে জরুরি হল অভিজ্ঞতা, যা আদতে বহুদিনের মগ্ন আত্মাহুতি-মনীষীসুলভ নিবিষ্টচিত্ততার ফল, ফসল। সুতরাং, ঢাল-তলোয়ারযুক্ত নিধিরাম সর্দার আসিলেন (১৬৯০), বাকিবকেয়া দু-বছরের জিন্দেগীর পুরো সদ্‌ব্যবহার করে উদাত্ত কণ্ঠে সকলকে আহবান জানাইলেন, দলে–দলে অভিজ্ঞ লোক জড়ো হতেই আশেপাশে ৩৮-টি গ্রাম (মোরল্যাণ্ডের ভাষায়— টাউন) গড়ে উঠল। অমন ধারার চালু ইতিহাসের দাখিলা কন্টিনিউ করে বলা যেতেই পারে যে, সেইসব গ্রামগুলোতে অতঃপর পণ্য উৎপাদিত হইতে শুরু করিল। উৎপাদিত বস্তুগুলো অবশ্য, মেশিনের অভাবে, হাতেই তৈরি হত। এবং ইয়ান সেন্ট জন, ব্রিটিশ ঐতিহাসিক, বলছেন ১৭৪০-এর দশকে কেবল কলকাতা থেকেই (সেদিনের মূল্যমানে) বছরে ৪ লক্ষ পাউন্ডের মাল লন্ডনে পৌঁছত। (একটি ‘রিড্‌ল’-এর আশ্রয় নেব=সে-সময়ে শুধু ইংলন্ড নয়, সারা পশ্চিম ইওরোপেই পণ্য পৌঁছে যেত।) এত বিশাল পরিমাণ পণ্য শুধুমাত্র হাতে তৈরি হতে গেলে তো সবচেয়ে জরুরি উপাদান হল কায়িক শ্রম। অতএব, গাদাগুচ্ছের কর্মক্ষম মানুষ, একত্রে ও একই জায়গায় পাওয়ার অর্থ হল সেই জায়গাটি বা উৎপাদন-স্থলটি বহু প্রাচীন। ২৫% জি.ডি.পি. তো প্লুটো-দূরত্ব, তিয়াত্তর বছরে আমাদের জিডিপি ১০-এর দাগও ছুঁতে পারল না। আর মিল-মেশিনহীন দুনিয়ায় তাঁরা চার-দশকেই শিল্পবিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন? সরল সত্য বরং বহু প্রাচীনকাল থেকেই জাহ্নবীতীরে বসত গড়ে ওঠার রীত-রেওয়াজ ছিল। শ্র্মবিভাগকে মেনেই নিজ নিজ জাতি-বর্ণ-গোত্র অনুযায়ী মালোপাড়া-মুচিপাড়া-বামুনপাড়া-কাঁসারিপাড়া-কুমোরপাড়া-তাঁতিপাড়া গড়ে উঠেছিল। আই রিপিট, এই বিভাজন শ্রমের ঠিকানা বা ধম্মের হিসাব অনুযায়ী ছিল না।! আর এমন সুপ্রাচীনতার কারণেই নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, নগর কলকাতার জনপদ-জনবল-জনবহুলতা নিশ্চিতই চার্ণকের আহবানের অপেক্ষায় থাকেনি।

সুতানুটিতে বড়ো একটা বাজার ছিল। তথ্য বলছে বাজার এরিয়া ৪৮৮ বিঘা। অর্থাৎ, বেশ বড়োই বটে। এতটাই বড়ো যে, ১৭০৩ সালেই কোম্পানির রেকর্ডে চড়ে বসেছে। (সূত্র: পি থঙ্কপ্পন নায়ার, দি লিভিং সিটি, পৃ-২৩২) কিন্তু, বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি কী করে হল? ‘কয়েক ঘর মাত্র লোকের বাস’ (পি.টি নায়ার) ‘অখ্যাত গণ্ডগ্রাম’ (রাধারমণ মিত্র), তাহলে এত বড়ো বাজারের কী দরকার ছিল? উলটো পাড়েই তো বেতড় ছিল! বাণিজ্যের পরিমাণ সাপেক্ষে বেতড় যথেচ্ছ ছিল না? ১৭০৬–এর ব্রিটিশ জরিপ অনুযায়ী ৪৮৮ বিঘা এলাকা জুড়ে কলকাতায় ‘বাজার-এরিয়া’ ছিল। প্রশ্ন তোলাই যায় যে, ৪৮৮ বিঘাতে কতগুলো ইউনিট বসতে পারত? স্থানীয় জনতা, বিশেষত, বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বিক্রেতা-আড়তদার-মহাজন-কুলি-খালাসি-যোগানদার ইত্যাদিরা ছাড়া অমন ঢাউস বাজারটি চলত কীভাবে? র‍্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম ছিল কি? যে-বাজারের মধু–মৌতাতের সুবাস সুদূর পশ্চিম ইওরোপে পৌঁছে গিয়েছিল, তা যদি এক গণ্ডগ্রামের অজ পাড়া গাঁয়ে হাটই হত, তবে তো ব্রিটিশের ফোর্ট গড়ারই তো প্রয়োজন পড়ত না। ৫০-৬০ বছর আগেই হুগলিতে ডেরা নিয়েছিল, ওরা দুর্গ বানায়নি তো! অভিধানে দেওয়া ব্যাখ্যা অনুযায়ী বাজার হল একটি সর্বসময়ের বিকিকিনির স্থায়ী জায়গা, হাট হল নির্দিষ্ট সময়ান্তরে বেচাকেনার স্থল আর গঞ্জ হল অঢেল পরিমাণ (নির্দিষ্ট) জিনিসের পাইকারি বেসাতির জন্য চিহ্নিত এলাকা। যে-পরিমাণ ব্যবসা চলত, তা (স্ত্রী-পুত্র-পরিবার সমেত) দু-দশটি ‘straggling’ পল্লিগ্রামের দশ-বারো ঘর গাঁইয়া দেহাতির পক্ষে অবশ্যই সাধ্যাতীত ছিল। সুদৃঢ় বাণিজ্য কাঠামো ছিল, নিশ্চিতই, আর রূপকথা বা মিথে পরিণত গ্রাম কলকাতা সংলগ্ন অঞ্চলের জনবহুল, বলিষ্ঠ সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তিভূমির ওপরই ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছিল ইওরোপীয় বণিকদল। বলা বাহুল্য, কেবল সমুদ্রবাণিজ্য নির্ভর (ষান্মাসিক) ব্যবসা চলত না বড়োবাজারের মতন সুপারবাজারে। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যকথায় কবিকঙ্কণের দাখিলামতো অন্তর্দেশীয় এলাকায় যেমন কর্ণাট-অন্ধ্র-পাঞ্জাব-মালাবার অঞ্চলে অন্তত এক শতাব্দী আগে থেকেই বাংলার পণ্য পৌঁছত।

সলিলকির ঢঙ্গে কে যেন ফিসফিসালো— খ্রিস্টীয় তেরো শতক, ভারতীয় জীবনযাত্রায় ঘটেছিল আমূল পরিবর্তন। যুদ্ধবিগ্রহের পথ থেকে সরে এসে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, চাষাবাদ, বস্ত্র-হস্ত-কুটিরশিল্পের দিকে মন দিল আশ্বস্ত সাধারণ মানুষ। গড়-দুর্গ-সেনানিবাসের বদলে অগুনতি কারখানা। পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ উৎপাদন। গঞ্জ–মণ্ডি-কেন্দ্রীয় বাজার। নতুন নতুন আড়ং। ৩২০০-টি আধা-শহর। ১৫০ মিলিয়ন অধিবাসী। ১৫৩০-১৬৩৫-১৬৭৩; পর্তুগিজ-ডাচ-ফরাসি। তুর্কি-পার্শি-চীনা বণিকের আনাগোনা। ১৫৯৫, আখ্যা পেল পরগণা বা মহাল। নতুন নাম, ডিহি কলকাতা। প্রাক্‌ ১৭৫০ বাংলার নগর-বন্দর গড়ে ওঠা, বণিক শ্রেণির মহাজনী উত্থান, আর্থিক লেনদেনের ইতিহাস সেভাবে নাড়াচাড়া করা হয়নি। অবশিল্পায়নের ইতিহাস রয়েছে, কিন্তু শিল্পায়নের বাখান নেই। হ্যামিলটনীয় জনবিরলতা থেকে হলওয়েলীয় জন-বহুলতার তত্ত্ব-তথ্যদিও কি সেভাবে প্রাপ্তব্য? লাখ চারেক লোক জড়ো হচ্ছেন মুষ্টিপ্রমাণ এক ‘বিশেষ’ এলাকায়, কেন-কী উপায়ে, কীসের বিনিময়ে— সে-ইতিহাস কোথায়? এ শর্ট হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা (১৯০১)-য় এ.কে. রায় লিখেছেন (পৃ-২১৬)— ‘beyond that [Chitpore] road… spread jungles and pools, swamps and rice-fields, dotted here and there by the straggling huts and hovels of a small number of fishermen, falconers, wood-cutters, weavers and cultivators.’ আর ওই বইয়েরই ২৩ পৃষ্ঠায় শেঠ-বসাকদের সম্বন্ধে লেখেন যে, তাঁদেরই অনুপ্রেরণায় গোবিন্দপুর ও সুতানুটিতে ‘a large colony of weavers’ বসবাস করতে শুরু করে দেয় এবং ইংরাজ বণিকদের আকৃষ্ট করার মতো জমজমাট সুতোর ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল। আদি কলকাতার জনসংখ্যার সঠিক মূল্যায়নের জন্য এই মন্তব্যের ‘লার্জ’ ও ‘কলোনি’ শব্দ দু-টির মাহাত্ম্য অপরিসীম। পরের লাইনেই লিখেছেন ‘ইট ওয়াজ থ্রু দেম দ্যাট দি রেসিডেন্টস অফ ক্যালকাটা ফার্স্ট গট এ গ্লিম্পস অফ দি পর্তুগিজ ট্রেডিং অ্যাট বেতড়, ফ্রম হোয়্যার দে কেম টু ক্যালকাটা অ্যান্ড এস্টাব্লিশড্‌ এ কটন ফ্যাক্টরি (আলগোদাম)। এই আলগোদামই হচ্ছে আজকের ক্লাইভ স্ট্রিট। ১৫৪০-এ পর্তুগিজরা বেতড় বাজার হয়ে সপ্তগ্রাম চলে যেত। আর ১৬৩০-এ তারা সম্রাট শাহজাহানের রোষে পড়ে বিতাড়িত হয়। সুতরাং, চার্ণকের বহু আগেই কলকাতায়, অর্থাৎ, আজকের কয়লাঘাট/ক্লাইভ স্ট্রিট এলাকায় পা রেখেছিল পর্তুগিজরা।

‘আর্লি অ্যানালস’-এ ব্রিটিশ-বাণিজ্য স্থাপনের আদিপর্বের পর্যালোচনায় সি আর উইলসন-এর বক্তব্যের বঙ্গানুবাদ করেছি এরকম— ‘বহু খানাতল্লাশির পর দু-টি বিশেষ কারণের জন্য চার্ণক সুতানুটি (বা কলকাতাকে) ব্রিটিশ-বাণিজ্যের পক্ষে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জায়গা হিসাবে বেছে নেন: ১) সামরিক দিক থেকে জায়গাটির নিরাপত্তা এবং ২) ‘ইট ওয়্যাজ অলসো অ্যান এক্সেলেন্ট কমার্শিয়াল সেন্টার’। অর্থাৎ, এটি একটি উচুঁদরের বাণিজ্য-কেন্দ্র ছিল। ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি আরও লিখেছেন যে— ‘দি সিটি ইজ দি গ্রোথ অব মেনি সেঞ্চুরিজ!’ অর্থ হয়, কলকাতা কিংবা হুগলি নদীর যে-অঞ্চলে এ-সময়ের কলকাতা অবস্থিত, তার একটি পূর্ব-ইতিহাস রয়েছে আর নগরটি বহু শতাব্দীর বৃদ্ধির ফল। নিম্ন-ভাগীরথীর অববাহিকা অঞ্চলের চেয়ে ছোটনাগপুরের এলাকায় জনবসতির ঘনত্ব, উপজ ফসলের অনুপাতে খামতি থাকাই বরং, তর্কাতীতভাবে, একটি আর্থ-ভৌগোলিক সত্য। দুই-তিন ফসলি জমির সুবাদে ভাগীরথী তীরবর্তী এলাকার প্রতি বর্গকিলোমিটার পিছু বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে, অগুনতি লোকের বসবাসের পাকাপোক্ত ঠিকানা হয়ে ওঠা, নিশ্চিতই, অতি স্বাভাবিক অর্থনৈতিক পরিণতি। আর তারই স্বীকৃতি হিসাবে ১৬৯৮-এর জমিদারি হস্তান্তরের বইনামায় ‘কলকাতা’ নামের ডিহি ও পরগনার ‘যৌথ’ সূচনা রয়েছে। হ্যামিল্টনীয় বারো হাজারের পাশে কবিকঙ্কণের ‘ডানি বামে যত গ্রাম, তার কত লব নাম’ কি খুবই বেমানান?

এ-সময়ের ব্রিটিশ স্থপতি-ঐতিহাসিক মার্টিন বিটি মন্তব্য করেছেন যে— ‘Indian cities were not distinguished conceptually and materially from the countryside’. সপ্তগ্রাম বা হুগলি বড়োসড়ো নগরে পরিণত হয়নি। প্রাগাধুনিক ভারতীয় নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সে-সময়ের গ্রামগুলো আধুনিক ইওরোপীয় ধাঁচের এক ঘনসন্নিবদ্ধ এবং বৃহদাকার নগরাঞ্চলে পরিণত হয়নি; বরং সংলগ্ন থেকেও নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছিল। ষোড়শ শতকীয় বাংলার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র (১৫৪০-এর) হুগলি থেকে (জলপথে) কলকাতার দূরত্ব ৩৩ কি.মি. মাত্র। অর্থাৎ, সহজেই প্রভাবিত হওয়ার মতো নৈকট্য। সুপ্রতিষ্ঠিত জনপদ হিসাবে মঙ্গলকাব্যে বা রাজস্বপ্রদায়ী অঞ্চল হিসাবে আইন-ই-আকবরী-তে উল্লিখিত শান্তিপুর-নবদ্বীপ-মাটিয়ারি-মুড়াগাছা-হালিশহর-নইহাটী–ব্যারাকপুর (বর্বকপুর)-খড়দহ কিংবা ত্রিবিণী-মগরা-রিষড়া-শ্রীরামপুর-কোন্নগর-কোতরং অথবা আদিগঙ্গার অববাহিকা এলাকা যেমন ছত্রভোগ-মেদনমল্ল প্রভৃতি এলাকা সন্নিহিত হয়েও নিজ নিজ ভিন্ন সত্তা-আইডেন্টিটি নিয়ে গয়ংগচ্ছতায় ডুবে থেকেছে। ভারতীয় রীতি-নীতির সঙ্গে তালমেল রেখেই যেন রাজধানী, প্রশাসনিক বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভূমি হিসাবে গড়ে ওঠার কৌলিন্য ব্যতিরেকে কোনো এলাকাই তেমন বৃহদাকার নগরে পরিণত হয়নি। পের্লিন-মেণ্ডেল-মারফানি প্রভৃতি বিদেশি অর্থনীতিশাস্ত্রীরা প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রি বা বাণিজ্যিক মূলধনের সঙ্গে জনবৃদ্ধির, সাধারণের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের কথা পেড়েছেন। জিওফ্রে মুরহাউসের ‘দলে দলে’ শব্দবন্ধটিও তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সুতরাং, প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক পর্বের অর্থনৈতিকতার স্বরূপ উন্মোচনে জনবহুলতার বিষয়টি তাই সর্বাগ্রে বিচার্য: প্রাক্‌-ব্রিটিশ নগর কলকাতা কি সত্যিই ‘অখ্যাত গণ্ডগ্রাম’ ছিল?

‘কেন্দ্রীয় অঞ্চল’ তত্ত্বে ওয়াল্টার ক্রিস্টালার পাঁচ ধরনের জনবসতির উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে ছোটো এলাকাকে গণ্ডগ্রাম বা হ্যামলেট বলা হয়। জনসংখ্যার নিরিখে সেই এলাকাগুলো হল, পর্যায়ক্রমে— ১. গণ্ডগ্রাম; ২. গ্রাম; ৩. আধা-শহর (টাউন); ৪. নগর; ৫. অঞ্চলের প্রধানতম শহর বা রাজধানী।

উপরিউক্ত বিভাগ অনুসারে বলা যায় যে, ১৬৯০-এর কলকাতা, কমপক্ষে, একটি টাউন তো ছিলই, যেহেতু, বাণিজ্যিক কর্মচাঞ্চল্যের কেন্দ্র হিসাবে বড়োবাজারের মতন এক সুপারবাজার ও সেই বাণিজ্য অঞ্চল সংলগ্ন উপযুক্ত জনবসতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে একশো বছর আগেই একটি পরগনা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আঞ্চলিক শাসনকর্তার বাসভূমি বা ‘ডিহি’-তে পরিণত হয়েছিল।

তৃতীয় পাতা

Categories
প্রবন্ধ

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

কলকাতা একটি শ্রমতালুক

Truth is such a rare thing; it is delightful to tell it.
— Emily Dickinson

অর্থনৈতিকতার দ্বিবিধ প্রবৃত্তি— আমদানি ও রপ্তানি। তর্কাতীত এবং অনিবার্য এক সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করেই এই প্রবন্ধটি শুরু করতে চাই যে— জন্মলগ্ন থেকেই কলকাতা একটি রপ্তানি-ভিত্তিক বাণিজ্যিক শ্রমতালুক হিসাবে গড়ে উঠেছে। অমেয় শস্যভাণ্ডার, উন্নতশ্রেণির কাঁচা মালের সামীপ্য, বহুপ্রসূ কৃষি-ব্যবস্থা, এবং অভাবনীয় কারিগরি দক্ষতার সৌজন্যে বাংলার পণ্যসম্ভার একইসঙ্গে গুণগত সৌকর্য ও স্বল্প-বিনিময়মূল্যের অধিকারী হয়ে ওঠে। উৎপাদন-ব্যয় এতই কম হত যে, ব্রিটেনের তুলনায়, শতকরা পঞ্চাশ-ষাট ভাগ দাম কম রেখেও ভারতীয় সূতিবস্ত্র বিক্রি করে মুনাফা অর্জন সম্ভবপর ছিল। অতি গভীরে নিহিত গ্রামব্যবস্থার সঙ্গে তাঁত-শিল্প যুক্ত হয়ে বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর সেই সুবাদে, বাংলার বাকি অংশের সঙ্গে একযোগে, অন্তর্দেশীয় ও বহির্বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি হয়ে ওঠে বিস্তীর্ণ পশ্চাৎভূমি-সহ শ্রীময়ী সম্পদশালিনী ষোড়শী, সপ্তদশী কলকাতা। বস্তুত, প্রগাঢ় অর্থনৈতিক চাহিদা থেকেই এ-শহরের উত্থান। সুতরাং, সতেরোশোর কলকাতা একটি অখ্যাত গণ্ডগ্রাম বা পোড়ো শ্মশানভূমি গোছের জনবিরল মরুসদৃশ জনপদ ছিল— এ জাতীয় চালু কহাবত-বক্তব্য-মন্তব্যের ‘স-প্রমাণ’ তীব্র বিরোধিতাই হল এ-প্রবন্ধের মুখ্য চর্চাবস্তু।

এই তো সে-দিন (১৯৭১) কলকাতায় বেড়াতে এসে জিওফ্রে মুরহাউস সাফ জানিয়ে দিলেন যে, চার্ণকের ডাকে সাড়া দিয়েই না কি দলে দলে লোকজন এসে আদি (ব্রিটিশ) কলকাতায় বসবাস শুরু করে। আর সেই সূত্রেই না কি কলকাতার সামাজিক-অর্থনৈতিক-ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন ঘটেছে। তাঁকে ছাপিয়ে গিয়ে লন্ডনের আরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সমাজবিজ্ঞানী শ্রীমতী এরিকা বার্বিয়ানি, তথ্যপ্রযুক্তির গনগনে দ্বি-প্রহরে (২০০২) লেখেন— “সন ১৬৯০, যে-সময়ে ব্রিটিশরা বাংলায় এসেছিল, তার আগে কলকাতার অস্তিত্ব ছিল না… এই শহর আর তার এমন প্রতিচ্ছবিটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবদান।” এমনকী, সুখ্যাত অর্থনৈতিক ইতিহাস বিশেষজ্ঞ লুই ডুমন্টের মতোন ব্যক্তিত্বও মন্তব্য করেছেন যে, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বলতে যা বোঝায়, ভারতবর্ষে তা ব্রিটিশের হাত ধরেই শুরু হয়েছে। স্পটলাইটের মতোন এই তিনটি মন্তব্যের নিশানা হল ষোড়শ-সপ্তদশের আদি কলকাতা, তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, প্রাথমিক শিল্পায়ন ও প্রারম্ভিক নগরায়ণ। কিন্তু, শুধু কি বিদেশিরা? কলকাতা বিশেষজ্ঞ শ্রী পি.টি. নায়ার লিখেছেন— “সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর ছিল অজ পাড়া গাঁ। কয়েক ঘর মাত্র লোকের বাস ছিল। একমাত্র নাব্য ঋতুতে (জাহাজ আসা-যাওয়ার সময়ে) একটা হাট বসত ও কর্মব্যস্ততা দেখা দিত” (কলকাতার সৃষ্টি ও জবচার্ণক, পৃ. ১৫২)। কিংবা রাধারমণ মিত্রের নজরে ষোলোশো নব্বইয়ের এ-শহর ছিল ‘এক অখ্যাত গণ্ডগ্রাম’। সাধারণের মনেও যেরকম, ঐতিহাসিক অনুসন্ধানেও তেমনই— (ব্রিটিশ প্রচারযন্ত্রের বদান্যতায়) পাকাপোক্তভাবে ডেরা বেঁধেছে এইসব গল্প-কাহিনি। অথচ, প্রাক্‌-ব্রিটিশপর্বে—১) ভরপুর রপ্তানি-বাণিজ্য ছিল ২) ভারতীয়, বিশেষত বাংলার, পণ্যসৌরভের আকর্ষণে ছুটে এসেছিল তামাম পশ্চিম ইওরোপ। আর সেই বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি ছিল একালের কলকাতার ৩০/৪০ মাইল ব্যাসার্ধের অন্তর্গত ভাগীরথীর নিম্ন-অববাহিকা অঞ্চল। এতদ্‌সত্ত্বেও, আদি কলকাতার প্রাক্‌-ব্রিটিশ শিল্পকেন্দ্রিক অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দিহান হওয়া কি সম্ভব? ১৬৯০-পূর্ব মুঘল কলকাতায় কি যন্ত্র-ভিত্তিক শিল্পায়ণের পূর্বসুরি হিসাবে বুনিয়াদি ‘গ্রামীণ’ শিল্পের চহলপহল-হুড়হুজ্জত কি, বাস্তবিকই, ছিল। যদি থেকে থাকে, তবে কি— চার্ণকের আহ্বান (মুরহাউস) শহরের অনস্তিত্ব (বার্বিয়ানি) অথবা অর্থনীতিহীনতা (ডুমন্ট) প্রভৃতি মন্তব্যগুলো— নিছকই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রটনামাত্র? এইসব জট-জড়তা-জড়িমা-জটিলতাই, বস্তুত, এই প্রবন্ধের চর্চাবস্তু।

পুঁচকে ডিঙি দেখে অভ্যস্ত গ্রামবাসীর চোখের সামনে জলজ্যান্ত বিশাল জাহাজ, তাগড়া-হাট্টাগোট্টা শাদা চামড়া ঢের-গুচ্ছের! সচরাচর— ‘ই বস্তুটো কি?’— প্রশ্ন নিক্ষেপকারী কলকাতাবাসী ‘কয়েকঘর’ শ্রমিক-তাঁতি-চাষিসমাজ বিন্দুমাত্র কুতূহলী না হইয়া কলিযুগের অহল্যাজন্মে ঘুমাইয়া থাকিতেই পছন্দ করিলেন। কেন-না, তাঁহারা স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া প্রস্তরীভূত। শ্রীশ্রীরামচন্দ্রের নব-অবতার, চার্ণক নামধারী অভিজ্ঞ কাপ্তেন আসিয়া পাদস্পর্শে তাহাদের ধন্য করিবেন: তাঁহারা কর্মমুখর হইয়া উঠিবেন ইত্যাদি-প্রভৃতি। এই পর্ব থেকেই, বস্তুত, গোরুর কল্পতরুতে ওঠার প্রথম ভাগটির সূত্রপাত। শতকোটি আরব্যরজনী-কাহিনিতে আমরা বুঁদ হয়ে রইলাম। আজও মজে আছি। কিন্তু, ঘুমঘোরে থাকলেও, অনুত্তরিত ছিটফুট চিন্তার একটি-দু-টি মাঝে মাঝেই গেরিলা-আক্রমণ শানায়— যেমন—

• পণ্যের টানে পর্তুগিজ বাহিনী সপ্তগ্রামে এবং শেঠ-বসাকেরা সুতানুটি/গোবিন্দপুরে এসে থিতু হন। বাংলা তথা কলকাতার শিল্প বিকাশের ইতিহাসে এই দু-টি ঘটনা কি কোনো বিচ্ছিন্ন বৃত্তান্ত?
• মালিক (থুড়ি) পয়সা লগ্নিকারী শেঠেরা এলেন ১৫৫১-এ আর শ্রমিক-মুটে-তাঁতি-চাষিরা, চার্ণকের হাঁকডাকে, শয্যা ত্যাগ করিয়া, অকুস্থলে, হাজির হইলেন ১৬৯০-এ? ১৩৯ বছর পরে? এত্ত লম্বা ঘুম?
• ইতিহাসকার (সমস্বরে, দেশি-বিদেশি সবাই) বলছেন একেবারেই গণ্ডগ্রাম ছিল প্রাগাধুনিক কলকাতা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই প্রশ্ন করে বসি— ‘অজ পাড়াগাঁর তাহলে দু-দুটো মুখোমুখি বাজারের (বেতড়-সুতানুটির) প্রয়োজন কি ছিল?’ এই টুকরো তথ্যই কি জোরগলায় দাবি (হ্রস্ব-ই-কার) জানায় না যে, শিল্প-সমৃদ্ধি হামিনস্ত্‌, হামিনস্ত্‌, হামিনস্ত্‌, এখানেই ছিল!

আর্ণল্ড টয়েনবি, বিশ্ববিশ্রুত ব্রিটিশ অর্থনৈতিক-ইতিহাস বিশেষজ্ঞ— ১৭৬০-এ শুরু হয়ে ১৮৪০ পর্যন্ত জারি থাকা ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নাম দিয়েছিলেন শিল্পবিপ্লব। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকায় লেখা হয়েছে যে, কৃষি ও কুটির শিল্পভিত্তিক অর্থনৈতিকতা থেকে ভারীশিল্প এবং মেশিনজাত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বদল ঘটাই হল শিল্পবিপ্লব। এরই লাগোয়া সেঁটে রাখতে চাই সতেরো-আঠারো শতকের ভারতীয়/বাংলার শিল্পপ্রগতির ছবি, যার মৌতাতে আকৃষ্ট হয়ে ভারতমুখী হয়েছিল তামাম পশ্চিম ইওরোপ। বৃহৎশিল্প, যন্ত্র, মিল ও মেশিন ছাড়াই সারা পৃথিবীর শতকরা ২৫ ভাগ পণ্য উৎপাদিত হত ভারতবর্ষে। স্রেফ বাংলারই জি.ডি.পি ছিল ১২%। জুনি টং, জন এল এস্পোজিটো আর ইন্দ্রজিৎ রায়ের লেখা বইয়ে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সপ্তদশের মুঘল বাংলা উপমহাদেশের শতকরা ৫০ ভাগ আর বস্ত্র-কৃষি-জাহাজ শিল্পের দৌলতে সারা বিশ্বের ১২% জি.ডি.পি-র উৎপাদক ছিল। (খন্দকার হাশিম, ডেইলি স্টার পত্রিকা— ৩১/০৭/২০১৫) অমন যুগান্তকারী ও অভাবনীয় মাত্রার শিল্পোৎপাদনের চূড়ান্ত বা অন্তিম দিনক্ষণও জানিয়ে দিয়েছেন ঐতিহাসিকেরা— সন ১৭৫০। অর্থাৎ, ইংল্যান্ডীয় শিল্পবিপ্লবের ঢের আগেই শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল ভারতবর্ষে। কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মিল ও মেশিন ছাড়াই, শুধুমাত্র কুঠির ও হস্তশিল্পের দৌলতেই, ভারতবর্ষ অমন উচ্চতাকে ছুঁতে পেরেছিল। প্রখ্যাত অর্থনীতিশাস্ত্রী Coleman বলছেন যে, প্রাক্‌-শিল্পায়নের তিনটি শর্ত রয়েছে— ১) গ্রামীণ শিল্প, ২) বিদেশি বাজারের চাহিদা-সূত্রে রপ্তানি বাণিজ্য এবং ৩) স্থানীয় স্তরে— গ্রামীণ শিল্পের সঙ্গে কৃষিজপণ্যের বাণিজ্যিক তালমেল, যোগসাজস।

প্রধান সমস্যা হল (ইতিহাসসম্মত) প্রত্যক্ষ তথ্যের অভাব। তথ্য নেই— তাই সত্য অনুপস্থিত। কেউ মৃত, কিন্তু লাশ পড়ে থাকার অর্থ তো সে একসময় জীবিত ছিল। অতএব, পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। মজার কথা হল মিথ্যাকে নানান রঙে ছোপানো যায়। সুদর্শন চক্র দিয়ে সূর্যকেও ঢেকে ফেলা যায়। হয়তো কার্যসিদ্ধিও হয়। কিন্তু সত্যকে কাটাছেঁড়া করা যায় না। সে নিটোল, সে অমোঘ। তার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। নির্মল আলোকরশ্মির মতোই সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। শিল্পে জোয়ার আসিয়াছিল, কিন্তু ৪৮৮ বিঘা একটি বাজার থাকা সত্ত্বেও কলকাতা বেহুঁশ পড়েছিল— অভাবনীয় মনে হয় কি? অতএব, জুলি অ্যান্ড্রুজের ঢঙে নিজেকেই না হয় সাদামাঠা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই— ‘হাউ ডু ইউ সলভ্‌ এ প্রবলেম লাইক মারিয়া’।

শিল্পবিপ্লবের আগে— ইওরোপীয় সোনাদানা জমা হত ভারতীয় সিন্দুকে। পট পরিবর্তিত হয়, উনিশ শতকের শেষভাগে; উৎপাদিত পণ্যের বদলে ভারতীয় কাঁচামাল পৌঁছত ব্রিটিশ বাজারে। প্রশ্ন করব না— কেন? কী কারণে এই ফেরবদল? শহর-নগরের ইওরোপীয় ব্যাখ্যা আর ভারতীয় জীবনচর্যা-নগরায়ণ-শিল্পভাবনার মধ্যে মূলগত পার্থক্য ছিল। খুঁজে দেখব না তা কীরকম? মিল-মেশিনহীন কর্মক্ষমতার চূড়ান্ত যন্ত্রবৎ পারদর্শিতা, ভারত জুড়ে অজস্র কারখানা, কায়িক শ্রমের অশেষ স্রোতোময়তা, পনেরোশো মিলিয়ন জনসম্পদের গরিমা পরিবর্তিত হল কীভাবে অবশিল্পায়নের সরস্বতী-লুনি-হাকরায়: সেই ‘দি লস্ট রিভার’-এর (অ) জনগণতান্ত্রিকতার বিবরণী লিখে রাখব না? তবে, এই অক্ষর-হর্ম্য কেন, সিসিফাস?

(১৮২৯-এ প্রকাশিত ও উইকিপিডিয়ার ডিজিটাইজড্‌ তথ্য সংরক্ষণের সূত্রে প্রাপ্ত হিস্টোরিকাল অ্যান্ড ইক্লেস্টিকাল স্কেচেস, পৃ-১৬য় উল্লেখিত ঘটনাবলি অনুসারে) ১৬৮৮-তে যেখানে চার্ণককে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল, সেই উলুবেড়িয়া গ্রামটি ছিল ‘populous’ এবং কলকাতা থেকে (নীচের দিকে) মাত্র ২০ মাইল দূরে অবস্থিত। কিন্তু, তিন মাস না কাটাতেই চার্ণকের যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল, মন বসছিল না কিছুতেই। তাই (১৮২৯-এ ছাপা বইয়ের) ইতিহাসকার লিখেছেন: ‘obtained a permission to return to Suttanuttee’. ছ্যাঁকা লাগল যেন! ১৬৮৮-তে যার নিজেরই কোনো বসতঘর নেই, পাক্কা হাটুরে, সেই লোকই দু-বছর না কাটতেই তিনটে গ্রামের মালিক, যাকে পারছেন তাকে যেখানে খুশি বসে পড়ার অনুমতি দিচ্ছেন। কলকাতা কি মগের মুলুক ছিল না কি? ডিহিদার-জমিদার-তালুকদার-জাগিরদার-কোতোয়াল-জনসমাজ ইত্যাদি-প্রভৃতি কিছুই ছিল না কি? শাসনতন্ত্র, শাসক=প্রশাসক কিছুই না? তাহলে চার্ণক কার পারমিশন নিয়েছিলেন? কীসের অনুমতি? বেছে বেছে সুতানুটিকেই কেন মনে ধরেছিল কাপ্তেনের? ‘Populous’ উলুবেড়িয়ার চেয়ে কি ১৬৮৮-র সুতানুটি বেশি স্বাস্থ্যসম্মত ছিল? কিংবা এমন অর্থও তো করা সম্ভব যে, ইওরোপীয় নজরে, বিশেষত, আংরেজি শাদা মানুষের বোধবুদ্ধিতে অন্তত (ইউ অট টু আন্ডারস্ট্যান্ড)— সুতানটি সে-সময়ে লিভেবল, থুড়ি, বসতযোগ্য ছিল।

এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে, একটি শ্রমতালুক হিসাবেই নিজস্ব ছাপ রেখেছিল কলকাতা। কিন্তু, কবে থেকে সেই প্রশ্ন রেখেই শুরু করি বরং। সূত্রধরের মতন প্রথমেই জানিয়ে রাখি যে, মুরহাউসের উক্তিটিতেই মন্দোদরীর সিন্দুকটি খুঁজে পেয়েছি; ওখানেই তো কলকাতাকেন্দ্রিক মিথকথার মৃত্যুবাণ মজুত। সুস্পষ্ট হল ক্রমে যে, প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন সম্বন্ধে যে-প্রাথমিক বিশেষ শর্তের কথা অর্থশাস্ত্রীরা বলে থাকেন— সেই জনপ্লাবন, আপামর গরিবগুর্বোর যোগদানই তো মুরহাউসের বাণীর নিহিতার্থ, অর্থাৎ, জনপ্লাবন ও গ্রামীণ শিল্পায়ণের নাড়ীর যোগটি, বস্তুত, খুল্লমখুল্লা স্বীকার করা হয়েছে। অতএব, এ-প্রবন্ধের ‘ইতি গজঃ’ অংশের মূল বিচার্য হল

১) পের্লিন কথিত প্রি-কোপারনিকান ফেজ বা কুটির শিল্পের (গ্রাম্য) প্রাথমিকতা ও জনপ্লাবন।
২) বণিকী পুঁজির উত্থান। ‘দেশি’ শিল্পায়ণ এবং প্রাগাধুনিক নগরায়ণ।
৩) (ভারতীয়) অবশিল্পায়ন। চাষি-তাঁতি-সুতোকারবারি থেকে খানসামা-সরকার-খিদমদগার-পাঙ্খাপুলার-হুঁকোবরদারির জীবন।

জুলাই ২০০৪ হয়তো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় একটা কবিতা লিখেছিলাম, যার প্রথম পঙক্তিটা ছিল— ‘আর ওই শহুরে বকুলগন্ধ জানে কি শ্বেতকেশ ঘামের ইতিহাস?’ ২০২০-র এই সময় হলে, সুররিয়াল অনুষঙ্গ টেনে হয়তো জুড়ে দিতাম— ‘উদোম ভিজেছ কি যন্ত্রের স্বেদ-রক্তে-অনুভবে?’ শিল্পবিপ্লবের ফলে বাজারে এল বড়ো বড়ো মিল-মেশিন। কিন্তু, যান্ত্রিক পারদর্শিতার কাছে মানুষী প্রয়াসের অবর্ণনীয় শক্তি-জিগীষা-জীবনস্পৃহার কি কোনোই দাম নেই? নতুবা, লুই ডুমন্টের প্রাজ্ঞ সুচেতনায় আমরা কীভাবে পাই— ‘No doubt there is in India today a distinct sphere of activity which may properly be called economic, but it was the British government which made this possible.’ প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অ্যান্ড প্রি-কলোনিয়াল সাউথ এশিয়া প্রবন্ধে প্রখ্যাত অর্থনৈতিক ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ফ্র্যাঙ্ক পের্লিন ডুমন্টের ওই মন্তব্যটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আমরা তো শুনেছি-জেনেছি ব্রিটিশ লুঠতরাজ, পরিকল্পিত কুশাসন ও ব্রিটিশ স্বার্থবাহী নানাবিধ আইন প্রণয়নের জন্য ভারতে ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন বা অবশিল্পায়ন ঘটেছিল। বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষ যে-পণ্যসম্ভার বিদেশে রপ্তানি করত, তা কি শিল্পজাত পণ্য নয়? কুটির বা হস্তশিল্প কি শিল্পের সংজ্ঞা বহির্ভূত? প্রাসাদ-অট্টালিকা থাকলেই তবে শহর হিসাবে গণ্য হবে, অন্যথা নয়?

১.জনপ্লাবন ও গ্রামীণ শিল্পায়ন
পের্লিন লিখেছেন যে— ‘আই শ্যাল সাজেস্ট দ্যাট ইভেন্টস উয়িদিন ইন্ডিয়া নিড টু বি রিকাস্ট”… আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল ভারতীয় (শিল্প) প্রয়াস— ‘in which rural industrialization in Prussia, Bohemia and Bengal are best treated as aspects of single-set…’ উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে যে, ফ্র্যাঙ্কলিন মেণ্ডেল ডক্টরাল থিসিস হিসাবে ‘প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ তত্ত্বটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে গ্রামীণ শিল্পের কথা বলেন। মেণ্ডেল মনে করতেন যে, গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজ বন্ধ থাকার সময়ে (বাড়তি) শ্রমদানের পরিস্থিতি তৈরি হত। সেই (বাড়তি) শ্রম ব্যবহার করে, প্রথম দিকে, গ্রামীণ আয় বাড়ানোর সুযোগ হয়, যা শহুরে সঙ্ঘ-মন্ডিগুলোর একচেটিয়া কারবারের মূলে মারাত্মক আঘাত হানে। পাশাপাশি, জনসংখ্যা বৃদ্ধিরও সহায়ক হয়ে ওঠে। ওই বর্ধিত জনগণের যোগদানের কারণে উৎপাদনের জোয়ার আসে; বাড়তি শ্রমিকশ্রেণি ও গ্রামীণ পুঁজির সহায়তায় শিল্পোন্নয়নের আবহ সৃষ্টি হয়। মেণ্ডেল-এর মতে ‘প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’=বিদেশি বাজারের জন্য উৎপাদিত বাণিজ্যিক কৃষিপণ্যের সঙ্গে গ্রামীণ হস্তশিল্পের আঞ্চলিক বিকাশ। প্রাক্‌-ব্রিটিশ কালখণ্ডের সঙ্গে বাংলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কী অপূর্ব সাদৃশ্য, ঐকতান। সুলতানি-মুঘল যুগের কালধর্মিতার জেরক্সকপি যেন। কিংবা পের্লিন যেভাবে বলেছেন— ‘Proto-Industrialisation being the first and necessary phase of transition to industrial capitalism… Proto-Industrialisation… has been described in regions which would eventually industrialise and those which would instead stagnate, Japan And England on the one hand, Brittany and Bengal on the other. It concern domestic manufacture before industrialization but also that which coexisted and even rose alongside factory production.’ পের্লিনের মন্তব্য অনুযায়ী আধুনিক শিল্পবিপ্লবের পূর্বসূরি হল ‘গ্রামীণ’ বুনিয়াদি শিল্প বা ‘প্রোটো ইন্ডাস্ট্রি’। তাঁর মতে ইওরোপ-এশিয়ার অগ্রণী কিছু জায়গায় শিল্পায়নের প্রথম পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়। সেইসমস্ত জায়গাগুলোকেও ফের দু-ভাগে ভাগ করেছেন তিনি। ১) যে-সমস্ত জায়গাগুলো শিল্পায়নের পথে এগিয়েছিল যেমন জাপান ও ইংল্যান্ড। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের দেশগুলো হল ব্রিটানি ও বাংলা। তারা অবশিল্পায়নের পথে হেঁটেছিল। পের্লিনের এই মন্তব্যের অর্থ হয় যে, বাংলায় বুনিয়াদি শিল্প বা ‘প্রোটো ইন্ডাস্ট্রি’ ছিল। ব্রিটিশের স্বার্থপরতায় বাংলার শিল্পসম্ভাবনার চারাটি শুকিয়ে গিয়েছিল। বাংলায় তাই পরবর্তীকালে অবশিল্পায়ন দেখা দিয়েছিল। ভারি মজার এক কার্টুন দেখলাম ফেবু-তে। জি.ডি.পি-র টবে কেউ ঝারি দিয়ে জল ঢেলেছিলেন, আর কেউ কেটলি দিয়ে গর্মাগরম চা ঢালছেন। হাঃ, ব্রিটিশ লিনিয়েজ। চাষি-তাঁতি-মুটে-সুতোকারবারি–সেদিনের মেট্রোচালক নাবিক ইত্যাদি দু-এক কোটি পোশাক বদল করে রঙ্গমঞ্চে ফের: সিঁথি-সিলামপুর-ধারাভি-জে.জে.ক্লাস্টার-মাল্লাপুরম-ভায়ন্দর-চারমিনার-বেলেঘাটা বস্তির শ্রীহীন চেতন খিদমদগার, বিপুল (মোটু) খানসামা, কেষ্টা পরামাণিক, গুপি হরকরা, মশালচি ভগমান, বাপু সহিস, নর্মসহচরী রমা, পুটুস হুঁকোবরদার…

হ্যামিল্টনের হিসাব অনুযায়ী ১৭১০-এ বারো হাজার আর জেফানিয়া হলওয়েলের ১৭৫২-য় চার লাখ নয় হাজার। অর্থ হয়, ফি-বছর গড়ে ৯৮০০জন লোক কলকাতা শহরে বাসা বেঁধেছিল। প্রচলিত ইতিহাস যদিও গঙ্গাতীরবর্তী মুষ্টিমেয় কয়টি (ব্রিটিশ প্রভাবিত) জনপদের মধ্যেই এই শহরাঞ্চলকে সীমিত রেখেছে। সেখানে শ্যালদা নেই, বাগমারি বা বেলেঘাটা! ওরা কিন্তু, (১৫৮০-র) চণ্ডীমঙ্গলে ছিল কিংবা (১৫৯৫-এর) আইন-ই-আকবরীতে রয়েছে। চোখ খুলেই যা দেখা যায়, তা আমরা দেখতে পাই না! দেখাশোনার আগেই সুর ভাঁজি— প্রভু দেখেছে কি? ফ্র্যাঙ্ক পের্লিন-এর মতে পূর্বানুমাণ, পদ্ধতিগত প্রচলন, প্রাপ্তব্য ব্যাখ্যা ও তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে পণ্ডিতেরা মনে করেন যে, প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক ভারতীয় অর্থনৈতিকতা নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে। সেই কারণে প্রাক্‌-ব্রিটিশ পর্বের ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাসকে ‘প্রি-কোপারনিকান ফেজ’ অর্থাৎ, মূলগত বা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পূর্বাবস্থার পরিস্থিতি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন পের্লিন। লক্ষণীয় বিষয় হল যে, ইংলন্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটার আগে ইওরোপ থেকে সোনারূপা জমা হত ভারতীয় বাজারে।

দ্বিতীয় পাতা

Categories
গল্প

শুভদীপ ঘোষের গল্প

শীতঘুম

তৎক্ষণাৎ ফোন করে বিমলকে পায় না অনিরা। সপ্তাহখানেক বাদে ফোনে পায়। শরীর যদিও একটু দুর্বল তথাপি ভালো আছেন। ডাক্তার অনেকটা এরকম বলেছেন বিমল জানায়, স্ত্রেপটোমাইসিন টিবির জার্মকে ঠিক মেরে ফেলে না, ওটা জার্মগুলোর চারপাশে একটা শেল তৈরি করে, বলের মতো, জার্মগুলো কনশিল্ড থাকে নির্জীব ও নির্বিষ হয়ে ওই বলয়ের ভিতরে, আজীবন। মানুষটি ওইভাবেই পুরোপুরি সুস্থ জীবন কাটিয়ে দিতে পারে উইথ অল নরমাল একটিভিটিস। অনেক সময় অনেকদিন বাদে, ওইরকম একটা দুটো শেল ড্রপলেটের সাথে বাইরে এসে পরে। এর কিছু মাস পরে আবার বিমলের সাথে দেখা হয় ওদের হিচককের বার্ডস দেখতে গিয়ে। পীড়নের উপকরণ হিসেবে তৈরি করা অস্ত্র ছাড়া, মানুষ যে পৃথিবীর যে-কোনো ক্রিচারের কাছেই নিতান্ত অসহায় এবং সবচেয়ে দুর্বল একটি প্রাণী, ফিকশানের মুনশিয়ানার বাইরে গিয়ে অন্ধকারে কালো কালো মাথাগুলির কতজন সেটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলা মুশকিল, কিন্তু বিমলকে সেদিন অনিদের বয়েসের ভারে ওই প্রথমবারের জন্য ন্যুব্জ ও কিঞ্চিৎ দুর্বল বলে মনে হয়েছিল। কখনো কখনো নিবিষ্ট অতীত অন্বেষণের মধ্যে ভবিষ্যতের নিরুচ্চার দাগ থেকে যায় কোথাও যেন! ফিটন গাড়িতে অপু যেরকম তাঁর আশা ও সর্বনাশ দু-টিই দেখতে পেয়েছিল অপর্ণার চোখের কাজলে!

এরপরেও আরও বছর দু-য়েক ওদের দেখা সাক্ষাৎ ছিল। এরই মধ্যে অনি অতনু চাকরিতে ঢোকে, অনির অন্যান্য সময় কমে আসে, অতনু যদিও এবং অনস্বীকার্য যে, খানিকটা বিমলের অনুসরণেই থিয়েটারে সখের অভিনয়ে ঢোকে, কিন্তু বিমলের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমেই শূন্য হতে থাকে। আরও প্রায় তিন চার বছর পরে দু-হাজার তেরো চোদ্দ সাল নাগাদ, অতনু অনিকে জানায় বিমলকে অনেকবারের চেষ্টায় শেষমেশ পাওয়া গেছে। বিয়ের নেমন্তন্ন করতে গিয়ে দীর্ঘ কথোপকথনের ভিতর দিয়ে অতনু জানতে পারে বিমলের শরীর পুনরায় ওই ড্রপলেটের ঘটনাটার পর থেকেই ক্রমশ খারাপ হতে থাকে, বছর চারেক আগে ওর লিউকেমিয়া ধরা পড়ে! ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হসপিটালে ভর্তি হন। দীর্ঘ চিকিৎসা চলে কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। সামুহিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গোটা পরিবার। যাবতীয় আশা যখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে ঠিক সেই সময় ওই নির্দিষ্ট লিউকেমিয়াটির ওষুধ আচমকা বেরোয় জার্মানিতে। হেয়ারপিন লিউকেমিয়া। কলকাতায় খবর আসে কিন্তু ওষুধ আসে না। প্রায় কয়েক লক্ষ টাকা ধারদেনা করে ওষুধটা আনানো হয় মুম্বাই থেকে। প্রাণদায়ী হয়, কিন্তু ডাক্তাররা জানিয়ে দেন এর একটা পর্যায়ক্রমিক সারভাইবালের ব্যাপার আছে। বিমলকে পাঁচ বছরের মাথায় আবার টেস্ট করে দেখতে হবে যে, ব্যাপারটা উইদিন রেঞ্জ আছে কি না, যদি থাকে তাহলে এর লংজিভিটি বেড়ে দাঁড়াবে দশ বছর, অতঃপর একই প্রক্রিয়া। এইসব কথার মধ্যেই অতনুকে বিমল নির্লিপ্তভাবে জানায় যে, চিকিৎসার খরচের জন্য সে বউ মেয়েকে কিডনি পর্যন্ত বেঁচে দিতে ফোর্স করেছিল, সে-সবের অবশ্য দরকার পরেনি শেষ পর্যন্ত।
জানালায় ধাক্কা লাগার শব্দে অনির ঘুম ভেঙে যায়। অনি একটু উঠে ধাক্কা দিয়ে জানালা খুলে দেখে বাইরে ঝড় হচ্ছে। বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখে রুপা ঘুমে অচেতন, আবার জানালায় শব্দ। রুপা জেগে থাকলে নির্ঘাত এই প্রথম ভোরেও হপ্তা তিনেক আগের ঘটে যাওয়া সাইক্লোন ও তৎ সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতির স্মৃতি আর একবার রোমন্থন করত। জানালা ভেজিয়ে দিয়ে মোবাইল ফোনটা খুলে দেখে ভোর চারটে। রাত দুটো নাগাদ সোমেশ্বরের দুটো ফিড এসেছিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে চরম সঙ্কটে পড়েছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার গুলি, সংক্রমণের চাপ গ্রাম ভারতে ক্রমবর্ধমান, সামলাতে হিমশিম অবস্থা এবং দুই, নৈহাটি অঞ্চলে রাস্তায় যে-ময়ূর দু-টিকে সন্তর্পণে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছিল ও গান্ধীনগরের রাস্তায় যে-হরিণগুলিকে, বনদপ্তর জানিয়েছে তাদের মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিয়েছে! অনি অবজ্ঞা ভরে ফিডদুটোকে সরিয়ে দেয়, দেশে সংক্রমণের সংখ্যা যবে লাখ সোয়া লাখ ছাড়িয়েছে তবে থেকে এসবের খবর রাখা ও বন্ধ করে দিয়েছে, কানে ঘাড়ে ভালো করে জল দিয়ে গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে।

ঘুম ভেঙে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে, উঠবে উঠবে করছে, সাড়ে সাতটা বাজে, মোবাইল বেজে ওঠে।

‘ঘুম থেকে উঠেছিস!’— অতনু

‘বলো?’

‘কুন্দনন্দিনী, মনে পড়ছে?’— অতনু

‘কে!?’— ঝাঁঝালো গলা

‘আরে খানদানী খানদানী, বিমলদা বলেছিল, হাঃ হাঃ এবার মনে পড়বে। পরশু রাস্তার মাঝখানে আমায় ধরে ফোন নাম্বার দিল, নতুন নাম্বার, বলল বিমলদার খুব দরকার। আমার কৌতূহলি চোখ দেখে শরীর নাচিয়ে বলল ‘যোগাযোগ আছে, আরে এই গতরটাকে এড়ানো অত সহজ না কি!’, আমার বিশ্বাসযোগ্য লাগেনি অবশ্য কোনো কথাই’— অতনু

‘সাতসকালে এ-সব শোনানোর জন্য ফোন করেছিস বলে তো মনে হয় না, যোগাযোগ হয়েছিল কি?’

‘আমায় করতে হয়নি, নিজেই ফোন করেছিলেন গতকাল রাতে, অল্প কথা তো কোনোকালেই বলতে পারেন না, যেতে বলছেন তোকে আমাকে শিগগিরি, বললেন, ‘রক্তের কথা রক্তের সম্পর্কের বাইরে তো তোমাদেরই বলেছি, কিন্তু এটা আর কেউ জানে না গলা একটু জড়ানো মনে হল যদিও’— অতনু

‘কথাটা কি বলবি তো?’

‘সলিডারিটি ট্রায়ালের ব্যাপারটা জানিস তো? হু যেটা করে বিভিন্ন সময়ে। এই সংক্রমণের মধ্যে অক্সফোর্ড, ইতালি, ইসরায়েল কোথাওই ভ্যাকসিন ট্রায়াল অবশ্য তেমন ফলপ্রদ হয়নি। ভারতেও না কি শুরু হয়েছে কিছুদিন হল। বললেন কীভাবে হয় জানি কি না, বলে নিজেই বলতে শুরু করলেন!’— অতনু

‘হ্যাঁ জানি পদ্ধতিটা, দু-তিনটে গ্রুপে ভাগ করা হয় নন-ইনফেকটেড পারসনদের, একটা গ্রুপকে ভ্যাক্সিনাইজড করা হয় আরেকটা গ্রুপকে করা হয় না, অ্যান্ড দে আর অ্যালাউড টু বি এক্সপসড উইথ দ্য ইনফেকটেড পিপল, কিছুদিন পরে দুটো গ্রুপ থেকেই দেখা হয় কতজন ইনফেকটেড হল, তার উপর মানে সেই ডেটার উপর সাম্পলিং আর ইনফারেন্স করা হয় কতটা এফেকটিভ সেটা বোঝার জন্য, মাইক্রোবায়োলজিস্টদের কাজ, ডাক্তারদের খুব তেমন ধারণা থাকে না। অঙ্কে আমাদের পিজি পর্যন্ত পড়তে হয়েছিল স্ট্যাটিস্টিকসটা। কিন্তুউ!’

আকাশে বিদ্যুতের বলিরেখা আর তার শব্দের মধ্যে যে ক্ষণের উৎকণ্ঠা থাকে সেইরকম যেন, ‘উনি ওই ট্রাইয়ালে যেতে চান, বললেন, ‘আমার তো আর কিছু নেই’, শরীরের যা হাল, তাই নিজে আসার আগে উনি চান যাতে আমরা গিয়ে সরজমিনে ওনার হাল হকিকত একবার দেখে আসি’— অতনু

ক্ষণিকের নৈঃশব্দ্য, ‘কী অদ্ভুত! তুই কী বললি?’

‘না বলিনি’, তবে উনি বললেন, ‘আহত স্যার ফিলিপ সিডনি, জুটফেন নামক যুদ্ধে, জলের পাত্র তুলে দিচ্ছেন এক সৈনিকের হাতে, সম্ভবত রন এম্বেলটনের ইলাসট্রেশান ছিল, একটা এক্সেবিসানে এ-ছবি দেখে আমরা অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম, তোমাদের মনে আছে? আজ কেন জানি না অনেকটা সেরকম অনুভূতি হচ্ছে কথাটা জানিয়ে।’’— অতনু

অনি চিরকাল দেখেছে জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে ওর ভাবনাগুলো কীরকম যেন হয়ে যায়! অপঘাতে মৃত্যুর খবর শুনেছে কিন্তু নিজে কখনো অপঘাতে মৃত মানুষ দেখেনি, বাজ পড়ে মৃত্যুর খবর শুনেছে কিন্তু বাজ পড়া মৃতদেহ কখনো দেখেনি, এমনকী বাজে পোড়া গাছ পর্যন্ত নয়, এইসব মনে আসতে থাকে।

এর সপ্তাহখানেক বাদে দোনোমনা করে একবার যাওয়া স্থির করে ওরা, কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে না। যা এতদিন নিয়ন্ত্রণে রাখা গিয়েছিল, কোটিকোটি অসহায় পরিযায়ী মানুষের ক্রমান্বয় পদধ্বনিতে সেই গ্রাম ভারত এবং বাংলার গ্রাম লাল তালিকাভুক্ত হয়ে পড়ে অবশেষে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে।

প্রথম পাতা

Categories
কবিতা

বিজয় দে’র কবিতা

সান্ধ্য কবিতাগুচ্ছ

গেস্টাপো

যাকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে সেই মিস্টার এক্সকে আমি কি চিনি? এই শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীর দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শতাব্দীর ওপার থেকেই যেন উত্তর এল “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি নিশ্চয় চেনো”
আমার তো প্রশ্নের শেষ নেই।
“মিস্টার এক্স কি এই দেশেতেই থাকেন? বসবাস করছেন? নাকি অন্য কোনও দেশ থেকে এখানে আসবেন?”
কাটা কাটা উত্তর এল “ তিনি ভূত ও ঈশ্বরের মতো সর্বত্র বিরাজমান। তিনি ছিলেন। তিনি আছেন। তিনি থাকবেন”

“আমি কি ধর্ম ধুয়ে জল খাব?” চায়ের দোকানে বসে যিনি টেবিল চাপড়ে এই কথাটা বললেন, তার উলটোদিকেই আরেকজন, তিনি কিন্তু কথাটা শুনলেন তারপর, খুব শান্ত স্বরেই বললেন “চুপ। চুপ্। মিস্টার এক্স এসব কথা শুনলে খুবই রাগ করবেন, দেয়ালেরও দু-কান আছে। তিনি নিশ্চয় কাছাকাছি কোথাও আছেন”

“একটা পিয়ানোর তার গলায় পেঁচিয়ে যদি সিলিং থেকে আপনাকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়, তবে আপনার কীরকম লাগবে? খরচ একেবারে নেই, সময়ও মোটামুটি কম, ধড় থেকে মুন্ডুটা কেটে বেরিয়ে আসতে যেটুকু। বিচ্ছিন্ন হওয়ার, এই ফাঁকে আপনি একটু ছোটোখাটো স্বপ্নও দেখে নিতে পারেন”

তিনি অন্ধকারে আছেন। মুখ দ্যাখা যাচ্ছে না। আমিও আরেক অন্ধকার থেকে এই প্রথম তাকে জিজ্ঞেস করলাম “তাহলে আপনিই মিস্টার এক্স? নাকি অন্য কিছু?
যেন শতাব্দীর ওপারের অন্ধকার থেকে একটি উত্তর ভেসে এল “আমি গেস্টাপো”

সাদা জামা
“একদিন এই বাড়িগুলো সব ভূতের বাড়ি হয়ে যাবে”

ইদানীং এরকম একটা কথা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে
ম্যুনিসিপ্যালিটির লোকজন এই দিকে আসে। তাদের গায়ে সাদা পোশাক। হাতে সাদা চক

কোনো বাড়ি ভূতগ্রস্ত হলেই তারা নাকি দরোজায় দাগ দিয়ে যাবে

কিন্তু ভূত হবে কী করে? এখানে কেউ ভূত-প্রস্তুত প্রণালী জানে বলে শুনিনি

সকাল-বিকাল ব্যালকনি থেকে সামনের সরু গলিটির দিকে তাকিয়ে থাকি…
ওই, ওই বুঝি ওরা এল

গা শিউরে ওঠে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। সজোরে স্ত্রী আমার হাত চেপে রাখে

এতটাই আতঙ্ক যে, সে ঘরের ভেতরের সব সাদা জামা কাপড় কোথাও না
কোথাও লুকিয়ে রাখে

“একটাও সাদা জামা যেন চোখের সামনে না থাকে”

আর আমি মনে মনে আমার সব সাদা জামাকে মৃত বলে ঘোষণা করি

চোপা

আপনি নিজের কবিতার ভেতরে নিজেরই আগাপাশতলা বমি আপনি জমি দখলের লড়াইয়ে একজন চতুর ও সহজ পলাতক
আপনি গর্তে গর্তে যতদূর আপনি ইঁদূরের ভেতরে ইঁদুরও ততদূর আপনি নিজের মৃতদেহের চামড়ায় লেগে থাকা স্বদেশের মানচিত্র

তুমি পুস্তকের একশো চল্লিশ পৃষ্ঠায় লিপ্ত গোপন সংক্রমণ তুমি হাজার মেঘের ভিড়ে একমাত্র মাছের বাজার
তুমি অন্ধকার বটপাতার ওপরে একাকী মূহ্যমান শামুক তুমি সবুজ পূর্ণিমার স্রোতে ভাসমান ভুতুম প্যাঁচার নির্যাস

তুই একটা ভাঙা দোতারা থেকে ছিট্‌কে-পড়া গানের কঙ্কাল তুই একটা কাচের বোতলের ভেতরে নষ্ট চাঁদের কুলকুচি
তুই সমস্ত হর্ষধ্বনির ভেতরে উড়তে থাকা ছাই-সমগ্র তুই দিনান্তে পাখিটোলার ভেতরে ডাহুক-শালিখের ওলাওঠা

অ্যান্টার্কটিকা

এই সুগন্ধ শিশু, সাদা ও সমৃদ্ধ। শিশুটির হাত ছুঁয়ে ফেলতেই সুগন্ধ সাতকাহন
তেঁতুলতলার মাঠ পেরিয়ে খোলাবাজারের দিকে চলে যায়
শিশুটি বলল “চলো তোমাকে একটা ধবধবে সাদা ও শীতল দেশ দেখাই ওখানে
আমি কখনও কখনও স্বর্গের গন্ধ হয়ে বসবাস করি
তখন এক সুদূরের বালক এসে আমার দুই হাতে নতুন নতুন পালক লাগিয়ে দিয়ে
চলে গেল, যেন আমি একটা পাখি। সুগন্ধ আমার পথপ্রদর্শক

এমন যে একটি দেশ আছে, জানতাম না, যেখানে গোটা দেশটাকেই সমাধিক্ষেত্র
মনে হয়। আমি এখানে পৌঁছে দেখি আগেই সুগন্ধ বরফ হয়ে বসে আছে

এতদিন আমি কোনও কথা বলিনি। আজ বললাম “তুমি কি শুধুই শিশু নাকি শুধু
সুগন্ধ নাকি সমাধিক্ষেত্রের চাতালে নিছক এক পাতা বরফ

উত্তর এল “আমিই একমাত্র দেশ, আমি একমাত্র সুগন্ধ, আমি একমাত্র শিশু
এই দেশ থেকে তোমাদের দেশের বাড়ি যেতে আমার মাত্র দেড় মিনিট

গাছবন্দি

গাছ কখনো জামা-কাপড় পরে না। তার কোনো লজ্জাবোধ নেই। গাছকে একদিন পোশাক-আশাকের
দোকানে অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে

গাছ কি কখনো ঘেউ ঘেউ করতে পারে? আমি অন্তত শুনিনি। কিন্তু কেউ কেউ নাকি শুনতে পায়। এবং
তাদের কেউ কেউ গভীর রাতে গাছের মুখে জাল গলায় শেকল পরিয়ে দিয়ে আসে

গাছের কিন্তু খুব খিদে আছে। তবে তারা যা খায় সব অনুবাদ করে খায়। প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা
চাঁদ বা সূর্য গিলে খেতে পারে না

গাছে গাছে নাকি খুব প্রেম। যারা প্রেমের কবিতা লিখতে পারে না তাদের চিবুক ছুঁয়ে গাছ একটা ছোট্ট মন্ত্র
পড়ে “লেবুপাতা করম চা শরীর চায় গরম চা”। তারপর কবিতা আসে সপ্রেমে

তোমরা কি কেউ তুতুলগাছ চেন? এই একটি গাছ, যার সামনে দাঁড়ালে মন ভালো। না দাঁড়ালেও। মন
খারাপ হলে দু’মিনিট দাঁড়াই; কথা বলি। তুতুলগাছের সাথে মন বিনিময় সব গাছ জানে

আমাকে গাউচ্ছা বলতে পারো কিম্বা গাছুয়া। অসুবিধে নেই। কিন্তু গাছকে কেউ বৃক্ষ বললে গাছ খুব লজ্জা
পায়। আর কেন যে আমার চোখমুখ লাল হয়ে আসে জানি না

টাঙ্কি

— তুমি একটু কুসুমবনে মেঘের ঘনঘটা… এই গানটা গাইতে পারবে?
— আহা, তোর বুকটা এত ফাঁকা ফাঁকা কেন রে? তুই কি অসুখ?
— তোমার মুখটা যেন ঠিক লবণদানি, এবার একটু পানিয়াল হয়ে যাও
— এবার বসন্তে আমরা সব হসন্ত বিসর্জন দিয়ে দেব

ব্যালকনির হুকে একটি নীল তোয়ালে ঝুলছে। ঝুলছে মানে ভেজা তোয়ালেটি
হাওয়ায় শুকোচ্ছে। নীল তোয়ালের লোমে বা পশমে অনেকদিনের ঘুম ও জাগরণ
তাদের গায়েও লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক হাওয়া

উলটোদিকের বারান্দায় একটি লাল রঙের তোয়ালে। তার গায়েও অনেক কথা লেখা। সে
কিন্তু একটু বেশিই বলতে চায়। সেইসব কথার অনেক চোখ আছে। সেইসব চোখের অনেক
মরিয়া দৃষ্টি আছে। সেইসব দৃষ্টি থেকে কুসুম কুসুম অনেক গল্প

আমি ওদের মাঝখানে যেতেই দু-টি তোয়ালে
আকাশের দু-রকম মুখ হয়ে গেল

নীল তোয়ালের বুক থেকে লজ্জ্বা আর
লজ্জ্বার বুক থেকে ব-ফলা খসে গিয়ে উড়ে গেল
লাল তোয়ালের বুকের দিকে

তোয়ালেও মানুষ; আর তোয়ালেকে মানুষ ভেবে
আমার জীবনে যে কত ভুল

কবি যখন

কবি যখন ছবি আঁকে তখন সেটা ট্রামলাইন না হয়ে আর উপায় থাকে না

আমার চোখের সামনে একটি ছবি; কাচ দিয়ে বাঁধানো ট্রামলাইন। চোখের সামনে থেকে
দৃশ্য শুরু হয় তারপর ট্রামলাইন ক্রমশ মিশে যায় দিগন্তের দিকে

ট্রামলাইন দেখতে দেখতে আমার ঘুমে অনেক চাঁদের উদয়, আবার দেখতে দেখতে
অনেক চাঁদের অস্ত। একটা ঘণ্টাধ্বনি টিংটিংটিং চলতে থাকে আমার ঘুমের সঙ্গে

আমাদের জলপাইগুড়িতে শেষে ট্রামলাইন পাতা হয়ে গেল? খবরটা শুনেই আমি রাস্তায়। ট্রামলাইন খুঁজতে আমি
এপথে-সেপথে। একটা দুর্ঘটনার আশঙ্কা আমার পিছে পিছে আসছে

কবি যখন ছবি আঁকে তখন ট্রামলাইন মুছে দেয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না

Categories
গল্প

শুভদীপ ঘোষের গল্প

শীতঘুম

বাপ ঠাকুরদার ঠিকুজি কোষ্ঠী নিয়ে ভারত সরকারের পার্লামেন্টে আনা যে-বিলটা তুমুল বাক্বিতণ্ডার পর অবশেষে পাস হয়ে গেল সেই নিয়ে অনিমেষদের তর্কাতর্কির শেষ ছিল না। গোবলয়ের হিন্দুত্ব, রাডিক্যাল ইসলাম, ভারতবর্ষের পেরিনিয়াল হিন্দু মুসলমান সমস্যা এইসব নিয়ে দুপুরের খাওয়ার টেবিল গরম হয়ে থাকত। একটা ছোটোখাটো গ্রুপ ছিল অনিদের, যাবতীয় প্রলোভন, যুগের মুদ্রাদোষ এইসবের পরেও মাথার কিছু জায়গা খালি থাকত কিংবা বলা যেতে পারে জিনগত ত্রুটির কারণে এইসব অর্বাচীন ব্যাপার নিয়ে সময় নষ্ট করার বদভ্যাস ছিল ওদের। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও ক্রমপাতনশীল অর্থনীতি না কি হিন্দু মুসলমান সমস্যা কোনটা আসল কোনটা বানানো, কোনটা অগ্রাধিকার যোগ্য কোনটা তুচ্ছ, হ্যাঁ বেশ মনে আছে সেই সময় খুব কথা হত এইসব নিয়ে। কিন্তু পরা-বাস্তবতার আভাস সে-সময় বাতাসে একটা কোথাও ছিলই! অনি এসে খাওয়ার টেবিলে সোমকে বলে ‘ব্যাপার মোটেই সুবিধের নয়, অলরেডি ইউরোপ ইনফেক্টেড, ইরান, ইতালি, চীন তো আছেই, এখন শুধু পায়ের নীচের গলিগুলো দিয়ে এখানে ছড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষা, সেটা হলে কিন্তু আমাদের কমপ্লিট মারা যাবে!’ চারপাশে তাকিয়ে হাতের ভঙ্গিতে দেখায় অনি। নকশাল পন্থী যে-দলটা মার্কসবাদী লেনিনবাদী নামে পার্লামেন্টের রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত থেকে যায় সোমের বাবা সেই পার্টির হোল টাইমার ছিল। অফিসে এসেছে থেকে অনি দেখেছে সোমও যে-কোনো ব্যাপারে সেই পার্টির ব্যাখ্যাটাই আগে দিত। কিন্তু বিগত এক-দু-বছরে এর পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যক্তিগত কোনো কারণ থাকতে পারে এবং তা হয়তো এমনই যে, তাতে ব্যক্তিগতও হয়ে যেতে পারত, তাই এই পরিবর্তন। এইসব ঠিকই ছিল, ছেচল্লিশের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ও তৎপরবর্তী দাঙ্গা, চরম-নরমপন্থী কংগ্রেস, শক্তির সমতুল্যতা এই পর্যন্তও চলছিল, কিন্তু গৈরিক ভারতবর্ষের একপেশে ধারণা নিয়ে একবার তুমুল বাক্বিতণ্ডার পর থেকে অনিরা সোমেশ্বর ওরফে সোমের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা একটু বুঝেশুঝে করত। ‘আমাদের এখানে তো তেমন প্রভাব পড়বে না বলছে, ওয়েদারের জন্য’— পাশের টেবিল থেকে গলা ভেসে আসে। অনিরা যেখানে খাওয়া দাওয়া করে সেটা ওদের অফিস কমপ্লেক্সের কমনগ্রাউন্ড, ওরা কয়েকদিন ধরেই লক্ষ করেছে অনেকেরই মুখে মাস্ক দেখা যাচ্ছে। অতনুর অফিস পাশেই। অতনুও মাঝে মাঝে খেতে আসে ওদের সঙ্গে, বিকেলে চা খেতে বেরিয়ে প্রতিদিন দেখা হয়। সেদিন চা খেতে বেরিয়েও ওই একই ছবি।

এর হপ্তা তিনেক পর। বিকেলের শেষ সূর্যের আলোয় অনিমেষ অফিস থেকে সময়ের আগে বেড়িয়ে পড়ে। অতনুর কাউনসেলর বলেছিল রিপ্রেশন নির্জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়। এমন কোনো ইচ্ছে যা অবদমিত কিন্তু আপনাকে মাঝে মাঝেই পীড়ন করছে। মানুষের সেইসব শারীরিক ও মানসিক অভিজ্ঞতা না কি অতিদ্বেষাত্মক। নন্দনচর্চার কথা শুনে অনিকে ওই ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘সব কিছুর শেষে দেখবেন একজন কবি বসে থাকেন’, ওঁর কথা নয়। অবাধ যোগসাজশ যদিও বলা যাবে না মানে যাকে ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন বলে, তবে অতনু বলেছিল মালটা পাক্কা চালিয়াত। অফিসপাড়ার মোড় থেকে ট্যাক্সি নিতে নিতে অনির মনে পড়ছিল এই কথাগুলো। সকালবেলা ফোন করে অতনু খবর দেয়, ওদের দলের নাটক আছে সন্ধ্যেবেলা দক্ষিণ কলকাতার একটি হলে। গোড়ার দিকে অনি সব ফ্রি পাসেই দেখতে যেত। কিন্তু ইদানীং অতনু দিনক্ষণ বলে দেয়, অনি টিকিট কেটে যায়। ওই দিন একটু দোনোমনা করে মোবাইল থেকে টিকিট কাটার সময় অনি দেখে পেছন দিকের দুটো রো মাঝখান থেকে ফাঁকা পড়ে আছে। অনি মাঝামাঝি দেখে দু-দিক থেকে আট নটা চেয়ার ছেড়ে একটা টিকিট কাটে। রুপা আসতে পারবে না, ওঁর এক পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে এরকমই জানিয়েছিল। অনি ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখে লোক সব ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মনে হয়, দু-চারজন যারা বাইরে ঘোরাঘুরি করছে তাদের দেখে রুমাল বের করে মুখে বেঁধে নেয়। হলে অর্ধেকেরও কম লোক, দু-দিকে সিট ফাঁকাই পড়েছিল। নাটক শুরু হওয়ার একটু আগে বাঁ-দিকের শেষ ফাঁকা সিটটায় একজন ভদ্রমহিলা এসে বসেন, মুখ মাস্কে ঢাকা। প্রায়ান্ধকারে বেশ কয়েকবার ওনার সঙ্গে চোখাচোখি হয় অনির। আলো সম্পূর্ণ নিভে যাওয়া ও মঞ্চের পর্দা উত্তোলনের মধ্যে অনি টের পায় ওনার পাশে এসে লোক বসেছে। ব্লাউজের উপরের দুটো হুক খোলা রেণু, যে-দৃশ্যে গলাকাটা ছাগলের মুণ্ডুর মতো ছটফট করতে করতে বিজন ওরফে অতনুকে বলছে, ‘নিক, নিয়ে যাক। আমার আসবাবপত্র সব বিক্রি করে টাকা নিয়ে নিক ওরা!’ অনির মনে হয়েছিল এবার এই ধরনের চরিত্রে অতনুর অভিনয় বন্ধ করাই ভালো। রুবিকে, সাগরিকা হোটেলের ছাদ থেকে আগের একটি নাটকে যে-দৃশ্যে অতনু মিলোনন্মত্ত বানের শব্দ শোনাচ্ছে, সেই একই অভিব্যক্তি আবারও দেখা গেল এই দৃশ্যে। মানুষ কতদূর পর্যন্ত নীতি মেনে চলবে! নৈতিকতা তাকে যতটা অ্যালাউ করবে ততটাই তো! কিন্তু এর কী শ্রেণি নির্বিশেষে কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড আছে! সমস্ত মানসিক সমস্যার একটা মূল জায়গা দেখা যায় ভালোবাসার অভাব। ভালোবাসা নীতি নৈতিকতা মেনে চলে কিন্তু তার রেপ্রেসিভ আউটকাম আছে। এই রেপ্রেসন না থাকলে কিনশিপ তৈরি হত কী! যৌনপ্রেম সভ্যতার কোন পর্যায়ে থাকত তাহলে এতদিনে, কোন পর্যায়েই-বা এখন আছে কেউ কী হলফ করে বলতে পারে! অনি অতনুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোর এক্স্যাক্ট অসুবিধেটা কী হয়?’ অতনু পরিষ্কার বলতে পারেনি। অনুমানে অনি বুঝেছিল দীর্ঘক্ষণ গুম মেরে থাকাটা সম্ভবত ওর একটা মানিফেসটেশান। বিরতির আলো জ্বলার পর অনি তাকিয়ে দেখে ভদ্রমহিলা একা বসে আছেন। এরপর আর কারো আসা টের পায়নি অনি। সো-এর পর গ্রিনরুমে যায় অনি। ভালোলাগা, খারাপলাগা, এরম এলোমেলো কিছু কথার মাঝখানে অতনু হঠাৎ অনিকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর বিমলদাকে মনে আছে?’ অনি ভুরু কুঁচকে একটু ভেবে বলে, ‘বিমলদা! মানে, গোর্কির বিমলদা! অবশ্যই মনে আছে, কেন কী ব্যাপার?’ ‘সো-এর আগে ফোন করেছিলেন, ব্যস্ত আছি শুনে ফোন কেটে দিলেন, করে দেখব পরে আবার’। বিমলদার স্মৃতি রোমন্থনের তেমন সুযোগ সেদিন পায়নি অনিরা, আচমকা ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় সবাই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ে, ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা ক্রস করে উলটো পাড়ে যাওয়ার সময় সেই মহিলাকে অনি অতনু দু-জনেই দেখতে পায় ব্রিজের মাঝখানে, সিক্তবসনা।

এর সপ্তাহ দু-য়েক পর ‘প্যানডেমিক’ শব্দটা প্রায় খিস্তির পর্যায় পুনরুক্ত হতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। অতনু ও সোমের মোবাইল থেকে ক্রমাগত বিভিন্ন নিউজ ফিড আসতে থাকে অনির মোবাইলে, অনিও সেগুলি ফরওয়ার্ড করতে থাকে ইতিউতি। সংক্রমণের মরটালিটি সংক্রান্ত আলোচনায় অনি লেখে, ‘মরটালিটির প্রশ্নে এইচ আই ভির কথা মনে এল। যে-রোগ শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে আবধ্য ছিল, আমেরিকাতে আশির দশকে তা প্রায় মহামারির চেহারা নেয়। মরটালিটি রেট অল মোস্ট হান্ড্রেড পার্সেন্ট। এলজিবিটি কমিউনিটিকে আইসোলেট করা হয় ও মূল অভিযুক্ত ঠাউরে কাঠগড়ায় তোলা হয় সে-সময়’। উত্তরে অতনু লেখে, ‘এতে ওই কমিউনিটির প্রতি পরবর্তীকালে অদ্ভুতভাবে সলিদারিটি বাড়ে, দে বিকেম দ্য পার্ট অফ দ্য সিস্টেম স্লোলি। প্রশ্নটা হল ‘প্যানডেমিক’-এর নাম করে যেভাবে সরকার মানুষের গতিবিধির উপর নজরদারি শুরু করেছে ইভেন বাই ইউজিং মোবাইল অ্যাপ তাতে ইফ উই আর নট কশাস, ইন দ্য ফিউচার ‘প্যানডেমিক’ চলে যাবে তার নিজের নিয়মে একদিন হয়তো অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে, কিন্তু রাষ্ট্র! স্বৈরতন্ত্র!’ মৌনতা সন্মতির লক্ষণ মানে অনি। এর দু-একদিন বাদে ওদের পুরানো বাড়ির দরজার সামনে বাইকে বসা একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ওকে জিজ্ঞেস করে ‘১১/সি-টা কোনটা হবে?’ মুখে বাধ্যতামূলক মাস্ক ও হাতে গ্লাভস, অনি হাত দেখিয়ে দূরের একটা বাড়ি দেখিয়ে দেয়, বিষ্ণুদের বাড়ি। লোকটা চলে গেলে, উলটো দিকের ব্যালকনি থেকে রাশভারী গলা শোনা যায়, ’বাইরে থেকে ফিরেছে মনে হচ্ছে?’। দূর থেকে সানাইয়ের শব্দ ভেসে আসছে, বেচারা প্রসন্য নায়েবকে যেন বিশ্বম্ভর জিজ্ঞেস করছেন, ‘বন্দে আলির সানাই না?’ অনি ঘরে ঢুকে যায়।

এই বিষ্ণু এক অর্থে ওর ছোটোবেলার বন্ধু। যা হয় বড়ো হয়ে যাওয়ার পর বন্ধু থাকে কিন্তু বন্ধুত্ব থাকে না। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার, অতি শীর্ণকায় চেহারা, পাজামা পরত কোমরে গার্ডার দিয়ে, অনেক বড়ো বয়স পর্যন্ত অন্তর্বাস পরত না অনিরা লক্ষ করেছে। একবার একমাত্র সন্ধ্যার শুকতারাকে সাক্ষী রেখে এই ছেলে নিখোঁজ হয়ে যায়। প্রায় কয়েক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর জটলার মাঝখানে আচমকা প্রেতের আগমন, বাড়ির পেছন দিকের সেফটি ট্যাঙ্কের উপর এতক্ষণ বসে ছিল! উলটো দিকের বাড়ির স্নেহশীলা অবিবাহিত যে-দিদির বাড়িতে অন্তর্বাসহীন বিষ্ণুর অবাধ যাতায়াত ছিল, তিনি চোখের জল মুছে স্নেহে ওকে বুকে টেনে নেন। বাবা মায়ের মুখে ফ্লুরোসেন্ট জ্বেলে এ-ছেলে শেষ পর্যন্ত বিদেশে যায় চাকরির সুবাদে। সম্ভবত এই ভোরে বাধ্যতামূলক চোদ্দ দিনের কোয়ারেন্টিইন সেন্টারকে এড়িয়ে নিরপরাধী বিষ্ণু পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ি চলে আসে, তাই এই শিকারির আগমন। প্রশাসন একটিভ তাহলে, পাড়ার লোক খবর দেয় পুলিশ এসে মা ছেলে দু-জনকেই তৈরি হতে বলে গেছে, নাইসেড টেস্টের জন্য যেতে হবে সম্ভবত, বাবা আগেই মারা গেছেন। ‘এদেরকে শিক্ষিত বলে! কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই সোজা বাড়ি চলে এসেছে!’— পাশের বাড়ির গলা। পুলিশ আবার আসে, কিছুক্ষণ পর একটা গাড়ির আওয়াজ পেয়ে অনি বারান্দায় গিয়ে দেখে একটা হলুদ ট্যাক্সি ওদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিকে চলে যাচ্ছে, ভিতরে নিরাপদ দূরত্বে বিষ্ণু আর ওর মা বসে আছেন, মুখে মাস্ক, অনি হাত দিয়ে নিজের নাক মুখ চেপে রাখে, পুলিশের বাইকটা উলটো দিকের রাস্তার মোড়ে মিলিয়ে যায়। অনির মনে পড়ে বিষ্ণুর ঠাকুমা বেঁচে থাকাকালীন মাছ তো দূরস্থান, বিধবা ছিলেন, পেঁয়াজ রসুনও খেতেন না, এমনকী যে-জায়গায় বসে একবার আমিষ ভোজন হয়েছে জ্ঞানত তিনি সেই স্থানে গিয়ে কখনো বসতেন না। মানুষ রোগ থেকে রুগীকে কি কোনোদিনও আলাদা করতে পেরেছে, পাপ থেকে পাপী যেমন! অনি ঘরে এসে ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে নেয়।

এরই কিছুদিন আগে অনিদের অফিস বন্ধ হয়ে যায়। অতনুদেরও। বাড়ি থেকে কাজ, অতনুদের নয় অবশ্য। এর মধ্যে ফোনে সোমের সঙ্গে অনির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের এবং সোমের রাজনৈতিক তরজা অনির মাথা ধরিয়ে দিয়েছিল। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, রেমডিসিভির সোম জানিয়েছিল, কিছু উন্নতির কেস দেখা যাওয়াতে, ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে। রেমডিসিভির না কি ভাইরাল শেডিংটাকে কমাতে সক্ষম। অনি জানায় মার্কিনদেশে সংক্রমণ সব থেকে বেশি হওয়ায় সিনিয়র সিটিজেন না হলে হাসপাতালে ভর্তি নিতে চাইছে না, লক্ষণ লঘু হলে তো আরওই নয়। অতনুর এক দিদি জামাইবাবু ওখানকার ডাক্তার, দু-জনেই সংক্রমিত কিন্তু বয়স কম বলে হাসপাতাল ভর্তি নেয়নি। ওনারা বাড়িতেই নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা করেন, গোড়ায় ক্লোরোকুইন খেয়ে ওদের বমি শুরু হয়। এখন দু-জনেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন। এই লকডাউনের মধ্যে অতনু একদিন ফোনে জানায় ওদের নাটকের দলগুলির যে-এসোসিয়েসান আছে তার বাইরে অতনুরা একটা ফান্ড তৈরি করেছে টেকনিশিয়ান ও প্রতিদিন অভিনয় করে যারা সংসার চালায় তাদের জন্য। বিমলের কথা ওঠে এই সূত্রে আবার, স্কুলের মাস্টারির বাইরে সখে থিয়েটারে অভিনয় ও ফিল্ম ক্লাব এইসব করে বেড়াতেন। এরকম বিচিত্র মানুষ অনিরা জীবনে খুব বেশি দেখেনি। ভীষণ সমস্যাশঙ্কুল জীবন কিন্তু এমন একটা অনড় ভাব ছিল, আদিরস মিশ্রিত মুখের ভাষা কিঞ্চিৎ প্রগলভতায় ভরা, অদ্ভুত ভঙ্গি কিন্তু কথার মধ্যে পারস্পেকটিভ পাওয়া যেত নানা ধরনের। স্কুলের মাস্টারমশাই হিসেবে একেবারেই ভাবা যেত না। কলকাতায় থাকতেন হেদোর কাছে, পুরানো বাড়ি ছিল নদিয়া জেলায়, রানাঘাটের কাছে। অনিদের সাথে প্রথম দেখা দু-হাজার সালের আশেপাশে। সম্ভবত গোর্কি সদনের মাসিক সিনেমা প্রদর্শনীতে। ডিসিকার বাইসাইকেল থিফ দেখার শেষে। ছবি শেষ হলে, অনিরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে দীর্ঘকায় মৃণাল সেন কৌতূহলী ও নাছোড় বিমলকে বলছেন, ‘ভাবতে পারেন এ-ছবি চল্লিশের দশকে বানানো, আজও দেখলে মনে হয় এই কালকে বানানো হয়েছে!’ শোনা কথার মধ্যে যখন আকাঙ্ক্ষিত কথা থাকে তখন কথায় কথা বাড়ে। মৃণাল সেন তাঁর সাগরেদ সমেত হাঁটা দিলে বাইরে চা খেতে এসে অনিরা দেখে বিমল মৃণাল সেনের চেনা কেউ নন এবং প্রায় বিনা পরিচয়েই ওদের বলছে, ‘মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত কোথাও শুনেছ অপমানে বাপ ছেলে একসঙ্গে কেঁদে ভাসাচ্ছে! এ শুধু শালা নিম্নবিত্তেরই বারমাস্যা, পৃথিবীর যেখানে যাও! আমার জানতে ইচ্ছে করে এ-ঘটনা ওঁর ছেলের জীবনেও ঘটবে কি না!’ এর মাসখানেক পরে, পরের বছর হবে হয়তো, নাম মনে নেই, ইতালির ছবি, অতনু বলে, ‘পার্সোনাল সিনেমা বলে যদি কিছু থেকে থাকে এ একেবারে তাই, একজন মানুষের অবসেসন, তার পায়ুকাম, পৃথুলা রমণীদের প্রতি আকর্ষণ এ-সব কি কোনো এস্থেটিক্স এনে দিতে পারে? কোন অ্যালকেমির জন্য লোকে এ আবার দেখতে চাইবে!’ অনিমেষ ভাবতে থাকে।

উল্লাসের হাসি-মাখা অরুণ অধর
গোপ-সীমন্তিনী-গণে চুম্বে নিরন্তর।
আলিঙ্গনে আমোদিনী নিতম্বিনী-দল,
তিমির অঙ্গের মণি করে ঝলমল।
বিশাল বক্ষেতে কিবা বিমর্দ্দিত আজি
গোপ-নিতম্বিনী-গণ-উচ্চ-কুচ-রাজি।

আমার তো এই মনে এল, এর জন্য আবার দেখব কী?’ বারোশো শতকে লেখা জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে আবৃত্তি করে শোনায় বিমল। রসময় দাস নয়, শ্রী শরচ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রী নগেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রণীত ও প্রকাশিত গীতগোবিন্দের এই বাংলা পদ্যানুবাদটি বিমলের কাছে আছে। আজ যা রেপ্রেসেড হয় ক্ষমতার নৈতিক অনুশাসনে কাল তা আকুপাকু করে নতুন চেহারায় ফিরে আসে, সাবভারসানের চেহারা নিয়ে, ক্ষমতার অলিন্দে অন্তর্ঘাত ঘটানোর অভিপ্রায়। বিমল চুকচুক করে চায়ে চুমুক দেয় আর চোখ পিটপিট করতে থাকে, পয়সা মেটায় প্রতিবারের মতো অনিরা। ‘তোমার বাড়ি যেন কোথায় বলেছিলে?’, অতনু উত্তর দেয়, ‘রানাঘাট’। ‘রানাঘাট টকিজের পাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা এঁকবেঁকে চূর্ণীর দিকে চলে গেছে ওই দিকে একসময় নিয়মিত যেতে হয়েছে বুঝলে’। মানুষের কিছু অনিবার্য অসহায়তা থাকে, যা ক্রমউন্মোচিত হতে থাকে প্রকাশের আধার পেলে। জ্যান্ত পুড়ে যাওয়ার আগে প্লেগাক্রান্ত মেয়েটির আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে পরিচালক জানতে চেয়েছিলেন, ‘ইস ইট দ্য আঙ্গেলস ওর গড ওর স্যাটান ওর জাস্ট এম্পটিনেস, হু উইল টেক কেয়ার অফ দ্যাট চাইলড?’ দ্য সেভেন্থ সীল ছবিতে, এ-দেশের মানুষ এই প্রশ্ন করার অবকাশই পায় না। সেই দিনের ও পরের দিনের বেঁচে থাকা, ব্যাধি, অপমান, কোটি কোটি মানুষের অবমানবের জীবন, তাদের জন্মান্তরের অশান্তি দিতে পারে কেবল, তার চাইতে মরনোত্তর সেটেলমেন্টের সেমিটিক ভাবনা এখন মনে হয় অনেক বেশি ভালো বোঝাপড়া, এই সন্দর্ভ তৈরি করে বিমল অনিদের সঙ্গে সেই দিন। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার পরপর শ্লেষ্মা দিয়ে রক্ত আসতে শুরু করে বিমলের, সেই সময়ই এই ডাক্তার সেই ডাক্তার ঘুরে অবশেষে যৌবনের অনিবার্য টানে রানাঘাটে আসা শুরু হয়। চম্পার সঙ্গে প্রেম তার আগে থেকেই ছিল। গোঁড়ায় কিছু না জানালেও একদিন খয়েরি রক্তের ছাপ দেখে ও চাপা কাশির দমক দেখে বিমলকে চুমু খেতে বাধা দেয় পয়োধরা চম্পা। বিমল জোর করে চুমু খায়, উপরন্তু স্তনে মুখ দেয়। এর পরেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। সম্পর্কে সম্পূর্ণ ছেদ ঘটার আগে চম্পার বাবা চেয়েছিলেন দৈবক্রমে পাওয়া এই সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে বিমলের গায়ে অসন্মান স্থায়ীভাবে লেপে দিতে। বিমলকে কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় চূর্ণীর শেষ মাথার গলির ডাক্তারের কাছে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই বিমলকে ভর্তি করে দেওয়া হয় ধুবুলিয়ার টিবি হাসপাতালে। এই শোকে বিমলের বাবার একটা ম্যাসিভ স্ট্রোক হয়, দু-একদিন বাদেই উনি মারা যান। ‘সেই সময়ের কথা, ষাটের দশকের শুরুর দিক, স্ত্রেপটোমাইসিন দেওয়া শুরু হয়েছে কিন্তু ফুল প্রুফ নয়, আর ভরসা সেই চিরাচরিত রোদ্দুরের আলো আর ট্যাঁকের জোর থাকলে পশ্চিমে গিয়ে মাসের পর মাস ভালো জল হাওয়া খাওয়া আর শরীরে এন্তার রোদ লাগান।’ — অনর্গল বমনক্রিয়ার মতো, অনিদের কথাগুলো বলে যায় বিমল। ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরে বিমল জানতে পারে ফিমেল ওয়ার্ডে চম্পা ভর্তি হয়েছে। দাদা এসে বিমলকে বলে যায় ওর সঙ্গে দেখা করার কোনোরকম চেষ্টা না করতে। দুই বাড়ির মধ্যে অশান্তি প্রায় হুমকি হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিমলকে প্রায় দু-বছর থাকতে হয়েছিল ধুবুলিয়াতে। স্ত্রেপটোমাইসিন কাজে আসে, বিমল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়, কিন্তু চম্পা, বিমল ছাড়া পাওয়ার বছরখানেক বাদে মারা যায়। সুস্থ হওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত তীব্র মাথা ঘোরা ও বমি ছিল বিমলের নিত্তসঙ্গী। মা দাদারা বিমলকে আর পড়াশুনো করতে দিতে চায়না, পেয়ারাপাড়া গ্রামে ওদের যে জমিজায়গা ছিল তাই দেখাশুনো করতে বলে। তথাপি দু-বছরের ব্যবধানে বিমল এসে ভর্তি হয় উত্তর কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি বিভাগে। পিজি বিএড দু-টিই শেষ করে অবশেষে চাকরি নেয় স্কুলে। এরই মধ্যে একদিন পেছন থেকে বিমল ভেবে ভুল করে ওর দাদার উপর কিছু লোক চড়াও হয়, কিঞ্চিৎ হাতাহাতির মধ্যেই ব্যাপারটা তখনকার মতো মিটে যায়, তাই পুনরায় পড়াশুনো করার আকাঙ্ক্ষা ছাড়াও কলকাতায় চলে আসার বা বলা ভালো বাড়ির লোকের পাঠানোর পিছনে আর একটা কারণ ছিল পূর্বের প্রেম ও অশান্তির আবহ থেকে বিমলকে দূরে সরিয়ে রাখা। মেয়ে ও মদের নেশা বিমলের অল্পবিস্তর থেকেই যায়। বিয়ে করে, একটি মেয়েও হয়। সখে থিয়েটারে অভিনয় এর কিছু কাল পরে শুরু হয়, নব্বই-এর দশক থেকে ফিল্ম ক্লাব, থিয়েটার ছেড়ে দিলেও ফিল্ম ক্লাবে যাতায়াত অনেকদিন পর্যন্ত ছিল। গত দশকের মাঝামাঝি বেশ কিছু দিনের অ্যাবসেন্সে একদিন বিমলের এসএমএস পায় অতনু। লেখা ছিল, ‘অতনু— ১৫/০৪/২০০৬, ৭:০০ পিএম— ৯:০০ পিএম, সাডেনলি, অকারড ৩-৪ টিএসএফ ব্লাড উইথ কাফ (৫৪ ইয়ার্স এগো ১৯৬২-৬৪ ইয়ার: কেএসআর–ধুবুলিয়া–ক্রি–সদর–এমসিএইছ), মেডিক্যাল কলেজ ইমারজেনসি ডায়গনোনসিস: হেমপটিসিস (পাস্ট হিস্ট্রি + টুডে— সিমস সেম: আই ই: নরমাল); সোয়ালিং অফ ফিট; বিপি— ১২৫/৭৫; নেক্সট চেকআপ: আফটার ওয়ান উইক;’।

শেষ পাতা

Categories
গল্প

সেলিম মণ্ডলের গল্প

হাতটি

আকাশে একটিও তারা নেই। গুমোট। বৃষ্টি হওয়ার প্রয়োজন ছিল। আকাশের কি ভালো লাগে এত ভারী মেঘ বয়ে বেড়াতে? আকাশভারী মেঘের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মনে হয়— অন্ধকার আকাশটা এখুনি ঘরের ভিতর ঢুকে আমাকে চেপে মারবে। কতদিন কিছু লেখা হয় না! পড়াতেও মনোযোগ বসে না। কতদিন নতুন উপন্যাস পড়িনি! বিছানায় নেরুদার প্রশ্নপুঁথি, মণীন্দ্র গুপ্তের গদ্যসংগ্রহের প্রথম খণ্ড, উৎপলের কবিতা সংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ড ছড়িয়ে… কোনোটি দু-পাতা পড়ব তার ইচ্ছেও হচ্ছে না। বালিশের পাশে একটা ডায়েরি ও লাল কালো দু-খানা কলম পড়ে। ডায়েরিতে লিখি না। কাটাকুটি করি। নিজেকে যখন ভীষণ একা লাগে ওই ডায়েরির পাতায় অজস্র বক্ররেখা টানি। তারপর মুখগুলো মিলিয়ে দিই। আজ কিছুই ইচ্ছে করছে না। ল্যাপটপটা অনেকক্ষণ আগে বন্ধ করে রেখেছি। স্পিকারটাও অফ। খেয়েছিও অনেকটা দেরিতে। রাতে খাওয়ার সময় একমাত্র টিভির ঘরে ঢুকি। খেতে খেতে খবরের চ্যানেলগুলো স্ক্রল করি। চ্যানেলগুলো বড্ড বোরিং। এই বিপর্যয়ে মানুষজনের কী অবস্থা তা যত না খবর করে তার থেকে বেশি খবর করে এ-সরকার কী করছে, ও-সরকার কী করছে! কোন সেলেব্রটি পেগন্যান্ট! গঙ্গায় তিমি ভাসছে!

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, মাথায় কী সব উদ্ভট প্রশ্ন ঘুরছে—

তারাদের কি অভিমান হয়?

ধারে কেনা যায় কি তারার ছটফটানি?

তারাদের বিয়েতে কি চাঁদের নিমন্ত্রণ থাকে?

হঠাৎ, মনে হল পিছন থেকে কেউ একজন ঘাড়ে হাত রাখল। আমি একটুও চমকে গেলাম না। পিছন ফিরেও তাকালাম না। আমি আগের মতোই আছি। ছোটোবেলা থেকেই ঘাড় ধরতে পছন্দ করি। কেউ ঘাড়ে হাত রাখলেও ভালো লাগে। প্রেমিকার সঙ্গে যখন বেরোতাম, হাত না ধরে ঘাড় ধরতাম।

আজ আমার ভিতর কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। লাইট অফ। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। অন্ধকার আকাশে কিছুই দেখা যায় না। না-দেখাটাও অনেক সময় আনন্দের। আমরা যত না দেখব, পৃথিবী বোধহয় ততই রহস্যময় সুন্দর।

হাতটি আস্তে আস্তে আরও চাপ দিয়ে স্পর্শ করছে। আমার মন্দ লাগছে না। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে। এত রাতে আমার ঘরে কেউ আসবে না। আসলেও এভাবে আচমকা এসে ঘাড়ে হাত দেবে না। কিন্তু এ-নিয়ে আমার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতাই নেই। একইরকমভাবে আকাশ দেখছি তো দেখছিই। ঘড়ির ব্যাটারি বহুদিন শেষ হয়ে গেছে। লকডাউনের মধ্যে কেনাও হয়নি। সত্যি বলতে আজকাল ঘড়ি দেখার প্রয়োজনই হয় না। সারাক্ষণ হাতের কাছে মোবাইল থাকে। কিন্তু এখন মোবাইল কোথায় আছে জানি না। অন্ধকারে খুঁজে পাওয়াও যাবে না। মা, ঘুমোতে যাওয়ার আগে বারবার বলে গেছে, বেশি রাত করবি না। এখন ক-টা বাজে আমার আইডিয়া নেই। রাতে খেয়েছি তাও ঘণ্টা ৩-৪ হবে। সেই সূত্রে অন্তত ২টো বা ৩টে বাজে। ঘুম আসছে না। এবার ঘুমোতে যাওয়া দরকার। আমি অনুভব করলাম ঘাড় থেকে হাতটি সরে গেছে। আকাশেও যেন মেঘের ভিতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটি তারা। হতেও পারে দূরের কোনো জোনাকি। আমি মাঝে মধ্যেই তারার সঙ্গে জোনাকি গুলিয়ে ফেলি।

ঢক ঢক করে কয়েক গ্লাস জল খেয়ে, মোবাইলটাও খুঁজতে লাগলাম। পেলাম না। বোধহয় টিভির ঘরে রেখে এসেছি। খাটের একপাশেই কোনোরকমে বইয়ের ওপর বই চাপিয়ে মশারি টাঙিয়ে নিলাম। এই বিরক্তিকর কাজ আমাকে একটি কারণে করতে হয়। যাতে মায়ের বকা না খেতে হয়।

সঠিক ক-টা বাজে, এখনও জানি না। অন্যান্য দিন শোবার সময় মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি টের পাই না। মশারির মধ্যে চুপচাপ আছি। ঘুম আসছে না। আমার ঘরটাই মনে হচ্ছে আকাশ। একটাও তারা নেই। গুমোট। খালি ফ্যানের হাওয়ায় অল্প অল্প মশারির নড়াচড়া টের পাচ্ছি। একটা সময় আমার ঘুম নিয়ে অহংকার ছিল। বিছানায় পড়লেই ঘুমিয়ে যেতাম। আজকাল কী হয়েছে, শুলেও ঘুম আসে না। ঘুম আসে, আবার ভেঙে যায়। এখন আমি ঘরের মধ্যেই আকাশ দেখছি। কখন তারারা আসবে অপেক্ষা করছি।

এর মধ্যে একটা কালো বিড়াল এসে জানালার ধারে কুৎসিতভাবে ডাকছে। জানালার একটা পাল্লা খোলা। তা দিয়ে কিছুটা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বলতে— তার উজ্জ্বল দু-টি চোখ। এত তীব্র আলো মনে হচ্ছে এই তো দু-টি তারা জ্বলছে আকাশে। কিন্তু ওই ডাকটা আরও পাগল করে তুলছে। কিছুক্ষণ পর বিড়ালটা নিজেই চলে গেল।

চোখটা আস্তে আস্তে একটু ভার লাগছে। চুপচাপ আছি। আকাশটা আরও ঝাপসা হয়ে আসছে। পাশ ফিরে কোনোরকম চোখটা বুজলাম। আবার যেন পিঠে কারো হাত স্পর্শ করল। কিছুই বললাম না। এবার সে নিজে থেকেই বলল, তারাদের দেখা পাবে না। আমার মাথায় হাত বোলাতে লাগল। এই কণ্ঠস্বর আমার চেনা। এই কণ্ঠস্বর আমি ভীষণ পছন্দ করি। কিন্তু আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

— কথা বলো।

— আজ তুমি চলে যাও। চলে যাও প্লিজ।

— তুমি তারাদের দেখা পাবে না। দেখো, আকাশ থেকে ওই অন্ধকারে ঝরে পড়ছে রক্ত। টের পাও, ওই রক্ত কাদের? শুনতে পাও কি কোনো আর্তনাদ।

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। ফ্যান চলছে। ঘরের দরজা বন্ধ, পাশের ঘর অবধি শব্দ হয়তো পৌঁছায়নি। তবে কোনোরকমে নিজে সামলে বললাম, আজ তুমি চলে যাও, প্লিজ। আমি নিজেকে সামলাতে পারব না। পাশের ঘরে কিছুক্ষণ আগেই বাবার কাশির আওয়াজ পেয়েছি। জেগে যেতে পারে। ও নাছোড়। কিছুতেই যাবে না। মাথায় হাত বোলাতে থাকে আর বলে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি তুমি ঘুমাও। মাথায় হাত বোলাতে থাকে, মাঝে মাঝে কপালে চুমু খায়। এই আদর আমার সহ্য হচ্ছে না। সব কিছু অসহ্য লাগছে। আমার কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি পাগল হয়ে উঠছি। রাতের পর রাত ঘুম নেই। কিছু সহ্য হচ্ছে না। গভীর রাতে স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছে না। অন্ধকার গুমোট আকাশে তারা খুঁজছি!

যেভাবে হোক একে তাড়াতে হবে। না হলে আমি আরও পাগল হয়ে যাব। চিৎকার করে উঠব। কয়েকবার ঘুরে লাথি মারলাম। তার কিছুই যেন হল না। একইভাবে আমার পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে। আজ রাতে আমার সঙ্গে থাকবে। গল্প করতে চায়। বিরক্ত হচ্ছি বলে চুপচাপ গায়ের গন্ধ নেবে। মাথায় হাত বোলাবে। কিন্তু সে যাবে না…

হঠাৎ, একটা শব্দ কানে এল। গেট খোলার শব্দ। একটু স্বস্তি পেলাম। মা বোধহয় বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠেছে। আমার ঘরে আলো জ্বললে মা এসে দেখে যায়। আজ অন্ধকার। আসার প্রশ্নই নেই। মা-কে কি ডাকব? এত বিরক্ত লাগছে কেন? মা এসে কি একে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে? আমি কি সত্যিই চাই, একে দূর দূর করতে? আজ তো প্রথম নয়, তাহলে কেন বারবার সে আসে?

কিছুক্ষণ পর আবার দু-বার আওয়াজ পেলাম। একবার বাইরের গেট লাগানোর, আরেকবার আরেকবার শোবার ঘরের সিটকানি মারার।

— তুই কি যাবি বাল?

— আমি তোমার কি ক্ষতি করছি? ঘুম পাড়িয়েই তো দিচ্ছি।

— দ্যাখ, বাল; তোর এই আদর আমি চাই না।

— তাহলে জানালার ধারে গিয়ে কেন, কেন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলে?

— তা তোর কী?

— তুমি, তারার দ্যাখা চাও। অথচ, তারা তোমার কাছে এলে তাকে দূর ছাই করো।

— আমি তোর মতো তারা চাই না। নীল আকাশে জ্বলজ্বল করা তারা দেখতে চাই।

— যে-আকাশে তুমিই মেঘ ঘনিয়ে আনলে সেই আকাশেই তারা দেখবে? আর যে-রাতে অন্ধকার তারাদের গিলে নেয়, সেই রাতকে, না তারাকে; তুমি বিশ্বাস করো না?

তুই তোকারি পর্যায়ের তর্ক-বিতর্ক শুরু হল। আমি পাশ ফিরে একইরকমভাবেই শুয়ে আছি। ও মাথায় যতই হাত বুলিয়ে দিক, কিছুতেই ঘুম ধরে না।

ডান হাতে প্রচণ্ড ব্যথা। শরীরটা আগের চেয়ে অনেকটা হালকা লাগছে। ঘরটা আগের মতো অতটা অন্ধকার নয়। জানালার একটা পাল্লা দিয়ে অল্প অল্প আলো ঢুকছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকাল হবে। জানালার ফাঁক দিয়েই দেখা যাচ্ছে— পাঁচিলে ঝিমোচ্ছে একটা পাখি। ও কি আমায় সারারাত পাহারা দিচ্ছিল? পাশেই নারকেল গাছ। প্রতিদিন কত পাখি ওর পাতায় বসে খেলা করে। পেচ্ছাপের বেগ পেয়েছে কিন্তু বালিশ ছেড়ে ওঠার শক্তি নেই। তিনরাত টানা ঘুম নেই। হাতের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি গতকাল। ঘুম এতই গভীর ছিল কিছুই টের পাইনি। মাথার পাশেই পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইপত্র। মা এসে কোনোরকমে লাইট অফ করে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। তবে আমার ডায়েরির একটি ছেঁড়া পাতা বুকের ওপর লেপটে ছিল। স্পষ্ট ছিল তার দাগ। মনে হচ্ছিল— সদ্য ইস্ত্রি করা সাদা পাঞ্জাবী…

Categories
গদ্য

রণজিৎ অধিকারীর গদ্য

বাল্যকাল কিংবা এক কাল্পনিক অতিভুজ


শুশুনিয়া পাহাড়ের পায়ের কাছে রাস্তা, আর রাস্তার পর থেকেই গ্রাম শুরু হয়েছে। ঢালু রাস্তা নেমে গেছে, রাস্তার দু-দিকেই ছড়িয়ে বাড়ি, এইভাবে কিছু দূর গ্রাম ছাড়িয়ে গেলেই গন্ধেশ্বরী নদী। গ্রীষ্মে প্রায় জল থাকে না, অতি শীর্ণ। এই গ্রামে একবার মাসাধিক কাল ছিলাম এক দরিদ্র মূর্তিশিল্পীর বাড়িতে। শুশুনিয়া পাহাড়ের গা থেকে পাথর কেটে এনে বাড়িতে বাড়িতে এই মূর্তিশিল্প। রোজগারের একটা সহজ শিল্পিত পথ। এখানে অনেক রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পীর বাড়ি ঘুরে ঘুরে তাঁদের কাজ করা দেখেছি বসে বসে। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে প্রায় প্রতি ঘর থেকেই পাথর কাটার ঠুকঠুক শব্দ কানে আসবে।

যাঁরা খুব নিপুণ শিল্পী তাঁরা খুব ছোটো ছোটো মূর্তি আর সূক্ষ্ম কাজ করেন।

আমার সংগ্রহে আছে তেমন কিছু মূর্তি। কিন্তু যাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি আমরা তাঁরা শিল্পী হিসেবে তেমন কিছু নন, ভালো করে দেখলে তাঁদের কাজের অনেক ত্রুটি ধরা পড়ে। প্রায় দিন আনি দিন খাই অবস্থা।

শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে যেখানে মন্দির আর প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের ভিড়, সেখানে তাদের পাতা দোকান। যতটুকু যা বিক্রি।

তো ওঁদের বাড়িতেই দেখেছি মূর্তি তৈরির আগে ছোটো ছোটো করে মাপমতো পাথর কেটে রাখা— তারপর একেকটাতে ধীরে ধীরে ফুটিয়ে তোলা হয় একেক দেব দেবীর মূর্তি।

মাত্র দুটো ঘর, আর ঘেরা দুয়ার নিয়ে কানু কর্মকারের বাড়িখানা, সামনে বেড়া দেওয়া সামান্য উঠোন। স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে সংসার।

বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঠুকঠুক করে পাথর কাটেন শিল্পী, কিছুক্ষণ পরই একটা মূর্তি হয়ে যায়, স্ত্রী সেটাকে সরিয়ে রাখেন। তেমন সৌখিন কাজ নয় তাঁর।

রাতে একটা ঘরে তাঁর দুই ছেলের সঙ্গে আমি আর বাবা শুই।

একদিন খুব রাতে ঠুকঠুক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল, বিছানা থেকে নেমে দুয়ারের কোণের ছোট্ট কুঠুরিটাতে উঁকি দিই, এত ছোটো যে সেখানে একজন বসে কেবল কাজ করতে পারে, বাকিটা নানা আকারের পাথরে ভরতি।

একটা হ্যারিকেন-এর আলোয় শিল্পী কানু যেন একটা ঘোরের ভেতর ঝুঁকে পড়ে পাথর কাটছেন।

আমিও পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জগতে যেন আর কোথাও কিছু ঘটছে না, খুব দূর থেকে কোনো মাতালের জড়ানো চিৎকার নৈঃশব্দ্যেরই একটা অংশ মনে হয়, আর এখানে ঠুক ঠুক…।

পাথরের টুকরো আর সাদা গুঁড়ো শিল্পীর দু-পায়ের ফাঁকে জমছে। কিছুক্ষণ পরই মূর্তিটা একটু রূপ পেল, ক্রমে শিল্পীর হস্তচালনা আরো সাবধানী হয়ে উঠল।

খুব মগ্ন হয়ে কাজ করছেন তিনি, কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন এক মস্ত বড়ো সাধনা। আরও একটু পরে যখন মূর্তিটা সম্পূর্ণ হয়ে এল, তখন সেই অল্প লালাভ আলোয় দেবী মূর্তি যেন ঝিকমিক করে উঠল। একটু আগে যা ছিল পাথরের টুকরো, তারও আগে পাহাড়ের ভেতর স্তব্ধ জমাট অন্ধ, কোটি কোটি বছর… আজ তার মুক্তি ঘটল। অল্পবয়সী চোখে দেখা সেই দৃশ্য সেই উপলব্ধি আজও আমার কাছে অলৌকিক।

সেই জ্যোতিতে ভরে যাওয়া মলিন কুঠুরি, সেই মুহূর্ত আমি কখনো ভুলব না। দিনের আলোয় পরে ওই মূর্তি দেখে হতাশই হয়েছি। ত্রুটি ধরা পড়ে যে-চড়া বাস্তবের আলোয়, সেই বাস্তবই তো আমাদের জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যায়, তার থেকে মুক্তি নেই। তবু একেকটি দিনের উদ্ভাস অবাস্তব সুন্দর হয়ে থেকে যায় মনে।


শুশুনিয়া গ্রামের এক দিকে পাহাড়, উলটো দিকে গন্ধেশ্বরী নদী। সন্ধ্যের আগে আগে বাবার সঙ্গে নদীর দিকে নেমে যাই। নদীর দিকটাতে বেশ কয়েকটি বড়ো পুকুর। বিকেলের দিকে যাতায়াতের পথে দেখেছি— পুকুরের একদিকে নারীরা স্নানের জন্য ব্যবহার করে, কিছু দূরে পুরুষেরা। আমাদের যাতায়াতের পথে স্নানের জায়গাগুলো পড়ে। আর এখন বিকেলের পর মহিলাদের ভিড় জমে পুকুরে। উঁচু আলপথ দিয়ে আমি একটু আগে আগে চলেছি। বাবা বেশ পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু কেনই-বা আমি সেদিন অতখানি এগিয়ে গিয়েছিলাম এতদিন পর আর বলা সম্ভব নয়। মনে কোনো পাপচিন্তা ছিল!—

মনের অন্য দিকটা আজও তা মানতে চায় না। স্নানরতা নারীকে দেখার অনীহা সাধুতার পর্যায়ে পড়ে, আর আমি সাধু নই। সামনের ঝোপটা পেরোলেই পুকুর, সমবেত নারীদের হাসি আর কথার শব্দ আসছে।

তবে আমি যে অন্যমনস্ক ছিলাম— সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আলপথ থেকে নীচে নেমে কিছুটা জমি পেরিয়েই পুকুরপাড়। পা-টা নামাতে গিয়েই চকিতে তুলে নিলাম আর স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে, শ্বাস বন্ধ করে আমি দাঁড়িয়ে— ফণা তুলে যে আমার সামনে— অত বড়ো বিষধর কি জীবনে আর কখনো দেখেছি?

বাবা এখনও কেন আসছে না! এত কান্না পাচ্ছে।

আর কখনো একা একা এভাবে এগিয়ে আসব না। পুকুর থেকে উঠে একজন প্রৌঢ়া এদিকে পা বাড়াতেই ফণা নামিয়ে সে চলে গেল। আমি তখনও দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ করিনি।— কী হল? চলো। আমি ভয়ে ভয়ে ঘটনাটির কথা বলতেই বাবা বলল— তোমার মনের মধ্যে কোনো কুচিন্তা ছিল। এসো।— বলেই বাবা এগিয়ে গেল।

আমি কিচ্ছু না বলে চুপচাপ বাবার পেছনে চলতে লাগলাম। তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে।

বাকি পথ, এমনকী নদী থেকে ফেরার পথেও বাবা এ-বিষয়ে আর একটি কথাও বলল না। কিন্তু তারপর থেকে যখনই বাবার সামনে যাই, মনে হয় আমার যা কিছু গোপন ভাবনা তার সবকিছুই বাবা স্পষ্ট পড়ে নিতে পারছে।


বর্ষায় শালবনের সে এক রূপ হয়। বেলপাহাড়ি পেরোলেই বৃষ্টিভেজা শালপাতার রং মনকে এক সজীবতায় ভরে দেয়। শুধু বাসের জানালার দিকে বসতে পাওয়া চাই, দক্ষিণ-পশ্চিমে তাকিয়ে মন কেমন করে ওঠে— থরে থরে মেঘের মতো পাহাড়ের শিরা। কিছুটা এগিয়ে বাঁ-দিকে রাস্তা গেছে ওদলচূয়ার দিকে— কী নির্জন আর রাস্তার দু-দিকে প্রকৃতির রূপ আশ্চর্য সুন্দর।

ভাবি, ভ্রমণবিলাসী বাঙালি কত কত দূর বেড়াতে যায় প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য অথচ বাড়ির কাছে ওদলচূয়া কাকরাঝোড় দলমা পাহাড় অবহেলায় চুপ করে পড়ে থাকে অভিমানে।

যাক, বাঁ-দিকে না বেঁকে সোজা রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠে নেমে চলে গেছে ভূলাভেদা হয়ে বাঁশপাহাড়ি। বাঁশপাহাড়ি থেকে ঝিলিমিলি খুব কাছে। এইসব অঞ্চলের নিবিড় প্রকৃতির ভেতরে আমি দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছি।

ভূলাভেদার পরের ছোট্ট স্টপেজ তামাজুড়ি, দু-একটা দোকান ছাড়া তখন কিছু ছিল না, তবে বাঁ-দিকে যে-সরু পাথুরে রাস্তাটা ঢুকে গেছে তার দু-দিকে বেশ কিছু বাড়ি।

১৯৯০-৯১ সালে আমার বাবা এই নির্জন শান্ত পরিবেশে একটি আশ্রম গড়ে তোলে। বাবা তার কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে বছরের অনেকটা সময় এখানেই কাটাত।

আমি এই আশ্রমে আসি তারও দু-একবছর পরে।

স্কুলের ছুটি থাকলে আমি এখানে এসেই থাকতাম।

মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর প্রায় টানা দু-মাস ছিলাম মনে আছে। পরবর্তী কালে আমার মধ্যে যখন ধর্ম বিষয়ে সংশয় দেখা দিতে শুরু করে, উপবীত ত্যাগ করি, তারপর থেকে ওই আশ্রমে আর যাইনি বললেই চলে। কিন্তু সে-সব অনেক পরের কাহিনি।

বাল্যে মনের মধ্যে যখন এ-সব জটিলতা দেখা দেয়নি, সহজ দৃষ্টিতে চারপাশটাকে দেখি ও নির্মল আনন্দ পাই, তখনকার স্মৃতিগুলি এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে।

আশ্রমে সারাদিন শিষ্যদের আনাগোনা আর সন্ধ্যেতে কীর্তনের আসর বসে। এই আসরে গানের চেয়ে কথা বা তত্ত্ব আলোচনা হয় বেশি, শিষ্যদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেয় বাবা।

ফলে আমার ছুটি, বাজাতে হয় না। সারাদিনই প্রায় আমি লাগামহীন ঘুরে বেড়াই, আশেপাশের গ্রাম, কারুর উঠোনে গিয়ে বসে থাকি দড়ির খাটিয়ায়। কোথাও নির্জন একটা গাছের তলায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রকৃতপক্ষে এই সময়গুলোই আমার জীবনকে শান্ত এক তারে বেঁধে দেয়।

একটা ঘটনার কথা বলি। ওইসব অঞ্চলে দেখেছি পুরুষেরা খুব অল্পবয়স থেকেই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।

এখানে যারাই বাবার শিষ্য হয়েছে, তাদের অধিকাংশই নেশায় আচ্ছন্ন থাকত এককালে, বাবার সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে নেশা থেকে মুক্ত হত।

অবশ্য এমন উদাহরণও আছে যে, কেউ পুনরায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে আবার কান্নাকাটি করে নেশা ছাড়ার শপথ করেছে… আবার… আবার।

এদের স্ত্রীদের যন্ত্রণার শেষ থাকত না। স্বামী নেশা করে সারা সারা দিন ঘরে, এদিকে হাঁড়ি চড়ে না। প্রায়ই তারা বাবার কাছে এসে পায়ে পড়ত। কিন্তু এ-সব ক্ষেত্রে বাবাই-বা কী করতে পারে— বুঝতাম না!

কখনো তারা স্বামীকে আশ্রমে আনত, বাবা সারাদিন ধরে তাদের বোঝাত, দেখেছি।

তবে একবার একটা ঘটনায় আমি আশ্চর্য হই, এবং বাবাকে অন্যভাবে আবিষ্কার করি।

পাশের গ্রাম থেকে একটি রুগ্ন বউ এক সন্ধ্যায় এসে কান্নাকাটি করে বাবার কাছে। বাবা তাকে কথা দেয় যে যাবে তার বাড়ি কোনো একদিন।

দু-একদিন পরেই বাবা সেখানে গেল, এবং আমাকে কোনোমতেই সঙ্গে নিতে চাইল না।

আমি সারা সকাল এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ালাম, দুপুরে স্নান করে খেলাম। কিন্তু দুপুর গড়ালে আর ভালো লাগল না। এক শিষ্যের সঙ্গে গেলাম সেখানে।

গিয়ে দেখি, তার ছোট্ট ঘর, সামনেটা ফাঁকা অনেকটা জায়গা। একদিকে অনেকগুলো মহিষ, অন্য দিকে একটা গাছের নীচে খাটিয়ায় বাবা শুয়ে, নীচে একটি লোক চোখ লাল, ইনিয়েবিনিয়ে কী সব বলে চলেছে।

বাবা কিছুক্ষণ পর বলল, তুই যদি নেশা না ছাড়িস এখানেই শুয়ে থাকব, জলগ্রহণও করব না তোর ঘরে।

স্পষ্ট সব কথা মনে নেই, তবে সন্ধ্যের পর আমরা ফিরে আসছিলাম, বাবা চুপচাপ সামনে হেঁটে যাচ্ছিল। বাবার মুখেই পরে শুনেছি, সে না কি নেশা ছেড়ে দিয়েছিল। যদিও অনেকেই পুনরায় আগের জীবনে ফিরে যেত সঙ্গদোষে— এরকম আক্ষেপ করতেও শুনেছি বাবাকে।

ধর্মে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু সেদিন সারাদিন রোদে খাটিয়ায় শুয়ে যে-চেষ্টা বাবা করেছিল, তার সাফল্য ব্যর্থতা মাথায় রেখেও বাবার ওই রূপকে শ্রদ্ধা না করে পারি না। কেন-না নেশা ধ্বংস করে দেয় এক-একটা সংসারকে— নিজের চোখে দেখেছি।


আরেকটি ঘটনার কথা বলি, তাকে দৃশ্য বলাই ভালো— যা আমাকে এক ঝটকায় অনেকটা বড়ো করে দিয়েছিল। যা ছিল এতদিন রহস্য আমার কাছে আর বাল্যের কৌতূহল মাত্র, শরীরে একটা অনুভূতি আনে কিন্তু কুয়াশাচ্ছন্ন হয়েই থেকে যায়— তা হঠাৎই স্পষ্ট প্রকট রহস্যহীন হয়ে ওঠে সেই দৃশ্য দেখবার পর।

একটা সাইকেল জোগাড় করতে পারলেই হল, তামাজুড়ি হয়ে যে-পিচ রাস্তা পশ্চিমে বাঁশপাহাড়ির দিকে চলে গেছে, ওই পথে কয়েক কিমি গেলেই চাকাডোবা। তার একটু আগে ডান দিকে রাস্তা ঢুকেছে, পায়ে চলা পথ, নুড়ি পাথরময় সেই পথে সাইকেল চালানো খুব কঠিন। ঘন জঙ্গল, দূরের কিছু দেখা যায় না।

দিনের বেলাও এত শান্ত চুপচাপ চারিদিক, মনে হয় একটা পাথরে বসে সারাদিন কাটিয়ে দিই। ওই পথে কিছুটা এগোলেই লালজল পাহাড়। অমন নাম কেন জানি না। পাহাড়ের অনতিদূরে একটি গ্রাম— পাহাড়ে উঠলে পুরো গ্রামটা ছবির মতো স্পষ্ট দেখা যায়। ছোট্ট পাহাড়, যেন বড়ো বড়ো আখাম্বা কালো পাথর এলোমেলোভাবে কেউ সাজিয়ে তুলেছে।

লোকবিশ্বাসের ওপর কথা চলে না। ওই পাহাড়ের গুহায় না কি কোনো সাধু এককালে সাধনা করত। আমি নিজে চোখে দেখেছি— সেই গুহা এত সংকীর্ণ যে, সেখানে বছরের পর বছর কারুর পক্ষে বাস করা অসম্ভব মনে হয়। তার ওপর লম্বা চ্যাটালো পাথরগুলোর বিন্যাস এমন যে, দেখলে মনে হবে এই বুঝি ধ্বসে পড়বে একটু ধাক্কা দিলেই। ভয়ে ভয়ে কতবার উঠেছি, কখনো একা, কখনো সঙ্গে দু-একজন থাকত।

একেবারে ওপরের পাথরটা এমনভাবে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে, যেন একটা বারান্দা। একটু ঢালু কিন্তু বেশ বসা যায়। তাতে যে কত অজস্র প্রেমিক-প্রেমিকার আঁচড়! সবাই নিজেদের প্রেমকে স্থায়ী করতে চেয়েছে তাদের নাম লিখে। কিছু পড়া যায়, কিছু দুর্বোধ্য লিপির মতো, পড়া যায় না।

এর নীচেই একটা পাথর আছে, ওপর থেকে চট করে দেখা যায় না। সেবার একাই গিয়েছি, আনমনে পাথরটার ওপরে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাই।

কিন্তু যেন একটা ঘষটানির শব্দ আর ফিসফাস, খুব কাছেই।

কীসের শব্দ বুঝতে না পেরে পাথরের এক প্রান্তে সরে যাই— আর চমকে উঠি। যে-দৃশ্য দেখবার জন্য মন প্রস্তুত ছিল না তেমন কিছু যদি ঘটতে দেখা যায় তাতে মনের যে-অবস্থা হয়, আমার সেই বর্ণনাতীত অবস্থা তখন। সেইসঙ্গে বহুদিন মনের ভেতর জমতে থাকা শরীরী রহস্য— দুটো নগ্ন শরীরের আঁচড়কামড় আর ছন্দোময় ওঠানামায় যেন সেই রহস্য উন্মোচিত হয়ে যায়। ওরা তখন ভ্রূক্ষেপহীন, তাদের হুটোপাটিতে যেন আস্ত পাথরটাই ধ্বসে পড়বে অনেক পরে একটা লেখায় পড়েছিলাম, পিকাসো ষোলো বছর বয়সে গুস্তাভ কুর্বে-র আঁকা একটি নগ্ন ছবি (Origin of the World) দেখে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন, আমারও সেই দশা তখন।

একটা যৌনক্রিয়া— যা বালকের দেখা প্রথম যৌনদৃশ্য যে কীভাবে মস্তিষ্কে ক্রিয়া করে তা টের পেয়েছিলাম আমি। বহুদিন পর্যন্ত ওই দৃশ্য আমার মাথাজুড়ে উথাল-পাথাল করত। অমন উন্মুক্ত, অমন উদ্দামতা। যখনই একা থাকতাম তাদের শীৎকারধ্বনিগুলো আমাকে উত্তেজিত করে দিত।

ওই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে অমন মুক্ত যৌনতা এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়ে থেকে গেছে আজও— এবং তা আমার মধ্যে এই ধারণার জন্ম দেয় যে, অর্গলবদ্ধ অন্ধকার ঘরের ভেতর ঘটে চলা যৌনক্রিয়া কখনো পূর্ণতায় উন্নীত হতে পারে না।

প্রথম পাতা

Categories
গদ্য

রণজিৎ অধিকারীর গদ্য

বাল্যকাল কিংবা এক কাল্পনিক অতিভুজ

কিন্তু হারমোনিয়ামটা গেল কোথায়! মালপত্র নামানোর সময় দেখা গেল বাকি সবই আছে— ডুগি তবলা, খোল, বাঁশির লম্বা ব্যাগ, তার সানাই, আমাদের পোশাক-আশাকের ব্যাগ… শুধু হারমোনিয়াম নেই।

এদিকে গানের আসরের সময় হয়ে এল, এখন উপায়!

গ্রামের নাম মনে নেই, ঝাড়গ্রাম থেকে শিলদা যাওয়ার পথে, শিলদার একটু আগের একটা বাস স্টপে নেমে ডান দিকে জঙ্গল পেরিয়ে কয়েক মাইল ঢুকে এসেছি আমরা। সন্ধ্যের আগে আগে আমাদের মালপত্র আনার জন্য এখান থেকে গোরুর গাড়ি পাঠানো হয়েছিল। সবকিছু গাড়িতে তুলে দিয়ে আমরা ঝাড়া হাত পা পেছনে হেঁটে হেঁটে আসছি। বাবা দলের অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। আমি একটু আগে আগে। দু-দিকে শালের জঙ্গল ঘন হয়ে এসেছে, আধো জ্যোৎস্নায় সেই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলেছে বছর পনেরোর চোখ। নুড়িভরা উঁচু নীচু পথে চলতে হোঁচট খেতে হয় কিন্তু কিছুক্ষণ পর চোখ সয়ে গেলে অসুবিধা হয় না। কথা বলতে বলতে আমরা কখনো গাড়ির চেয়ে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ি, আবার কাছাকাছি হই… বয়স্করা এত কথা বলে কেন?

ওরা দেখে কম, বলে বেশি।

গ্রাম থেকে যে-লোকটি আমাদের আনতে এসেছিলেন, তিনি শোনাচ্ছেন, কেমন ধর্মপ্রাণ তাঁর গ্রাম, কবে কোন কীর্তনীয়া এসে পরপর পনেরো দিন আসর করতে বাধ্য হয়েছিলেন, শ্রোতারা কেমন মুগ্ধ হয়ে রাত জেগে গান শোনে… দেখবেন আসন ছেড়ে কেউ উঠে যায় না… আপনার গান হবে বলে সকাল থেকে মাইকে প্রচার চলছে। টুকরো টুকরো এমন সব কথাই মনে আছে। অন্তত ২৬-২৭ বছর আগের কথা।

কিন্তু এখন উপায়? বাবার খুব সখের চেঞ্জার হারমোনিয়াম। চেঞ্জার হারমোনিয়ামে কীর্তন গাইতে তখন আর কোনো কীর্তনীয়াকে আমি দেখিনি।

সাধারণত কীর্তনে সিঙ্গল বা ডাবল হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হত। শুধু জুড়ি বা জুড়ি হায়ার রিডের প্রচলন ছিল।

অবশ্য হারমোনিয়াম নিয়ে বাবাকে খুব চিন্তা করতে দেখলাম না। বলল— গ্রামে কোনো হারমোনিয়াম নেই? এনে দিন, তাতেই গান হবে।

পাওয়া গেল কেষ্টযাত্রার দলের একটা সিঙ্গল হারমোনিয়াম।

সারা গ্রাম ভেঙে লোক এসেছিল সেদিন পালাকীর্তন শুনতে। বাবা অনেকবার বলেছে আমাকে যে— সেদিন না কি আমি চমৎকার খোল বাজিয়েছিলাম। অবশ্য ওই বয়সে যা-ই বাজাই শ্রোতারা প্রশংসা করত। পরপর তিন দিন সেখানে আসর হল, তারপর আবার চললাম ফুলকুসমার পথে। কিন্তু সেদিনের সে-হারমোনিয়াম রহস্যের উন্মোচন আজও হয়নি।

এই মধ্যবয়স থেকে যখনই নিজের লম্বিত জীবনের দিকে তাকাই— অবাক হই। কেমন ছিল সেই বাল্যকালের চোখে দেখা জগৎ? আজকে যা দেখি, যেভাবে চারপাশের জগৎ আমার সামনে প্রতিভাত হয়— তা এতটাই আলাদা যে, বুঝি সেইসব দিনের সঙ্গে একটা বড়োসড়ো ফারাক ঘটে গেছে কীভাবে যেন! আমি, আমার দেখা দৃশ্য আর উপলব্ধির। সেদিনের ‘আমি’ থেকে আজকের ‘আমি’ পর্যন্ত যদি একটা রেখা টানা যায় আর সেদিনের ‘আমি’-র থেকে সেইসব দিনের উপলব্ধ জগৎ পর্যন্ত আরেকটা রেখা আঁকি— দুটো রেখা মিলে একটা কোণ তৈরি করে না কি? যত দিন যায় বাল্যে দেখা জগতের সঙ্গে এই আমি-র দূরত্ব বাড়তেই থাকে, যেন একটা ক্রমপ্রসারমান কাল্পনিক অতিভুজ… হায়, কখনোই যা যুক্ত হবে না, কোনো রেখা দ্বারাই!

কত কিছুই যে বদলে যায়! ধারণাগুলো পালটায়… মনোভঙ্গি, বিশ্বাসের ধরন…।

তবু সেইসব দিন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এক কোণে, হারায় না। আমার… আমাদের মতো সাধারণের তুচ্ছের জীবনেও তারা কত ঝলমলে। কোনটা লাল, কে-বা গাঢ় নীল, মুখ করুণ করে থাকা দিন, বাঁকাচোরা, বেদনার, তুমুল সুখের কিংবা হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করা ভালো লাগার দিন…। এক বালক শালবনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একা, বনের দিকে তাকিয়ে থাকে, ভয় পায়, ছোটে… হয়তো এটুকুই মনে পড়ছে এত দূর থেকে, তার আগের পরের আর কিছুই মনে নেই, অন্ধকার।

তবু সেই ছবিটির কী অসীম মূল্য আমার কাছে!

বাবার এক অল্পবয়সী শিষ্য, তার কথা মনে পড়ছে। তখন সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো, পড়া ছেড়ে দিয়েছে, বাড়িতে থাকে না, টো টো করে ঘুরে বেড়ায় তাই বাবা তাকে সঙ্গে নিয়েছে। কিন্তু আমার তাকে ভালো লাগেনা একটুও, একেবারেই সহ্য করতে পারি না।

সে বাবার আজ্ঞা পালন করে, আমাকে খুশি করার চেষ্টায় থাকে। বাবার কথামতো তার সঙ্গেই ঘুরতে বেরোতে হয়, একা কোথাও যাওয়ার সুখ নেই আর। বিরক্ত হয়ে থাকি তার ওপর। হারমোনিয়ামটা আমি তুলতে পারি না, সে অনায়াসে সেটা তুলে আসরের মাঝখানে রেখে আসে। আমি অল্পবয়সের ঈর্ষায় পুড়তে থাকি। মনে অশান্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াই, খাই, বাজাই।

বাবা অবসরে তাকে তবলা শেখাতে বসে, তার খ্যাংরা কাঠি আঙুলে কোনো বোল ফোটে না দেখে আমার আনন্দ হয়। আড়ালে হাসি। কী বিচিত্র মানুষের মনের রূপ!

মেট্যালা থেকে লাল রাস্তা ঢুকে গেছে গভীর জঙ্গলের ভেতর, আমরা ওই পথেই সেদিন হুমগড়ের কাছাকাছি একটা গ্রামে যাচ্ছি। বড়ো শালগাছগুলো কেটে নেওয়ায় কোথাও কোথাও বেশ ফাঁকা। হয়তো কাছাকাছি কোনো গ্রাম আছে, কিন্তু দেখা যায় না, ছেলেদের চিৎকার ভেসে আসে, মহিষ চরে বেড়াচ্ছে। বিকেল শেষ হয়ে আসছে, তখন এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছই, রাস্তাটা নেমে গেছে, ঝোরামতো, জল পেরিয়ে যেতে হবে।

বাকিরা হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে পেরোনোর প্রস্তুতি নেয়।

কিন্তু আমি? বাবা বলল— মনু, তুমি ভাইকে ধরে পার করে দাও। বলা হল ধরতে কিন্তু সে তখন আচমকাই আমাকে ঘাড়ে তুলে নিল, ওই শরীরে কী শক্তি তার!

কিন্তু আমি কেন পারলাম না একাই জল পেরোতে?

এই সুযোগে ও আমাকে কব্জা করতে চায়? কিন্তু কয়েক মিনিট ওর কাঁধে চেপে জল পেরোতে পেরোতেই ওকে ভালোবেসে ফেললাম। বাল্যকালের চোখের জল কী বিশুদ্ধ! তারপর থেকে সে যে কী আপন হয়ে উঠল আমার! যেখানে যাই, সে সঙ্গে যায়, যে-কোনো সমস্যা থেকে সেই উদ্ধার করে। যোগাযোগ ছিল অনেক দিন।

পরে একসময় খবর পাই বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দিকে না কি মাওবাদীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল, পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়েও ছেড়ে দেয়। তারপর কিছুদিন তার খোঁজ কেউই পায় না। বেশ কিছুদিন পর জঙ্গলের ভেতর তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। কেন কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল? কে তার উত্তর দেবে?

তার কথা যখনই মনে পড়ে— বাল্যকাল থেকে আজকের এই আমি পর্যন্ত টানা যে-কাল্পনিক রেখা তা আরও টানটান হয়ে ওঠে, ব্যথায় টনটন করে ওঠে।

না, তার জন্য নয়, এই কান্না এক বিশুদ্ধ উপলব্ধির।


ঘটনাটি ঘটেছিল কোথায়— ছাতনা না কি বিষ্ণুপুরে?

ও-সব দিকে তখন রামায়ণ গান বা পালাগান শুনতে লোক হত দেখবার মতো। মাঝে মাঝে আমার ভয়-ভয়ই করত, বুক দুরুদুরু…। পারব তো এতজনের সামনে বাজাতে? অবশ্য গান শুরুর কিছুক্ষণ পরেই বেশ হাত জমে যেত, তখন এত এত দৃষ্টির সামনে বাজাতে ভালোই লাগত।

কিন্তু সেদিন গান শুরুর অল্প কিছু পরেই বিপত্তি ঘটল।

এমন আর কখনো ঘটেনি।

একজন সমীহ করবার মতো বনেদি চেহারার প্রৌঢ় হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে বললেন— এভাবে আপনি পালাগান করতে পারেন না।

বাবা থামিয়ে দিলেন গান, ভালো করে বুঝতে চাইল তাঁর বক্তব্য।

যা বুঝলাম, বাবা গানের মধ্যে যে-রাগরাগিণীর আরোপ করছে, তা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। কৃষ্ণবিষয়ক গান বিশুদ্ধ সুরে গাওয়া উচিত ইত্যাদি।

বাবা কীর্তন শিখবার আগে কিছুকাল মার্গ সংগীতের চর্চা করেছে। শুনেছি, বাবার ঠাকুরদার আমল থেকে আমাদের বাড়িতে ধ্রুপদী সংগীতের চর্চা, তার প্রভাব পড়েছিল বাবার মধ্যে। আমি লক্ষ করতাম, একেকদিন বাবা একটু বেশিই রাগ-রাগিণীর ব্যবহার করত। আর সেদিন আমাকে খোল রেখে বেশি তবলা বাজাতে হত।

তবে সেদিনের মতো আর কখনো ঘটেনি। বাবা তৎক্ষনাৎ আসর ত্যাগ করল, একটা গুঞ্জন শুরু হল শ্রোতাদের মধ্যে। অনেকে সেই মানুষটির ওপর বিরক্ত হলেন। কর্তৃপক্ষ এসে বারবার অনুরোধ করলেও বাবা কারো কথাই শুনলেন না।


একটি মতে বাঁকুড়ার ছাতনা শহরে যে-বাশুলী মন্দির আছে, সেখানেই চণ্ডীদাস সাধনা করতেন। সেই মন্দিরের পিছনে একটি লাগোয়া ঘর, আমরা একবার ওই ঘরটিতে টানা পনেরো দিন থেকেছি। মন্দিরের সামনে আটচালা তারপর মাঠ, মাঠ ঘেঁষে পিচ রাস্তা চলে গেছে, রাস্তার ওপারে একটি ছোটো পুকুর। কথিত যে, ওই পুকুরেই রামী রজকিনী কাপড় কাচতে আসত। আমরা দিনের পর দিন ওই পুকুরে স্নান করেছি। কিন্তু সবসময়ই মনে হত, গল্পে শোনা পুকুর কেন এত ছোটো হয়! কল্পনা আমার বাধা পেত।

অবশ্য আমার এই বালকোচিত কল্পনার সঙ্গে ঐতিহাসিক সত্যের কীই-বা সম্পর্ক!

এখানে আসর বসত সন্ধ্যের মুখে মুখে এবং গান শেষ হত রাত দশটার মধ্যেই।

প্রচুর নানা বয়সের মহিলা গান শুনতে আসত।

তারা কখনোই বাজনার মান বিচার করত না।

একটি অল্পবয়সী ছেলে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে কখনো শ্রীখোল কখনো তবলা বাজাচ্ছে— এটাকে তারা বিস্ময়মিশ্রিত মুগ্ধতা দিয়ে দেখত।

পুরুষ শ্রোতারা এই ব্যাপারটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিত না। বরং তাদের মধ্যে অনেকেই থাকত কীর্তনের প্রকৃত সমঝদার।

তো তখন সাধিকা রাধার চরণ পাবে বলে কৃষ্ণের চূড়া বামে হেলছে…

চূড়া বামে-এ-এ হে-এ-লে-এ বামে হেলে-এ।

কৃষ্ণের চরণ পাবে বলে।

বামে হেলে চূড়া-আ-আ বা-আ-মে-এ হেলে-এ।

কৃষ্ণের চর-অ-অ-ণ পা-আ-বে-এ বলে…

আর গলার মালা তখন?

আপনি দোলে মালা আপনি দোলে

গলার গুণ কি মালার গুণ…

দোলে মালা সে যে

ধীর লয় থেকে পরের গানেই আমার হাত দ্রুত লয়ে বোল তুলত খোলে।

প্রাণ খুলে বাজিয়েছিলাম কি সেদিন? গানের আসর ভাঙতেই প্রৌঢ়া ক-জন মা মাসির মতো আদল তাদের— এসে আমাকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নেয়। আর বল লোফালুফির মতো এ-কোল ও-কোল হতে হতে কখন তুলনায় অল্পবয়সীদের কোলে পৌঁছে গেছি। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল কিন্তু এমন একটা অনুভূতি যা আগে কখনো হয়নি, অজস্র নারীর চুম্বন আর তাদের শরীরের ঘনিষ্ঠ স্পর্শ আমাকে এক নতুন সুখানুভূতির কাছে নিয়ে গিয়েছিল— অনেক পরে যখন স্পষ্ট যৌন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, যৌবনের দিনগুলিতে তা যেন একটা আর্তিই বয়ে এনেছে আমার কাছে কিন্তু সেদিনকার সেই দমবন্ধ হয়ে আসা সুখানুভূতি আমাকে নতুন অপূর্ব একটা জগতের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিল। তখন সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি— সেদিনের সেই সমবেত আদরের কথা যখনই মনে পড়ে, আবিষ্ট হয়ে পড়ি। ভাবি যে, আমার এই ছোট্ট সংগীতজীবনের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার হয়তো পেয়েছিলাম সেদিনই।

শেষ পাতা

Categories
গদ্য

তমাল রায়ের গদ্য

কে জন্মায় হে বিপ্লব?

‘লুকিং আউটসাইড ইজ ড্রিমিং, লুকিং ইনসাইড ইজ এওকেনিং’

দাদুর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে, ছ-বছরের মেয়েটি। সম্পর্ক হয়তো একটা কিছু আছে। এও সত্য সব সম্পর্কের নাম হয় না। পথ যেমন হয় উঁচু বা নীচু। সব পথেরই শেষ থাকে। অথবা থাকে না। এও হাইপোথিসিস! সে তুমি গল্পই লেখো বা ছবি আঁকো বা মুভি নির্মাণের সময় কিছু স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন মাস্ট। কিন্তু চূড়ান্ত নয়! ধরো দাদুর নাম ইগো আর শিশুকন্যা কনসাসনেস। বাকিটা সময় বলবে। মানে কাহিনিতে রং ঢং লাগাবে সময়। ধরা যাক দাদুর স্ত্রী বিগত হয়েছেন প্রায় বছর ত্রিশ। তার নাম ছিল আনকনসাস। তার সন্তানদের কেউ ছিল লিবিডো, কেউ ইডিপাস বা ইলেক্ট্রা। সময় নামক গণৎকার এদের বড়ো করায় বাঁধা হননি। কেবল যার গর্ভ থেকেই কনসাসনেসের বাপ কাকার জন্ম, সেই আনকনসাসকে তুলে নিয়েছিলেন ঈশ্বর। ঈশ্বরও এক আপেক্ষিকতা। যে থাকলে আমাদের মত খেঁদা, প্যাঁচা বা টেঁপা, টেঁপিদের সুবিধে। যা বলার প্রয়োজন তা হল, যে-কোনো জার্নিই হল একটা ইনডেফিনাইট মেকিং! যাতে বাতাসের মিহিগুঁড়োর মতো অজান্তেই লেগে থাকে সাররিয়েল বা সুপার রিয়েল। দূরে একটা পাহাড়। ধরা যাক তারও উত্তরে জনপদ। পাহাড় টাহার যদি এনসার হয় খামখেয়ালির, তাহলে বলা যাক, এনারা উত্তরেই জেনারালি অভিষিক্ত। যেমন ধ্রুব তারা। যদিও ধ্রুব এক ফলস্‌হুড। এখানে বলা বাহুল্য মিসোজিনি আছে। মিথোজীবিতাও আছে। ধরা যাক পাহাড়ের কোলে একটি গ্রাম, গ্রামের নাম ইচ্ছেবাড়ি অথবা নকশালবাড়ি। আর ইগো নামক প্রৌঢ় কনসাসকে নিয়ে হেঁটে চলেছেন স্মৃতিসৌধ প্রদর্শনে। নাত্নি কনসাসনেস। আপাতত আঙুল তুলে দেখাচ্ছে একটি নদী। জল বয়ে যেত কখনো। এখন খটখটে শুকনো। দাদু অবশ্য আকাশ ভরা সূর্য তারার নীচে দাঁড়িয়ে সে-সব কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ, সন্ধ্যে নামছে, পাখিরা ঘরে ফিরছে। আর কুয়াশা জড়ো হয়েছে অনেক। শীত আসার আগে যেমন হয়। ধানক্ষেতে মৃত্যুর নোটিস বা বিপ্লব! কেবল কুয়াশায় হারিয়ে গেল কনসাসনেস। স্বজন হারানোর দুঃখে শোকে ইগো কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তোমার মহাবিশ্বে প্রভু হারায় না-কো কিছু। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে চলেছেন: ‘কালেক্টিভ কনসাসনেসের কথা। আর কনসাসনেস শুকনো নদী পেরিয়ে ইগোকে খুঁজতে গিয়ে হাতে পেয়েছে চিরকুট। লেখা লুকিং আউট সাইড ইজ ড্রিমিং, লুকিং ইনসাইড ইজ এওকেনিং। শেষ আলোটুকু সম্বল করে, কনসাসনেস এপারে, আসতে চেষ্টা করছে। পেরে উঠছে না। বয়সোচিত কারণেই সে নিরুদ্বিগ্ন। ইগোকে এলোপাথাড়ি দৌড়াতে দেখে, সে হাসছে। ভাবছে এও এক খেলাই। সমাজ সভ্যতা বা বিপ্লবের ইতিহাসে যেমন হয় আরকী!

ফ্রেদরিকোর তেমন ভরসা ছিল না বর্ষায়। গ্রীষ্ম আরামদায়ক হলে সে বসে থাকত সমুদ্রতীরে। একা বসে থাকার সময় আলো আঁধারিতে চোখে পড়ত, একটা উজ্জ্বল আলোর অবিরাম ঘুরে যাওয়া। মার কাছেই শোনা, বাবা না কি অমনটাই ছিলেন, শুনে সরে যাওয়া আলোর সিঁড়ি বেয়ে সে পৌঁছতে চেয়েছিল টাওয়ারে। সেখান থেকে সমুদ্রকে চেনা যায়। দূরত্ব যেভাবে চেনায় সময়কে। একটানা সোঁ সোঁ সুরের মাঝে অক্ষরের পর অক্ষর গাঁথলে জন্ম নেয় ব্যালাড। যুদ্ধ তেমন বৃহৎ হয়ে ওঠে না কখনোই। কিন্তু লড়াইটা থেকে যায়। ফলে টবে লঙ্কা গাছ, তার পাশে নয়নতারা, তারও পাশে ক্রিসানথিমাম। চিঠি আর আসত না। পাগলের মতো মাথা নাড়াতে নাড়াতে ফ্রেদরিকো সময়ের কাঁটা কে উলটো করে দিতে চাইত। সে চাইত হাতদুটো হোক আরও লম্বা, প্রেম বা বিরহে দীর্ঘ হাতই একমাত্র অবলম্বন অথবা আলিঙ্গন। তারপর ফট ফট কিছু শব্দ। আর ঘুম ছড়িয়ে গেল শহরে। বৃষ্টির ছাঁট লাগতে যখন হুঁশ ফিরল টবে ফুটেছে মৃতদেহ। সমুদ্র থেকে টবের দূরত্ব মাত্র কয়েক মিটার। বাকিটা ক্যামেরায় দেখানো হয়নি। কেবল বিশাল তারাভরতি কসমিক এম্ফিথিয়েটারে তখন কেবল সমুদ্র গর্জন। ক্যাওসের জন্ম হচ্ছে ফ্রেদরিকো ফুলের পাশেই…

যে বা যারা ভীতু, সর্বদা দর্শনকে যুক্তি হিসেবে খাড়া করে, এছাড়া উপায়ই বা কী!

: কাম্যু।
: হুঁ
: সত্য বড়ো প্রকট, আলোর মতোই। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মিথ্যে বরং দূর নক্ষত্রের মতো, যা আশপাশের অনেক কিছুই চেনায়।
: কে?
: বলো দেখি।
: বুঝি না।
: কে, সার্‌ত্র? সিমন দি বোভোয়া?
: কাম্যু।
: সত্যি বলে কি সত্যি কিছু আছে?
: জানি না।
: কেন?
: আর মিথ্যে?
: এত জেনে কী হয়?
: কিছুই হয় না হয়তো। তবু তো মানুষ জানে।
: ইয়ং ইটালি কে গঠন করেন?
: জানি না।
: মাৎসিনি।
: ইউ এন ও কবে প্রতিষ্ঠা হয়?
: জানি না।
: ১৯২০, ১০ জানুয়ারি।
: আচ্ছা!
: পৃথিবীর স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধ কোনটি?
: জানি না।
: ১৮৯৬। ব্রিটেন আর জাঞ্জিবার। ৩৮ মিনিট। ব্রিটেন জিতেছিল।
: আচ্ছা!
: আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটান কে?
: জানি না!
: আব্রাহাম লিঙ্কন।
: বুঝলাম। জাতি সংঘ বলে কি আদৌ কিছু আছে? না কি বড়োলোক দেশের দালালি করাই জাতি সংঘ!
: হুঁ
: কী হুঁ?
: যুদ্ধ কি শেষ হয় আদতে?
: কী জানি!
: ক্রীতদাস প্রথার অবসান হয়েছে? ইজ ইট?
: তোমার কী মনে হয়?
: এপ্রিল ১৪, ১৮৬৫। গুড ফ্রাইডের প্রেয়ারে তাকে কেন খুন হতে হল?
: বেশ!
: আর জানো, যুদ্ধ টুদ্ধ কখনোই শেষ হয় না। চলতেই থাকে।
: আর মৃত্যু?
: কী?
: কিস্যু না, যেদিন প্রেম থাকবে না। আত্মমর্যাদাবোধ থাকবে না, সেটাই মৃত্যু! সে তুমি যতই বেঁচে থাকো। আপাতত ছায়ার সাথে ছায়ার যুদ্ধ ল্যান্ডস্কেপে। কেবল বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। কেউ হয়তো কাঁদছে। কেউ কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে সংগোপনে।

ভিজে ক্যানভাসে হেঁটে যাচ্ছে ছোট্ট চড়াই। ধোঁয়া উঠছে। জীবন না মৃত্যুর কে জানে!


চলন্ত জানলার রডে আপাতত বসে একটি পাখি। ট্রেনের গতি খুব মন্থর! উপায়ও নেই। লাইনের দু-ধার জুড়েই অসংখ্য মানুষ অভিনন্দন জানাচ্ছে… ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছে… পাখি খানিক ঘাবড়ে কামরার মধ্যে ঢুকে ওড়াউড়ি করল। ধাক্কা খেল, সার দিয়ে রাখা বন্দুকে। তারপর কী করে যেন উড়ে গেল বাইরে! যাবার আগে পিচিৎ করে খানিকটা পায়খানাও করে দিয়ে গেল। ভেতরে গান চলছে, চেনা সুর, মনে পড়ছে না কিছুতেই… কেউ খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে, কেউ-বা সদ্য কেনা জামা বা ট্রাউজার্স। মাইকিং হচ্ছে। ফুল ছুঁড়ছে লোকজন, কী উন্মাদনা। ওরা বিশ্বাস করে, এ-দেশ তাদের মাতৃভূমি, আর মাতৃভূমির বীর সন্তানরা এই ট্রেনে করে এগিয়ে চলেছে… প্রশস্তিমূলক কথা আর গানের মাঝেই পোয়াতি মেয়েটা কী কুক্ষণে কেঁদে উঠল এরই মাঝে, কে জানে! হঠাৎ ভাবগম্ভীর পরিবেশ! সকলের চোখেই জল। কুমারী মেয়েটা তার ইউ এস জি রিপোর্টের প্যাকেটটা ট্রেনের দরজায় দাঁড়ানো যার হাতে তুলে দিল তার বাম বগলের তলায় ধরা ক্রাচ! ট্রেন চলছে। আবার স্লো বিটে প্যাট্রিওটিক সং বাজছে। ট্রেন এগোচ্ছে, সামনে কিছু দূরেই তো ওয়ার ফ্রন্ট…