Categories
গল্প

সুজয় পালের গল্প

মনশোকরহিতা

সারাদিন পর ঢাকঢোল বাজিয়ে পূর্ণাহুতির মাধ্যমে শীতলাপূজা শেষ হল, ঠাকুরমশাই বেশ গর্বের সাথে বললেন, “লিন, এ বসরের মতো শেতলাষ্টমীর মায়ের পুজো নির্ভিগ্নে শেষ হোলো,

Categories
গল্প

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের গল্প

প্রত্যাশা নিরোধক

ধ্রুবর কোনোদিনও প্রত্যাশা ছিল না। আমার মনে প্রত্যাশা জন্মাক— তাও চায়নি। অথচ আমি অসাবধানে প্রত্যাশাধারণ করে ফেললাম। রাতে একা ছাদে বসে বসে নিজেকে বোঝাতাম, “আসলে কেউ কাউকে ভালোবাসিস না। প্রথম প্রথম, তাই ঘোর লাগছে। নেশা… অ্যাডিক্ট হয়ে গেছিস। বেরিয়ে আয়… না হলে এরপর বাংলা সিরিয়ালের মতো হবে। আজ গিফটের কথায় ইমোশনাল হয়েছিস, কাল অন্য কোনো কারণে হবি। ঠিক ততটাই সময়ে চেয়ে বসবি যতটা ধ্রুব ওর পরিবারকে দেয়… ন্যাকামো এবং শয়তানী একসাথে করা হবে সেটা!”

আসলে, আজকাল ধ্রুবকে সত্যিই খুব চালাক মনে হয়। ওর ইমোশনাল উইকনেস নেই। নিজের জীবনের স্বাদ বদলাতেই আমাকে এভাবে অ্যাপ্রোচ করেছিল— অসমবয়সী বন্ধু, হেলদি রিলেশনশিপ। আর পরিণত বয়সের ইন্টেলেকচুয়াল, ইমপ্রেসিভ ব্যক্তিত্বদের প্রতি আমার দুর্বলতা আমাকে মারল। ধ্রুব আমার কাছে অবশ্যই এমন কিছু… যা সমবয়সী কোনো পুরুষ-বন্ধু কোনোদিন হতে পারেনি।

“You who suffer because you love, love still more. To die of love, is to live by it.”

— তুমি আমার কাছে ফাদার-ফিগার নও… আর আমিও তোমার মেয়ের মতো নই। তাহলে সমস্যাটা কোথায় বলো তো?

— বাবার মতো, মেয়ের মতো… এ-সব লেবেলিং না থাকলে কনসার্ন ফুরিয়ে যায় না।

— ও… কনসার্ন?! কেমন কনসার্ন শুনি? পেশেন্টের জন্য ডাক্তারের? না… কনসার্নটা ঠিক কেমন… হেল্প মি?

— তোকে এখন যা-ই বলব… ভুল মানে করবি। তিক্ততা বাড়বে।

— না, তুমিই তো বলছ কনসার্নের কথা। কোনোভাবে আমি কনসিভ করলে এই কনসার্নটা থাকত তো? আর আমি অ্যাবর্ট করতে না চাইলে?

আসতে আসতে অনেক কিছুই অপছন্দ হচ্ছিল মানুষটার। জড়াতে চাইছিলাম না… অথচ প্রত্যাশাটা ঘন হচ্ছিল। অনেকদিন পর দেখা হলে লম্বা একটা ইন্টারকোর্স… দু-তরফে কাঙ্ক্ষিত অর্গ্যাজম। তারপরেই ও উঠে বসে সিগারেট ধরাত, অথবা মোবাইলে ম্যাসেজ দেখতে শুরু করত। যেন ক্লায়েন্ট, মিটে গেছে… এবার আমি চাইলে কিছুক্ষণ থাকতে পারি, না হলে আসতে পারি। নিজেকে ডিট্যাচ করার চেষ্টাও করছিলাম… ভাবতে পারিনি এভাবে একটা ধাক্কা আসবে। দু-তিন দিন কনডম না ব্যবহার করার জন্য ওকে দোষ দিইনি… ইচ্ছে আমারও ছিল। কিন্তু যখন কাঁধে মাথা রেখে জানতে চাইলাম, “টেস্ট পজিটিভ এলে কী করবে?”… নিরাসক্ত ভাবে বলল, “কেন? অ্যাবর্ট করে দেবে?”

কোনো সংকোচ নেই… দ্বিধা নেই… রাস্তার ধারে গাছের ডাল ছেঁটে দেওয়ার মতো কোল্ড অ্যান্ড ইজি সলিউশন।

তুমি তো জানতে আমার ওভারিয়াল সিস্টের কথা? তুমি তো জানতে আমাকে ডিপ্রেশনের জন্য ওষুধ খেতে হয়? ডাক্তার ধ্রুব… তখন কোথায় ছিল তোমার কনসার্ন?

একটা আপাত উষ্ণ মনের মানুষকে এমন বেনিয়া ক্লায়েন্টের মতো ঠান্ডা মাপা উত্তর দিতে দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। ডাক্তারি করতে করতে কি সবরকম কাটা-ছেঁড়াতেই এরা সাবলীল হয়ে যায়?

সেদিন ফিরে এসে দুটো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম… প্রায় এক সপ্তাহ রোজ ঘুমের ওষুধ খেতে হত। বাবা আলাদা থাকা শুরু করার পর বাড়িতে লুকিয়ে যার কাছে কাউনসেলিং করতে যেতাম… আবার তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলাম। আবার অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট, নার্ভের ওষুধ— এ-সব দিল। তাকে সব কথা ভেঙে বলতে পারিনি… একটা কাল্পনিক বয়ফ্রেন্ডের নামে দোষ চাপিয়ে দিলাম। দুঃস্বপ্ন দেখা, হাত কাঁপা, ইনসিকিওরিটি— এ-সব বললাম।

ধ্রুবর মতো কারো জন্য নিজের জীবনের স্বাভাবিকতা নষ্ট করছি— এটা ভেবে সব থেকে বেশি রাগ হত নিজের ওপর।

কলকাতার বাইরে পিএইচডি করতে যাচ্ছি— জানিয়েছিলাম ধ্রুবকে। আমার এই স্পেসটা দরকার ছিল… শুধু ধ্রুব না, চেনা জানা সবার থেকে… সবকিছুর থেকে। ইচ্ছে করেই কলকাতার বাইরে অ্যাপ্লাই করলাম। খুব সাফোকেটিং লাগছিল চারপাশের সবকিছু। একরকম মোনোটোনাস মানুষগুলোকে। অসহ্য লাগছিল বোনকে, মাকে। মনে-প্রাণে চাইছিলাম পালিয়ে যেতে।

ধ্রুব বারণ করল না। শুধু বলল— তুই বুঝবি না, জানি। বাট আই রিয়েলি ফিল ওরিড ফর ইয়ু। দূরে থাকবি, একা থাকবি… দুশ্চিন্তা হবে— কেউ না কেউ তোকে এক্সপ্লয়েট করছে। কোনো না কোনোভাবে তুই ব্যথা পাচ্ছিস।

“এক্সপ্লয়েট তুমিও করেছ ধ্রুব। ব্যথাও দিয়েছ… ব্যথা দিতে ভালোই লাগত তোমার।”— এ-সব চেপে রেখে বললাম, “ও সব ফালতু চিন্তা ছাড়ো। হাজারটা ছেলেমেয়ে পড়তে যাচ্ছে। নো বিগ ডিল। যাদের চিন্তা করার তাদের জন্য করো।”

ধ্রুব কথা বাড়াল না। যোগাযোগ রাখার জন্যে জোরও করল না। শুধু বলল, “খোঁজখবর রাখিস… এলে জানাস। কিছুই তো তোর অজানা নয়।”

ফর আ চেঞ্জ… সেদিন আমরা ক্লিনিকে না, দেখা করতে গেছিলাম বাগ বাজার ঘাটের ওদিকে। পিএইচডি-তে চান্স পেয়েছি বলে ট্রিট দিয়েছিল… খেয়েওছিলাম নির্লজ্জের মতো।

“‎And yet I have had the weakness, and have still the weakness, to wish you to know with what a sudden mastery you kindled me, heap of ashes that I am, into fire.”

বাসন মাঝতে মাঝতেই আমার রুম-মেট দিশারীর লাউড মোনিং শুনতাম। এত কাছ থেকে অন্য কাউকে এভাবে গোঙাতে শুনিনি। নিজে মোন করা আর অন্যরটা শোনা এক নয়। তবে এ-সব সয়ে গেছিল। আমার প্রয়োজনটা ছিল অন্যরকম। খুব ইচ্ছে করত পুরোনোদের কাবার্ডে বন্ধ রেখে বেশ কিছু নতুন বন্ধুদের মাঝে বাঁচতে। অ্যাডিকশন ছাড়াতে অনেক সময়ে যেমন বিকল্প কিছু ধরিয়ে দেওয়া হয়… হয়তো সেরকম। ধ্রুবকে ভোলার চেষ্টা করলে ভেতরে একটা চাপা কষ্ট হত। সেক্স স্টার্ভড মনে হত নিজেকে। কাউকে বলতে পারতাম না। হয়তো মিডল এজ ক্রাইসিসের মতো শোনাত… লোকে হাসত শুনে, আলোচনা করত আড়ালে।

অরিঘ্ন ছিল এক চমৎকার থেরাপি। বিন্দাস… গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে। নিজের ফ্ল্যাটে ঘর অন্ধকার করে, নীল-লাল এলইডি-চেইন জ্বালিয়ে ট্রান্স মিউজিক শোনে। শখের গিটার বাজায়। চাকরি করে… কিন্তু দায় নেই উন্নতি করার। কমিটমেন্টের ধারে কাছেও যাবে না… ঠিক করে রেখেছে। ওর ঘরে বসে হুঁকো টানতাম… রেট্রো মিউজিক শুনতাম… বাইরে থেকে যা হোক আনিয়ে খেতাম… সঙ্গে রাম। অরিঘ্নও আসত আমাদের ফ্ল্যাটে। রুম-মেট বুঝত আমারও কেউ আছে… শুধু আমিই একতরফা মোনিং শুনতে বসে নেই। ভালো জেল করত আমাদের মধ্যে। এমনকী আমার টপ ওর গায়ে হত, আর ওর পাঞ্জাবী আমি পরে বসে থাকতাম। ওই আমাকে অ্যাডভাইস দিত— তুই চুল ছোটো করে ফেল… আমি লম্বা করি। তুই কালার্ড লেন্স নে, আমি কাজল পরি। তুই ট্যাটু কর… আমি পিয়ার্সিং করি। ধ্রুবর ছায়া থেকে আমাকে টেনে সরিয়ে আনছিল ছেলেটা। অরিঘ্নকে আমি থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম, কিন্তু ঠকাতে চাইনি। নিশ্চিন্ত ছিলাম, ওর কমিটমেন্ট নেই… ও আমার ওপর মানসিকভাবে নির্ভর করে না। অবাক হতাম… বন্ধুত্বর থেকে শারীরিক সম্পর্কের এই কেমিস্ট্রিটা এত ম্যাচিওরভাবে সামলাতে দেখে।

ওই দিনগুলোতে অরিঘ্ন পাশে না থাকলে হয়তো ম্যানিক ফেজটা আবার জাঁকিয়ে বসত, স্ট্রেসটা আমাকে পিষে ফেলছিল।

দু-তিন সপ্তাহর গ্যাপ হলে অ্যাডিক্টদের মতোই একটা কষ্ট হত। ধ্রুবকে তত বেশি ঘেন্না করতাম। বেসিনে গিয়ে থুতু ফেলতাম ধ্রুবর মুখটা মনে করে… দায়ী করতাম সব কিছুর জন্য। অরিঘ্নকে ডেকে পাঠাতাম, বা ওর ফ্ল্যাটে চলে যেতাম… হয়তো না জানিয়েই। দরজায় তালা থাকলে সিঁড়িতে কিংবা রাস্তায় বসে অপেক্ষা করতাম। কিছুক্ষণ ফোরপ্লের পরেই মাথাটা একদম খালি হয়ে যেত। ধ্রুব যেমন পছন্দ করত, সেভাবেই এক্সপার্ট হয়ে উঠেছিলাম। ধ্রুব নিজেকে বাঘ ভাবত, আর পরাজিত শিকারের মতো অসার হয়ে যেত শেষের দিকে। অরিঘ্নকে পেয়ে মাঝে মাঝে আমার বাঘ-নখ বেরিয়ে আসত। ও সামলাতে পারত না। মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নিত, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার ভান করত। ধ্রুব বলত, “তোকে অন্য কেউ ফোর্স করবে, তোর কষ্ট হবে— ভাবলে আমারও কষ্ট হয়, বিশ্বাস কর?”… এগুলো মনে পড়লে আরও বেশি জোর করতাম অরিঘ্নকে, ডমিনেট করতাম ভীষণ রকম। “ব্লোজব পেলে তো এনজয় করিস! চাটার সময় হেজিটেট করছিস কেন? চাট?!” দু-তিনবার চড়ও মেরে দিয়েছি, মৃদু আপত্তি করছিল বলে। সরি বলেছি পরে। মুড ঠিক করতে নিজের এল শরীরে এলইডি চেইন জড়িয়ে বলেছি— চল ফটোশুট কর!

ও ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে পারত… বা সোজা বলে দিতে পারত— পোষাচ্ছে না। তার বদলে শুধু জল খাওয়া, সিগারেট খাওয়া, জয়েন্ট বানানো… এসবের নামে পালিয়ে বাঁচত। একবার শুধু গায়ের দাগগুলো দেখিয়ে বলেছিল, “এরপর অ্যান্টিসেপ্টিকটাও নিজেই আনবি। কলকাতা গেলে মা-র সামনে জামা খোলা চাপ হয়ে যায়!”

সহ্য, কিংবা সাহায্য… কেন অরিঘ্ন এটা করত, জানি না। ওর পক্ষে সম্ভব ছিল আমাকে বিছানা, ফ্ল্যাট কিংবা জীবন থেকে লাথি মেরে সরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু ও ধ্রুব নয়। তাই, সচেতনভাবেই পারতাম না ওকে আঘাত দিতে। আবার ভয়ও হত… আর একটা ডুবো নির্ভরতায় ধাক্কা খাব।

কলকাতায় যিনি কাউনসেলিং করতেন, তাঁকে ফোন করলাম… ভিডিয়ো-কলে কাউনসেলিং শুরু করলেন। এছাড়া আর উপায় ছিল না।

“If you loved someone, you loved him, and when you had nothing else to give, you still gave him love.”

বোনের গায়ে হাত তুললে বোনও আমাকে ছেড়ে দেবে না। আর, মা মানসিকভাবে অভিভাবক নেই আর। কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। এভাবেই কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাবে মেয়েটা। এটাই ওর ভবিষ্যৎ।

একবার কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম ঠাট্টার ছলে— “আয়নায় গিয়ে নিজের মুখটা দেখ আগে!” তারপরই মনে পড়ল— একবার তিন দিন স্কুলে যায়নি ও… একজন টিচার ক্লাসে এই কথাটা ওকে বলেছিলেন বলে। ও মুখে কিছু বলল না, দেওয়ালে ঝোলানো আয়নাটা নিয়ে ছাদ থেকে নীচে ফেলে দিল।

অথচ বোনকে কিছুটা হলেও আমি ধ্রুবর কথা বলেছি। প্রফেসর আর কলেজের বন্ধুদের কথা বলেছি। অরিঘ্নর কথা বলেছি।

যদি আমি দুটো কথা বললে, ও একটা কথা বলে। এতে শুধু আমার সিক্রেট জেনেছে, আমি তেমন কিছুই পাইনি ওর থেকে ব্ল্যাকমেল করার মতো। তাও ছোটো বোন… আত্মকেন্দ্রিক আর ঢ্যাঁটা হলেও কিছুটা ভরসার জায়গা। মা-বাবার থেকে বেশিই ভরসার জায়গা। দিদিমা চলে যাওয়ার পর আর কেউই নেই কথা শেয়ার করার মতো।

এইরকম একটা ঢ্যাঁটা, অকৃতজ্ঞ এবং আত্মকেন্দ্রিক ভরসার কথা উপেক্ষা করেই ধ্রুবর কাছে গেলাম। বেড়ালের নখ লেগেছে— এটা মিথ্যে নয়।

দুপুর নয়, সন্ধ্যেবেলা… পাঁচজন পেশেন্টের পর। মানিকদা জিজ্ঞেস করল কেমন আছি। ভাগ্যিস বলেনি— কদ্দিন পর এলে!

ধ্রুবর মধ্যেও তেমন পরিবর্তন লক্ষ করলাম না আমাকে দেখার পর। হাতে আঁচড়টা দেখে বলল, “এমন কিছু না। এর থেকে বেশি আঁচড় লাগে মানুষের।”

— জন্তুর আঁচড়।

— হ্যাঁ জন্তুর আঁচড়… মানুষের আঁচড়… চিন্তা করার মতো কিছু না।

— ইনজেকশন লাগবে না? সিরিয়াসলি বেড়ালের নখ লেগেছে!

— নিয়ে রাখো তাহলে… সেফটি। মানিককে বলে দিচ্ছি। আর একটা অ্যান্টিসেপ্টিক লিখে দিলাম। এনাফ।

— ইচ্ছে করে আঁচড়ায়নি, লেগে গেছে অ্যাক্সিডেন্টালি।

— হুম, অ্যাক্সেন্ডান্টালিও আঘাত লাগে… নাম?

‘নাম’ জিজ্ঞেস করতে থমকে গেলাম। প্রায় এক বছর কোনো যোগাযোগ নেই, রাখতেও চাই না। কিন্তু এতটা?!

চুপ থাকতে পারলাম না, বলে ফেললাম, “কিছুই মনে পড়ছে না?”

প্যাডে আমার নামটা লিখল, পদবিটা লিখল না। লিখতে লিখতেই বলল, “কিছুই ভুলিনি।”

চুপচাপ দেখলাম… প্রেসক্রিপশন লিখে গেল ভাবলেশহীন মুখে। ফ্যানের হাওয়ায় কপালের সামনে এসে পড়া চুলগুলো উড়ছিল। আগে হলে সরিয়ে নিয়ে কপালে একটা চুমু খেতাম। প্রেসক্রিপশনটা হাতে দেওয়ার আগে আবার নামের কাছে নিয়ে গেল কলমটা, জিজ্ঞেস করল— “পদবিটা যেন কী?”

— ডু ইয়ু ইভেন নো মি?!

— পদবি মনে থাকে না… মানুষ থেকে যায়।

কোনো রকমে ফিজটা দিয়েই প্রেসক্রিপশনটা হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমার ভুল, পুরোপুরি আমার ভুল। ধ্রুব অনুতপ্ত হওয়ার কোনো কারণই খুঁজে পায়নি এই এক বছরে।

ঘরে ফিরতেই বোনকে দেখলাম থমথমে মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলে উঠল, “আমায় তো কিছু বলিসনি!” টপ-টা চেঞ্জ করতে করতে নিতান্ত বিরক্তি নিয়েই জানতে চাইলাম— কীসের কথা, কী জানানো হয়নি। তখনও ইঞ্জেকশনের জন্য হাতটা ব্যথা করছিল। নখের আঁচড়ের থেকে ছুঁচ ফোটানোর ব্যথা বেশি। “অরিঘ্নদাকে ফোন করেছিলাম।” কথাটা শুনেই বোনের দিকে ঘুরে চেঁচিয়ে উঠলাম, “কী?!”

— চিল! নম্বর ছিল… কল করেছিলাম।

— আমার ফোন ঘেঁটে ওর নম্বর নিয়েছিস?

— সো হোয়াট?

— ঠিক করিসনি। আই অ্যাম নট ওকে উইথ ইট। এখনই স্ক্রিনলক মারব…

— সে তোর প্রাইভেসি নিয়ে তুই চাট… বাট ইয়ু শুড হ্যাভ টোল্ড মি! এক্সপেক্ট করেছিলাম জানাবি যে ইয়ু হ্যাভ মুভ্ড অন।

কথাটা মনের ভেতর থিতিয়ে নিতে কিছুটা সময় চলে গেল। অরিঘ্নর ব্যাপারে বোনকে হালকাভাবে বলেছিলাম। প্রোফাইল ঘেঁটে পোস্ট-কমেন্ট এ-সব দেখে ও-ই ধরে নিয়েছিল আমরা রিলেশনে আছি। আমিও বলে দিয়েছিলাম ফার্স্ট স্টেজ… কেমন এগোয়ে দেখি।

অরিঘ্নর সঙ্গে বোনের কতদিন ধরে কথা চলছে কিছুই জানি না… আজ জানলাম ওদের মধ্যে কথা হয়। অরিঘ্ন আমাকে জানায়নি, অথচ বোনকে জানিয়েছে— ও বিদিশার সঙ্গে রিলেশনে আছে; আমাদের মধ্যে আর কিছু নেই। অথচ আমি জানলাম না… আমারই ব্যাচমেট বিদিশার সঙ্গে ও রিলেশনে আছে!

একবার মনে হল— বোনকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য পুরোটাই ব্লাফ দিয়েছে অরিঘ্ন। বা আমাদের দু-জনকেই কাটিয়ে দেওয়ার জন্য…

বিদিশা বা অরিঘ্নর প্রোফাইলে ওদের দু-জনের সম্পর্কে এমন কিছুই পাইনি… যার থেকে আন্দাজ করা যায় ওদের মধ্যে কিছু brew করছে।

আমার এই ফ্যান্টম রিলেশনের শেষ হয়ে যাওয়ার খবরটা আমার একেবারেই পাত্তা দেওয়ার কথা না। অরিঘ্ন আর বিদিশা দু-জনকেই চিনি… জিজ্ঞেস করলেই হয়। তাও কেমন বারবার মনে হচ্ছিল— বিদিশার জন্য অরিঘ্ন আমাকে ডিচ করল। লুকিয়েছে আমার থেকে ইচ্ছে করেই। বিদিশাও নিশ্চয়ই জানে না— আমি ওর ফ্ল্যাটে যাই, ও আমার ফ্ল্যাটে আসে।

অরিঘ্নও যেন কীভাবে ধ্রুব হয়ে উঠল হঠাৎ… শুধু বোনের মুখ থেকে শোনা একটা কথায়…

বুকের ভেতর থেকে একটা কান্না ঠেলে আসছিল। পারলাম না। অরিঘ্নর ম্যাসেজ দেখতে বা ওকে ফোন করতেও ইচ্ছে হল না। ফোনটা সুইচ অফ করে ছাদে বসে একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিলাম। বোন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল… বিচ্ছেদের সান্ত্বনা। লুকিয়ে কেনা রামের বোতলটা ব্যাগ থেকে বার করে রাখল। যেমন স্নেহময়ী মা সন্তানের সামনে মন খারাপের সময়ে প্রিয় খাবার এনে রাখে।

রামের বোতলটা শেষ করতে করতেই মনে পড়ল… কাল আমার কাউন্সেলিং-এর শেষ দিন। উনিই বলেছিলেন ধ্রুবকে একবার ফেস করে দেখতে… ওভারকাম করতে পারছি কি না। ফেস করতে বলেছিলেন, আমি বাঁশ নিয়ে এলাম। কাল দিদিমার কথা বলব। মাঝে মাঝে দিদিমাকে স্বপ্নে দেখি। দিদিমার মৃতদেহ ফুল-দিয়ে সাজানো, শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইলেকট্রিক চুল্লি না, নিমকাঠে দাহ হচ্ছে। দাহ হওয়ার মাঝে যখন সবাই অন্য দিকে… দিদিমা আমার হাত ধরে মন্দিরের সিঁড়িতে বসে আছে। কেউ ওভাবে আমার হাত ধরেনি। ধরে না। আমাদের কথা হয় না। আগুনের শিখা অন্ধকার আকাশের দিকে ভেসে ভেসে যায়। ঝিঁঝিঁ ডাকে একটানা, আর দূরে শেয়াল… মাঝে মাঝে। দিদিমা নিজের সৎকার দেখে চশমা না পরেই… এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে। যেভাবে দশমীর দিন মায়ের বরণ দেখত তাকিয়ে তাকিয়ে।

ছ্যাঁকা লাগতেই সিগারেটটা আঙুলের ফাঁক থেকে পড়ে গেল। বোন ছাদে চিৎ হয়ে পড়ে আছে আউট হয়ে… বিড় বিড় করছে। ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর দিদুনকে মনে পড়ে?” চোখ খুলে তাকাল, তারপর আকাশের চাঁদের দিকে দেখিয়ে হাতটা ফেলে দিল আবার।

দিদুন বলেছিল—

“ব্যথার নিজস্ব স্মৃতি থাকে। যে ব্যথা দিয়েছিল, যে ব্যথা ভুলিয়েছিল, অথবা সারিয়েছিল— তাদের স্মৃতি। তোর দাদু আমার গায়ে দু-একবার হাত তুলেছিল, সে-ব্যথার দাগ নেই। কিন্তু একবার একজন হাতটা পিছমোড়া করে এমন মুচড়ে দিলে!… মনে করলেই কবজিটা এখনও টনটন করে। এখন কেমন দেখতে হয়েছে কে জানে!”

প্রথম পাতা

Categories
গল্প

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের গল্প

প্রত্যাশা নিরোধক

“For every hundred crimes committed in the name of love, only one is committed in the name of sex.”

Categories
গল্প

অরিন্দম রায়ের গল্প

হতে পারত একটি ভূত
কিংবা একটা বাঞ্চোৎ-এর কাহিনি

“বল মাগি…”

চমক ভাঙল। ভূতটা যেন স্বপ্ন-জগতে ছিল এতক্ষণ।

ভূতেও স্মৃতি হাতড়ায়? এটা ভেবে এ অবস্থাতেও বাচ্চু যেন কিয়দ পরিমাণ হেসে ফেলল। স্মৃতি বড়ও নিঠুর। বোকাও। সময় অসময় না বুঝে নাক গলায়। বাচ্চু তারপর ভাবতে থাকল…

ভূতটা দ্যাখে, নীলুকে দেওয়ালে ঠেসিয়ে দেওয়া হয়েছে যেমন-তেমন করে। কিছুটা কাত হয়ে সব নিগ্রহ সহ্য করছে নীলু। তাকে অর্ধ-বিবস্ত্র করা হয়েছে। ওর রক্তশূন্য স্তন মর্দন করছে দু-জন দু-পাশে দাঁড়িয়ে। আর হোঁৎকাটা বন্দুকের নল এগিয়ে দিচ্ছে সায়ার দিকে। নীলুর চোখে জল। বাচ্চু স্পষ্ট দেখে ভূতটা কিছুই করতে পারে না। নিঃশব্দে অশ্রাব্য খিস্তি দেয় কেবল। বালের সমাজ শালা ভূতে ভয় পায়। ভূত নিয়ে ভয়ঙ্কর সিনেমা বানায়। ঘণ্টা! ভূত শালা কেবল দেখতে পারে। করতে পারে না কিছুই। করতে পারলে তো সমাজটাই শালা বদলে যেত। নীলুর উপর অত্যাচার বাড়ে। বাচ্চুর ভূত খুঁজে পায় না কী করবে!

দেওয়ালে ঠেস দেওয়া বাচ্চু বোঝে ভূতের ফোকালাইজার কেটে যাচ্ছে এবার। নীলুর এভাবে যন্ত্রণা পাওয়া, নিগ্রহ, ও কল্পনা করতে পারছে না আর। অথচ, ও নিশ্চিত জানে এমনই হবে, এমনই হয়। তাই আবার ফিরে যায় বাকিটা দেখতে। অদমনীয় কৌতূহলে…

নীলুর বাঁ ভ্রুতে সিগারেট গুঁজে দিল কে একজন। বোবা নীলু যন্ত্রণায় কাতরায় কেবল। বেঁকে যাওয়া ঠোঁট রক্তাভ। বাচ্চু তার শেষ স্মৃতিচিহ্ন এঁকেছে কিছু আগে। এমন সময় পাশের ঘর থেকে কে আঁতকে উঠে হাঁক পাড়ল— “স্যার! এখানে একটা মেয়ের বডি…”

— নাহ! নীলুকে মরতেই হবে। নইলে বাচ্চুর মরেও মুক্তি নেই। বাচ্চু স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। নীলুকে রেখে যাওয়া চলবে না কিছুতেই। কিন্তু গুলি তো দুটো। তবে তো মেয়েকে থাকতে হয়… বাচ্চু প্রাজ্ঞ এক ঋষির ন্যায় ধ্যানস্থ হয় মনের তপোবনে… নতুন করে সাজায় মরণ-ঘুঁটি…

ঘরের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বাচ্চু পড়ে মেঝেয় চিৎ হয়ে। থকথকে ঘিলু ছিটকে আছে। রক্ত-ঘিলুর উপর ভারী বুটের ছাপ পড়ছে। এ-ঘর থেকে ও-ঘর হেঁটে ফিরছে কতকগুলো পা। একটা হোঁৎকা মতন বিশ্রী লোক। মুখে সিগারেট। বাচ্চুর দিকে ঘৃণিত চোখে একবার দেখে নিয়ে সম্মুখের ঘরে এগিয়ে এল। এসে বসল চেয়ার নিয়ে। বলল—

“কোনো ভয় নেই মামণি। এই, এর মুখের কাপড়টা খুলে দে…”

ঘণ্টা দেড়েক পর বন্ধনমুক্ত হয়। মেয়েটা ভেঙে পড়ে কান্নায়। ও জানে না বাচ্চু মরে পড়ে আছে পাশের ডাইনিং-এ।

“আমার বাবা কোথায়? মা?”

“তোমার বাবা একটা আস্ত শুয়োরের বাচ্চা ছিল। বুঝলে মা? তুমি জানতে না তোমার বাবা কী করত? মালটা খোচর ছিল। কত লোকসান…”

“না, না। বাবা এমন ছিল না”

“চোওপ! ন্যাকামো না। বল তোর বাবার কোথায় সিক্রেট রুম? কী কী এভিডেন্স পেয়েচে দেখতে হবে”

“জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না। আমি তো হোস্টেলে থাকতাম। দু-দিন হল বাড়ি এসেছি”

“ধ্যুৎ! কেন যে শালা সহজে কেউ কিছু বলে না! ভালো লাগে না বাল! এই, একটু নাড়াচাড়া কর…”

বাচ্চুর ভূত বোবা হয়ে দেখে যাচ্ছে সব। কান্নার ভাব আসছে। কিন্তু অশ্রু না।

একজন পিস্তল ঠেকায় মেয়ের কপালে।

হোঁৎকাটা আঁতকে উঠে বলে— “এই! এ শালা, কেরে! একটা কচি ডাবকা মেয়ের মাথায় পিস্তল ধরা হচ্চে? বালটা জানো না প্যান্টের নীচে কামান আছে?”

‘‘হাঃ হাঃ হাঃ হা…”

মেয়ে চিৎকার করতে গেল… আর তখনই এক থাপ্পড়। ভয়ে কুঁকড়ে গেল ও। হোঁৎকাটা মেয়ের গালে, গলায়, পিঠে, ঠোঁটে, বুকে হাত ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে গেল। আবার। আবার।

“বলো মা, বলো… কামরা দেখিয়ে দিলেই হল। ল্যাটা চুকে যায়”

“বিশ্বাস করুন আমি কিচ্ছু জানি না’ কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়ে।”

“এই, এ মালটাকে মেঝেতে ফ্যাল।”

বাবা বাচ্চু, ভূতের চোখ দিয়ে মেপে নিতে চায় আগামী ঘটনা-প্রবাহ…

পিস্তলের নল তাক করা। না থাকলেও ক্ষতি ছিল না। তবু রাখে। একটা প্যান্টির পাশে সাময়িক ও ধারাবাহিকভাবে জমা হচ্ছে কতকগুলো জাঙিয়া। ভূতের তো চোখের পাতা থাকে না। তাই নিষ্পলক তাকিয়ে ও। ওঁরাওদের পাহাড় দেবতার মতো নিশ্চল। মেয়ের কোমরের নীচ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ভূতের মনে পড়ল প্রথম কয়েকবার ঋতুস্রাবের সময় মেয়েকে কিছুতেই চুপ করাতে পারেনি ও। সারাক্ষণ কেঁদেছিল। ভয়ে। আর তিনমাস পর, ও আঠারোর হতে পারত…

“লোকসান পুষিয়ে নে ভালো করে তোরা”— মেঝেতে হাঁটু দিয়ে কোলা ব্যাঙের মতো বসল হোঁৎকাটা। হোঁৎকাটার কাঁধের উপর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভূতটা দেখল ওই বিপুল মেদের পাহাড় থেঁথলে দিয়েছে কচি শরীরটা। মেয়ের ক্ষতবিক্ষত বুকের দিকে ভূতটা চেয়ে রইল পাথর চোখের নিষ্পলক ঈশ্বরের মতো…

দেওয়ালে ঠেস দেওয়া বাস্তবের বাচ্চু ভাবে ছেলেবেলায় শালা ফালতু ভয় পেত ভূতকে। প্রকৃতপক্ষে ভূত বড়ো অসহায়। একটা গাছ, একটা ধৃতরাষ্ট্র যেন। কিন্তু চক্ষুষ্মান। বাচ্চু বুঝল ওর পক্ষে আর দেখা সম্ভব নয়। ফোকালাইজার কেটে যাচ্ছে। কিন্তু তখন তার আর কিছু করার নেই। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে ও। তাই বাচ্চু দেখব না দেখব না স্থির করেও দেখতেই থাকল…

ইতিমধ্যে আরও এক হায়না ছোপ ছোপ রক্তে, পায়ের ছাপ এঁকে এগিয়ে এল অর্ধমৃত উলঙ্গ শরীরটার দিকে। মাত্র সতেরোটা বসন্ত… তার মধ্যে কতটুকুই-বা উপভোগ করেছে মেয়েটা! এমন সময়— ‘স্যার! বাচ্চু যে-দরজার মুখে পড়েছিল তার দরজা ভেঙে দেখলাম বোধহয় ওর বউয়ের লাশ…”

— নাহ! কিছুতেই মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ও যদি প্রকৃত পিতা হয় তবে মেয়েকে ওই নরক যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে মারতেই হবে তাকে। কোনো দ্বিধা নয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল রিভালভারেতো মাত্র দুটো গুলি। বউ, মেয়েকে মারার পর তবে ও নিজে ধরা পড়বে… আর একবার যদি ধরা পড়ে…

আলো-অন্ধকারময় একটা ঘর। উলঙ্গ বাচ্চু হাত বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে। তার পুরুষাঙ্গ রক্তাক্ত, কিছু চামড়া, মাথার চুল, দু-হাত আর পায়ের ছ-টা নখ ঘরের মেঝেয় ছড়ানো… ডেঁয়ো পিঁপড়ে লাইন দিয়েছে… বাচ্চু এ-সব দেখে আর শিউরে ওঠে। দেখে আর শিউরে ওঠে। কিন্তু দেখে… জ্বর অনুভব করে গায়ে। কিন্তু কী করবে ও? সিদ্ধান্ত নিতে পারে না! কাকে বাঁচাতে পারবে না? স্ত্রী? কন্যা? নাকি, নিজে? সব ওলোট-পালোট হয়ে যায় আবার। দেওয়াল ঘেঁষে বসে বাচ্চু। চূড়ান্ত অসহায় হয়ে কাঁদতে থাকে। দেওয়াল, যা প্রতিবন্ধকতার রূপক হিসাবে বহুল ব্যবহৃত হয় সাহিত্যে, তার গায়ে কিল মারে, মাথা ঠোঁকে… যেন এখুনি ত্রাতা হয়ে আসবে নরসিংহ… বালের ফিল্মে এমন হয় দেখেছিল কখনো। তাই কিল, চড়, থাপড় মারতেই থাকে দেওয়ালে… আর কাঁদতে থাকে… কাকে আরাম-মৃত্যু দেওয়া যায়… কিন্তু তা বলে নিজের বউকে খুন করবে? নিজের মেয়েটাকে… যাকে দেবশিশুর মতো বড় করেছে… অথচ মারা দরকার… কাকে মেরে বাঁচানো যায়… বাচ্চু চোখের জল না মুছে এবার আরও স্থির, ফোকাসড্‌ আর শান্ত হয়। সচেতনতার ঠুলি পরে পুনরায় সাজাতে চেষ্টা করে দৃশ্যপট। এবং পুনঃ তপস্বী হয়… কার কার মৃত্যু প্রয়োজন… ওদিকে বিড়াল পায়ে লোকগুলো উঠে এসেছে হয়তো বারান্দায়— বাচ্চু ভাবে। সময় নেই। দ্রুত ভেবে নিতে হবে বাচ্চুকে… সিদ্ধান্তে পৌঁছুতেই হবে। দুটো গুলি আর তিনটে মানুষ। বদ্ধ গুমোট ঘরে বাচ্চু ভাবতে থাকে…

[মার্জনা করবেন। কে খবর দিল? কারা, কেন বাচ্চুকে চায়ছে?— জানি না। বাচ্চু একটা চুতিয়া হয়তো। গণতান্ত্রিক সমাজের ক্ষতি করছিল। কাঁধে লোগো লাগানো হোঁৎকাটা রক্ষক হতে পারে। আবার হোঁৎকাটা বড়ো ব্যবসাদার হতে পারে, রাজনৈতিক নেতাও হতে পারেন বৈকি। কিংবা… যে কেউই হতে পারে। আপনি খামোখা ও-সব ভাববেন না। বরং ভেবে নিতে পারেন, আপনিই হোঁৎকাটা। শরীর একটু স্থূল হল? তা হোক। মজা নিন। আর ভেবে নিন— বাচ্চু অন্য ধর্মের, অন্য পার্টির, অন্য বর্গের, অন্য বর্ণের বা টিভি, চায়ের দোকানে তক্ক করা, প্রশ্ন তোলা অন্য মতাদর্শের বা ট্রেনের সিটে কমপ্রোমাইজড না করা একটা পিওর বাঞ্চোৎ।]

প্রথম পাতা

Categories
গল্প

অরিন্দম রায়ের গল্প

হতে পারত একটি ভূত
কিংবা একটা বাঞ্চোৎ-এর কাহিনি

শ্রমজীবী সূর্যটা প্রাত্যহিক দহনে বড়ো অবসন্ন এখন। এক পরিযায়ী শ্রমিকের মতো সে এলিয়ে পড়ছে ক্রমশ পৃথিবীর পশ্চিম কোলে। এদিকে গা ঘেঁষা-ঘেষি করে উঠে যাওয়া

Categories
গল্প

শুভদীপ ঘোষের গল্প

নিরুদ্দেশ

সারা গা চেটে দিচ্ছে কেউ এরকম একটা কিছু দেখতে দেখতে অনিমেষ শুনতে পায় রুপা জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে ‘অনি ওকে পাওয়া যাচ্ছে না, অনি’। ঘুম ভাঙার সময় ধাতস্ত হতে একটু সময় লাগে,

Categories
গল্প

শুভাঞ্জন বসুর গল্প

ধাক্কা

এক-একটা দিন এমন হিসেবের বাইরে দিয়ে চলা শুরু করে যে, চেষ্টা করেও আর হাতে আনা যায় না। গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছিল শিতাংশু। যেগুলো করলে মন মেজাজ ভালো থাকে সবকিছুই প্রায় করা হয়ে গেছে।

Categories
গল্প

অনুরাধা মুখার্জির গল্প

ডেথ সার্টিফিকেট

কিন্তু ডাক্তারবাবু তখনও জানতেন না যে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে আরও দুর্ভোগ, আরও অনেক যন্ত্রণা। বহু অপমান ভোগ করতে হবে তাঁকে। আজীবন দুঃখ ভোগ আছে তাঁর কপালে। সুলিখিত চিত্রনাট্যের সবেমাত্র প্রথম দৃশ্যের অভিনয় সাঙ্গ হয়েছে ‌গত রাতে।

দশটা বাজতে না বাজতেই আবার পুলিশ আসে ওয়ারেন্ট নিয়ে। ডাক্তারবাবু গ্রেফতার হন ভূয়ো ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার অপরাধে। পাড়ার মধ্যে অজস্র কৌতূহলী ও আশঙ্কিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে মাথা নীচু করে পুলিশের জিপে চড়ে চলে যান ডাঃ রায়। বেশ কয়েকদিন হাজতবাসের পর জামিনে মুক্ত হন তিনি। আদালতে তাঁর অপরাধ প্রমাণিত হয়। কিন্তু কী পরিস্থিতিতে তাঁকে ভূয়ো সার্টিফিকেট দিতে হয়েছিল তা আদালতের বিচার্য বিষয় ছিল না। শাস্তিস্বরূপ তাঁর রেজিস্ট্রেশন নাকচ হয়, তিনি হারান তাঁর পেশা, তাঁর চিকিৎসার অধিকার। লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, বিতাড়িত চিকিৎসক এতটা আঘাত নিতে পারলেন না। সিভিয়ার করোনারি এ্যাটাকের ফলে তাঁকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়। শয্যাশায়ী ডাক্তারবাবু জানতেও পারেন না যে, তাঁর দুই ছেলের জীবনে কী পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে।


ডাক্তারবাবুর ছেলেদের কথা বলার আগে তাঁকে শেষ করে দেওয়ার জন্য যে-নাটক সাজানো হয়েছিল সেই নিয়ে দুই একটি কথা বলে নেওয়া যাক। এই নাটকের রচয়িতা যদিও সেই ওসি কিন্তু উপাদান যোগাড় করে দিয়েছিলেন ওসিকে তাঁর পৃষ্ঠপোষক এক ধনাঢ্য স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি। মৃতা মহিলা তাঁর আশ্রিতা অসহায় আত্মীয়া। ইচ্ছেমতো ভোগ করার পর মহিলা যখন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন ও অনাগত সন্তানের পরিচয়ের জন্য দাবি জানান তখনই তাঁকে ইহলোক থেকে সরিয়ে দেবার জন্য পরিকল্পনা করা হয় দারোগাবাবুর জ্ঞাতসারে। আর এই হত্যাকাণ্ড তাঁর হাতে তুলে দেয় ডঃ রায়ের উঁচু মাথাটা ধুলোয় লুটিয়ে দেবার সুযোগ। তাই ডাঃ রায় বাড়ি ফিরে আসার পর মহিলার শব গেল শ্মশানে ও পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক রেড হল সেখানে, পুলিশের ডাক্তার রায় দিলেন বিষক্রিয়ায় মৃত্যু, শববাহকরাও গ্রেফতার হল। তবে পুলিশি তৎপরতায় আদালতে আত্মহত্যা প্রমাণিত হওয়ায় তারা মুক্তি পেল জরিমানা দিয়ে। জরিমানার টাকাও কিছু দিনের হাজতবাসের খেসারতস্বরূপ তারা ভালো টাকা পেয়েছিল। এ-সব তথ্য সামনে আসে অনেক পরে। তার আগেই ডাক্তারবাবুর জীবনে চরম সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে।

ডাক্তারবাবুর দুই ছেলে, বড়ো কানু ও ছোটো শানু। এই নামেই তারা এই তল্লাটে পরিচিত। সহদর ভাই হলেও স্বভাবের দিক দিয়ে তারা দু-জন বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। কানু জীবনকে নিয়েছিল খুব হালকা চালে, লক্ষ্যহীনভাবে সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া হল তার প্রকৃতি। সেই রাতের অত্যাচার আর বাবার এই লাঞ্ছনা দেখে সে হয়ে গিয়েছিল ভীত, সন্ত্রস্ত ও সদাসশঙ্ক।

আর উচ্চ-মাধ্যমিকের ছাত্র শানু দাদার একদম বিপরীত, অত্যন্ত গম্ভীর ও সিরিয়াস ছেলে। তার স্বপ্ন বাবার মতো ডাক্তার হবে সে, আর সেই লক্ষ্যেই নিজেকে গড়ে তুলছিল সে। কিন্তু সেই অভিশপ্ত রাতের অত্যাচার আর বাবার অবমাননা আর দুর্গতি তার মধ্যে জ্বালিয়ে দিল প্রতিহিংসার আগুন। সে ঠিক করে এই অত্যাচারের, অসহ্য লাঞ্ছনার আর বাবার অপমানের বদলা তাকে নিতেই হবে। বহু চেষ্টায় সে যোগাযোগ করে তাদের সঙ্গে যারা মাঝে মাঝেই গভীর রাতে চিকিৎসার জন্য তার বাবার চেম্বারের দরজায় টোকা দিত। তারাও শানুকে লুফে নিল। ওই অত্যাচারী পুলিশ অফিসারের নাম অনেকদিন যাবৎ তাদের হিটলিস্টে ছিল। এখন শানুর মুখে ডাক্তারবাবুর লাঞ্ছনার সম্পূর্ণ বিবরণ জানতে পেরে তাদের মাথাতেও আগুন জ্বলে উঠল। তৈরি হল প্ল্যান অফ আ্যকশন। এবার ফাঁদ পাতল তারা, মূহূর্তের ভুলে সেই ফাঁদে পা রাখলেন সেই অফিসার আর সেই ভুলের খেসারত দিতে হল তাঁকে নিজের প্রাণ দিয়ে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম— অত্যাচারীর ক্ষমা নেই।

কিন্তু পুলিশের গায়ে হাত পড়লে সমস্ত বাহিনী আহত বাঘের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। এই ঘটনার পর পুলিশ বাহিনী অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। সন্দেহভাজনদের তালিকায় শানুর নাম ছিল তাই সর্বপ্রথম কানুকে এনে হাজতে ঢোকায়। পুলিশের অত্যাচার কানুর মতো দুর্বল চিত্তের ছেলের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। তাই সে যতটুকু জানত, যা আন্দাজ করত সব বলে দিল পুলিশকে।

পুলিশ এবার হানা দিল শানুদের গোপন ডেরায়। অতর্কিত আক্রমণে কয়েকজন পালিয়ে যেতে পারলেও শানু ও আরেকটি ছেলে নিহত হল পুলিশের গুলিতে। শানুর দেহ সনাক্তকরণের জন্য হাজত থেকে বার করে আনা হল কানুকে। ভাইয়ের মৃতদেহ দেখে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়া কানুর চোখের সামনে দিয়ে যখন শানুর মৃতদেহের একটা পা ধরে টেনে হিঁচড়ে তোলা হল শববাহী গাড়িতে তখন কানু আর সইতে পারল না। অত্যাচারিত হয়ে পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দি ও তার ফলে শানুর হত্যা ও আদরের ছোটো ভাইয়ের মৃতদেহের নিদারুণ লাঞ্ছনা, বাবার ওপর নির্যাতন ও তাঁর নিদারুণ অসুস্থতা, এতগুলি আঘাত সহ্য করার মতো মানসিক শক্তি ছিল না কানুর, ফলে পাগল হয়ে গেল সে। ডাক্তারবাবু যখন সুস্থ হলেন তখন তাঁর দুই ছেলের মধ্যে একজন মৃত ও অন্যজন বিকৃত মস্তিষ্ক। আর পরিস্থিতির শিকার হতবাক, হতচকিত তাঁর স্ত্রী আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে কাঁদতেও ভুলে গেছেন। ডাক্তারবাবু নিজেও শয্যা আশ্রয় করলেন, পণ করলেন আর কখনো চিকিৎসা করবেন না।

কিন্তু জীবন তো শুধুই তমসাচ্ছন্ন নয়। তাই দিনের পর দিন চলে তাঁর দরজায় ধর্ণা। মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত রোগী যেমন আছে তেমনই আছে তাঁর বিনা ভিজিটের রোগীরা। সবাই প্রত্যহ সোচ্চারে জানিয়ে যায়— আমরা কাগজ জানি না, নম্বর চিনি না। আমরা শুধু আপনাকেই জানি। আপনার ওষুধই আমাদের কাছে মৃতসঞ্জিবনী। এগিয়ে আসে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারা বেকার যুবকরা, জানায় তারা ডাক্তারবাবুর নির্দেশ অনুযায়ী কম্পাউন্ডারের কাজ চালিয়ে নেবে। আগেকার কম্পাউন্ডারবাবুরা কাজ ছেড়ে দিলেও কাজ চালিয়ে নিতে পারবে তারা ও এই কাজের জন্য বেতনাভিলাষী নয় তারা। তাদের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা যে, চেম্বার খুলুন তিনি, আগের মতো রোগী দেখুন। আর পারলেন না ডাঃ রায়, আবার স্টেথোস্কোপ ধরতে বাধ্য হলেন নামকাটা ডাক্তার।

তাঁর আত্মীয় বন্ধুরাও চুপচাপ বসে ছিলেন না, অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন তাঁর হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। পুনর্বিচারে তিনি ফিরে পেয়েছেন তাঁর চিকিৎসার অধিকার।

সত্তরের দশকের পর কেটে গেছে আরও দুই দশক। রুগ্ন, জীর্ণ শীর্ণ ডাক্তারবাবু তাঁর পুরোনো মান্ধাতার আমলের এ্যাম্বাসেডর গাড়ি চড়ে প্রত্যহ সকালে বাড়ি বাড়ি কলে যান। তবে এখন ওই একবারই কলে বার হন দিনে। আগেকার মতো যখন-তখন বার হতে পারেন না শরীরের জন্য। তবে চেম্বারে দু-বেলাই বসেন। সাহায্যের জন্য একজন জুনিয়র চিকিৎসক নিয়োগ করেছেন। কিন্তু আর কখনো ডেথ সার্টিফিকেট তিনি দেন না। প্রয়োজন হলে নবীন ডাক্তার সেই কাজ করেন। সার্টিফিকেট লিখতে গেলেই তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীবনোচ্ছ্বল তাঁর দুই কিশোর পুত্র কানু, শানুর মুখ। যাদের একজন পৃথিবী থেকেই হারিয়ে গিয়েছে আর অপরজন আছে মানসিক হাসপাতালে। অথচ এই দু-জনকে যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই তিনি নিজের সব নীতি, আদর্শ বিসর্জন দিয়ে জীবনে প্রথম ও শেষ বারের মতো ভূয়ো ডেথ সার্টিফিকেট দিতে বাধ্য হয়েছিলেন আর আজ তাদের স্মৃতিই তাঁর হাত চেপে ধরে, সার্টিফিকেট লিখতে দেয় না।

প্রথম পাতা

Categories
গল্প

অনুরাধা মুখার্জির গল্প

ডেথ সার্টিফিকেট

বেলা এগারোটা। প্রতিদিনের মতো ডাঃ রায়ের চেম্বারে রোগীর ভিড় ওয়েটিং রুমে, বাইরের বারান্দা ছাপিয়ে সদর রাস্তা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। নিত্যদিনের এই এক চিত্র।

Categories
গল্প

অনুরাধা মুখার্জির গল্প

ডেথ সার্টিফিকেট

বর্ষার রাত। ডঃ রায়ের চেম্বারের দরজায় জোর ধাক্কা। এ ধাক্কা তো নির্যাতিত, আহত তরুণদের মৃদু সশঙ্ক করাঘাত নয়, এই শব্দ কোনো বলদর্পী, গর্বান্ধ ব্যক্তির সজোরে পদাঘাতের শব্দ। ডাক্তারবাবু নিজেই দরজা খুললেন। দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন জনাচারেক কনস্টেবল-সহ সেদিনের সেই থানা ইনচার্জ।

— ডঃ রায় আপনাকে তো একটু থানায় যেতে হবে, নিজের করতলে রুলার ঠুকতে ঠুকতে বললেন ওসি।

— এত রাতে! এই বর্ষায়! বিস্মিত প্রশ্ন ডঃ রায়ের।

— আপনি চিকিৎসক, চিকিৎসা আপনার ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তাই আপনার আপত্তি করার তো কোনো কারণ নেই। ব্যঙ্গের কশাঘাত হানেন থানা-অফিসার।

— কিন্তু থানায় তো আর রোগী দেখতে যেতে হবে না। এসেছেন তো আমায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তা সেটা তো কাল সকালেও করা যেতে পারে, তাতে তো কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। বিদ্রূপের প্রত্যুত্তরে বলেন ডাক্তারবাবু।

— ওহ্! সরি! থানা বলাটা আমার স্লিপ অব টাঙ্‌। থানা নয়, থানার কাছাকাছি আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে এক রুগ্না মহিলাকে দেখার জন্য আপনাকে নিতে এসেছি। ব্যঙ্গের রেশ তাঁর কথায় বেশ স্পষ্ট।

বিপদের আভাস পেলেও ডাক্তারবাবু শান্তভাবে প্রশ্ন করেন, “তিনি কি খুব অসুস্থ, কাল সকালে গেলে চলবে না?”

— না ডক্টর, তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। আপনি এখনি চলুন।

— চলুন তাহলে, আমি ভিতরে একটু বলে আসি। “পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে তিনি জিপে ওঠেন। নিদ্রাতুর ভীত চোখে তাঁর স্ত্রী এসে দরজা বন্ধ করেন।

দারোগাবাবুর সঙ্গে ডাঃ রায় এসে ঢুকলেন একটা ছোটো একতলা বাড়িতে যেটা মোটেও থানার কাছে নয়। যে-ঘরে তাঁরা ঢুকলেন সেখানে একটি তক্তাপোশের উপর এক মহিলা দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছেন ও রোগীর আশেপাশে কেউ নেই। ডাক্তারবাবুর অভিজ্ঞতা তাঁকে পুরো ঘটনার অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে সচেতন করল। তিনি এগিয়ে গিয়ে রোগিনীর মুখ দেখলেন, অনাবশ্যক জেনেও রোগিনীর নাড়ি, আঙুল ও নখের রং পরীক্ষা করলেন ও স্পষ্ট বুঝলেন রোগিনীর মৃত্যু হয়েছে বিষক্রিয়ায়, এবং তাঁকে ডেকে আনার নিহিতার্থ তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। ধীরে রোগিনীর হাতটা নামিয়ে রেখে ওসির মুখোমুখি দাঁড়ালেন— “এই মহিলার মৃত্যু অন্তত ঘণ্টা তিনেক আগেই বিষক্রিয়ায় হয়েছে, তবে আমাকে এভাবে ডেকে আনা হল কেন?”

— ইয়েস ডঃ রায় সে-তথ্য আমার জানা আর আপনাকে ডেকে এনেছি কারণ, আমার একটা নর্মাল ডেথের সার্টিফিকেট চাই আর সেটা আপনাকেই দিতে হবে।

— অসম্ভব। গর্জে ওঠেন ডাঃ রায় “এ তো ক্লিয়ার কেস অফ পয়জনিং, মে বি মার্ডার অর সুইসাইড। আর তার তদন্ত তো আপনার এক্তিয়ারভুক্ত। আমি সার্টিফিকেট দেব না।”

— দিতে তো আপনাকেই হবে ডাক্তার। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন ওসি, “অসম্ভবকে সম্ভব করার পদ্ধতি আমার জানা আছে।”

— আমি দেব না। দৃঢ় স্বরে জানান ডাক্তারবাবু।

এরপর ঘরের মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন ডঃ রায় আর পিঞ্জরাবদ্ধ পশুর মতো পদচারণা করতে থাকেন দারোগাবাবু। আর শয্যায় পড়ে থাকে বিষজর্জর মহিলার মৃতদেহ। এইভাবেই কেটে যায় ঘণ্টাখানেক। এবার থানা ইনচার্জ চীৎকার করে ওঠেন— “আপনি সার্টিফাই করবেন কিনা?

“কখনোই নয়।” শাণিত স্বরে উত্তর শোনা যায়।

“আপনাকে করতেই হবে ডাক্তার। না শুনতে আমি অভ্যস্ত নই।”

— আমি করব না, কী করবেন আপনি? এ্যারেস্ট করবেন? টর্চার করবেন? করুন আপনার যা খুশি। কিন্তু আমার এক কথা সার্টিফিকেট আমি দেব না।

এবার তীব্র ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে ওসির কণ্ঠস্বরে— দেবেন ডাক্তার দেবেন। দাওয়াই আমার জানা আছে। ডাক্তারকে নিয়ে এবার থানায় আসেন তিনি। এএস আই-কে বলেন, “যাও। ডাক্তারের দুই ছেলেকেই তুলে আনো।”

— এ আপনি করতে পারেন না। ডাক্তারবাবু চীৎকার করে ওঠেন।

— আমি সব পারি ডাক্তার। এখন ইমার্জেন্সি চলছে। মিসায় তুলে আনব আপনার ছেলেদের আর প্রমাণ করে দেব যে, তাদের সঙ্গে বেআইনি রাজনৈতিক দলের যোগাযোগ আছে। ইচ্ছে করলে এনকাউন্টারও করতে পারি। ছাদ কাঁপিয়ে অট্টহাস্য করে ওঠেন দারোগাবাবু।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর দুই কিশোর পুত্রকে হাজতে পুরে দেওয়া হয়। তারপর চলে নির্মম অত্যাচার। ছেলেদের আর্তচিৎকারে কানে হাত চাপা দিয়ে বসে থাকেন ডাক্তারবাবু। তাদের প্রতিটি আর্তনাদ যেন তাঁকে কশাঘাতে বিদ্ধ করে। তিনি জানতেন তাঁর অস্বীকৃতির মূল্য তাঁকে চোকাতে হবে, তিনি সমস্ত দুর্যোগের কল্পনা করেছিলেন নিজেকে ঘিরে আর তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলেন। কিন্তু কোনো নরপিশাচ যে তাঁর নিরপরাধ কিশোর পুত্র দু-টির উপর এরকম নির্মম অত্যাচার করতে পারে তা ছিল তাঁর স্বপ্নাতীত। এই দুঃসহ অবস্থায় কেটে যায় অনেকটা সময়। আর পারেন না তিনি সহ্য করতে। পিতৃহৃদয়ের অনাবিল স্নেহের কাছে মাথা নত করে তাঁর আদর্শ, চিকিৎসকের নীতি, তাঁর মূল্যবোধ। ডাক্তার কাঁপা হাতে লিখে দেন সার্টিফিকেট। অফিসারের উচ্চ হাস্যে ফুটে ওঠে তাঁর বিজয়োল্লাস। দুই পুত্র-সহ ডাক্তার মুক্তি পান ভোররাতে। অনেক কষ্টে আহত, পীড়িত দুই পুত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন যখন, তখন রাজপথে যান চলাচল শুরু হয়েছে। প্রাথমিক শারীরিক চিকিৎসার পর (মানসিক ক্ষতের চিকিৎসা করার মতো মানসিক সুস্থতা তখন তাঁর নিজের ছিল না) পুত্রদের নিয়ে তিনি যখন বিশ্রাম নিতে গেলেন, তখন তাঁর দরজায় রোগীর আগমন সবে শুরু হয়েছে। এই প্রথম তাঁর চেম্বারের দরজা বন্ধ রইল রোগীদের জন্য। কম্পাউন্ডারবাবুরা জনে জনে তাঁর অসুস্থতার সংবাদ দিতে থাকল।

শেষ পাতা