Categories
2021-May-Story গল্প

বনমালী মাল

পাথুরে আঁধার

— ভাতারছাড়ি তোর ক-টা ভাতার লাগে রে? ভাতার ছেড়ে এখানে বাপের ঘরে এসে পড়ে আছু!

টালি আর টিন দিয়ে ছাওয়া আটচালা ঘর থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ দাঁত কড়মড় করতে করতে বেরিয়ে আসে। স্বর শুনে মনে হয়, গলার শিরা ফুলিয়ে, স্বর সপ্তমে চড়িয়ে না বলতে পারার জন্য বক্তার রাগ-বিরক্তি দানা বাঁধতে বাঁধতে দুঃখ-কষ্টে পাথর হয়ে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে বললে পাড়ার লোক, রাস্তার লোকও মুখ চাপা দিয়ে হাসবে। শুকনো মুখে পরামর্শ দিয়ে কিংবা হা হুতাশ করে মনে মনে ঘাই দেবে—

— এত দ্যামাক ভালো নয়, আগেই বলছিলাম।

— ভাতারের ঘর ছেড়ে কতদিন পড়ে আছে!

বলে কেউ কেউ বাতাসের দিকে একটা সাজানো নাটকের সূত্রধরকে ছুঁড়ে দেয়।

বছর সাতেকের একটা ছেলে খালি গায়ে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ভোটের আগে আগেই নতুন রাস্তা তৈরির মহড়া চলছে যেন। এই ক-দিন আগে পর্যন্ত যে-রাস্তাটার ওপর দিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে যেত গোটা কয়েক গাড়ি, বাসসমেত, যাত্রীদের বিরক্তি অগ্রাহ্য করে, প্রায় রাতারাতি রাস্তাটা হয়ে গেছে তকতকে ঝকঝকে। ছেলেটার পেছন পেছন তার মা।

— মরবে…

দরজা পেরিয়ে রাস্তার দু-দিক দায়সাড়াভাবে দেখেই কুশি বিকৃত গলা ফুঁসতে ফুঁসতে এগিয়ে যায় সজনে গাছটার দিকে—

— এরকম করেই একদিন মরবি গাড়ির তলায় চাপা হয়ে।

শীতের সকালের একঝাঁক দাগী কুয়াশা হনহন করে ঢুকে যাচ্ছে খোলা দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে। ভেতরের সেই চাপা গলার শিরা তখনও ফুলে ফুলে ফুঁসছে।

— কতবার তো আনতে আসছিল, যাওনি কেন?

— ছ্যানাটা বড়ো হইছে, লজ্জা করেনি তোর!

ছেলেটা ততক্ষণে কয়েকটা কুয়াশা আর ধুলামাখা সজনে ফুল হাতে নিয়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে। কুশি প্রথমে একটু থমকে যায়। হাতখানেক দূরত্বের জিনিসও অস্পষ্ট। একটু ঝুঁকে দৃষ্টি পরিষ্কার করে সে। সদ্য মৃত সজনে ফুলগুলো তার কাছে কত স্পষ্ট! গাছের দিকে তাকিয়ে কুয়াশার ঝরনায় অন্ধ হয়ে গেল সে। ফুল ফুটে আছে নিশ্চিত। অথচ এখন তারা মৃত। শুধু আলোর দুর্বলতায় কত নরম জীবনও ফ্যাকাশে।

কুয়াশা কেটে কেটে একটা লরি উত্তর থেকে দক্ষিণে মিলিয়ে গেল। অজান্তেই জোর করে ছেলেটার সেই হাত ধরে কুশি, যে-হাতে ফুলগুলো কাফনের স্বপ্ন দেখছিল, চটকে দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল তারা।

— মরলে দেখতে পাই… সবাই খাক করে দিল মোর জানটাকে…

এখন আরও একটু সচেতন কুশি। তার গলা নিয়ে। গলার জোর নিয়ে।

কুয়াশার আবরণে তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তার গলা যে-কেউ শুনতে পারে!

তাকে নিয়ে আবার কেউ ভাবনার একটা ফাঁদ পাততে পারে এখুনি!

জোড়া জোড়া চোখ মায়া মিশিয়ে দেখতে দেখতে কুশির শরীর আর চরিত্র ভেদ করবে!

এখুনি চটকে যাওয়া ফুলগুলোর মতন তার গলা ভিজে ভ্যাপসে নেতিয়ে গেল, কিন্তু একটা জলজ্যান্ত বিরক্তি তাকে দমাতে পারল না। একটা শিশু হাতটানা খেতে খেতে সেঁধিয়ে গেল ঘরের ভেতর। ভেতর থেকে আসতে থাকা সেই বাখান গোঙানি থেকে এখন বোঁটায় কুয়াশা লাগা সজনে ফুল হয়ে ঝুলে আছে। এখুনি খসে পড়বে নিস্তব্ধ অসহায় খাদে।

আলো আর তাপ ক্রমে তাদের রূপ ছড়িয়ে দিচ্ছে কুয়াশা উবিয়ে। দিনের প্রথম আলো পড়ে কুশির মায়ের ঘরে। দরজা পেরিয়ে আলো ছাড়িয়ে আলোর আভা ঘরের দুয়ার মাতিয়ে তোলে। আলোর পিঠে আলো চাপতে শুরু করলে কুশি বিন্দু থেকে বিন্দু হতে হতে মিলিয়ে যায় ঘরের এককোণ অন্ধকারে। আলো মুখে নিয়ে বাইরে বের হওয়ার সময় পেরিয়ে এসেছে কুশি… রাতদিন নিজের বানানো একটা নৌকায় চড়ে বসে থাকে সে। পালহীন। দাঁড় নেই। স্থির কালো জল বা স্রোতের দৃশ্য তাকে ভাবিয়ে ভাবিয়ে ক্লান্ত করে, তারপর নিশ্চল পড়ে থাকে সেও ওই নৌকোটার মতন।

জানালার আলো পেরিয়ে বসে থাকে কুশি। দিনের বেশিরভাগ সময় এখানে বসে থেকে ভাবে আর ভাবে সে। দেখতে পায়, রাস্তার অপর প্রান্তের ঢাল নেমে গেছে নিরীহ সমতল জমির বুকে। সবুজ ঘাস কিংবা ধানখেত ভরা চোখ কুশির মধ্যে স্থায়ী একটা প্রভাব ফেলে রেখেছে। স্বামীর বাড়ি থেকে যেদিন প্রথম চলে আসে সে, সেদিনের সেই সবুজ আর আজকের সবুজে কোনো তফাত নেই। সেদিনের কুয়াশাবিহীন সকাল চরাচরে যে-গোপন মুখরোচক কথার বীজ বুনেছিল, আজ তারা কিছু সময় আগে অবধি কুয়াশায় ঢাকা ছিল, রোদে রোদে তারা জ্বলে পুড়ে গন্ধ তুলছে। ঘাস আর ধানের গা থেকে কুয়াশা উবে গিয়ে কাঠখোট্টা বাদামি কিংবা বিবর্ণ করে তুলছে তাদের।

একটা দোমড়ানো টেলিগ্রাফ পোস্টের দেহ পড়ে আছে। তারবিহীন। মুচড়ে যাওয়া সাইকেলের টায়ার জাপটে ধরে আছে মুথা ঘাস। এইসব স্থির চিত্রকণা কুশির গা সওয়া হয়ে গেছে। আগে এক-একটা সময় স্থির দাঁড়িয়ে থেকে কুশিকে শৈশব মনে করাত এরা। মুখ থুবড়ে পড়ার পরও দল বেঁধে থাকা যায়!

কুশির মুখ বেয়ে একটা গলায় দড়ি দেওয়া গোরুর ছায়া রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেল।

তিনজন সন্ন্যাসী একহাতে উত্তরীয় গলায় তুলতে তুলতে আর অন্য হাতে পোক্ত একটা লাঠি ঠুঁকতে ঠুঁকতে—

“গৃহস্থের কল্যাণ হোক…”

অন্যমনা হয়েও কুশি যেন সহজাতভাবেই তার নিজের আবছায়াকে চিতায় তুলে অপেক্ষা করতে থাকল লাঠির শব্দ মরে যাওয়া অবধি। এখন সে আরও আরও অন্ধকার আঁকড়ে ধরতে চায়।

একটা সাদা পাখি আটচালার টঙে এক টুকরো হাসি আর ছেনালিই বোধহয়, ফেলে দিয়ে উড়ে গেল দূর মাঠের বাবলা গাছটাতে।

প্রতিদিন নতুন করে রোদ ভূমিষ্ঠ হলে একটা কুয়াশার যেন অগস্ত্য যাত্রা শুরু হয়। প্রতিদিন কুশির স্বপ্নের আর যাপনের বয়স বাড়ে। শরীর এগিয়ে যায় মৃত্যুর কাছে। ভাবনার সঙ্গে। হাঁক দিতে দিতে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে একটা বাঁক কাঁধে লোক। জানালা দিয়ে রাশি রাশি মন টানা শব্দ কুশির কানে আসে।

পাথর বাটি বিক্রির সোনালি চিৎকার দোল দোল ভাসা খাচ্ছে ছন্দে।

নকশা কাটা
কালা পাথর
পূজায় দেবেন যজ্ঞে দেবেন

কুশির জানালার সামনে এসে সেই সুর হুমড়ি খেয়ে খেয়ে পাথর হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা ভ্রূকুটি সত্ত্বেও বেরিয়ে যায়। কুশির মা দরজার বাইরে পা রাখলেই আগন্তুক বিক্রেতা গতি থামিয়ে শূন্য হয়ে গেল। পাহাড়ি চেহারায় একটা রুক্ষ হাসি খেলিয়ে বিক্রেতা এই সকালেও কপাল থেকে একআঙুল ঘাম টেনে এনে ফেলল রাস্তার উপর। পায়ে পায়ে হাঁটা পথ আর ক্লান্তি সরিয়ে জনপদে প্রথম খরিদ্দার পাওয়ার আশায় পসরা বিছিয়ে দিল রাস্তার মরে যাওয়া জায়গাটায়।

— নিজের হাতে গড়া মা…

— পাহাড় থেকে নিজে হাতে কেটে ছেনি মারিছি…

— এই ফুল ফুল নকশাগুলানকে চোখের সামনে বড়ো হতে দেখিছি আর তেমন করেই তুলিছি এখ্নে…

বড়ো থেকে ছোটো সাতটা মাপের পাথরবাটি একে-অপরের ভেতর সাজানো আছে। কাঠ-হাতে বের করে করে দেখায় সে। যেন হাতে করেই সে জানালার ওপাশে অদেখা একটা উঁকি দেওয়া মুখের ভাব পালটে দিচ্ছে। লোকটার কথার টুকরো টুকরো শুনতে শুনতে কুশি ভাবনার ছায়ায় ডুবে যাচ্ছে। তার খেয়াল নেই, রোদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। স্পষ্ট।

পাহাড়ের বুক চিরে পাথরের একটা একটা টুকরো গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে! লাল দগদগে ছিন্ন একটা নাড়ি নিয়ে সে হয়তো রাতদিন স্বপ্ন দেখে গর্ভবতী হওয়ার! ছবির পর ছবির গয়না সাজিয়ে… কী সুখ আর স্বপ্ন! এরপর হয়তো ঘরের অন্ধকারে কিংবা কুয়াশা ঘেরা একান্তে পড়ে থাকবে দিনের পর দিন! সবার আড়ালে। একটা পুজোর প্রয়োজনে সাজো সাজো গন্ধ তুলে, পেটে ধরবে কত কত প্রসাদ। খালাস করবে… আবার রাতভোর অপেক্ষা করবে আরও একটা প্রসাদ চড়ানোর!

কুশির চোখ নির্বাক ভাষায় মায়া ছড়াচ্ছে।

কুশির মা পাথরবাটি নাড়াচাড়া করে দেখছে। পরখ করে নিচ্ছে, বাটির মুড়ি বা অন্য কোথাও কোনো খুঁত আছে কিনা।

—ঢাঙ্গিকুসুমের বিল পাহাড়ের নিজের কোল থিকে চিরে আনা মা…

—লিয়ে লিন। ঠইকবেননি মা…

কুশি ভাবে, পাহাড় তার অসহায়তা বিলিয়ে দিয়েছে যেন। পাহাড় জানে, এভাবেই সবাই পাথর নিয়ে যায়, এতে কোনো শঠতা নেই। না নিয়ে গেলেই যত অনিয়ম।

ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে একআকাশ স্তব্ধতা আর স্থিরতা নিয়ে। কেনা বেচার মাঝে সামান্য এক দর্শক, যার কাছে পাথর মানে খেলনা, কুয়াশা মানে সজনে ফুল-খেলা।

সন্ধ্যা নামে। রাতের ভেতর দিয়ে গভীর ভাবনাগুলো হেঁটে যায়। কুশির শোবার ঘরের এক টুকরো বিছানার পাশে ঠাকুর পুজোর বাসন। পাথর বাটিগুলো সাজানো আছে কোলে কোলে। জীবনের অনেকটা সময় সে পেরিয়ে এসেছে সকল দেবতার পথ এড়িয়ে। ইদানীং তাকে সেঁধিয়ে যেতে হচ্ছে কুয়াশার মতো ঘন আবছায়ার একটা দুর্ভেদ্য কোটরে। মায়ের কথার বাণ থেকে মুক্তি পেতে সে বেশিরভাগ সময় কাটায় দেবতার কাছে। মাকে দোষ দিতেও পারে না কুশি। কতগুলো রক্তহীন সাদা মুখ দাঁত খিঁচিয়ে গাছের সবুজ পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলছে। ছেলেটার মুখ আর আদুড় গায়ে চোখ বোলাতে বোলাতে কুশির চোখে অতীত ঝাঁক বেঁধে ভিড় করে।

ছোটোবেলার কত কথা আর খেলা মনে পড়ে কুশির। শুধু একটু ভয় ছাড়া অন্য কোনো বাধা ছিল না যেখানে। কাঁচা আম ছাড়ানোর জন্য ঝিনুক ঘষে ঘষে ধারালো করে নেওয়া, কলসি কাখে কলতলায় জল আনতে গিয়ে পাড়ার সবার সঙ্গে হাসি ঠাট্টা কিংবা যত্ন করে মাটি তৈরি করে নিজে হাতে একটা চারাগাছ পুঁতে দেওয়া— এখনও কুশির মনে অমলিন হয়ে আছে।

বাইরে রাতের থমথমে নীরবতা ভেঙে একটু বাতাস শিরশিরিয়ে বয়ে গেল। এই সময়েই সজনে ফুলগুলো তাদের জীবনের চরম প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘুম নেই কুশির চোখে। আজ কয়েকমাস সে বাপের বাড়িতে পড়ে আছে। কত বছর আগের কথা…

—আমরা মৃত্যু অব্দি কালপুরুষ আর লুব্ধক হয়ে থাকব…

বিছানার রাত উষ্ণ হয়ে উঠত এমনভাবে। কুশি আর তার স্বামীর দাম্পত্য রাতে রাতে একটা বীজ বোনে। স্বামীর বাড়ির পাশ দিয়ে রেল চলে যায় নৈঃশব্দ্য ভেদ করে। ঘুমেল রাত টের পায় না, কতখানি যন্ত্রণা পেল চরাচর, বাঁশির তীক্ষ্ম বাণে। কুশির সংসার পুরোনো হয় দিন দিন। সম্পর্কে শ্যাওলা পড়ে। একদিন একটা মেঘ এসে ঢেকে গেল লুব্ধক। কোনোদিন আবার কালপুরুষ গোটা ঢাকা পড়ে যায়। সমস্ত নিয়ম অগ্রাহ্য করে ঝাঁক ঝাঁক তারা ছোটাছুটি করতে করতে স্থির জমাট বাঁধা কথাগুলোকে ধাক্কা দিতে শুরু করে। একদিন স্পষ্ট চেয়ে দেখল কুশি, কালপুরুষের নীল কোমর বন্ধনী খুলে পড়েছে। তির আর ধনুক, যা এতদিন আগলে এসেছে উজ্বল লুব্ধককে, একটার পর একটা তির ছুটে যাচ্ছে আর সব তারার দিকে। মোলায়েম গতিতে।

এখন কুশি একা। বিছানা আর বালিশে লেগে আছে ঘরে জ্বলা মৃদু আলোর আদর। অস্থির কুশি বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। আজও কালপুরুষ আছে নিশ্চয় ভেবে। আছে। বিলম্বিত চাঁদ তখনও লজ্জায় তেজী হয়ে ওঠেনি। ওই তো… কালপুরুষ দাঁড়িয়ে আছে দুই পা উন্মুক্ত করে। পায়ের মাঝে এক অমোঘ কৃষ্ণগহ্বর যেন শুষে নিচ্ছে অগণিত তারাকে। তারাগুলোর দিগশূন্য গতি মাড়িয়ে দিচ্ছে লুব্ধকের আলো। রাস্তার দিকে তাকায় কুশি। শিহরণে টান পড়েছে চামড়ায়। এই রাস্তায়ই আজ সকালে একজন হয়তো ভুলিয়ে ভালিয়েই বিকিয়ে গেছে পাথর বাটিগুলো। সাজানো। প্রকৃতির মায়া আঁকা আলপনা গায়ে।

বিছানায় আবার কুশি। কালো কালো পাথর বাটিগুলো ঘরের আলোটুকু শুষে নিচ্ছে। কেবল সাদা রঙের আলপনাগুলোই চোখ মেলে জেগে আছে গর্বে। হয়তো থাকবে না বেশিদিন। ব্যবহৃত হতে হতে কোণ ভাঙবে। মেটে রঙের বিষণ্ণতা ধুয়ে মুছে দেবে নতুনের ঝলমলে ভাবকে।

—ফিরে কি যাবে কুশি? ওর কাছে? নিজের ঘরে?

—ভাঙা পাথরের টুকরোগুলো আর ফিরতে পারবে না কোনোদিন।

—যদি যায়ও, এখানের হাতের ছোঁয়া আর প্রসাদ মুছে চিরতরে, সেখানে পাহাড়ের কোল ওকে আর চাইবে না আগের মতন!

—পড়ে থাকবে এখানেই। কানাচে। ঢাঙ্গিকুসুমের মায়া মাখা স্বপ্ন জড়িয়ে।

কখন পাতা লেগে যায়, জানতে পারে না কুশি। একটা আলতো ঘুম গড়িয়ে গিয়ে খুব অল্প সময়ে ধাক্কা খায় সকালের সঙ্গে।

আবার সকাল। আবার কুয়াশা। সজনে ফুল ঝরে পড়ার মতন নিঃশব্দে গুমরে যাচ্ছে কতগুলো অকথন। এখনও কিছু সজনে ফুল পড়ছে। বাতাসে উড়ে গিয়ে কেউ পড়েছে রাস্তায়। থ্যাঁতলানো। ঠায় দরজার বাইরে ঘন কুয়াশার পেটে দাঁড়িয়ে আছে কুশি। প্রায় রাতজাগা চোখ মুদে আসছে কুয়াশার খাতিরে।

কী ভাবছে সে!

একটু পরই রোদ উঠবে…

প্রতিদিনের মতন সে গিয়ে বসবে ঘরের ভেতর, জানালার পাশে। জানালা থেকে যতটুকু বাহির দেখা যায়, দেখবে। ফল্গুস্রোতের মতন অন্তর ফেঁড়ে চিরে যাবে মায়ের কথাগুলো। মাঝে মাঝে আগুন উসকে যাবে স্বামীর ঘরের আটটা বছর।

তারপর কুশির চোখ গিয়ে পড়বে রাস্তা পেরিয়ে একটা চৌকো মতন বাঁজা জমির উপর। বাঁশের বাতা দিয়ে ঘেরা। একটা গামছা কাঁধে প্রৌঢ় লাঠি উঁচিয়ে গবাদিপশু ঠেসে দিয়ে যাবে সীমানার ভেতর। এ-সব পেরিয়েও কুশি দেখবে, একটা কোকিল আর একটা কোকিলের ঠোঁটে পালক গুঁজে বুঝে নিচ্ছে বসন্ত আসার সঠিক দিনক্ষণ।

আজ মুমূর্ষু কুয়াশার ওপর রোদের জন্ম হলেও, কুশি ঘরে গেল না। স্থির চোখে সে দেখছে ওই প্রৌঢ়ের দিকে। কোকিলগুলো আজ সেখানে নেই। বিচলিত নয় কুশি। ছেলেটা ততক্ষণে সজনে ফুলে মশগুল। যন্ত্রচালিতের মতন ছেলেটার এক হাত ধরে কুশি। আর এক হাতে একটা পাথর বাটি।

বাস আর পুরুষের অপেক্ষা না করেই রাস্তা বরাবর মিলিয়ে যাচ্ছে কুশি।

Categories
2021-May-Story গল্প

শুভংকর গুহ

নৌকোপাখি

একটি পাখি উড়ে এসে নৌকো হয়ে বসল সৈয়দ দ্বীপে।

বালুচরে হলুদ সর্ষেখেতের ওপরে একটি মেয়ে গান গেয়ে গেয়ে বাতাসের তরঙ্গ ভাসিয়ে দিয়েছে। মাঠের ওপরে হলুদ সর্ষেফুল ঠুকরে ঠুকরে ফেলে রেখেছে দ্বীপের নৌকোপাখি।

সৈয়দ দ্বীপের খেয়াঘাটের নাম শালু মিঞ্চার ঘাট। খেয়াঘাট মানে কাদার ওপরে যাত্রীর ওঠা-নামার দাগ মাত্র। জোয়ার এলে জল টিপটিপের মতো শালু মিঞ্চার ঘাট পিট পিট করে তাকায়, ভাঁটা পড়লে আবার দিব্য ঘুমিয়ে পড়ে। নদীর বড়োই উজান মায়া, সোমত্তের মতো গোপনে লজ্জাহীনা। ঝোড়ো বাতাসে ভরা আবেগে যৌবনের তুফান টের পায়। ঝড়বৃষ্টি, আষাঢ় শ্রাবণ সৈয়দ দ্বীপ বা শালু মিঞ্চার ঘাটকে কাত করতে পারেনি। সৈয়দ দ্বীপে কানসারি ঘাটের যাত্রীরা অবাক হয়ে শব্দ করে ‘ব’, খানিক দম নেওয়ার অবসরে ‘ঠ’, বলে বসে পড়ে, সৈয়দ মিয়াঁর দোকানে।

দোকান মানে দরমার ও শুকনো পাতার ছাওনির ফোকরে কয়েকটা জলচৌকির মতো আসন পাতা। খরিদ্দার এলে ফুঁ দিয়ে উনান উসকোয় সৈয়দ মিয়াঁ। বাকি সময় উনানের আগুন ঝিম মেরে ঘুমিয়ে থাকে। সৈয়দ মিয়াঁর বিবি ছিল, কিন্তু সে কোথায়? কেউ প্রশ্ন করলে, সৈয়দ বলে, নদীর পানিতে থাকে। আমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। কুটিরে আর ফেরে না। সাথে আছে দুইটা ছাগল। আর আছে এক দ্বীপের কন্যা, কিন্তু সে মাঠেই থাকে। যেন জলখালি পাখিরালয়ের কন্যা। জল যেমন মেঘের ছদ্মবেশ ধরে থাকে, এই কন্যা সেইরকম।

বিশ্রামের জন্য কাদা পার হয়ে সৈয়দ মিয়াঁর বিশ্রামখানায় জিরোলে, সুদূরে নদীর দিকে তাকিয়ে দেখলে, নদীর বাঁকা দিকটা পাখি শিকারির ভাঙা ধনুকের মতো পড়ে আছে। সৈয়দ মিয়াঁ প্রথমে বলবে— একঘর জন্নতের সময় নিয়ে, বসে বসে বেলার রোদ পার করে নাও মাতব্বর। তা কোথাকার গো তুমি?

লিঙ্কা হোসেন বলে— চাঁদপালের।

নীলকণ্ঠর বিহারের লঞ্চে এলে বুঝি?

কানসারি যাব। কাজের সন্ধানে।

অ। বুঝেছি। তুমি কারিগর?

বসাকের নৌকার কারখানায় যাব।

বসাকদের তিনটা নৌকার কারখানা আছে। কোন কারখানায় যাবে?

যে-কারখানায় কাজ পাব সেখানেই যাব।

তুমি নৌকার কারিগর।

কানসারির খেয়া কখন আসবে?

কিছুক্ষণ আগেই খেয়া গেল কানসারির ঘাটে।

কতক্ষণ পরে আসবে?

ওবেলায় আসে। সৈয়দ দ্বীপ থেকে যাত্রী শুধু যায়। কানসারি থেকে খালি খেয়া আসে। আচ্ছা কী নিবে বলো?

লিঙ্কা হোসেন আবার তাকালো সৈয়দ মিয়াঁর দিকে। যেন বলতে চাইল, তোমার কৌতূহল আমার কাছে প্রবল ঠেকছে মিয়াঁ। শুনেছি, কানসারি যেতে হলে, সৈয়দ দ্বীপে নামতে হয়। মিয়াঁর দিকে তাকিয়ে লিঙ্কা হোসেন বলল— লঞ্চ কানসারির ঘাটে যায় না তাও জানি।

হ্যাঁ, কানসারি যেতে হলে, একবার আমার দোকানে সব যাত্রীই ‘ঠ’ দেয়। খেয়া আসে। খেয়া কানসারি যায়।

চাঁদপাল থেকে সৈয়দ দ্বীপে লঞ্চে পাঁচ ঘণ্টা লাগে। সেই ভোর থেকে জলের বুরবুরি আর লঞ্চের মোটরের ঘর ঘর শব্দে কান মাথা ঝি ঝি করছে। গলা শুকিয়ে এসেছে।

গারুতে নদীর পানি আছে। পাতালের খোদার পানি কোথায় পাব? একা থাকি। একজনের জন্য কি আর সরকার মাতব্বর পাতালের পানির ব্যবস্থা করবে?

খোদার ইচ্ছা থাকলে একজনকেই কৃপা করেন।

ছাগলের দুধ আছে। এট্টু চা দেই?

খাবার দাওনের কিছু আছে? আচ্ছা আগে চা দাও।

কানসারির খেয়া ফিরত আসতে এখন অনেক অনেক দেরি। আগে একটু চা নাও। তারপরে খাবার কিছু নাও। খাবারের আয়োজন করা আছে। কড়াইয়ে তেল ঢেলে নেড়েচেড়ে দিব।

তাই করো। আগে চা দাও। গোরুর দুধ নাই।

গত পূর্ণিমার রাতে ভরা কোটালে গোরু ভাসিয়ে নিয়ে গেল নদীর পানি। দুইটা ছাগল ঘরে ছিল। একটাই গোরু ছিল, নদী খেল। দুইটা ছাগল দোকানদারির জন্য কোনোরকমে সামলে রেখেছি।

এখানে একা একা এই নির্জন দ্বীপে দোকান পেতে রেখেছ, অন্য কোথাও চলে যাও। একদিন না একদিন নদীর পানি ফুঁসে উঠে তোমার সর্বস্ব নিয়ে নিবে। তখন?

যাওয়ার হলে কি এই নির্জন দ্বীপে একা দোকান পেতে বসে থাকতাম? লঞ্চ যাওয়ার সময় কানসারি যাওয়ার খেয়ার যাত্রী নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। সেই লঞ্চ আবার ফেরার সময় সৈয়দ দ্বীপে আসে না। চাঁদপালের লঞ্চের সইদ দ্বীপে আসা আছে কিন্তু ফেরা নাই। কানসারির যাত্রী নামিয়ে দিয়ে লঞ্চ চলে যায়। খেয়া এই ঘাটে এলে যাত্রী চলে যায়। সেই একবারই দোকানের দান পাই। তোমার মতো কয়েকজন এলে, একটু বেচাকেনা হয়। তাহলে এট্টু চা দিই?


সৈয়দ দ্বীপে চমৎকার সর্ষের খেতের হলুদ গালিচা দেখে চোখ জুড়িয়ে নিচ্ছিল লিঙ্কা হোসেন। আর ভাবছিল, চাঁদপাল থেকে লঞ্চে আসার সময় নদীর পাড়ে জমি জুড়ে, চমৎকার সর্ষেখেতের ফুলের হলুদের সঙ্গে এখানকার হলুদের অনেক অনেক তফাত আছে। এই হলুদের মধ্যে খোদার মহিমার স্পর্শ আছে যেন। স্পর্শ আছে চমৎকার খেত সেলাইয়ের।

সৈয়দ দ্বীপের সর্ষে খেতের হলুদ বড়োই চমৎকার। কেমন শীতের কাঁথার মতো ছড়িয়ে আছে চারধার। সোঁ সোঁ বাতাসের ব্যতিক্রমী উল্লাস চারধারে, একটি বালিকার বিন্দু যেন খামারের জন্মবীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সর্ষেখেতের চারধারে ছুটে বেড়াচ্ছে লাল পোশাকের আন্দোলন। লিঙ্কা হোসেন দেখছে, বালিকা ছুটে ছুটে যাচ্ছে পাখির উড়ানের সাথে। সৈয়দ দ্বীপের আয়তনকে ছুটে ছুটে বালিকা, খাটো করে আনছে। পিছনে দোকানদারের চায়ের আয়োজনের পাত্রের ঠোকাঠুকির শব্দ ভেসে আসছে। একদিকে মানুষের সংসারের ঠোকাঠুকির শব্দ। অন্য দিকে সর্ষেখেতের বাতাসের অন্তহীন সোঁ সোঁ শব্দ বিন্যাস এনেছে ফকির অনন্তের।

লিঙ্কা হোসেন সারাজীবন ধরে, মাচা বেঁধে ক্ষেতের ফসল পাহারা দিয়েছে, খেত বুনেছে, কাঠের তক্তা পরের পর পাশাপাশি ফেলে, নৌকো বানানোর কাজ শিখেছে। সারারাত খেত পাহারায় সে আবিষ্কার করেছে, সজারু আসে ঠিক মধ্যরাতে, মাঠের ওপরে লতিয়ে থাকা কদু কুমড়া সাবার করে দিয়ে মাঠ খালি করে দিয়ে যায়। গোটা কয় আসে। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার আলোতে ধারালো কাঁটার মতো জীব মাঠের অধিকার নেয়।

জীবনে অনেক মাঠ দেখেছে। কিন্তু এমন মাঠ জন্নতের কোথায় আছে? চমৎকার হলুদ মখমল পেতে রেখছে খোদার দরবার। লিঙ্কা হোসেনের খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, একা মানুষের হাতে যদি এমন চমৎকার মাঠ ফসলের আবাদ হয়, তাহলে পাখির ডাকে পুণ্যির ফল আসে।

নদীর ওপারে কানসারির খেয়াঘাট ধোঁয়ার মতো অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। আর দূরে বহু দূরে নৌকো কারখানার ছাওনি ও কলকারখানার চিমনি দেখা যাচ্ছে। ঘন বসতি, বাড়িঘর, নগর, মাঝে মাঝে যানবাহনের ক্ষীণ হাওয়া হর্নের শব্দ ভেসে এসে এসে সৈয়দ দ্বীপে তুলোর মতো নরম হয়ে গেছে। বড়োই মোলায়েম এই দ্বীপ। পিছনে মিয়াঁর দোকান, সামনে সর্ষেফুলের খেত, দুই পাশে নদীর প্রবাহের হু হু বাতাস।

লিঙ্কা হোসেন বুঝতে পারেনি, সৈয়দ মিয়াঁ কখন তার পিছনে দাঁড়িয়েছে, মাটির পাত্র থেকে চায়ের ধোঁয়া, ছাগলের ঘন দুধের লোমশ গন্ধ আনছে। সৈয়দ মিয়াঁর ছায়া তার শরীর জড়িয়ে যেতেই, লিঙ্কা হোসেন, পিছনে তাকিয়ে বলল— সর্ষের খেত বড়োই সোন্দর।

কানসারির বাজার থেকে খেয়ার মাঝি, সর্ষে এনে হাতে তুলে দিয়েছিল, তাই ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। যেভাবে সর্ষে ছড়িয়েছিলাম, বীজ নিজে থেকেই সারি সারি হয়ে যায়। হাতে ধরে মাটিতে পুঁতে দিলেও এত সুন্দর হয় না। কিন্তু সবই হাওয়া বাতাসের খোদার ইচ্ছা। প্রাণ ভরে দৃশ্য নাও। যারা আসে সবাই দৃশ্য নিতে জানে না। তুমি নিতে পারছ। তাই আমার অন্তর শান্তি পাচ্ছে।

সর্ষেফুলের মধ্যে কন্যা ভেসে যাচ্ছে? তোমার কন্যা মিয়াঁ?

মাঠ ফসলের।

তোমার ঘরে থাকে না?

মাঠে থাকে।

মাঠে মাঠে থাকে? ঘরদুয়ার নাই কন্যার?

এত সুন্দর সর্ষেফুলের মাঠ, এত ফুল, জগৎ সংসারে তার কি আর ঘর চাই?

লিঙ্কা হোসেন দেখছিল কানসারির ঘাট থেকে খেয়া সৈয়দ দ্বীপের দিকে আসছে। খেয়ার পিছনে কানসারি নগর ঝাপসা রেখার মতো। যে-খেয়াটি আসছে, খুব মন্থর তার গতি। আসতে চাইছে কিন্তু আসছে না এমন এমন। ভাঁটার মধ্যে নৌকোছবি যেন স্থির। মাঝে রোদের বিস্তার কেটে দিচ্ছে, খেয়ার মন্থর স্থির গতি। লিঙ্কা হোসেন উদর থেকে চাল ডালের ঢেঁকুর তুলে, খেয়ার ফেরার দৃষ্টি থেকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল সর্ষেফুলের ওপরে খেত কন্যা পাখির মতো ডানা মেলেছে।

খেয়া এসে সৈয়দ দ্বীপের শালু মিঞ্চার ঘাটপাড়ে স্থির হল। খেয়া থেকে মাঝি গণেশ মোদক চিল্লিয়ে উঠল— ক-জনা গো মিয়াঁ?

সৈয়দ মিয়াঁ উত্তর করল— মাত্র একজন। চাঁদপুরের যাত্রী নেমেছে।

কাদা শুকিয়ে উঠলে ফলার মতো খোঁচা খোঁচা হয়ে যায়। শীতকালে কাদার ফলা ধারালো হয়ে ওঠে। লিঙ্কা হোসেন সাবধানে পা ফেলে ফেলে খেয়ার মধ্যে উঠে গেল। লিঙ্কা হোসেন বলল— কানসারির ঘাটে যেতে কতক্ষণ লাগবে গো মাঝি?

গণেশ মোদক বলল— একটু অপেক্ষা করি। জোয়ার আসছে। বুঝতে পারছ না? জোয়ার এলে, খেয়া বাতাসের এক টানে চলে যাবে ওপারের ঘাটে। একটু অপেক্ষা করি। কানসারির কোথায় যাবে?

বসাকদের নৌকার কারখানায়।

কাজ আছে বুঝি? নৌকার বায়না আছে?

আমি নৌকার কারিগর। যাচ্ছি কাজের সন্ধানে।

তোমার মতো অনেক নতুন কারিগরকে সৈয়দ দ্বীপ থেকে নিয়ে গেছি কানসারির ঘাটে।


কানসারি শিল্পাঞ্চলের ইট-পাথরগুলি, রাস্তা যানবাহন, পেট্রল পাম্প, বড়ো বড়ো পেল্লাই আকাশছোঁয়া ইমারত সময়ের সঙ্গে কথা বলতে থাকল। দূরের গির্জা থেকে ঔপনিবেশিক সান্ধ্য ঘণ্টার ঢং ঢং শব্দ লিঙ্কা হোসেনের মনে চাঁদপুর ঘাটের অতীতের নৌকার কারখনার ছাউনি এঁকে দিল। কী অলস সময় ছিল। নৌকার কারখানার কাঠ তক্তা কবে যে ফুরিয়ে এল। সেই সেদিন প্রথম যেদিন কানসারি ঘাটে নেমে এসেছিল লিঙ্কা হোসেন, সেদিন কাঠ পুড়ে যাওয়ার গন্ধ তার নাকে আকুল কাজের সন্ধানের আগুন ব্যস্ততা এনে দিয়েছিল। নৌকা বানানোর কাজ তাকে জীবিকার সন্ধান দিয়েছিল। ঘাটে পড়ে ছিল কয়েকটি মাত্র খড়ের চালার মতো কুটির।

লিঙ্কা হোসেন ঘাটের একপাশে দাঁড়িয়ে দূরে দেখছিল, সৈয়দ দ্বীপটিকে। খোঁজার চেষ্টা করছিল গভীর জোয়ারে কাছিমের পিঠের মতো ভেসে থাকা সামান্য ভূমিখণ্ডকে। সৈয়দ দ্বীপ অনেক বছর হল মুছে গেছে। মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে নদী, সাগরের খারিকে আহ্বান করে এনেছে নিজের শরীরে। কত দূর দেশের জাহাজ কানসারি ঘাটে সারি সারি নোঙর ফেলেছে। আলোতে ঝলমল করছে নদীর চারধার। নাবিকরা জাহাজের খালাসি কানসারি বাজারে পণ্যের সন্ধান করছে। কেউ কেউ পতিতালয়ের রাস্তার। কানসারি ঘাটের বাজারে এখন মোহরের শব্দ। লিঙ্কা হোসেন কিং সাইজ ফরাসি হালকা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে নিজের বাসখানার দিকে এগিয়ে গেল।

কিছুটা দূরে যেতেই লিঙ্কা হোসেনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল শিপবিল্ডার্স কোম্পানির পর্তুগিজ মালিক কোলাম্বো ব্রগেঞ্জার সঙ্গে। লিঙ্কা হোসেন এগিয়ে গিয়ে সান্ধ্য অভিবাদন জানালো— গুড ইভিনিং।

কোলাম্বো ব্রগেঞ্জা বিনম্র উত্তর দিল— গুড ইভিনিং মিস্টার হোসেন।

কোলাম্বো ব্রগেঞ্জা সামান্য কয়েক পা এগিয়ে যেতেই পানামা টুপিটিকে নদীর প্রবল বাতাসে সামলে নিয়ে, হাঁটা থামিয়ে, লিঙ্কা হোসেনকে কী যেন বলতে যাচ্ছিল।

লিঙ্কা হোসেন একটুও বিলম্ব না করে, বলল— হ্যাঁ মিস্টার ব্রগেঞ্জা ডেক অফিসারকে সমস্ত নির্দেশ আমাদের সংস্থার তরফ থেকে দেওয়া আছে, এরিনা কর্পোরেশনের জাহাজ আগামীকাল ফ্লোট করছে। আপনি বিচলিত হবেন না।

ধন্যবাদ মিস্টার হোসেন।

লিঙ্কা হোসেন নিজের বাসখানার ফুলের উদ্যান অতিক্রম করে, এগিয়ে যেতে থাকল আর দেখতে থাকল আকাশে পাখির মতো উড়ে যাচ্ছে সারি সারি ডিঙি নৌকোর মিছিল।

Categories
2021, January, Kobita কবিতা

মনিশংকর বিশ্বাস

ফল

রোদের জটা থেকে ছিটকে ওঠে কয়েকটি শালিখ
‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ কিশোরীর মতো ধানক্ষেত একা শিস দেয়
গোলাপ ফুলটি আসলে ততটা বড়ো, যতদূর তার সুগন্ধ
বহুদূর হ’তে আকাশে জীবন্ত কোনো গ্রহ তাকে প্রেম নিবেদন করে।
এইসব মিলেমিশে থাকে আমার ভিতর—
বাইরে থেকে বোঝাই যায় না এই মিলমিশ—
একটি বৃহৎ সংখ্যা যে-রকম দুই বা দুইয়ের অধিক সংখ্যার যোগফল।

মেঘ, বৃষ্টির প্রতি

যেদিন তুমি দুঃখ দাও না কোনো—
সেদিনও কেন এত কষ্ট পাই?

শৈশব

এক হাঁটু জল
জলে বাবার ছবি— শুধু একটি মাত্র তারা
কেঁপে কেঁপে দূরে সরে যায়

পারভার্ট- ১

ধর্মাবতার, মিথ্যে বলব না, ঘুম থেকে উঠবার পর থেকেই
শুরু হয় যৌনচিন্তা— মাইল-মাইল লম্বা আর প্যাঁচালো পথ—

চড়ুই পাখি, যারা সারাদিন খুঁটে খায় আর যৌনতা করে
ওদের তো তবু চিন্তাটা করতে হয় না—
এদিকে আমি হাড়হাভাতে
সারাদিন এই পাপের পথে হাঁটি
চটির ফিতে ছিঁড়ে যায়, পায়ে এটা ওটা বিঁধে যায়
এত হিউমিডিটি, যে দম খিঁচে আসে
তবু দরজা খোলে না কোনো…

সন্ধ্যাবেলায় আত্মহত্যার পরে
কখনো-সখনো একপশলা বৃষ্টি নামে—

আরও রাতের দিকে
এঁটো-হাতে ছেঁড়া জবাফুল নিয়ে বসে থাকি
রুগ্নবউ ঘেন্নায় পাশ ফিরে শোয়…

অতর্কিতে

তাজা বরবটির মতো ট্রেন—
এসো, তাকে শীত বলে ডাকি

ব্যক্তিগত ঈশ্বর বা পথের কুকুর—
কাউকে নিয়ো না সঙ্গে

গত তিনদিন ধরে চোখে লেগে থাকা মেয়েটি
পালসের ভিতর হেসে ফ্যালে।

চাঁদের নিজস্ব আলো আছে

চাঁদপানা মেয়েটি আজ হাওয়াইয়ান ব্রিজ ও ল্যাভেন্ডারের মিশ্র সুবাস পরে এসেছে।
এই সুবাস তৈরি হয়েছে বহুদূরের এক সমুদ্রশহরে—
কোরাল প্রাচীর ঘেরা ছোট্ট এক শহর
সেখানে সব পুরুষেরা মৎস্যজীবী, সমুদ্রনির্ভর—
তবে মেয়েরা মূলত সুগন্ধি-কারখানায় কাজ করে
আজ মেয়েটির সঙ্গে সেই সমুদ্রললনাদের এক ঝাঁক এখানে এসে পড়েছে
তাদের রোদ্দুর আর তলপেটের ব্যথা-সমেত।


আর আমি সারাক্ষণ ভাবছি, এই সুগন্ধে
ঠিক কতটুকু
চাঁদের নিজস্ব আলো

Categories
অন্যান্য

সেলিম মন্ডল

অদৃষ্ট

হাওয়ায় পুড়ে গেল ঈশ্বরের ছায়া, এখন নীল রঙের রোদ হাতে নিয়ে
ঈশ্বর ঘুরে বেড়ান মাঠে ঘাটে, ধুলোর আলপনা জমে তাঁর গায়ে,
নব্য প্রেমিক প্রেমিকারা তাঁকে পাথর মনে করে নিজেদের নাম
যত্ন করে লিখে রাখে— ঈশ্বর সব দেখেন আর মুচকি হাসেন,
নতুন অলংকার পেয়ে, আহ্লাদে, আবার পুড়ে যান ঈশ্বর…

বধূবরণ

সেদিন চৌকাঠ ডিঙিয়ে রোদ্দুর এলো, এলো আলো বাতাস জল—
একটা আস্ত সমুদ্র এসে ভাসিয়ে দিল খাট, আলমারি, ঘরের সমস্ত আসবাব…
এখন খোলা জানলার পাশে ভ্যান গখের হলুদ গম ক্ষেত,
আর রাতের বেলায় ছাদ জুড়ে মুনলাইট সোনাটা…
তোমার অর্ধেক আকাশ ‘এই শুনছ…’ বলে আলতো টোকা দিল আমার অর্ধেককে,
দু-চারটে তারা খসে পড়ার পর—

সেদিন তোমার সঙ্গে চৌকাঠ ডিঙিয়ে গোটা পৃথিবী এলো আমার ঘরে
আর আস্ত একটা সূর্য এসে আটকে রইল আমাদের বাড়ির আশমানে