Categories
2021-May-Poem কবিতা

গৌতম সরকার

হরেশ কাকার স্যান্ডো আর শরীরে লবণ দিয়ে ভারতবর্ষ আঁকা।
সে-ম্যাপে আছে পাকিস্তান, চীন, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ।
সে যখন হাল দেয় তখন মাটির গন্ধ গায়ে মাখতে ঘুটকুরি আসে, দুধ সাদা বক, টেকেনাই…। এরা
কোন এক প্রাচীন কাল থেকে স্নান করে না। শরীরে তাদের শামুক খোলের মতো মেঠো গন্ধের আস্তরণ।
প্রতীক্ষা নিয়ে বসে থাকে… এক আড়াই আঙুলের লোভে।
আর সেই ডানপিটে আড়াই অন্ধকারকে দড়ি বানিয়ে বানিয়ে ভাগ করে— নুন, ভাত, ফ্যানা।

তোমাকে পেতে চেয়ে শরীর পেতেছি।
আর পেতেছি দুধ সাদা বুক…
তোমাকে চেয়ে উল্লেখযোগ্য উলঙ্গ হয়েছি। অথবা দৃষ্টান্ত হব বলে।
উপরে দিয়েছি ভেজা খড়। ছেঁড়া ধকর। ছোটো ছোটো টেকা দেখব বলে ভোরের আঁচল সরিয়েছি।
ছেনিতে ছুয়েছি জল। মুস দিয়েছি মাখিয়ে…
এত কাণ্ডের পর জুহুরি এসে যখন বল— ও তো খাস্তান!!
তবে পরাগও মিছামিছি মিলন করে। শরীর চেপে থাকে রস।

পাগলা গোরুটাকে অনেক কষ্টে বাগাতে পেরেছি।
সে এখন ডান বাম বোঝে। উঠস বইস বোঝে।
হাই তোলে না আর আগের মতো। লাঙল তুলে দিই ঘারে। তাল তাল সন্তান পাবার আশায় বীজ পুঁতে দিই জমির শরীরটাতে…
জানো নন্দ— এতে কতবার শরীর ভাঙে।
আমার, জমির, গোরুর।
আর তুমি শুধু উল্লেখযোগ্য ভাম ধরো। বাজে খেলো। নীতি করো। আমি কতটুকু তোমার নিয়েছি? আর তুমি কতটা পেয়েছ নন্দ?
চলো খেরোর খাতা খোলো…

মা বলে— বাসন একখানে থাকলে ওমন শব্দ হবেই।
রোজই রেগে ওঠে বড়ো মুখ ওয়ালা ডেকচি। ঝনাঝন শব্দ হয়। কেটলির কারি আর আগুন মোতা গরম সইতে পারি না বলে একা চলে যাই দূরে।
কেকারুদের বাগানে বড়ো গাছে গিয়ে লুকোচুরি হই। মা হয় হয়রান। বাবা হয় আগুন
মা বলল— একদিন দেখিস
সেই যে টুকুনটা ছিল। আমি তাকে বলতাম চিকনঠোঁটি। সে গতকাল হাতবদল হয়েছে। তার কান্না দেখে আমি ভান করেছি।

মা আর কিছু বলে না।
এখন শুধু ভাত হতে ইচ্ছে করে…

পিতা হওয়ার চিন্তা আঁকি। কিংবা আদরের কোল।
দুই থেকে বারো ঘরের নামতা মুখস্থ হয়নি কোনো কালেই। তাই, যোগ আর ভাগের সময় অনেক দাঁড়ি কেটেছি খাতায়।
বলে আপাত এই শ্বাশত বুক ছিঁড়ি। হাতের রেখায় মৃত্যু যোগ খুঁজে একের পর এক গুণ কষতে থাকি। ইনফিনিটি চিহ্ন ছেড়ে হাল কষি ততক্ষণ, যতক্ষণ না বুদ্ধের চরণ অবধি পৌঁছাতে পারি…

পুতুলনাচ এখন নতুন করে ভাবি…
কেমন এক অদৃশ্য সুতোয় ঝুলে আছে মেঘ।
যেমন থাকে জন্ম ও মৃত্যুর সম্পর্কের মাঝামাঝি। উলম্ব… কোনো মোহযুক্ত টান নেই অযথা ঝড়ে যাওয়ার। নেহাতই নিয়ম মেনে চলা ক্লাস সেভেনের ছাত্র সে…
ঘণ্টা-রুটিন-পোশাক…

সে যখন লাবণ্য খায়। বিয়ে হয়…।
খিদে বাড়ে আরও।
মনে হয় আর নয়। নয় আর…
তারপর আবার চরম হতে চায়। শক্ত হয় আটি… তুলতুলে হয় দানব। সে তো এক ভয়াবহ চক্রব্যূহে লড়াই!! লড়তে থাকা ক্লান্ত ভক্ষক চেটেপুটে খেতে থাকে রস।
এরপর না-থাকার এক দশর্ন পাঠ করে। আর না। না আর… সাধু হয়।
না-বাচকের পাঠক হয়।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

অর্ণব রায়

ধ্বংসশহর: একটি অনুবাদ কবিতা

একবার আমাদের পুরোনো পিক আপ ভ্যান আর চার ক্রেট বিয়ার নিয়ে অসীমের প্রান্ত দেখব বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সে-প্রান্তটি, দেখা গেল, এক অচেনা মহিলার বাড়ির সামনে দুম করে থেমে গেল। ইতিমধ্যে ক্রেটের সব বরফ গলে জল হয়ে গেছে। অছিলা নয়, সত্যি সত্যি বরফ চাইতেই সেই বাড়ির সামনে থেমেছিলাম। আদিগন্ত গমের খেতের মধ্যে সেই একখানা একক কাঠের বাড়ি। ফিকে হলুদ আর কালচে রং করা।

আমি কোনোদিনও ভুলব না সেই সামনের কাঠের বারান্দা। ঝোলানো হ্যামক। আইসড টি। ভাই লুসি, অতদূর তুই কোনোদিন যাসনি। অতক্ষণ গাড়ি চালানোর পরে অমন একজোড়া চোখ, চোয়ালের ধার, নরম গ্রীবা আর কখনো কেউ দেখেনি। আর কেউ কখনো অমনভাবে কারোর বলা কথার দিকে হৃদয় পেতে রাখেনি।

এইসব আগুনঝড় ভূমিকম্প পাতালের আগ্রাসন মিটে গেলে একদিন আমরা ওই বাড়িটার খোঁজে বেরিয়ে পড়ব। দড়জায় টোকা মেরে বলব, একটু বরফ পাওয়া যাবে আপনার কাছে? এক আধটা পিক আপ ভ্যান আর কয়েক ক্রেট বিয়ারও জোগাড় হয়ে যাবে নিশ্চই।

ভাই লুসি, ওই বুঝি শুরু হল। আগুনের হলকার মতো এক একটা বাতাসের ঝাপটা বুঝি আসতে শুরু করল। রাত থাকতে চক্রাকার লাল মেঘ বাবায়ারামের মাথার ওপর জমতে শুরু করেছিল। যেন আমরা জানতাম, শেষের শুরু এরকমটাই হবে।

আমরা এ-সব পাশে নিয়েই রাস্তায় হেঁটে বেরিয়েছি। কিছু যে হবে, তা আমরা জানতাম। কিন্তু বিশ্বাস করতাম, কিছুই হবে না। আমাদের জানা আর বিশ্বাসের মাঝে এখন গরম হাওয়া বইছে। গা যেন পুড়ে যাচ্ছে।

এখন কবরস্থানের পাশে গিয়ে প্রার্থনা করার সময়। যে যার পাপের জন্য নিজ নিজ মাপে শাস্তি চেয়ে নেওয়ার সময়।

কিন্তু যদি কেউই না দেখছে, প্রার্থনা করে কী করব? ঈশ্বর এ-শহর ছেড়ে স্মিথদের ওয়াগনে চেপে চলে গেছেন।

যেন এক বিষণ্ণ মেলায় মাঝরাতে এসে উপস্থিত হয়েছি। এখানে লোকের মুখ নিথর। নাগরদোলা থেকে বিষণ্ণতা উপচে পড়ছে। খেলনার দোকান থেকে দুঃখের ফেনা ভসভস করে বেরিয়ে আসছে। আলোগুলি উজ্জ্বল কিন্তু ফিনফিনে কালো চাদরে ঢাকা। ডাঁই করে রাখা খাবারগুলি পাথর হয়ে গেছে। ছুঁয়ে দিলে ভেঙে যাবে।

আমরা, মানে আমি মার্থা আর বাচ্চারা একবার এই মেলায় এসেছিলাম। প্রচুর জিনিস দু-হাত ভরে কেনার পর, এখানেই আমাদের মধ্যে কিছু একটা বিষয় নিয়ে তীব্র ঝাঁঝালো ঝগড়া শুরু হয়। সেই ঝগড়া শুরুর মুহূর্ত থেকে মেলাটি সেই অবস্থায় স্থির হয়ে আছে। আর ধীরে ধীরে ভঙ্গুর পাথর হয়ে যাচ্ছে।

ভাই লুসি, সেই থেকে একটি ঘামে চটচটে মেলায় আমি পথ হারিয়ে ফেলি। সম্পূর্ণ ফাঁকা মাঠে অসংখ্য গলিপথ সৃষ্টি হয়। অগুন্তি ফেরিওয়ালা তাদের বেলুন, বুদবুদ, খেলনা বাঁদর নিয়ে আমার মুখের ওপর ‘পিকাবু’ বলে উঁকি দিয়ে যায়। অচেনা মুখের পাথর আমি রোজ দেখি।
আজ তোর সাথে মেলায় এসেছি। আজ আবার মেলা চালু হবে। এ-পর্যন্ত সরল আজ আমরা হব।

প্রবীণ বয়সে এসে হোমার অন্ধত্বের গুরূত্ব বুঝলেন। সারাজীবন আলোর জন্য হাহাকার করেছেন। সারাজীবন তার কল্পিত জগৎকে একবার দেখার জন্য আকুলি বিকুলি করেছেন। শেষ জীবনে এসে বুঝলেন, আলো নয়, আলোয় উদ্ভাসিত প্রিয়মুখ, ঘরবাড়ি বস্তুপুঞ্জ— কিছু নয়। অন্ধকারই আসল রূপ। নিকষ সীমাহীন অবয়বহীন কালো। এখন তিনি সেই অন্ধকারের ওপর অন্ধকার দিয়ে আঙুল নেড়ে নেড়ে আলপনা আঁকেন।

ভাই লুসি, আমরাও কি সেরকমই কোনো অন্ধত্বে ডুবে গেছি? দেখতে পাচ্ছি কি পাচ্ছি না তা-ই বুঝতে পারছি না। আলো আঁধার গোধূলি সকাল সাদা কালো ধোঁয়া ধূসর— কিচ্ছুটি এখানে নেই। এখান বলতে ঠিক কোথায় তা-ও স্পষ্ট নয়। পৃথিবীর বুক থেকে আমাদের শহর স্বেচ্ছায় গুটিয়ে নেই হয়ে গেছে। শহরের স্মৃতিও আর আমাদের মধ্যে নেই।

লুসি, আমি তোকে ডাকছি, কথা বলছি বটে, তুই আদৌ আমার সাথে শোনার দূরত্বে আছিস কি না জানি না। গাধাটি কোথায় গেল? আমিই-বা কই?

এ-সবের মাঝে হোমারই-বা কী করছেন? কী লিখছেন?

প্রথম ক-দিন ওরা খুব ঈশ্বর ডেকেছিল। ওরা, যে যেরকম, মাটিপূজারী, পাখিবাদী, ব্যথাসঞ্চয়ী, অবিশ্বাসী— যে যার মতন করে প্রাণ থেকে আবেদন পৌঁছোনোর চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। একদিনও কোনো গাছতলা, গুহা, পাতালঘর, যাদুর মাধ্যমে রোগ সারানো— একটি দরবারের একটি সিটও খালি যায়নি। লোকে রাস্তায় হাঁটু ভেঙে ভেঙে বসে পড়েছে যখন তখন।

প্রথম যেদিন বাবায়ারামের মাথা নড়ে উঠল, তার প্রায় একমাস আগে থেকে চৌকো টেলিভিশনের ভেতরে থাকা মেয়েটি হাত পা নেড়ে আমাদের নীচে, মাটির তলায় সান্দ্র আগুনের চলাচলের কথা বলে আসছিল। শহরের কেউ শুনতে পায়নি। শহরের সকলে সকাল হলে গাড়ি নিয়ে ট্রাফিকের মধ্যে লাফিয়ে পড়তে, বিকেল হলে সেই ট্রাফিক ভেঙে ভেঙে বাড়ি ফিরতে, সপ্তাহ শেষে আবার সেই গাড়ি নিয়ে সমুদ্রের জলে পা ডোবাতে বেরিয়ে পড়তে ব্যস্ত ছিল। রেস্তোঁরাগুলি প্রতি সন্ধ্যায় মানুষের সমবেত গুনগুনানিতে গুনগুন করছিল। প্রথম যেদিন বাবায়ারামের মাথা নড়ে উঠল, টেলিভিশনের ভেতরে থাকা মেয়েটি সেদিন আর হাত পা নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করল না। সেদিন তার ঠোঁটের একপাশে এক নীরব আধখানা হাসি ফুটে উঠল। সেদিনও গোটা শহরে তাকে দেখার কেউ ছিল না। সকলে, যে যেখানে ছিল, স্তব্ধ বিস্ময়ে বাবায়ারামের মাথার দিকে তাকিয়ে ছিল।
ঈশ্বর ডাকার পর্ব একদিন শেষ হলে সকলে শুঁড়িখানায় গিয়ে ভিড় জমাতে শুরু করে।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

মণিশংকর বিশ্বাস

ফল

রোদের জটা থেকে ছিটকে ওঠে কয়েকটি শালিখ
‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ কিশোরীর মতো ধানখেত একা শিস দেয়
গোলাপ ফুলটি আসলে ততটা বড়ো, যতদূর তার সুগন্ধ
বহুদূর হতে আকাশে জীবন্ত কোনো গ্রহ তাকে প্রেম নিবেদন করে।
এইসব মিলেমিশে থাকে আমার ভিতর—
বাইরে থেকে বোঝাই যায় না এই মিলমিশ—
একটি বৃহৎ সংখ্যা যেরকম দুই বা দুইয়ের অধিক ক্ষুদ্রতর সংখ্যার যোগফল।

অশোকনগর

ভালোবাসি— এই ব্যক্তিগত বোধগম্যতার আঁধারে
একটি জোনাকি ক্রমাগত জ্বলে বা নেভে।
বরষাঘন চোখের মতো পুকুরের ধারে
দাঁড়িয়ে রয়েছি, ভিজে কুকুরের আনুগত্য নিয়ে।
সাইকেলে বাঁধা বেলুনগুচ্ছের মতো
কী যেন একটা
ছটফট করে, উলটো দিকে ছুটে যেতে চায়।

তোমার চোখের বিন্দুবিসর্গ আমার ভালো লাগে

আমি চাই ও-দু-খানি চোখ জানালা দিয়ে এসে
আমাকে তুলে নিয়ে যাক

…নিয়ে যাক তোমার নিজ্‌ঝুমে, অশোকনগর।

কলাবউ

তোমাকেই পেতে চেয়ে বাকি সব আগডুম বাগডুম
এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকও চলে গেল
তুমি সেই দেহতত্ত্ব গান।
সুন্দরের জলে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে—

দুপুরের নির্জন খয়েরিনীল কচুরিপানায়
যেরকম ডুবে থাকে রাজহাঁস।
মনে পড়ে গত শতকের আশির দশক—
মানুষের যা যা দরকার, সব আবিষ্কার হয়ে গেছে
দুপুরবেলা আমিও আবিষ্কার করেছি কখন
প্রতিদিন তুমি শাড়ি খুলে উড়াও পাখির ঝাঁক
পুকুরের জলে মেশে বৃত্তাকার হলুদ
ওই উদ্বৃত্ত নাভিদেশ পরক্ষণেই অন্য মহাদেশ
বৃষ্টিবন…
পঁচিশ বছর দেখা হোক বা না হোক

আজও তোমার মুখের ’পরে
আমার সকল যৌনইচ্ছা খেলা করে।

প্রাক্তন

পুরোনো দিনগুলিকে দুর্বোধ্য সংকেত মনে হয়।

কী যেন ভুলতে হবে—
সারাক্ষণ মনে পড়ে।
রক্তের গভীরে ফোটা এই রক্তজবার মালা
অতর্কিতে দেবতার পায়ের দিকে চেয়ে
হাড়িকাঠের মান্যতা চায়
অন্ধের চোখের সাদা অংশের মতো ভয়
ও কালো অংশের মতো উদ্দেশ্যহীনতা
ছাগশিশুটির ’পরে ভর করে।

আমাদের সম্পর্ককে, অতঃপর, জলে ধুয়ে ফেলা রক্তের দাগ মনে হয়।

নিজের পুরোনো কবিতার মুখোমুখি

যখন পিছন ফিরি তোমাকে দেখতে
মনে করি এ কোন সময়?
তুমি কি গভীর নও তত
তবে কেন এত জল, এত কান্না উপচে পড়ছে?
ফার্নপাতা, শ্যাওলায় ঢেকে গেছে প্রেমিকার চুল
পাথরের শ্বেতাভ হাসির দাগ লেগে আছে
ওই মর্মরজটিল বেদেনির ঠোঁটে…
লতানো ফুলের গাছ থেকে
ঝরে পড়ে ফুল, আরও শাদা ফুল।
একটি গোখরো হিলহিলে, সহসা উঁকি মারে
সবুজ পিচ্ছিল অক্ষরের ফাঁকে

অধীর প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতন।

Categories
2021-May-Translation অনুবাদ

ডোনাল্ড বার্থেলমে

রেবেকা

ভাষান্তর: ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ

রেবেকা লিজার্ড তার নামের— কুচ্ছিৎ, সরীসৃপীয়, একেবারে অগ্রহণযোগ্য— শেষের অংশটুকু বদলানোর চেষ্টা করছিল।

‘লিজার্ড’, বিচারক বললেন। ‘লিজার্ড, লিজার্ড, লিজার্ড, লিজার্ড। আপনি যদি এটুকু অনেকবার উচ্চারণ করেন তাহলে এতে আর কোনো সমস্যা থাকে না। এ-সব তুচ্ছ উপদ্রবে আপনি আদালতের ক্যালেন্ডার তছনছ করে দিতে পারেন না। অনেকেই সম্প্রতি তাদের নাম বদলেছে। নাম পরিবর্তন টেলিফোন কোম্পানি, বিদ্যুৎ কোম্পানি এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বোচ্চ স্বার্থের সাথে যায় না। প্রস্তাবটি নাকচ করা হল।’

লিজার্ড কেঁদে ফেলল। নাকের নীচে চেপে ধরল চন্দ্রমল্লিকার সুবাস মাখা ক্লিনেক্স টিস্যু।

‘দুর্বল মহিলা’, একজন বলল, ‘আপনি কি স্কুলশিক্ষক?’

অবশ্যই তিনি একজন স্কুলশিক্ষক, নির্বোধ কোথাকার। দেখতে পাচ্ছ না, বেচারি ভেঙে পড়েছেন? তাকে একলা থাকতে দিচ্ছ না কেন?

‘আপনি কি সমকামী লেসবিয়ান নারী? এই কারণেই কি আপনি কখনো বিয়ে করেননি?’

ওহ্ যিশু, হ্যাঁ, তিনি সমকামী লেসবিয়ান নারী, তুমি যেমনটি বললে। তুমি কি তোমার মুখটা একটু বন্ধ করবে?

রেবেকা জঘন্য এক চর্মবিশেষজ্ঞের কাছে গেল (নতুন এক জঘন্য চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ), কিন্তু তিনিও আগের বিশেষজ্ঞদের মতো একই কথা বললেন। ‘সবুজাভ’, তিনি বললেন, ‘ত্বকের হালকা সবুজ, এটা বংশগত অস্বাভাবিকতা, কিছুই করার নেই, আমার শঙ্কা হচ্ছে মিসেস লিজার্ড।’

‘মিস লিজার্ড।’

‘কিছুই করার নেই মিস লিজার্ড।’

‘ধন্যবাদ ডাক্তার। বিরক্ত করার জন্য কি আমি সামান্য কিছু আপনাকে দিতে পারি?’

‘পঞ্চাশ ডলার।’

বাড়ি ফিরল রেবেকা। মেইলবক্সে পেঁচিয়ে থাকা বাড়িভাড়া বাড়ানোর নোটিস তার জন্য অপেক্ষায় ছিল। বর্ধিত এই ভাড়া আবার আগের মাসগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ব্যাপারটা একেবারে ধর্মঘটী নাছোড় শিক্ষার্থীদের মতো।

অবশ্যই আরও কিছু ক্লিনেক্স লাগবে। কিংবা একটা পিএইচডি। কোনো উপায় নেই আর।

চুলায় মাথা ঢুকিয়ে রাখার কথা ভাবল সে। কিন্তু তারটা তো ইলেক্ট্রিক ওভেন।

রেবেকার প্রেমিকা হিল্ডা ফিরল দেরি করে।

‘কেমন কাটল?’ দিনটা কেমন ছিল তাই জানতে চাইল হিল্ডা।

‘বিচ্ছিরি।’

‘হুমম’, বলল হিল্ডা। চুপচাপ সে দু-জনের জন্য কড়া একটা পানীয় তৈরি করল।

হিল্ডা দেখতে খুব সুন্দরী। রেবেকাও সুন্দরী। তারা একে-অপরকে ভালোবাসে— আমরা যেমন জানি, এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক ও সুনিপুণ ব্যাপার। হিল্ডার চুল সুদীর্ঘ ও সোনালি, একটু ছায়াময়তা সেই সোনালি চুলের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রেবেকারও আছে ধ্রুপদী এবং আবেদনময় গঠন। যেই দেখে সেই তার প্রশংসা করে।

‘দেরি করলে কেন’, বলল রেবেকা, ‘কোথায় ছিলে?’

‘স্টেফানির সাথে একটু পান করছিলাম।’

‘স্টেফানির সাথে পান করলে কেন?’

‘সে আমার অফিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এসে বলল।’

‘কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?’

‘বার্কলেতে।’

‘স্টেফানি কেমন আছে?’

‘সে ভালো আছে।’

‘স্টেফানির সাথেই তোমার পান করতে হবে কেন?’

‘আমিও একটু পান করতে চাইছিলাম।’

‘স্টেফানি হালকা সবুজাভ নয়, তাই তো? চমৎকার, গোলাপি রং স্টেফানির?

হিল্ডা উঠে গেল। সিঅ্যান্ডডব্লিউ-র চমৎকার একটা অ্যালবাম চালিয়ে দিল রেকর্ড প্লেয়ারে। এটা ড্যাভিড রজার্সের ‘ফেয়ারওয়েল টু দ্য রায়মান’ আটলান্টিক এসডি সেভন টু এইট থ্রি। এতে আছে ‘ব্লু মুন অব কেন্টাকি’, ‘গ্রেট স্পিকেল্ড বার্ড,’ ‘আই এম মুভিং অন’, এবং ‘ওয়াকিং দ্য ফ্লোর ওভার ইউ’-র মতো জনপ্রিয় গানগুলো। ন্যাশভিলের সেরা সব ব্যক্তিত্বের সমাবেশ ঘটেছে এই রেকর্ডে।

‘গোলাপি রংটাই সব কিছু নয়’, বলল হিল্ডা। ‘এবং স্টেফানি কিছুটা বিরক্তিকরও। তুমি তো তা জানো।’

‘এতটা বিরক্তিকর নয় যে, তুমি তার সাথে পান করতে যেতে পারো না।’

‘স্টেফানির ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই।’

‘আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময়’, রেবেকা বলল, ‘একটা লোক আমার জিপার খুলে ফেলেছিল।’

ড্যাভিড রজার্স গাইছেন ‘ওহ্, প্লিজ রিলিজ মি, লেট মি গো।’

‘কী পরে ছিলে তুমি?’

‘এখন যা পরে আছি।’

‘তাহলে তো বলতে হয়’, হিল্ডা বলল, ‘পাছার ব্যাপার লোকটার ভালোই রুচি আছে।’

রেবেকাকে সে সোফায় ফেলে জড়িয়ে ধরল। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’, বলল সে।

‘সরো’, ঠান্ডা গলায় বলল রেবেকা। ‘যাও, স্টেফানি সাসারের সাথে সময় কাটাও গিয়ে।’

‘স্টেফানি সাসারের ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই’, দ্বিতীয়বারের মতো বলল হিল্ডা।

কেউ যেটাকে সবচেয়ে বেশি আঁকড়ে ধরতে চায় সেটাকেই আবার প্রায়শ ‘দূরে ঠেলে’ দেয়, ঠিক প্রেমিকের মতো। খুবই সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু খুব পীড়াদায়ক, মনোস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। এক্ষেত্রে (আমার মতামত) এমন এক ব্যাপার ঘটে যে, যা প্রকাশ করা হল তা যেন ‘বিশুদ্ধভাবে’ প্রকাশ করা হল না। যেন ছোটো একটা ক্ষত থেকে গেছে তাতে, থেকে যায় কোথাও মারাত্মক কোনো একটা জায়গা। এমনকী, ঘটতে পারে ভয়ংকর কোনো কিছু।

‘রেবেকা’, হিল্ডা বলল, ‘আমি আসলেই তোমার এই হালকা সবুজ রংটা পছন্দ করি না।’

‘লিজার্ড’ শব্দটি টিকটিকি, গুইসাপ, গিরগিটি, আঞ্জিনার মতো নানা কিছুর সাথে যুক্ত। ‘লারোস এনসাইক্লোপিডিয়া অব অ্যানিমেল লাইফ’-এর তথ্য অনুযায়ী এই ধরনের প্রাণীর অন্তত বিশটি পরিবার এখনও বিদ্যমান। বিলুপ্ত হওয়া আরও চারটির কথা জানা যায় জীবাশ্ম থেকে। এই প্রাণীগুলোর রয়েছে অন্তত আড়াই হাজার প্রজাতি। এরা হাঁটা, দৌড়ানো, আরোহন করা, গর্ত খোঁড়া— এই ধরনের নানা অভিযোজনে সক্ষম হয়েছে। অনেকগুলোর আবার আকর্ষণীয় নামও আছে। যেমন— রঙিন টিকটিকি, চ্যাটালো পা টিকটিকি, কটিবন্ধ টিকটিকি, দেওয়াল টিকটিকি।

‘বেশ কয়েক বছর ধরে আমি সেটা এড়িয়ে গেছি, কারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমি আসলে এটা খুব একটা পছন্দ করি না’, হিল্ডা বলল। ‘এটা কিছুটা—’

‘জানি আমি’, বলল রেবেকা।

রেবেকা বেডরুমে গেল। কোনো একটা কারণে চালিয়ে দিল রঙিন টেলিভিশনটা। সবুজ একটা আভা ছড়িয়ে ‘গ্রিন হিল’ ছবিটা তখন টিভিতে শুরু হচ্ছে মাত্র।

আমি অসুস্থ, আমি অসুস্থ।

আমি এক চাষী হব।

আমাদের ভালোবাসা, আমাদের যৌনপ্রেম, আমাদের সাধারণ প্রেম!

হিল্ডা বেডরুমে ঢুকল। বলল, ‘খাবার রেডি আছে।’

‘কী খাবার?’

‘পর্ক আর রেড ক্যাবেজ।’

‘আমি এখন মাতাল’, বলল রেবেকা।

আমাদের নাগরিকদের অনেকেই মাঝে মাঝে এমন একটা সময়ে মাতাল হয় যখন আসলে তাদের মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার। এই যেমন রাতের খাবারের সময়টায়। মাতাল হলে ঘড়ি কোথায় রাখতে হয়, চাবি কোথায় থাকবে, মানি ক্লিপটা কোথায় রাখবে— এ-সব তোমনে থাকে না। অন্যের সুস্বাস্থ্য, প্রশান্তি, প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি সংবেদনশীলতা কমে যায়। অতিমাত্রায় অ্যালকোহল নেওয়ার কারণগুলো অ্যালকোহলের প্রতিক্রিয়ার মতো তত পরিষ্কার নয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা সাধারণত মনে করেন যে, মদ্যপান খুব গুরুতর সমস্যা হলেও কিছু ক্ষেত্রে তার চিকিৎসাও আছে। বলা হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে অ্যাঅ্যা (মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং চিকিৎসা সংস্থা ‘অ্যালকোহলিক্স অ্যানোনিমাস’) বেশ জনপ্রিয় ও কার্যকর। আসল ব্যাপার হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি।

‘এখন উঠো’, হিল্ডা বলল। ‘যা বলেছি তার জন্য আমি দুঃখিত।’

‘তুমি তো সত্যিই বলেছ।’

‘হ্যাঁ, তা সত্য’, স্বীকার করল হিল্ডা।

‘কিন্তু শুরুতেই এই সত্যটুকু তুমি আমাকে বলোনি। শুরুতে তুমি বলেছ আমার এই রংটা সুন্দর।’

‘শুরুতে আমি তোমাকে সত্যটাই বলেছিলাম। আমি মনে করেছিলাম যে তা সুন্দর। তখন।’

হিল্ডার সংক্ষিপ্ত তিনটি বাক্যের মধ্যে এই ‘তখন’টা চরম শব্দ। যখন শব্দটি এভাবে ব্যবহৃত হয় তখন এটি মানুষের শব্দভাণ্ডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা উস্কে দেওয়া শব্দ। বিগত হয়ে যাওয়া সময়! সেই সময়ের সাথে বিগত হয়ে যাওয়া অবস্থা! মানুষের যন্ত্রণাকে কীভাবে পরিমাপ করা হবে? কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, হিল্ডা এই অবস্থায়ও রেবেকার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করছে, কিন্তু, পাঠক, হিল্ডার এই অবস্থানকেও ঈর্ষণীয় বলে বিবেচনা করা যায় না, সত্য হচ্ছে, বের্গসঁ যেমন জানতেন, এক কঠিন আপেল কঠিনই, তা সে কেউ ধরুক আর কেউ ছুঁড়ুক।

‘তাহলে আর কী?’ পাথরকণ্ঠে বলল রেবেকা।

‘তারপরও আমি তোমাকে ভালবাসি—’

তোমার এই তারপরও যে-ভালোবাসা সেটি কি আমি চাই? তুমি চাও? কেউ কি তা চায়? তারপরও আমরা কি কিছুটা তেমনই নই? আমাদের সবার মধ্যেই কি এমন ব্যাপার নেই যা বলতে গেলে আমাদের অতীতের দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করে। আমি তোমার কিছু বিষয় দেখেও দেখি না, তুমি একইভাবে আমার কিছু দিককে নজরের বাইরে রাখো, আর এই কিছু বিষয়ে আমাদের পরস্পরের অন্ধ থাকা, এই বন্ধ রাখা চোখের চোখাচোখি, ১৯৬০ দশকের শুরু থেকে এই অভিব্যক্তির ব্যবহার, আমরা আমাদের কড়কড়ে আর সুরভিত জীবনযাপন বজায় রেখে চলেছি, নিশ্চয়ই এটাকে বলে ‘সেরাটা করা’। যেটিকে আমি বরং সবসময় বিবেচনা করেছি আমেরিকার আদর্শের ম্যাড়ম্যাড়ে ধারণা হিসেবে। আমার এই সমালোচনাকে অন্যদের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে। উদাহরণ হিসেবে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ম্যাকিনলের কথা বলা যায়। যিনি মেনে চলতেন যে, সবসময় হাসিখুশি থাকা সম্ভব না হলেও ভালো মেজাজ বজায় রাখাটা মূল্যবান এবং সঠিক।

রেবেকার মাথায় হাত রাখল হিল্ডা।

‘তুষার পড়তে শুরু করেছে’, বলল সে। ‘তুষারপাতের মৌসুম আসছে শিগগিরই। আগের সেই তুষারের দিনগুলোর মতোই আবার আমরা একসাথে। আগুনের পাশে বসে বাস্টহ্যাড পান করা। সত্য হচ্ছে এক বদ্ধ ঘর। যে-ঘরে দরজায় মাঝে মাঝেই আমরা ঠকঠক করি এবং সেটি বন্ধই থেকে যায়। আগামীকাল তুমি আমাকে আবার দুঃখ দেবে এবং আমি তোমাকে আবার বলব যে, তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ এবং তারপর আবার দুঃখ দেবে, তারপর আবার। জাহান্নামে যাক। এসো হে নীলচে সবুজ রঙের বন্ধু আমার, এসো আমার সাথে বসে রাতের খাবার খাও।’

তারা একসাথে খেতে বসল। তাদের সামনে রাখা পর্ক আর রেড ক্যাবেজ থেকে ভাঁপ উঠছে। তারা ম্যাককিনলে প্রশাসন নিয়ে ধীরে ধীরে আলাপ করছে। সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদরা বিষয়টি সংশোধন করছিলেন। কাহিনি এখানেই শেষ। এই কাহিনি লেখা হয়েছে বিভিন্ন কারণে। কারণগুলোর মধ্যে নয়টিই গোপন। দশমটি হচ্ছে, মানব প্রেমের বিষয়ে— যা সবসময়ই ভীষণ এবং সোনালি— বিবেচনা কখনোই বন্ধ করা উচিত নয়, উষ্ণ ত্বকের পাতায় যে রং আর নকশার উল্কিতেই তা খচিত থাকুক না কেন।

Categories
2021-May-Story গল্প

আদিদেব মুখোপাধ্যায়

এখন ভস্মের অধ্যায় শেষ হচ্ছে

অনেকক্ষণ হয়ে গেল, আমি একভাবে শুয়ে আছি, নড়তে চড়তে পারছি না। চাইছিও কি নড়তে, হয়তো না। আমার পেটে আবছা ব্যথা ছড়িয়ে যাচ্ছে, কেন করছে ব্যথা?সাতসকালেই খারাপ কিছু খেয়েছি কি আমি? মনে পড়ছে না। ব্যথাটা ছড়িয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে ফের। এটা আসলে একটা ঘূর্ণি, একটা প্যাঁচানো রাস্তায় ব্যাপারটা চলে; ছড়িয়ে পড়া, ফিরে আসা, আবার ছড়িয়ে পড়ার পথে এটা শুরু আর শেষ আর ফিরে শুরু হতে থাকে, এটা, মানে এই ব্যথাটার কথা বলছি আরকী। ব্যথা আমাকে শুধু ব্যথার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে, ব্যথার কথা মনে করাচ্ছে ঘূর্ণির কথা, ঘূর্ণি আবার ব্যথায় বদলে যাচ্ছে, ব্যথা আমায় আর অন্য কিছুই মনে করাচ্ছে না। রক্তশূন্যতায় শাদা একটা নিথর সিলিং, তার দিকে একভাবে চেয়ে আছি আমি। চোখের পাতাও কি পড়ছে, হয়তো পড়ছে, হয়তো পড়ছে না। কোনো কিছু স্থির করে মনে করতে যে কতদিন পারিনি। রোদের একটা রেখা নাক বরাবর চলে গ্যাছে, তার ভেতরে চকচকে ধুলো ঘুরে ঘুরে উঠছে। কোথায় পৌঁছেছে রেখাটা? আমি বলতে পারি না। আমি ঘাড় তুলতে পারি না, আমি নড়তে পারি না, আমি চড়তে পারি না, আমি চেয়ে থাকতে পারি কেবল। হয়তো রেখাটা কোথাও মিশে গ্যাছে। কিংবা হারিয়ে গ্যাছে। হয়তো সেখানে, যেখান থেকে ফোঁপানিটা উঠে উঠে আসছে। উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোথায়? যেখান থেকে উঠে আসছে, সেখানেই কি? জানি না। কী করেই-বা জানব। দিক সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আচ্ছা, আমি কোথায় আছি? এই বালিশের নরম, এই বিছানার নরম আমায় ছুঁয়ে আছে। আমার ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে আমি তোমাকে কী বলব? যা কিছু নরম তাদের মধ্যে আমি শুয়ে থাকি আর ততটুকুই আমি বুঝি যতটুকু আমায় ছুঁয়ে থাকে? কিন্তু না, আমি এ-সব ভাবব না। আমি এখন মুখ ডুবিয়ে দিয়েছি আলোতে। তাপ শুষে নিচ্ছি। রক্ত কলকল করে উঠছে আমার মধ্যে, কোলাহলে আমি ভরে যাচ্ছি। ঘাসের মধ্যে নিবিড় একটা সাপ অতি ধীরে তার খোলস ছাড়ে আর স্থির হয়ে শুয়ে থাকে আর শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভাবে। তুমি, ওহ্‌ তুমি, সামান্য জিভ কাঁপানোর ক্ষমতাও আমার নেই, ফিশফিশ করা, তাও কি আছে, তোমার গাল অপর দিকে ফেরাতে কি আমায় হাত ব্যবহার করতে হবে? সহসা হাওয়া দিলে অন্ধকার দুলে দুলে ওঠে, ঘনত্ব পাতলা হয়ে আসে, অন্ধকারের প্রথম কণা তার দ্বিতীয় কণার থেকে আলগা হয়, সরে যায়, অপেক্ষাকৃত পাতলা অন্ধকার এসে সেই মাঝখানের জায়গা দখল করে নেয়। তুমি মুখ নীচু করে একভাবে বসে থাকো, নড়ো না, চড়ো না, চেরা চেরা শুকনো জিভ কেঁপে ওঠে। শিরশিরে হাওয়া দেয়, রেখা বেঁকে যায়, বিন্দুরা অবস্থান পালটায়, বক্রতলে বদলে যায় সমতল, বাতাস এসে বক্রিমার শূন্যতাকে ভরাট ও অবলুপ্ত করে। আমি নিঃশ্বাস চেপে রাখি। আড়াল থেকে গোয়েন্দা কিংবা চোরের মতো আমি দেখছি তোমায়। দেওয়ালের প্লাস্টারে নখগুলো বসে যাচ্ছে। বাস্তবতা সময়ের মধ্যে তার ঝুরিগুলো নামিয়ে দিয়েছে, ঝুরিরা ক্রমাগত নিজেদের বিন্যাস পালটাতে থাকে। সামান্য পালটে যাওয়া, ব্যাস, তাতেই স্মৃতি দুমড়ে যায়, আকার মুচড়ে যায়, অস্ফুটে কঁকিয়ে ওঠার শব্দ আসে। এতক্ষণের নৈঃশব্দ্য ভেঙে পড়ে। ইতস্তত পড়ে থাকে মুহূর্ত, মাড়িয়ে এগোলে তারা কাচ ফেটে যাওয়ার শব্দ করে ওঠে। আস্তে আস্তে তোমার চুল ছড়িয়ে পড়ে আর মিশে যেতে থাকে নরম অন্ধকারে। সাপ নড়েচড়ে ওঠে, ঘাসের ওপর তার নিথর খোলসচিহ্ন পড়ে আছে। আমি কাঁপা কাঁপা আঙুল বাড়িয়ে দিই ভাঙা ছবিদের আর অস্পষ্ট শব্দদের গুলিয়ে-যাওয়া দিকে। দপ্ করে লাফিয়ে ওঠে শিখা, অল্প অল্প অন্ধকার পুড়ে ছাই হয়ে ঝরে যেতে থাকে। আমার কামনা এখন জ্বলন্ত মোমবাতি হয়েছে, গলে-যাওয়া তার একটি ফোঁটা আসলে একটি অশ্রুবিন্দু, মোমবাতির গোড়ায় এসে অশ্রু জমে কামনা হতে থাকে। এই বদলে-যাওয়া দেখে অস্পষ্ট হেসে ওঠো তুমি। বা হয়তো ভুল দেখি, তুমি হাসছ না, শুধুই চেয়ে আছ, বা হয়তো হাসছ, বা আমি জানি না ঠিক। আলো-আঁধারিতে কেবলই ভ্রম তৈরি হয়। আমি আলতো করে ছুঁই তোমাকে। পাথরের ঠান্ডা উঠে আসে আঙুলের ডগায়। আবার হাওয়া দেয়, ঘুরে ঘুরে ওঠে, আলোছায়া কাঁপতে কাঁপতে সন্ত্রস্ত দানব হয়ে যায়। আমি দু-হাত দিয়ে চেপে ধরি তোমার মুখ। নখ বসে যায় গালে। এটা কী, মুকুট, হ্যাঁ, মুকুটই তো। একটা কাঁটার মুকুট পরানো তোমার মাথায়, কে পরিয়েছে, কেন পরিয়েছে? আমি বুঝতে পারি না। থিরথির করে চেরা জিভ কেঁপে ওঠে। স্রিক স্রিক শব্দ হয়। টিক টিক করে একটা ঘড়ি কোথা থেকে প্রতিবাদ জানায়। দেখি, তোমার চোখের কোণা দিয়ে রক্ত নেমে আসছে। না-বলা ব্যথায় তোমার চামড়া নীল হয়ে গ্যাছে। আমি রোধ অনুভব করি। গরাদের মতো সে জেগে ওঠে, সর্বস্ব দিয়ে আমাকে নিরস্ত করে। আমি আমার রোগা হাতেদুটো দিয়ে শিক ধরে থাকি। শিকের ওপর বিদ্যুৎ পিছলে যেতে থাকে। ক্রুদ্ধ, ফোঁসফোঁস শব্দ ওঠে। ঘাসের ওপর দুটো নুড়ি রৌদ্রে ঝকঝক করতে থাকে। আমার কামনার জ্বলন্ত শীর্ষ আমি হাতের আড়ালে ধরি। বাতাসের অভাবে সে ছটফট করে। নিভে যায়। লুপ্ত চরাচরে আমি একা, একমাত্র অস্তিত্ব বজায় রাখি। শুধু অস্তিত্ব, যার দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, হয়তো উচ্চতাও নেই। হয়তো সে বিন্দুর মতো, কে জানে, আমি বুঝতে পারি না। সে কি স্থির, না কি সে অসীমের দিকে উঠে যাচ্ছে, না কি ঢুকে আসছে এক অতল কুয়োয়? আমি নিশ্চিত হতে পারি না। হয়তো আমি শুধুই একটা বিন্দু, কেবলই বিন্দু, যে-আমি একবিন্দু ব্যথা হয়ে বিন্দু-আমার ভেতরে ঢুকে পড়েছে কখন। অতলতা এক ঘূর্ণি, তার প্রথম বলয় থেকে অনন্ত বলয়ের দিকে ব্যথা নেমে আসে। ব্যথা স্থির হয়। ব্যথা উঠে আসতে থাকে। অসীম, অতল ও স্থিরতার মধ্যেকার যে-রাস্তা তার প্যাঁচগুলো আমার অস্তিত্ব কিংবা ব্যথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে থাকে। এই একঘেয়েমি আমাকে সহ্য করে নিতে হয়। এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না। জিভ নাড়াতে পারি না। ফিশফিশ করতে পারি না। একটা ঘড়িও থাকে না যে, সময় জানব। আমাকে ছুঁয়ে থাকে নরম। সিলিং-এর রক্তশূন্যতায় তোমার মুখ কল্পনা করি। পারি না। একটা আঁচড়ও কাটতে পারি না। এটা আসলে একটা অনন্ত সাদা, অনন্ত শীতলতা, এখানে কোনো প্রশ্ন নেই, উত্তরও নেই, প্রশ্ন উত্তরের মাঝামাঝি কিছু, বিবৃতি, তাও কি আছে? হয়তো নেই। আঃ। নতুন করে কিছুই আর ভাবতে পারি না। ব্যথা শুধুই ব্যথা আর ঘূর্ণি হয়ে জেগে থাকে। শ্বাসপ্রশ্বাস জেগে থাকে শ্বাসপ্রশ্বাস হয়ে। রক্তের কোলাহল কোলাহলের বেশি কিছু বলে না। আমি বরং এক দুই তিন গুনি। মনে মনে। সংখ্যাগুলো সহসা থমকে দাঁড়ায়। সিঁড়ির ধাপে বুটের শব্দ, থমকে যায়। দরজায় আঘাতের শব্দ, এবার, এবার। গেস্টাপোরা এক্ষুণি ঢুকে পড়বে ঘরের ভেতর। একটা দুটো না, প্রতিটি সকালে এই ভয়ে তুমি ঘুমোতে পারতে না। মনস্তাত্বিক লাকঁ তোমার চিকিৎসা করেছিলেন। গেস্টাপোর কাছাকাছি একটা ফরাসি শব্দের মানে হল স্পর্শ। ছোঁয়া, কিন্তু আলতো করে। বেশ, তুমি তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো এবার। বালিশের নরম তোমায় ছুঁয়ে থাকবে। ২০০২ সালে গুজরাতের একটি হাসপাতালে মুকেশ ঠাকুর আর বশির আহমেদ পাশাপাশি বেডে শুয়ে ছিল। তাদের রক্ত গড়িয়ে পরস্পর মিশে যাচ্ছিল মেঝেতে। তারা প্রায় একইরকম ছোঁয়া পেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ছিল। শুধু শব্দের মানে পালটে দেওয়া। একটা চিহ্ন, তার ঈষৎ বদল। না, এ-সব কথা তোমার উদ্দেশে আমি বলি না। আমি জানি না আর কোনো কথার কোনো মানে আছে কি না। কথারা অতিদ্রুত কথা বাড়িয়ে তোলে। শূন্যতাকে দুমড়ে দেয়। নৈঃশব্দ্যকে ভেঙে ফ্যালে। থাক, বরং মুহূর্তেরা মুহূর্তের মতোই থাক। তাদের কথায় বদলে দিও না। অর্থ খোঁজা এক ভয়াবহ জুয়োখেলা। ঐ আড্ডায় আমি আর কিছুতেই যাব না। এরা কোথা থেকে উঠে আসছে, এইসব কথারা? আমি বলতে পারি না। হয়তো যেখানে আবার এরা মিশে যাবে সেখান থেকেই। আমি জানি না। আমি বিড়বিড় করতে পারি না। আমি নড়তে চড়তে পারি না। ফিশফিশ করতে? তাও না। আমি শুধু তোমার কথা ভাবতে থাকি। হায় তুমি, সর্বত্র তুমি ব্যাপন করে আছ, সুতরাং সবকিছু তুমিই হয়েছ। আবার সবকিছুরই রূপ হয়ে তুমি বসে আছ নরম অন্ধকারের কেন্দ্রে। তোমার গাল কী করে ছোঁব আমি, কী করে বসিয়ে দেব নখ? তোমার চোখের রক্ত কী করে আমি মুছে নেব কাঁপা কাঁপা আঙুলে? দ্যাখ, আমার কামনা কখন বদলে গ্যাছে প্রেমে, আমার প্রেম তার নিষ্কম্প শীর্ষে উদাসীনতা হয়ে জ্বলে আছে। তোমার দিকে এবার একটু ঝুঁকে পড়ি আমি, প্রথমবারের মতো লক্ষ করি এটা একটা হুইলচেয়ার, যার ওপর তুমি বসে। এখানে কি ভূমিকম্প হয়েছিল কোনো? মেঝে ফাটলো কী করে? তোমার হুইলচেয়ার ঢুকে গ্যাছে মেঝেতে। আমি ঝুঁকে বসি আর দু-হাত দিয়ে তুলতে থাকি একটা চাকা। আমার ঘাম হয়, পরিশ্রম হয়। মনে হয় কেউ আমায় লক্ষ করছে আড়াল থেকে, কখন মুণ্ডু লুটিয়ে দেবে ভূঁয়ে। কই, চাকা তো এতটুকু উঠছে না! আমি আকুল হয়ে উঠি, গালি দিতে যাই নজরদারের উদ্দেশে, ডাকতে যাই তার নাম ধরে। থমকে যাই। রোধের গরাদ ওঠে। কিছুই মনে পড়ে না আমার। কার নাম, কাকে ডাকব, কী বলে ডাকব, কিছুই মনে আসে না। দু-মুঠোয় শিকের ধাতবতা, আমি চেয়ে থাকি। ঘাসের মধ্যে সাপ আবার তার মুখ নামিয়ে নেয়। রোদ্দুরে দুটো নুড়ি শুধু চকচক করে। আস্তে আস্তে আবার নরমে মিশে যাই। ধুলোরা এলোমেলো ঘুরে ওঠে। এক বিন্দু ব্যথা হয়ে ঢুকে আসি বিন্দুসত্তার ভেতরে। কী খাবার খেয়েছি মনে আসে না। হয়তো খাওয়াই হয়নি সকাল থেকে। জানি না। বুঝতে পারি না। ব্যথা শুধু ব্যথার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ঘূর্ণি মনে পড়ায় ঘূর্ণির কথা। ব্যথা আর ঘূর্ণি কখন একাকার হয়ে যায়। বাস্তবতা সময়ের মধ্যে তার ঝুরিগুলো নামিয়ে দিয়েছে, তাদের বিন্যাস প্রতি পলে বদলে বদলে যায়। রক্তশূন্য সিলিং তার রক্তশূন্যতায় ছড়িয়ে থাকে। প্রশ্ন ও উত্তরের অতীত তার শীতলতা, তার অবরোধ। তারই মধ্যে চূড়ান্ত বিবৃতি খুঁজি। মেলে না। ও কার ফোঁপানি? বুঝতে পারি না। ভাঙা ছবি আর অস্পষ্ট শব্দেরা একটু একটু করে মুছে যায়। শ্যাওলায় আচ্ছন্ন প্রাচীন কুয়ো দিয়ে আমি অতলতার দিকে ঘুরে ঘুরে নেমে যেতে থাকি।

Categories
2021-May-Prose গদ্য

তন্ময় ভট্টাচার্য

বাঁ-হাতে ছুড়ে দেওয়া লেখা

সময় আর দিনকাল— এ-দুই নিয়ে ভারি ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে মনে। অবশ্য দুয়ের মধ্যে ফারাকও কি আছে কোনো? নিজস্ব অবস্থান অনুযায়ী বিচার করি। মনে হয়, এখনকার মতো খারাপ সময় আর আসেনি। নাকি সময় বরাবরই খারাপ, আমি-অবধি এসে পৌঁছোয়নি বলে নিশ্চিন্ত ছিলাম এতদিন?

সমাজের দিকে তাকাই। বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে খারাপ আর কীই বা হতে পারে! ‘আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়ো’— এই স্পর্ধামাখানো বাক্য বলার সাহসই-বা দেখাতে পারছে কে! চরমতম পরিণতি যা— মৃত্যু— সেই সুন্দরই আজ ওঁৎ পেতে রয়েছে চারপাশে। মৃত্যুচিন্তার শরীর থেকে খসে পড়ছে বহুকল্পিত সৌন্দর্যও। কদর্য ডাক আর তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা— জীবৎকালের হিংস্রতম চোর-পুলিশ খেলার সামনে দাঁড়িয়ে, আর কোন চেতনাই-বা জরুরি হয়ে উঠবে!

যদি সমাজবিচ্ছিন্ন হতাম, কিংবা মারিসীমানার বাইরে নিরাপদ অবস্থান কোনো, সময় ‘কু’ হত না ততখানি। বরং দূর থেকে বিচার করতে পারতাম; কে জানে, হয়তো নিগূঢ় কোনো দর্শনও উঁকি দিত অবরে-সবরে। কিন্তু প্রবলভাবে জড়িয়ে থেকে এটুকু বুঝেছি, পেট আর পিঠ বাঁচানোর লড়াই-এর থেকে কঠিন কিছুই নেই। নিজের ও আত্মস্বজনের পিঠ বাঁচাতে বাঁচাতে, না-পেরে, সর্বাঙ্গে চাবুকদাগ নিয়ে আর যাইহোক, সাহিত্যবিলাস হয় না। তাও এই স্বল্প সময়ে— যখন ধাতস্থ বা অভ্যস্ত হতে অনেক দেরি, চাইছিও না হতে, বরং অসম লড়াইয়ে বার বার হার মানাতে চাইছি মৃত্যুকে। শব্দ খুঁটে-খুঁটে লেখার মন আজ মৃত। তবে মনের সুবিধা এই, উপযুক্ত সঞ্জীবনী ছিটিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তোলা যায় আবার। দৈহিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই বিকল্প নেই। ফলে, বেঁচে থাকলে, মনকে ফিরিয়ে আনা দুষ্কর হবে না ততটাও। আপাতত এই কেঠো, অপরিকল্পিত ও চলনসই গদ্যেই সময়ের কাছে নতিস্বীকার।

বিপরীতে অন্য চিন্তাও যে উঁকি দিচ্ছে না, তা নয়। এতখানি সীমাবদ্ধ হয়ে গেলাম? বর্তমান ও তার সমস্ত নেতি-কে অতিক্রম করার যে-পথ, তা থেকে পিছলে গেলাম এতখানি! আমারই অবহেলা এর জন্যে দায়ী, সন্দেহ নেই। নিজেকে ভেসে যেতে দিয়েছি, ঝাঁপিয়ে পড়েছি বাইরের কলরোলে। কিন্তু ভয়ংকর এ-বাহিরের সামনে আত্মসমর্পণ না করেই-বা উপায় কী! সমাজ তো বটেই, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে— মৌলিক ‘আমি’-র অস্তিত্বেও যখন ভয় ঢুকে পড়ে, মনে হয়, রেহাই নেই এবার। শিল্প-সাহিত্য সেই স্তর অবধি পৌঁছোতে পারবে না। অন্তত, স্বল্প জীবনকালে এমন সংকট এর আগে দেখিনি আমি। যে-মানুষ নিজের বা অন্যের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, সমস্ত শৈল্পিক সৌকর্য সে ঢেলে দেয় মুহূর্তের ওই ক্রিয়াতেই। কোনো কবিতা-গান তখন অস্ত্র হয়ে আসে না। অস্ত্র হয় না শব্দব্যবহারের অপার্থিব সূক্ষ্মতা। বরং, শিল্পের চোখে যা ‘স্থূল’, সেসবই বাঁচাতে পারে মানুষের প্রাণ।

তাহলে শিল্পের ভূমিকা কী? বার বার খুঁজছি এর উত্তর। মারিতে আক্রান্ত বা মৃত কোনো মানুষকে কেন বাঁচাতে পারল না শিল্প? কেন নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা-উচ্চারণেই থেমে গেল তার দৌড়?
উত্তর দিয়েছে শিল্প নিজেই। মনের সঙ্গে কারসাজি তার। এবং, মনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেটুকু শরীর, তার সঙ্গে। শরীরের শরীর সে ভেদ করতে পারে না। ভাইরাস পারে।

এবং, এতদিনকার আলোড়িত সেই কথাই প্রতিধ্বনিত হল আবার। সামান্য ভাইরাসের কাছে আমাদের চর্চা কৃষ্টি বোধ সূক্ষ্মতা সব অসহায়। ফলে, যে-অস্ত্র অবশ্যম্ভাবী, তাকেই তুলে নিতে হত। আর এই লেখা? থেকে যাক সময়ের অভিশাপ হয়েই। এর বেশি কোনো ভূমিকাই নেই এর। দুঃসময় কাটলে, হয়তো ফিরে পড়ব। অস্তিত্বের চরমতম সংকটে, না, কবিতা পাশে এসে দাঁড়ায়নি। দাঁড়িয়েছিল চিকিৎসা। বন্ধু। ‘বন্ধুর কবিতা থেকে আমাকে আবার দেখা যায়।’ এই মারিকালে, বেঁচে থাকার চেয়ে বড়ো কবিতা আর নেই। ‘জীবন’ নামের সেই কবিতাই প্রতিফলিত করছে আমাকে-তোমাকে। বেঁচে থাকা দেখতে পাচ্ছি আমি। তোমার মধ্যে। আয়নায়। লিখে-ফেলা এই অসংলগ্নতায়।

মনে পড়ে চাঁদ সওদাগরের কথা। অনিচ্ছুক হয়েও মনসার পূজা। বাঁ-হাতে ছুড়ে দিয়েছিলেন ফুল। পরিবর্তে, ফিরে পেলেন বাণিজ্যতরী। আমার এ-লেখাও তেমনই, বাঁ-হাতে ছুড়ে দেওয়া। যতই তাৎক্ষণিক হোক, না-লিখে উপায় নেই। অধরা রইল নীরস তরুবরও। কিন্তু শুষ্কং কাষ্ঠং থেকে যাওয়ার সামর্থ্যটুকু ছিনিয়ে নিতে পারবে না কেউ।

বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, আবার স্বাভাবিক হবে সব। ফিরে পাব আগেকার ডুব। কোনো-না-কোনো মুহূর্তে, কারো কবিতা পড়ে আফশোস জন্মাবে আবার। মনে হবে, যদি লিখতে পারতাম এমনটি। বেঁচে থাকা সেই অতৃপ্তি উপভোগের জন্যেই। জীবন— কবিতা— এক-একটা হাতছানির নাম। সমুদ্রের বুকে বাড়তে থাকা ঘূর্ণিঝড়ের মতো। ডাঙায় আছড়ে পড়বে, ধ্বংসও আনবে; তবু না-পড়া অবধি, শান্তি নেই, শান্তি নেই তার…

Categories
2021-May-Prose গদ্য

সুপ্রিয় মিত্র

জনহিত মে জারি

মৃত নক্ষত্র থেকে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। ভুল কথা। মৃত নক্ষত্র একা সেই জন্ম দিতে পারে না। দু-টি মৃত নক্ষত্র তাদের ধুলোবালি, হাওয়া নিয়ে মহাশূন্যের সংসারে এমন এক সংঘর্ষের মুখোমুখি হয় যে, তারা ফের জ্বলে ওঠে। এ এক পলিটিকাল ইনকারেক্টনেস। এত ঝামেলা আছে, তাই আমি-তুমি আছি। বা ছিলাম। কারণ, নক্ষত্র হয়ে ওঠা মাত্র তারা আবার একে-অপরের থেকে দূরে সরে যায়। তাদের চারপাশে গ্রহ ঘোরে ফেরে। এমনকী, ঘুরপাক খায় গ্রহদোষ। এ দোষ উদ্ভাসের। যেভাবে কথায় কথা বাড়ে। আলোও তেমন। আলো সতত ঘনিষ্ঠ নয়, যতটা অন্ধকার। এমনকী এককও নয়। নিজের উৎসের মধ্যেই বন্দি হয়ে পড়ে। সময় ও পরিসরের বক্র অভিসারে মহাসংসারের খেলা জমে ওঠে।

নক্ষত্রজগতের মতো, আমরা নিঃসঙ্গ। একক হওয়ার তাড়নায় একা। যেভাবে শিকারিকে তাড়া করে শিকারের প্রত্যাশা। আমাদের দূরে সরে যাওয়া, আমার-তোমার গুণ। ওই যে নিকটস্থ ভার্গো তারাজগৎ, সেকেন্ডে ১২০০ কিমি বেগে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ওই যে দূরতর নক্ষত্রদ্বীপ ‘থ্রি সি-২৯৫’ ১ লক্ষ ৫০ হাজার কিমি প্রতি সেকেন্ড বেগে সরে যাচ্ছে আমাদের থেকে— এও কি আলোহীনতা নয়? যত দূরের, তত দ্রুত সরে যাওয়া। যত কাছের, তার গতি তত কম। তবু, সরে যাওয়া থেকে এর ছুটি নেই।

শ্মশানে বন্ধুর মুখাগ্নি করতে গিয়ে, কবরিস্তানে বন্ধুকে নুন-মাটি দিতে গিয়ে, এ-সত্য জ্বলে ওঠে। জ্বলে ওঠে সোডিয়াম লাইট। সম্পর্কের, অনিয়ন্ত্রিত বিন্যাসে। আর নিয়ন্ত্রণে যা থাকে, তা কেবল সংঘর্ষ। আছে বলে, জ্বলে ওঠা আছে। আছে— এই থাকাটাই অনঙ্গ নিয়তি।

আর, এ-সবের থেকে কিছু দূরে, বসে আছে গাছ। টাটানো সিলিন্ড্রিকাল দেহ। পাখি এসে মায়া বাড়িয়ে দিচ্ছে, ঋতু এসে পিঠ চাপড়ে দিয়ে যাচ্ছে— চালিয়ে যাও, আরও থাকো, চুপ করে বেঁচে থাকতে হবে, দোস্ত!

এ যেন এক নীতিশিক্ষা— যত চুপ করে থাকা, তত প্রাণ। একদম চুপ করে যাও। কেবল হাওয়া এসে চুল আঁচড়ে দিয়ে যাবে। তাকে তুমি ঘেঁটে দেওয়া ভেবো না। তারপর দ্যাখ, তোমার সমস্ত দেহ ও দেহবুদ্ধি থেকে বেরোচ্ছে শ্বাসবায়ু। তোমার নিশ্বাস নিয়ে আর একজন কথা-বলা-দেহ বেঁচে আছে। তুমি তাকে অক্সিজেন জোগাচ্ছ।

তাই বলে, তুমি যেন মরে যেয়ো না। কিংবা, মরে গেলেও কী আর হবে।

এভাবেই সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

চোখে জল নেমে আসে। উড়ে আসে ঝড়। আমি থেমে আছি। আর, সকালে পর্বতের হাওয়া, দুপুরে সমুদ্রের, ভোররাতে মরুবায়ু আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। এও কি ভ্রমণ নয়, এ কি নয় প্রকৃতির কাছে যাওয়া? আসে না কেবল অরণ্যের সমূহ বাতাস। পড়শির বাগানের ফল-ফুল-মূল না খেয়েও, অক্সিজেন ভোগ করে যেভাবে মানুষ এবং অজান্তে দ্রাক্ষাবনের শেয়াল হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে ধোপার কাঁধে গাধা, হয়ে ওঠে জনমদুখী বাপের বাস্তুশোক— অরণ্যের দুঃস্বপ্ন নিয়ে, বনানীর নিশ্বাসচিন্তা বয়ে, সেও একদিন ভাবে— আর ক-টা দিন পর মৃতবন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাবে। এবং সংঘর্ষ হয়ে পড়বে পুনর্নিয়তি। মানুষের চলে যাওয়া থেকে মানুষ এই আশ্বাস কুড়োয়।

এবং সে কাঁদে। বিশ্বাস আছে বলে কাঁদে।

জানলা-দরজার নাম রুদালি। হাওয়ার সঙ্গে সংযম অভ্যাস করে যারা, তারা একসময় সেই হাওয়ার প্রতি ক্লান্তবোধ করে বা নিজেরাই হাওয়া হয়ে ওঠে। ঝড় যেন সেই তালে থাকে। সম্পর্ক তো এমনই। হম রহে না হম, তুম রহে না তুম। কিংবা, পদ্মাবতীর বিবাহমঙ্গল। নিজেকেই তার প্রেমিক মনে হয়, নিজেই সে প্রেমিকা। প্রেমিককে মনে হয় সে। আলম্বন, উদ্দীপন।

জানলা এখন হাওয়া। হাওয়া এখন দরজা। ঘরে ঢুকে পড়ছে। বাইরে থেকে বন্ধ হয়, না কি ভেতর থেকে খোলে, কেউই সবটা বলতে পারে না। কিংবা সবই একপ্রকার হাওয়া। ধুলো জমাট হলে আকার আছে, নয়তো নেই।

ঘরে হাওয়া খেলানোর যারা রিংমাস্টার, সেই জানলা আর দরজা এখন বুক চাপড়ায়। মানুষের থেকে তারা একটা জায়গার নামই উচ্চারণ করতে শিখেছে। দমদম। দ্দম দ্দম দ্দম দ্দম। এয়ারপোর্ট? সেখানেও হাওয়ার আখ্যান। বার্নৌলির নীতি দিয়ে বাড়িকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন? জানলা দরজা এখন বাড়িদের ডানা। উড়তে পারে না। কিন্তু এই ক্ষুদ্র সাহসদের বরাবর ভয় পেয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠান। কৃষককে ভয় পায় রাজধানী, শ্রমিককে ভয় পায় কারখানা, পৌরুষ-শূন্যতাকে ভয় পায় পুরুষতন্ত্র, লিট্ল ম্যাগাজিনকে এড়িয়ে থাকে স্যর-ম্যাডামদের পত্র-পত্রিকা, রাস্তার হোটেলকে ভয় পায় বড়ো রেস্তোরাঁ। তেমনই হাওয়াকে ভয় পায় ঘর। ফলে ততটুকু, যতটা বিলাসের। কিন্তু বিলাস একসময় মুক্তি পেয়ে বিধ্বংসী হয়ে ওঠে।

গরম ভাত কে না চায়। কিন্তু আঙুল তাকে সমঝে চলে। ফুঁ-সহযোগে তার গরাস ওঠে। ফুঁ বেড়ে গেলে ভাত ছিটকে যাবে। কিন্তু ভাত শুকিয়ে গেলে শুকনো বিপদ। গলা দিয়ে নামতে কষ্ট।

ওই যে, আধপেটা শ্রমিক, ফ্যানভাতে বাঁচে। কিন্তু, সতত জল বিনা কে চলিতে পারে? সতত জল যেভাবে জীবন, সেই জীবনখানি জলের ধর্মে উচ্চ থেকে নীচে ছুটে যায় যেহেতু, প্রতিষ্ঠান চায় একে পৃথিবীর অভিকর্ষ-দোষ বলে চালিয়ে দাও। জীবন যে বাধ্যত জল, সে-কথাটি এখানে উচ্চারণ কোরো না। পাঁচশো-হাজার কিলোমিটার অনুল্লিখিত সে ছুটে যাক, বাস্তুভিটের নামে, শিকড়ের নামে, আশ্রয়ের নামে, অপলাপের নামে, সে যাক। তার পরিধি যতটুকু বড়ো হয়েছে, যেন গোল্লাপাক খেতে খেতে বিন্দুতে গিয়ে গুমখুন হয়ে ক্ষান্ত হয়। জীবনের পিয়াসায়, প্রাণবায়ু যেন বড়ো হয়ে ওঠে, যেন ভবঘুরে শাস্ত্রস্নিগ্ধ নয়, গড়িয়ে যাওয়া শেষত পাথরের ধর্ম পায়। কেবল বেঁচে থাকাটাই যেন অনঙ্গ অভিজ্ঞতা লাগে। এইরূপে ঝড় প্রলয়ের হাওয়া-সহ আসে। অতিথি হয়ে নয়। কোল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে আসে, হে ধর্ম, তোমার সন্তান। সন্তানের ধারক বা বাপ-মা এখানে সন্তানের জাগরণ, জ্বালানি। যেহেতু তাদের ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী, যে-কোনো অপত্যের স্নেহে।

ঝড়ের জ্বালানি কি বৃষ্টি? ততক্ষণ, যতক্ষণ মেঘের পেটে সে রয়েছে? ফুরালে ঝড়ও ফুরিয়ে আসে? বাচাল হাওয়া এ-সব বোঝে না। মেঘ চুরি করে আনে। বিপদ সে চায়, কিন্তু শুকনো বিপদ চায় না। জলকে দলে টানে। জল, যা মরণোত্তর। হাওয়া, যা জীবনবিমুখ।

কেন এতক্ষণ ধরে পড়ছেন? যান, দেখুন, দরজা-জানলা-সিলিন্ডারে কোনো লিক রয়ে গেল না তো?

Categories
2021-May-Interview সাক্ষাৎকার

হিরণ মিত্র

“চিত্র আমাকে রচনা করেছে, আমি চিত্র রচনা করিনি”

আলাপচারিতায় রণজিৎ অধিকারী

কথা শুরুর আগের কথা:

শিল্পী হিরণ মিত্রের সঙ্গে যে আমি যে-কোনো সময় যে-কোনো একটা কথা পেড়েই আলোচনা শুরু করে দিতে পারি, এ-প্রশ্রয় তিনিই আমাকে দিয়েছেন। এত এত কথা বলেছেন আমার সঙ্গে, তা সব এখানে রাখলে মহাভারত হয়ে যাবে। একটা পাঠযোগ্য কথোপকথন তৈরি করার অন্য সমস্যাও আছে। হিরণ মিত্রের মধ্যে থাকা অনেকগুলো হিরণ, তাদের একসঙ্গে ধরব কী করে?… যিনি পোর্ট্রেট করেন আর নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন যিনি, “উষ্ণ আলোয়ানের পাশে” লেখেন যে-কবি আর ‘আরবানিয়া’-র সৃষ্টিগুলি যাঁর… তাঁরা কি একজন হতে পারেন? ধরুন, শিল্প সাহিত্য-বিষয়ক অজস্র গদ্য লিখেছেন যিনি আর রাত জেগে অন্ধকারে পাগলের মতো রেখার পর রেখার জন্ম দিচ্ছেন যিনি… তাঁরা? তাঁরা সবাই মিলে একজন হিরণ?— এর উত্তর পাওয়া সোজা নয়। হিরণ মিত্র এমন একজন শিল্পী, যিনি আধুনিকতাবাদের গণ্ডি পেরিয়ে উত্তর-আধুনিক ধারণাগুলিকে আত্মস্থ করে নির্মাণ করে নিয়েছেন এক নিজস্ব জগৎ, যে-জগৎ রূপ-অরূপ রেখা ছায়া শূন্যতা দেখা-না-দেখা গতি ও গতিহীনতা দিয়ে গড়া… সংগীত আর জ্যামিতি বিষয়ে সম্যক ধারণা না থাকলে তাঁর চিত্রের সঙ্গে কোনো ক্রিয়ায় অংশ নেওয়া অসম্ভব। সেই হিরণকে আমি আমার সমূহ সীমাবদ্ধতা দিয়ে ধরবার চেষ্টা করেছি।

এতজন এত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাঁর, তাই নতুন করে নেওয়া কোনো সাক্ষাৎকারে পুনরাবৃত্তি থাকা স্বাভাবিক হয়তো। কিন্তু আমি এখানে খুব সচেতনভাবে চেষ্টা করেছি এমন কিছু সংলাপ এখানে রাখার, যা আগের কোনো কথোপকথনে নেই। এমন কিছু নতুন প্রসঙ্গে কথা বলেছি আমরা, যেগুলি তথাকথিত শিল্প-সমঝদারদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা কথা বলার সময় শিল্পের সীমানা মানিনি, স্বভাবতই আলোচনা ক্যানভাস পেরিয়ে আর্ট, আর্টের ধারণা, রূপ আর রূপাতীত জগৎ, নাটক ও যৌনতা… ইত্যাদি নানা বিষয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

কথা তো চলতেই থাকে তাঁর সঙ্গে, চলতে থাকবে। সামনে বসে, তাঁর কাজ দেখতে দেখতে কিংবা দূরভাষে…।

এমনও হয়েছে, তাঁর লেখা পড়তে পড়তে, তাঁর তৈরি করা নাট্যমঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা ফাইন আর্টস একাডেমিতে তাঁর কোনো প্রদর্শনী দেখে… একা একাই আমি তাঁর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছি। রাস্তায় হাঁটছি কিন্তু টের পেয়েছি যে, আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোনো বিশেষ ছবিতে ব্যবহৃত তাঁর তীব্র লাল রং।

একবার উত্তম মঞ্চে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল, ওই নাটকের মঞ্চনির্দেশনায় ছিলেন হিরণ মিত্র… আগেও একবার দেখেছি নাটকটি কিন্তু মঞ্চনির্মাণের তাৎপর্য যেন ধরতে পারলাম দ্বিতীয়বার দেখার পর, নাটক শেষ হওয়ার পরও বেরোতে ভুলে গেলাম, একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ… যেন মঞ্চটাই আমার সামনে অভিনয় করে চলেছে কোনো কলাকুশলী না-রেখেই। মঞ্চের নানা বিন্যাস আর রেখার কাজগুলো নানা মুদ্রায় আমার সামনে হাজির হচ্ছে। এই জাদুখেলা দেখাবার লোক তো একজনই… শিল্পী হিরণ মিত্র। তাঁর মঞ্চনির্দেশনায় ‘ফ্যাতাডু’, ‘আলতাফ গোম্‌স’, ‘রাজা লিয়র’ নাটকগুলি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এ-কথা মানবেন।

বালক বয়সে গুস্তাভ কুর্বের আঁকা ‘অরিজিন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ চিত্রটি দেখে পিকাসো প্রায় পাগল হয়ে গেছিলেন, আমরা ওই বয়সে পাগল হওয়ার অমন সুযোগ পাইনি, এই মধ্যযৌবনে হিরণ মিত্রের নগ্নিকা সিরিজের অসামান্য কাজগুলো দেখতে দেখতে আমার পাগল হতে ইচ্ছে করে। তাঁর নগ্নিকাদের এত ভঙ্গি, এত বিভঙ্গ তাদের শরীরের এত মুদ্রা! মুহূর্তে মুহূর্তে যেন তাদের রূপ ও আকার বদলে যেতে থাকে।

একটি চিত্রে যোনিলোমগুলো যেন বাষ্পের মতো উন্মুখ হয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে, তারা যেন শরীরে লেগে নেই, উড়ে যেতে চাইছে।

আবার একটি প্রসৃত আকারের যোনির দুই পাশের অববাহিকায় নেমে এসেছে গুল্ম, এ তো বিদেশীয় হতে পারে না তবে কি এ-দেশীয়, কোনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর!

পরের কথোপকথনের জন্য আরও অনেক প্রসঙ্গ তোলা থাকল, হয়তো একটা গোটা দুপুর অপেক্ষা করে আছে, কিংবা রোদ নেমে আসা শান্ত কোনো বিকেলে আবার তাঁর স্টুডিয়ো লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াব দু-জনে, তেরছা একটা রোদের টুকরো এসে পড়বে সেই লিপিগুলোর গায়ে, যাদের পাঠোদ্ধার হবে না কখনো কিন্তু অনায়াসে রোদে আর লিপিতে সংলাপ রচিত হয়ে চলবে। জানি যে, সেই অলীক কথোপকথন কখনোই লিখে উঠতে পারব না।

রণজিৎ অধিকারী: ‘জীবনের উৎসব’ লেখায় আপনি বলেছেন, “ছবি আঁকাটা আমার কাছে উৎসবের মতো”—এই যে উৎসব শব্দটি শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলেন, এর ফলে এই শব্দের তাৎপর্যটাই কি বদলে গেল না?

হিরণ মিত্র: উৎসব। সাধারণভাবে মানুষ সামাজিক। উৎসবে সমাজ কথাটা আসে। কিন্তু আমি একাকী মানুষ, আমার তেমন কোনো সমাজ নেই। কল্পিত অবস্থান আছে। উৎসব একপ্রকার জীবনকে উপভোগ করার, প্রতিটা মুহূর্তকে আলোকিত করার অথবা গভীর অন্ধকারকে আবিষ্কার করার …। উৎসব সবসময়ই যৌথতার কথা বলে। আমিও প্রতিফলিত হই, নিজেই নিজের আবিষ্কারে। কিন্তু নার্সিসাস নই। একসময় এই বদনাম আমার ছিল, সে-কথা ভুল বোঝার বা ভুল ব্যাখ্যা করার বদনাম, আজও হয়তো আছে। এ মোহিত হওয়া নয়। মনের কত কত হাজারো কুঠি আছে, সব কি আমরা ভ্রমণ করতে পারি, এক জীবনে তা অসম্ভব। তাই এই ‘উৎসব’কে আবিষ্কার করি। চিত্র রচনাও এক উৎসব, মৃত্যুও তাই— জীবন যেমন।

রণজিৎ: আপনি লিখেছেন, “রেখা থেকে রেখার জন্ম হয়”— এর মানে দাঁড়ায় একটা চিত্র বা ছবিতে তা পূর্বপরিকল্পিত নয়, মানে আঁকতে আঁকতে এগিয়ে যাওয়া? একটু যদি স্পষ্ট করেন।

হিরণ মিত্র: এই “রেখা থেকে রেখার জন্ম হয়”, এটা একধরনের ক্রমাগত বা ক্রমিক ধারায় চলনের কথা। আমি একটা রেখা টানলাম, সাদা কাগজে… সেই চলনের যেমন পূর্ব-পরিকল্পনা নেই, তেমনি সেই রেখা, তাকে প্রত্যক্ষ করার মুহূর্তে একটা বিদ্যুৎচমকের মতো চকিতে আরও আরও রূপ ও রেখা ভিড় করে ওঠে। তারা যেন ওই রেখার গর্ভ থেকে উঠে আসা আর্তি। আমি বিস্মিত হই। আরও কৌতূহলী হয়ে উঠি। এগিয়ে যাই…। রূপ তাই আমাকে নির্মাণ করে, অথবা বলা যায় দু-জন দু-জনের পরিপূরক। এই ক্রিয়া চলতেই থাকে, একসময় বিরামও ঘটে। তখন সরে যাই ওই নির্মাণ থেকে।

রণজিৎ: আপনি নানা সময়ে এই কথাটি বলেছেন যে, চলতে চলতে আঁকা, আঁকতে আঁকতে ভাবা… এর মধ্যে আমরা একটা নতুন ধরন দেখতে পাচ্ছি, একটা নতুন ভাবনা। একটু যদি বলেন...

হিরণ: এটি একটি বিচিত্র ক্রিয়া— এই চলতে চলতে আঁকা, আঁকতে আঁকতে ভাবা। ষাটের দশকের শেষ পর্বে, আমার মধ্যে একধরনের শিল্প-বিচ্ছিন্নতা আসে। মানে, চারপাশের শিল্পচর্চা বা  অগ্রজ শিল্পীদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিই। শিল্পীরা ভাবে, আমি নানা ব্যক্তিগত কারণে বা ব্যর্থ হয়ে এই শিল্প-ভূখণ্ড ত্যাগ করেছি। বিষয়টা তাদের বোধগম্য হওয়া সেদিনও সম্ভব ছিল না, আজও নেই।

আমি তো আসলে ভিন্ন এক শিল্পদর্শনের খোঁজে ছিলাম, যে-ধরনের শিল্প-অভ্যাস আমার মধ্যে গড়ে উঠেছিল ইতিমধ্যেই, অগ্রজদের পাশে থেকে অর্থাৎ তার আগে দীর্ঘ পনেরো বছর তাদের সঙ্গ পেয়েছি, সেই ‘সঙ্গ’-তে আমি ক্লান্তি বোধ করতে থাকি। আমি সন্ধান করি… ভারতের বৃহৎ ব্যাপ্ত লোকজীবন— বাউল, দরবেশ, ফকির, নাচিয়ে-গাইয়ে-বাজিয়েদের, যারা শুধু মনোরঞ্জন করে না, তাদের আছে এক ভিন্ন শিল্পের ধরন। তারা বাইরে এক রূপ ধরে থাকে, আর ভেতরে জমিয়ে রাখে অফুরন্ত এক প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তিকে আমরা তথাকথিত শিল্পীরা চিহ্নিত করতে পারিনি। আমাদের কলা-সমালোচকেরা ধরতে পারেননি। এমনকী এই প্রাণশক্তির উৎস বিষয়টিই তাঁদের কাছে অপরিচিত আজও।

এই লোকজীবন কিন্তু চলমান, তাই তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমিও চলমান হলাম। নাচের সঙ্গে… রচনা… নাচের মধ্য দিয়েই অনুভব করলাম। নাচতে নাচতে আঁকা অভ্যাস করলাম। আমাদের পাশ্চাত্য ও পূর্বী শিল্পশিক্ষায় স্থির থাকা, মনস্ক থাকা, শারীরিকভাবে খুবই জরুরি শিক্ষা।… রেখা রিক্ত হয়ে যাবে, অনিয়ন্ত্রিত রেখার জন্ম হবে। তুলির চলন বিক্ষিপ্ত ও অবিন্যস্ত হবে। এইসব প্রাচীন ধারণা এই চলনের ঠিক বিপরীতে থাকে। অনেক জড়তা কাটাতে হয়েছে। সমালোচনা শুনতে হয়েছে, আজও হয়।

তখনও আমি আমেরিকান অ্যাকশন পেইন্টার জ্যাকশন পোলককে ততটা গভীরে জানতাম না বা চর্চা করিনি। কিন্তু তাঁর অপ্রত্যক্ষ প্রভাব যেন আমার উপর পড়ল। আমার সহযোগী বাউল ও ছৌ নাচিয়েরা উৎসাহ দিল। ধ্রুপদী নাচিয়েরাও অংশ নিল, এমনকী সংগীতজ্ঞরাও…।

এই চলমানতার সাথে ভাবনার চলমানতাও যুক্ত হল, ফলে ভাবনা এবার গতি পেল। দুরন্ত রেখার জন্ম হল।

ক্যালিগ্রাফিক অ্যাবস্ট্রাকশন আখ্যা দেওয়া হল একে। অক্ষরচর্চা আরও একটা বিষয় হয়ে উঠল।

রণজিৎ: একজন সাধারণ কবি হিসেবে আমার মনে হয়, জড়জগৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আর বিমূর্ত শিল্পের মধ্যে কোথাও যেন একটা নিবিড় যোগ আছে, একজন শিল্পী হিসেবে এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

হিরণ: বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একটি তত্ত্ব ও সত্য অমোঘ, তা হল স্বর্ণচ্ছেদ বা গোল্ডেন সেকশন— এ একটি চূড়ান্ত তত্ত্ব। প্রকৃতি সৃষ্টি হয়েছে, ব্রহ্মাণ্ড তৈরি হয়েছে, তার চলমানতা, ভারসাম্য, আকর্ষণ, বিকর্ষণ সবই এই নিয়মে বাঁধা। আমরা শিল্পীরাও অজান্তে তার মধ্যে চলমান, এটা কোনো বাধা নয়, এটা কোনো আরোপিত নিয়ম বা শৃঙ্খলা নয়, এ নিজের নিয়মে নিজের মধ্যেই সম্পূর্ণ। ফুল, পদ্ম, মাকড়সার জাল, গ্যালাক্সি… সবই ছন্দে নির্মিত।

একে আবিষ্কার ও সমর্পণে শুধুমাত্র আমাদের মুক্তি ঘটে। আমরা তথাকথিত শৃঙ্খলে বদ্ধ নই। আবার যেহেতু এই পরিচালক তাই মুক্ত ভাবনাও আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য দেয়।

এতে জ্যামিতি আছে, আবার জ্যামিতিকে পাশ কাটিয়ে নতুন প্রতিপাদ্য নির্মাণও আছে।

রণজিৎ: আপনার চিত্রকলা প্রসঙ্গে দু-জন শিল্পীর চিত্রকর্ম বিষয়ে জানতে চাইব— পল ক্লি, কাঁদিনস্কি… আপনি কীভাবে এঁদের মূল্যায়ন করেন?

হিরণ: পল ক্লি ও কাঁদিনস্কি। দু-দেশের দুই শিল্পী। একজন জার্মান আর অন্যজন রাশিয়ান। দু-জনের ভাবনা-বিষয়ও ভিন্ন, সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। কিন্তু কোনো আপাত বিরোধ নেই। ক্লি ও কাঁদিনস্কি যৌবনে অর্থাৎ ষাটের দশকে খুবই প্রভাব ফেলেছিলেন। তাঁদের সম্বন্ধে বলতে গেলে একটু দীর্ঘই হয়ে যায় কথা। পল ক্লি-র ‘পল ক্লি অন মডার্ন আর্ট’ বইটি খুবই উৎসাহ দেয়। ছোটো ছোটো কথা, লেখা, দার্শনিক প্রকাশ। চিত্রের দর্শন যে একটি প্রধান উপাদান ক্লি-ই আমাকে শেখান। যেমন, “From the root the sap flows to the artist, flows through him, flows to his eye. Thus he stands as the trunk of the tree.” (Paul Klee)

দেখা ও তাকানোর তফাত ঘটে গেল। কাঁদিনস্কি শেখালেন জ্যামিতি। আকারের সাথে আকারের আন্তর্সম্পর্ক। সংগীতের মতো, তারা ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। মূর্ছনা রচনা করছে। দৃশ্যেরও ধ্বনি আছে, তা কাঁদিনস্কি দেখালেন। আমরা দেখার চেয়ে শুনলাম বেশি। আগে এমনটা ঘটেনি। যুবক বয়স, আবিষ্কারের নেশা,… বুঁদ হয়ে গেলাম শিল্পচর্চায়। আমার চর্চা চিরকালই খুব গভীর ও আত্মস্থ… এ নিয়ে বেশি বলা আমার ইচ্ছে নয়। কেউ প্রশ্ন করেনি, তাই জানানোরও বালাই ছিল না। আমার চারপাশের শিল্পীদের সঙ্গে বরাবরই আমার যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ। তাঁরা কী ভাবছেন আমাকে নিয়ে, তাও জানি না। আমার লেখাও তাঁরা পড়েন না, হয়তো ভাবেন পড়ার কিছুই নেই…

ফলে অস্বাভাবিক ও আলটপকা মন্তব্য করেন। নানাভাবে অবজ্ঞা করতে চান, এড়িয়ে যান, হয়তো আমার কাজ দেখেন কিন্তু না-দেখার ভান করেন…।

রণজিৎ: কিছু দিন ধরেই আমরা দেখছি, আপনি ধারাবাহিকভাবে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে এক-একটা সিরিজ আঁকছেন যেমন বেনারস, পিকাসো, চ্যাপলিন ইত্যাদি। এই ধরনের স্টাডির অভিমুখটা কী থাকে?

হিরণ: এই তিনটি নাম একসঙ্গে বলা ঠিক হবে না। বেনারস, পিকাসো, চ্যাপলিন… এক নিঃশ্বাসে বলার মতো নয়।

বেনারসে আমি অল্প কিছু দিন কাটিয়েছি, সে অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আবার ‘ব্যক্তিগত’ এই শিরোনামে কিছু শিল্পীকে নিয়ে আমি একধরনের লেখা ও আঁকায় সম্প্রতি ব্যস্ত আছি। ‘ব্যক্তিগত চ্যাপলিন’ প্রকাশিত, এর পর দু-টির কাজ প্রায় সমাপ্ত—‘ব্যক্তিগত পিকাসো’ ও ‘ব্যক্তিগত দালি’। কাজ করছি ‘ব্যক্তিগত হুসেন’ নিয়েও। এই কাজগুলির মজা হচ্ছে, এঁরা আমার কাছে শিল্পী হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছেন না। যদিও তাঁরা মূলত চিত্রশিল্পী, তা সত্ত্বেও এখানে আমার কাছে ধরা দিচ্ছেন অভিনেতা হিসেবে। তবে তাঁরা কি শিল্পরচনায় অভিনয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন!— না, তাও নয়। তাঁদের চিত্ররচনা, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে অভিনয় একটা বিশেষ প্রকাশভঙ্গি হিসেবে চলে আসছে। যেন এক-এক জাদুকর, ভেল্কি দেখাচ্ছেন… বিষয়টি বেশ বিস্তৃত। স্থানভিত্তিক যে-ধারাবাহিকগুলিতে আমি অংশ নিই— তার অবস্থান এর চেয়ে ভিন্ন। সেখানে একটা স্থানই বলিষ্ঠ চরিত্র হয়ে ওঠে। জনপদ, মানুষজন… তার ঐতিহ্য অদ্ভুত এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।

রণজিৎ: আপনার চিত্রে একটা বিষয় খুব দেখা যায় যে— দৃশ্যের চলমানতা। জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত আঁকার এই বিশেষ ধরন। এই প্রক্রিয়াটা কীভাবে মস্তিষ্ক থেকে তুলিতে উঠে আসে?

হিরণ: তিন নম্বর প্রশ্নের উত্তরে চলমানতা নিয়ে কিছুটা বলেছি। দৃশ্যের চলমানতা আমার শরীর ও মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে নিয়েছে। রক্ত সঞ্চালনের মতো তা প্রবাহিত হয়। ক্রমাগত সারাদিন ও রাত্রি… আমি সর্বক্ষণ সচল থাকি। আমি আক্ষরিক অর্থেই ২৪×৭-এর শিল্পী, সেই অভ্যাসের শিল্পী। এমনকী নিদ্রিত অবস্থাতেও আমি কর্মরত থাকি। স্বপ্নে… ঘুম ভেঙে উঠে স্বপ্নে দেখা ছবিগুলি এঁকে ফেলি। হয়তো বালখিল্যের মতো শোনাবে কিন্তু এ এক বিষম অভ্যাস। ক্রমাগত এই অভ্যাস আমাকে আরও আচ্ছন্ন করে রাখছে। চিত্রে বা শিল্পে চলমানতা আমার চিত্রের মূল সম্পদ। রেখা, রং, তুলির চলন, সবই অস্থির, অনিশ্চিত এবং কৌতূহলী। এখান থেকেই ওই কথাটা উঠে আসে… ছবি আমি আঁকি না, ছবি আমাকে আঁকে, আঁকতেই থাকে। কীভাবে ঘটে যায়! কবি উৎপলকুমার বসু একে বলতেন, ‘অটোমোটর’।

রণজিৎ: এই যে চলমানতা, এটা আপনার নাটকের কাজের ক্ষেত্রে খুব খাপ খায়,… নাট্যমঞ্চে আপনার কাজ নাটকের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক খুলে দিয়েছে। কথাটা হল, এই যে মঞ্চটাকে চলমান করা… এই আইডিয়া কি নাটকে কাজ করতে করতেই এসেছে?

হিরণ: নাটকের মঞ্চনির্মাণের আগে আমি এক বিচিত্র পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছি। ভারতের কোনো মঞ্চশিল্পীই এই পদ্ধতিতে আস্থা রাখেননি, তাঁদের কাছে এটা অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্য। কিন্তু… আমার কাছে ভিন্ন অর্থ নিয়ে এসেছে তা।

যেমন: নাটকের মহড়া চলাকালীন বিভিন্ন স্তরে তার ‘দৃশ্যতথ্য’-কে চিত্রবদ্ধ করে রাখা, ডকুমেন্টেশন যাকে বলে। এই কাজটি খুব দ্রুত ও নানা কৌশল নিয়ে করি আমি। দৃশ্য আঁকতে আঁকতে মঞ্চের ধারণা তৈরি হয়। সমগ্র পদ্ধতিটা একটা সচল ব্যাপার— স্থিরতা নেই, থেমে থাকে না কিছুই, মহড়া নিজের মতো চলতে থাকে, আমার আঁকাও… তারপর সেই আঁকা নিয়ে আলাপ আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ইত্যাদি।

পরিচালক, আলোকশিল্পী, অভিনেতা, অভিনেত্রী… সকলেই অংশ নিতে থাকে, নতুন নতুন দৃশ্যেরও জন্ম হতে থাকে। এই পদ্ধতি ভুল কি ঠিক, ভালো কি মন্দ… সে-সব দীর্ঘ বিতর্কের বিষয় কিন্তু এর কার্যকারিতা থেকেই ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-এর মতো মঞ্চ নির্মিত হয়েছে, ‘দেবী সর্পমস্তা’ হয়েছে, ‘ইটসি বিটসি’ হয়েছে, ‘লিয়ার’ হয়েছে। আমি যে-সব নাটকে মঞ্চের কাজ করেছি, এমনভাবে এই পদ্ধতিতেই করেছি। এটা একটা ভাবনা-প্রক্রিয়াও বটে।

রণজিৎ: আপনার রেখা কখনো কখনো তীব্রভাবে যৌনতার প্রকাশ ঘটায়। অথচ সেভাবে আপনার আঁকা নগ্ন চিত্র সাধারণ দর্শকদের সামনে প্রকাশ পায়নি। একটি রেখাই যে দর্শককে উত্তেজিত করে দিতে পারে, যৌনকাতর করে তুলতে পারে, তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ আছে আপনার কাজে। আসলে যৌনতাকে ভিন্নভাবে দেখা ও দেখানোর চেষ্টা কীভাবে এল আপনার মাথায়?

হিরণ: এখানে একটু জানিয়ে রাখি, আড়ালে আমার নগ্নচিত্রের বিশাল সম্ভার জমা আছে এবং আমি আজও নগ্নচিত্র আঁকার অভ্যাস বজায় রেখেছি। বিস্তারে বলছি না। কিশোর বয়স থেকেই যৌন প্রবণতা বাসা বাঁধে, এ নিয়ে দীর্ঘ লেখা আছে আমার। সাধারণ যৌন কৌতূহল আর শিল্পীর যৌন কৌতূহলে তফাত আছে। আমার সেই অর্থে সমস্ত রঙে রেখায় যৌনতার চলন,… নগ্নতা একটা মাত্র যৌনপ্রকাশ। কামসূত্রের চৌষট্টি কলায় তার নানা প্রকাশ। নগ্নতা, যৌনমিলন… তার সামান্য এক-একটি লক্ষণ… তার থেকে অনেক যৌন চিত্ররচনা— ওই কলার একটি অংশ, তাই এই বিষয়টি খুবই ব্যক্তিগত এবং জটিল।

যৌনতা আমার রক্তে। লেখাগুলো স্বাভাবিক যৌনতার রূপ নিয়ে খোদাই করে যায়। মননে যৌনতা। স্বপ্নে আসে যৌনতা। যৌন অভ্যাস সচল থাকে স্বপ্নে। যৌনতা নিয়ে সমাজে অনেক ট্যাবু, সেইসব ট্যাবু সামলে আমি এই ক্রিয়া চালিয়ে যাই। এখানে তার বিশদ বিবরণ দেওয়া অসম্ভব।

রণজিৎ: চিত্রকলার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটো জগতে আপনার অনায়াস যাতায়াত— উচ্চাঙ্গসংগীত ও কবিতা। এই দুটো জগতের কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে আপনার মননে?

হিরণ: উচ্চাঙ্গসংগীত ও কবিতা। অল্পবয়স থেকেই আমি সংগীতপ্রিয়। ফলে উচ্চাঙ্গসংগীতকে খুব গভীর করে পাই ছাত্রজীবনে। নানা যোগাযোগে তা ঘটে। রাত জেগে সংগীত-সম্মেলন শোনা… আস্তে আস্তে যখন থেকে বিমূর্ততা বাসা বাঁধল মাথার ভেতর, সংগীতের মধ্যে তার রূপ আবিষ্কার করলাম। দিশা দেখাল প্রাচ্য পাশ্চাত্য… দুই ধরনের ধ্রুপদী সংগীত। ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় গড়ে ওঠা বোধে চিত্ররচনায় ঢুকে পড়লাম। বিচিত্র রূপ আবিষ্কার করতে লাগলাম। দেশে বিদেশে, নেশা ধরে গেল। সংগীতের তাল লয় মাত্রা… তার সঙ্গে চিত্ররচনার চলমানতা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল। ঘোর কিছুতেই কাটে না, বাকি জীবন এভাবেই চলবে হয়তো।

সংগীতের নানা ধারা। বাদ্যযন্ত্র, কণ্ঠ… সবই রূপ সৃষ্টি করে। ধ্বনি থেকেই দৃশ্যের জন্ম এই বিশ্বাস ক্রমশই গভীর হতে লাগল। তাকে চর্চায় নিয়ে এলাম। বুঝতে লাগলাম ঠিক কোন মাত্রায় ধ্বনির ক্রিয়াকর্ম দৃশ্যের বাঁকগুলোকে চিহ্নিত করে যাচ্ছে। নৃত্যের ছন্দের সঙ্গে ধ্বনি, নৃত্যের নানা ভঙ্গিমার সঙ্গে রেখার সম্পর্ক…

প্রত্যক্ষ করলাম। এটাই আমার প্রাপ্তি।

কবিতার ধ্বনিও আমাকে আকর্ষণ করে। ভাষা ও ভাব দৃশ্যের নানা কুঠুরিতে ভ্রমণ করায়। ছবি আঁকার ফাঁকে কবিতাই পড়ি। সবসময় মনের সাথে মিলবে এমন নয়। কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করার তাগিদে অনেক কবিতা পড়তে হয়, বার বার পড়তে হয়। পছন্দ অপছন্দকে প্রাধান্য দিই না। কবিদের মধ্যে এই প্রবণতা আছে। বড়ো কবি, ছোটো কবি… ইত্যাদি। আমার কাছে কবিতা একটা বিমূর্ত চলন। আমিও কবিতার দৃশ্য খুঁজতে থাকি। কবিতার বক্তব্যের আড়ালে থাকা কবিকে খুঁজি।

তার বয়স জানি না, পরিচয় জানি না। সে একটি কণ্ঠস্বর মাত্র। এই আড়াল থেকে যার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। এ এক ভিন্ন আবিষ্কার। এমন হতেই পারে, সেই কবি, সেই কবিতা… মানে যার সঙ্গে… যাকে আমি কানেক্ট করছি, সে আমারই নির্মাণ… হতেই পারে মূল কবির ভাবনা আর আমি কবির যে-ভাবনাটা দেখছি, দুটো ভিন্ন রেখা কিংবা সমান্তরাল… তবু্ও এই নির্মাণ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি না। আমার মধ্যে কবিতাপাঠ,… হয়তো সে-পাঠের কোনো বিশেষ ভূমিকা আছে। কবি যেখানে ছন্দ, ভাষা, পঙ্‌ক্তি নিয়ে ব্যস্ত, প্রকাশে ব্যস্ত, আমি সেখানে অপ্রকাশে ব্যস্ত। অপ্রকাশই শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, এই ধারণা আমাকে অদ্ভুত একটা মানসিক স্তরে নিয়ে যায়। এ কবিদেরই অবদান। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। যেহেতু আমি নির্দিষ্ট কোনো মূল্যমানে নিজেকে আটকে রাখি না তাই কবিতার বিচার আমি করতে বসি না। আমি তাই সমস্ত স্তরের কবিদের পাশেই থাকি। কবিতা আমার কাছে একটা চিত্রমাধ্যম। তার মান নয়, মাঝে মাঝে দুর্বল ভাষাপ্রয়োগ আমাকে হতাশ করে ঠিকই। কিন্তু তখনও আমি সেই কবিকে আঘাত করি না… সে তার মতো থাকুক, ভাবুক… এভাবেই হয়তো কোনোদিন তার পরিণতি আসবে।

এভাবেই কবিতার নানা বিচিত্র প্রকাশ, তার ভাব ভাষা ভঙ্গি… আমাকে আচ্ছন্ন রাখে, অনেকটা সংগীতের মতোই। কবিতা পড়তে বড়ো ভালোবাসি, প্রিয় কবির সংখ্যাও কম নয়।

রণজিৎ: শরীরের ভাষা, আকার ইঙ্গিত নিয়ে আপনি অনেক কাজ করেছেন। চিত্রকলার সঙ্গে এই বডি ল্যাঙ্গুয়েজের সম্পর্ক কী? সাধারণ দর্শকদের জন্য যদি একটু সহজভাবে বলেন।

হিরণ: শরীরের ভাষা। মহড়াকক্ষে যখন আমি অভিনেতাদের দেখি… খোলা মাঠে নৃত্যরত কাউকে দেখি কিংবা চলচ্চিত্রে… নৃত্যরত… এ-সবই কিন্তু শরীরী ভাষা। শরীর তার দ্বিভঙ্গে ত্রিভঙ্গে চতুর্ভঙ্গে নানা বিভঙ্গে নানা বার্তা দিয়ে যায়। সেগুলি নৃত্যের প্রয়োজনে বা ছন্দের প্রয়োজনে স্বাভাবিকভাবে আসে ও প্রয়োগ হয়। যখন আমি তাকে আমার চিত্রে, রেখা বা রঙে রূপ দিই অর্থাৎ, প্রয়োগ করি তখন আমার শরীরও নৃত্যরত থাকে… দ্রুত তার চলন। খুবই দ্রুততার সঙ্গে মুহূর্তে তা রচিত হয়। একই সাথে তার ভাষা ভঙ্গি তাল ছন্দ সবই রূপান্তরিত হয়ে যায়। দর্শক যখন ছবিগুলি দেখে, তখন সেও অনুভব করতে পারে নৃত্য-ছন্দের, অভিনয়-ছন্দের, ভাষা-ছন্দের। শরীরী ভাষা একেই বলে, অনুবাদ-ক্রিয়া কতটা গভীর, কতটা মনোযোগী, কতটা সৎ ও নিবিষ্ট তার ওপর নির্ভর করে দর্শকের এই দেখা কতদূর পৌঁছোতে পারে। দর্শক সেই মুহূর্তে পৌঁছে যায়। সে দেখতে পায় ঘটনাটি তার চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে, সে তখন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে।

রণজিৎ: কিছুদিন আগে একটি সংবাদপত্রের লেখায় আপনি ‘কাজের ছন্দ’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। এই ছন্দ আসলে কী? চিত্রকলার সঙ্গে তা কীভাবে যুক্ত?

হিরণ: কাজের ছন্দ— এই কাজের ছন্দ… এটা আমার একটি প্রিয় শব্দবন্ধ। কাজের ছন্দ আসলে দীর্ঘ অভ্যাসে স্বাভাবিক ছন্দ নির্মাণ করে। কোনো আড়ষ্টতা ছাড়াই। তুলি যেন মুহূর্তে ছিটকে বেরোয়, যেভাবে তির ছিটকে যায়। ধনুক থেকে। মন— শরীর— রচনা তিনটে যখন এক সূত্রে বাঁধা পড়ে, তখন এক স্বাভাবিক তাল তৈরি হয়। তাল ও লয়। মনের মধ্যে আঁকা ও না-আঁকার মধ্যে ঢুকে পড়ে। মানে যখন আমি আঁকছি বা যখন আমি আঁকছি না। শব্দ ও নীরবতা। আঁকা অংশ ও শূন্য অংশ।… এ-সবই তাল লয় নির্ভর। দু-টি রেখা নির্দেশ দেয় তাদের মধ্যবর্তী শূন্য অংশ, কতটা শূন্যতাকে ধারণ করবে। এটা বলতে পারো একটা দৃশ্য কথোপকথন। শিল্পের সাথে শিল্পীর সংলাপ। আঁকতে আঁকতে কথা চালাচালি, ভাবের আদানপ্রদান হচ্ছে। কান খাড়া করে দৃশ্যের নির্দেশ শুনতে হচ্ছে। এমনকী তুলিতে তরল রং নেওয়ার সময় হঠাৎ একখাবলা রং পড়ে গেল কাগজে বা ক্যানভাসে। ছবি কথা বলে উঠল,… সেটাও শুনতে হবে,… তাকে অবজ্ঞা করলে কিন্তু কাজের ছন্দ চলে যাবে। কাজের ছন্দ আবার অন্য অর্থেও ছন্দে থাকা, সর্বক্ষণের ছন্দে থাকা। চুপ করে বসে আছি। অন্ধকারে। তখনও ছন্দে আছি। একা। হাঁটছি… তখনও ছন্দের ভেতরেই আছি। আমি… চুম্বনরত… তাও ছন্দে। এই ছন্দকে ধারণ করতে হয়। কথা বলে যাচ্ছি দীর্ঘক্ষণ কিন্তু আমি ছন্দে আছি। এ শরীরের বাইরের অংশ নয়, এ ভিতরের অংশ, এ নিজেই নিজের ছন্দে থাকে, আর কাজের ছন্দেই থাকে।

রণজিৎ: আপনি একটি গদ্যে লিখেছেন যে, দর্শককেও শিল্পী হতে হবে। দর্শকই শিল্পী।… কথাটা শুনতে সহজ মনে হলেও, তত সহজ নয়, ব্যাখ্যার দাবি রাখে। একজন দর্শক সবসময় তো শিল্পী হতে পারে না, তবে কি এটা একটা প্রক্রিয়া?… হয়ে ওঠার? নাকি এক-এক বিশেষ মুহূর্ত তাকে শিল্পী করে তোলে?

হিরণ: দর্শক— শিল্পী? এই কথাটার বহু মাত্রা আছে। যেমন একজন অভিনেতার মধ্যে দর্শক থাকে… তেমন, দৃশ্য-শিল্পের সামনে দাঁড়ালে একজন সংবেদনশীল দর্শক শিল্পী বনে যান। সাধারণ দর্শকেরা, যে-কোনো শিল্প-ক্রিয়া, চিত্র যদি তা গতানুগতিক না হয়, তার পরিচিত কোনো শিল্পী না হন, কিংবা যদি তা খুব প্রচারিত, খ্যাতিমান শিল্পী না হন তবে সাধারণত অনীহা প্রকাশ করেন— এটা স্বাভাবিক। যে-চিত্রকর্মের সঙ্গে কাহিনি যুক্ত হয়ে আছে, তার চাহিদা আছে… অর্থাৎ, মিথ বা গাথা সেই কর্মটিকে মহার্ঘ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে এবং স্বভাবতই অনুধাবনযোগ্য… সেই চিত্রকর্ম প্রসঙ্গে এ-কথা খাটে না, কেন-না বিখ্যাত সেই চিত্রকর্ম বিষয়ে দর্শকের আবেগ বা আগ্রহ অনেকটাই আরোপিত। আবার অপরিচিত কোনো চিত্রকর্মের পাশ দিয়ে অনেক শিক্ষিত দর্শকও অন্যমনস্ক হয়ে হেঁটে যায়, কোনো আগ্রহ দেখায় না।… এ আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। দুই গ্যালারির প্রখ্যাত মালকিনদেরও এমন আচরণ করতে দেখেছি। কিন্তু দর্শক কীভাবে শিল্পী হবেন? শিল্প রচিত হয় দেখার জন্য। এই দেখা বা দর্শন এবং তার আকর্ষণ বহুক্ষেত্রে দর্শককে সম্মোহিত করে। দর্শক যখন কোনো চিত্রকর্মের সামনে দাঁড়ান— এ নিয়ে কবি উৎপলকুমার বসু খুব সুন্দর লিখেছিলেন,… আপনারা পরস্পরের পূর্ব-পরিচিত কিন্তু বহুদিন দেখা হয়নি।

সাধারণভাবে চিত্রকর্ম কোনো শারীরিক কসরত নয়, এ-মনের ছায়ায় ধরা জগৎ, দর্শককে নানাভাবে আহ্বান করে, বহু সময় দর্শক সেই আহ্বান শুনতেও পান। এটা একটা প্রক্রিয়া। খুব সামান্য হলেও যেটা প্রয়োজন, তাহলে শিল্পের প্রতি সহানুভূতি। এই সহানুভূতিই শিল্পকর্মটিকে সজাগ করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। শিল্প সজাগ হলে দর্শকও সজাগ হয়ে ওঠেন। প্রাণস্পন্দন দেখতে পেতে পারেন আপাত মৃত স্থির চিত্রকর্মটিতে।

চিত্রকর্ম চিরকালই নীরব— এই নীরবতা ভাঙে দর্শকই, তারা পরস্পর কথা বলাবলি করে, একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়… একটা বিন্দুতে পৌঁছাতে সাহায্য করে। যে-কোনো চিত্রকর্মই প্রাণশক্তির আধার, অফুরন্ত প্রাণশক্তি তার। দর্শক সেই প্রাণশক্তি, সেই আধারকে পুনর্নির্মাণ করেন যে-কোনো চিত্রকর্মকে।

এই পুনর্নির্মাণই দর্শককে শিল্পী বানিয়ে তোলে। বিমূর্ত চিত্রের বাড়তি সুবিধা— তা দর্শকভাবনার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। দর্শক তাঁর ভাবনায় তা-কে চিহ্নিত করে— রূপ দেয়, ব্যাখ্যা দেয় এবং উপভোগ্য করে তোলে— এখানেই তার সৌন্দর্য। শিল্পী, তার শিল্পের যে-সীমারেখা চিহ্নিত করে রেখেছেন, দর্শক সেই নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করে যান। এটা ঘটে, তার কারণ— শিল্পীর বহুক্ষেত্রে কিছু সংস্কার থাকে, অবচেতনের সংস্কার। দর্শক সাধারণভাবে এই সংস্কার থেকে মুক্ত, যেহেতু তিনি ওই গঠনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নন, তাই তাঁর মনে কোনো ভার থাকে না।

এছাড়া শিল্পী, তাঁর শিল্পকর্মের প্রতি আবেগতাড়িত মায়ায় আবদ্ধ থাকে, দর্শকের সেই আবদ্ধতা নেই, সেই মায়া নেই। দর্শক ভারহীন নির্লিপ্ত মনে শিল্পকর্মকে আবিষ্কার করতে পারেন। তাই শিল্পী-শিল্পী আর দর্শক-শিল্পীতে তফাত ঘটে যায়। তবু্ও কোথাও একটা সংযোগও থাকে। কলাসমালোচকেরা এ-ব্যাপারে বরাবরই একটু পিছিয়ে থাকে… সে তার প্রতিষ্ঠিত অবস্থান নিয়ে সতত ব্যস্ত বলে… চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য বা অন্যান্য শিল্পকর্ম তার কাছে বহু ক্ষেত্রে অধরাই থেকে যায়। সে তাকে ব্যাখ্যা করতে চায়, টীকা যুক্ত করে, নানা তারিকায় তাকে বিদ্ধ করার চেষ্টা করে— এটাই তার প্রাথমিক কর্তব্য বলে সে মনে করে।… এবং ব্যর্থ হয়।

শিল্পী-দর্শকরা সাধারণত অন্য শিল্পীর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকেন না ও এড়িয়ে যেতে ভালোবাসেন… এইসব গুণবিহীন সাধারণ দর্শকই একমাত্র দর্শক-শিল্পী হওয়ার বিরল সম্মান পেয়ে যান, উপভোগ করেন, প্রকৃত মিলন ঘটে তাঁদের মধ্যে। দর্শকই তখন প্রকৃত শিল্পী আখ্যা পেতে পারেন।

রণজিৎ: আমরা যে-কোনো কাজ করার পর বিশ্রাম নিই। পড়তে পড়তে বিশ্রাম নিই, গান গেয়ে যাওয়ার মধ্যেও ক্লান্তি আছে, টানা তবলা বাজানোর সময় নিজেও দেখেছি… দু-তিন ঘণ্টা পরই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। অথচ আপনি বলেন, টানা দীর্ঘক্ষণ ছবি এঁকে যেতে পারেন, এমনকী রাতজুড়ে, অসুস্থ হয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা এঁকেছেন, এমনও ঘটেছে… কীভাবে ঘটে এটা? ক্লান্তিকর মনে হয় না? নাকি উলটোটাই যে, এই জগতের যা কিছু ক্লান্তি তা-র থেকে রিলিফ খুঁজছেন সৃষ্টির মধ্যে? আঁকা কি স্বস্তি এনে দিচ্ছে আপনাকে?

হিরণ: ক্লান্তি ও বিশ্রাম— ক্লান্তি মনের, ক্লান্তি শরীরের। ক্লান্তি একটা ধারণা, ধারণা— কেন-না আমার মনে হল শরীর ও মন দুই-ই বিশ্রাম চাইছে, শ্রম থেকে বিশ্রাম। আমার কাছে শ্রমই বিশ্রাম। শ্রম অর্থাৎ, এখানে শিল্পকর্মের শ্রম… আমাকে আরও শক্তি জোগাচ্ছে, সেই শক্তিই চালিকাশক্তি, তাই বিশ্রামের প্রয়োজন পড়ছে না। পিকাসো একটি অদ্ভুত কথা বলতেন… চোদ্দো-পনেরো ঘণ্টা টানা ছবি আঁকতেন যখন, প্রশ্ন করলে বলতেন, শরীরটাকে স্টুডিয়োর বাইরে রেখে এসেছি,… যেভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলিম তার পাদুকা মসজিদের বাইরে রেখে আসে! আমি ওভাবে বলার সাহস রাখি না বা বলা যায় আমার তেমন কোনো স্টুডিয়ো নেই… নেই কোনো তোরণ, তাই শরীরকে বাইরে রাখার ব্যবস্থাই নেই। আমার কোনো ঘর নেই, আমার কোনো ‘বাইরে’ নেই।

এক রাত্রে ভীষণ অসুস্থ হলাম। বহু দূর দেশে আছি। নানাভাবে বিব্রত। একমাত্র সম্বল, রং তুলি… যা আমাকে নিরাময় করে তুলবে।… বিচিত্র আমার চলন।

কালো কাঠকয়লা দিয়ে সাদা কাগজে আঁচড় টানা শুরু হল। রাতভর। অসম্ভব অসুস্থ অবস্থায়… তবু যেন নিজেকে নিজের সামনে মেলে ধরতে পারছি। এইভাবে ভোরের আগে আগে, শুয়ে পড়লাম আর নতুন একটা কাজ স্বপ্নে শুরু করলাম, সাদা ক্যানভাসে, সাদা রং নিয়ে চিত্ররচনা। সাদায় সাদায় মনের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রশান্তি এল, এমনই প্রশান্তি এল যে… ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর ঘুম। সকালের আলোয় ঘুম ভাঙল।

একটা বিশেষ কারণে শরীরের বিশেষ কিছু অংশে অসহ্য যন্ত্রণা হয়, চলাফেরা ভীষণ কষ্টকর হয়ে ওঠে, কিন্তু সেই অসুস্থতা আমাকে চিত্রের জগতে নিয়ে যায়। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের খোলা ছাদের চিত্র-চত্বরে পৌঁছালাম। বিশাল একটা ক্যানভাস প্রায় প্রস্তুত করা ছিল, তাকে টেনে নামালাম, একাই। শুরু হল দ্বৈরথ, শরীরে তীব্র যন্ত্রণা আর এদিকে রঙে রেখায় জাদুখেলা… কখন যে যন্ত্রণা ভুলে গেলাম!

এত ভালো লাগতে লাগল ওই ব্যথা… ওই যন্ত্রণা! শরীর ও মনকে যেন আদর দিচ্ছে। এর কোনো ব্যাখ্যা হয় না। কোনো যুক্তি কাজ করে না— এর পক্ষে বিপক্ষে। মানুষ যে কতভাবে আর কখন কীভাবে আনন্দ পায়— তা আজও তালিকাভুক্ত করা যায়নি।

রণজিৎ: একজন কবি হিসেবে আমি এমন কল্পনা করি— আসলে আমরা তো জগতের প্রায় কিছুই দেখতে পাই না; না, কথাটা মায়াবাদীদের মতো করে ভাবছি না যে… সব মায়া ইলিউশান। বরং আমার প্রশ্নটি বিজ্ঞাননির্ভর… ব্রহ্মাণ্ডের অধিকাংশই তো ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটার দিয়ে ভরা, তাহলে যা কিছু দেখছি, তা যৎসামান্যই! তবে দৃশ্যরূপ… সবই তো অসম্পূর্ণ! ফর্ম দাঁড়াবে কীভাবে? রূপ কি অসম্পূর্ণ? শিল্পীকে তাই অরূপের খোঁজে যেতে হয়? শিল্পে এই চোখে দেখা অবয়বের গুরুত্ব আদৌ কতখানি?

হিরণ: ডার্ক এনার্জি। না-দেখাকে দেখা। এ এক বিচিত্র প্রয়াস। কী দেখি ও কেন দেখি এ-প্রশ্নের সহজে উত্তর হয় না। সারাজীবন খুঁজে যাওয়া ও বিস্মিত হওয়া শুধু। যে-আকারগুলোকে আমি দেখি বা আঁকি, তা আমার সম্পূর্ণ পূর্ব-অভিজ্ঞতায় থাকে না, কখনো কোনো আভাস হয়তো থাকে। কিন্তু তারা আমার কাছে সেই মুহূর্তে নতুন।… আবার এই আকারগুলো কেন, কী করে? প্রায় উদ্দেশ্যহীন বিচিত্র কিছু আকার… কখনো নারীদেহ, কখনো সর্পিল… কখনো আবার ঘন ঝোপের মতো, কখনো শস্যখেত, কখনো-বা নদীর মতো বয়ে যাওয়া… জীবন, পরিপার্শ্ব… ক্রমাগত মূর্ত হয়েই চলেছে।

অন্ধকার আমার একটা প্রিয় আস্তানা। আশ্রয়। কালো অন্ধকার আমাকে পরিপূর্ণ করে রাখে। একটা ভলিউম— একতাল অন্ধকার— আমার রেখাচর্চার প্রধান উপকরণ।

তেমনভাবে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কালো কাঠকয়লা হাতে ধরা আছে শক্ত করে… আঁচড় কেটে চলেছি সাদা কাগজে। দেখতে বা বুঝতে পারছি। কাগজের সীমানা শুধুমাত্র, সেই সীমানাকে মান্যতা দিয়েই দ্রুত আঁচড়ে কাহিনি বোনা চলছে।

অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছে, কারণ, আমার সৃষ্ট রেখাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, শুধু অনুভব করতে পারছি। রেখার সাথে সাথে মনের মধ্যে এক রেখার জাল বিছানো চলছে। দেখতে পাচ্ছি সব স্পষ্ট। সে-দেখা কালো দেখা… সে-দেখা অন্ধকার-ছোঁয়া দেখা… সে-দেখা রচনা থেকে দূরে চলে যাওয়ার দেখা… সে-দেখায় কোনো মোহ নেই, কারণ, রচনাই নেই শুধু ঘিরে আছে কালো অন্ধকার, কালো অন্ধকারে কালো রেখা কালো অস্তিত্ব নিয়ে অদ্ভুত আনন্দ দিচ্ছে।

এই কালো, এই অন্ধকার, ডার্ক-ম্যাটার কিনা জানি না, ডার্ক-এনার্জি কিনা জানি না, ডার্ক এটুকু জানি। আকার যখন নিজের গতিতে… শুধু অনুভবে… এঁকে চলা হয়, শুধু স্পর্শে সব কিছু বোঝা যায়… তখন তার প্রভাব ভীষণ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে, মনের, মাথার মধ্যে গেঁথে বসে আকার, আকারের অনুপাত আন্তর্সম্পর্ক তখন গৌণ হয়ে যায়… আবার তারা বায়বীয় নয়, ভাসমান নয়, তারা শক্ত মাটিতে প্রথিত।

আকারগুলি মূর্ত অথবা বিমূর্ত— ঠিকঠাক বললে না-মূর্ত! তবু্ও সে অনুপাত হারায় না, ছন্দ হারায় না… তাল লয় কিছুই হারায় না। আসলে সে ধ্বনি হারায় না, ধ্বনি তাকে ছন্দোবদ্ধ করে রাখে কিন্তু কিছুই শোনা যায় না, শুধু অনুভবে ধরা যায়। তাই ব্রহ্মাণ্ডের বেশিরভাগ না-দেখা না-দেখাই থেকে যায় এবং না-দেখানোই ঘটে চলে!

রণজিৎ: আমি কবিতাতেও ব্যর্থভাবে এমন আইডিয়া আনার চেষ্টা করেছি— যে-জগৎ আসলে কতকগুলি বিন্দু ত্রিভুজ বৃত্ত বহুভুজ ইত্যাদি জ্যামিতিক ধারণার সমন্বয় মাত্র! অসংখ্য রেখা ও তাদের মধ্যেকার সংঘর্ষ কাটাকুটিই হল এই জগৎ… এছাড়া আর কী? আমার এই ধারণা আরও স্পষ্ট রূপ পেতে সাহায্য করেছে আপনার সৃষ্ট আরবানিয়া। এটা কতজন লক্ষ করেছেন জানি না, আরবানিয়া একটা এক্সেলেন্ট আর্ট-ওয়ার্ক, একটা জাদু!

হিরণ: জগৎ— একটা জ্যামিতিক অস্তিত্ব। এটা শিল্পীরা, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের শিল্পীরা উনিশ শতক থেকে বলে আসছেন, তাঁদের কাজে কর্মে প্রয়োগও করেছেন।

এটা একটা সামগ্রিক ধারণা। জ্যামিতি এক অর্থে মানুষেরই আবিষ্কার, যদিও তার উৎস প্রকৃতি, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে জ্যামিতি কিন্তু সেই জ্যামিতি আমাদের মনের ও শরীরের উপর কতটা আশ্রয় করে আছে!…

শরীরের বাইরে গিয়ে শরীর দেখতে গেলে— যেহেতু আমরাই মূর্তিমান জ্যামিতি তাই আমাদের সকল কাজই তারই প্রকট রূপ। একে আমরা আলাদা করব কীভাবে?

জ্যামিতি নানাভাবে মিশে থাকে আমাদের চারপাশে। টুকরো টুকরো করে তাকে উপলব্ধি করা যায়। বিশাল আকারে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় বা… বৃত্ত, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ… সব সীমানা নির্দেশ করে আমাদের নিশ্চিন্ত করেছে। সেই আকার যখন চিত্র বা ভাস্কর্যে সরাসরি উপস্থিত হয়, তখন সে ভিতরটাকে বাইরে থেকে দেখতে থাকে। বাইরের যেমন বাইরে আছে, তেমনি ভিতরেরও ভিতর আছে। হেঁয়ালির মতো শুনতে লাগলেও এর মাধুর্য আলাদা। এ সংঘর্ষে পূর্ণ, এ শান্ত, এ ক্রমাগত প্রশ্ন করে, সংশয় প্রকাশ করে… কবিতা বা ছবিতে। কবিতা, অক্ষর ও ধ্বনিনির্ভর, সাধারণত আকারনির্ভর নয়। কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে আকার নির্মিত হয়— বোধের আকার, উপলব্ধির আকার। আকার, আকার পায়। কবিরা হয়তো সাময়িক হলেও সেই আকারে আশ্রয় নেয়। শিল্পীদের অস্তিত্বই আকারসর্বস্ব। সেই আকারের কোনো অর্থ থাক বা না-থাক, আকার থেকে তার মনন রূপ পায়। আকার থেকে জন্ম আকারেই মিলিয়ে যায়। একসময় তার দেহ আকারবিহীন হয়ে ভস্ম হয়ে গেল— রয়ে গেল উপলব্ধির মন। সেই মনের কি কোনো জ্যামিতি নেই? সেও কি তখন জ্যামিতি-বহির্ভূত একটি নিরাকার?… সে তখন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে আশ্রয় নিল। এতকাল সে ছিল একজন ব্যক্তি, এবার থেকে সে বহু হয়ে গেল। বহু মানুষ, বহু মন, বহু অস্তিত্ব… তাকে আকার দিতে লাগল। সে কার কাছে কেমন ছিল! সে অলক্ষ্যে হয়তো এটা উপভোগও করছে! তার এই জীবন, আর ঐ জীবন, যার সেতুও জ্যামিতি, একটা মনের বিস্তৃতি। সে নেই কিন্তু আছে।

আরবানিয়া, মানে শহর, জ্যামিতিক শহর ঘিরে আমার একটি প্রদর্শনী হয়, দু-হাজার বারো সালে, কলকাতায়… নানা বিতর্ক ওঠে, অনেকেই একে গ্রহণ করেনি… এটা তাদের ব্যক্তিগত এক্তিয়ার। আমি খোলা মাঠ, প্রকৃতি… গাছ, পুকুর, ধানখেতের সন্তান মনন আমার খেতে কর্ষণ করে, কর্ষণ করেই যায় ফসলের আশায়। কিন্তু তার পরিণতি হল জ্যামিতিক শহরে— এটা তার বাধ্যতা। বেঁচে থাকার ও বাঁচিয়ে রাখার বাধ্যতা। এই ঘিরে থাকা ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, আয়তক্ষেত্র, বৃত্ত… সবাই অট্টহাস্য করতে লাগল। হাত ধরে ধরে নেচে যেতে লাগল আমাকে ঘিরে। সে কি জীবনের উৎসব, না মৃত্যুর উন্মাদনা? আকারগুলো নাচছে,… আকারগুলো কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট।… আকার অন্ধকারে, আকার আলোতে, আকার কুয়াশায় ঢাকা। একটা পোড়া গন্ধ। ধোঁয়া। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ছে না।… সেও আকার নিচ্ছে, মনের ঘিরে থাকা পর্দায়। ছায়া নড়ছে তাতে, ছায়াবাজি! আমিই তখন আরবানিয়া— আরবানিয়া একটা ধারণা মাত্র, কোনো রচনা নয়।

খাড়াই লেখাগুলো, অরণ্যের মতো ছায়া ও অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উদ্ধত, আমি নত। আরবানিয়া আমাকে ভক্ষণ করছে, আবার উগরে দিচ্ছে। আমি তার লালা, পিত্ত, পূতিগন্ধে ডুবে আছি। আমি ভেসে উঠতে চাইছি, নিশ্বাস নিতে চাইছি। একটা রমণীকণ্ঠ আমাকে দূর থেকে ডাকছে,… হয়তো নাম ধরে, তার সুরেলা কণ্ঠ বাঁশির সুরের মতো আমাকে শান্ত করছে, আশ্বস্ত করছে। আমি আবার স্বপ্নে মজে যাচ্ছি। আমি আরবানিয়া থেকে মুক্তি পেতে চাইছি… কিন্তু জ্যামিতি আমার পিছু ছাড়ছে না।

Categories
2021-May-Translation অনুবাদ ধারাবাহিক

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

প্রথম অধ্যায়

ফা-হিয়েন পূর্বে যখন চঙান প্রদেশে ছিলেন, বৌদ্ধ গ্রন্থের তিনটি ভাগের মধ্যে শৃঙ্খলা বিষয়টির অসম্পূর্ণ অবস্থা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। এবং পরবর্তীতে হাঙ শির দ্বিতীয় বছর অর্থাৎ কিনা ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হুই সিঙ, টাও চেঙ, হুই জিঙ ও আরও কয়েকজন মিলে ভারতবর্ষ ভ্রমণ স্থির করলেন। উদ্দেশ্য, বাকি বৌদ্ধ শৃঙ্খলাগুলি সংগ্রহের চেষ্টা করা। চঙান থেকে যাত্রা শুরু করে পর্বত পেরিয়ে তাঁরা এসে পৌঁছলেন সিয়েন কুই রাজার রাজ্যে। ইতিমধ্যে বর্ষা আগত, তাই বর্ষাকাল তাঁরা এখানেই কাটালেন। বর্ষা শেষে আবার শুরু হল পথচলা। এবার এসে থামলেন নু তান রাজার রাজ্যে। সেখান থেকে ইয়াং লু পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে সৈন্য কবলিত স্যাঙ ইয়ে শহরে এসে উঠলেন। স্যাঙ ইয়েতে তখন চলছে রাজদ্রোহ, এবং পথ দুর্লঙ্ঘ্য। ফলত তার বৌদ্ধ অতিথিদের বিষয়ে রাজা বেশ উদবিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষক স্বরূপ তখন তিনি নিজস্ব ব্যায়ে তাঁদের সেখানেই রেখে দিলেন। সেখানে দৈবক্রমে তাদের সাক্ষাৎ হল পথ চলতে চলতে পূর্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া চি ইয়েন, হুই চেন, সেং শাও, পাও উন, সেং চিঙ এবং অন্যান্যদের সঙ্গে। এবারের বর্ষাকাল অতিবাহিত হল এখানেই। তারপর বর্ষা অন্তে আবার চলতে থাকা। এবার এসে পৌঁছানো গেল তুন হুয়াং। এখানে রয়েছে সংরক্ষিত শিবির; পূর্ব থেকে পশ্চিমে আশি ফুটের মতো, আর উত্তর থেকে দক্ষিণে চল্লিশ ফুটের কাছাকাছি এই শিবির। মাসাধিক সময় এখানে অতিবাহিত করার পর ফা-হিয়েন-সহ পাঁচজন পরিব্রাজক এবার যাত্রা আরম্ভ করে সামনে অগ্রসর হতে লাগলেন। বাকিরা রইলেন সেখানেই। এভাবে পাও উন আর তার সাথীদের সঙ্গে আর একবার বিচ্ছেদ হল ফা-হিয়েনের।

তুন হুয়াং শিবিরের অধ্যক্ষ, গোবি মরুভূমি অতিক্রমের সমস্ত আবশ্যক সামগ্রী তাঁদেরকে দিলেন। মরুভূমিতে অশুভ আত্মার বাস আর হাওয়ায় উত্তাপ। এ-হাওয়ার সম্মুখীন হওয়ার অর্থ ভয়ংকর মৃত্যু। আকাশে নেই কোনো পাখির কলরব, মাটিতে নেই কোনো পশুপ্রাণী। একটি পথের চিহ্ন খুঁজে চেয়ে থাকো অনিমেষ। পথ মেলে না। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল মৃত মানুষের ক্ষয়াটে হাড়। এই যেন গন্তব্যের দিশা, এই যেন একমাত্র পথের সংকেত। সতেরো দিন প্রাণপণে হেঁটে প্রায় পনেরোশো লি পথ অতিক্রম করে অবশেষে এসে পড়া গেল মাখাই মরুভূমি।

দ্বিতীয় অধ্যায়

এ-ভূমি উষর, এবড়ো-খেবড়ো। চীনাদের মতো এখানকার লোকেদের পোশাকও মোটা, অমসৃণ; পার্থক্য একটাই এরা পশম আর টেকসই মোটা কাপড় ব্যবহার করে। এই রাজ্যের রাজা বৌদ্ধে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি। এখানে প্রায় চার হাজার সন্ন্যাসী আছেন এবং সবাই হীনযান মতাবলম্বী।

রাজ্যের সাধারণ মানুষ এবং সাধু সন্তদের মধ্যে ভারতবর্ষের ধর্ম সর্বব্যাপী বর্তমান। কিন্তু তাদের অভ্যাসের ক্ষেত্রে রুক্ষতা ও পরিমার্জনার একটা প্রভেদ দেখা যায়। এ-অঞ্চল থেকে পশ্চিমে যত এগোনো যায়, যে-সব দেশ অতিক্রম করবে তা সবই প্রায় একরকম। প্রভেদ একটাই যে, টারটার উপভাষায় তারা কথা বলে তা সর্বত্র সমান নয়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীগণ সকলেই ভারতীয় পুথি অধ্যয়ন করেন, এবং ভারতীয় কথ্যভাষার চর্চা করেন। মাসাধিক কাল এখানে অতিবাহিত করার পর ফা-হিয়েন আর তাঁর সঙ্গীরা উত্তর-পশ্চিম দিক ধরে চলা শুরু করলেন। পনেরো দিন একটানা ভ্রমণের পর পোঁছলেন উ-ই নামের একটি দেশে। এই উ-ই প্রদেশের চার হাজারের অধিক সন্ন্যাসীগণ, সকলেই হীনযান মতাবলম্বী। ধর্মাচরণ যথাযথ পালন করা হত। চীন দেশ থেকে শ্রমণেরা যখন এখানে এসে পড়লেন, দেখা গেল এ-দেশীয় সন্নাসীদের আচার অনুষ্ঠানে তাঁরা খানিকটা অনভ্যস্ত। ফু সিং তাং ও কুঙ, সানের সুরক্ষা পেয়ে ফা-হিয়েন দুই মাসেরও কিছু বেশি সময় এখানে কাটিয়ে যান। এর পর তিনি পাও উন আর বাকি সঙ্গীদের কাছে ফিরে আসেন। এর পর সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তে আসা গেল যে, এই প্রদেশের মানুষেরা নম্রতা, প্রতিবেশীর প্রতি কৃত্য এ-সবের কোনো চর্চা রাখে না। আগন্তুকের প্রতি এদের আচরণে বড়োই শীতলতা। পরবর্তীতে চি ইয়েন, হুই চিয়েন, এবং হুই ওয়েই ভ্রমণের উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কাও চাং প্রদেশে ফিরে যান। তবে ফা-হিয়েন ও তাঁর দলের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেহেতু ফু আর কুঙ সান সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলেন তাই তাঁরা অবিলম্বে দক্ষিণ-পূর্ব দিক ধরে যাত্রা আরম্ভ করলেন। জনশূন্য এ-প্রান্তর। স্থল বলো, আর জল, পথ কেবল দুর্গম। এ-পথের নির্মমতা তুলনা রহিত। এই রাস্তা পেরোতে যে-অসম্ভব কষ্ট তাঁরা ভোগ করেছিলেন তা উপমার অতীত। পথের নিষ্ঠুরতায় কেটে গেল এক মাস। তারও দিন পাঁচেক পর তাঁরা গিয়ে পৌঁছলেন উ টিয়েন।

তৃতীয় অধ্যায়

সমৃদ্ধশালী, সুখী দেশ। মানুষ সচ্ছল, শ্রীমন্ত। ধর্মবিশ্বাস তাঁদের কাছে স্বীকৃত, সকলেই বৌদ্ধ ধর্মে ধধর্মান্তরিত। ধর্মীয় সংগীতেই পরিতৃপ্তি খুঁজে পেত তারা। কয়েক হাজার সন্ন্যাসী, বেশিরভাগই মহাযান সম্প্রদায়ের। সকলের খাদ্যের যোগান আসত একটি সর্বজনীন তহবিল থেকে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসত করত মানুষ আর প্রত্যেক বাড়ির দরজার সামনে ছোটো প্যাগোডা তৈরি করত যার সবচেয়ে ছোটোটির উচ্চতা কুড়ি ফুট। পর্যটক শ্রমণদের জন্য ঘর তৈরি করে রাখত। যে-সব শ্রমণেরা তাদের অতিথি হয়ে আসত তাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব এই ঘরে রাখা থাকত। যারাই এসে পৌঁছত, সকলেই পেত আতিথ্য। দেশের রাজা, ফা-হিয়েন আর তাঁর সঙ্গীদের স্বাচ্ছন্দবাস স্থির হল চু মা টি নামক মঠে। মঠটি মহাযান সম্প্রদায়ের। বৌদ্ধ ঘণ্টার শব্দে তিন হাজার সন্ন্যাসী একত্রিত হলেন আহারের উদ্দেশ্যে। ভোজনকক্ষে প্রবেশ করলেন। তাঁদের আচরণ গভীর ও শিষ্টাচারপূর্ণ। সুবিন্যস্ত ক্রমান্বয়ে তাঁরা আসন গ্রহণ করলেন। এ-সবই হল নিঃশব্দে। আহারপাত্রে ঝংকার উঠল না কোনো, খাদ্যের জন্য সশব্দে ডাকলেন না কোনো পরিচারককে, কেবলমাত্র ইঙ্গিত করলেন হাত দিয়ে। হুই চিং, তাও চেং আর হুই তা কাশগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল, কিন্তু ফা-হিয়েন আর অন্যেরা তিন মাস যাবৎকাল সেখানে রইলেন প্রতিমূর্তির শোভাযাত্রা দেখবার জন্য। ছোটোখাটো মঠগুলি বাদ দিলে এখানে বৃহৎ মঠের সংখ্যা তাও দাঁড়াবে গোটা চোদ্দোয়। পক্ষকাল অন্তর এ-সব মঠের সন্নাসীরা শহরের রাস্তায় জলছড়া দেন, ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করেন। এর পর মূল সড়কপথগুলিকে সাজিয়ে তোলেন। শহরে প্রবেশ দ্বারের উপর দিয়ে বিছিয়ে দেন অলংকৃত, সুদৃশ্য এক মস্ত শামিয়ানা। রাজা তাঁর রানঔফ এবং মহিষীদের নিয়ে এখানে বসত করেন কিছুকাল। চু মা টি মঠের সন্নাসীরা মহাযান সম্প্রদায়ের। আর রাজাও এই মহাযান তত্ত্বে গভীর শ্রদ্ধাবান। শোভাযাত্রার সূচনায় আছেন সন্নাসীগণ। শহর থেকে তিন চার লি দূরত্বে চতুঃচক্র বিশিষ্ট প্রতিকী যান তৈরি করা হত। তিরিশ ফুটের বেশি উচ্চতার এই যানটিকে দেখে মনে হত চলন্ত পটমণ্ডপ। সাতটি মূল্যবান দ্রব্যে খচিত এই সজ্জা, সোনা, রূপা, পান্না, স্ফটিক, চুনী, তৃণমণি, আর অকীক। চূড়ায় শোভা পাচ্ছে আন্দোলিত পতাকা আর কারুচিহ্নিত চন্দ্রাতপ। যানের একেবারে মধ্যভাগে স্থাপিত রয়েছে মূর্তি। সঙ্গী দুই সেবক বোধিসত্ত্ব। মূল বিগ্রহের পরেই রয়েছে বাকি উপদেবতাদের প্রতিমূর্তি। সোনা, রূপায় মণ্ডিত এই মূর্তিগুলি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে শূন্যে। শহরের প্রধান দ্বার থেকে বিগ্রহ যখন একশো কদম দূরে রাজা নামিয়ে রাখলেন রাজমুকুট, পরে নিলেন নতুন পোশাক। এর পর হাতে ফুল ও সুগন্ধি অর্ঘ্য সাজিয়ে খালি পায়ে চললেন প্রতিমা সন্দর্শনে। রাজ সেবকগণ রাজার অনুসারী হল। ফুল ছড়িয়ে, সুগন্ধি জ্বালিয়ে ভূমিতে আনত হলেন রাজা।

বিগ্রহ শহরে প্রবেশের মুখে রানি ও মহিষীগণ প্রবেশ দ্বারের উপর থেকে রংবেরঙের ফুল ছুড়তে থাকলেন দূর পর্যন্ত। যেন মেঘদল হতে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে সে-ফুল। আর এভাবেই রচিত হচ্ছে পূজার অর্ঘ্য। প্রতিটি মঠের বিগ্রহযান ভিন্ন ভিন্ন। আর প্রত্যেকের জন্য ধার্য করা আছে আলাদা দিন। পক্ষকালের হিসেবে প্রথম চন্দ্রোদয়ের দিন থেকে শুরু হয় আর শেষ হয় চৌদ্দোতম দিনে। শোভাযাত্রার সম্পূর্ণ সমাপ্তি শেষে রাজা ও রানি ফিরে গেলেন তাদের রাজপ্রাসাদে। শহর ছাড়িয়ে সাত আট লি গেলেই পড়বে একটি মঠ। নাম তার ওয়াং সিন। আশিটি বৎসর আর তিন রাজার রাজত্ব ব্যায় হয়ে যায় এই মঠ নির্মাণে। দুইশো পঞ্চাশ ফুট উচ্চে খোদাই করে খচিত রয়েছে সোনা রূপা। এই সুউচ্চ নির্মাণের বিশালতাকে পরিপূর্ণ করেছে নানা রত্নের সমাহার। উচ্চ মিনারের পিছনেই আছে চমৎকার সজ্জিত একটি উপাসনা গৃহ।

কড়িবরগা, থাম, দরজা, জানালা সকলই স্বর্ণে মোড়া। আর আছে শ্রমণদের থাকার ঘর। সে-সবের সজ্জা ভাষার অতীত। পর্বতের পুব প্রান্তের ছয়টি রাজ্যের রাজা তাঁদের মূল্যবান মণিরত্নময় অর্ঘ্য দান করেন এই মঠে।

চিত্রঋণ: গুগল

Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ


ধুতি-পাঞ্জাবির শক্ত কাঠামোটা মাথা হেলাল, যেন আনমনেই। সেই ছন্দেই অভ্যাসবশে পায়ের ভারী বুটজুতোজোড়া তাল ঠুকল। ঠকাস! একইসঙ্গে কালো একটা পুলিশ ভ্যান গড়গড় আওয়াজ তুলল সহসা। সেই সঙ্গেই ব্যাং-ব্যাং-ব্যাং— নিঃশব্দে আগুন ঝলসে উঠল রয়্যাল টকির ফাঁকা গেটে। রক্ত মেখে চারটে লাশ গড়িয়ে পড়ল সে-টকির গেটে! ফলে খাস সাহেব কলকাতার সে-এলাকায় হঠাত্‍ই সন্ধ্যের আঁধার জমাট হল। কিছু লোক দৌড়ে গেল। আশেপাশের ছাদের টিভি-অ্যান্টেনায় বসে থাকা কিছু কাক ঝিমুনি ভেঙে উড়াল দিল দিগ্বিদিক—আকাশে পাক মারতেই থাকল। সন্ধ্যের এই আঁধারসাজে তিনটে লোক টকির গেট ছাড়িয়ে পুলিশ ভ্যানের আড়ালে হঠাত্‍ই উবে গেল। পুলিশ ভ্যানের কালো অন্ধকারই হয়তো তাদের মুছে দিল। কেন-না সে-ক্ষণেই ভ্যানটি গড়াতে শুরু করেছিল।

রাস্তার চলন্ত মারুতি গাড়িটা হঠাত্‍ই হর্ন দেওয়ায়, আচমকাই— গাড়ির হেডলাইট আছড়ে পড়ল যেন দোকানে টাঙানো ফোটোটার ওপর। ছবির লোকটাকে ঝলকে আলোকিত করে, পরক্ষণেই আঁধার এঁকে গাড়িটা ছুটে চলে গেল তার গন্তব্যে। ফলে ফাঁকা নিস্তব্ধ দোকানে সন্ধ্যের আঁধার জমাট হল সহসা। উলটো দিকে কাউন্টারে বসা মানুষটা সে-অভিঘাতে সামনে টাঙানো ফোটোটার ওপর চোখ মেলে। পরক্ষণেই গাড়ির ছুটন্ত আলোর মুছে যাওয়া তাকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করে রাস্তায়। ততক্ষণে বাস-রিকশা-মানুষের জটলায় সে-গাড়ি হারিয়েই যায় প্রায়। তবুও চেনা গাড়ি তাই, মানুষটা বাধ্য হয় গাড়িটাকে চিনে নিতে— দীনদার গাড়ি না!

এই চকিতে চিনে নেওয়া দোকানের অন্ধকারকে আরও ঘন করে যেন। মানুষটা চেয়ার ঠেলে উঠে কাউন্টার ছেড়ে উলটো দিকে ধায়। শাড়ির খুঁট দিয়ে ফোটোটার ঝুলকালি মোছে পরম মমতায়। অভিমান চোখে নুন ছড়ায়। জলহীন কান্নায় বোবা উচ্চারণ ফোটে— কাল একটা মালা কিনতে হবে সকালে! ফলে অন্ধকার জমাট হয় আরও। আবার হয়ও না। কেন-না তক্ষুনি আঁধার ঠেলে দু-জন খদ্দের ঢোকে দোকানে। বেঞ্চিতে বসে।

— বউদি দুটো চা হবে!

— একটু বসুন, দিচ্ছি। বিস্কুট, কেক কিছু লাগবে?

— হ্যাঁ, দুটো বিস্কুটও দিন।

রূপা, দোকানের মালকিন, গ্যাস জ্বালায়। সে-ইন্ধনে সহসা চারদিকে আলো ফুটে ওঠে যেন। দোকান লোকে লোকারণ্য। চা, ঘুগনি, ভেজিটেবল-এগ চপ, টোস্ট— টেবিলে টেবিলে হারু দিয়ে উঠতে পারে না, হিমশিম খায়।

চাপা গলায় আওয়াজ ওঠে— দশকা বিশ! দশকা বিশ! ব্ল্যাকার নিমু হিসহিসিয়ে ওঠে। নব্বই পয়সার লাইনে মারামারি প্রায়। ম্যাটনি শো ভেঙে ইভনিং শো শুরু হল বলে! অমিতাভ বচ্চনের মারকাটারি সুপারহিট হিন্দি বই! মায়াময় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রূপার মুখ। সে-মায়ায় পাশের রূপশ্রী হলের জীর্ণ কঙ্কালটা জেগে ওঠে ঘুম ভেঙে। আলো মেখে সত্যিই রূপশ্রী যেন সে!

হ্যাঁ, রূপশ্রী সিনেমা হলের খাতায়-কলমে অন্য মালিক থাকলেও, বকলমায় আসল মালিক তো কৃষ্ণনাথই! দীননাথ তারই ছোটোভাই। রূপা তার দেওরকে দীনদা বলতেই অভ্যস্ত প্রথম থেকেই!


তখন সদ্য কলেজ। আঠারোর ফোটা কলি। হ্যাঁ, কৃষ্ণকলিই! যেহেতু ছিপছিপে রূপা কালোর দিকেই ঢলে ছিল। আদর করে যাকে শ্যামবর্ণ বলে। সত্যিই কি রূপা আদরের ছিল কারও তখন! সামান্য ডিমঅলা বাবার পাঁচ ভাইবোনের দ্বিতীয় সে! বস্তির গরিব ঘরে দিন আনতে পান্তা ফুরানো জীবনে আদর থাকে না, থাকতে নেই! তবুও তো কনেদেখা আলোয় সাজে আকাশ কোনো কোনো দিন। সাজায় চরাচরময় প্রকৃতিকে, যা আলো আঁকে মানুষের মনে। মন যেহেতু মানুষেরই নিজস্ব ধন— মানুষ অজান্তে রেঙে ওঠে সে-আলোয়। রাঙা মন নবীন হয় যদি, তবে লজ্জাও পায়। যেমন সে-বিকেলে কনেদেখা আলোয় রূপার নবীন মনখানি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে নীরবে লাজরাঙাই যেন। মুদিয়ালি হরিসভা পেরিয়ে, মুখার্জিদের বাড়ি ছাড়িয়ে, বাঁশঝোপের নির্জনতা যখন ফতেপুর সেকেন্ড লেনে—কোথায় যেন চ্যাংড়া সিটি বেজে উঠেছিল— টি-ই-উই! একবারই। কেন-না দ্বিতীয়বার বেজে ওঠার মুখে সে-ধ্বনি রক্তাক্ত। মুখ না তুলেই রূপা বুঝেছিল কেউ যেন গলির আধা অন্ধকারে প্রাণপণে হারিয়ে গেল। রূপার তৃতীয় নয়ন, যা নারীরই, অনুভব করেছিল তার ওপর লম্বা ছায়ার মায়া। যে-মায়া বলেছিল— যাও, বাড়ি যাও নিশ্চিন্তে। আর কেউ কোনোদিন কিছু বলবে না তোমায়!

রূপার আড় নয়নে তখন ব্রজের সে-রাখালের ছায়া! হ্যাঁ, কৃষ্ণনাথই! রূপার বুক ছোট্ট চড়ুই পাখির মতো থরথরিয়ে কেঁপে উঠেছিল। সন্ধ্যার সে-ঈশ্বরীয় আলোয় ঢেউ তুলে রূপা হেঁটে গিয়েছিল ধীরে বাড়ির পানে। বাড়ির পানেই কি? নাকি রাখালরাজার বাঁশির টানে ব্রজের পানে— পবিত্র রজ উড়িয়ে। জানেনি রূপা সেদিন। হয়তো জেনেওছিল!

কিন্তু এ যে কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ! ব্রজের কানাই সে তো নয়! রূপা বুঝেছিল তা দিন গড়ালে। এখন রূপা রাস্তা দিয়ে, গলি দিয়ে হাঁটে, দিনের আলোয়, সন্ধ্যের আবছায়ায়— যেন রাজেন্দ্রানি সে। সে অনুভব করে তা। নারীর তৃতীয় নয়নে সে বোঝে যে, কেউ যেন লুকিয়ে অনুসরণ করছে তাকে। প্রথম প্রথম ভয়ই পেত সে— কৃষ্ণ যে মস্তান! গুণ্ডা! যুদ্ধবাজ! রাজা সে! তাকে ভয় পাওয়া যায়, সমীহ করা যায়, ভালোবাসা যায় কি? একদিনের ভাবনা ছিল না তা, বহু দিনের পথ চলতি ভাবনারা জড়ো হয়ে এমন মুরতিই পরিগ্রহ করেছিল তার মনে। কখনো দিনের সমারোহে, কখনো সাঁঝের মায়ায়। আর সে-মায়ার সমারোহে কৃষ্ণের যোদ্ধাসাজ মুছে একদিন রূপার মনে পীত বসন উঁকি দিয়েছিল। সে সোনালিহলুদ এক বাদল সাঁঝে যেন ময়ূরপুচ্ছের ঝলমলানি পাখনা মেলেছিল। ময়ূরের মতো নেচে উঠেছিল রূপার মন! হঠাত্‍ই সাঁঝের সে-আবছা ছায়ায় মিশে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সজলকৃষ্ণ একখণ্ড মেঘই যেন। কৃষ্ণ! ভয়ে-বিস্ময়ে ভিজে গিয়েছিল রূপা। দুরুদুরু চোখে তাকিয়ে ছিল কৃষ্ণপানে। না, না, কৃষ্ণ কেন? রাজা, রাখালরাজাই যেন। কেন-না সে সজলকৃষ্ণে নিবেদন ছিল। একটা প্যাকেট বাড়িয়ে বলেছিল সে-মায়া,

— আজ তোমার জন্মদিন। এটা নাও।

সে-নিবেদনে দূরবর্তী সন্ধ্যের ছায়ারা ঠাইনাড়া হয়েছিল যেন উল্লাসি-বিভঙ্গে। তারা যে কৃষ্ণের যাদব, বৃষ্ণীর দল! রূপা যদিও দেখেনি তা। কেন-না তখন তার চোখে ভালোবাসা-ভয়-বিস্ময় একত্রে সজল ছায়া এঁকেছিল। লোকটা জানল কী করে তার জন্মদিনের কথা? মনের কথা সে-অন্তর্যামী কৃষ্ণ পড়তে পেরেছিল। বলেছিল— কলেজে গিয়ে জেনেছি।

যদিও আসল জন্মদিবস আজ নয় তার। তখনকার নিয়ম মেনেই খাতায়কলমে তা সত্য শুধু। জন্মদিন সে পেরিয়ে এসেছে গত হেমন্তে। এমন কথা মনেই এঁকেছিল রূপা, প্রকাশ্যে কেবল এ-উচ্চারণটুকুই ফুটেছিল তার ঠোঁটে— এ আমি নিতে পারব না।

— কেন? জলদস্বর ঘন হয়েছিল শুধু।

— বাড়িতে কী বলব? তিরতির কেঁপেছিল রূপা।

— বলবে, কৃষ্ণ দিয়েছে।

— তবুও…। রূপার গলায় যেন বালির চরা, যদিও চোখে নদীর ফল্গুমায়া।

— তাহলে আমিই গিয়ে দিয়ে আসব বাড়িতে তোমার। সে-জলদ স্বরে অনুরণন ছিল যেন। রূপা আলগা হাত মেলে দিয়েছিল, যে-হাতে কৃষ্ণের বরাভয় আঁকা হয়েছিল সে-আলোক সাঁঝে।হ্যাঁ, আলোক সাঁঝই তা, কেন-না রূপার মনে প্রথম বর্ষার নূপুর ধ্বনি, কেকা রব। মেঘ চিরে বজ্রের ঝিলিক, যা সমীহ জাগিয়েছিল।

রূপা সে-উপহারটুকু বুকের কোণে লুকিয়ে হাঁটা দিয়েছিল মাথা নীচু করে নিশ্চুপে। শব্দহীন প্রতিটি পদক্ষেপে তবুও আঁকাছিল সে-নীরব ধ্বনি— কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! সে-ধ্বনিতে মহিম ছিল সন্ধ্যাখানি, যাকে ঈশ্বরীয় রূপদানে কোনো বাড়িতে শাঁখও বেজে উঠেছিল সহসা!

তবুও বাড়িতে যোদ্ধা কৃষ্ণকে লোকানো যায়নি। রূপার বাবা গর্জে উঠেছিল যেন— মস্তানের সঙ্গে পিরিত! তুই তো যাবিই, সঙ্গে আমরাও গুষ্ঠিশুদ্ধ সবাই জাহান্নমে যাব!

সে-কীর্তনে দোহারকি করেছিল রূপার মা যেন— হায়! হায়! হা আমার পোড়া কপাল!