Categories
2021-July-dharabahik

সোমা মুখোপাধ্যায়

আরতী পালের ঝুলনের পুতুল

তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। উলটোডাঙার মুচি বাজারের কাছে আরিফ রোডে থাকতাম। বাজারে ঝুলনের সময় মাটির পুতুল বিক্রি হত। এখান থেকেই কিনেছিলাম একটা সুন্দর পুতুল। একটি ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। পেছনে ল্যাম্প পোস্ট। ফুটপাথ আকাশি রং করা আর চৌকো খোপ কাটা। ল্যাম্প পোস্টের গায়ে রুপোলি রং। বাতিটা সাদা। ছেলেটা লাল হাফ প্যান্ট আর হলুদ জামা পরা। তার দিয়ে তৈরি ঘুড়ির সুতোয় কাগজের ঘুড়ি। সবটাই একআঙুল মাপের। অসম্ভব দক্ষ এই কাজ। বহুদিন ছিল ওটা। তারপর হারিয়ে যায়।

২০১৫ সালে মাটির পুতুলের খোঁজে গিয়েছিলাম নাগের বাজার রথের মেলায়। জমজমাট মেলায় ঘুরতে ঘুরতে সদ্য নির্মীয়মান ব্রিজের একধারে নজর চলে যায়। চমকে উঠি। সেই ছোটোবেলার ঝুলনের পুতুল সাজানো আছে। ভিড় ঠেলে উঁকি দিয়ে আর নজর ফেরাতে পারি না। রং-বেরঙের কত পুতুল। সকলেই ঐ একআঙুল সমান। আর পুতুল বিক্রি করছেন এক দম্পতি। ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাসা করে নাম জানলাম মনোরঞ্জন পাল। ফোন নাম্বার চাইতে মহিলাকে ডাকলেন। খদ্দের সামলাতে সামলাতে বললেন মহিলাটি ওঁর নাম আরতী পাল। নিমতা কুমোরটুলিতে থাকেন। নাম্বার দিলেন। আমি সেই ছোটোবেলার ঘুড়ি ওড়ানো পুতুল নিয়ে সেদিন ফিরে এলাম। এরপর গড়ে উঠল আলাপ।

সে-সময় বিশ্ববাংলা স্টোরের জন্য চলছিল বাংলার পুতুল সংগ্রহ। আমিও যুক্ত ছিলাম। সেই কারণে গেলাম কিছু দিনের মধ্যেই আরতী পালের বাড়ি। একেবারে বিরাটি যাওয়ার মূল রাস্তার পাশেই। বাড়িতে ঢোকার মুখে ছোটো ছোটো পুতুল সাজানো। কোনোটায় রং হয়েছে কোনোটায় হয়নি। এটাই ওদের স্টুডিয়ো। এখানেই নানা ঠাকুর গড়া হয়।

ঝুলনে সাজানো হলেও রথ আর ছাতুবাবুর বাজারের চড়কের মেলাতেও একসময় বিক্রি হত এই পুতুলগুলো। একখোল ছাঁচে পুতুলের দেহটা তৈরি করে সেটা শুকিয়ে খড়িমাটির গোলা লাগিয়ে তবে রং করা হয়। এই রংটা খুব সাবধানে করতে হয়। এত ছোটো পুতুল। আরতী পাল সংসারের কাজের ফাঁকে এটা করেন স্বামীর সঙ্গে। হাত লাগায় ছেলেও।

কুমোর পরিবারের মহিলারা এমন পুতুল গড়ার সঙ্গে অনেক দিন ধরেই যুক্ত। কাঁচা মাটির এই পুতুলগুলোতে একদিকে আছে পৌরাণিক পুতুল আর অন্য দিকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের রোজনামচা। মেয়েদের রান্না, মাছকাটা, শিবপুজো, মা ও ছেলে, পিওন, পুলিশ, আইসক্রিম থেকে ফুচকাওয়ালা, সবজিওয়ালা এমনকী হাল আমলের রিয়েলিটি শো থেকে জনপ্রিয় সিরিয়ালের চরিত্রের সন্ধান— সবটাই মিলবে আরতী পালের পুতুলে। আর পৌরাণিক পুতুলেতে আছে কৃষ্ণলীলা আর রামায়ণের কাহিনির দৃশ্য। রাধাকৃষ্ণ, পুতনা বধ, কালীয় দমন থেকে দশানন রাবণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটে সমাজে লোকশিল্পী তাকে প্রকাশ করেন নিজের মতো করে। ঝুলনের পুতুলে তারই প্রভাব আমরা দেখতে পাই। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের একটা বড়ো অংশ এখানে রূপায়িত হয়।

এই পুতুল তৈরি কীভাবে হয় তা চাক্ষুস দেখেছিলাম ওঁদের বাড়িতে। পুতুলের মাটি আসে ডায়মন্ড হারবার থেকে সোদপুরে। সেখান থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এই আঠালো পলি মাটি ভালো করে চটকে নিয়ে চটা দিতে হয়, অর্থাৎ, কাঠি দিতে হয়। তারপর ছাঁচে পুতুলের দেহটা তোলা হয়। এরপর হাত দিয়ে দেওয়া হয় ‘ফিনিশিং টাচ’।

অনেকে বলেন ঝুলনে সাজানো হয় বলে এটা পোড়ানো হয় না। আরতী পাল তা মনে করেন না। তাঁর মতে তাঁদের মাটিতে এখানে চটা বা কাঠি থাকে বলে পোড়ানো‌ হয় না। কুমোরটুলি থেকে শুকনো রং কিনে আনা হয়। তেঁতুলের বিচির আঠা দিয়ে আগে জাল দিতে হয়। এই রঙের সঙ্গে আঠা মেশানো হয়। এখন যাকে মিডিয়াম বলে তেমন। এর ফলে রংটা হাতে লাগলে ওঠে না।

আরতী দেবীর মা এই পুতুলগুলো বানাতেন। ওঁর ছেলে রং করেন, চোখ আঁকেন। নারকেল মালায় রং রাখা হয়। বাজারি তুলি ব্যবহার করা হয়। ইতিমধ্যেই আরতী পালের পুতুল বেশ পরিচিত হয়েছে। বিশ্ববাংলা পার্ক স্ট্রিটের স্টোরে রয়েছে তাঁর ছবি। শিল্পী হিসেবে এ কম প্রাপ্তি নয়! এছাড়াও সরকারি বেসরকারি নানা মেলায় আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন তিনি। সারাবছর আগেও তৈরি হত এ-পুতুল কিন্তু এখন চাহিদা বেড়েছে অনেক।

আরতী পালের এই পুতুলগুলো এক অসাধারণ শিল্পকলার উদাহরণ। আমাদের রাজ্যে নানা অঞ্চলে এমন পুতুল হয়। কিন্তু আঙ্গিকের দিক থেকে আরতী পালের পুতুলের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। বাংলার মাটির পুতুলের মধ্যে একটা যুগ প্রবাহ দেখা যায়। এই পুতুলগুলো একেবারেই বাস্তবানুগ (naturalistic) কৃষ্ণনগরের মতো মডেল-এর মতো বাস্তবধর্মী নয় (materialistic) নয়। অর্থাৎ, শিল্পী যেমনভাবে তাঁর পারিপার্শ্বিককে দেখে তাঁকে নিজের মতো করে রূপায়ণ করেন। হবহু‌ তুলে ধরেন না। এখানেই আমাদের শিল্পের মূল নির্যাস ধরা পড়ে।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’-তে এই বিষয়টা ভারি চমৎকার বলেছেন—
“একবার কৃষ্ণনগরের পুতুল গড়ার কারিগর জ্যোতিকা’র একটা মূর্তি গড়ল। অমন সুন্দর চেহারা তাঁর, যেমন রং তেমন মুখের ডৌল— মূর্তি গড়ে তাকে নানা রং দিয়ে এনে যখন সামনে ধরল সে যা বিশ্রী কান্ড হল, শিশুমনও তা পছন্দ করবে না। মাটির কেষ্ট ঠাকুরের পুতুল বরং বেশি ভাল তার চোখে। পুতুলগড়া সোজা ব্যাপার নয়। তার গায়ে এখানে‌-ওখানে বুঝে একটু-আধটু রং দেওয়া, চোখের লাইন টানা, একটু খোঁচা দিয়ে গয়না বোঝানো, এ বড় কঠিন। সত্যি বলব, আমি তো পুতুল নিয়ে এত নাড়াচাড়া করলুম, এখনো সেই জিনিসটি ধরতে পারিনি। একটু ‘টাচ’ দিয়ে দেয় এখানে-ওখানে, বড় শক্ত তা ধরা। সেবার পরগনায় যাচ্ছি বোটে সঙ্গে মনীষী আছে। কোথায় রইল সে এখন একা-একা পড়ে, কী শিখল না-শিখল একবার লড়তে এলে তো বুঝব। তা সেবার খাল বেয়ে যেতে যেতে দেখি এক নৌকো বোঝাই পুতুল নিয়ে চলেছে এক কারিগর। বললুম, ‘থামা থামা বোট, ডাক্ ঐ পুতুলের নৌকো।’ মাঝিরা বোট থামিয়ে ডাকলে নৌকোর মাঝিকে, নৌকো এসে লাগল আমার বোটের পাশে। নানা রংবেরঙের খেলনা, তার মাঝে দেখি কতগুলো নীল রঙের মাটির বেড়াল। বড়ো ভালো লাগল। নীল রংটা ছাই রঙের জায়গায় ব্যবহার করেছে তারা, ছাই রং পায়নি নীলেই কাজ সেরেছে‌। অনেকগুলো সেই নীল বেড়াল কিনে ছেলেমেয়েদের বিতরণ করলুম। পুতুলের গায়ের ‘টাচ’ বড় চমৎকার।”

আরতী পালের কৃতিত্ব এখানেই। বংশ পরম্পরায় এক ধারাকে নিয়ে চলেছেন তিনি। আর তা বহন‌ করছেন ওঁর ছেলে। পড়াশোনা করে চাকরি করলেও নিজেদের পেশাকে ভোলেননি।

আরতী আর মনোরঞ্জন পালের সুন্দর সাজানো পরিবার। এক ছেলে আর মেয়ে। রয়েছে নাতনিও। স্টুডিয়ো পার হয়েই ওঁদের থাকবার ঘর। পাশেই রান্নাঘর। গেলেই অমায়িক আপ্যায়ন মেলে। কখন‌ এই শিল্পী দম্পতি যেন অনেক কাছে চলে এসেছেন। জীবন আর শিল্পের মেলবন্ধনে গড়া এই শিল্পীর পরিবার।

প্রথম পর্ব

Categories
2021-July-Poem

স্বস্তিকা ভট্টাচার্য

জল

যে চলে গেছে
তার প্রতি প্রশ্ন নেই
যে রয়ে গেছে
তার প্রতি আশা নেই।

মানুষ তো জলের মতো
যে-ধারা একবার গেছে,
তা আর ফেরত আসে না।

অথচ টাইম কল
তার জন্য কত অপেক্ষা!

মাছবাজার

বাজারে যাই
মাছের জল পেরিয়ে এগোই।

দাম বেড়ে গেছে
তাই পছন্দমতো মাছ নিতে গিয়েও
না নেওয়ার অজুহাত পেয়ে যাই।

খুব রেগে গেলে বলি,
“মাছের বাজার পেয়েছ বুঝি!”
অথচ জানি
ওই বাজার থেকে কীভাবে মুখ ঢেকে বেরোই।

বাড়ির খুদেরা রোজ এক মাছে বিরক্ত
কিন্তু ওই দুপুরের দিকে পড়ে থাকা
নেতিয়ে যাওয়া মাছ ছাড়া আমার গতি নেই।
পরের মাসের এক তারিখ আসে যায়।
মাছের রকমে বদল আসে না, আনি না তাই।

যা সস্তায় পাওয়া যায়,
তার বেশি কিছু আমি জানি না।

সাধারণ কথা

যারা পাশাপাশি ঘুমায়
সবাই মা-সন্তান, স্বামী-স্ত্রী
পরিচিতও নয়।
ফুটপাথে পিঠ রেখে
আকাশ দেখে একসাথে
রাত্রিবেলা পাশ ফিরে ঘুমায়।

দরকার শব্দটা ভীষণ সীমিত।
ভাত, কাপড়
মাথার ওপরে ছাদ।

মিছিল গেলে তাকিয়ে থাকে
কোলে বাচ্চাকে নিয়ে
যেন ফ্রি-তে সার্কাস!
কেউ ঝান্ডা নিয়ে চলে গেলে
শোনে,
“আমরা আসলে দিন বদলাবে।”

সংসার

মা চিরকাল একটাই সংসার বুনলেন
বাবার যত রাজ্যের গল্প,
সেই সংসারের দাওয়ায় বসেই।
মায়ের সংসারে এদিকে গল্প নেই,
একটা নিয়মে বাঁধা সব।
অথচ বাবার গল্পে,
কোনোদিন সংসার আসেনি।

এ-কারণে কি প্রয়োজনেই শুধু কথা বলতেন,
মা-বাবা?

ঈশ্বর

ঈশ্বর এখনও চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।
লন্ঠন খুলে নিয়ে বউ চলে গেছে,
পুকুর ঘাটের অন্ধকারে স্নান সারতে কষ্ট হয়,
ঈশ্বর স্নান সেরে এলে তাকে ‘ বলে ডাকি।

নৈবেদ্য সাজিয়ে রাখে মানুষ,
ঈশ্বর মানুষে উত্তীর্ণ হন খাবারের চাহিদায়।
ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে গিয়ে অস্পৃশ্য হন ভগবান,
এক পাতে ভোগ খায় ভোগী আর দাতা।

আলেয়া জড়িয়ে উপাসক হন সাধু,
গেরুয়ার আড়ালে লালিত লোভ জেগে ওঠে।
“ঈশ্বর আছে, আছে ঈশ্বর”— চিৎকার করে ওঠে উপচার,
প্রণামীতে নেশা করেন ভগবান।

বউ লন্ঠন নিয়ে ফিরে আসে ভোরে।
যেটুকু যা ধুয়ে গেছিল, তাই লেগে যায় গায়ে
মানুষজনম ঘুচে যায় গোপনে।
ধরা-চুরো-নৈবেদ্য, ঈশ্বরজনম আবার প্রচারিত হয়।

ঈশ্বর ফের চাদর মুড়ি দিয়ে জব্বর ঘুমের প্রস্তুতি নেন।

 

Categories
2021-July-Story

তীর্থংকর নন্দী

হট লুক বিষয়ক

প্রাচীনকালে কি হট লুক শোনা যেত! কী শহরে কী গ্রামে! এই শব্দ নিয়ে কি কোনো বই আছে! ধৃতি এই বিষয়ে কিছুই বলতে পারে না। জানে না। দিউ তো আরওই জানে না। এ-সব বালক বা শ্রী কেউই জানে না।

***
শ্রী-র গল্প প্রথমে শুরু করা যাক। শ্রী মোটামুটি সুন্দরী। বিবাহিতা। বয়স তিরিশ। একটি মাত্র কন্যাসন্তান। শ্রী-র বিয়ে হয় দশ বছর আগে। বালাতে। বালা এই শহর থেকে বেশ দূরে। ট্রেনে লাগে একরাত। কিছুটা গ্রাম কিছুটা শহরের মিশেল নিয়ে গড়ে ওঠে বালা। বিয়ের পর প্রথম প্রথম শ্রী-র বালাতে থাকতে ভালো লাগত না। পরে অবশ্য অভ্যস্থ হয়ে যায়। শ্রী-র স্বামী রেলে চাকরি করে। নাম বুবু। দশটা পাঁচটা পুরুষের মতন বুবুও অফিস থেকে রোজ বিকাল সাড়ে পাঁচটায় বাড়ি ফেরে। শ্রীও সারাদিনের একাকিত্বের শেষে বুবুকে বিকালে কাছে পেয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়ে। চা বানায় গরম লুচি ভাজে আলুর তরকারি করে। খুব আয়েশ করে দু-জনে সান্ধ্য টিফিন সারে। তারপর জমাটি গল্পগুজব। সারাদিন অফিসে কী হল। কে কে টিফিন খাওয়ালো এইসব।

মধ্য বৈশাখী বিকাল। গাছসারির সরু পথ ধরে শ্রী ছেলেকে নিয়ে চলে স্টেশনে। ছেলের জন্য খেলনা গাড়ি কিনতে। স্টেশনের এ-পাড়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। সবই ভালো ভালো জিনিস বিক্রি হয় বালা স্টেশনের ও-পাড়ে। এখন ছ-টা বাজে। রোদের হালকা তাপ বেশ অনুভূত হয়।

শ্রী ছেলেকে নিয়ে ওভারব্রিজে ওঠার সময় যেন খেয়াল করে বুবু দাঁড়িয়ে। সামনে একটি চায়ের দোকান। সঙ্গে অল্প বয়সের এক মহিলা। মহিলার ঠোঁটে চড়া রঙের লিপস্টিক। দেখলেই কেমন লাস্যময়ী মনে হয়। দু-জনে চা খায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে। যেন বহু পরিচিত। পুরোনো। মহিলা মাঝে মাঝে বুবুর কানে যেন কী বলে। কী বলতে পারে। শ্রী ব্রিজে উঠতে গিয়ে থমকে যায়। দৃশ্যটি দেখে শরীর মন কেমন গরম হয়ে পড়ে। দু-কান দিয়ে আগুন ঝরে। শ্রী এই হট লুকের ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। কে এই মহিলা। কে এই লাস্যময়ী!

হট লুকের ঘটনাটি শ্রী ইচ্ছে করেই ছ-মাস চেপে রাখে। অবশ্য চেপে রাখার কারণও আছে। বুবুকে একটি ঘটনা দিয়ে বিচার করতে মন চায় না। চায় আরও হট লুক। আরও ঘটনা। আরও দৃশ্য। তবেই তো বুবুকে চেপে ধরতে পারবে। বালা স্টেশনের আগে একটি ছোটো পার্ক আছে। গরমকালের সন্ধ্যায় মানুষ এই পার্কে আসে। বসে। হাওয়াতে শরীরসমস্ত মন ঠান্ডা করে। পার্কের ভিতর দিয়ে হেঁটে গেলে স্টেশন অনেক কাছে পড়ে। শর্টকাটে স্টেশনে চলে আসা যায়।

একটি শরৎ সন্ধ্যা। সন্ধ্যাটি আজও অমর। শ্রী সেই সন্ধ্যা কখনো ভুলতে পারে না। পারবেও না। ছেলেকে নিয়ে শ্রী-র বালা স্টেশনের বাজার থেকে আটা কেনার কথা। আটা লাগে বুবুর জন্যই। বুবু রাতে রুটি ছাড়া খেতে পারে না। পার্কের ভিতর দিয়ে শর্টকাটে স্টেশনে যাওয়ার সময় শ্রী হালকা অন্ধকারে টের পায় বুবুকে। বুবু পার্কের বেঞ্চে লম্বা হয়ে শুয়ে। মাথাটা সেই লাস্যময়ীর কোলে পাতা। লাস্যময়ী বুবুর চুলে বিলি কাটে। গল্প করে। হাসি ঠাট্টা চলে দু-জনের। আবছা অন্ধকারে শ্রী এই দৃশ্য দেখে চোখ কপালে উঠে যায়। ভুরু কুঁচকে ওঠে। এমন একটি হট লুক দেখতে হবে শ্রী কল্পনাও করতে পারে না। বাড়িতে এসে চুপচাপ বুবুকে রুটি তরকারি মাছের ঝোল খেতে দেয়। একটি বাক্যও সেই দৃশ্য নিয়ে ব্যয় করে না।

পরদিন সকালে ছেলেকে নিয়ে শ্রী শহরে চলে আসে। বাবা মা-র কাছে। বালাতে আর কখনো কোনোদিন ফিরে যায় না।

***
বালকের গল্প শুরু করা যাক। বালকের গল্প না শুরু করলে বালক আড়ালে থেকে যাবে।

বালকরা থাকে শিল্পাঞ্চলে। চারিদিকে বিভিন্ন শিল্প। তবে ইস্পাতের কারখানাই বেশি। বালকের বাবা ইস্পাত কারখানার কর্মচারী। বালকের বয়স কুড়ি-একুশ। ক্লাস সিক্স অবধি পড়ে আর স্কুলের দিকে যায়নি। স্কুল ভালো লাগে না। ফলে বালকের কাজ সারাদিন টো টো কোম্পানি। আরও দু-চারজন একই বয়সের ছেলে বালকের সঙ্গে থাকে। ওদের একটি ছোটো দল আছে। প্রত্যেকে গাঁজা বিড়ি চোলাইয়ে অভ্যস্থ। সর্বক্ষণ ওদের চোখজোড়া লালবর্ণ। কোনো বাড়ি থেকে আম চুরি করবে। কোন বাড়ি থেকে পেয়ারা! কোন বাড়ি থেকে কলা এইসব নিয়েই বেশ কেটে যায় নিত্যদিন। সঙ্গে আছে আজ কোন বাড়ি থেকে বাসন চুরি করা যায়। অথবা কোন বাড়ি থেকে ভাঙা সাইকেল! মোবাইল! লোহার টুকরো! চুরি করা জিনিস বিক্রি করে দিব্যি জুটে যায় গাঁজা। বিড়ি। চোলাই। এইসব কুকর্মের জন্য মাঝে মাঝে হাজতবাসও হয়। অবশ্য হাজতবাস এদের কাছে গা সওয়া।

বালকদের বাড়ি থেকে মিল্ক কলোনি একটু দূরে। কলোনির পাশে বটবৃক্ষ ঘেরা একটি শান্ত পুকুর আছে। শান্ত পুকুরটি বয়স্ক সকালে কেমন যেন অশান্ত হয়ে পড়ে। কলোনির ছেলেমেয়েরা এমনভাবে স্নান করে সাঁতার কাটে যে শান্ত জল ভেঙে বড়ো বড়ো ঢেউ খেলা করে। বটগাছের আড়ালে বসে বালক বন্ধুদের নিয়ে মজায় আড্ডায় মেতে ওঠে। নেশার জন্য সবাই কেমন এলোমেলো। অসংলগ্ন কথাবার্তা। কিন্তু বালকের চোখজোড়া বন্দি থাকে পুকুরে। মেয়েদের স্নানের দৃশ্যে। আরও কত কী! ছেলেরা জলে দুপ দাপ লাফিয়ে পড়ে। চিত সাঁতার কাটে। বাটারফ্লাই সাঁতার। কেউ কেউ ডুব সাঁতার দিয়ে উলটো দিকের জমিতে গিয়ে ওঠে। বেশি নেশার জন্য বালকের বন্ধুরা গাছর ছায়ায় একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু বালক জেগে থাকে। ঝিম মাথায় ঝিম চোখে অশান্ত পুকুরের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন দৃশ্য দেখে।

কলোনির রুম্পা অনেক বদলে গেছে। স্নান সেরে জলের ঢেউ থেকে পাড়ে দাঁড়ালে ভেসে ওঠে নীল বর্ণের সিক্ত প্যান্টি। নীল বর্ণের সিক্ত অন্তর্বাসের জলছবি। বালক ঝিম চোখে একদৃষ্টে রুম্পাকে দেখে। রুম্পার সিক্ত শরীর দেখে এমন হট লুকে রুম্পাকে কোনোদিন দেখেনি। রুম্পা নীল বর্ণের প্যান্টি নীল বর্ণের অন্তর্বাস নিয়ে একসময় বটবৃক্ষের আড়ালে হারিয়ে যায়। বালকের ঝিম চোখ থেকে রুম্পা লুকিয়ে পড়ে। তবুও বালক অশান্ত পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে আর কি হট লুকের দৃশ্য দেখা যাবে না! মনে মনে ভাবে পুকুর যখন আছে স্নানের দৃশ্য যখন বর্তমান তখন হট লুক অবশ্যই কোথাও লুকিয়ে।

ঝিমুনিতে চোখজোড়া বুজে আসে যেন। তবুও হট লুকের লোভে বালক চোখ বোজে না। জানে আর দশ মিনিট অপেক্ষা করলেই জল ঢেউ থেকে উঠে আসবে কলোনির লালি বৌদি। লালি বৌদির আগুনের মতন ফিগার। তিরিশ আঠারো চল্লিশ। স্নান শেষে যখন ডাঙায় ওঠে মনে হয় স্বর্গ থেকে পরি নেমে এল। কী রূপ! কাঁধ অবধি ঘন চুল। টানা দুটো চোখ। ভারী নিতম্ব নিয়ে যখন হাঁটে মনে হয় মাটি ফেটে যাবে। লালি বেউদির ভারী নিতম্ব কে না দেখে! এই হট লুক সর্বজনপ্রিয়।

***
দিউ ঘর অন্ধকার করে শুয়ে। শরীর মন একদম ভালো না। দিউ-র গল্প এইখান থেকেই শুরু হক। অন্ধকার ঘরটি কেমন ভূতের মতন। তবুও অন্ধকারই ভালো। দিউ শুয়ে শুয়ে দু-টি জিনিসের কথা খুব ভাবে। এক আজকের ইন্টারভিউ কেমন হল! দুই ইন্টারভিউ দিতে যাবার সময় লেকের কাছে যে-ছেলেটিকে ব্যায়াম করতে দেখে! অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে শুয়ে শুয়ে দিউ চিন্তা করে চাকরিটা কী হবে! প্রশ্ন-উত্তরের পালা ঠিকঠাকই হয়। দিউ শুয়ে শুয়ে মনে করে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর যেমন মাপা মাপা হওয়া দরকার ঠিক তেমনই সে উত্তর দেয়। চাকরিটা তা হলে হবে তো! চাকরিটা তার ভীষণ দরকার। চাকরিটা না হলে তিনজনের একটি সংসার সম্পূর্ণ বসে যাবে। ডুবে যাবে। অন্ধকার ঘরে দিউ-র কখন ঘুম এসে যায়। দিউ গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে।

ঘুমের ভিতর সকালের ঘটনাবলি হুবহু এক হয়ে স্বপ্নে ফিরে আসে। দিউ স্বপ্নে দেখে সকাল ন-টার সময় গোলপার্কে। লেকের রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে দশ নম্বর লেক ভিউ রোডের তিন তলা বাড়িটিতে। দোতলায় সকাল দশটায় ইন্টারভিউ। দিউ হাতে সময় নিয়েই বাড়ি থেকে বেরয়। ধীর পায়ে লেক রোড ধরে। লেক থেকে উঠে আসা হাওযা ভালোই ঠান্ডা। শীতের সকাল ন-টা মানে এখনও ভোর ভোর ভাব। পাঁচ মিনিট হাঁটার পর চোখে ভেসে আসে তিনজন যুবকের শরীর কসরত করার চিত্র। বয়সে বড়ো ছেলেটির শরীর স্বাস্থ্য বেশ। বাইসেপ দারুণ। সিক্স প্যাক যেন মনে হল। ফ্রি হ্যান্ড করার সময় দারুণ লাগে। অত্যন্ত সুঠাম চেহারা। দেখলেই চোখজোড়া ফেরানো যায় না। দিউও অনেকক্ষণ চোখ ফেরাতে পারে না। পারেনি। কয়েক মিনিটের জন্য যেন ভুলেই গিয়েছিল তাকে ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে। দিউ অনেক কষ্টে সেই হট লুক ছেলেটির থেকে চোখ সরিয়ে গাছমালা ধরে লেক ভিউ-এর দিকে হাঁটা শুরু করে। ঠিক এইখানে এসেই ঘুমটা ভেঙে যায়। দিউ তাকিয়ে দেখে অন্ধকার ঘর। বিছানায় ক্লান্ত শরীরে সে একা। অন্ধকারের ভিতরেই ছেলেটিকে আবার যেন দেখতে পায়। এইরকম হট লুকের চেহারা এই শহরে আর কোনোদিন দেখেনি। দেখবেও না। দিউ-র মনে হল অন্ধকারের ভিতর সুঠাম পুরুষটিকে ডাকে। বিছানায় আসতে বলে। পাশে আদর করে শোওয়ায় তারপর সারারাত ছেলেটির সঙ্গে গল্প করে। নাম জানতে চাইবে। কোথায় থাকে জানবে। কী করে ইত্যাদি।

***
হট লুকের সঠিক ভাষা কী! হট লুক কেন বলা হয়! হট লুক নামকরণ কে বা কারা করে! হট লুক শব্দটি কবে থেকে চালু হয়!

ধৃতি অফিস থেকে এসে চা খেতে খেতে কথাগুলো নিয়ে ভাবে। চিন্তা করে। ধৃতি ভাবে তার বাবা অথবা ঠাকুরদা যখন অল্প বয়সের ছিল তারা কি এই হট লুক শব্দের সঙ্গে পরিচিত ছিল! অথবা হট লুক-এর কি কোনো অন্য নাম ছিল! ঘরে টিভি চলে। ধৃতির চোখ এমনিই টিভির পর্দায়। খুব যে মন দিয়ে সংবাদ শোনে তাও না। অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে এলে শরীর মন যখন আর দেয় না ধৃতি তখন চা খেতে খেতে টিভি চালিয়ে দেয়। খবর হয়। বিজ্ঞাপন দেখায়। চটুল গান হয়। নেতারা তর্ক করে। বিতর্ক হয় কোন নেতা কত বড়ো চোর। কোন তেলে চুল ওঠে না। কোন ক্রিমে মহিলাদের দেহ চকচক করে। কোন পিল জন্ম নিয়ন্ত্রণে একদম নির্ভুল কাজ করে ইত্যাদি।

টিভি নিজের মতন চলে। আধঘণ্টা বাদে সিনেমা হবে। রাতে একসময় অ্যাডাল্ট মুভি হয়। বাবা মা হয়তো খেয়ে শুয়ে পড়ে। ধৃতি কীসের টানে যেন নিত্য এইসব অ্যাডাল্ট মুভি দেখে। এইসব মুভিতে কোনো ভালো গল্প থাকে না। থাকে শুধু বেড সিন। চুমু দৃশ্য এইসব। ধৃতি যদিও এইসব মুভি ভালো করে মন দিয়ে দেখে না। শুধু যেন টাইম পাসের জন্য টিভি খুলে রাখে।

রাত এগারোটা। ধৃতি বাথরুম থেকে হাত পা মুখ ধুয়ে আবার সোফায় এসে বসে। চিন্তা করে কাল অফিসে কী কী কাজ প্রথমে করতে হবে! পেমেন্টে গিয়ে কিছু কথা সেরে নেবে। টিফিন টাইমে বাইরে না বেরিয়ে কিছু খাবার আনিয়ে নেবে। কেন-না বকেয়া কিছু কাজ কালই শেষ করতে হবে। প্রতি রাতে অফিসের চিন্তা করতে করতেই রাত বেড়ে যায়। চোখেও ঝিমুনি আসে। একসময় মা রাতের খাবার টেবিলে এনে রাখে। বলে খেয়ে নে। রাত হচ্ছে। ধৃতি রাতের খাবার ইচ্ছে করেই দেরি করে। কেন-না খাওয়া শেষ হলেই চোখজোড়ায় গাঢ় ঘুম নেমে আসবে। তখন বসে থাকা খুব কষ্টকর। সাড়ে এগারোটায় বিজ্ঞাপনের মেয়েটি আসে। রোজই আসে। আসে চমৎকারভাবে। টিভির কাচ পর্দায় ভেসে উঠবে মেয়েটির হালকা হাসির রেখা ঠোঁটে দুলিয়ে। পরনে মেরুন বিকিনি। মেরুন অন্তর্বাস। চেহারা যথেষ্ট ভালো। পুরুষ্ট। হাসতে হাসতে চেয়ার টেবিল সোফা ডাইনিং টেবিলের মজাদার কত গল্প শোনায়। দামে কম। মজবুত বেশি। আবার অত্যন্ত কম সুদে ক্রয়ও করা যায়। লোন সহজেই পাওয়া যায়। তিন বছরের জন্য সহজ লোন। দশ মিনিটের বিজ্ঞাপন ধৃতি খুব মন দিয়ে দেখে। শোনে। কাচ পর্দায় মেয়েটির হট লুক দেখতে দেখতে রাতের খাওয়া শেষ হয়। চোখে গাঢ় ঘুম জড়িয়ে আসে। বিছানায় চলে যায়।

আগামীকালও ধৃতি হট লুকের মেয়েটিকে দেখতে দেখতে রাতের খাওয়া খাবে। ঘুমিয়ে পড়বে। রোজই দেখবে। এই হট লুক যেন শেষ না হয়।

Categories
2021-July-Translation

হ্যান ক্যাং

“যদি আমি ১০০ % সুস্থ হতাম তাহলে আমি লেখক হতাম না”

ভাষান্তর: শতানীক রায়

আপনার নতুন বইটি আপনার দিদির কাহিনিকে ঘিরে যে জন্মানোর দু-ঘণ্টা পরে মারা যায়। আপনাকে এখন এই কাহিনি লেখার জন্য— কী বাধ্য করল— বা অনুভব করালো?
আমি ভেবেচিন্তে আমার বড়োদিদির সম্পর্কে লিখিনি। আমাকে বড়ো করে তুলেছে আমার বাবা-মা যারা কখনো তাকে ভুলতে পারেনি। আমি যখন ‘হিউম্যান অ্যাক্টস্‌’ লিখছিলাম, সেখানে একটা এক লাইনের সংলাপ ছিল: “মরে যেয়ো না, অনুরোধ করছি মরে যেয়ো না।” সেটা আশ্চর্যভাবে একইরকম আর সেটা আমার ভেতর অনুরণনিত হয়েছে। তখনই আমি আবিষ্কার করি সেটা আমার মায়ের স্মৃতি থেকে প্রভাবিত আমকে সে বলেছিল যে, সে ওই শব্দগুলো ক্রমাগত দিদিকে বলে গেছিল যে আমার জন্মানোর আগেই মারা গেছিল।

আপনি লেখেন যে, কীভাবে আপনি “জন্মেছেন আর বড়ো হয়ে উঠেছেন সেই মৃত্যুস্থানেই”। সেটা আপনার বড়ো হয়ে ওঠাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?
সেটা শুধু বিচ্ছেদের ব্যাপার ছিল না। সেটা ছিল আমাদেরকে কেন্দ্র করে যে, আমরা কত মূল্যবান। বাবা-মা আমার ভাই আর আমাকে বলেছিল: “তোমরা আমাদের কাছে খুব মূল্যবান হয়ে জন্মেছ আর আমরা তোমাদের জন্য অনেককাল ধরে প্রতীক্ষা করেছি।” কিন্তু সেখানে শোকও ছিল। সেটা ছিল শোক আর মূল্যবান জীবনের মিশ্রিত বোধ।

আপনি বইতে স্বীকার করেছেন যে, যদি আপনাদের মায়ের প্রথম দুটো সন্তান মারা না যেত, তাহলে হয়তো আপনি আর আপনার ভাই জন্মাতেন না। এটা আপনাকে কীরকমভাবে ভাবায়?
যখন আমার মা আমাকে গর্ভে ধারণ করেছিল, সে খুব অসুস্থ ছিল, তাকে অনেক ওষুধ খেতে হচ্ছিল। যেহেতু সে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল, সে গর্ভপাত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তারপরই সে আমার নড়াচড়া নিজের ভেতর অনুভব করে আর সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে জন্ম দেওয়ার। আমার মনে হয় এই জগৎ পরিবর্তনশীল আর ভাগ্যবশত আমাকে এই জগৎটা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

বইয়ের শুরুর পৃষ্ঠাগুলোতে, আপনি বলছেন যে, আপনি চাইছেন এই বইয়ের লেখার প্রক্রিয়া যেন রূপান্তরকারী হয়, সেটা কি হয়েছে?
হ্যাঁ, এই প্রক্রিয়া আমাকে সত্যি সহযোগিতা করেছে। নিত্যদিন সেটা ছিল একটা ছোটো আচারের মতো: প্রার্থনার মতো। যখন আমি লিখছিলাম, সেটা মনে হচ্ছিল যেন আমি নিত্যদিন কাছে আরও কাছে পৌঁছে যাচ্ছি, দিনের পর দিন, আমাদের ভেতরের সেই জায়গায় যা কখনো ধ্বংস করা যাবে না, যা সৃষ্টিও করা সম্ভব নয় বা নষ্ট করাও যাবে না।

কৈশোরাবস্থায় আপনার একটা নিস্তেজ করা মাইগ্রেন ছিল। সেটা আপনাকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে?
আমার মাইগ্রেনের ব্যথা আমাকে সবসময় মনে করায় যে, আমি একজন মানুষ। কারণ, যখনই মাইগ্রেন শুরু হয়, আমাকে থামিয়ে দিতে হয় আমার কাজ, আমার পড়াশুনো, আমার রোজনামচা, সেটা আমাকে সবসময় আমাকে নম্র করে এসেছে, আমাকে সহযোগিতা করেছে এটা বুঝতে যে, আমি মরণশীল আর দুর্বল। যদি আমি ১০০ % সুস্থ আর প্রবল অনলস হতাম তাহলে হয়তো আমি লেখক হতাম না।

আপনি বলেছেন, ১৪ বছর বয়সেই আপনি জানতেন যে, আপনি লেখক হতে চান। আপনি কীভাবে জানতে পারলেন?
আমি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম। আর তখনই, পাঠক হিসেবে, আমি অনুভব করলাম প্রতিটি লেখকই উত্তর খুঁজছেন আর তাঁদের কাছে কোনো উপসংহার নেই, কিন্তু তাঁরা লিখে যাচ্ছেন। সেই অবস্থান থেকে আমি ভাবলাম, কেন আমিও সেটা শুরু করে দিই?

আপনার বাবাও একজন ঔপন্যাসিক। তিনি আপনাকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন?
আমি যে-বাড়িতে বড়ো হয়ে উঠছি সেখানে অনেক বই ছিল— আমার মনে হয় এটা একটা বিশেষ দিক।

আপনার পছন্দের কিছু ছোটোদের বই কী কী ছিল?
আমি অনেক কোরিয়ান লেখকদেরই পছন্দ করতাম আর অনুবাদ বইও, যেমন অ্যাস্ত্রিদ লিনড্রেন-এর ‘দ্য ব্রাদার্স লাইয়োনহার্ট’।

কোন লেখকেরা সবচেয়ে বেশি আপনার লেখনিকে অনুপ্রাণিত করেছে?
কোরিয়ান লেখকদের মধ্যে আমি লিম চুল-উ-এর ছোটোগল্প ভালোবাসি। আর বিদেশি লেখকদের মধ্যে আমি ভালোবাসি দস্তয়েভ্‌স্কিকে।

কোন সাহিত্যিকের সঙ্গে, মৃত বা জীবিত, আপনি সবচেয়ে বেশি ইচ্ছুক দেখা করতে?
আমি লেখকদের সঙ্গে দেখা করতে চাই না: আমি তাঁদের সঙ্গে আগেই দেখা করেছি তাঁদের বইয়ের মাধ্যমে। যদি আমি তাঁদের বই পড়ে থাকি আর কিছু অনুভব করি, সেটাই আমার কাছে খুব মূল্যবান বিষয়। লেখকেরা তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব নিজের বইতেই দিয়ে দেন সেই কারণেই আমার পক্ষে সে-সব বই পড়াই যথেষ্ট।

আপনার উপন্যাস ‘দ্য ভেজেটেরিয়ান’ ইন্টারন্যাশনাল ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করে। সেটা আপনার লেখকজীবনে কীরকম প্রভাব ফ্যালে?
আমি অনেক বেশি পাঠক আর বৃহৎ দর্শকের সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু কয়েক মাস পরেই আমি ফিরে যেতে চেয়েছি আমার ব্যক্তিজীবনে, কারণ, একজন লেখকের জন্য সর্বক্ষণ খুব বেশি মনোযোগ ভালো নয়। আবার মনোযোগের তোয়াক্কা না করে এবং ক্রমাগত লিখে যাওয়া, এটা অসম্ভব।

Categories
2021-July-Essay

তোর্সা বোস

নাচনি নাচ

নাচনি নাচ বিষয়টি মূলত ঝুমুর গানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই নাচের ক্ষেত্রে মূলত উপস্থিত মহিলা নৃত্যশিল্পীগণ প্রথমেই রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিকে স্মরণ করে বা এক প্রকার আসর বন্দনা দিয়ে নাচ শুরু করেন। এই নাচের বিষয়বস্তু থাকত মূলত রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ, রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিরহ লীলা ইত্যাদিকে ভিত্তি করে। প্রাচীনকাল থেকে মূলত পুরুলিয়া অঞ্চলের রাজদরবারে বিশেষত কাশিপুর রাজবাড়িতে এই নাচনি নাচের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এই নৃত্যে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত মাদল, ঢোল, সানাই, সিংগা, হারমোনিয়াম প্রভৃতি কখনো কখনো এর সঙ্গে বাজানো হত আড়বাঁশি। সেই প্রাচীনকাল থেকেই নাচনিদলে সাধারণত দশ থেকে কুড়ি জন শিল্পী থাকতেন দলের প্রধান পুরুষকে বলা হত রসিক এবং যে-সকল মহিলারা নর্তকী হিসেবে দলে নাচতেন তাঁদেরকেই বলা হত নাচনি।

নাচনি প্রথার উৎপত্তি:

পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চলে নাচনি প্রথার শুরু হয়েছিল মধ্যযুগীয় শিল্পী বরজুরাম দাসের হাত ধরে। ইতিহাসের সূত্র ধরে যদি আমরা নাচনি নাচ কোথা থেকে এসেছে তা জানবার চেষ্টা করি তবে দেখা যায় যে, মূলত উত্তর ভারতের বাইজি নাচের যে-সংস্কৃতি তাকে অনুকরণ করে এই নাচনি প্রথা বাংলায় আসে। তবে এ-কথা প্রথমেই জানিয়ে রাখি নাচনি নাচে, কিন্তু কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা অংশগ্রহণ করতেন না। এতে অংশগ্রহণ করতেন মূলত নীচু সম্প্রদায়ের গরিব ঘরের মেয়েরা। নাচনিদের ইতিহাসে যিনি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন তিনি ছিলেন শ্রীমতি সিন্ধুবালা দেবী। যদিও উনি কাশীপুরের রাজবাড়িতে নাচনি হিসেবে যে-সমাদর লাভ করেছিলেন তা ওঁর নাগর বা রসিক চেপা মাহাতোর হাত ধরে। যদিও সমাজ এই নাচনিদের শিল্পীদের কখনোই ভালো চোখে দেখত না। কেবলমাত্র রাজ-রাজাদের বা সম্ভ্রান্ত জমিদারদের মনোরঞ্জন করাই ছিল এদের কাজ। নাচনিরা তাদের রসিককে কেন্দ্র করেই বেঁচে থাকত। শিখত নাচ গান, অর্থাৎ, এই রসিকই ছিলেন এদের জীবনসঙ্গী আবার শিক্ষাগুরু। তবে এইসকল রসিকদের কাছে যে-সব মেয়েরাই নাচনি হিসেবে যোগ দিত তারা অনেকেই ছিল পথভ্রষ্ট। এইসকল নাচনিরা কখনো হয়তো বাবা-মায়ের অর্থকষ্টের কারণে বিক্রি হয়ে গেছে শিশুকালেই কোনো-না-কোনো রসিকের কাছে। জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ কী তা তারা কখনোই দেখেনি রসিকের সাথে এদের জীবন কাটত নানান সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। রসিকরা এদের নাচ গান শিখিয়ে অতি দ্রুত নিজেদের মনের মতন করে গড়ে তুলতেন। নাচনি মেয়েদের কাজ হত গ্রামের রাজা কিংবা জমিদারদের মনোরঞ্জন করা কিন্তু তার বিনিময়ে এরা কখনোই যোগ্য মর্যাদা বা ন্যূনতম সম্মানটুকু পেতেন না। সম্ভ্রান্ত সমাজ এদেরকে মানুষ বলি বলেই গণ্য করতেন না। একসময় কোনো নাচনি মারা গেলে তার দেহ সৎকার পর্যন্ত করা হত না। পায়ে দড়ি বেঁধে ধাঙ্গড় দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে কোনো ভাগাড়ে সেই নাচনির মৃতদেহ ফেলে আসা হত। কী মর্মান্তিক তাদের জীবনের শেষ পরিণতি নাচনিদের জীবনের এই ইতিহাস অনেকটা যেন বাংলার বাউলানি, অর্থাৎ, যারা বাউলদের সঙ্গিনী তাদের সঙ্গে মেলে। যদিও এই বাউলানিরাই বাঁচিয়ে রাখে তাদের বাউলদেরকে কিন্তু শেষ জীবনে তাদেরও অবস্থা হয় এই নাচনিদেরই মতন। বর্তমানকালে একজন উল্লেখযোগ্য এবং স্বনামধন্য নাচনি শিল্পী হলেন শ্রীমতি পস্ত বালা দেবী কর্মকার। ২০১৮ সালে তাঁকে লালন পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়। যদিও আজ যে আমরা তাঁকে খ্যাতির জায়গায় বসিয়েছি লালন পুরস্কারে ভূষিত করেছি তা কিন্তু তাঁর জীবনে এত সহজে আসেনি। পস্তবালার জীবনের ইতিহাস ভীষণই করুণ। তাঁর মা বিমলা দেবী ছিলেন একজন নাচনি যিনি তৎকালীন জমিদার বাড়িতে নিযুক্ত ছিলেন। পস্ত বালার ক্ষেত্রে তাঁর মা-ই নিজে তাঁকে এই পথে এগিয়ে দেন। পেটের দায়ে সেই ছোট্ট পস্তবালা নানান লোকের বাড়িতে ঘরের ফাইফরমাশের কাজ, ঝিয়ের কাজ এমনকী ভিক্ষা পর্যন্ত করেছেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে একজন অতি বৃদ্ধের সঙ্গে তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। স্বভাবতই এই বিয়ে তাঁর ক্ষেত্রে সুখের হয়নি। নানান অত্যাচার সহ্য করে একসময় তিনি শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন। এর পর তাঁর জীবনে নাচের হাতে খড়ি হয় শ্রদ্ধেয়া সিন্ধু বালা দেবীর কাছে। এর পর তাঁর জীবনে রসিক হয়ে আসেন বিজয় কর্মকার। ভালোবাসার টানে তিনি ঘর বাঁধেন বিজয় কর্মকারের সঙ্গে যদিও বিজয় ছিলেন বিবাহিত এবং কয়েকজন সন্তানের পিতা। পস্ত বালা নিজেই বলেছেন রসিকের বাড়িতে এসো তাঁর কপালে সুখ জোটেনি বরং রসিক তাঁর নিজের পরিবার বাঁচাতে পস্তর উপার্জন করা পয়সা আত্মসাৎ করে নিতেন। এভাবে দিনের পর দিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কাটাতে কাটাতে একসময় শুরু হয়, কিছু শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের হাত ধরে এই নাচনিদের বাঁচানোর জন্য আন্দোলন। অবশেষে ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নাচনিদের স্বীকৃতি দেন তৈরি হয় মানভূম লোকসংস্কৃতি ও নাচনি উন্নয়ন সমিতি। যেখানে এখন সম্পাদিকা আসনে রয়েছেন পস্ত বালা দেবী। যে-রসিক বিজয় কর্মকারের বাড়িতে একসময় তাঁর জায়গাটুকুও জোটেনি আজ নিজের অধিকারে তিনি সেই জায়গা করে নিয়েছেন। যথেষ্ট সমাদর করা হয় তাঁকে। তাঁর নিজস্ব একটি বাসস্থান হয়েছে। বহু জায়গা থেকে ডাক আসে তাঁর, গ্রামে গ্রামে এমনকী শহরেও তিনি নৃত্য পরিবেশন করতে আসেন। যদিও এত কিছু সত্ত্বেও নাচনিদের নৃত্যের যে-ভঙ্গিমা বা শৈলী তা কিন্তু আজও আমাদের বাবু সমাজ বা তথাকথিত সভ্য মানুষরা ভালো চোখে দেখেন না তবে যেহেতু এটি একটি অতি প্রাচীন লোকসংস্কৃতির বা আদিমতম একটি লোকনৃত্যের অঙ্গ বা অংশ তাই তাঁদের সেই মৌলিকত্বকে খণ্ডন করার বা অস্বীকার করার কোনো অধিকারই আমাদের নেই।

বর্তমানকালের নাচনি এবং তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থান:

পূর্বের সিন্ধু বালা দেবী বা বর্তমানের পস্ত বালার মতো এখন আরও যে-সব নাচনি শিল্পীরা রয়েছেন যেমন বিমলা দেবী, সরস্বতী দেবী এঁদের মতো গুটিকয়েক শিল্পীরাই কিন্তু কেবলমাত্র এখন আর এই পেশার সঙ্গে টিঁকে আছেন। এঁদের পরে জানি না আর কে বা কারা এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, কারণ, কী-ই-বা আছে এঁদের? সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত না আছে এই শিল্পীদের জীবনে কোনোরকম কোনো নিশ্চয়তা, সম্মান, যোগ্য মর্যাদা, যোগ্য মজুরি কিংবা দু-বেলা দু-মুঠোভাতের জোগান। যদিও-বা আগেকার দিনে এইসকল নাচনিদেরকে অন্তত কাজ দিয়ে জমিদারবাড়ি কিংবা রাজদরবারের রাখা হত এখন সেই রাজাও নেই রাজদরবারও নেই ফলে নেই নাচনিদের খোঁজ। এখন এইসব নাচনিদের দেখা পাওয়া যায় পুরুলিয়া এবং তাঁর আশেপাশের অঞ্চলে যে-সকল পালা-পার্বণ বা মেলা হয় তাতে, কিন্তু তা আর কতই-বা হয় আর তা দিয়ে তাঁদের কী-ই-বা অর্থ আসে হাতে। ফলে অর্থের এবং উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই শিল্প আজ ধ্বংসের সম্মুখীন।

নাচনি সম্প্রদায় সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা:

লোকসংগীতের একজন ক্ষুদ্র গবেষক হিসেবে একসময় জানতে চেয়েছিলাম পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতিকে আর সেই সুবাদেই পুরুলিয়ায় বা পুরুলিয়ার আশেপাশের বেশ কিছু মেলা কিংবা বা বাধনা, মকর, টুসু ইত্যাদি পালা পার্বণে ছুটে যেতাম। এমনই একবার শীতকালে পুরুলিয়ার একটি জনপ্রিয় বাৎসরিক মেলায় (সৃজন উৎসবে) উপস্থিত হই। সেখানে নানা শিল্পীদের আগমন, নানারকম শিল্পের সম্ভার, বলা যেতে পারে গোটা ভারতবর্ষে যেন সেখানে এসে হাজির হয়েছিল এবং তার পাশাপাশি ছিল এই হারিয়ে যাওয়া নাচনিদের দলও। উৎসুক মনে গিয়ে দাঁড়াই সেই নাচনি দলের কাছে। যদিও যতদূর মনে পড়ে, তাঁরা মেতেছিলেন তাঁদের নিজেদের দলের মানুষদের সঙ্গে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের মতো শহুরে মানুষদেরকে আশেপাশে দেখলেও এঁরা একটু ভয়ই পান। যাইহোক খানিক ইতস্তত হয়েও এগিয়ে যাই এঁদের সঙ্গে আলাপ জমাতে প্রথমেই মাঝবয়সি যে-মহিলা নাচনি শিল্পীরা সঙ্গে কথা হয় তাঁর নাম ছিল কাজল বালা দেবী। কথায় কথায় জানতে পারি তাঁর বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি। অনেক ছোটো বয়স থেকেই তিনি এই পেশায় আসেন। তাঁর মাও ছিলেন পেশায় একজন নাচনি। আর তিনিও একটা বয়সের পরে এই পেশায় আসেন। তাঁর জীবনেও আছে রসিক যদিও এই রসিক পরিবর্তন হয়েছে দু-একবার। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁর জীবনের প্রথম রসিক তাঁকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। তারপর আসেন দ্বিতীয় জন, এখন তিনিই তাঁর স্বামী বা রসিক। আলাপ জমতে থাকে ক্রমশ। জানতে চাই তাঁদের এই যে অপূর্ব সাজসজ্জা তার সম্পর্কে। কীভাবে এঁরা তাঁদের কেশবিন্যাস করেন বা কী কী অলংকার পরেন এই নাচনি নাচের সময়। নিজের চোখেই দেখি খুবই রংচঙে সাজগোজ বাহারি শাড়ি হাতের চুরি গলায় মালা ইত্যাদি। উনি ওঁর সাধ্যমতো উত্তর দেন তবে এরই মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উনি দেয় যে, তা হল এঁদের সাজ-পোশাকের ক্ষেত্রে কোমরে একটি কোমরবন্ধ পরা হয়। যেটি কিনা এই নাচের সাজসজ্জার একটি বিশেষ অলংকার। এর পরে শুরু হয় তাঁদের নাচ সঙ্গে ঝুমুর গান দুই মিলে তৈরি হয় স্বর্গীয় পরিবেশ আমিও হারিয়ে যাই সেই আদিরসের সুরে। বেশ রাতের দিকে থামে এঁদের পরিবেশনা। ভেঙে যায় মেলা। আমিও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলি আমার ডেরার দিকে। ফেরার পথে ভাবতে থাকি কাজল দেবীর সাথে বলা কথাগুলো সম্পর্কে। আহা, কী আফসোস তাঁর কণ্ঠে ছিল। পরিষ্কার বলেছিলেন, আজকাল আর ক-টা জায়গাতে নাচনি নাচের আসর বসে আর বসলেই-বা আমাদের কী-বা এমন পাই? খুবই কম টাকা দেয়। এমনকী কোথাও কোথাও তো রাতের খাবারটুকুও তাঁদের দেওয়া হয় না। ভাবছিলাম তবে কোথায় উন্নত হল আমাদের সমাজ? আমরা তো আমাদের আদিমতম সংস্কৃতির কথাই ভুলতে বসেছি। তার বদলে জায়গা নিয়ে নিয়েছে সস্তার চটুল সংস্কৃতি। আচ্ছা যাঁরা আজও নাচনিদের সেই আগেকার দিনের মতোই খারাপ চোখে দেখেন, নাচনি মানেই খারাপ পথে যাওয়া মেয়ে মানুষ তাঁরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন কেন নাচনিদের নাচে গানে অশ্লীলতা (যদিও কোনটা অশ্লীলতা আর কোনটা শ্লীলতা এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার) প্রয়োগ রয়েছে? আসলে আমরা ভাবি বড়োই কম আর সেই কম ভাবনার উপর মন্তব্য করি বা নিজেদের ভাবনাকে চাপাই অনেক বেশি তাই হয়তো নাচনিরা আজও সমাজের সেই অন্ধকারেই রয়ে গেছেন। যে-নাচনি নাচের ভঙ্গিমা বা শৈলীকে অশ্লীল বলা হত বা আজও বলা হয় তা কীসের জন্য তার জন্য দায়ী ছিল তৎকালীন উচ্চবিত্ত বাবুসমাজ। উচ্চবিত্তদের অতি স্থুল রুচিবোধেই তো ছিল নাচনিদের নৃত্যের যে-কুরুচিকর ভঙ্গিমা বা শৈলী তার কারণ। বাবুদের মনোরঞ্জনের চাহিদা মেটাতে এই নাচনিরা নাচের সাথে কিছু অশ্লীল দেহ-ভঙ্গিমার আশ্রয় নিয়েছিলেন তাহলে এতে নাচনিদের দোষ কোথায়?

উপসংহার:

পুরুলিয়া তথা মানভূমের লোকসংস্কৃতির ইতিহাসের পাতা থেকে নাচনি নাচের আজ যে-অবলুপ্তি তার জন্য কিন্তু দায়ী আমরাই, কারণ, সিন্ধু বালা, পস্ত বালা কিংবা এঁদের পরে আর সামান্য কয়েকজন যাঁরা আজও খুব কঠিনভাবে এই শিল্পকে বুকে আঁকড়ে বেঁচে রয়েছেন এঁদের পরে এই শিল্পকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আর কিন্তু কেউ নেই। কারণ, সমাজ উন্নত হওয়ার পাশাপাশি আজকাল আর পুরুলিয়া বা তার আশেপাশের অঞ্চলের মেয়েরা এই নাচনি গানের সঙ্গে যুক্ত হতে রাজি নয়। তাঁরা বরং লেখাপড়া শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে চাকরির খোঁজে পাড়ি দেয় দেশের নানা প্রান্তে। যদিও যুগের পরিবর্তন অনুযায়ী অতি স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু তবুও কি এমনভাবে এইরকম একটি সুপ্রাচীন শিল্পকে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেখা যায়? এ কি মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক নয়? আজও যাঁরা লোকসংস্কৃতি লোকসমাজ কিংবা লোকশিল্প নিয়ে বিন্দুমাত্র হলেও চিন্তিত এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী সেইসকল শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদেরকে উচিত নয় কি সরকারের দরজা অবধি এই নাচনি শিল্পের কথা পৌঁছে দেওয়া? যাতে কেবলমাত্র গুটিকয়েক নাচনি শিল্পীকে কেবলমাত্র বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত না করে এই সমগ্র শিল্পটিকে পুরুলিয়ার অন্যান্য যে-সকল সমাদৃত শিল্প যেমন ছৌ নাচ কিংবা ঝুমুরের কাছাকাছি নিয়ে আসা অথবা এর পাশাপাশি সরকারের দৃষ্টিপাত করা উচিত যাতে আজও যাঁরা নাচনি পেশায় নিযুক্ত তাঁরা যাতে পুনর্বাসন কিংবা মাসিক একটি ভাতা বা বার্ধক্যের জন্য সুচিকিৎসার সুযোগ পায়। এর পাশাপাশি সরকার এবং লোকসংস্কৃতির সঙ্গে যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছেন তাঁদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন বা আবেদনে বলা চলে যাতে করে একাডেমিক স্তরে এই নাচনি শিল্পকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। যাতে অন্তত কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী যোগ দেয় এতে। নাচনি গান বা নাচ আসলে কি তা তাঁরা যেন শেখে এবং এর ফলেই একদিন আশা করা যায় হয়তো এঁদের হাত ধরেই বর্তমানকালের কিছু পরিবর্তনকে সঙ্গে রেখেই এই নাচনি শিল্প আবার উঠে আসবে। এতে যেমন করে এই শিল্পটি আবার প্রাণ ফিরে পাবে তেমনি বাঁচবে এই শিল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা প্রান্তিক শিল্পীরা। কারণ, আমরা সকলেই জানি শিল্পী বাঁচলে তবেই শিল্প বাচবে। যে-নাচনিদের পায়ের ঘুঙুরের তালে মেতে ওঠে রসিক দর্শকেরা বা শিল্প অনুরাগীগণ সেই নাচনিদের পায়ে যেন আর কোনোদিনই তাঁদের মৃত্যুর পরে দড়ি বেঁধে টেনে না নিয়ে যাওয়া হয়। যোগ্য মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার পাশাপাশি, অন্তত মৃত্যুর পরে যেন তাঁরা তাঁদের শেষ কৃত্যের যোগ্য মর্যাদাটুকু পায়।

Categories
2021-July-Poem

মহিউদ্দিন সাইফ

শুরুর দিনের কথা

সেই হাঁসীর শূন্যতা ভরা মুখ ঈর্ষ্যারতি-র
জেনে কাছে গেলাম।
সাধ হল, এত অপাঠ্য পীত লিপি কার?
চকিতে আকাশের ইঙ্গিতময় সুবাস কষ্টিপাথরের হয়ে এল।
যে-আভাস বহুদিন, বহুকাল থেকে
উঠব উঠব করে রোজ গাঢ় হচ্ছিল
আজ নেহাতই অবলীলায় সরোবর খুলে বেরিয়ে এল
ঝাড়তে ঝাড়তে শত ডানা।

বাতাসের সূক্ষ্ম কণাগুলি,
যেগুলিকে জানতাম ধুলোপিণ্ডের সারাৎসার বলে,
সহসা চৌচির হয়ে
ফোটাতে লাগল একটি করে নিশুত কদম।

আমি আকাশ আর মাটির মাঝখানে
সিঁদুর-হরিতাল খুঁটিটা ধরে ভাবছি,
হাঁস, হব কি হব না…!

পাখিঅলা

একদিন এক পাখিঅলা এল, আমাদের খুশবুদার দেশে।
জন্মের পর এই প্রথম।
পাখিদের মুখ এত গাঢ়!
রঙ্কিনীর মনে হল।

সে কত কিসিমের, কত ছাঁদের রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা।
নির্মল কেশগুচ্ছে গরবিনী
পীতধড়ায় ইঙ্গিতময়,
কাঁচা অঙ্গের মখমলে সাত ঘোড়া
চরে বেড়াচ্ছে, প্রগল্ভ মাঠ।

লাল পদ্মের মতো পাখিঅলা,
যেন দীর্ঘ জীবন পার হয়ে এসে শোনাল অভিনব কথা।
ত্রিভুবনের গূঢ় রঙ ছেনে ফোটাল
স্ফূর্তি নামের এক বুদবুদ।

আমরা ছেলেবুড়োরা যাবতীয় চোখ খুলে দেখতে লাগলাম
ভিন্ন ভিন্ন পাখি থেকে উত্থিত হচ্ছে
একএকটি নিরল শব্দ।
সেই ধ্বনি ক্রমে গাঢ় হতে হতে
আমাদেরই মাঝে রুয়ে দিচ্ছে শত শত যুগনদ্ধ তরু।

ঘোড়াজন্ম

পড়ে থাকি
অর্জুন গাছের গোড়ায়
আরও সব দারাসুত
মুখে মুখ গুঁজে, গুফতুগু
বপ্তা মংলার সাথে, খুবধীরে, প্রণয়মেদুর।
সে এক ইশানচাপা, নেশাড়ু অখিল,
ছড়িয়ে রাখে উঁইমেকা, থানে
একগাছি সুতো, কাজল, এয়োতির সিঁদুর।
এন্তেজাম করে, সাঁকরাতে, মাধুকরী
গন্ধে উথাল জুড়িভোগ।

পিতার থেকে মন্ত্র নিয়ে, অঙ্কুরিত নাদ
বেঁধেছে এই কচ্ছপী বীণা।
সেই থেকে তার হাতে ভরণ-পোষণ,
গান শুনি: অর্ধমাগধি দোঁহা।

নির্ভাবুক বসে থাকি, দ্রুতমন্দ ছায়ায়
গোপন টুরুই ডাকে কোনো কোনো দিন।

জ্যোৎস্না রাতে

জ্যোৎস্নায় লহর, উড়ছে চরকার সুতো।
শুক্লা দ্বাদশীর আকাশ, পাহাড়ি নীল ও মন্থর।
তা-ই অধিকার করে বসে আছে বুড়ি
বৃহন্নলা বটের তলায়।

সীতালাউ ফুল টুপাতে রাখা
অপার্থিব দোপাটির আলো, শিশির স্বাগতা।

এদেরই গোপথ দিয়ে নেমে আসে
আরও একটি বুড়ি, অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ।
ত্বকের কুঞ্চনে সৌরভ, গুলঞ্চবাহার।
মহাদানা ঘাটে দূরজন্মের স্মৃতির মতো নেমে
ভাঙে গোল পাথরটির গুমান।
মাখিয়ে দেয় মাথায় চন্দন পায়ে গেরুমাটি।

হাত ধুতে ধুতে
ব্রহ্মানন্দ তালশাঁসের মতো হয়ে আসে পুকুর।
একটি মোহন পাখির দিকে চোখ ঠেরে
হেসে ওঠে,
কে এই মরমিয়া?

জল…

নিরাময়

‘একদিন জলাশয়ের মতো এক যুবতী এসে
আমাদের শৈশবের কাঁথাকানি রাখা
প্যাটরা খুলতেই চারপাশে প্রস্রাবের মহক।’

এটুকু শুনেই মনে হল, কার কাছে যেন
রাখা আছে তামার ঘুনসি।
পিতামহের জালকাঠিগুলি পেলাম না বলে
নামাজ-পাটির থেকেও উঠে এল প্রাণ?
হাঁস আর সাপের খেল দেখতে চেয়ে
সারারাত কাবার হল জ্যোৎস্নার খোঁজে…

কিন্তু এ-ধূলিশয়ান সংসারে দেখলাম
একটি কাবরা ছাগল চরে বেড়াচ্ছে সঞ্চালিত বাতাসে।
আউল করা সবুজে দু-একখানা বংশলোচন।
আর অদূরে মকরধ্বজ আকাশে
কে যেন আমাদের হরিমান রোগ
শুক আর শারিতে স্থাপন করছে,
বুনো হরিদ্রায় ছড়িয়ে দিচ্ছে।

 

Categories
2021-July-Poem

পিন্টু পাল

দৃশ্যের বাগান থেকে


শুয়োপোকার মতো কামনা হু-হু করে ঢুকে পড়ে বুকে। প্রেমবিহ্বল আবেগ। যেন স্থির জলে খোলামকুচি এঁকে দিয়েছে ঢেউয়ের আলপনা। বিকলাঙ্গ অতীত ক্রমশ পাথর করে দেয় সব।শিমুলের ডালে নেমে আসে বছরের প্রথম বসন্ত। প্রচ্ছন্ন আগ্নেয়গিরির মতো উদ্বেগ উসকে দেয় জন্মদাগের উঠোন।

ওগো সর্বগ্রাসী, ভালোবাসায় যে বড়ো ভয়!


ধীরে ধীরে আগাছা শিকড় নামায়। ভুল মন্ত্রোচ্চারণের মতো শঙ্কা চিড় ধরায় হাড়ে। রজনীগন্ধা সুবাস হারিয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। দক্ষিণে নলখাগড়া দল পাকাতে পাকাতে ঝাঁক বেঁধে আসে।জ্বরে পুড়ে যায় পিঠ।

কালো বিড়াল আঁচড়ে দেয় দেহজবলয়।


শালগাছের পাশেই রাধাচূড়া। সাদা পায়রার দল সোনালি গমের শীষ নিয়ে বসে। চঞ্চল ঠোঁট। দূরে লাজুক শালুক পুকুরে ফুটতে ফুটতে আড়চোখে দ্যাখে উন্মাদ মাছরাঙা পাখি। গাছে গাছে শ্যামাকোকিল আকাশ ছুঁয়ে গান আনে। গোঁসাইপুর ডিঙিয়ে বেজে ওঠে একতারার সুর।

তবে কি বৃষ্টি এল এই!


অন্ধকারে চকচক করে ওঠে যোনি। যেন অভ্র ছিটিনো জলভেজা বালুতট। পায়ে রাবার গাছের আঠা। বৃষ্টি নামছে দেখে পেখম মেলে এগিয়ে আসে ময়ূর।

অন্ধকারে শরীর এগিয়ে যায় সাপের মতন


এই ঘন আলিঙ্গনের মাঝে রাস্তা বয়ে যায়। মৃত পালকের মতো মায়া ভাসতে ভাসতে আছড়ে পড়ে মাটিতে। কাঠঠোকরার নরম ঠোঁটে লেগে থাকে বুড়ো পলাশের রস। জাদুনগরীর জানালায় শোক চুপটি করে বসে। দু-চোখের দৃশ্য ভেঙে ভেঙে যায়।

প্রতি রাতে জোনাকিপোকা আলো নিয়ে অসুখ সারায়

 

Categories
2021-July-Poem

খুরশিদ আলম

গোলপোস্ট

অন্ধ আয়নার ভিতর মুখ দেখছি
দেখা অ-দেখা মুখের নিজস্ব ব্যাপার। আমাদের
শেষ দেউটি কবে নিভে গিয়েছিল হাতের পাঁচের মতো
তারপরেও গুনে চলেছি ক্রমপর্যায়।
কখনো ব্যর্থ প্রেমিক কখনো দাবা খেলার ছক।
এই যে এত এত ঘুঁটি সাজিয়ে নিরঙ্কুশ আশাবাদ ব্যক্ত করা
একের পর এক তাঁবু সাজিয়ে স্ট্রাইকার না ফরওয়ার্ড
অথচ পাশ ফিরে তাকালেই ফাঁকা গোলপোস্ট

জোড়া দাঁত

জোড়া দাঁত দেখলে আমার ভয় হয়
তীব্র কোনো জ্বরের অনুষঙ্গ
আমাকে ভাবতে শেখায় সাত-পাঁচের যোগফল
মানুষ ও ভাত যেভাবে দেশ, মানচিত্র ফুটিয়ে তোলে
তা আসলে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি
যার পর্দা সরালেই আবহমান কোনো নদী আর নদীর ভিতর কান্না

দেশ

ঝুলন্ত ব্রিজের মতো একটি দেশ চারখানা পায়া
টিনের ছাওনি
যার সমস্ত শরীরজুড়ে অসংখ্য দাগ
ঋণগ্রস্ত কাঁধ নিয়ে তবু সে দাঁড়াতে চায়
স্বপ্ন দ্যাখে
মোহভঙ্গ যুবকের মতো সেও চায় একটু ভাত দুটো রুটি

মাটি

মাটি আলগা হলে বোঝা যায়
শুরু অথবা শেষ
প্রতিটি সম্পর্কের শক্ত ভিতের নাম মাটি
আলগা হলে চিড় ধরে ভেঙে যায়
নির্মাণ বিনির্মাণের ভেতর যে-বেঁচে থাকে তার উৎস হল মাটি

সফল

ক্ষতচিহ্ন মাত্রই অবস্থান বদল করে
ভাবতে শেখায় দোষ গুণের পরিধি
আলো উৎসের সন্ধান
সফলতা মানে এক দৌড়ে আকাশ ছোঁয়া নয়
প্রতিটি সফলতার পূর্বে শিখতে হয়
এক-একটি সিঁড়ি বেয়ে ওঠার কৌশল

 

Categories
2021-July-Poem

বন্ধুসুন্দর পাল

ভিতরে

ভিতরে আলাপ, আর কত কাছে যেতে হবে!
শুকনো পাতার দলে
কাঠকুড়ুনির পায়ের আওয়াজ বেচে
নামিয়ে এনেছে যে আমাকে
তার অবসর কেন শুধু আমি একাই গ্রহণ করব!

সে কি আশ্রয়ের চেনাশোনা কেউ?
অথবা পালতোলা নৌকা, যার শুধু বিরহ দিয়েই মাথা ঢাকা
নিচে, প্রেমিক-প্রেমিকারা পয়সা দিয়ে একঘণ্টা সময় কিনে নিচ্ছে ইচ্ছেমতো…

তা দিয়েই পেট চলে অপূর্ণ নদীর
ভেসে যাই আমি যার নির্দেশে, অতলে
সেও কি ভিতরে ডাকে! আমি সাড়া পাই…

অথবা স্তনহীন বৃদ্ধা, যে, মাছের পেটের ভিতর
আজন্ম যৌনতা চাপা দিয়ে সে পালিয়ে বেরিয়েছে
নদী থেকে সমুদ্রের তলা ভেদ করে

আর তার উপর দিয়ে একটা শকুন কার যেন মরা-চোখ খুবলে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে
তাদের কি শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হইল…

বাহানা

ফুরিয়েছে গৃহকোণ, ফুরিয়েছে আলো-চাল
ফুরিয়েছে ব্যথা

এসো চিঠি খুলে চিনি, এটা কার হাতের-লেখা

চিনেছি নোলক পড়া নাকের বাগান
চিনেছি ভাতের ফ্যান
গড়িয়েছি বালিমাখা মুখের বেগম

এত যে ঐশ্বর্য, তা কি অশৌচের কেউ নয়?

এসো হে জীবন, আমাকেও ছুঁয়ে দ্যাখো,
কেমন তোমার অতিমারির বাহানা…

পায়রা

সাধনা বিলিয়ে দিচ্ছি, ফিরে তাকিয়ো না, প্রিয় মুখ। অথৈ অবজ্ঞার অনুষ্ঠানে পাতপেরে খেতে এসো আলো। তোমার নাভির নির্মাণকার্য শেষ হলে একটা পায়রা পুষব সেখানে। সারা গায়ে তখন অনুরোধের আসর বসবে। তোমাকে যারা অনুশোচনার মতো দেখতে বলে বিদ্রূপ করত চিলেকোঠার ওপার থেকে, তাদের শরীর বেয়ে আকন্দফুল ঝরে পড়বে। আমার শীতলতা গ্রাস করো, বর্ণা, এই জঙ্গল আমাকে অশৌচ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে তোমার কাছে। ব্যাপ্তির তলদেশ ফাঁক করে যে-ক-টা শুকনো কাঠ কুড়িয়ে এনেছি, সেগুলো একান্তই শুধু আমার। সেখানে যে-সব শব্দ জোর করে ভাগ বসাতে আসবে তাদেরকে বৈধব্য আগুনে পুড়ে মরতে হবে। আমার শরীরে কোনো সিঁড়ি নেই, তুমি যেখানেই পা ফেলবে সেখানেই পোড়া কাঠ দেখতে পাবে। এভাবেই এক পা এক পা করে পা ফেলতে ফেলতে, ক্লান্ত হয়ে যখন আমার চিলেকোঠার ছাদে গিয়ে একদিন বসবে, তখন সমস্ত পোড়া কাঠ পায়রা হয়ে পুরো ছাদ সমেত তোমাকে ঘিরে ফেলবে। তোমার আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই…

ক্ষমা

জবরদখলকারী বিদ্বেষের মনোরম আতিথেয়তা আমাকে স্বীকার করবে বলে আলোরা দরজার সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। আমার সারা শরীর তখন ঘুমে ঢাকা। অতল মিশিয়ে দিয়েছে যে, তার কোনো বিকেলের ফেরিওয়ালা নেই। সন্ধ্যেবেলার গুমোগন্ধে যে-কাঁথাটা লাজুক কবিতার নিম্নদেশে এসে বার বার চিৎকার করে বলছে, ‘আমি তাকে চিনি!’ তবুও রাজহাঁসের মনখারাপে পুকুরপাড়ে মেঘ করে আসে না। ঘাসেদের সংগমের শব্দকে কোনো পাগল আর প্রেমিকা বলে ডাকে না। তবুও তোমার পিঠ বরাবর যে-শব্দ গড়িয়ে পড়ছে আমার অতল ভেঙে, ক্রমশ নীচে আরও নীচে, তাকে তুমি ‘ক্ষমা’ বলে ডেকো…

সমঝোতা

আশ্রয়ের দিকে মুখ না ফিরিয়ে যে চলে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড পৃষ্ঠা ভরে, তার দিকে সময় হাঁ করে ঢোঁক গিলে নিচ্ছে। এই যে বিষম খাওয়া জলজ সময়, এই যে আলজিভে কবিতা লুকিয়ে রোদের পিঠে ছুরি মারা অবয়ব, যা তাকে সম্পূর্ণতা দিয়েও হিসেব করতে বসেছে, তার কোনো পটচিত্র নেই আমার এই ঘুমন্ত বিছানায়। আমার পাশ ফেরার আগেই যে-জানালা রোজ উলঙ্গ কাঙালপনায় অক্ষরের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছে, আমাকে দোষী সাব্যস্ত প্রমাণ করে আমার থেকে ভোরবেলা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, তার থেকে আমি কখনো সকাল ভিক্ষে করিনি ।

আয়োজনে যে-আলো শরীর ঢেকে দেয়, তারও তো বৈশাখী ঝড়ে উড়ে যেতে মন চায়। এই নির্ভরতার উপোসবেলা ভেঙে যে আজও প্রতিটা ঘরের দোরে দোরে সন্ধ্যে দেওয়ার জল পড়ার শব্দ শোনে তার কাছে থেকে একটা অন্ধকার চুরি করে পালিয়ে বেরিয়েছি। তুমি আমকে শাস্তি দেওয়ার ছলে একবার অন্তত জড়িয়ে ধরো, দ্যাখো, আমি কেমন বিচ্ছিন্ন হতে হতে একটা নতুন শব্দের মতো চুপ করে শুয়ে আছি তোমার কোলে। কেউ আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আর তোমাকে খুঁড়তে যে-সব শব্দকর্মীরা এসেছিল, তারা কেউ পারিশ্রমিক না পেয়ে জেলে হয়ে গেছে…

 

Categories
2021-July-Poem

সৌরভ মন্ডল

সেরে ওঠো সভ্যতা


খটখটে মটির ফাটল দিয়ে দুটো হাত
কচি সবুজ সকাল নিয়ে আসে দু-চোখে;
প্রথম কেঁদে ওঠা বিদ্রোহে
আদম-ইভের কামনা লেগে থাকে;
পরস্পর-বিরুদ্ধ; ভেতর থেকে বাইরে
পাপের সংক্রমণ ভালোবাসার কবচকুণ্ডল
পরিয়ে দেয় কাজলের টিপে।
নাভির অন্তর্লীন যোগ আলগা হলে
প্রথম কঁকিয়ে ওঠা যন্ত্রণায় থাকেন ‘মা’।

গতকাল জন্মদিনের বাসি কষা মাংস
ডাইনিং টেবিলে; আহারান্তে
ইল্বল ডেকে ওঠে: “বাতাপি! বাতাপি!”
খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক নষ্ট করে
প্রতিটি নতুন সম্ভাবনা।
আশ্রয় আশায় ছোটো ছোটো ডাল-পাতা:
কেউ যদি ভালোবেসে বেড়া এঁকে দেয় চারধারে।
বাড়ন্ত বেলায় হাত এগিয়ে যায়
পড়শির নিষিদ্ধ প্রদেশ ছোঁবে তাই;
সব বেড়া ভাঙতে চায়,
ভালোবাসা ঘৃণায় বদলে যায়।

খাবার ডেলিভারি বয় লাঞ্চ-প্যাকেট হাতে
পুরোনো বন্ধুর দরজায়;
উপযোগিতার বাজারে আত্মীয়তা
অপ্রাসঙ্গিক। “রেটিংটা প্লিজ
দিয়ে দিন স্যার।”
সুস্বাদু বিরিয়ানির গন্ধে, উষ্ণতায়
মিয়ানো ঝালমুড়ির স্মৃতি শ্বাসরুদ্ধ;
স্বপ্নরা রোদের সাথে যুদ্ধ করে করে
ক্লান্ত হয়; কত সূর্যমুখী
ভরদুপুরের আশ্রয় খুঁজে চলে
কল-বয়ের রোমশ ক্লিভেজে।

বিকেলের ফ্ল্যাট ছোটো হতে হতে
খাঁচা হয়; খাঁচার পাখি উড়িয়ে দিলে
দেদার আকাশ!
আকাশে মুক্তি আছে, আছে ভয়ও।
সূর্য লুকিয়েছে পাটে। “ইকারাস!
আরও, আরও উঁচুতে উড়ে যাও,
আকাশে আকাশ হয়ে যাও।”
পড়ন্ত বেলা; মোমেরও ক্লান্তি আছে,
ঘসা লেগে লেগে সন্ধি আলগা হয়ে গেলে
ডালে এসে বসে পাখি;
দুপুরে স্খলিত বীর্য জল হয়ে আসে
বিকেলে; আশ্রিত আশ্রয় হয়ে ওঠে।

শেষ বেলায় পাখিরা বাসায় ফেরে;
গাছের ডাল কিংবা খাঁচায় কোনো তফাত নেই
অন্ধকারে; রঙের কোনো ভেদ নেই,
সব ক্ষমতার রংই কালো।
রোদ্দুর-ধোওয়া পালকের আলো নেভে কবে,
কেউ তার হদিশ রাখে না।
যারা কথা ভুলে যায়, গান ভুলে যায়,
তাদের মিছিলের একক স্লোগান রোদের মতো
ফুরিয়ে আসে আপোশের ঘরে
সহবাসে; ভালো থাকার লোভে
হেজে গিয়ে নিঃশেষ হয় খোঁয়াড়ে।

গাছ আর পাখির রসায়ন বাঁচিয়ে রাখে
জন্ম-চক্র; ছানার জন্য নিয়ে আসা বীজ
খসে পড়ে মাটিতে, উর্বর মাটি
গাছের জন্ম দ্যায়; সেই গাছই তো একদিন
বাড়ি হয়ে ওঠে, বাড়িতে বাড়ে ছানা।
বাড়ি আসলে ঘটনাচক্র;
এক অসংগঠিত বিদ্রোহ।
কত ঘর ভেঙে যায়, ভেসে যায়,
পুড়ে ছারখার হয়; তবু সভ্যতা
গড়ে তোলে বাড়ি, শূন্যে;
তঞ্চক সভ্যতা কি হিসেব রেখেছে
কত পাখি চলে গেছে বনে, অন্তরীক্ষে, সমুদ্রে
মিথ্যে নিয়মের পিছনে লাথি মেরে;
অভিশাপ ছুড়ে গেছে কত!
সেরে ওঠো সভ্যতা; বেঁচে থাক
মানুষ।