Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

রাজদীপ রায়

প্রাণাধিক দেবতা আমার

কী দুঃখ কী সুখ সবেতেই অবিচল থাকে এই কাঠের শরীর—
ঘর আজ বন্ধ। কেউ আসবে না। রাস্তায় জুতোর শব্দ, তারা কেউ
আসবে না ঘরের ভেতর। এই সময় যদি রক্তখাকি রোদ্দুরের কথা
ভেবে শিরা কেটে রাখি, তবে বেশ হয়! আমি পড়তে বসে যাই আমার
নিজস্ব মৃতদেহ ছড়িয়ে— তার বুকে মাঠ রেখে অনুভব করি
পৃথিবী অনেককাল আগেই মরেছে; এখন শুধুই সেই মরা নিয়ে টানাটানি—
দুর্বল হৃদয় কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল; তারা চলে গেছে পাহাড়ে।
কামুক কিছু মানুষ সমুদ্রের ধারে গিয়ে পোশাক খুলে দিয়েছে।
কালজয়ী হবার কথা এখনো ভুলতে না পেরে
বারবার মাথা পুঁতে দিচ্ছি নরম বালিশে;
এই দুঃখ কে বুকে নেবে?
এই মৃতদেহ কে পুড়িয়ে দেবে?
টবের সামনে সমানে দাঁড়িয়ে আছে বেড়ালটা, যাকে চাইলে সমস্ত মনের কথা
বলে দিতে পারতুম। খুব দেরি নেই পৃথিবীর অন্য এক নামকরণ হবে—
আমরা সেই আনন্দফোয়ারার মুখ রেখে সেলিব্রেট করব পুংজন্ম…
চেনা বারান্দা থেকে রুমাল উড়ে আসবে,
তারও অনেক ওপরে
প্যারাস্যুটে ভাসমান ধ্বংস হয়ে যাওয়া চাঁদের ভগ্নাংশ—
শেষবার বলো, তুমি এই টিপ্পনীর ভাষাকে অন্তত
কবিতা বলে ভুল করোনি।


সহজ-সরল কথা কে আর শোনাবে? আপনার মতো?
জ্বর হলে মাথায় কে পট্টি দিয়ে দেবে…
আহা কুহকের অতিজাল ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে যে বয়স্ক ঘুড়ি
আমি জানি কোন আকাশের কাছে তার কামভাব সংশ্লিষ্ট আছে!
তার ভিজে যাওয়া মুখে সূর্যাস্তের শর্করা ছড়িয়ে…
মানুষ সহিষ্ণু হবে— কথা ছিল— দুঃখের কথা বলবে গলা জড়িয়ে।
কিন্তু ইতিহাসকে সান্ত্বনা দিয়ে সে এখন কোন পাড়ায় ঝালমুড়ি
বিক্রি করে? বলতে পারেন সে কেন কথা বলে এত জটিল ভাষায়?

স্তাবকের আদিখ্যেতা বুঝে-বুঝে অণ্ডকোষ গাঢ় হয়ে যায়, দেখি
রাত্তিরে পেচ্ছাপ করবার মতো একটি সরল অনুভূতিও আজ
আকাশের কাছে এসে শুকতারা উপহার চাইছে—
অতএব সময় নেই।

আমাকে শেখান ভালোবেসে,
কাকে বলে ভিটামিন-সি, কাকে বলে প্রসন্ন কৌতুক
কাকে বলে অচিন রাগিণী, কাকে বলে তারাপদ রায়…


এমন দুঃখ দেবেন না, যা থেকে মুষড়ে পড়ি, আপনাকে আলবিদা জানাই—
বলি, এতদিন কাছাকাছি ছিলেন বলেই সরলতা জানা হল না…
আজন্ম কূটচিন্তার পাঁক আমাকে পাঠিয়ে দিল স্থাপত্যের দিকে
খিলান, গম্বুজ ঘুরে বুঝলাম এসব পূর্বপুরুষের কীর্তি।
আমরা এদের জিন বয়ে নিয়ে চলেছি সমানে, নারীসঙ্গ বর্জিত এক
সকালের কাছে, দাঁড়িয়ে দেখেছি কীটনাশক আমাদের শরীরে বেমালুম
পরাজিত। অতএব এখন নিশ্চিন্তে পৌরুষ ত্যাগ করা যেতে পারে—
বুঝতে পারেননি আসলে মাথায় শুধুই ঘিলু নয়, কিছু দ্রাবিড় সভ্যতাও ঘুমিয়ে ছিল।
তার ঠাটবাট আর ঠাকুমার গল্পের মতো দুটি মনমরা অথচ ফুর্তিবাজ মেয়ে।
মনে পড়ে, তাদের একজনকে অহিংসার পথ ছেড়ে দেবার সময় ভালোবেসেছিলাম
খুব, তারা বলেছিল, আপনার মূর্তি বসানো হয়েছে তেমাথার মোড়ে—
ওখানে লোকজন বিশেষ যায়-টায় না। দূরপাল্লার বাস দাঁড়ায় না।
শুধু একটা পাগল আকাশের দিকে তাক করে বাটি নাড়ে,
আর বিড়বিড় করে বলে: হে প্রভু, পরমেশ্বর, জুতোর মোলায়েমখানি
খুলে দিন না!
একটু পরাক্রম চাটি…


ভীতু আকাশের নীচে তস্য ভীরু চাঁদ, তার নীচে রোঁয়াচঞ্চু রেশনভিমানী
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছে একটা আরশোলা ক্রমশ গিলে নেবে বলে
এগিয়ে আসছে— অপদার্থ বাতাস কেমন শান্ত, লঘু
যেন খোলা মুখে আর একটু পরেই কেউ কীটনাশক ঢেলে দিয়ে যাবে
কেউ বলবে সন্ধ্যে হল, মুখ ঢেকে নাও— এখনই মৃতদেহ নিতে আসবে
নিয়ো শ্মশানের ডোম, অবচেতনের দেশে তাদের প্রত্যেকের হাতে
প্লাস্টিকের মেরুদণ্ড কাঁটা-চামচের মতো পরখ করবে— কার কত আয়ু বাকি
কে কত ইন্দ্রিয়পরায়ণ… জিভের অসাড় দিয়ে ছুঁয়ে থাকি সে-সব কাহিনি
শ্মশানযাত্রীরা দেখছে, কিছুটা আড়াল থেকে বিড়ি মুখে, স্নিগ্ধ আততায়ীর মতো।
তাদের প্রশ্নের কোল ঘেঁষে উঠে গেছে ছদ্মবেশী তারা; যার দূরাগত আলো দেখে
বুঝতে পারা যাচ্ছে না, জীবিত না মৃত, ঠিক কীরূপ প্রতিমা দিয়ে গড়া হবে
সত্যের স্বরূপ… এখন ঘুমোতে চলো, ভয়ের উপনিবেশে সবচেয়ে বেশি
শান্ত থাকে আবহাওয়া। প্রতিবেশী মাঠে রক্তদান শিবির বসেছে— মানুষ এসেছে সবে
ফিরে যাবে বলে; নাড়ি টিপে রক্তচাপ বোঝে সুঠাম ডাক্তার: ভয় কিসে?
আমার চোখের জল এখন ধূলার চেয়ে অতি সহজেই ভেঙে ভেঙে যায়!
যেন কোনো মহাপুরুষের পদধ্বনি কথা বলে:
এসেছ এতটা পথ? থেকে যাবে? তাহলে রসিকপ্রাণ হও।


জন্মের অনেক আগে আমরা সব পাথর ছিলাম।
খিলানে খিলানে তার মৃদু রসিকতা ফুটে উঠত নক্ষত্রের মতো—
কারা এই সৃষ্টিকাজ পছন্দ করেনি, কারা একে অশ্লীলতা মনে করে
আলকাতরা লেপে দিয়ে গেছে নাক-বরাবর… স্থির অনুপাতে
বসে দেখেছি সেসব পুড়িয়ে দেওয়া শিলালিপি থেকে
গতিমান অশ্ব, রাজার ধনুক আবার শরীর পাচ্ছে—
এইসব রাতজাগা তারাদের, যারা ভুলেও দেখেনি,
তাদের অসূয়া থেকে জেগে ওঠা আতুপুতু প্রেমের কবিতা
জয়টিকা দেওয়া হয়েছে তাদের মাথায়—
এরপর এইভাবেই লিখতে হবে, পৌরজন কেঁদে ভাসাবেন।
কালজয়ী এ-সব কর্মের সামান্য আগে তোমার প্রভূত জমি
ফাঁকা পড়ে আছে, প্রখর শয়তানি দিয়ে লেখো তো জমিয়ে
বানাও— বানাও নষ্টামি মাখানো কোনো তুমুল উপাখ্যান।
ভণ্ড আস্তিকের দেশে ওই নকল লেখাও কারা ভালোবেসে
মাথায় করবে— কড়া রোদে লণ্ঠন লেলিয়ে বলবে
সাবধানে যেয়ো ওগো প্রাণাধিক দেবতা আমার…


তুমি সত্য বলে দেবে কীভাবে লিখিতে হয়—সত্যিকার উপকথা
মর্ষকামী শোকের উল্লাস। কিংবা বড়োদিন আর ছোটোভাইমেজোভাই
ছিপ ফেলে বসে আছে, কখন নিরন্ন মাছ ধরা দেবে
সরকারি বিজ্ঞপ্তি এড়িয়ে—

ধারাপাত শেষ হয়ে গেছে, গ্রামার মুখস্থ করে উপকণ্ঠের ছেলেরা
সব বাড়িভাড়া বাকি রেখে ফিরে গেছে দেশে,
এখন শীতার্ত বোধ— জীবিকা হারানো
তুমুল অনিশ্চয়তা নিয়ে টোকা মারে, দেখ ঢাউস চাকরির নীচে
মারা গেল তোমার গ্রহিতা। সরলতা আদতে বিজ্ঞান— প্রসন্ন, চতুর
অনাহার প্রসবের কিছু আগে

ভোর হয় হয়… কালপুরুষের ছায়া ঘিরে ধরেছে তালবন
আতঙ্কিত যূথচারীদের রক্তের অভাবে আকাশ শুকিয়ে গেল!
তোমার এ-সমস্তই মনে হল প্রাকৃতিক রসিকতা;
সত্য কী? কীভাবে তা ঘটে, এইসব ভাবিতে ভাবিতে অসহায় আমি
বিড়ি ফুঁকে, ঢোঁক গিলে, খানিক বিষম খেয়ে—
পিণ্ডদান করে এলাম বাংলা কবিতার।

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

পার্থজিৎ চন্দ

রক্তবীজমাতা

যুদ্ধে যাচ্ছি, তার আগে মায়ের মন্দিরে একবার প্রণাম করে যাই। ছোটো ছোটো যুদ্ধ, গেরিলাযুদ্ধ… অস্ত্রের হাতে বন্দি আমরা নিছক সৈনিক। মন্দিরের সামনে রক্তমাখানো জবাফুল-হাতে লম্বালাইন, শত্রুমিত্র সবার একই মাতৃ-আরাধনা; ইনি ঈশ্বরেরও মা অসুরেরও মা…রক্তবীজমাতা। যুদ্ধক্ষেত্রের এক ধারে দেবীকে সাময়িক প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সৈন্য নিধনের দিনে ইনি শত্রু-মিত্রে সৈন্য সাপ্লাই দেন। যুদ্ধে যাচ্ছি, মায়ের মন্দির থেকে সোনার পালকি করে, মাথায় রাজছত্র, দেবীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আবার কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। মিলেমিশে আছে তার পালকিবাহক, সহাবস্থানে আছে সেবাইত। হুম হুম করে তারা মন্ত্র পড়ছে, একই মন্ত্র, ‘সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ…’, মাঝ-রাস্তায় তারা শুনতে পাবে গর্ভযন্ত্রণা তীব্র হচ্ছে, মোচন জরুরি। শিবিকা নামিয়ে তারা মুণ্ড কাটাকাটি যুদ্ধ করবে আর রক্তবীজমাতা কয়েকটি প্রসব করে কিছুটা তৃপ্তি পাবেন। তারপর দীর্ঘ যুদ্ধ, রক্তবীজমাতার যোনী থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসবে ঈশ্বর-অসুর। আমি তালবনে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবি, এখানে সবাই তাঁর অবোধ অথবা সুবোধ সন্তান, কে তবে দেবীর কাছে প্রতিদিন দিয়ে আসে এত জন্মবীজ!

শরীর

‘উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে’, আত্মা হননও করে না, হতও হয় না… দুপুরে মেঘ করলেই এই শ্লোকটির কাছে বাজে পুরানো রেডিয়ো। বাজতে বাজতে একদিন তার লাল-শাদা এভারেডি গলে যায়… রেডিয়ো চুইয়ে বিছানায় পড়ে ব্যাটারির রস, ঠিক যেন শয্যাগতর মূত্রপ্রবাহ। একদিন মানুষের শরীর থেকে আত্মাকে বের করে এনে ভরে ফেলা হবে ছোটো ছোটো ক্যাপসুলে; টানা করিডর, হাসপাতালের আলো, ট্রলির ওপর শুয়ে আত্মার গলিত ক্যাপসুল। কোটি কোটি ক্যাপসুল, লাল আর শাদা এভারেডি বেরিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে তারা শরীরের ভেতর ঢুকবে, একটি শরীরে ভুলক্রমে দু-টি ক্যাপসুল ঢুকে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটাবে। লাল ও শাদা এভারেডির মধ্যে ঘনিয়ে উঠবে দ্বন্দ্বমূলক সহাবস্থান। ধীরে ধীরে গলে যাবে আত্মার ক্যাপসুল, কিন্তু শরীর থাকবে। নতুন নতুন আত্মার কাছে তখন সুযোগ থাকবে শরীর বাছার। মোট কথা, সেদিনই যথার্থ প্রমাণ হবে, শরীর অবিনশ্বর— সে হননও করে না, হতও হয় না।

খাদ্য

এই সেই নিষাদীর গ্রাম, রুক্ষপথের ধুলোঝড় পার করে আমাদের গাড়ি থেমেছিল বিকেলবেলায়। বনজঙ্গলভরা টিলা, শরপঞ্চ ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রসন্তান এ-রাস্তা ধরেই মদ আর মাংসের লোভে ঢুকে পড়েছিল জতুগৃহের কালো গহ্বরে, তাদের সঙ্গে ছিল পোষ্য রাজহাঁস। ক্রূর অভিসন্ধিময় হত্যার পাশে, নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রের দগ্ধ শরীরের পাশে পড়েছিল সেই রাজহাঁস। সন্ধ্যে নামছে, বিরাট দিঘির জলে উড়ে যাওয়া পাখিদের ছায়া, জলের ভেতর সেই ছায়া যেন ঝলসানো হাঁসের শরীর। আমাদের সমস্ত অক্ষরের গায়ে ছায়া-ফেলা ঝলসানো হাঁস, তার ঠোঁট থেকে গড়িয়ে নামছে শ্লোক— অস্ত্র ধরো, অস্ত্র ধরো, এ-বনের ভেতর কোথাও ঝলসে উঠছে হাঁসের মাংস ঝলসে উঠছে তোমার খাদ্য

ভাষাশাবক

তারপর দূর কোনো স্ট্যাডেল— গুহার দিকে জেগে ওঠে মাছ-জীবনের ভোর। গলিত নৌকো ও নোহার হাড়গোড়… দীর্ঘ জড়ানো স্নায়ু মাংসপিণ্ড সমুদ্রগাছের ছায়া গুহামুখে। বিগত প্লাবন শিকড় উপড়ে এক কালো হাঁ-মুখের শূন্য রেখে গেছে। তার কাছে হাঁটু মুড়ে বসে গুহার ভিতর নির্মিত হতে দেখি কিমাকার জান্তব আদিম শরীর। সে মৎসশিকারে নেমে যায় নদীর গভীরে। নোহা ও নদীর কাছে শুয়ে থাকা মারমেড তার গর্ভে ধরে রেখেছিল এক ভাষাশাবকের ভ্রূণ। স্ট্যাডেল-গুহার গূঢ় অন্ধকারে ভাষাশাবকের গায়ে ফুটে ওঠে টোটেম ও ট্যাটুর গান। মূর্ত টোটেম ও বিমূর্ত গানের দ্বৈরথে যজ্ঞসম্ভূত তমসার জন্ম হয়েছিল। ফলে তমসার ডলফিনগুলি বিমূর্ত লাল বল নিয়ে সারারাত পাক খায়। ঘুম-সারেঙের ছিন্ন নৌকাটিকে ঘিরে পাক দিয়ে ঘোরে। জলের ভেতর মাছ-জীবনের দিকে হেঁটে আসে সিংহপুরুষ। তার অস্ফূট গান সারেঙের শ্রবণমাত্রার ঠিক নীচে ভেসে থাকে স্থির; লুব্ধক। অনিবার্য, অথচ সুদূর। সারেঙের গান ও আর্তনাদে তমসার সচকিত ডলফিন। যেন মাথাটুকু তুলে, নাসিকারন্ধ্রটুকু তুলে মহাপ্লাবনের দিনে ভেসে যাওয়া প্রাণীদের জগৎ-সংসার। তাদের মাথার কোটরে ঢুকে যাচ্ছে সারেঙ-শব্দ আর ভাষা-তমসার নীচে তার দেহটিকে কামড়ে ধরেছে সিংহপুরুষ। এই মূর্ত টোটেম ও বিমূর্ত গানের মাঝখানে রক্তলাঞ্ছিত দু-টি শুশুকের মুখ; যারা ভাষাশাবকের খাবার খুঁজতে এতটা এসেছে

হত্যা

সচেতন চর্যাপদে তোমাকে শপিং-মলের কাছে রেখে দিয়ে যাই। তুমি ঘুরে ঘুরে দেখো থাই-ফাটা জিন্স ম্যানিকুইনের ঠেলে ওঠা বুক (যদিও ইউনিসেক্স), কিছু বিনিময় ছাড়া কী-আশ্চর্য, তুমিও শপিং-মলের অমোঘ অংশ হয়ে ওঠো। লক্ষ বছরের ইতিহা্সে, শুধু দর্শনে এ প্রথম বাণিজ্য সম্পন্ন হল। যৌনতাও। কাহ্ন-ভুসু্কু ভাষানদীতীরে মূর্ছা গেলেন। রক্তমাংসমেদ ছাড়া নগরীতে বিবাহের বাদ্যি বাজল। ভুসুকুর খুলি থেকে নিয়ো-লিবার‌্যাল মদ চেটে খেতে খেতে ফেরার প্রহর ঘনিয়ে এসেছে। সচকিত ছেলেমেয়ে, ও.বি-ভ্যানে চেপে যারা বনভোজনের দিকে এসেছিল তার ফিরে যায়। তার আগে তছনছ করে যায় বাস্তুতন্ত্র। নৌকার সন্ত্রাসে নদী থরথর করে কাঁপে সচেতন চর্যাপদে তোমাকে শপিং-মলের কাছে এক অচলায়তনে রেখে দিয়ে আসি

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

পঙ্কজ চক্রবর্তী

ধুলোবালি

মেঝেতে ধুলোয় প্রতিদিন ভাঙছে সংসার। আমি টের পাই অন্যমনস্ক বাতাস দু-একটি বাসনপত্র নাড়াচাড়া করে। জীবন প্রস্তুত নয়। শূন্যতা ভরা বেলুন উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। লেখা নেই, শুধু এক চতুরতা এতদিনে লায়েক হয়েছে। ঐ তো ভাসছে মেঘফুলের তরী। দৃশ্যমানতায়। তোমার সিঁড়ি বেয়ে এসেছে খ্যাতি, স্বল্পবাক্ মানুষের ভাঙাচোরা যেটুকু দিগন্ত।

ধুলোবালি, কতদিন রাতে আমি মাথায় বুলিয়ে দিয়েছি এই হাত। তবু ভোরবেলা মানুষের সংসারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছ প্রতিদিন।

পিতামহ

শতাব্দী প্রাচীন একটা জানলা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন আমার পিতামহ। আর লোকজন এলে গল্প করতেন বাসি বোয়াল মাছের ঝোলের। আস্তে আস্তে তার চশমা ডুবে যেত জলের গভীরে। মাঝরাতে জ্যোৎস্নার উঠোনে ঘুরে বেড়াত নেত্রকোনা সাবডিভিশন। ধানখেতের মাথায় মরা জামগাছ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন অনেকদিন। কথায় কথায় চালের হাঁড়ির ভিতরে দেখতে চাইতেন এই স্মৃতি কতদিন পর্যাপ্ত। আমার সমস্ত বই তার বানান থেকে দূরে উদাসীন দুপুরের চিৎকার।

সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের এক নাবালককে তিনি শাসন করতেন একফালি বারান্দায় বসে।

সীমানা

একটি কাঠবেড়ালি মৃত্যু বসে আছে নিমগাছের ডালে। আমি ভেবেছিলাম তোমার রেলপথ এমনই বিস্তৃত। জামগাছের আড়ালে ঐ তো স্টেশন, টিকিটঘর। জনহীন দুপুর। শুধু ঘাসের জঙ্গলে বসে একজন বুড়ো মানুষ দিবাস্বপ্নের ভিতর হাসছে। এইসব জীবন বিপ্লব থেকে বহুদূরে। এমনকী শ্মশানের কাঠ তত মধুময় নয়। শতাব্দী প্রাচীন কাঠবেড়ালি তোমাকে আদেশ করি স্পর্শটুকু নাও।

সরে দাঁড়াও ঈষৎ ট্রেনের ঐ বাঁশি। আরও বেশি গাছপালা, কয়েকটি স্টেশন পাওয়া যাবে। তোমার কাঁসার থালায় বরিশালের রোদ্দুর। জলের নাভি থেকে উঠে আসছে রামকৃষ্ণ উদ্বাস্তু কলোনি।

দূরদেশি

ওগো ছোটোখাটো দুঃখ ভালো মানুষের উপেক্ষার ভিতর দীর্ঘ শীতকাল ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার অলীক দরজা পেরিয়ে যেটুকু ফসলের ছায়া, প্রস্তুত হই। একজন লিপিকর জলের ছায়ায় মুখ রেখে চলে গেছে দীর্ঘকবিতার দেশে। আমি কি ভোরের পায়চারি থেকে তুলে নেব সফল জীবন? মহৎ শিল্পের পাশে বসে ঐ যে কুকুর তুলে নেয় বাসি বিস্কুটের ছায়া। আমি শুধু মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখেছি খড়কুটো, মাছেদের অসুখী জীবন।

এমন তো হতেই পারে বড়ো দুঃখ প্রতিবেশীর ঘরে আসন পেতেছে। আমি যাচ্ছি যাই করে করে আজীবন পেয়ারা গাছের নীচে রাত কাটালাম।

দেবোত্তর

১৮৫৫, তোমার সোনার ছটা আমাদেরও গায়ে এসে লাগে। ছোটোখাটো ঘরের কাজ আর বাসন ধোয়ার জলটুকু ছাড়া এই জীবন অপরাধী, উচ্ছিষ্ট আহারের মতো প্রতারক। মন্দিরের গায়ে, মানতের ঢিলে শুধু তো প্রার্থনা নয়, কামনাও থাকে। থাকে অভিশাপ। কয়েক পুরুষের ভিজে গামছার নীচে রক্তের শ্রাবণ। জামগাছের নীচে জামাকাপড় ইস্তিরি করছে একজন দেহাতি মানুষ‌। তুমি তার কেউ নও। শুধু এক দালানের সিঁড়ি বুকে চেপে হাঁটে চতুষ্পদ।

আজ দেবোত্তর সম্পত্তির দিকে বাড়ানো সমস্ত হাত খসে গেছে। ওগো চরাচর, ১৮৫৫, আজও মানুষ তেমনই পাথর, শুধু এক ভ্রমণকারীর খাতা স্থাপত্য টুকে রাখে খুচরো অভিমানে।

শ্রমিক

টের পায়, ব্যক্তিত্বহীন মানুষ টের পায় শহর তাকে গ্রহণ করেনি। বন্ধ কারখানার বাতিল যন্ত্রপাতির ঘরে এখনও দু-একটি গেঞ্জি আছে তার নামে। প্রতিটি সূর্যাস্তের চুম্বন। দেখে মনে হয় খালি পায়ের ভ্রমণ। শুধু এক চায়ের দোকানদার মধ্যস্বত্বভোগী। দিনের পর দিন যায়। আগাছার পাশে বুনোফুল বেড়ে ওঠে রোজ। একদিন ফিরে যেতে হবে ঘনিষ্ঠ অন্ধকারে উটের মালিকের দেশে।

তবুও জলের কাছে ছায়ার মানুষটিকে দেখে তার আশ মেটে না। দেশান্তরের জল। তার নাভির ভেতরে রাখা আছে তালাচাবি বন্ধ কারখানার।

রাতের শহরে

নিজের ছায়া বিক্রি করে এই শহরে পড়তে এসেছি। অন্ধকারে মানিব্যাগে অবশ্যপাঠ্য বইয়ের চিরকুট। গম্ভীর এক লাইব্রেরিয়ান চুলের মুঠি ধরে দেখে নেয় ছদ্মবেশী পাঠকের ঘুম। তারপর খাঁচা ভর্তি এক ঝাঁক পাখি রেখে যায় টেবিলের ওপর। ফোর্থ ক্লাস স্টাফের সঙ্গে রফা হয়। দুস্প্রাপ্য বইয়ের পোকার জীবনের পিছুপিছু হেঁটে দেখি সামনে পথ নেই। শুধু এক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের নির্বাচিত দেহটুকু নিয়ে হাসির ফোয়ারা। ফুটপাতে অলৌকিক জেরক্সের দোকানে আলো জ্বলছে এই মধ্যরাতে।

আমি দেখি দুপুরের ঘাম, অবশিষ্ট ভাতের নীচে আতসকাচের এক গ্রাম। বহুদূর থেকে পড়তে এসেছে রাতের শহরে।

স্বর্ণযুগ

অর্থহীন শব্দের কুয়াশা, আমি রাজপথ ছেড়ে নেমেছি তোমার গলিপথে। দেখছি মানুষের ভিতর এক উট চলেছে আলোকবর্ষ সুদূরে। কামরাঙা গাছের মদিরা। ভাঙাচোরা মানুষ মাটির দাওয়ায় বসে পাঁউরুটি ভিজিয়ে নিচ্ছে চায়ের গেলাসে। আমার সমস্ত ধারবাকি তার বুকের পাঁজরে লিখে রাখি। মহৎ শিল্পের পাশে এই ধুলোমাটির জীবন বলছে তোমার মুখর ছায়ার কোনো বিকল্প নেই।

উটের ছায়ায় চলেছে বেঁটে মানুষের বউ। তাকে কিছু বলার আগেই বুঝি কথা শেষ— শুরু হল তোমাদের স্বর্ণযুগের সব গান।

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

রাণা রায়চৌধুরী

বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে


ঐ লাভ চিহ্ন উড়ে যাচ্ছে
ধরো ধরো, ও যে বিষাদের প্রতীক
ও যে অভ্রান্ত অভাবের বাড়ি

ওকে আটকে রাখো। ওকে ভয়ংকর তালাচাবির নিভৃত
আগুনে সাজাও।

এই লাভ চিহ্ন
মায়া ও বাসনা ঘেরা উদ্ভ্রান্ত এক
পাখির পালক, অপলক আকাশের নীল দিকরেখা

ধাক্কা ও আকাঙ্ক্ষা মাখা এক
বৈদ্যুতিক দূরবীণ, ওই শরীরে শরীর মেখে
কাঁদছে ও

ওকে রুমাল দাও, আর দাও সন্দেহের হ্যারিকেন

ওই উড়ে যাচ্ছে ও
গায়ে তার বাতাস আর, আর গান লেগে আছে –
বিরহের ব্যস্ততায় ওই বাথরুমে ঢুকল, হিসি ও সন্ধ্যার
সন্ত্রাস ওকে শান্ত করুক…

গদ্যের কারিগর ওকে দিক ঘাস
আর এফএম রেডিয়ো
তেহরানের বাতাসে ভেসে যাক সে


যারা বাইক চালিয়ে যায়, তাদের আমার
ভালো লাগে। তাদের গায়ে ও মনে
অজগরের চামড়া, বনজ সহজ গুল্মলতা,
আধুনিক আসবাবের মতো গতি আর
তীব্র আকাশ কাঁধে উহাদের চলে যাওয়া…

দেখি আমি

দেখার চোখ দিয়েছিল যে সেও চলে যায়
গানের গা থেকে পাতা খসে পড়ে
ছোটো পিশি পাস্‌ড অ্যাওয়ে বলে ট্রান্সমিটারে আগুন
জ্বলে ওঠে, গানের গা থেকে ছোটোপিশি খসে পড়ে

দেখি আমি

ছালবাকল ওঠা একটা জীবন
যাকে ট্রেন থেকে দেখা অচেনা গ্রামের
মতো মনে হয়, ওইখানে মেজদা সরোজিনীকে
জড়িয়ে শুয়ে ছিল, মেজদার বিছানায়
বাইকের চাকার দাগ
সরোজিনী ঘষটে ঘষটে মৃতদেহ হয়ে ওঠে

মেজদার লিঙ্গ যেন
ভয়ংকর লেপার্ডের মতো
অদৃষ্টের দিকে চেয়ে থাকা

হে বাইক, বিড়াল কাটা রাস্তায়
এত মেজদা ও সরোজিনী কেন আজও?
হে বাইক, তোমার গর্জনে কেন এত
আত্মত্যাগ লেগে আছে?


মোমবাতির একটা দীর্ঘ কালো ছায়া
দেখা যাচ্ছে।
একজন ঝুলে থাকা মানুষ যেমন
ভাল্লুকে রূপান্তরিত হয়।

একটা বিপরীতমুখীরেখা তোমার
আমার সবার জীবনে আসুক।
একটা রিভার্শাল টার্ন।
ষাঁড়কে দেখা যাচ্ছে ওই প্রস্ফুটিত
ফুলের মতো, আলোর মতো।

জিলিপির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
পাত্র ময়রার দোকানের এক নম্বর
কারিগর, ঈষৎ চুতিয়াও সে, সে একদিন
মিষ্টিকে তেতো বানাবেই।

বুল ভার্সেস বিয়ার ফাইট ইজ
কন্টিনিউড।

আরও নীচে থেকে, খাদের গভীর থেকে
একদিন হঠাৎ আমাদের লালায়িত ষাঁড়
উঠে আসবেই, সঙ্গে চাঁদের ক্ষতবিক্ষত
মায়া ও ভালোবাসা।

জিলিপির বিয়েতে একটু বেশি খাওয়া
হয়েছিল, আমাদের সবার।

আমরা বেশি বেশি খাব বলে ষাঁড়কেই
ভাইজান ভেবেছি চিরকাল…


ভাইমাডা পঞ্চাশ
ইস্টামেট পঞ্চাশ/পাঁচশো
অ্যাটোরভা দশ
কঙ্কর কর দুই দশমিক পাঁচ
ডক্সোলিন চারশো
ডুওলিন দুইশো
বুদামেট দুইশো

জাপিজ দশমিক পাঁচ
Telekast L
কোয়াশ
পটল
ঝিঙে
লঙ্কা এঁচোড়ে পাকা কদুলি

আটান্ন প্লাস
দিবানিদ্রা
ভোরের দুঃস্বপ্ন
মনখারাপ
মা নেই
বাবা নেই
আজ শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি লাভ
আজ মাতুলালয়ের শোকলাভ

একটা সাইকেল
কেরিয়ারে চৈতালি হাওয়া
চাকায় পাম্প কম
সামনে বাম্পার

মেয়েটি সুন্দরী
কিন্তু তিতিরের বয়সি
যাক গে যাক
মুখে মাস্ক
রুমালে কফ ও সিকনি
আধার ও প্যান নম্বর মুখস্থ

তবু রাত আর শেষ হয় না
ভোরের ফার্স্ট ট্রেন ক-টায়?
শিয়ালদা থেকে মেডিকেল কলেজ

ক্লাস ফোরের দিনগুলো
মনে পড়ে


আচ্ছা ভালো কথা, বেগম আখতার তুমি
শুনেছ? আচ্ছা গীতা দত্ত? সায়গল? আসলে
ভ্রূণাবস্থায় আমরা ছিলাম সুরে ভেসে মায়ের
পেটে। আমরা সুর পান করতাম। গর্ভাবস্থায়
মা-ও খেত গীতা দত্ত মা খেত সায়গল—
ঝাল-মশলা ডক্টরের বারণ ছিল— মা
সে-বারণ শুনে শুধু সুর খেত, গলাগলা সুর। বাবা
নামিয়ে দিত তার খুশি খুশি শরীর থেকে— এই
যে শিক্ষিত জঙ্গল আমাদের; এই যে
উচ্চ-শিক্ষিত বন্যরা গীতা দত্ত-র সুর দাঁতে
ছিঁড়ে নিয়ে পালাল ভক্তিভরা জঙ্গলের ভিতর,
ঐ জঙ্গলেও সায়গলের সুর আছে প্রাচীন
দেবদারু গাছে।

তো এই সুর এই পথ— নাউন আর
অ্যাডজেক্টিভ আর ভার্ব আর প্রোনাউন দিয়ে তৈরি।
এখানে সাঁতার এখানে নিষ্কাম কর্ম, নিরাসক্তি।
এইসব সুরের ভিতর ঝমঝম করে ফার্নিচার
ঝরে-ঝরে সংসার, ঝরে ন্যাতানো ইউটিউব—
এইসব সংবাদ শুধু তোমার জন্য, এই বেসুরো গান শুধু
তোমার জন্য রইল।

আমাকে একটু চা দাও, আর দাও একটি পথ,
দীর্ঘ একটা পথ দাও, অনেক দিন পথের দেখা
পাইনি, পাইনিকে পেতে পেতে না-পাওয়ার
দিকে যেতে চাই…

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

অমিতাভ মৈত্র

শর্টকাট

যদি ক্রাচ সঙ্গে থাকে
অস্তিত্ব স্রেফ দু-মিনিটের হাঁটা পথ

যে ভাবে মিথের জন্ম হয়

রাতে তারা দু-জন কবরখানার প্রধান ফটক থেকে
নেমে আসে নিঃশব্দে
আর অন্ধকার রাস্তায়
নরম থাবা ফেলে ঘুরে বেড়ায়।

লোকে বলাবলি করে
ধুলোমাখা শিরীষ গাছের আড়ালে
মাঝে মাঝে তারা পেচ্ছাপ করার জন্য থামে।

বুড়ো আর সূর্য

মাটির পাত্রে জ্বলন্ত কাঠকয়লা জুটত না বলে
শীতে অসাড় বুড়োটা চাইত
সূর্য যেন না ডুবে যায় কখনো।

সূর্যই জানে আসলে এক অবাস্তব ধর্মযাজক সে
মৃত্যুদণ্ডের আগে যে দণ্ডিতের সামনে
অনুভূতিশূন্য কিছু কথা
কাগজ দেখে অন্যমনস্কভাবে পড়ে যায়।

নিরাপত্তা

দেয়ালে শক্তভাবে জুড়ে থাকা প্রতিটি ইট
তৃপ্ত থাকে তাদের নিরাপদ সুসংবদ্ধ জীবনের জন্য।

বাতাস মাঝে মাঝে বিদ্রূপ করে তাদের জীবনকে

তারা কানে তোলে না।

আউটডোর টেবিল

উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নিঃসাড় আকাশ
আর তার পিঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে
আস্তে আস্তে, সারাদিন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে লাল স্টেথোস্কোপ

সম্ভবত অসুখ খুঁজছে।

সিদ্ধি

একজন মানুষকে হত্যা করার পর
কয়েকদিনই শুধু হাত কেঁপেছিল আমার
কিন্তু তারপর আবার যখন ছবি আঁকায় ফিরলাম
আমার কল্পনা আর রং
অনেক বেশি গভীর ও সাহসী হয়ে উঠেছিল

আমার মনঃসংযোগ আর তুলি ধরার ক্ষমতাও বেড়ে যায়

অনুতাপের ঘরের দেয়ালে যা লেখা ছিল

এমন জীবাণুশূন্য করে নিয়ো না নিজেকে, যাতে মনে হয়
সাদা সাবানের ওপর কালো ফিনাইল দিয়ে
                        লেখা হয়েছে তোমাকে

ঈশ্বরের হাতে, ঈশ্বরের লেখার খাতায়

শপিং মল-এ একজন আধ্যাত্মিক

ট্রায়াল রুমের ভেতর থেকে লাল কর্সেট পরা মহিলাটি
চাপা গলায় বললেন— গাধা কোথাকার!

আর ব্লেজার বাড়িয়ে ধরে একজন ঝকঝকে বিক্রেতা
                                            তখন বলছেন—
নিন এই দুর্দান্তকে! শুধু আপনার আগের জীবন আমাকে
                                            দিন।

মনে হয় এই শহরে সবাই
ঘরের আলো নিভিয়ে
স্ট্যাচু হয়ে থাকার খেলা পছন্দ করে
আর কোনোভাবে সেই খেলা আমাকেও টেনে নিচ্ছে হয়তো।

ঘষা কাচের ওপাশ থেকে আর একজন লাল কর্সেট
          খসখসে গলায় বলে উঠলেন— গাধা কোথাকার!

Categories
2021-June-Swaron

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

চলচ্চিত্র সম্পর্কিত একটি ব্যক্তিগত গদ্য

ছোটোবেলায় বেলা বালাজের ‘Theory of the Film’-এ একটা লাইন পড়ে বেশ উত্তেজিত হয়েছিলাম Cinema is the tenth muse। বইটি কেউ পড়তে নিয়ে দীর্ঘকাল বাদে ফেরত দিয়ে যাবার পর সেদিন নাড়াচাড়া করে দেখলাম। ওই লাইনটির তলায় সেই দাগ আজও আছে।

বাসে যেতে যেতে এদিক ওদিক তাকালাম। একটা বিজ্ঞাপন এখনও চোখে পড়ল। ইংরেজিতে। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘প্রেম করে যাও, বাচ্চা উৎপাদন কোরো না’। চোখে পড়ল ‘ফুলশয্যা’ ‘এক যে ছিল দেশ’ ‘জাল সন্ন্যাসী’। সন্ন্যাসীর হাতে ছুরি। বাংলা ছবি। হুড়মুড় করে নামল বৃষ্টি। ঝপ ঝপ বাসের ভেতর জানলা বন্ধ হতে লাগল। জলে ধুয়ে যাওয়া কাচের ওপারে দেখলাম বৃষ্টির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছে তৃপ্ত ও সুখী, বাংলা ছবির দর্শক ও তাদের মা মাসি বউ বোনেরা। মনে পড়ল, আমি একটা বড়ো ছবি করার কথা ভাবছি। জানলা তুলে দেখলাম। বাসের ভেতর দেখলাম। ভয়ে শিউরে উঠলাম। একটি মুখও মনে হল না আমার ছবির দর্শকের। দেখলাম, ফাঁকা চেয়ারের সার, কাউন্টারে হাই তোলা টিকিটবাবু। মাছি। কিলবিল করতে করতে চলা উদাসীন, ভ্রূক্ষেপহীন মানুষ-মানুষি।

এই দুঃস্বপ্নের ছবি দেখেন প্রায় প্রত্যেকেই। যাঁরা ছবি করতে চাইছেন নিজের মতন করে, যাঁরা নিজেদের ভাবনা-চিন্তা-বিশ্বাসের কাছাকাছি থাকতে চাইছেন, যাঁরা নিরুপায় ও চমৎকৃত এক ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই স্বপ্নতন্তু জাল ছিঁড়ে এই দুঃস্বপ্নেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়ে। আর তাঁদের বুকের ভেতর গুটিয়ে রাখা কয়েক লক্ষ ফুট আন-এক্সপোজ্ড ফিল্ম নেগেটিভে যে-সব ছবি ফুটে ওঠে, মাঝরাতে উঠে একা অন্ধকারে জেগে থেকে তাঁদের দেখতে হয় সেইসব। ফাঁকা, বহুদূর চলে যাওয়া রাস্তা, দূর থেকে গরগর শব্দ করে একটা বিন্দুর মতো প্রথমে দেখা দিয়ে সামনে দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে একটা মোটরসাইকেল। আবার। ফাঁকা রাস্তা বহুদূর পর্যন্ত, গরগর করে ছুটে আসছে এক মোটরসাইকেল। যে চালাচ্ছে সে পাথরের মতো, তার মুখ উলটো দিক করে বসানো আর তার চোখদু-টি অদ্ভুত আয়ত, কেন-না কাচের।

মানুষ বিয়ে করে সুখী হয়। বাচ্চা উৎপাদন করে বা না করে সুখী হয়, রাশ রাশ পদ্য লিখে ফেলে সুখী, হাঁ হয় ও দাঁত খোঁটে ও আবার রাশ রাশ পদ্য লিখে ফেলে, চাকরি করে সুখী হয়, সমালোচনা লিখে সুখী হয়। কেউ ব্রিজ বানায়। সুখী হয়। কেউ আদর্শের জন্য দালাল ও তার ভেড়ুয়াদের দ্বারা কবলিত হয়েও প্রাণ ভিক্ষা করে না— স্বপ্ন দেখে বদলে দেবার লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে। কেউ-বা মরা মাছের চোখ নিয়ে আরও অনেক ভেসে ওঠা মাছের সঙ্গে থেকে গিয়ে দেখে যায় সবকিছু ও সুখী হয়। ফিল্ম ভালোবেসে একজন যা করে তা হল লাফ দিয়ে সে উঠে পড়ে এক তাতানো তাওয়ায়। বা তা হল এক জ্যান্ত ইঁদুর গিলে ফেলার ব্যাপার। একদিন ঘুমাতে যাবার আগে সে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে বিছানায়, তার হাড়ের কুচি ও গুঁড়ো সে স্পষ্ট দেখতে পায় শেষবারের মতো। কিংবা শেষ-ভাজা হয়ে মাথা পর্যন্ত চাদর টেনে দেয় সে নিজেই। দেশ, ভারতবর্ষ।

তবুও প্যাঁচা জাগে। আর জেগে থাকে সে। স্ক্রিপ্টের পাতা উলটে যায়। কাটে, লেখে, কাটে। তারপর একদিন তার বাঁ-দিকে ডান দিকে অশেষ দুর্ভোগ দাঁড় করিয়ে রেখে সে তার জীবনের প্রথম বড়ো ছবির শুটিং-এর দিনটির সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। যতদিনে ছবি শেষ হয়, ততদিনে কবিতা থেকে পাঠক সরে গেছে আরও দূরে, ছবি থেকে দর্শক সরে গিয়ে আরও ভুল ও সংক্রামক এক অপ-ছবির অন্ধকারে জড়ো হয়েছে দলে দলে। সে মর্মাহত হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু খুব গোপনে অন্তত একবার নিজের কাঁধে হাত রেখে সে বলতে পারে যে, যথাসম্ভব কম নুয়ে সে কিছু করতে চেয়েছিল। রাত যায়, একদিন প্যাঁচাও ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে থাকে সে।

সে কী করতে পারত? সে নিশ্চয়ই ঠোঙা ভরা বাদামভাজা নিয়ে বসে থাকতে পারত না কেন-না সে ভালোবেসেছে ছবি তৈরি করার ব্যাপারটাকে। তার ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের দ্বন্দ্ব সে তুলে ধরতে চেয়েছে এখানেই। তাই ভেঙে পড়া অতল খাদের ভেতর থেকে কালো বেড়ালের হাতছানির ডাকে একেবারে সামনে এগিয়ে গিয়েও সে শেষপর্যন্ত পিছিয়ে আসে। চোয়াল শক্ত করে সে আবার বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে সে জানতে চায় ইয়োরিস ইভেন্‌স-এর ‘The Camera and I’, বইটি আছে? তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি তরুণ চলচ্চিত্রকার ও তাঁদের দর্শকদের ভীষণ কাছের মানুষ ইয়োরিস৷ লেনিন ও মাও-এর দেশের বহু অতুলনীয় তথ্যচিত্রের পরিচালক। একদিন দেখেছিলাম কয়লাখনির শ্রমিকদের দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘট নিয়ে তাঁর ছবি ‘বোরিনেজ’— না, নেই, সব, সব ফুরিয়ে গেছে। বিক্রেতা সখেদে জানান। বইটি না পেয়েও সে খুশি হয়ে বেরিয়ে আসে। সে ভাবতে থাকে তাদের, যাদের হাতে হাতে বইটি ঘুরছে। সে কেনে ডটপেন ও কাগজ। ফুটে ওঠে আবার নতুন ছবির দৃশ্য। তার চোখের সামনে না থাকলেও আছে, হয়তো অজস্র নয় তবু কিছু নতুন প্রাণের দর্শক, যাদের জন্য আপাতত কষ্টেসৃষ্টে হলেও সে বাঁচিয়ে রাখবে অন্তত তার ছবি করার ইচ্ছেটাকে। সে লিখতে থাকে। লেন্স ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখাতে থাকে প্রথম দৃশ্য। বহুদূর কালো এক রাস্তা দিয়ে গরগর করে ছুটে আসছে উলটো মাথার সেই মটোর সাইকেল-চালক তার আয়ত কাচের চোখ নিয়ে। একটার পর একটা হলে ঢুকে দৌড়ে চলে যাচ্ছে ওপরে, ভুল ও মিথ্যাকে বিশ্বাস করানোর জন্য সাদা ও রঙিন ছবির ক্যান খুলে গোটানো রিলের প্রথমটুকু হাতে ধরে সে নীচে ফেলে দিচ্ছে সে-সব, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, কেন-না নীচ থেকে একজন আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রথম দৃশ্য শেষ হয়। হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে।

আমরা সত্তরের যীশু, ১৯৭৭ (পত্রিকা), স্বপ্ন, সময় ও সিনেমা (গ্রন্থ)

ঋণ: শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়

Categories
2021-June-Haiku

মো. মুহাইমীন আরিফ

নভোমণ্ডল
দূরবীক্ষণে চোখ
বৃত্তদর্শন

চাঁদে গ্রহণ
জোয়ারে উপচানো
জলপেয়ালা

সমুদ্রজল
সৈকতে লাবণিক
লবণস্তূপ

চন্দ্রালোকিত
জলের আয়নায়
কে চাঁদমুখ

মুখে আহার্য
পিপীলিকার দল
শীত আসন্ন

বরফরোদ
প্রতিবিম্বিত সূর্য
ডিমকুসুম

পাহাড়শীর্ষে
গলাধঃপ্রক্রিয়ায়
গোধূলি সূর্য

পশ্চিমা বায়ু
পুবে পাতার স্তূপ
ভঙ্গুর বৃক্ষ

শ্রাবণবিন্দু
দিঘির ক্যানভাসে
জ্যামিতি বৃত্ত

১০

মাছের ঝাঁক
বক জেলের কানে
জলের গান

Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ


রূপা সকালে আগে দেওয়াল থেকে তার কৃষ্ণের ফোটোটা নামায়। পেছনে জমা ঝুলকালি পরিষ্কার করে। পরম মমতায় নিজের আঁচল দিয়ে আস্তে আস্তে ছবির ওপর জমা তেলকালির ধূসরতা মুছে দিতে থাকে সে। যেন তার কৃষ্ণের পরশ পায় সে-আদরে। হ্যাঁ, আদরই দেয় রূপা কৃষ্ণকে, তার রাজাকে কত-কত দিন পর। চোখ ভিজে ওঠে তার। ফোটোটা যথাস্থানে ঝুলিয়ে একটা গোড়ের মালা পরিয়ে দেয় ছবিতে। তার ঝাপসা চোখে গোড়ের মালা অতীত আঁকে।

উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়েই যেন! এক সন্ধ্যেবেলা কৃষ্ণ হাজির তাদের বাড়ি।

— কাল সকালে রেডি থাকবে। সকাল দশটা। এই নাও।

একটা সুদৃশ্য, কলকাতার বড়ো দোকানের ব্যাগ তার হাতে ধরিয়ে দেয় কৃষ্ণ।

— শাড়ি আছে। গয়নাও। কাল সকালে রেডি থাকবে। কাল বিয়ে করব আমরা। কালিঘাটে।

রূপা কী বলবে? সে নির্বাক প্রস্তরমূর্তি যেন বা। শুধু বুকের ভেতরটা তিরতির কেঁপে জানান দিচ্ছিল যে, সে বেঁচে আছে, মরেনি। যদিও ভয়, ভালোবাসা, জয়— জীবনের তীব্রতম আকুতিতে সে মরেই যেতে চেয়েছিল সে-সাঁঝে!

ফ্যালফ্যাল দৃষ্টির নিথর বাবার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে বলেছিল কৃষ্ণ— এটা রাখুন। সামান্য টাকা। বড়োমেয়ের বিয়ের ঠিক করুন। সব দায় আমার।

কাটা-কাটা স্বরে উচ্চারণ ভাসিয়ে কৃষ্ণ পিছন ফিরেছিল। এমনই কাটা-কাটা কথাতে অভ্যস্ত ছিল সে। যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই বলাই তার অভ্যাস। ঘরের চৌকাঠে পা দিয়ে চকিতে মুখ ঘুরিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে কথা ক-টাও—রামুকে দু-দিন পর দেখা করতে বলবেন আমার সঙ্গে। আমার ঠেকে। সকাল আটটায়। সাবান কলে লোক নেবে।

বেরিয়ে যায় কৃষ্ণ আঁধার ঠেলে বস্তির কয়েক জোড়া অদৃশ্য চোখকে পাত্তা না দিয়েই। রাত চিরে বাইক গর্জে উঠেছে ততক্ষণে।

পরের দিন সকালে সাদা প্যান্টের ওপর ঘি-রঙা সিল্কের পাঞ্জাবিতে আর গোড়ের মালায় কী অপূর্বই দেখতে লেগেছিল তার কৃষ্ণকে— যেন স্বয়ং কেষ্ট ঠাকুরটিই!

কালিঘাট মন্দির থেকে ওরা সদলবলে পার্ক স্ট্রিটে বড়ো হোটেলে গিয়েছিল। রূপার জীবনে প্রথম অত বড়ো হোটেলে খাওয়া। মুগ্ধ দৃষ্টিতে বার বার আড়চোখে দেখেছিল সে তার রাখাল রাজাকে। আনন্দে-আহ্লাদে!

গোড়ের মালায় আর সকালের নবীন রোদে কৃষ্ণের ফোটোটা ঝলমল করে ওঠে। যেন হাসে রূপার দিকে তাকিয়ে। এমনিতে গম্ভীর, চোখজোড়া সদা চঞ্চল, যা আভাস দেয় তার মন কোথাও স্থির না, ডাঙা পাচ্ছে না এমনই ভাসমান— সে গম্ভীর কৃষ্ণ হাসত খুবই কম। তবু রূপার মনে হত একমাত্র তার কাছে এলে যেন দাপুটে লোকটা কোথাও ডাঙা পেত, যা ভরসা, আশ্রয়ই হয়তো। তার মুখে হাসির সজল মায়া জাগৎ রূপার সান্নিধ্যেই যেন। তেমনি তো হেসেছিল সেদিন। যেদিন কৃষ্ণ প্রথম মায়া এঁকেছিল তার মনে, তার পরের দিন কলেজে ফি দিতে গিয়ে দেখে তার সারা বছরের ফি মেটানো হয়ে গেছে। তবে কি সে, সে-ই! সদ্য ফোটা রূপার মনে দোলা ছিল! লজ্জায় মাথা তুলতে পারে নি কলেজের অফিস কাউন্টারে। ক্লার্ক নৃপতিবাবু কি হেসেছিল!

কলেজ ছুটির পরে ফেরার পথে লজ্জায় মুখ নামিয়েই রূপশ্রী হল পার হচ্ছিল সে। কেন-না এই হলের আশেপাশেই তো ওদের আড্ডা। তখন বিকেল মায়া সাজাচ্ছে আকাশে। সে-মায়ায় এক কালো ছায়া ঢেকে নেয় তাকে— কেমন চমক দিলাম!

হে ধরণী দ্বিধা হও— এমনই যেন রূপার ভঙ্গিমা তখন। তবু অপাঙ্গে তার ঝিলিক হেনেছিল এক নিরুচ্চার হাসির উদ্ভাস। সে-উদ্ভাসই যেন আজ এই সকালে ঝিলিক হানে পৌঢ়া রূপার চোখে। ঝাপসা চোখে সহসা সকাল মুছে সাঁঝমায়া! রূপশ্রী হল আলো ঝলমল সুর বোনে— দশ কা বিশ! দশ কা বিশ! হারু হিমসিম খায় খদ্দের সামলাতে!

রূপার সজল চোখে ছায়া ফেলে সে-জলরঙা ছবির মায়ালু পেলবতাও। কৃষ্ণ কথা রেখেছিল। তার দিদির বিয়ের সব খরচ কৃষ্ণই দিয়েছিল। রামু সাবান কলে আজও চাকরি করে। ভালই মাইনে পায়। শুধু তাই-ই নয়, তার পরের বোনের বিয়ে, ছোটোভাইয়ের ল্যাম্প ফ্যাক্টরিতে চাকরি— সব দায়িত্ব যেন কৃষ্ণেরই। অথচ…। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পৌঢা রূপা।! আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। ফলে সকল সজলতা মুছে আলো ঝলমল সে-সন্ধ্যা হারিয়ে যায়। সকালের নবীন সে-রোদ তখন খর। দোকান সাজায় রূপা খদ্দেরর আশায়।

দু-একজন করে খদ্দের আসে। চা চায় তারা, খায়। গুলতানি মারে। বৃদ্ধ কিছু মানুষের আড্ডাখানাও যেন তার এই দোকান। রিটায়ার্ড, ঘরে সময় কাটে না। দোকানে আসে, ঘণ্টাখানেক গল্পগুজব করে। বাঘ মারে, হাতি মারে— বাতের গল্প আর নিজেদের বাতিল জীবনকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার গল্প। বার দুয়েক চায়ের অর্ডার দেয়। রূপা কিছু বলে না। রূপশ্রী হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তেমন খদ্দের হয় না আর। বাজার এলাকা তো নয়! ওই স্থানীয় লোকজন, পাশের পার্টি অফিসের লোকজন আর পথ চলতি দু-একজন— এই তো তার খদ্দের! বুড়ো লোকগুলো এলে ফাঁকটা অনেকটাই ভরে ওঠে। ভালো লাগে রূপার। ভালো লাগে যখন এমনই কথা ভেসে ওঠে ওদের চায়ের তৃপ্ত চুমুকে মিশে। কাটা। কাটা।

— মানুষ ছিল একটাই সে-সময়! আর নাই।

— হ্যাঁ, রাজা মানুষ। যে কোনো সমস্যায় তার দরবারে একবার হাজির হলেই হল।

ফলে গল্প গজায়, পল্লবিত হয়, মিথের মাহাত্ম্য ডানা মেলে।

— ওই তো সেবার! হালদার পাড়ার পাঁচু রিকশাঅলা, মেয়ের বিয়ের জন্য ধরলে— এমন বিয়ে হল যে তেমন তেমন বড়োলোকও হার মেনে যায়!

— আর দীনু মিস্ত্রির বাগানের ওই অনন্ত গো! জাহাজ কলে কাজ করতে করতে মরে গেল যে। তার বিধবা কৃষ্ণকে ধরতেই এক মাসের মধ্যে চাকরি পাকা তার ছেলের।

— ফতেপুরের শিবু ছেলেটা! ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেল। ভর্তির টাকা দিল তো কৃষ্ণই!

এমনতর গল্পের মাহাত্ম্য দোকানের চিলতে ঘরে মাথার ওপর পাক খায়, খেয়েই যায় ঘুর্ণিয়মান পাখার সঙ্গে! আর সে মাহাত্ম্যে হঠাত্‍ একফালি উড়ো সাদা মেঘ সূর্যকে ঢাকে যেন। সে-সকাল মলিন হয় সহসা। সে-ছায়ায় কথারা গলা নামায়। যেন কৃষ্ণের বিধবা না শোনে। দুঃখ না পায়!

— ও তো মস্তানি করতো ডকে, কারখানার চৌহুদ্দিতে। ওটা ছিল তার রাজপাট।

— পাড়ায় কিন্তু সে কোনোদিন কিছু করেনি। তার জন্য পাড়ায় আমরা শান্তিতেই ছিলাম সে সময়। ফোস করে সমবেত নিঃশ্বাস পড়ে যেন। সে-নিঃশ্বাসের অভিঘাতেই যেন মেঘ ভেসে যায়, সূর্য স্বমহিম হয়।

আর ঠিক সে সময়েই কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ছায়া বিলিয়ে সূর্য ঢোকে। সূর্য মিত্র। নকশাল ছিল নাকি সে! আলজাইমার রুগি। হাত-দুটো সবসময় কাঁপে। তবুও ডান হাতটা তার সর্বদা পকেটে গোঁজা থাকে। বোমা ফেটে ডানহাতের তালুটা নাকি তার নেই। যদিও সে তালুহীন হাত কেউ কোনোদিন দেখেনি। না দেখলেও ওটা সত্যই।

অন্যেরা শশব্যস্ত হয়ে সরে বসে বেঞ্চে জায়গা করে দেয় তাকে। সমীহ করে সবাই তাকে। নাকি মায়া! যেমন রূপার মায়াই হয় জীর্ণ লোকটাকে দেখে! ব্যর্থ বিপ্লব! ব্যর্থ মানুষ। শুধু সমাজ পালটানোর স্বপ্নে যৌবনটাকে পচিয়ে দিয়েছে জেলে! রূপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার কৃষ্ণও তো তাই! না, বিপ্লব সে করেনি। কিন্তু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল সেও তো! যদিও ক্ষমতার রাজনীতি, তবুও যথাসাধ্য গরিবকে সাহায্য তো কৃষ্ণও করত! তবুও কৃষ্ণ খুনি, গুন্ডা, মস্তান! যদিও এলাকার লোকের চোখে কৃষ্ণ কোনোদিন বিকৃত হয়ে কেষ্টা হয়নি। লোকের মুখে কৃষ্ণদা সম্বোধনে সমীহই ছিল। তবুও…।

রূপা জানে সূর্য মানুষটা চিনি ছাড়া লিকার চা খায়। ও চা এগিয়ে দেয় সূর্যের দিকে। টেবিলে নামিয়ে রাখে। সঙ্গে প্লেটে দুটো ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুটও।

মাথার ওপর পুরোনো পাখাটা নিশ্চুপ কথার জাল বোনে। সে নিঃশব্দতাকে বাড়িয়ে সূর্য ম্লান হাসি হাসে মুখ তুলে। ফলে নৈঃশব্দ্য জমাট বাঁধে আরও।

অগত্যা রূপই এগিয়ে আসে সে জেকে বসা নৈঃশব্দ্য তাকে ভাঙতে অন্য দিনের মতোই।

— সূর্যদা শরীর এখন ভাল তো?

— ওই চলে যাচ্ছে বোন। কাঁপা কাঁপা গলা এ-উচ্চারণও বোনে,— তোমরা সব ভাল তো!

— হ্যাঁ, দাদা চলে যাচ্ছে, চালাতে তো হয়ই!

কথা পড়তে পায় না আর। একজন লুফে নেয় কথাখানা।

— এই-ই হল আসল কথা! দিন চলে যায়, চালাতে হয়।

ফলে কথার টানে কথা বাড়ে।— সত্যি কী দিন ছিল বলো তো তখন?

— এই যে সূর্য বিপ্লব করেছিল ধান্দার জন্য? না, সমাজের ভালোর জন্যই তো!

— আমাদের কৃষ্ণর কথাই ধরো না কেন? গরিবের কত উপকার করেছে ও।

— আর এখন? রাজনীতি মানে ধান্দা, নিজের আখের গোছানো শুধু! গাড়ি-বাড়ি-ব্যাঙ্ক ব্যালান্স-প্রমোটিং! ছিঃ ছিঃ! সমাজটা উচ্ছন্নে গেল একেবারে।

কথারা এমনই জাগে ঘরময়। পাখার হাওয়ায় লাট খায়। রূপার কানে গুঞ্জন তোলে। কিন্তু কিছুই সে শোনে না। তার মন অন্য ভাবনা বোনে। কী পেল ওরা? কৃষ্ণ-সূর্য! কৃষ্ণ তো নেই-ই আর। সূর্য থেকেও নেই। জেল ফেরত লোকটা রাজনীতির রা আর কাড়ে নি। সব স্বপ্নকে হারিয়ে মৃত মানুষই যেন সে। জেল তার সকল জীবনীশক্তিকে নিংড়ে ছিবড়ে করে দিয়েছিল। অথচ সে আগুনে সময়ে সূর্য যেন জ্বলন্ত সূর্যই, মধ্যাহ্নের। তার বিভায় মেয়েরা পাগল ছিল। তার পরে সূর্যগ্রহণ কালে সে আলো জেলের অন্ধকারে হারিয়ে গেলে, মুছে গিয়েছিল সকল জীবন্ত গান। শুধু জেগেছিল মনীষা। প্রতীক্ষায় ছিল তার সূর্যের গ্রহণমুক্তির। গ্রহণ কেটে গেলে সে সূর্যকে বরণ করে নিয়েছিল। অতদিন পরও। ততদিনে মনীষা সরকারি চাকুরে। এলাকার পাঁচজনে ধন্য ধন্য করেছিল এ প্রেমের শুভ পরিণতিতে। তারপরেও কিন্তু থেকেছিল। মনীষা জ্বলন্ত সূর্যকেই ভালবেসেছিল বোধহয়! গ্রহণলাগা এ সূর্য হয়তো আকাঙ্ক্ষিত ছিল না তার! ফলে প্রেম উবে গিয়েছিল কবছরেই, শুধু দাম্পত্যের অভ্যাসটুকুই টিকেছিল— করুণায়, দয়ায়। যা টিঁকে আছে আজও পরগাছার মতো। মনীষা তো জেনেবুঝে ভালবেসেই গ্রহণ করেছিল লোকটাকে। সরকারি চাকরি। যা মাইনে পায় তাতে তো স্বচ্ছলতা উপচে পড়ার কথা সংসারে। যেমন পুরুষ মানুষরা একার আয়েই তো স্বচ্ছল! তবে কি বিদুষী, বিপ্লবী মনীষার মনেও পুরুষতান্ত্রিকতার থাবা! রূপা ভাবে। মনীষা কি অন্য কিছু আশা করেছিল মানুষটার কাছে! বড়ো নেতা হবে? মন্ত্রী হবে? কে জানে? ভাবনারা পাক খায় দোকানের আলো আঁধারিতে, টাল খায় পাখার একঘেয়ে ঘুরে চলায়।

রূপাও কি কিছু চেয়েছিল তার কৃষ্ণের কাছে? নিভন্ত মন কোনো সংকেত আঁকে না। সামান্য নারী সে শুধু চেয়েছিল তার মানুষটা ঠাকুর-ঠাকুর করে বেঁচে থাকে যেন। কিন্তু…! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপা গোপনে। পাখার হাওয়া ভারী হয়ে ওঠে। পরগাছা জীবন, তবুও সূর্য মানুষটা তো বেঁচে আছে! মনীষার হয়ে রূপা মনে মনে আদর দেয় জীর্ণ মানুষটাকে! দেওয়ালে ঝোলানো মানুষটা হাসে যেন— তেমনই মনে হয় রূপার!

ভাবে আর টুকটাক খদ্দের সামলায় রূপা। বেশিরভাগ জনই বাইরে দাঁড়িয়ে চা খায়। চা ফুটে উঠতে থাকে আগুনে। উথলায়। রূপা অভ্যস্ত হাতে হাতা দিয়ে উথলে ওঠা ডেকচির চাকে থিতু করে। কিন্তু তার মন! উথলে ওঠে, উথলে উঠতেই থাকে। খদ্দেরের আনাগোনা ছায়া আঁকে দোকানের আবছায়া পরিসরে। কথারা জেগে ওঠে, ভাসে। অভ্যাস্ত হাত তার মনহীন যন্ত্রের মসৃণতায় যেন খদ্দের সামলায়। মন তার ভেসে চলে যায় সেই সত্তরে! মনে মনে হাসে রূপা! রোগা-প্যাংলা লোকটা, দোখনের কোনো এক গ্রামে, কাঁধে রাইফেল মাঠের আল ভেঙে রাত চিরে হাঁটছে! দৃশ্যটা মনে হতেই মনের হাসি অজান্তেই রূপার ঠোঁটে আশ্রয় পায়। সচেতন রূপা সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলে তা। খুবই সরল সাধসিধে সূর্যদা! এই লোকটা বিপ্লবী! মানুষ খুন করেছে? করতে পারে অমন নরম লোকটা! অথচ রটনা তো তেমনই!

যেমন রটনা এও যে কৃষ্ণ নাকি খুনি! খুন করে কত লাশ নাকি শান্তিনগরের হোগলাবনে, ব্রূকলিন, সিকলেনের ঝিলে গুম করে দিয়েছে! ওরা নাকি সব ছিল তার বিরোধি দলের গুণ্ডা! কৃষ্ণের বিরোধি, নাকি পার্টির বিরোধি! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপা। মাথার ওপর পুরোনো পাখাটা একঘেয়ে একটানা ঘুরেই চলে গরম হাওয়ার ঘূর্ণি তুলে। ঘূর্ণি ওঠে রূপার মনেও। কিন্তু কে খুন হল, কার লাশ গায়েব হল কেউ জানে না তা! পুলিশও কোনো রা কাড়েনি। তবুও রটনা— কৃষ্ণ খুনি! পার্টির প্রশ্রয়ে খুন হওয়া মানুষগুলো সমাজ-সংসার থেকে মুছে যায়। পুলিশের ডায়েরি থেকে যায় সফেদ-সাদা!

রূপার ভাবনা টাল খায়, কেন-না টলতে টলতে সূর্য কাঁপা হাতে পকেট থেকে টাকা বার করে কাউন্টারে রাখে। তারপর দোকানের আলো-আঁধারিকে দুলিয়ে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে যায় বিপ্লবী সূর্য। রূপা তাকিয়ে থাকে টলায়মান সে-অতীতের ছায়ার দিকে। তাকিয়েই থাকে, কিন্তু চোখ তার ছবি আঁকে না, সেখানে তখন অন্য আলো-আঁধারির ছায়া— খুনি সূর্য বিপ্লবী! আর তার কৃষ্ণ গুণ্ডা! মস্তান! খুনি!

রূপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আবারও। রাস্তায় গরম হাওয়া বয়। সে-হাওয়ায় প্লাস্টিকের বাতিল এক প্যাকেট উড়তে উড়তে ঠেক খায় রূপার দোকানের চৌকাঠে।

প্রথম পর্ব

Categories
অন্যান্য

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

চতুর্থ অধ্যায়
পক্ষকাল শেষে শোভাযাত্রার অবসান হতেই শেং শাও নামক দলটি শি পিনের দিকে রওনা দিল। সঙ্গী হল ওইগার প্রদেশের এক বৌদ্ধ শিষ্য। পঁচিশ দিনের অবিরাম পথ চলা শেষে ফা-হিয়েন ও তাঁর অন্য সাথীরা এসে পৌঁছোলেন জু হো প্রদেশে। এ-দেশের রাজা বৌদ্ধধর্মের উপাসক। সহস্রাধিক সন্ন্যাসী আছেন এখানে আর সকলেই মহাযান ধর্মাবলম্বী। দিন পনেরো বিশ্রাম অন্তে আবার যাত্রা। দক্ষিণ দিক লক্ষ করে চার দিন পথ চলা শেষে দলটি এসে পড়ল পলান্ডু পরিসরে। এবার আবার এক নতুন দেশ ইউ হি। আবার দিন কয়েকের বিরতি। এবারের যাত্রা হবে দীর্ঘ, বিরামহীন। একটানা পঁচিশ দিন ভ্রমণ শেষে এবার এসে পৌঁছোনো গেল চি চাহ প্রদেশে। হুই চিং আর অন্য সাথীদের সঙ্গে এসে পুনরায় মিলিত হলেন তাঁরা।

পঞ্চম অধ্যায়
দেশের রাজা পঞ্চ শীল ধারণ করেছেন। এ হল পাঁচ বছরের মহাসমাবেশ। সব শ্রমণদের রাজা আমন্ত্রণ জানান এই সমাবেশে। আর বিপুল সংখ্যায় তাঁরা যোগও দেন। তাঁদের বসার আসনগুলি পূর্ব হতেই সুসজ্জিত করে রাখা হত, ছোটো ছোটো পতাকা আর স্বর্ণ রৌপ্যের সুতায় পদ্মফুলের নকশা করা শামিয়ানা দিয়ে। আসনের পিছন দিকে একেবারে নিদাগ, ঝলমলে ঝালর দিয়ে সাজানো হত। রাজা তার সব মন্ত্রী অমাত্যদের নিয়ে যাবতীয় আচার মেনে পূজার অর্ঘ্য দিতেন। এক, দুই কখনো-বা তিন মাস পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান পর্ব চলত এবং সাধারণত বসন্তকালেই বসত আসর। রাজার সভা শেষ হলে তিনি অমাত্যদের আহ্বান জানাতেন। এবার তাঁদের পূজার অর্ঘ্যদানের পালা। এই পর্বটি চলত দু-তিন, কখনো পাঁচ দিন ধরে। সকল নৈবেদ্য সারা হলে, এইবার রাজার আদেশমতো তাঁর মন্ত্রী, অমাত্যদের নিজস্ব ঘোড়ার সমকক্ষ কিছু ঘোড়ায় লাগাম, জিন পরিয়ে সাজানো হল। আনা হল অতি শুভ্র বস্ত্র, সকল প্রকারের রত্ন সম্ভার, শ্রমণদের যেমনটি প্রয়োজন। রাজা তাঁর অমাত্যবর্গ-সহ শপথ নিয়ে এ-সব সামগ্রী শ্রমণদের দান করলেন। এভাবে সন্ন্যাসীদের থেকে ভিক্ষা সামগ্রীর মাধ্যমে মুক্ত হল শ্রমণগণ। দেশটি তো পর্বতসংকুল এবং যথারীতি শীতল। গম ছাড়া আর কোনো শষ্য জন্মায় না। শ্রমণগণ তাঁদের প্রাপ্ত সামগ্রী গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ হয়ে এল মেঘলা, ফলস্বরূপ হিমশীতল হল সকাল। এই জন্যেই এ-দেশের রাজা প্রতিনিয়ত সন্ন্যাসীদের কাছে প্রার্থনা করে গেছেন যাতে তাঁদের প্রস্থানের পূর্বে খেতের গম পেকে ওঠে। বুদ্ধের ব্যবহৃত একটি পিকদানি আছে এ-দেশে। তাঁর ভিক্ষাপাত্রের মতো এটিও একই রঙের পাথরে তৈরি। আর আছে বুদ্ধের একখানি দাঁত। এবং এই দাঁতের সম্মানে এ-দেশের মানুষ তৈরি করেছে একটি প্যাগোডা। সহস্রাধিক সন্ন্যাসী আছেন এই স্থানে, তাঁরা প্রত্যেকেই হীনযান মতাবলম্বী। যত পুবে পর্বত ঘেরা স্থানে যাওয়া যায়, সেখানে মানুষ চীনাদের মতোই মোটা, খসখসে পোশাক পরে, যদিও তাদের পশম আর গরম বস্ত্রের ব্যবহার ভিন্ন। শ্রমণদের আচার অনুষ্ঠানও এখানে বিচিত্র আর অগণিত। এই দেশটি যেন পামীর, হিন্দুকুশের কোলে শিশুর ন্যায় রয়ে গেছে। আর এখান থেকে গাছপালা, ফুল, ফলের চরিত্রও যায় বদলে। চীনের সাথে মিল পাওয়া যায় কেবল বাঁশ, পেয়ারা আর আখ গাছের।

ষষ্ঠ অধ্যায়
এই স্থান থেকে পশ্চিমে এগোও, মিলবে ভারতবর্ষের উত্তর খণ্ড। পথ মধ্যে হিন্দুকুশ, পামীরের বিস্তার। বুনো পেঁয়াজের ভারী ফলন এ-অঞ্চলে। এক মাস যাবৎ যাত্রা শেষে সফল হলেন তীর্থযাত্রী দল। পার করলেন এই ‘পেঁয়াজ পরিসর’। বরফের এই দেশে শীত গ্রীষ্মে ভেদ নাই কোনো। আর আছে বিষধর ড্রাগন। সামান্য প্ররোচনায় ঢেলে দেয় বিষময় বাতাস, বৃষ্টি, তুষার, বালি ঝড় বা পাথর। এমন বিপদের মুখে দশ হাজারে একজন পালাতে পারে না, এমনই ভয়ংকর। এ-দেশের মানুষকে ‘তুষার শৃঙ্গের মানব’ নাম দেওয়া চলে অবলীলায়। এ-সকল পর্বত পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছোলেন উত্তর ভারত। একেবারে সীমান্তে তো লি জাতির মানুষের বসতি। এঁদের মধ্যে শ্রমণেরা আছেন। প্রত্যেকেই হীনযান মতাবলম্বী।

বুদ্ধের ছিল আঠারো জন ব্যক্তিগত শিষ্য। আর জানা যায় যে, তাঁদেরই একজন নিষ্ক্রমণ শক্তি দ্বারা এক কুশলী শিল্পীকে স্বর্গরাজ্যে নিয়ে যান, সেখানে মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব মূর্তির (চীনের মন্দিরে হাস্যরত ঈশ্বরের বিগ্রহ) দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বর্ণ ও বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণের জন্য। উদ্দেশ্য ছিল, যাতে ফিরে এসে তাঁকে দিয়ে কাঠের উপর নিজের একখানি মূর্তি উৎকীর্ণ করানো যায়। এই পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে সর্বমোট তিনবার স্বর্গলোক যাত্রা করেন। অবশেষে সম্পূর্ণ করলেন আশি ফুট উচ্চতার বিশালাকায় একটি কাঠের মূর্তি, যার চরণ দু-খানিই ছিল আট ফুট লম্বা। ব্রত, উপবাসের দিনগুলোতে উজ্জ্বল দীপ্তিতে ঝলমল করে উঠত এই মূর্তি। এইখানে পূজার অর্ঘ্য দেবার জন্য এ-প্রদেশের রাজাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত।

সপ্তম অধ্যায়
পর্বতের ইশারায় এগিয়ে যাও দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত ধরে,পাবে কঠোর, দুর্গম, অতি ভয়ংকর এক পথ। পনেরো দিন এই পথে একটানা চললেন যাত্রীদল। পাথর প্রাচীরের মতো নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে এক-একটি পর্বত। মোটামুটি একহাজার জেন তাদের উচ্চতা। দৈবাৎ প্রান্তে এসে পড়লে চোখের দৃষ্টি হয় বিহ্বল। দুর্মর সাধ জাগে এগিয়ে যাই সামনে, আর সত্যিই যদি সাড়া দাও সে-ইশারায়, হারিয়ে ফেলবে মাটি, হারিয়ে ফেলবে শূন্য। নীচে স্রোতস্বিনী সিন-তন। প্রাচীন সময়ের মানুষেরা পাথর কেটে পথ তৈরি করেছিল। পর্বতপ্রান্ত ধরে সাতশো ধাপের একটি সোপান। সে-সিঁড়ি বেয়ে যদি নীচে নামা যায়, দেখা যাবে নদীর উপরে ঝুলে আছে দড়ির সেতু। নদীর দু-টি তীরের মাঝের দৈর্ঘ্য আশি কদমের কম। চিঙ-ই-র মতে হুন সাম্রাজ্য থেকে আসা ছাং চিন বা কান ইং এই স্থানে পৌঁছোতে পারেনি। সন্ন্যাসীগণ ফা-হিয়েনের কাছে জানতে চাইলেন, পুবের দেশগুলিতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার কোন সময় থেকে শুরু হয়। ফা-হিয়েন বললেন, “যার কাছেই আমি জানতে চেয়েছি সকলেই বলেছে যে, ভারতবর্ষের শ্রমণেরা প্রাচীন রীতি মেনে, মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বের মূর্তি স্থাপনের দিন, নদী অতিক্রম করে বৌদ্ধ সূত্রাবলী এবং শৃঙ্খলাগুলি এখানে নিয়ে আসেন”। বুদ্ধের নির্বাণের তিনশ বছর পর এই মূর্তি স্থাপনা হয়। তখন চৌ সাম্রাজ্যের পিং ওয়াং রাজার শাসনকাল। এই সময় থেকেই বুদ্ধের উপদেশাবলি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মহান মৈত্রেয় ছাড়া আর কেউ বুদ্ধের ত্রিকায়া এবং তার উপদেশাবলির এমন সম্যক প্রচার করতে পারেননি। বিদেশিদের কাছে এই ধর্মবিশ্বাস এভাবেই পরিচিতি পায়।

হুন সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা মিং টি বৌদ্ধধর্ম প্রচারের স্বপ্ন লালন করেছিলেন। আর ফলস্বরূপ পবিত্র গ্রন্থগুলি ফিরিয়ে আনার জন্য অভিযান শুরু হয়। বুদ্ধের প্রচলিত অনুশাসনগুলির উৎস যে কী, তা মিং টির স্বপ্নের মতো একরকম অমীমাংসিত রহস্যই হয়ে রইল।

প্রথম পর্ব

Categories
Editorial

সম্পাদকীয়

অনেকদিন ধরেই আমরা পরিকল্পনা করছিলাম ‘তবুও প্রয়াস ওয়েবজিন’ মাসে মাসে প্রকাশ করার। ধীরে ধীরে সেই কাজের প্রস্তুতিও চলছিল। শেষপর্যন্ত মে মাসে এসে বাস্তবায়িত হল। আমরা বরাবর ভালো লেখা, নতুন লেখার সন্ধানে থেকেছি। এই সংখ্যাতেও আমরা চেষ্টা করেছি সদ্য লিখতে আসা কোনো তরুণের লেখা যেমন প্রকাশ করার, পাশাপাশি তেমন নানা বিষয় বৈচিত্র‍্যের নিরিখে অভিজ্ঞ কলমচির লেখা।

এই সময়টা কতটা সাহিত্যের জন্য অনুকূল, তা হয়তো প্রশ্ন রাখতে পারে। তবে ঘরবন্দি মনের সুদূর আকাশ সাহিত্যপাঠের বিকল্প কিছু হতে পারে না। কোথাও যদি এই সাহিত্য সংখ্যা আমাদের একটুও মুক্তির আলো এনে দিতে পারে, একটি পত্রিকা সফল।

পাঠে থাকুন। আনন্দে থাকুন।
আলো আসবেই।