Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

পাপড়ি রহমান

পাতার পাহাড়, রক্তবর্ণ হিম আর উষ্ণবয়সি ব্ল্যাকবোর্ড

টিলার উপর থেকে রাবারবাগানটাকে একেবারে পাতার পাহাড়ের মতো দেখায়। রাবার প্ল্যান্টগুলোর পাতাই কেবল দৃশ্যমান হয় বলে প্রাথমিকভাবে আমাকে এই বিভ্রমের ভেতর পড়তে হয়েছিল। অবশ্য এই বিভ্রমের ভেতর নাস্তানাবুদ হওয়ার পূর্বে আমি ঝুক্কুর ঝুক্কুরের দুর্দান্ত স্বাদ পেয়েছিলাম। আদতে ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে যেনতেন প্রকারের স্বাধীনতা নয়। দীর্ঘকাল ফাটকবাসের পর এক্কেবারে গ্যাস বেলুনের মতো উড্ডীন হতে পারা। উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো ঘটনাই ছিল সেটা। আমার আতঙ্কবাদী বাবা ওই প্রথমবার আমাকে ঘরের বাইরে দুই পা ফেলতে দিলেন। আর আমার এইরকম গ্যাসবেলুন হয়ে ওড়ার সুযোগ ঘটল রাজাকাক্কার কল্যাণে। রাজাকাক্কা মানে বাবার ফুফাত ভাই। তদুপরি তিনি ফরেস্টার বা আরও ঊর্ধ্বতন কোনো পদে কর্মরত। বাবা তাকে মোটামুটি দেবতাজ্ঞান করেন। রাজাকাক্কার মেয়ে বিউটি আপা আমার চেয়ে পাঁচ ক্লাস উঁচু। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যে কিনা আমারই ইশকুলে ভর্তি হল। আর বিউটি আপার সাথে আমার খাতির জমল দুধে ভেজানো চিতইয়ের মতো। যাতে কেবল চিত হয়ে ভেসে থাকা। উপুড় হওয়ার মতো কোনো ঘটনাই ঘটল না কোনোদিন! রাজাকাক্কা আর বিউটি আপার ব্যাপক টানাহেঁচড়ায় আমার আতঙ্কবাদী বাবার দিল সামান্য নরম হল। কিন্তু বন্দুকটা রইল আমার দিকে তাক করা। এই এক আরেক বিভ্রম। ভয় আর ভালোবাসা। দোস্তি আর ঘৃণা। আমি জানি তাক করে রাখা বন্দুকের নলটি অন্যত্র সরিয়ে নিলে বাবা একেবারে অন্য মানুষ। সদ্য জন্মানো শিশুর গায়ের পেলবতা সেই মানুষের মনে সেঁটে থাকে। অচেনা রূপ-গন্ধ-আশ্রয়। অথচ অহেতুক এই বন্দুক তাক করে রাখা — বাবাকে একেবারে আতঙ্কবাদীতে পর্যবসিত করেছে।

একেবারে পরম পাওয়া এই ঝুক্কুর ঝুক্কুর। ট্রেন আমাকে নিয়ে ছুটল ম্যালা দূর! ম্যালা দূর কত দূর? এইটা একটা প্রশ্ন বটে! ম্যালা দূর যে কত দূর তা মেপে বের করা মুশকিলের বিষয়।

ঝুক্কুর ঝুক্কুর করে ট্রেন গতি নিয়ে ছুটে চলল। আর গাছেদের-পাতাদের গন্ধ আমার নাকে ঝাপটা মেরে যেতে লাগল। আহ! কী করে বোঝাই যে সবুজের কী অদ্ভুত গন্ধ আছে! গাছেদের-পাতাদের গন্ধ কি মাতৃজঠরের গন্ধের মতো? আমি জানি না। মাতৃজঠর মানে কী তাই তো আমি ভালো জানি না!

উথালপাথাল করা সবুজগন্ধে ভাসতে ভাসতে আমি ট্রেনের জানালায় মুখ রাখলাম। তখন দুই ধারে পাহাড়ের সারি, বনজ ঝোপ দেখা দিয়েই মিলিয়ে যেতে লাগল। যেন ওরা মেঘের বিদ্যুৎ। সামান্য ঝিলিক মেরেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি পিছলে যায় লালমাটি আর দেবদারুর বনে। ভিনদেশি ত্বক নিয়ে ইউক্যালিপটাস। তেজপাতার ডাঁটো পাতার বৃক্ষরাজি। পাহাড় আর সমতলের আলোছায়ার ভেতর দুলতে দুলতে ট্রেন আমাকে সত্যি সত্যি যদুনাথপুরে পৌঁছে দিল।

নেমে দেখি ফরেস্টের জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জিপে ওঠার পর চলন্ত জিপের পেছনের খোলা অংশে তাকিয়ে দেখি কোথায় সেই পাহাড়ের সারি? কোথায়ই-বা রেললাইন? সব হাওয়া হয়ে গেছে। আর বিস্তীর্ণ সবুজ আমাদের ঘিরে রেখেছে। গাছেদের-পাতাদের এতটাই মেশামেশি যে, কোনটা যে কী গাছ তা-ও আলাদা করা দুরূহ। সেই নিবিড় বনরাজি, গাঢ় সবুজ গাছপালা আর পাখিদের বিচিত্র ডাক শুনতে শুনতে দেখি সেগুনের প্রায় গোলাকার ঢাউস পাতারা আকাশচারী হয়ে আছে। ত্রিপল ঢাকা জিপের ভেতর সবুজ গন্ধ ভরে উঠলে আমি মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠি — একটা গাছ আমি অন্তত চিনতে পেরেছি — সেগুন!

যখন আমার অপু-দুর্গার মতো গ্রামময় এক ছেলেবেলা ছিল, তখন আমি সেগুনকে বেশ ভালোই দেখভাল করতাম। কেউ তো আর জানে না — বোশেখের ঝড়বৃষ্টির পর সেই গাছের নীচে পড়ে থাকা ছিন্নপত্র ও গোটা গোটা ফল দেখার লোভে কতদিন আমি ছুটে গেছি। সেগুনের পাতা ডলে দুই হাত রাঙিয়ে তুলেছি। ওইসব খবর কেই-বা রাখে? ওই অপু-দুর্গার জীবনে কেই-বা আমার গতিবিধির উপর কড়া নজরদারি করবে?

আমার আতঙ্কবাদী বাবার খপ্পরে পড়ার আগে গ্রামময়, বৃক্ষময়, বৃষ্টিময় — স্বাধীন এক ছোটোকাল আমাকে মারাত্মক সুখী করেছিল!

আমার সেই ছোটোকালেই সেগুন আমার সঙ্গী হয়েছিল। সেগুনের ফুল ছিল হালকা ঘিয়ে রঙের। আকাশের তারকার আকৃতির। সেই ফুল নাকের পাতায় বসালেই পড়ে যেত। আমি ফের বসাতাম। এভাবেই দিনমান ফুলের উত্থান-পতন খেলায় মেতে থাকতাম। সেগুনের অনতিদূরে বাতাবিলেবুর গাছ। তাতে যখন ফুল ঝেঁপে আসত — আহা কী যে তাদের রূপ আর সুগন্ধ! আমাদের ছুটন্ত জিপের কোনো ধারেই বাতাবিলেবুর একটা গাছও নজরে এল না। শুধু গাছের গন্ধভরা, পাতার গন্ধভরা সবুজ হাওয়া কেটে কেটে আমাদের জিপ এগিয়ে চলল।

জিপ থামল বেশ উঁচু একটা টিলার নীচে। নেমে দেখলাম সুদীর্ঘ সিঁড়ি টিলাটাকে দুই হাতে পেঁচিয়ে ম্যালা দূর উঠে গেছে। আমরাও আমাদের তল্পিতল্পাসহ উঠতে লাগলাম। যতই উপরে উঠতে লাগলাম চারপাশে সন্নিবিষ্ট সবুজ পাতা ছাড়া আর কোনো দৃশ্য নাই! ওই প্রত্যন্ত পাহাড়িয়া অঞ্চলে বৃক্ষ আর আকাশ ছাড়া আর যেন কিছুই নেই!

সিঁড়ি আর শেষ হয় না। উঠতে উঠতে হাঁপ ধরে যায়। জলতেষ্টায় কণ্ঠ কাঠ-কাঠ হয়ে উঠলে — রাজাকাক্কার সুবিশাল বাংলো।

টিলার উপরের ওই বাংলো থেকে চারপাশে তাকালে দুই-চারটা ছড়া দেখতে পাওয়া যায়। ওইসব পাহাড়ি ছড়া বা ঝরনার জলে রোদ্দুর পড়ে রুপালি রঙের নহর বইয়ে দিচ্ছে।

এই যে একেবারে ছবির মতো সাজানো পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্যাবলি — যা দেখে মনে হয় স্বর্গ কোনোভাবেই এর চেয়ে উত্তম হতে পারে না। তবে সবচাইতে আনন্দের বিষয় এইখানে আমার আতঙ্কবাদী বাবা নাই। তার কড়া শাসন আর প্রচণ্ড মারধরের উপদ্রব নাই।

আহা! স্বাধীনতা! স্বাধীনতা সব সময়ই জীবনকে আনন্দময় করে তোলে। আমাকে যদি আর ফিরতে না হত ওই মারধরের সংসারে! যেখানে এক নিষ্প্রভ বুদ্ধির মা তার তৈজসপত্রের মতো নিজের মেয়েটিকেও এককোণে ফেলে রাখে — অযত্নে-অবহেলায়।

পরদিন ঘুম ভাঙতেই দেখি রোদ্দুর বাংলোটিকে স্পর্শ করে হেসে আছে। যেদিকে তাকাই সবুজের নানা রূপে একেবারে ব্যারাছ্যারা অবস্থায় পৌঁছে যাই। আদতে এসব হল সিদ্ধান্তহীনতার ঘোর। কোন্ সবুজ যে আমার নয়ন জুড়িয়ে দেবে আর আমি সেদিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকব!

বাংলো থেকে নীচে তাকালে পা শিরশির করে। বিস্তর সবুজের ভেতর আমার ঘূর্ণায়মান আঁখি হঠাৎ করে খুব কাছে এক রুপার নহরের সন্ধান পেয়ে যায়। সবুজ বনানীর মাঝখানটা চিরে যেন গলিত রুপার ধারা বইছে। আর ওই রুপালি স্রোত বহু নিম্নে সমতলভূমির ওপর সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে।

বাংলোতে দাঁড়িয়ে আমি ওই ঝরনার কল্লোল শুনছি। আহা! কে জানে মরণের পর স্বর্গ কেমন? কেউ তো ফিরে এসে বলে নাই স্বর্গের রূপ আসলেই কেমন?

কিন্তু আমি জানি এই বন-বনানীর সবুজ আর নমিত ঝরনাধারার চেয়ে স্বর্গ কিছুতেই উত্তম হতে পারে না।

রক্তবর্ণহিম

লোকালয় পেরিয়ে বহুদূরে বরমচালের রাবারবাগানটিতে যে-সবুজ রাজ্য গড়ে উঠেছে, তাতে হিমও যেন নামে একেবারে আপসহীনভাবে। কারণ সূর্যের আলো ওই অরণ্যে বা বনানীতে ছিটকি পাতার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রবেশ করে। রাতভর ওঁশ পড়ে পাতার উপর আর ওই ওঁশ বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপটপিয়ে ঝরতেই থাকে। ভোরে ঘুম ভাঙলেই দেখি অপরূপ দৃশ্যাবলি। দূর্বাঘাসের ওপর অজস্র ছোটো ছোটো হীরে যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে।

ঘুম ভাঙার পর ঝরনা থেকে তোলা জলে মুখ-হাত ধুয়ে নাস্তা খেতে হয়। প্রতিদিনের নাস্তার মেনু ঘরে তৈরি কাঁচা ছানা, হাতে বেলা রুটি, ছোলার ডালের হালুয়া। কোনো কোনো দিন গরম ভাত, ভর্তা, বাসি তরকারি। বাংলোতে কোনো পানি সাপ্লাইয়ের বন্দোবস্ত নাই। পানি আনতে হয় অনেক নীচুতে গিয়ে, ঝরনা থেকে। সেই পানি রোদের বুকে ফেলে গরম করা হয় এবং ওতেই চলে স্নান।
প্রায় বিকেলেই আমি আর বিউটি আপা হাঁটতে বেরোই। হাঁটবার জন্য আমাদের সুদীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হয়। আমরা হাঁটি রাবারবাগানের ডানা ঘেঁষে — কখনো-বা রাবারবাগানের ভেতর। গাছেদের আর পাতাদের ঝাঁঝালো সবুজ গন্ধে আমাদের বুক ভরে ওঠে। তখনও হয়তো সূর্যাস্তের ঢের দেরি। কিন্তু চারপাশে কী রকম সবুজাভ অন্ধকার। বিউটি আপা বেশ ভারী ধরনের কার্ডিগান গায়ে চাপিয়ে হাঁটে। আমার সেরকম উষ্ণ কোনো শীতের কাপড় নাই। আমাকে পরতে হয় আমার আতঙ্কবাদী বাবার খামখেয়ালিতে বানানো কোট স্টাইলের একটা জামা। সামান্য ভারী কাপড়টা — কিন্তু ভেতরে কোনো লাইলিঙের বালাই নাই। ফলে যত শীত সবটাই ওতে হুড়হুড়িয়ে ঢুকে পড়তে পারে এবং ঢুকে পড়েও। আমি শীতের বিষাক্ত কামড়ে মরণাপন্ন হয়ে উঠলেও কাউকে কিছু বলি না। আমার কোনো দীনতাই অন্যকে বলতে লজ্জা লাগে।

হাঁটতে হাঁটতে বিউটি আপা বাঁ-হাতের বুড়া আঙুল মুখে পুরে চুষতে থাকে। এটা তার প্রিয়তর অভ্যাস। যখন আশপাশে কেউ না থাকে বিউটি আপা তার এই অভ্যাস বজায় রাখে।

এদিকে আমি বয়সে ছোটো ও বিউটি আপার প্রিয় বলে এই কাজটি সে আমার সামনে হরহামেশাই করে। ওইরকম সবুজাভ অন্ধকারের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে বিউটি আপা একদিন বলে ওঠে — গন্ডারের গন্ধ পাচ্ছি।
— কী! মানে কী?
— গন্ডার নেমেছে পাহাড় থেকে। রয়েছে আমাদের কাছ থেকে সামান্য দূরেই।
— কী?
— হ্যাঁ, আমি গন্ডারের গন্ধ চিনি।
শুনে ভয়ে আমার গায়ের লোম জারিয়ে যায়।

বন্য জীবজন্তুও তাহলে রয়েছে এই অরণ্যে? ঘন জঙ্গল কেটে রাবার চাষ করা হয়েছে — মানুষদের কিছু ঘরবাড়িও রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কিন্তু তা প্রায় না-থাকার মতোই। তবুও একেবারে জনমনুষ্যি নাই এমন তো নয়! এর মাঝে গন্ডার কীভাবে আসে?

চিন্তা যত দ্রুতই করি না কেন — ওই সূর্যের আলোহীন সবুজাভ বিকেলে কোনো কিছুকেই প্রতিরোধ হিসেবে দাঁড় করাতে পারি না। হয়তো আমার মতো বিউটি আপাও পারে না। আমরা জানি, জঙ্গলের আড়ালে সূর্য হারিয়ে গেলে চারপাশ কত দ্রুত ঘন অন্ধকারে পূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন সিঁড়ি বেয়ে ওঠা কতটাই-না ঝুঁকির। ভাবতে ভাবতেই শীত যেন হঠাৎ আমাদের আরো আচ্ছন্ন করে ফেলে! আমরা জানি না — শীতের তীব্রতায় না গন্ডারের ভয়ে আমাদের দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক শব্দ তুলতে থাকে। যদিও খুব মৃদু সে-ধ্বনি। কিন্তু বিউটি আপা বা আমি দুজনেই সে-ধ্বনি থামাতে পারি না। প্রায় দৌড়ে বাগান থেকে বেরিয়ে আসি। বিউটি আপা সাধ্যমতো চেষ্টা করে আমার সঙ্গ ধরতে। কিন্তু আমি এত জোরে দৌড়াই যে মুহূর্তে রাবারবাগানের দীর্ঘকায় গাছগুলো দূর ছবির মতো অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিউটি আপা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে দৌড়ের গতি বাড়ায়। আমরা যখন টিলার উপরে উঠি তখন ওই সবুজাভ অন্ধকার ঘন কালোতে রূপ নিয়েছে।

আমাদের ঘেমে নেয়ে ওঠা শরীর গরম কাপড়ের আড়ালেই থাকে। ঝরনার তোলা জলে মুখ-হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে প্রবল কাশির চোটে আমি একেবারে কাস্তের মতো বেঁকেচুরে যাই। আমার মনে হয় প্রচণ্ড এক হিমখণ্ড আমার বুকের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ফলে বেদম কাশিতে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। বিউটি আপার আম্মা রসুন থেঁতো সরষের তেলে গরম করে আমার বুকে-পিঠে জোরে মালিশ করে দেন। কিন্তু আমার কাশির উপশম হয় না।

বিউটি আপা তার ঢাউস টেনজিস্টারের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গান বাজায়। একেবারে লো ভল্যুমে। আমি বলি —
আরেকটু জোরে বাজান
— না, না আর জোরে না।
— কেন?
— মানুষ শুনলে মন্দ বলবে।
গান বাজালে মানুষ মন্দ বলবে? আমি এই রহস্যের কোনো কূল-কিনারা পাই না। বিউটি আপাকে দেখি টেনজিস্টারের সাথে কান লাগিয়ে গান শোনে। ফলে আমাকেও কান লাগিয়ে গান শুনতে হয়। আমার কান ব্যথা করতে থাকে আর কাশিও বাড়তে থাকে।
এদিকে চাচিমা আমাকে প্রতিদিনই গোসল করতে বলেন। বলেন,
— গোসল করো, গোসল করো নইলে কফ বুকে শুকাইয়া যাইব।

আমি সূর্যের নীচে ফেলে রাখা কুসুম-গরম পানিতে হররোজ গোসল করি। বিকাল হলেই রাবারবাগানের ধারে বা ভেতরে বা ঘাসময় দীর্ঘ জমির উপর হাঁটতে থাকি। সঙ্গে বিউটি আপা। আমার পরনে আমার আতঙ্কবাদী বাবার খামখেয়ালিতে বানানো সেই কোট। ভেতরে লাইলিঙ ছাড়া। ফলে পাহাড়-টিলা-অরণ্য-ঝরনার যত হিম সব আমার শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ে। আমার কাশির বেগ বাড়ে। আর ঘুঁতঘুঁতে জ্বরে আমি অবসন্ন হয়ে পড়তে থাকি।

ওই পাহাড়-অরণ্য-ঝরনা আর বিশুদ্ধ বাতাস, তাজা ছানা — হালুয়া — রুটি কিছুই আমার জ্বর কমাতে পারে না! এমনকি আমার কাশিও না। জ্বর-কাশি নিয়েই আমি রাবার বানানোর প্রক্রিয়া দেখি। কীভাবে রাবারের বৃক্ষ কাটা হয়, কীভাবে তাতে টিনের পাত্র পেতে দেওয়া হয়, কীভাবে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিয়ে সেই রাবারের মণ্ড তৈরি করা হয়।

এদিকে চাচিমার গরম সরষের তেল আর রসুনের মালিশে আমি বিব্রত হতে থাকি। কারণ আমি দেখি আমার সমতল বুকে পক্ষীশাবকের নরম রোঁয়া উঠেছে। ডিমের কুসুমের মতো কুঁড়িস্তন আমাকে সংকুচিত করে তুলছে।

ধুর! চাচিমা খামোখাই এত কষ্ট করছে। আমার কাশি তো কিছুতেই কমছে না!

এদিকে অরণ্য বা পাহাড়ের কোনো পরিবর্তন নাই। এমনকি ঝরনাধারাও। বাংলোর উপর থেকে জলপতনের শব্দ আমি শুনতে পাই। চাচিমার আরদালি-বেয়ারারা ওই জল টিনের পাত্রে ভরে উপরে উঠিয়ে নিয়ে আসে।

আহ! একেবারে বিশুদ্ধ জল!

এই পাহাড়ের হাওয়া বিশুদ্ধ। গাছতলা-বৃক্ষরাজি, তাদেরও উদ্ভাসিত তারুণ্য। আর আছে বান্দরের মেলা। প্রায়ই গাছ থেকে নেমে এসে ওরা চাচিমার নানান কিছু নিয়ে পালিয়ে যায়! ওদের ধরার সাধ্য কারও নাই। আর আছে পাখিদের বিচরণ। কত বর্ণ-গোত্রের পাখি! কত বিচিত্র তাদের কথাবার্তা! বিশাল বিশাল রক্তচোষা! ভয়ে আমি একা কোথাও যাই না।

রক্তচোষা যদি আমার সব রক্ত চুষে নেয় এই ভয়েই কিনা কে জানে আমার শরীরের রক্ত জোট বাঁধে। অবশ্য আমি তা আদৌ বুঝতে পারি না।

আমি পুনরায় ত্রিপল ঢাকা জিপগাড়িতে চেপে বসি। বিউটি আপা সজল চোখে তাকিয়ে থাকে। চাচিমা বলেন — ‘ফের আইসো বাপ। ইশকুল ছুটি হইলেই আইসো।’

আমার আতঙ্কবাদী বাবা আমাকে নিতে এসেছেন। ফের সেই ভয়াবহ কারাগার। ফের বন্দীজীবন। ফের বৃক্ষহীন নগর। বিষাক্ত হাওয়া। ট্রেন আমাকে হাওয়ার টানে উড়িয়ে নিতে থাকে। বরমচালের অরণ্যে আমি কত যে কাঠবিড়ালি দেখেছি! কত পাখি আর তাদের গান!
কেন যে আমি মানুষ!

কাঠবেড়াল হলেও তো লুকিয়ে থাকতে পারতাম গাছের কোটরে।

দুই পাশের লালমাটির পাহাড় ফেলে ট্রেন কী ভীষণ জোরে ছুটে চলেছে! পাতাদের সবুজ ঘ্রাণ হাওয়া থেকে ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকে। আমি কি তাকালেই দেখতে পাব ওই নিবিড় স্নেহছায়াময় সবুজ বনভূমি?
জানি — পাব না।
ফেলে আসা কোনোকিছুই মানুষ কোনোদিন অক্ষত ফেরত পায় না!

উষ্ণ বয়সি ব্ল্যাকবোর্ড

আমাদের বাগানের ঘাসগুলা কি অতটাই সবুজ?

বিউটি আপার সাথে যে-ঘাসে আমি হেঁটেছিলাম তাদের মতো?

আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ঘাসেদের সবুজ হওয়া দেখি, কিন্তু কিছুতেই ওই সবুজের সাথে মেলাতে পারি না। আমাদের বাসার ভেতরে অরণ্যের ঘ্রাণ নেই — কেরোসিন তেলের ঘ্রাণ থইথই করে। মা ওই তেলে স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে। এদিকে তরল কাশির দমকে আমার শরীর আরও অনেক বেশি বেঁকেকুকে যায় — আমি কাশতে কাশতে দম নিতে পারি না।

আমাদের সাদা গোলাপ গাছে বিস্তর কুঁড়ি এসেছে। কয়দিন পরই ফুল ফুটিয়ে গাছটিকে এরা ঢেকে দেবে। নানা রঙের জিনিয়া আর গোলাপি সাদা দোপাটি ফুলের সারি দেখতে দেখতে আমার পাহাড়ের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। গন্ডারের গন্ধভরা বিকেল। আমাদের ত্রাস আর দৌড়ানো শুরু করা। ওই গভীর নির্জন অরণ্যে — ওই সবুজাভ সন্ধ্যাবেলায় আমাদের ত্রাণকর্তারূপী কেউ ছিল না। ফলে আমাদের দৌড়াতে হয়েছে। বেদম দৌড় যাকে বলে।

আমি আমাদের বাগানের ঘাসেদের রকম-সকম দেখতে দেখতে প্রচণ্ড কাশিতে ফের বাঁকাকুকা হয়ে যাই। তরল লবণাক্ত কফ ফেলতে ফেলতে হঠাৎ চমকে উঠি। দেখি রক্তের মতো কী যেন ঘাসের ভেতর গড়িয়ে যাচ্ছে।
রক্ত!
সত্যিই রক্ত নাকি?
ফের কাশি ওঠে। ফেলতে ফেলতে ফের চমকাই।
রক্ত!

আহা! সেই যে হিমের বিকেল — পাহাড়ের সেই প্রচণ্ড হিম কি রক্তবর্ণ ধারণ করে আমার ফুসফুসের ভেতর বাসা বেঁধেছে!

তৃতীয়বারের কাশিতে ঘন রক্ত উঠে আসে।
আর বাগানের ঘাসে সেই রক্ত লাল ফড়িঙের মতো ঝুলে থাকে। আমি আমার আতঙ্কবাদী বাবাকে ডাকি।
— বাবা কাশির সাথে রক্ত যাচ্ছে!
— কী বলো? কই দেখি?
— বাগানের ঘাসে।

বাবাকে বলা হয় না ঘাসের ওপর বসে থাকা লাল ফড়িংদের পিছু পিছু আমি কত সাবধানে পা ফেলেছি। দুই হাতে ডানা দুটো যে-ই ধরতে যাব — হঠাৎ সে উড়ে গেছে! আর আমি সে-দুঃখে প্রায়ই কেঁদে ফেলেছি। আজ সেই লাল ফড়িঙের দল আমাদের বাগানের ঘাসের ওপর স্থির বসে আছে। ভারি অদ্ভুত কাণ্ড তো!

বাগানের ঘাসে রক্তচিহ্ন দেখে বাবা ভয়ানক গম্ভীর হয়ে যান। আমাকে আর কিছুই বলে না।
এরপর থেকে আমার ইশকুল কামাই হতে লাগল। বিকেলবেলার সাথীরা আমাদের বাসায় আসা ছেড়ে দিল। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্রমাগত কাশতে লাগলাম। রক্ত ঝরে ঝরে আমার ফুসফুস প্রায় শূন্য হয়ে গেল। অবস্থা দেখে বাবা প্রায় উন্মাদগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। এ-ডাক্তার, সে-ডাক্তার — ছোটো-বড়ো সব ডাক্তার জড়ো করে ফেললেন। ওষুধ-পথ্য-এক্সরে-জ্বর-চাদর এইসবের মাঝে আমার জীবন কী অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে গেল!

আমি রাতভর কাশতাম। আমার বিছানার পাশে ছাইভর্তি বাসন দিয়েছে মা। যাতে বাতাসে জীবাণু না ছড়ায়। ভোর হতে হতে রক্তে ভিজে সব ছাই দলা পাকিয়ে যেত। আমিও অবাক হতাম — আমার এতটুকুন শরীরে কী করে এত রক্ত এল?

এই যে অবিশ্রাম কাশছি — কাশির সাথে টকটকে তাজা রক্ত উঠে আসছে, তবুও কেন রক্ত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে না আমার শরীর থেকে?

সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার মনে পড়ে যেত ইশকুলের কথা। ক্লাস টিচার রাবেয়া খাতুন ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ি দিয়ে তারিখ লিখছেন। তার দুধসাদা আঙুলে চকখড়ি ধরে রাখা। সরু সরু চমৎকার আঙুলগুলো চকের গুঁড়োতে মাখামাখি! রাবেয়া খাতুন, আমার খাতায় প্রায়ই লিখে দেন ‘ভালো রাখা’।
‘ভালো রাখা’ মানে কী?
একদিন লিখলেন ‘রাখা’।

আমি বুঝলাম ‘ভালো রাখা’ মানে গুড ধরনের কিছু হবে। আপার নাম আসলে রাখা — রাবেয়া খাতুন। রক্তের সমুদ্দুরে ভাসতে ভাসতে আমার শুধু ইশকুলের কথাই মনে পড়ে। খরস্রোতা নদী পেরিয়ে আমার ইশকুল — আমার ক্লাসরুম আর সহপাঠীরা। এদিকে মাকে দেখি আমার খাবারের গ্লাস-প্লেট সব আলাদা করে দিয়েছে। আমার প্লেটে সে কাউকে খেতে দেয় না। অন্যদের প্লেট-গ্লাসে খেতে দেয় না আমাকেও। এটা সে এতটাই চাতুরীর সাথে করছে যে আমার আতঙ্কবাদী বাবা টেরও পান না।

আমার কি ভয়ংকর কোনো অসুখ করেছে?
নইলে মায়ের এত সাবধানতা কেন?
আমি একদিন খেতে বসে কেঁদে ফেলি!
বাবা চোখ লাল করে জানতে চান,
— কী হইছে? কান্দস কেন?
আমি বলি,
— আমার খাওয়ার প্লেট-গ্লাস মা আলাদা করে দিয়েছে।
— কোনটা তোর?

আমি আঙুল তুলে একটা লাল বর্ডারের প্লেট দেখিয়ে দিলে বাবা ওতে খেতে বসে যান।
বাবার মুখ দেখি থমথম করে। দেখি বাবাও কাঁদছে।

আমার উপলব্ধি হয় — আমার শরীরটা পাখির মতো হালকা হয়ে গেছে। এখন আমি যেন ইচ্ছে করলেই উড়ে যেতে পারি। উড়ে উড়ে বরমচালের রাবারবাগানে পৌঁছে যেতে পারি। ওইখানে যে-ঝরনা বইছে, সে জলপান করে ফিরে আসতে পারি; অথবা ওই সবুজ বনভূমির প্রতিটি বৃক্ষের পাতায় পাতায় দোল খেতে পারি। ঠোঁট দিয়ে খুঁটে দিতে পারি পাতাদের শিরা-উপশিরা। অথবা উড়তে উড়তে ওই অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলতে পারি। হয়তো তখন অন্ধকার ঘনায়মান। বানরের দল গাছের ডালে চুপটি করে বসে বসে অপেক্ষা করছে রাত্তিরের। অন্ধকারের ভয়ে আমার পাখি-শরীরটা নিমেষে লুকিয়ে ফেলতে পারি পাতাদের আড়ালে, যাতে কেউ আমাকে আর খুঁজে না পায়। আমি অরণ্যের গন্ধের ভেতর, বিশুদ্ধ হাওয়ার ভেতর, ঝরনার জলের ভেতর একাকার হতে হতে ভুলে যেতে পারি সংসার-কারাগার। যেখানে বাড়াবাড়ি শাসন, কড়া পড়ার চাপ, প্রচণ্ড মারধরে আমার ছোট্ট শরীরটা প্রায়ই নীলাভ হয়ে থাকে। সেই জখমচিহ্নের দিকে তাকিয়ে আমি সারারাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। একটা জখম না-সারতেই আরেকটা জখমের চিহ্ন তীব্রভাবে শরীরে বসে যায়।
অবিরাম কাশি, রক্তপাত, ওষুধ, পথ্য, চাদর, বালিশ, বিছানার সঙ্গে আমার আতঙ্কবাদী বাবা সেঁটে থাকেন। আমার ভয়ানক অসুস্থ শরীরটাকে সারিয়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। কিন্তু আমি তো সেরে উঠতে চাই না। সেরে উঠলেই আমার শরীরটা আর পাখি থাকবে না। ভারী শরীর নিয়ে আমি কি আর উড়তে পারব? কিন্তু আমাকে যে উড়তেই হবে।

উড়ে উড়ে যেতে হবে ওই পাহাড়ে, ওই অরণ্যে। ওই অরণ্যে আমি ফের যেতে চাই — যে-অরণ্যের হিম আমার ফুসফুস ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। আমার এই অসুস্থতা, প্রবল রক্তপাতময় শরীরটাকে আমি ওই অরণ্য ছাড়া আর কোথায়ই-বা রাখতে পারব?

ওই অরণ্যের দিনগুলোতেই তো আমার সমতল বুকে ডিমের কুসুমের মতো কুঁড়িস্তন জেগে উঠেছে। ওই অরণ্যই আমাকে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে।

এখন এই ভাঙাচোরা, মৃতবৎ, ক্ষয়িষ্ণু শরীরটাকে নিয়ে আমি আর কোথায় আশ্রয় পাব?
আমি জানি মানুষ ফিরিয়ে দিলেও অরণ্য কিছুতেই ফেরাবে না। ফেরাতে পারবে না। অরণ্যের ঠাঁই মানুষের জন্য চিরকালের।

Categories
কবিতা

নীলাঞ্জন দরিপা

অযুত পাগলামিপুঞ্জ


আমার দু-খানি দুঃখ, যদিও সদ্ভাব নেই, আমাকে নিস্তার দিতে তবু দু-জনেই
পথে নামে, ভিন্ন পথ, কিন্তু শেষে মিলে একই, কজনই-বা হতে পারে দুঃখ নিবারক
এখন দু-জনই থমকে, অনন্ত দু-হাত নিয়ে ম্যাজিক দেখায় মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ
কখন সংকেত দেবে সে-আশায় বসে থেকে এত বুদ্ধু ঘুণাক্ষরে চিনতেও পারে না
আমাকে অদ্ভুত বেশে। অতঃপর নিজেরাই হতোদ্যম হয়ে ধরে পরস্পরে হাত
দু-খানি বিচ্ছিন্ন দুঃখ, মুখদেখাদেখিটুকু ছিল না যাদের তারা একত্রে বাসায়
ফিরে এলে পাশবিক হাসি ছাড়ে ঠান্ডা হওয়া তড়কা-রুটির মতো ব্যাচেলর দিন


যা কিছু বলতাম, সব, অদ্ভুত বনজ শব্দে, তাই রেখে এসেছিলে গভীর বাদাড়ে
অথচ সে-ভাষা, ভাবো, জঙ্গলও বোঝেনি মোটে, আসল প্রশ্নের মুখে নিরুত্তর ছায়া
আমার সময় জলে ও জঙ্গলে বইয়ে দিল, এ-সুযোগে শিখেছি সে ফ্যাল-ফ্যাল চোখ
বিচ্ছেদের পড়া ধরলে সেইভাবে চেয়ে থাকি যেন নষ্ট ছেলেবেলা চুটিয়ে ভুলেছি
বোবা বরফের ছন্দে এসব ঝঞ্ঝাট ভাষা ছুঁয়েও দেখবে না স্বভাবত
কারণ এখনও স্পর্শে নামে অন্ধকার সিঁড়ি, ক-ধাপ পেরোচ্ছি সে তো খেয়ালও থাকে না
অথচ আমাকে ত্রস্ত করে এ-অনুচ্চ স্বরে ফোটালে হঠাৎ কেন জান্তব আওয়াজ


বাঁ-হাতে স্বপ্নের ঘড়ি, সময় কেমন যাচ্ছে না জেনেই উড়ে এসে বসেছ ডায়ালে
খামোখা চকচক করছ, আমিও অভ্যেস বশে, কবজি তুলে দেখে নিচ্ছি আয়ু কতক্ষণ
ব্যাস, চোখে চোখ পড়ছে, সারাদিন কী অস্বস্তি, পাশে বন্ধু ঝাপটা দেয় যেন ধুয়ে ফেলবে এই অন্ধের কাজল
বেশি বয়সের মোহ, তোমাকে কীভাবে দেব, অযুত পাগলামিপুঞ্জ, সে তো কম বয়সের কাছে
না কাটা নেশার মতো সুসময়ে দুঃসময়ে মায়াবী খোরাক হয়ে আছে


তুমি তো জানোই আমি এই জল হাওয়া খেয়ে তবুও তোমায় সাজাব না
কখনো ঠগের শব্দে, যা বলার স্পষ্ট বলে যাব।
মাঝে মাঝে তবু জানি নিষ্ঠুর মায়ের মতো, রাতে
লুকিয়েছি কোনো এক নতুন পুরুষ বক্ষে, তোমার ধারণাটিকে মন্দির চাতালে
যখন এসেছি ফেলে, কান্নাকাটি তখনও থামেনি
ভেবেছি এই যে মোহ, কাম, লোভ এই মতে কাটাব জীবন
কিন্তু কী যে হয় কী যে ভয়ানক হয়ে যায় এখনও বুঝি না
চুলের কাঁটাটি তার হৃদয়ে আমূল গেঁথে বিছানায় ফেলে আসি রক্তমাখা লাশ
তোমাকে জুটিয়ে কোলে তবে শান্তি, জেগে ওঠো দুধের কান্নায়
তোমাকে বাজারে আমি বিখ্যাত করব না প্রিয় প্রতারক উচ্চারণে, নির্বোধ তারিফে
অর্ধযৌনসুখী এই স্তন ধরব ওই মুখে, সপাট ভাষায়


এমন অদ্ভুত ছায়া দিলে আর যাওয়াই হল না
রোদের বিস্তারে কোনোদিন। পুরোনো ছবির মতো সাদা সাদা দাগ নিয়ে
দুর্বিপাকে কারো হাতে আসি, এ-পাতা ও-পাতা ঘুরে
নিঃশব্দ দ্বিপ্রহরে মাকে ডেকে যে ফোটায় পৃথিবীর আশ্চর্য জিজ্ঞাসা
একদিন আমিও কি অমন সরল প্রশ্নে থরোথরো বুকে
চৈত্রের রোদ্দুর ভেঙে তোমাকে ডাকিনি


কী থাকে বলার? এত সামান্য কারণে যদি না হও কাতর
এই অভিযোগে মাথা নীচু করি, দেখি কত যত্ন আয়োজন
তোমার আঙুল থেকে ঝরে ঝরে পড়ে, কত শুশ্রূষা শব্দের
না শোনা হুল্লোড় জড়ো করে আছ নিভন্ত অধরে
অপচয়ে ব্যথা জাগে, ভাব ভুল, ভাব ফের অল্পেই জেগেছে
তাই চুপ, তাই সরে আসি
করুণা বিবর্ণ আজ, তোমাকে মলিন করব, সে-সাহসও নেই


যে-জামাটি ছোটো হয়ে গেছে বলে দুঃখ হয় তার কাছে বসি
বয়ঃসন্ধির দুঃখ; সহজে ভাঙে না
রিফুর সূচের মতো ঢুকে পড়ি ছিঁড়ে যাওয়া বোতামের ঘরে
দেখি আজও বিপন্মুক্ত, রোমাঞ্চ চেনেনি। শুধু বুকের পকেট
এখনও হাতের লেখা আছড়ে ফেলে বুকের ভেতরে
ভাঁজে ভাঁজে কেটে গেছে, সেসব অক্ষর টুকরো নিয়ে
এত যে নষ্টামো, সব এক জন্মে শোধ তুলে নেবে
যে-জামাটি ছোটো হয়ে গেছে তাকে চেনাব না দেহের সৌষ্ঠব


আসলে সাহস নেই, নইলে কি কবিতা লিখতাম
নইলে তো তল্লাট হত লণ্ডভণ্ড, কবিতাসদৃশ আমাকেই লেখা হত
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কতো নয়া মহল্লায়, রকে, সভাঘরগুলি
কেঁপে উঠতো স্পর্ধা দেখে, ভাষার দৌরাত্ম্যে কেউ উচ্চারণে সাহস পেত না
আসলে আশঙ্কা, ভয়— কিছু নেই, তাই এত মলিন শব্দেও পারি ভালোবাসা লিখে
নিরীহ অক্ষরবৃত্তে, তোমাকে উচ্ছন্নে নিয়ে যেতে


বহুব্যবহারে, জানি, ক্ষয়ে যাবে মুগ্ধদিন, তবু এ-অস্পষ্ট শ্লোকে সন্দেহের চোখ
তখনও অটুট রাখবে, মেপে নেবে দু-হাতে ঝাঁকিয়ে
জীবনে রহস্যকথা কম নয়, তারও বেশি হতচ্ছাড়া ভাষার প্রশ্রয়
আমি তো লিখিনি বজ্র লিখিনি তো হারে-রেরে-রেরে
আমার সমস্ত কথা মাটির অতীতে সিঁদ কেটে
রেখে আসে কুলুঙ্গীতে পুরোনো বানানরীতি, আমাদের কথার অভ্যেস

১০
তোমাকে বলার জন্য যথাযথ শব্দ খুঁজে ফুরিয়ে ফেলেছি এই প্রিয় শীত, বাংলা ভাষার
অদৃষ্ট তামাশা জানে। এখন উথলে ওঠা বসন্তের ঠোঁটে
অযাচিত বাঙ্ময় করেছে
তুমি তো দূরেই ছিলে, এ-সুযোগে তোমার দুঃখও
মোহ-লালসার দিনে চুপিচুপি সরে গেছে উত্তর না পাওয়া সেই বন্ধুটির মতো
এখন নকল হাতে কীভাবে সাক্ষর রাখি বেহায়া ঋতুতে

১১
বদলি হওয়া প্রতিবেশী চলে যাচ্ছে চোখের আড়ালে
সিঁড়িঘরে সেই সবে কান্না ধরে এসেছে তখন
সন্ধে হব হব রং গালে এসে পড়ে
খুলেছে আলোর গুমটি এতক্ষণে মফস্সল জুড়ে,
সার সার আড্ডা চিরে দিয়ে
ও সাদা এম্বাস্যাডার কেন আসে,
                        কেন-বা কাঁদায়
উনিশশো নব্বই, আমি তোমার কিশোরীটিকে পড়াতে পারব না জানি
আমার কবিতা, তাই দুঃখ হয়, আলোর গুমটি খুঁজে ফিরি
আমাকে ফিরিয়ে দাও তার চোখ, সিঁড়িঘর, পবিত্র কান্নাটি

Categories
কবিতা

দেবজ্যোতি দাশগুপ্ত

গুসবাম্পস

বাইরের আঘাত চিনিয়েছে ব্যথা কাকে বলে।

ছাপ রেখে গ্যাছে আদর।

বার বার ওদের কাছে ফুরিয়ে দিয়েছ নিজেকে।

অথচ কেউ ভিতর থেকে বুঝিয়েছে—
তোমার অস্তিত্ব শরীরের থেকে একচুল বেশি,
যাকে তুমিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারো না।

বারান্দা

প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে গড়া শরীরগৃহ।

হাত থেকে চোখ, চোখ থেকে ঠোঁটে অবাধ বিচরণ।

মনোরঞ্জন!

অবহেলিত উত্তরের বারান্দায় উদাসীন টান।

অতিথি আপ্যায়নে জ্বলে ওঠে আলো।
আর প্রত্যাবর্তনে,
মাংসল মেঝেতে এসে পড়ে হাড়ের নকশাখচিত জ্যোৎস্না-রোদ।

বোধ

সমস্ত ছেড়ে আসার থেকে চালাক হয়েছি।
যেখানে রয়েছি, তার থেকে বোকা।
দুয়ের মাঝখানে যা যা ঘটছে, সব বুঝতে পারছি।
স্রেফ এক কথায় প্রকাশ করার শব্দ পাচ্ছি না বলে,
কিছু সমাধান করা যাচ্ছে না।
প্রগাঢ় সমস্যা ফ্রেমে ধরে রেখেছে সময়।
আর তীক্ষ্ণ পেরেকের মতো খুচরো বিপত্তি,
রক্ত ঝরিয়ে গড়ে তুলছে তাকে।

ওষুধ

স্ট্র্যাপ খোলা জন্ম আমাদের।
বিস্বাদ মেখে দিনের পর দিন বসে থাকি একটা রোগের অপেক্ষায়।

পৃথিবীর ঠোঁট অবধি পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেড়ে গ্যাছে বয়স।

মৃত্যুর মুখে পিছনে ধেয়ে আসা অশ্রুস্রোত,
আমাদের নিয়ে যায় লক্ষ্যের কাছাকাছি।

অথচ সব ঠিক হয়ে গেলে অবাক চোখে দেখি—
স্বাদে, গন্ধে, রঙে না জড়িয়েও
সবসময় পাশে থেকে জল কীভাবে জীবন হয়ে ওঠে!

আরশিবয়স

কনফিউসড্ কৈশোর ও ফ্রাসট্রেটেড যৌবন,
দুটো ভোলাপচুয়াস কুকুরের মতো শৈশব নিয়ে টানাটানি করে।

সংখ্যার দিকবদল ব্যস্তানুপাত।

কাচের গুঁড়ো, সময়ের বালি
ঘড়ির কাঁটা, কাঁটার তার।
তারে মেলা কাপড় কাপড় সাল।

ভাঁজে ভাঁজে নতুন বালক বইয়ে মলাট দ্যায় মা।

 

Categories
কবিতা

তৈমুর খান

ভিখিরি

দুর্বোধ্যের দুয়ারে
আমার হেমন্তকাল ও আমি
নতুন ধানের ঘ্রাণ
শিশিরের ভেজানো আবেশ মেখে
দাঁড়ালাম

তোমার মুখের দিকে
কোন সূর্য চেয়ে আছে
আজ?

সেই তো হলুদ শাড়ি
গোলাপি কাঁচুলি
রজনীগন্ধার মতো ফিকে সাদা চুড়ি
বেজে ওঠে

ভাষা নেই আমার
আজও কিংবদন্তির পাড়ায়
আমি নৈঃশব্দ্যের ভিখিরি

আনন্দের খোঁজে

আনন্দরা কোথায় গেল?
ঘরদোর ফাঁকা পড়ে আছে
শোকেসে সাজানো আছে পুতুল
রঙিন বেলুন আর খেলনাপাতি
শেল্ফে সব বইগুলি গোছানো আছে
ওয়াল হুকে ঝুলছে পুরোনো শার্ট
জানালার কাচে জমে আছে ধুলো
ধুলোয় আঙুলের অজস্র দাগ…

সূর্য রোদ গুটিয়ে নিচ্ছে এখন
গোধূলির আবিররাঙা মেঘে
নীরবে ঝরে পড়ছে দিন বিদায়ের সুর

কাঠের চাকা লাগানো গোরুর গাড়িটি
এখন এখানে আর নেই
ধানমাড়া খড়গুলিও এখানে রাখে না কেউ
বিকেলের শীতে রোদপোহানো মানুষ বসে না এসে
গল্পগুলি সব হারিয়ে গেছে
দু-টান বিড়ি খেয়ে যেত তারা আগে…

আনন্দরা তখন ফিরে আসত রোজ
ধান সর্ষে গম অথবা ইক্ষুক্ষেত থেকে
আনন্দদের ছেলেমেয়েরা শিস দিত
পায়রা নামত হাঁস-মুরগির ভিড়ে

অবেলায় কালিমাখা ধানসেদ্ধ হাতে
আনন্দরা ভাত খেত একসাথে বসে
কুটুমেরা আসত দূর দূর থেকে
ধুলোমাখা পা ধুয়ে উঠে বসত খাটে

কখনো ভোর হত মুড়ি ভাজা ঘ্রাণে
কখনো খেজুর রসে জমত পাটালি
কখনো শুকনো মাছ আর পুঁইশাকে
রান্না হলে চেয়ে নিয়ে যেত প্রতিবেশী

আনন্দরা খড় বিছিয়ে তালাই পেতে
দিব্যি ঘুমাত শীতের রাতে
শিয়ালের ডাকে পার হত রাত
আনন্দরা স্বপ্ন পুষে ঘুমে কুপোকাত

আজ একা ফিরছি শুধু ওদের ডেকে ডেকে
কেউ আর জল তোলে না শান্ত দিঘির ঘাটে
কেউ আর সাঁতার কাটে না স্নানে এসে
শালুক ফুল তোলে নাকো প্রথম ভালোবেসে

আনন্দরা কোথায় গেল?
এক খাবলা মাটি তুলে শুঁকে শুঁকে দেখি
স্নেহের পরশ লেগে আছে
ঝরে পড়া শুকনো ঘাম আর ধুলো
হেঁটে যাওয়া খালি পায়ে…
হয়তো আর বাজে না বেল পুরোনো সাইকেলে!

একটি নিজস্ব কবিতা

তোমার কাজের মধ্যে আছি
তোমার আলোর মধ্যে আছি
আমার ক্ষতগুলি শুধু উপশম খোঁজে
বাইরের ভিড়ে যেতে চায় না কেউ আর
অনেক নষ্টের পর যেটুকু বেঁচে আছি
হৃদয় তাতেই বাঁধে ঘর

হয়তো বসন্ত নেই তবু তো কোথাও ঘ্রাণ আছে
স্মৃতির আয়নার পাশে হলুদ ডানার প্রজাপতি
শব্দে শব্দে গুঞ্জন ওঠে
চাক গড়ে উপলব্ধির মৌমাছি

মুখ দেখে নিই একান্ত নিজস্ব মুখখানি
হেসে ওঠো, যে-হাসি ভোরের দৃশ্যে মিশে যায়
শরতের নিভৃত উল্লাসে নীলাকাশ হয়
তোমাকেই খুঁজে খুঁজে পাই কাকলি-কূজনে

নিজেকে দেখেছি এবার

অসুখ থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছি
দ্রুত মোটরগুলি চলে যাচ্ছে
পতাকা নেই আমার
হে মানুষ, পতাকা নেই!

ঘৃণার জলে ভিজতে ভিজতে
একটাও চালা নেই
সাইকেল নির্ভর জীবন
খণ্ডেৎ ত বিহীন বলে
উৎসব এল না আর

দূরের নকশা দেখে দেখে
কত পদ্ম ফুটল
চৈতন্য জাগল কলরবে
হাওয়ায় উড়ল সিংহাসন

একটা ভ্রমরের পেছনে পেছনে মধু সংগ্রহের উড়ান শুধু আর কিছু নয়

সংশয়

সংশয় একজন বালক বলে
ওকেও মাঝে মাঝে ভিরু মনে হয়
ব্রিজের উপর দিয়ে আমাদের গাড়িটি ছুটছে
ব্রিজও ছুটছে না তো?

আমরা ঝুলে আছি অনন্ত গভীরে
এখানে ভাঙা আকাশের টুকরো আর নিসর্গের নাভি স্বয়ংক্রিয় মায়াবী নিশীথ পড়ে আছে

যেতে যেতে ভাবনারা নড়ে উঠছে
ক্রমশ যেতে যেতে কেঁপে উঠছে আলো
সংশয় কিছুই বোঝে না—

ঝুলন্ত মহুল বনেও নিশ্চুপ কোকিল
টুপটাপ ঝরছে তার শৈল্পিক হৃদয়…

প্রস্তুতি

তোমার আঁচলে কত নক্ষত্র ফুটেছে
বিচিত্র আলোর ঝিকিমিকি
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি!

ওখানে হৃদয় রাখব তোমার আলোয়
ওখানেই রেখে দেব আমার বাঁশির সুর
ওখানে কখনো হবে না অন্ধকার!

শুধু রাত্রির সন্তান হয়ে বেঁচে থাকা যায়?
মাইল মাইল রাস্তা হেঁটে জীবনের আয়ু হল ক্ষয়
অন্ধকারে নিজেকেও বিশ্বাসঘাতক মনে হয়

সারারাত যদিও জেগে থাকি
সারারাত যদিও নক্ষত্রফুল কুড়াই
তবু এক উজ্জীবনের ডাক আসে শুনি

দীর্ঘশ্বাসগুলি লুকিয়ে ফেলি
আর তৃষ্ণাগুলি অস্বীকার করি
গভীর নির্জনে একা চুপি চুপি যাই…

এই জন্ম

যে-শব্দ গান হয়নি
আমি সে-শব্দের কাছে যাইনি কোনোদিন;
যে-মেঘ বৃষ্টি দেয়নি
আমি কি সেই মেঘের কাছে গেছি?
আমার শস্যের খেতে শব্দ আর গান
আমার মাথার ওপর মেঘ আর বৃষ্টির সম্মোহন।

এই জন্ম শুধুই বাঁশি
এ-জীবন শুধুই ভেজা ভেজা অভিমান

দুপুর বিকেল হয়ে আসে
বিকেল রাত্রির ডাক পায়—
গেরুয়া আলোর পথে নামে রাঙাচেলি
রাত্রিতে হেসে উঠবে অদ্ভুত জ্যোৎস্নায়!

বিশ্বাসের ধ্বনিগুলি বেজে ওঠে
অলৌকিক সমুদ্রের নৌকাগুলি ছেড়ে যায়
একে একে সমস্ত নাবিকেরা সাদা পোশাক পরে
আমিও ধূসর গন্ধ মুছে ফেলি মনে মনে

উপলব্ধির সব জানালায়
আমার আসক্তি তীব্র হলে
আবার আবার মেঘ জমে
শব্দেরা গান হয়ে ফেরে।

পাটনি কথিত

ওগো নদী, আমি চলে যাচ্ছি
আর ফিরব না কোনোদিন
আমার নৌকা ভাসিয়ে দিলাম

এখন আমি বিপন্ন স্মৃতির ভেতর
বানিয়ে নিয়েছি ঘরবাড়ি
এখন কান্নার জলের পুকুরে স্নান সারি

বহুদিন দেবী আসে না আর
গাড়ি চেপে চলে যাচ্ছে সব দেবী
সেতুর বাঁধনে বন্দি সব নদী সভ্যতার

কার স্পর্শে কে-বা সোনা হয়
কার বরে কাদের সন্তান দুধ-ভাত খায়
কিছুরই হিসেব জানা নেই তার

শুধু পতাকা উড়ছে চারিদিকে
হানাহানি আর কুৎসার গানে হাততালি
সব রাস্তা জুড়ে নেমেছে বাহিনী

এই পথে কবে আসবে আবার
আমাদের নবজন্মের বিদ্যা ও সুন্দর?
ছেঁড়া অন্নদামঙ্গল হাতে দাঁড়িয়ে আছে রায়গুণাকর!

Categories
কবিতা

সুবীর সরকার

বাজনা

তুমি বাজনা বাজাবে বলে খুলে এনেছি মৃতের
                                                হাড়
ঘোড়া আছে, অশ্বমেধ নেই।
ঘুঘুর ডানায় যখন রোদ
আমরা তখন কোনো না কোনো কর্মসূচি বেছে
                                                নিই
বিশ্রাম সেরে একটা ঘরে ফিরবার দুপুর
ঘামে ভেজা গামছা।
ধানখেতে জল জমলে উপচে ওঠে
                                                অভিমান
ডুব সাঁতারে আছি।
অবসর ভেঙে অবসাদ।

পুতুল

মনকেমনের দু-পাশে দোনলা বন্দুক।
পালকিতে যাত্রী নেই।
শোকেসে দুপুরের আলো
পুরোনো নদীবন্দরের গায়ে হেলান দেয়
                                                পুতুল

গ্রামার

গ্রাম ও গ্রামার ঘেরা নদী।
ভূগোলের ভেতর ইতিহাস হয়ে ঘুমিয়ে থাকে
                                                জঙ্গল আর জনপদ
আমাদের জেগে থাকতে হয়
অদ্ভুত এক কাচের পৃথিবীতে

লালশাক

উনুনে কাঠ গুঁজে দিচ্ছ।
এদিকে লালশাকের বাগানে সন্ধে নামে
হিম থেকে আমরা হেমন্তে সরে যাই
পেতে রাখা রাস্তা।
অন্ধকারে বিছিয়ে দেওয়া শোক।
বিকেলে হাডুডু খেলি
খুব চেনা মনে হয় সার্কাসের
                                                তাঁবু

হাসপাতাল

ব্যক্তিগত দোলনার পাশে ঘোড়াটি দাঁড়িয়ে
                                                থাকে
মৃতরা উঠে আসে শহরের রাস্তায়।
হাসপাতাল আর বাণিজ্যকেন্দ্র ঘিরে তারা শিস
                                                দেয়
এতসব ঘটে,ঘটেই চলে।
আমি লিখি, ভাঙা ডানার ইতিহাস।

Categories
কবিতা

শুভদীপ দত্ত প্রামাণিক

নেলপলিশ

ঘাড়ের ওপর ভাড়াবাড়ির রান্নাঘর।
অমিয়দা ফেরিঅলার গলাতে রেখে দিল চোরাই মৃতদেহ!
নিখুঁত খুনি কোথায় কিনতে পাওয়া যায়?
ডাকাত কাউন্টারে শিলিগুড়ি যাওয়ার বাস টিকিট,
             টিকিটে দূরত্বের জায়গায় পুরুষাঙ্গ।

নাভির ওপর টায়ার পার্ক।
গাড়ি দাঁড়াবে হাঁস-মুরগির ঘরে।
কালো মাছ পুড়িয়ে খেল অবিবাহিত নেলপলিশ।

আতপচালের উপর খড়ম পড়ে হাঁটে শ্যামবর্ণ বিছে।

ব্যাকটেরিয়া

হাতের খেঁজুর পাতার ছায়া।
কীভাবে দেব মৃত্যুর আনন্দসংবাদ,
                        মারা গিয়েছে নৌকা দেবীর কনিষ্ঠ কন্যা!

এখন সে মর্ত্যে— মানুষের মতো গায়ের রং,
                             নরম হাড়ে ব্যাকটেরিয়া জন্মাচ্ছে!

ধানের গোলা,
ঘামে ভেজা ফ্রক থেকে ঝরে পড়ছে
                             গোরুর দুধের গন্ধ।

খাদ্যনালী

ব্যাঙাচির ছায়া নারী কল্যাণ সমিতির অফিসে।
সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোড়া জানিয়েছে:
সে ভাতের ছায়া খাবে।
খাদ্যনালী দিয়ে দ্বীপ পৌঁছাল কাঙালের হাঁটুতে,
                             হাঁটুতেই রেশন ডিলারের বাড়ি।

আদি সূত্র ডাকছে।
আদি হোঁচট ডাকছে চোয়ালকে।
রেললাইনের পাথরে ছেঁড়া হারমোনিয়াম!

মকরক্রান্তিরেখায় প্রথম সভা করল পোড়া জ্ঞান।

জরুরি বৈঠক

টোটোভরতি ক্লাসমেট খাতা।
খাতার শেষ পাতায় বালিগঞ্জ প্লেস,
বালিগঞ্জ প্লেসে হিড়িম্বা তুলি সাক্ষাৎকার নিচ্ছে ফ্যানের।
শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে কামবীজকে!
ডিম্বাশয় থেকে দেখা যাচ্ছে বস্তি-চটকল।
চটকল এখন শুধু রবিবার বন্ধ।

বৃদ্ধ বেশ্যাদের জরুরি বৈঠক শেষ হয়নি,
                             সিদ্ধ ডিম নিম্ন আদালতের ক্লার্ক।

জজ আপনি বলুন: কে আমার মা?
কুন্তীর ঠোঁটে অন্ধকার!

আয়ু মন্দির

মেঘ জমেছে সান্তাক্লজের এ্যাপেন্ডিক্সে!
ভৌতিক ইঁদুরের গর্তে আয়ু মন্দির।
                      চাতকের নিঃশ্বাসে কেয়া ফুলের ছায়া।
সাপ দুধ খাই গাভীর স্তনে।
সাপের বিষ অসুরগণের মধু,
অর্ধেক ইউরেনাস গোলাপে কোজাগরী।

পুকুরের পাড়ে টিকটিকির কাটা লেজ!
পেয়ারা গাছের আর্থিক অবস্থা পাথর।
নক্ষত্রের অন্তর্বাস বেনেবউটির চোখের মতো উজ্জ্বল।

গাঙচিল স্বেচ্ছাবসর নিয়ে পাতাললোকে কবিতা লিখবে,
কুমিরের পিঠে রাধাকুণ্ড।

 

 

Categories
কবিতা

সুমন জানা

বন্দর

নদীর গভীর থেকে দীর্ঘতম ক্রন্দনের মতো
উঠে আসে আজানের ধ্বনি,
বিষণ্ণ বন্দর জুড়ে সন্নাটা ছড়ায়—
মোহনায় চওড়া হতে থাকা স্যান্ড-হেড
মালবাহী জাহাজের পথে যত প্রাচীর তুলেছে
ততই বন্দর ক্রমে ফাঁকা হয়ে গেছে—

কাজ-হারা শ্রমিকেরা তবুও কাজের খোঁজে আজও
ইউনিয়ানের সঙ্গে ঘোরে, চা খায়, পতাকা ধরে থাকে
দলীয় শ্লোগান মেরে অশ্লীল ভঙ্গিতে হেসে ওঠে।
নেতাদের প্রতিশ্রুতি পরিত্যক্ত কারখানার ঝোপে
শৃগালের মতো দ্রুত গা ঢাকা দিয়েছে—

বন্দরের কয়লা ও লোহা
বাতাসে মিশিয়ে দেয় নিজেদের প্রবণতাগুলি,
ভবিষ্যতে কোনো দিন স্ফুলিঙ্গ ছড়াবে!

কয়লার তপ্ত আঁচে গলে যাওয়া লোহার দৃঢ়তা
মানুষের সভ্যতা নির্মাণ করে দিয়ে আপাতত
ব্যবহারহীন হতে হতে মরচে ধরে খসে পড়ে গেছে

আমার অভ্যাসগুলি

আমার অভ্যাসগুলি খাপছাড়া, স্বভাব-জটিল।
তার সঙ্গে যদি কোনও নদীর তুলনা করি, তবে
সেই নদী সারাক্ষণ ভরা নদী ক্ষুরধারা নয়,
হতে পারে মজা নদীও তা,
বুকে যার পলিজমা উর্বরতা, ফসলের খেত।
চটে ঘেরা শৌচাগার, সবজির বাগান, কুঁড়ে ঘর। পলাতকা
নদীর স্মারক হয়ে থেকে যাওয়া অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদে
যে-কয়েকটি জেলে ডিঙি আজও টিকে আছে,
আমার অভ্যাসগুলি তাদের স্খলিত পাটাতন
কাপড় কাচার জন্য জেলে বউ যেগুলিকে ঘাটে পেতে রাখে।

গেঁড়ি ও গুগলির খোঁজে সারাদিন জলে পড়ে থাকা
আমার কর্তব্যগুলি তাতে বসে দু-দণ্ড জিরোক!

প্রাকৃত

বৈষ্ণব কাব্যের মত্ত দাদুরী পুকুর পাড়ে ডাকে।
অসংস্কৃত জল, তাতে প্রাকৃত পৈঙ্গল ছন্দে বাড়া
কচুরিপানার দামে কোথাও গোপনে
ডাহুকীর সদ্যফোটা বাচ্চা রাখা আছে,
মেঘ দেখে তাই তার এত চঞ্চলতা—
মেঘ দেখে আরও যার বুক কাঁপে,
গোবিন্দ দাসের মেয়ে, তারও নাম রাধা।
এরকম কোনো এক শ্রাবণেই যাকে পাড়ার ছেলেরা
একরাত কৃষ্ণ-সহ ক্লাবঘরে আটকে রেখেছিল,
সেখানেই ফুলশয্যা, সেখানে বাসর। পরদিনই
কৃষ্ণ তো স্বভাবমতো বৃন্দাবন ছেড়ে
রাধিকা-বিহীন কোনও মথুরায় গেছে,
এখানে রাধিকা একা বাচ্চা নিয়ে
বাড়ি বাড়ি ঠিকা কাজ করে, আর ভাবে
বড়ো হলে ছেলেও কি একদিন বাপের মতোই
অন্য কোনো রাধিকার হৃদয় পোড়াবে?

রাস্তা

যে-রাস্তার সড়কের সঙ্গে যোগ নেই
সে-সব রাস্তার কথা ধীরে ধীরে লোকে ভুলে যায়—
শুধু সড়কের সঙ্গে যোগ আছে, এই যোগ্যতায়
বাড়ির কানাচ দিয়ে যাওয়া সব গলিঘুঁজি রাস্তাও যখন
কংক্রিট বাঁধানো হয়ে গর্বে ফুলে ওঠে,
সড়কের যোগহীন রাস্তাটির যত প্রশস্ততা
বুনো আগাছার ফাঁকে সম্ভ্রম হারায়

গলিতে তুফান তুলে যখন সদম্ভে ছোটে বাইক
সাইকেল উড়িয়ে নিয়ে বালকেরা যায়,
সড়কের যোগহীন রাস্তাটিতে তখন মন্থর এক বুড়ো চাষি
অকাল বর্ষণে ভেজা পাকা ফসলের আঁটি রোদে মেলে দেয়

লোক চলাচল নেই বলে এসব রাস্তায়
মেঠো ইঁদুরেরা তার গর্ত থেকে নির্ভয়ে বেরোয়,
বাবলার হলুদ ফুলের পাশে নীলকণ্ঠ পাখি বসে থাকে,
রোদের আশকারা পেয়ে তার কাছে ঘেঁষে আসে ছায়া,
হাওয়ার চঞ্চল হাত গাছেদের বেণি খুলে দেয়।

যে-রাস্তার সড়কের সঙ্গে যোগ নেই,
সে-রাস্তা দিয়েই রোজ দুপুরের রোদ একাকী সন্ধ্যার দিকে যায়…

শিখর

যে যার পাহাড় নিয়ে বসে থাকি, অটল শিখর,
বুক ফেটে কত শত শতদ্রু বিপাশা ঝরে যায়…
কত বর্ষা চলে যায়, ধস নামে, খসে পড়ে শিলা,
বুকে যে-পাষাণভার জমা থাকে, কখনো নামে না—
মুখোমুখি বসে থাকা, তবু দুই মুখে দু-রকম মেঘ,
একের মুখের মেঘ অন্যের আজও নয় চেনা।

মেঘের রাজ্যেই বাস, মেঘ ফুঁড়ে ওঠা দুই চূড়া,
এ-চূড়া আগ্নেয় গিরি, ও-চূড়াতে গলেনি বরফ…

মিথ

সিমেন্টের সঙ্গে আরও এক ভাগ বেশি বালি গোপনে মিশিয়ে
জোগাড়িয়া হারাধন গ্রীষ্মকালে খড়ের চালে আরামের গল্প ফাঁদে

খড়ের চালে বাসা বাঁধা চড়ুই পাখির ঝাঁক বিস্মৃতির ওপার থেকে উড়ে এসে
রাজ মিস্ত্রি হারাধনের বাটি থেকে নির্ভয়ে মুড়ি খেয়ে যায়

প্রমোটার হারাধন স্বপ্ন দেখে খোলা এক আকাশের—
সে-আকাশে উঁকি মারা সারি সারি তালগাছের পাতার শীর্ষ থেকে
বাবুই পাখির বাসা ঝোলে, তাদের ধরে আনা জোনাকিতে
সেইসব বাসার খোপে খোপে সন্ধে হলে আলো জ্বলে ওঠে।

জোগাড়িয়া থেকে রাজমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি থেকে প্রমোটার, হারাধনের বিবর্তনের ইতিহাসে
বাবুই পাখির বাসা আর খড়ের ঘরে আরামের গল্প
মিথ হয়ে বার বার ফিরে ফিরে আসে…

রাগের সন্তান

গেঁড়ি গুগলি খুঁজে ফেরা হাঁসের পালের পাশাপাশি
আমাদের এ-পাড়ার মেয়ে বউগুলি রোজ দুপুরের রোদে
ঝাঁক বেঁধে নেমে পড়ে নয়ানজুলিতে,
এক বেলা নিরামিষ কাটাবার মহাআয়োজনে
ছাকনি জালে উঠে আসে চুনোপুঁটি মাছ।
বাড়তি কিছু মিলে গেলে কাছাকাছি বাস স্টপ আছে,
নিমেষেই সব কিছু ফাঁকা হয়ে যাবে…

তাদের চোখের প্রান্তে ঝলসে ওঠে বাজারের আলো,
নখের দুরূহ কোণে নেল পালিশের মতো কাদা,
মরদ দেয় না কিছু, এইসব চোরা রূপটান
মেয়েদের নিজেদের উপার্জন, মরদ জানে না।
মরদেরা সারাদিন ঠা ঠা রোদে জগতের হাতে
পর্যুদস্ত হতে হতে সঞ্চয় করেছে শুধু রাগ,
সব রাগ ঢেলে দেবে অন্ধকারে রাতের শরীরে…

তাদের সন্তানগুলি, আমাদের এ-পাড়ার ছেলেপুলেগুলি
সেইসব মরদের ক্রোধজাত, জন্ম থেকে রাগের সন্তান…

বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ

মেঘেরা এখন খুব স্বাস্থ্য-সচেতন।
বিবাহিতা মেঘেরাও অষ্টাদশীটির মতো স্লিম হতে চায়,
সকাল হওয়ার আগে প্যারেডে বেরোয়,
তারপরে রোদ উঠে গেলে
ত্বকের ক্ষতির ভয়ে আর তারা বাইরে আসে না,
নেহাত বেরোতে হলে ফুলন দেবীর মতো
ওড়নায় ঢেকে রাখে মুখ।

আমাদের মতো যারা মেঘেদের বন্ধু ও স্বজন,
শনির মানত রাখি, মেঘেদের ঘরে যত কার্তিক বসাই,
কোনো কিছুতেই আর বৃষ্টি আসে না।

মনে হয়, আজকাল মেঘেরাও কন্ডোমের ব্যবহার শিখে গেছে!

শ্রীযুক্ত বদন দাস

তাঁতঘর অন্ধকার।
বদন দাসের তাঁতকলে ধুলোর চাদর বোনে নীরবতা,
মাকুর বদলে। অথচ বদন আজও হাটে যায়,
রাধামনি হাট থেকে কিনে আনা মিলের গামছা বড়ো যত্ন করে বেচে—
কেবল যে-সব দিনে হাট নেই, জাল হাতে চষে ফেলে বাড়ির পুকুর,
সন্ধ্যাবেলা এক গাছ থেকে অন্য গাছে বাদুড় ধরার জাল পাতে।
লবাদের বাঁশবনে শিরিষের ডালে ঝোলা যে-সব বাদুড়
সন্ধ্যাবেলা পর্যটনে যায়, সকাল হওয়ার আগে
তাদের দু-একটি যদি কখনও না ফেরে,
বদন দাসের ঘরে উৎসবের আয়োজন লাগে।

তাঁতঘর অন্ধকার। উৎসবের শেষে
শ্রীযুক্ত বদন দাস স্তব্ধ মাকুটির মতো বসে থাকে…

বিড়ির জন্য সনেট

বিড়ির ধোঁয়ায় আছে পাঠের বিরতি,
কৈশোরের মুক্তিস্বপ্ন, চোরা সুখ, ভয়।
ধোঁয়ার বিষম দিকে চরিত্রের গতি,
‘উন্মার্গগামিতা!’— ক’ন গুরু মহাশয়

কটুগন্ধ, তেতো স্বাদ, প্রতি টানে কাশি
প্রিয় নারীটির মুখ সহসা বিকৃত
ফারাক থাকে না কিছু, আঠারো কি আশি
যুবাকে প্রবীণ লাগে, জীবিতকে মৃত!

তথাপি বিড়ির তুল্য বন্ধু নাই আর
এক ফুঁকে দূরে যায় যত ভূত প্রেত
দেহ সূক্ষ্ম হলে বাড়ে মগজের ধার
বিড়ি অর্থে শ্রমজীবী, প্রোলিতারিয়েত,

যতই নেভাতে চাক সাহেবের বুট
আগুন লুকিয়ে রাখে পাতার চুরুট।

 

 

Categories
কবিতা

নীলম সামন্ত

বারান্দা


যৌথের বারান্দায় বিচ্ছিন্ন শব্দবোধ—
পুরোনো মাটি।
দু-হাতে ভিক্ষাপাত্র;
ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে স্বস্তিক৷
কেউ কি দেখেছে?
দেওয়ালে লেগে নেই শাবকের তিল।
পুজোহীন ষষ্ঠী—
অথচ বার বার বলেছি বারান্দাই উৎসব।


বেনামি পাখি, ছড়ানো ভাত—
বারান্দা ঢুকে পড়ে বুকের ডান দিকে।
দু-একটা ব্লকেজ।
যতদূর চোখ যায় ধু-ধু মাঠ,
ভাঙা ইলেক্ট্রিক পোস্ট।
ডান দিকে আর একটু সরে গেলে স্পষ্ট হয়—
আধপাকা খেজুর আর গম রঙের তফাত
ঠিক ততটা যতটা
জানালা আর বারান্দার৷


রাস্তার ওপর মুখ বার করে ঝুলে থাকা বারান্দা
ঘন সবুজ
বড়ো বড়ো থাম
কাচের বাটিতে শুকনো চন্দন—
চোখ বন্ধ করলেই
অবুঝ সুবর্ণলতা।
যার দুপুর-বিকেল—
একফালি রবীন্দ্রনাথ
হিসেবের ভগ্নাংশে কোকিলের সুর
বাঁশিওয়ালার চোখ
সারারাত অন্ধকারে আঙুলে ফুল ফোটায় চৌরাশিয়া।


জীবনে সে আসার পর প্রতিটা আঙুলে
বারান্দা এঁকে বলেছিল
“তোমার একটু দখিনা বাতাস প্রয়োজন”।
এক পেয়ালা ব্ল্যাক কফি
আর একটা কাপ সহ আংটিতে
লিখে রাখছি
একাকিত্ব—
কোটেশনে ভালবাসার রেস্তোরাঁ ও রংরুট।


আঘাত আর বারান্দা পরিপূরক ধরে নিলে
নিজেকে কবর থেকে তুলে
পুড়িয়ে ফেলি
বছরের পর বছর
যা কিছু প্রস্তর
যা কিছু ভঙ্গুর
সাকুল্যান্ট সাজানো টেরিরিয়াম
দু-একটা পাহাড় হেঁটে যাবার পর
প্রচার করি
আঘাত কিংবা বারান্দা
ওক কাঠের ফায়ারপ্লেসে নিজেদের সাজিয়ে তুলছে
পরিত্যক্ত রেড ওয়াইনে।

Categories
কবিতা

রাজীব মৌলিক

খচ্চর

পায়ের তলাতে রাখা আমাদের দুঃখ
তবু কেন ঘাসফুল হয়ে ফুটল না
নদী হয়ে ছুটল না—

গড়িয়ে পড়ছে দিন; দেহ থেকে হাত
তারা কেন আদালতে গিয়ে বলল না
পড়াশোনা করে চুষে দিতে পারব না কালো দাগ।

মা-কে নিয়ে কথা হয় রোজ
ভাগাভাগি করি হাতাহাতি করি খিস্তি দিয়ে বলি
জন্ম না দিলেই বাঁড়া দেখতে হত না
খচ্চরের মুখে ঝামা ঘষে দিলে কেউ ফাঁসি হয়ে ফুটত না!

দেশকে আমার মনে হয় কেন ভিখিরির কোল
গভীর ঘুমেও ভেঙে যায় ঘুম থেকে
ডেকে ওঠে ককিয়ে যে পাড়া
বেশ্যার ভাতের ফ্যানে আমার আইন দেয় টোল।

মাজন

আমার এখন মানুষকে দেখলে ভয় হয় না
কাউকে আর অনুরোধ করে কিছু বলতে হয় না
কোনো অবিশ্বাস করার কিছু নেই

এখন আমি সরকার পক্ষের
সরকার আমাকে যা বলে আমি তাই করি
আমার নিজস্ব কোনো চোখ কান নেই
বন্ধুরাও আমার দলে যোগ দিয়েছে
আশাবাদী গোটা পৃথিবীটাই আমার সঙ্গে

যদিও আমার বাবা মা বিরোধিতা করেছে
এবং তারা সরকারের সমস্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে
আমি সুবিধাবাদী পন্থায় বিশ্বাসী

নিজের সুখের জন্য সরকারের পতন চাইতেও পারি।

আমার কবিতা

আমার কবিতা ঘুমিয়ে পড়েছিল
খিদেয়, তৃষ্ণায়, পাঠকের অবহেলায়
সক্রিয় আগ্নেয়গিরির মতো আবার জেগে উঠেছে

এখন আমার কবিতা খেতে জানে
ঘুমোতে জানে
লোকমুখে উলঙ্গ হতে জানে
কুকুরের মতো পা চাটতে জানে

আমি আশ্চর্য হই তার জাদুকরী শক্তি দেখে
আমার কবিতা কখন কুকুর হয়ে গেছে
কখন ঘেউঘেউ করা শিখল—

দেশটা কি সত্যি সত্যি কুকুরে ভরে গেল!

খেউড়

বাবাকে গালি দেওয়ার মতো শব্দ বাংলা অভিধানে নেই
তাই সরকারের মতো তার কাজকর্ম বলে গালি দিই

সে এতে মনে কিছু করে না
ভাবে ছেলে সোনার টুকরো
গালি দিলেও গায়ে লাগে না

অথচ আমি মন থেকে বাবাকে গালি দিই
আর মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি

কাউকে যেন এমন হাত না দিয়ে পাঠান
যে-হাতে শুধু ইট পাথরের শব্দ লেগে থাকে

সঙ্গে একটা কালো টিপসই…

হাটবার

পশুদের হাট বসেছে আজ
সমস্ত হিংস্র পশুরা বুথে বুথে দামি গাড়ি নিয়ে ঘুরছে
আর দেখছে ছোটো ছোটো হরিণ শাবকের দল
লাইন দিয়ে বলী হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে

ব্যানারে ফেস্টুনে খোদাই করা তাদের নাম
কেউ-বা মাইকে ছড়িয়ে দিচ্ছে হুমকি
বলি হওয়ার বিভিন্ন পন্থা

আমার বাবার শরীর ভালো না
তবু সে হাটে যাবে

হাটে না গেলে গোয়ালে বলী হওয়ার মতো পশু নাই

উপত্যকা

গুষ্টিশুদ্ধ বোকাচোদা একজায়গায় জড়ো হয়েছে
এবার বাজেট তৈরি হবে—
কে কার পেটে লাথি মারবে তার প্ল্যান লিখে রাখা হবে
ভিখারির দল এ শুনে রাস্তা অবরোধ, ট্রেনে আগুন জ্বালাবে
ওদের কাজই দেশে আগুন লাগানো

এত বেশি আগুন যদি পোঁদে থাকে
তাহলে সাহস করে যা না মেরে আয়
প্ল্যানিং কমিটির পোঁদে

মরলেও লোকে বলবে
শিশুকালে বাঘিনী মায়ের দুধ পান করেছিল

বালটা আসলেই একটা মাল ছিলো…!

ডাঁসা

ডাঁসা পেয়ারার মতো তোমার ভবিষ্যৎ
অন্ধকারে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে—

তুমি জ্বলে উঠছ
গাঁজাখোরের মতো

উজ্জ্বল হয়ে উঠে আবার কেলিয়ে যাচ্ছে তোমার ভবিষ্যৎ
আর তাতেই বাঁড়া তুমি রেগে লবডঙ্কা
সামান্য দেশলাইয়ে বারুদ কম থাকায়
হাত উঠালে দোকানদারের উপর
হাত উঠালে মা বোনের উপর

অথচ তোমার প্রতিটি রাতজাগা জুড়ে আলো ফেলছিল
থিওরি, থিসিস, লিটেরাচার, সায়েন্স।

ভিত্তিহীন

একুশতম গোল মিটিঙেও দেশের উন্নয়নের কথা বলা হল না
আর রাজ্যটা তো বোকাচোদায় পেয়েছে
যে-ই ক্ষমতায় আসে সেই গাঁড় মারে

এবার দুর্গাপূজায় মা-কে পুরোনো শাড়িতে দেখতে হবে
অথচ উদগাণ্ডুগুলো নশ্বর দেহে কেজি কেজি সোনা পরিয়ে
পালন করবে ডি জে উৎসব।

ভাড়াটে মাগিদের নাভি দেখে নৃত্য ভুলে যাবে
কিশোরী মেয়েটি।

তবু বিদ্রোহ করবে না। রাস্তায় নামবে না একজোট হয়ে
পার্টি পার্টি করে নিজের রক্ত চুষতে দেবে—

অথচ যে-কোনো মুহূর্তে দেশটা বলদে যেতে পারত
শুধু একটা বিদ্রোহ দরকার
সমস্ত রং ভুলে একবার মাঠে নামলেই নৃপতিরা পালটে যেত।

শোঁ-শোঁ

শোঁ-শোঁ আওয়াজ করে গিলে খাচ্ছে তোমাকে আমাকে
স্বপ্নের ভেতরেরও ঢুকে পড়ছে হেলিকপ্টার
আমাদের প্রিয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী

তার শরীরে কোথাও স্বপ্ন নাই
তার মনে কোথাও পাপ নাই

সে নরক থেকে পালিয়ে এসেছে
লুসিফার তল্লাশি করেও ব্যর্থ হয়েছে

এবার আমরাও ব্যর্থ হয়েছি চিনতে
তবু সোচ্চার হচ্ছি না

আমাদের কলিজা সে কিনে ফেলেছে
জোম্বি হয়ে গেছি আমরা

নিজেদের রক্তকে ভাবছি বিরোধী মুখ।

Categories
কবিতা

দেবাশিস বিশ্বাস

নামহীন


সন্ধেই কিচিরমিচির করে যখন তার পাখি থাকে না। উঠতি চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বয়স। এই বয়স নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিল ভৈরব। তার দেখা ভয়ংকরতম উদাহরণ হল সে। যেমন লেকচারে জীবন পোড়ে৷ এক পোড়া ঘরে বেলুন ফাটাচ্ছে শিশুটির৷ কি না করেছে সে। বাপের সম্পত্তি হল কচ্ছপের পিঠ— তাকে ধরার বারুদে নত হয়ে গেছে। কৃত্রিম বয়স ওড়ানোর তালিম নিচ্ছে হাওয়ায়।

ভৈরব ঐ কিচিরমিচিরে দৃশ্যহীন।
মাথায় পাগড়ী থাকলেই কি হয়? কখন যে পাইথন পেঁচিয়েছে মাথায়… তার ঘণ্টা ভেঙেছে
শব্দ হয়েছে পৃথিবীর বুকে

এটা তুমি ঈগলের চিৎকার বলছ?


মাথা ঝোঁকার জন্য হলে মরে যেতাম

হাসির ভিতর আঁকা থাকত দাঁত।
এমন করেছো তুমি—
ঘরের ভিতরের হাসি ঘর থেকে বার করতে?

পুরোটা সকাল আলো পোড়াতে গিয়ে হাত পোড়ে
নক্ষত্রের পিণ্ডি মুছে হাসির ভিতরে আঁকো—
— নাহ্! জটিল হচ্ছে চিৎকার!
আমরা কেন কিড়িমিড় শব্দ করে ভয় দেখাচ্ছি তাকে!

তার হাসপাতালে ঘুরতে যেও
জটিল রোগগুলো মরে যাবে সে জানে—


কবিতা লিখলেই
মানুষের কানে চোখ বাড়ে… রোম খাঁড়া হয় প্রগাঢ় দুপুরে
ভেণ্ডি বাগানে এত সবুজ ধুয়ে গ্যাছে কেন?
কবিতা লিখলেই, প্রশ্ন আসে
উত্তর সাপের হেঁটে আসা নকল করে।
ঝুম করে কারোর হাসি পারতে বল্লেই—
তোমার হাত এত লম্বা হয় যেন মহাকাশ চুরি করে পকেটে পুরছ।

কবিতা লিখলেই,
হাসিকে থেঁতলে দিও
মানুষের কানে চোখ বাড়ে
ভেণ্ডি বাগানে


উৎসব শুরু হয়
অন্ধ তাঁবুর নির্জনে, ব্যাঙ এসে লাফ দ্যায় ঘাড়ে
তার ইউরিক চর্চা যখন ছিল না তখন অতিবর্ষায় পায়ে পাপড়ি হয়ে ফাটে…
পায়ের দোষকে মাথায় তুলো না।
পায়ের জন্যই এই হাঁটা পথ মাথাকে ন্যুব্জ করে।
তারপর ঘর আসে,

ঘরের ভিতরের হাসি ঘরেই থাকছে কেন—
ব’লে রু রু দুপুর কাঁতরাচ্ছে ভীষণ!

জবলেস

চাষের উর্বরতার জন্য কেঁচোকে নিয়ে এক নম্বরের প্রশ্ন
উত্তর দিলে সেন্ট্রাল আমায় গ্রুপডি-তে নিয়োগ করবে
আমি আমেরিকার পতাকায় ক-টি তারা মুখস্থ করেছিলাম
যাতে আন্তর্জাতিক উত্তরের জন্য দু-নম্বর বেশি পাওয়া যায়
এরকম অবস্থায় যারা পারে না
তারা সকাল থেকে সন্ধে কোনো নক্ষত্র দেখে না
ইমাজিন করুন, ওই মুহূর্তটুকু সে কেঁচোর প্রয়োজনীয়তা অথবা আমেরিকার তারা সম্পর্কে কতটা ব্যতিব্যস্ত

হাত ফাঁক করলে কল্পনা ঝরে
যুবতীরা কল্পনা খায়

এপিটাফ

বনভূমি ডেবে রাখে
হাতগাড়ি
তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া কি মুশকিল, বলো!

যদি আগুন ধরিয়ে দিই
যদি ক্রুড অয়েলের লোভে প্রিয়তম হাড়-ম্যান
নিজের অক্ষিকোটরে বিশুদ্ধ বারুদ লুকিয়ে রাখে

নিশ্চয়। ঘরের কোনাটায়
যদি আগুন ধরিয়ে দি
বনভূমি ডেবে রাখে হাতগাড়ি ও কিছু সস্তার অ্যালকোহল!

আপাতত আকাশ কাঁপিয়ে
পাখিগুলির তন্তু আঁশ পায়ুনালী
ওড়াতে ওড়াতে, আমি এক ধোঁয়াপ্রবণ শিলায় খোদাই করে রাখছি এসব—

শেষে পৃথিবীর ভাগাভাগি তেমন জটিল নয়

নিরক্ষরেখা, অক্ষাংশের হ্যালুসিনেসন ছাড়া!

অস্বস্তি

কবিতা লেখার দায়ে বানানো হয়েছে—
এরকম ভাবলে মন শ্রান্ত হয় বলছ?
যেদিন গুচ্ছ গুচ্ছ গুহ্যদ্বার থেকে কাগজ বার করে আনছি আমার এক কবি বন্ধু ইংরাজি কবিতা পড়ছেন ওয়াইনকে সাক্ষী রেখে। মহিষের তেল মেখে নেচে উঠছে দাঁড়ি। এই এক বিকাল।
একটা
হেবি ওয়েট পাথরকে মদ্য চোখে মেয়ে বানিয়ে দিচ্ছে
আর তাকে
খাওয়ার চেষ্টায়
পাহাড় কাঁপাচ্ছে, নিম্নে তার পদ্যলেখা
অস্বস্তি
পাখি বাবলা গাছে বসে হাগছে
সে হাগায় ঝগড়া হচ্ছে পশ্চিম পাড়ায়—
তাতে বীজ থাকে
ছিঁবড়া ছিঁবড়া সূর্যাস্তের খুন
দৃশ্যেরও গলার অন্দরে পাখিকঙ্কাল
মরা শালবনে
মুতে
চলে গ্যাছে বাবুল সর্দার—
দাঁতে তার শামুকের মাজন।

পাখিকে যে-কোনো গাছে হাগতে বল্লে
সে কেবল ঘুরেফিরে
এখানেই
চকচকে বিপ্লবের উপর হেগে দ্যায়
যা দিয়ে
পাখির গুহ্য চিরে
মানুষ হয়েছে
তুখোড়
গায়ক।
এখানে
কেন্দ্র ছিল বলে চিৎকার দেখাচ্ছে দূরে/প্রান্তে
ফাটা

আউট অব কভারেজ
এখন
ঝিরি ঝিরি প্রচারবিমুখ শাকাহারী কুনোব্যাং ডুব দিচ্ছে
প্রকৃতির মায়াময়
আলুথালু
উচ্চিংড়ের পাতায়
প্রশ্ন করছো এ্যাত?
চাঁদ ফেটে মহাকাশ
মহাকাশ ফেটে
ঘিলুর তেল— মহাকাল পোলতে জ্বালিয়ে ধ্যানে বসেছেন
‘হরাস’ যার ডান চোখ রোদের নক্ষত্র
কোথাও