Categories
2021-Utsob-Poem

পার্থজিৎ চন্দ

রক্তমাখা, চোদ্দো লাইন-৪

শুয়ে আছে পিণ্ডবৎ, তাকে তুমি গর্ভ বলে মানো
ভাবো, এটুকু অর্জন নিয়তির কোটি সম্ভাবনা
ঘুরে ঘুরে ধাত্রে আসে, তারপর ধারকের রীতি
তাকে শস্য-স্পর্শ দেওয়া। অভ্রান্ত রাস্তার শেষে বাড়ি
দাঁড়িয়ে রয়েছে একা, ভাঙা সাইকেল টব ছুরি
নিপুণ সাজানো। তাকে রাখা আপেলের টুকরো;
যেহেতু সে-গর্ভ থেকে খিদে নিয়ে জন্মেছে সকালে
তার ক্ষুধিত লালার সামনে অসহায় খাদ্যরথ
দ্বিবিধ প্রকাশে ফোটে। মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না
এবং সে গর্ভে ঢালে অনিবার্য টন টন খিদে
ফলত এ-গর্ভাশয় অযৌন জননের চিৎকার
বুকে নিয়ে বার বার অশ্রু ফেলবে, শিহরিত হবে
শুয়ে থাকবে পুত্ররূপে কন্যারূপে শূন্যতার হিম

প্রসববেদনা শেষে হাতে ধরো দ্বিগুণ অসীম

রক্তমাখা, চোদ্দো লাইন- ৫

আগে দাও পরিখার নির্ভরতা, মদ। তারপর রাত-পথিকের
মাথার ভেতর অচিরাৎ ঢুকে যাবে সেই সব মায়াবাদ্য, ট্রাম্পেট
এই যে স্লটার-হাউস মাৎসন্যায়ের, আরব্যরজনী ফুঁড়ে গল্প
ক্ষুধাতুর কামকলা অলীক কথন, সাজানো উপসংহার প্রায়।
ক্যাসেলে ঝিলিক দিয়ে ওঠা অস্ত্রশস্ত্র, আর গোপনীয় নয় রাত
বরং ভেলভেট কর্সেট প্রকাণ্ড হুক নিজে হাতে খুলে মাংস ধরবে
ক্রমতালিকার মৃত্যুধারা রক্তধারা নিয়ম মেনে সম্পন্ন হবে;
উদ্‌ভ্রান্ত তাতার দস্যুর হাতে জাদুপ্রদীপের অধিকার
আরও বেশি রাত্রের হিংস্র ছায়ামথ, উন্মুক্ত করেছে এতক্ষণে
ক্যাসেলের প্রকৃত দরজা, গুমঘর। দু-হাতে পরানো বাঘনখ
স্বয়ংক্রিয়, ইঙ্গিত একযোগে ফোটে স্থলে জলে অন্তরিক্ষে, দুর্গে
হতভম্ব আপেলের দিকে ছোটে সাপ। লিঙ্গ নিরপেক্ষ নীল ভ্রূণ
একমাত্র হিংসার। তার আশ্বাসে নিশ্চয় এতদূরে আমিও আসিনি

দেখো, তোমার পাঠানো জলৌকার ফেরা, পিঠে বস্তা… রক্তভেজা নুন

রক্তমাখা, চোদ্দো লাইন- ৬

লূতাতন্তু ছড়িয়েছে ব্যবস্থার দূরতম কোণে
প্রতিটি গল্পের শেষে ঢুকে গেছে চিতা খরগোশ
প্রথমে চিতার হাঁ-য়ে মিশে যায় খরগোশের মাথা
অজীর্ণ মাংস-হাড় জন্মান্ধ কথকের আইরিসে
ঢুকে আরেক কাহিনি, প্রতিনায়কের ঘামরক্ত—
মাখা, অস্বীকার করে চিতার ঘাতক দাঁত থাবা
গল্পের সাপেক্ষে গল্প এভাবে স্বাধীন ভূমি পেলে
সার্থকতা পায় চোখ। গল্পের থেকে মাইক্রোস্কোপ
তুলে ফেলে দর্শকের ভূমিকা বদলায় সংগোপনে
তখন সে খুঁজে ফেরে রহস্যজনক দূরবীন
চোখ রেখে দেখে ভ্রম, ইস্কাপন হরতন দেখে
দেখে রাজার ভূমিকা অকস্মাৎ বদলের বিবি
সেখানে মাকড়-রাত প্রশ্নাতুর, অনিবার্য কূট

যা ছিল স্পষ্ট অ্যালবার্ট, দূর থেকে মনরোর ছবি

রক্তমাখা, চোদ্দোলাইন- ৭

ভূর্জপত্র, খাগের কলম… সংঘর্ষ পরিস্থিতি
বলে একে মানা আবশ্যিক। কারণ এ-অবিরাম
ঘর্ষণের ফলে ফুঁসে উঠবে কুণ্ডলীকৃত অজগর
পাক দিয়ে ধরবে কুরুক্ষেত্র প্রতিটি রথের চাকা
রক্তস্রোত তির বৃংহণ, কে কাকে যে বিশ্বরূপ
দর্শন করাবে মৃত্যুতীরে… চাকা বসে যাওয়া রথ
নিকট বর্তমানের থেকে দূর বর্তমানে যায়
তথ্য, সংকেত। দূরগামী আলোর শরীর থেকে
তালা খোলা সে-সব সিন্দুক ঝরে পড়বে আমাদের
সমস্ত প্রলাপ লক্ষ করে। দাঁত-ভাঙা গজানন
তখনও লিখছে প্রতিটি শব্দ গুপ্ত-হত্যা গুপ্ত-প্রেম
সংঘর্ষ বিরতিবিহীন, ফুলকি উঠছে ঊর্ধ্বদিকে
উত্তাপে শিথিল হয়ে আসে মোমের কলম, গলে

আরও কত কুরুক্ষেত্র শ্যামবাষ্প ঢাকা যুদ্ধ অগণন

Categories
2021-Utsob-Poem

নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছায়ামানুষের খেলনাগাড়ি

১৮
ত্যক্ত কারখানার লাশ
পড়ে আছে জলে ও আগুনে

গা বেয়ে গড়িয়ে রক্ত মাটিতে জমাট

জানলা হাট করে খোলা; পাল্লা একদিকে কাত হয়ে
ভিতরে লোহার কান্না, স্প্রিঙের ফিসফিস

পাখি ঢুকে পড়ে রোজ
কেউ কেউ বেরিয়েও আসে

কখনো গভীর রাত্রে বেহেডউন্মাদভবঘুরে
অজ্ঞান মাংসের চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে খোলে

চরাচর ঢেকে যায় মরচেলাগা পালকে পালকে

১৯
ধ্বনিসমূহের মধ্যে কে যেন নীরবে ঢুকে গেছে

পাখির গলায় চোরাবালি

পায়ের তলার জমি ওলটপালট করে
আড় ভাঙছে মাটির ফোয়ারা

জল কেটে বসে যাচ্ছে মর্মরিত আলোর চাবুক

আকাশে বৃংহণ আর রক্তমাখা তুলোর গোঙানি

দৃশ্যের ভিতরপর্দা ছিন্ন করে উঠে আসছে
অদৃষ্টিমোহন সাঁকো—

পবিত্র, পিছল

২০
সকরুণ স্ট্রিটলাইট বুঁদ

তলায় পা ফাঁক করে শুয়ে আছে গলি

ঝাপসা হয়ে আসা নাম অক্ষর পারছে না কিছুতেই

ভিতরে শিসের শব্দ
বিস্মৃতমেরুন পর্দা গাঢ় হতে হতে হদ্দ খাঁ-খাঁ

লোক ঢুকছে, বেরোচ্ছে পালক

বিজন মাংসের ছাঁট মুখে নিয়ে নিবিষ্ট কুকুর

ঠিকানা হারানো শোক আয়নার বাজার পার করে
গলিটার সামনে এসে বাঁশি হয়ে যাচ্ছে একা একা

২১
ক্লান্ত পোড়োবাড়ি ধীরে গাছের মুঠোয় ঢুকে গেছে

কাজ বলতে তার শুধু দিনভর ঝিমোনো

স্বপ্ন বলতে ছায়া চেটে খাওয়া

ভিতরে বাতাস ঘোরে

দক্ষিণের জানলা থেকে ঝাঁপ দেয় যুবতীর হাসি

মেঝেয় লুটানো ম্লান জাফরিকাটা আলোর পাঁজরে
ঝুঁকে আসে পাথরের ফণা

নোনা ঝুলবারান্দা শুধু চুপিসাড়ে মুঠো থেকে খুলে
ভাঙতে ভাঙতে উড়ে যায় ক্যালাইডোস্কোপের ফুটো দিয়ে

২২
দুপুরের রোদে বসে পাথরের ছায়া ভাঙে গান

তালে তালে সোমত্ত হাতুড়ি

ঘাম ঝরে

মুখে মুখে ফিরে আসা কলির শেষপ্রান্ত ধরে
দিন ক্রমে ঢলে পড়ে অনাবিল হাসির পারদে

একটু দূরে ত্রিপলের তাঁবু
হাওয়ার সংসার আগলে নিভু উনোনের পাশে শুয়ে

উঁচুনীচু রাস্তাগুলো খেলাচ্ছলে ডিঙোতে ডিঙোতে
রাতের খোরাকি নিয়ে উঠে আসে আলোর ঝরোকা

২৩
ঘোলাটে আকাশ ভেঙে গাছের গোড়ালি ডুবুডুবু

পাতায় পাতায় মিহি জলপিয়ানো
রিডের প্রলাপ

সামান্য উঁচুতে মাঠ দিগন্তে উপুড়

পিঠভরতি এলোমেলো চাবুকের ক্ষত চুয়ে চুয়ে
নরম মাংসের রেণু গুলে যায় জলে

ডুবে যাওয়া ইঁদুরের গর্ত থেকে উঠে আসে
ভাঙা দাঁত; বালকবেলার

ভেজা কাকতাড়ুয়া শুধু ফাঁকা মাঠে একপায়ে দাঁড়িয়ে
এ-পাশ ও-পাশ দোলে— যেন অনন্তের

পিয়ানোবাদক; যার হাতের আঙুলগুলো কাটা

২৪
ঝুরো পাথরের গান খরজে নেমেছে

আবছা আলো-অন্ধকারে ফণা তুলে দুলছে বুনোঘাস

বেলেপাথরের পিঠ, ছোপ ছোপ লোহার কালসিটে
শরীর বেঁকিয়ে যেন বহুকাল গুঁড়ি মেরে বসে

তলায় অনেক নীচে
দহে হাবুডুবু খাওয়া বাতাসের ছিন্নভিন্ন হাসি

আকাশ এলিয়ে আছে, শশীচুর ঝরে পড়ছে বনে

দস্তার নূপুর খুলে রেখে
বুকে হেঁটে উঠে আসছে কাটা জিভ; সুরসবিতার

Categories
2021-Utsob-Poem

হিন্দোল ভট্টাচার্য

মৃৎফলকে লেখা


বড়ো অন্ধকার, তবু দুঃখ থেকে একদেওয়াল দূরে
সুন্দর যেখানে ম্লান মুখ
নির্জন ঘরের মতো, জানলা খুলে রাখে শীতকালে।
তোমার হাসির শব্দে ভেঙে পড়ে
বরফের নদী।


তোমার শহর থেকে দূরে থাকি,— তোমার ভাষায়
কবেকার মরচে ধরা লোহার পেরেক বিঁধে আছে।

মানুষ দেবতা হলে, দেবতা শয়তান হয়ে যায়
ঘন ঘন রক্তবমি করে;

এত বিষ তুমি কেন ধারণ করেছ মহাদেব?

তাহলে সমুদ্র তোল, ধিকিধিকি প্রতিহিংসা
ভালো কথা নয়।

তোমার শহর থেকে দূরে থাকি,— সুন্দরের গায়ে
কবেকার পোড়া দাগ লেগে আছে জড়ুলের মতো


সেও তো আসলে মূর্তি,— যে কখনো নিজেকে ভাঙে না

খোলা চোখে পলক পড়ে না

তার চেয়ে মূর্তিকর হওয়া ভালো,— বার বার গড়ে
বার বার ভেঙে দেওয়া যায়

ব্যর্থ হলে মানে, তুমি বেঁচে আছ,—
রক্ত চলাচল হয়
দু-চোখে এখনও জল আসে…


ভালো, উদাসীন থাকা। এঁটো বাসনের স্তূপে
যেভাবে আহার লেগে থাকে

ইশকুলবাড়ির গায়ে বিকেলের আলো,—
তোমাকে ঈশ্বর ভাবি।

মাছি ও পিঁপড়ের সারি প্রাণকণা খুঁটে নিতে আসে…

ভালো, উদাসীন থাকা। আকাশ এবং শস্যখেত
মুখোমুখি শোয় যেরকম…

খেলা অসমাপ্ত রেখে পড়ুয়ারা ঘরে ফিরে যায়

পড়ে থাকে মাঠ যার সবুজের ফাঁকে ফাঁকে
জীবনের দুঃখ লেগে আছে


ঝরে যেতে পারি আমি, ঝরে যেতে পারো তো তুমিও
এ-পৃথিবী ঝরে যাচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিরাতে—
আমাদের সকলের আয়ু আর মায়া ঝরে যায়।

যাওয়াটাই বড়ো কথা, থাকা তো কেবল
সমাধির কাজ। তুমি সমাধি হবে কি?
শিলালিপি থেকে তবু শুনেছ কি চোরা আর্তনাদ?

যুবতী যক্ষিনী জানে, তার স্তন বড়ো বেশি মৃত।
কামের আগুন নিভে গেছে তাই তাহাদের দেবী মনে হয়;
কোথাও সংগীত যেন শুধু প্রতিধ্বনি হয়ে আছে।

সংগীত ফুরিয়ে গেলে, তার পর শূন্যতাই জন্ম দেয় সুর…


আমাকে গোপনে রেখে ঈশ্বর বিদেশ চলে যান
হাওয়াবদলের রক্ত বেসামাল করে।
দেখি গুহামানবের চোখ দিয়ে, ভাবি জগন্নাথ
কীভাবে অন্ধের চোখে দেখা দেন এ-ঘন বরফে?
এখন আঁধারশীত। ঘনঘন ছোবল মেরেছে
পিশাচেরা যেরকম পাকে পাকে খায়।
আমি তো গোপনে দেখি ঈশ্বরের ছদ্মবেশে রন্ধ্রপথ দিয়ে
এসেছে কালাচ-বিষ। রয়েছে খোলস।
আমরা দু-জনে বসে আছি কবে ঈশ্বর ফিরবেন—


এই তো এলে, এর মধ্যে যাই যাই ভাব কেন, শোনো ওদিকে
কীর্তনের গান শুরু হল। রাতটা থেকেই যাও। না-হলে শ্বাসকষ্ট হবে,
ফিরে যাওয়ার পথ এত সহজ নয়।

কত চড়াই, ধ্বস, নালা, চোরাবালি, পাথর,— কোথাও কোথাও রাস্তাই নেই।
কোষবদ্ধ কিছু হাত বুনো লতাপাতা জড়িয়ে এ-পথে ধুলোয় মিশে আছে

ফিরে যাওয়ার পথ এত সহজ নয়।


যখন ঈশ্বর নেই, আমি খুব নিরাপদে থাকি!
এলোমেলো করে দেওয়া তার কাজ, আমি তো গুছোই
সে বলে, সঞ্চয়ী মন বড়ো;
বই গোছাই, ভালো করে পরিষ্কার করি ঘর, ফুল তুলে আনি…
মন্ত্রের বদলে কিছু অভিমান পড়ি।
তিনি পাথরের মতো তাকিয়ে থাকেন
ঈশ্বর এলেই শুধু
আচমকা হাওয়ায়, ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় খেত
ঘরের ভিতরে জমে ধুলো, মাটি, জল।
দেখি মৃত গাছের ডালেও
একটি আশ্চর্য সাদা ফুল ফুটে আছে।


কারা যেন আমাদের নিয়ে
অসমাপ্ত উপন্যাস লেখে।

এক-একটি অনুচ্ছেদে
এক-একটি চরিত্রে কথা বলি।

ক্রমশ লিখিত হই
তাঁর ইচ্ছেমতো।

তোমাকে হত্যার কথা ভাবি প্রতিদিন।
তোমাকে লেখার কথা ভাবি।

Categories
2021-Utsob-Poem

পঙ্কজ চক্রবর্তী

ধুলোর সংবাদ

আমি তো ভাবতেই পারি শোক নামমাত্র। চলে যেতে পারি আমোদিত ধুলোর অরণ্যে। তুমি জল দাও বারান্দায় প্রতিটি শিকড়ে। খুব যোগ্য মানুষ আমি নই। অবিবেচক। হলুদ পাতার দু-পাশে রান্নাঘর এঁকে বসে থাকি। ভাবি ভুল মানুষের বুকের আগুনে ফুটবে ডালভাত। দরজার ফাঁকে তদন্ত করবে তোমার পাঠানো লোক। ‘হাত পুড়িয়ে খায়’ এই মর্মে সংবাদ ছড়াবে বাজারে।

তোমার স্তন্যপানে প্রতি রাতে জেগে ওঠে হলুদ পাতার এক বাঁশি। আজ যদি তুমি না বলো, কেমন করে বুঝব মধ্যরাতে প্রতিটি গাছ একাই ঈশ্বর!

আবাসন

সূর্যাস্তের আলো গায়ে মেখে তুমি নেমে আসছ দশতলা বিল্ডিং থেকে। আজ তোমার ছেলের জন্মদিন। সকালে তার মুখ দেখা হয়নি। তবু মেঘের কানে কানে শুভেচ্ছা চেয়েছ এই জীবনের। এত উপর থেকে মনে হয় পিপাসা নিরর্থক। তবু শূন্য বুকে দম্পতি চায় ছোটোবাড়ি। সামান্য কয়েকটি ফুলগাছ। আর তখনই তোমার মনে পড়ে উটের সাম্রাজ্যে পোশাকের মূল্য নেই কোনো। তবু বাড়ি ওঠে মাঠের মাঝখানে। শূন্য হাওয়ায় ভেসে যায় তোমার সর্বস্ব। ঐ তো বাড়ি ফেরার পথ…

ঘরের জ্যামিতিটুকু নিঃসঙ্গ রান্নাঘরে একফালি আলো জ্বেলে রাখে…

গোধূলি

দীর্ঘস্থায়ী বাসনপত্রের ভিতর এখন তোমাকে দেখতে পাই। যেন পলাতক উড়োমেঘ, গাছের সংসার। তুমি দেবদূতহীন বেঁচেছিলে আরও পনেরো বছর। বাবার ফরিদপুরের কাঠের ছোটোবাক্সে জমিয়ে রাখতে দু-জন মানুষের অসংলগ্ন চিঠি। এখন আশ্বিন মাসের দুপুর। নিখিলেশ কাকুর আত্মমগ্ন প্রতারক ছায়া পড়ে আছে দক্ষিণের বারান্দায়। মানুষের রক্তমাংসে উপমার রাগ তেমন দীর্ঘস্থায়ী নয়। তোমাকে ডাকতে ডাকতে সুতো গুটোচ্ছি কেবল

এই তো সেদিন নিমগাছে এসে বসেছে নিজস্ব লাল ঘুড়ি। আমি তার পিছু পিছু অতর্কিতে পিছনের জানলা খুলেছি…

বাজার হাটের কড়চা

এই যে প্রতিদিন বাঁচি সে শুধু বাজার, ম্লান কিছু দোকানপাটের আলো। কয়েক টুকরো কাগজ আর ঘন ঘন প্লাস্টিকের বিবাহবন্ধনী। যদি সে আসে অলৌকিক হবে। মেঠোজল, বৃষ্টির দিন মনে হবে আঁধারের নৌকোবিলাস। নদীর ওপার থেকে এই তো সেদিন এল ঘন দুধ আর সুগন্ধি সাবান। খদ্দের দোকানীর লুকোচুরি খেলা কেমন স্বাস্থ্যবান শুয়ে আছে পথের ওপরে। কয়েকটি কুকুরের ছায়া আগন্তুক ঢুকে পড়ে জীবনীর প্রকাশ্য দরজায়।

আমরা নেই-মানুষের দল আজও দেখি দোকানপাট, রজকিনী ভাঙাচোরা আলো, ঢুকে পড়ছে অস্পষ্ট বুকের ভেতর। দু-একটি ধানখেত, নদী, সমুদ্র, নিকষিত হেম ছাড়াই দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকা গেল।

বাজারসমিতি

বাজারসমিতি, তুমি অনুরাধা পাড়োয়ালের শ্যামাসংগীতের মতো উদাসীন। খুব ভোরে মায়ের আঁচলে টের পাই উনোনের থাবা। ঐ তো এক হাজার চোখের সামনে তুমি কীভাবে খুলে ফেলো শাড়ি দূর থেকে দেখি। বেলা বাড়ে। চায়ের দোকানে ধারবাকি। সস্তার সিগারেট। তোমার স্তন, বাম বাহু উঁকি মারে বাজারের থলির ভিতর। শুধু সুখী মানুষের নিস্পৃহ চোখের মতো আরেকটা দিন চলে যায়।

তোমাকে এনেছি বিবাহ করে নগদ কুড়ি হাজার টাকা আর লাল সাইকেলের বিনিময়ে। এসো, বোসো, এমন এক বিকলাঙ্গ আখ্যানে। ঐদিকে শনিমন্দির, অলঙ্ঘ্য শ্যামাসংগীত— তার নীচে মাতৃআজ্ঞাবহ জল।

অবমানব

মেয়েলি কিশোর জানে নারীবাদ বলে কিছু নেই। শুধু তার চোখের চাহনি সন্দেহ করেছিল পুরুষের ছায়া। বাথরুমের দেওয়ালগুলি কবে থেকে ছন্নছাড়া প্রেমিকের চোখ? প্রতিদিন আয়নার ছবি জানে নির্জন বুকের রহস্য। প্রতারণা। লিঙ্গের পবিত্র আবহসংগীত। নারীর বুকের উপর, হে মায়াবী পুরুষ আমাকে চর্বচোষ্য খাও। ছুঁড়ে দাও রজঃস্বলা নদীর ওপারে। যদি পিতৃপুরুষ খোঁজ নেয় বলে দিয়ো নিজস্ব পাজামা আমি রেখে গেছি গাছের কোটরে।

নেই, নেই, কিছু নেই, সত্যি নেই, মেজদির দ্বিতীয় স্বামীর জীবনে। শুধু বাঁশবন থেকে একটু দূরে এখনও উড়ছে তার সন্ধ্যার রক্তমাখা প্রেমের অক্ষর।

Categories
2021-Utsob-Poem

অনুপম মুখোপাধ্যায়

সেন্ট পিটার্সবার্গ

আমারই ভিতরে আছে সাবেক শহর
পুরাতন ইমারত প্রাচীন পাঁজর

ধাতুময় ইতিহাস এই শহরের
আমার সম্ভ্রম চায় অন্ধকার রাতে

এখানে কান্তার নেই মেয়েমানুষের
বুকের বোঁটায় নেই খয়েরি জোছনা

প্রেম আছে ঘৃণা আছে তার চেয়ে বেশি
প্রেম আর ঘৃণা নিয়ে অভিনয় আছে

ভাঙা উৎসবের দাঁত লেগেছে বাতাসে
কালো নদী বয়ে গেছে শহর দু-ভাগ

দস্তয়েভ্‌স্কির লেখা কাহিনি যেমন
এপারে দাঁড়িয়ে শুনি ওপারে চিৎকার

পাললিক

টেথিস সমুদ্রে তুমি ডুবে থেকেছিলে
অনুপম তুমিও তো পলির পাহাড়

বাতাস তোমার বুকে ডাকাতি করেছে
ছিঁড়ে রেখে গেছে সব জীবন কাহিনি

পাহাড়েরও সীমা থাকে উচ্চতাবিশেষ
কিছু পাখি উড়ে যায় পাহাড় পেরিয়ে

পর্বত হলে না কেন হতে পারলে না
হালকা হাতের চাপে গড়ে উঠেছিলে

টেবিলে কে রেখে গেছে দুধের গেলাস
খেয়ে নাও দিঘা যাও হাওয়া পালটাও

নিরো

অন্ধ লোক হেসে ওঠে তুষার পতনে
তুমি আরও দেওয়াল ঘেঁষে যাও

সরু গলি
পিঠে বোঝা
বৃদ্ধ ঘোড়া আসছে

শহরের যে-বাড়িতে আগুন লেগেছিল
তুমি আজও যাবে কি সেখানে

আধপোড়া পাণ্ডুলিপি
টিপে দেখবে কি

মনে কি পড়বে সেই ভুলে যাওয়া মুখ
মিশকালো বেহালার বাঁকে

জাহাজ ২

ভাঙা ১ জাহাজের অবয়ব থেকে সমুদ্রের ফেনা মুছে
নতুন জাহাজ আজ প্রকাশিত হল

ক্ষুধার্ত লোক কি বোঝে রেস্তোরাঁর ভিতরে বসা
অন্য ১ ক্ষুধার্তের জীবন কেমন

হাওয়া যত ছুটে যায় ধুলোভরা রাস্তা দিয়ে
অনেক দূরের কোনো কুটিরের দিকে
দুঃখ তত সোজা নয় বৃষ্টিতে ভাসিয়ে
পরিচ্ছন্ন বন্দরের অনুমতি পাবে

নতুন আষাঢ়ে মেঘ কোথায় গর্জন করে
কোথায় ভাসিয়ে দ্যায় নোঙরের ফুল

তার দেহ তার সে-শরীর আরও বহুকাল
তারই নিজের হাতে ব্যবহৃত হোক

Categories
2021-Utsob-Poem

অঞ্জলি দাশ

বোবা জল

মজা পুকুরের জলে ডুবে আছে অবুঝ বয়স,
চাঁদের ষোলোটি কলা কৌশলের জাল ফেলে
তীরে পাহারায়…
ঢিল ছুড়ছ,
আর বোবা পুকুরের বুক থেকে ব্যথার বুদ্‌বুদ উঠে
লুটিয়ে পড়ছে পায়ে।
ব্যথারা কি নীল?
নাকি স্পর্শভুক প্রেমের প্রান্ত ধরে বেড়ে ওঠা
জন্মান্ধের আলো?
ওইটুকু আলোর লোভেই অন্ধকারে বাঁধা পড়ে আছি।
বন্ধনের বিষ তুমি জানো,
জানো বন্ধনমুক্তির হাহাকার।
যে-সময় সমুদ্রে বাতাস ওঠে, বন্ধ পারাপার…
আমাদের দুঃখী পুকুরের বুক
জমানো কথার তোড়ে আছড়ে পড়ে ঘাটে।

বিবাহ বার্ষিকী

মুগ্ধ হাওয়া থেমেছে যেখানে, সেইখানে আমাদের মার্চ মাস। তার গায়ে টুকরো খিদে, আজও। বিমর্ষ ফুলের মতো ছোটো, তবুও বিশেষ।
যেন কোনো দীর্ঘ যাত্রা, ধীরগতি। সামনে কোথায় যেন সামান্যই আলো। জড়িয়ে আসা পথ, জুড়িয়ে আসা তাপ।
গতিবিলাসের মোহে স্বপ্ন ভুলেছে ঘুম। সে জানে না কোথায় কতটা রাত জাগা।
ট্রেনও বোঝেনি এখানে থামতে নেই। পথ নেই, তবু পলক নিবিয়ে দিয়ে উড়ে যেতে হয়।
কতদূর আর? কতটা পিছন দিকে মার্চ মাস আমাদের?
জলা পাহাড়ের পাশে চোরবাটো উঁকি মারে মাত্র একবার। সেইখানে শীত আর অন্ধকার পরস্পর আলিঙ্গনে।
ওই স্থিতি আমাদের নয়। আমাদের সূর্যোদয় অন্ধকারে সন্নিবিষ্ট। শুকনো পাতার গায়ে বাদামি রোদ্দুর লাগলে আমাদের ভাত ফোটে আজও।

বিষাদ প্রান্তর


সমস্ত মৃত্যুর স্বর একপাশে সরিয়ে রেখেছি।

আমার ভ্রমণ যত দূর, সেই অব্দি থেমে আছে পথ,
পাহাড় ততটা দূর অপেক্ষা করেছে।
তাহার ওপাশে কোনো দেশ নেই।
ধূ ধূ অবকাশে আছে হাওয়া… মানবিক গন্ধহীন,
নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া কবিতারও মৃত্যু নিশ্চিত জেনে
ফিরে আসি।
সমস্ত ভ্রমণ শেষে বিন্দু বিন্দু আমি পড়ে থাকে পথে,
পাহাড়ের ভাঙা টুকরো তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে দেখি,
জীবনের পাশে একটি কলম অপেক্ষায়।


খানিকটা অল্পবয়স রেখে আসি পথে,
ছাদহীন বৃষ্টি ও শিশির পান, ধীরে বাড়ে অবোধ ডালপালা,
বেড়ে ওঠে আর প্রতি রাতে শীত করে
ষোলো বছরের পর জ্বর আসে তার, আগুন শরীরে পথ পোড়ে।
এ-ঘর এখন রোদ্দুরবিহীন, ভুলে যাই ঘাসের বয়স।
ছাদের ছায়ায় বন্ধ চোখের পাতা ক্রমে ক্রমে অন্ধকার সহ্য করে,
স্মৃতিহীন, একা লাগে।


কিছু আগে কেউ যেন সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেছে
আকাশের দিকে, অনিচ্ছায়।
তার মনখারাপের ছায়া ভেঙে ভেঙে মেঘ খেলছে,
জানি বৃষ্টি হবে।
উঠোন পিছল হবে ফের, নীল হয়ে জেগে উঠবে ঘাসফুল
ওরা ব্যথা গিলে খায়।
আমাদের আনন্দ বিষাদ, প্রত্যেক পায়ের ছাপ,
লিখে রাখে জন্মকোষে।

বুঝি চুপ করে কান পেতে আছে দরজা জানালা
চিড় ধরা দেয়ালের তীক্ষ্ণ শিস, চিরে দিচ্ছে
গোপন অপেক্ষা
কার যেন খবর আসেনি কতদিন।

দীর্ঘ পথের হাহাকার,
চোখ থেকে মেঘ মুছে দেবে একদিন,
তার আগে ফিরিয়ে নেবেই কথা রাখবার দায়।


সব পথ মুছে গেলে পৌরাণিক শিকড়ের কাছে ফিরে আসি,
ভেঙে পড়া ঘর,
জং ধরা শিকলের গায়ে হাত বোলাতেই
নখের ডগায় সামান্য রক্ত জমে,
ওইখানে লেগে আছে প্রতিশোধপরায়ণ প্রেম।

তবু শেষমেষ উনুন জ্বলেছে রান্নাঘরে,
সাত সতেরোর ব্যথা দিয়ে ষোড়শ ব্যঞ্জন।
এ-ওষধি তোমাকে তো উপশম দেবে অগ্নি।
তার দিকে উড়ে যাবে মন পোড়ানোর ছাই
আসলে যে নিয়ম ভেঙেছে।


একা আছে কেউ—
বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে অন্য কেউ মৃদুস্বরে ডেকে বলছে,
ওই যে অন্ধকার, ফাল্গুনের ছেঁড়া চিঠি আগলে বসে আছ,
ও-সব তো অন্য কারো জানি
তোমার কেবল ওই বিষণ্ণতাটুকু, তাকে রোদ দাও, বৃষ্টিস্নান দাও।

এ-যাপন অন্য পাণ্ডুলিপি,
আরও বেশি বেশি সাজিয়ে তোলে সে-পুরোনো অক্ষর
ভাঙাচোরা, তবু ছবি তৈরি হয়।
তবু অন্ধকারের শরীর জড়িয়ে
কোনো আশ্চর্য গানের পঙ্‌ক্তি বেজে বেজে
শূন্যতার আবাহন করে, বাঁশিটিও শ্বাস নিয়ে বাঁচে।
বন্ধ জানালার গায়ে নিশিডাক লাগে।


বোঝা যায় এইমাত্র ভেজা গাল মুছে এল।
অশ্রু অথবা প্রেম
যে-কোনো দাগের পাশে প্রশ্নচিহ্ন থাকে।
ঘাসমাটি ভেবে তুমি কেন অবুঝের মতো
তার সামনে হাত পেতে থাকো?
সে কিন্তু নিরুত্তরে শাদা পাতা হাতে নিয়ে
কিছু অক্ষর ছড়িয়ে রাখে নির্বিকার।

ভিন্ন বর্ণ, রাগে বা বিরাগে
আমরা যে কাহিনি বানাই, বার বার দৃশ্যপট পালটে ফেলি,
তার যাপনচিত্রটি নিয়ে অকারণে কাটাকুটি খেলি।
খেলা শেষ হলে দেখি, অন্তঃসারশূন্য আমরাই।


বিষাদ ধুতে ধুতে অন্ধকার জমে ওঠে বহমানতায়
আতঙ্কিত জলের জীবন… ঝিম ধরা, বিবমিষা,
আমরা আশ্রয় করি যাকে, সেই রাত পাথরের মতো,
জোনাকি অথবা চাঁদ সকলেই তার গায়ে মাথা কুটে অন্ধ হয়ে যায়।
আমাদেরও চোখ বুজে আসে,
দৃষ্টি বিভ্রমে প্রিয় মুখ ভেবে চাঁদকেই হাতের পাতায়
নিয়ে দেখি সেও ভয়ে গুটিসুটি মুখ গুঁজে আছে
জোনাকির বিপন্ন ডানার নীচে।


নদী আর মন দুইয়ের সীমান্তে এক তটরেখা,
নৌকো বাঁধা আছে
অথচ কোথাও কোনো নদী নেই।
তীররেখা ঢেউয়ের স্পর্শ চেয়ে কেবলই নিজেকে ভাঙে,

আমি তাকে জলস্রোত দিতে চেয়ে
অশ্রুগ্রন্থি ছিঁড়ি, ভেসে যাই নিজে।


অন্য জন্মে বিশ্বাস রাখিনি
চোখের আড়ালে কিছু রেখাচিত্র রং চায়, তাকে নাম দিই, স্মৃতি।
ঝাপসা দেয়ালে বিরহের চিত্রপট, তারই খুদকুঁড়ো সুখ জড়াই শরীরে।

পথ আজও নানাভাবে প্রলোভিত করে,
পরিব্রাজকের ঝুলি ছিঁড়ে ফেলে মাটিতেই শরীর গেঁথেছি।

বিরহ বেদনা ছাড়া অন্য নেশা ছোঁয়নি কখনো,
শুধু অক্ষর আশ্রয়।
প্রাণহীন রেখা বন্ধনের সঙ্গে ওঠা বসা হেতু ব্রাত্য।
ঘুমের মূল্য দিয়ে সামান্য যে-বোবাশব্দ
জড়ো করি ভেজা বালিশের পাশে,
তারা হাওয়ার শরীরে মেশে,
আমি একা বিরহবেদনা নিয়ে মাথুর রচনা করি।

১০
পূর্ণ আকাশ নেই, শুধু কিছু ছেঁড়া মেঘ পাশে,
তারা জানে ছাদ নিয়ে ভাবিনি কখনো।
মাটি খুঁড়ে নদীকে এনেছি দরজায়,
শরীরে জড়িয়ে গেছে জলের শিকল।

তৃষ্ণা লিখি জল দিয়ে, সুখ আঁকি জলে… মুছে যায়।
মুছে তো যাবেই, পণ্ডশ্রমের শাস্তি এই।

যদি চাও অশ্রুর সমস্ত উৎস ফিরিয়ে দিতেই পারি আজ।
দেয়ালে ফাটল, কষ্ট লুকোনোর কোনো অবকাশ নেই,
তবুও সে অবেলার রোদটুকু আত্মসাৎ করে।

Categories
2021-Utsob-Poem

সরদার ফারুক

বুনো চাঁদ

ইতস্তত পড়ে আছে শামুকের ভাঙা খোল
সাদা কড়ি, তারামাছ, ত্রিকোণ পাথর
বালির কাগজ জুড়ে কাটাকুটি খেলা
শেষ হতে বেশি দেরি নেই

ঝাউপাতা নাচে শুধু হাওয়ার উচ্ছ্বাসে
নারকেলসারি বলে ওঠে—
ওকে বিয়ে দিয়ে দাও!

তাঁবুর জীবন ভুলে, যাযাবর, শহরের দিকে হাঁটে
বুনো চাঁদ পিছু নেবে, কখনো ভেবেছ?
বাঁশের সেতুর কাছে বেদেনির চুড়ির দোকান

জ্বর

বিড়ালবিদ্বেষী কেউ বলেছিল প্রাণীটির রোমের নীচেই থাকে
জ্বরের জীবাণু। বাড়িতে বিড়াল নেই, তবু মাঝেমধ্যে জ্বর হয়
রক্ত পরীক্ষার কথা ভাবি
এমন সংক্রমণ খুব কম আছে— ত্বক থেকে স্নায়ু
এতটা নিবিড় করে আর কেউ জড়ায় আমাকে?

প্রবল দংশনে সব প্রতিরোধ ছেঁড়ে। যদি আজ সবাই ভুলেছে
তবে সে থাকুক— অন্তহীন এই নির্বাসনে, গোপন প্রেমিকা

কুশপুত্তলিকা

যেন তুমি অনেকটা মদ পান করে শুয়ে আছ মাঠে
মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয় লাজুক তারার হাসি
যেন তুমি দিনমান অনাথের মতো পথে ঘুরে
দোকানির বয়সি মুখের রেখা দেখে যাও

এখন নীরব থাকা ভালো। আইনের বইয়ে বাসা বাঁধে
বোলতার পরিবার
প্রহরীর জুতোর ডগায় ঘাস লেগে আছে, বন্দুকের নলে
সাদা প্রজাপতি বসার আগেই উড়ে যায়
নীল ওড়নার নীচে মহাদেশ, অচেনা ভূগোল
কখনো দেখেছ তুমি মেরুর বরফ, প্রেইরির তৃণভূমি?

তোমার গোপন কথা সকলেই জানে
চৌরাস্তার মোড়ে টাঙিয়ে রেখেছে কুশপুত্তলিকা
শীতের আগুনে সহসাই ছাই হয়ে যাবে

হাত

ছবিতে তোমার কাঁধে কার যেন হাত!
খোঁপায় গাঁদার ফুল, হাসি হাসি মুখ
জুলাইয়ের অসহ্য গরমে
মানচিত্র ফুটে আছে বাহুর সন্ধিতে

ফোটোগ্রাফারের ভুলে
ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর মাথা কাটা পড়ে গেছে
শুধু বনমানুষের মতো তার
রোমশ থাবাটি দেখা যায়

মৃদঙ্গ

সুডৌল মৃদঙ্গ দেখে থমকে দাঁড়াই
কী করে বাজাই
কীভাবে তুলব আমি রাধাকৃষ্ণ বোল?
ভাবতেই সাতটি সাগরে উতরোল
আড়-ঠেকা, সম-ফাঁক, নিগূঢ় তেহাই
হিসাব মিলাই

আসলে তো সুর-তাল সব মনে মনে
বিষাদমথিত আর তোলপাড় ক্ষণে
উঠে আসে হাতের আঙুলে
এক জীবনের না পাওয়ার কথা ভুলে

Categories
2021-Utsob-Poem

যশোধরা রায়চৌধুরী

প্রেম আর মৃত্যুকে নিয়ে কিছু কথা

মৃত্যুর সঙ্গে প্রেমের একটা কীরকম যেন সম্পর্ক আছে।

মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার অনুভূতি,
অনুক্ষণ শ্বাসরোধ হয়ে আসা আলোর কথা, ভাবতে ভাবতে
তলিয়ে যাওয়া প্রেমের মধ্যে
এই তো চেয়েছিল আরিস্তোত্‌ল থেকে অলোকরঞ্জন
অথবা রাসেল থেকে রবিশংকর…
বলো চায়নি?

শিক্ষিত মানুষের আর যা যা চাওয়া থাকে
তার গভীরতা
শ্যাম্পুর পর মাথায় খুশকি আছে কিনা আঙুলে খুজলি করে
দেখে নেওয়ার মতো।

মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার ক্ষমতা
অশিক্ষিত মানুষের আছে
গাছ থেকে পিছলে পড়ে যাওয়ার সময়ে
রাতঘুমে বোবায় পাওয়ার সময়ে
হাঁচবার সময়ে।

হাঁচতে যে-সুখ
মুহূর্তের এক শতাংশের জন্য যে-মৃত্যু
হৃদযন্ত্রের বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে-মওকা
সর্ব অঙ্গের ক্রিয়াপ্রক্রিয়া থেমে যাওয়া সমেত

সেইসবের একশোগুণ বেদনা
প্রেমের ক্ষেত্রেও অর্জিত হলে
পৃথিবীর প্রতিটি প্রেমিক… চণ্ডীদাস থেকে জয়দেব
মিশেল ফুকো থেকে নীরদবরণ…
সবাই ধন্যি ধন্যি করত…।

বাকি যা কবিতা ও কথা ও দর্শন রচনা প্রেমকে নিয়ে, তা মিথ্যাচরণ।

তবে ৯৯% ক্ষেত্রে প্রেম থাকে না বলেই
এসব দরকার পড়ে আমাদের।


মৃত্যুর সঙ্গে প্রেমের একটা কীরকম সম্পর্ক আছে।
প্রেমের চূড়ান্ত অবস্থায় আমরা মরে যাওয়ার কথা বলি।
আমরা মরার মতো কষ্ট পাই, প্রেম চলে গেলেও, আবার।
তাহলে এই দু-রকম মরার মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে।
তবে ভয়, যেটা প্রতিপদে আমাদের ভেতরে কাজ করছে,
নিজেকে সম্পূর্ণ হারানোর কষ্ট
আর সব হারিয়ে ফেলার দুঃখ আর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া,
আর শরতের মেঘের মতো উবে যেতে থাকার
বেদনা… সব মিলিয়ে,
আমার এখন মৃত্যুকেই বেশি বেশি প্রেমের মতো লাগছে।

কবিতার নাম শিল্প

আমি তো ভাষা পারি ভাষার আলো পারি আলোর চেয়ে পারি অন্ধকার
কিছু তো পাড়ি দেওয়া অথবা থেমে গিয়ে শ্রবণ সরু গান স্তব্ধতার

পাড়িতে আছে ভয় হয়তো পরাজয় হয়ত টানা গান ফুৎকারের
তবু তো চাক্ষুষ করেছি মন্দকে টেনেছি জিভখানি চিৎকারের

এখনও দম আছে এখনও ঘাম ঝরে তুমুল কষ্টেও হাসিই পায়
এখনও শ্রম করে অনুক্রম ধরে পেছনে চলে গেলে বাঁশি ফেরায়

ফের হে বালকেরা ফের হে বালিকারা হও হে কষ্টেই দৃষ্টিবান
যদি ভাষায় থাকো ভালোবাসায় থাকো নিজের শিল্পেতে দাও হে শান!

Categories
2021-Utsob-Poem

বিপ্লব চৌধুরী

টাকা মাটি মাটি টাকা

প্রেম একবারই এসেছিল। সরবে। রান্নাবাটি, কান্নাকাটি, ফাটাফাটি ঝগড়া আর তুমুল শরীরে। সন্দেহে ঝুঁকে পড়ে বার বার সে দেখত আমার মুখ। আমি তার ঘুমন্ত বুকে হাত রেখে জাগাতে চাইতাম। ভোরের আলো এসে পড়ত আমাদের কুঁচকানো বিছানায়। আমরা সিনেমায় যেতাম, নাটক দেখতাম, হেঁটে বেড়াতাম বইমেলার ভিড়ে। এইভাবে তিনটি শতাব্দী ধরে চলেছিল আমাদের দ্বিতীয় জীবন। তারপর কী যে হল। আমার প্রবাসী বন্ধু দীপেনের সাথে তার ভাব হয়ে গেল। আমার সঙ্গে আড়ি। আমি ভেঙে পড়লাম। গ্যালন গ্যালন মদ খেলাম আর ঘন ঘন গেলাম বেশ্যাপাড়ায়। প্রবাসে, দৈবের বশে যার সঙ্গে তোমার জমে উঠেছিল খেলা, একদিন ভেঙে গেল সেই খেলাঘর। তার অনেকদিন পরে টোকিয়ো নিবাসী দীপেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এই উঁচু কলকাতায়, পার্ক স্ট্রিটের একটি অভিজাত বারে। তার মুখে, তোমার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হলাম। ‘হে ধরণী, দ্বিধা হও’ মনে হয়েছিল। সে নাকি তাকে বলেছিল যে, পীরিতি ভাঙনের খেসারত স্বরূপ আমি সেই ভদ্রমহিলার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা চেয়েছিলাম। শুনে প্রথমে বিদ্যুৎ চমকে উঠলেও তারপর হো-হো-হো হাসি পেয়েছিল। টাকা আমি জীবনে চাইনি, না তোমার কাছে, না আমার জীবনদেবতার নিকটে। আমি শুধু চেয়েছি তোমায়। আমি চেয়েছি বাংলা মদ, বাঙালির প্রধান খাদ্য মাছ আর ভাত এবং বঙ্গভাষায় লিখিত কিছু উত্তম বইয়ের সম্ভার। টাকা আমি চাইনি কোনোদিন। আমি শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম। সাপের মতন, সর্বাঙ্গ দিয়ে অনুভব করতে চেয়েছিলাম এই পৃথিবীর মাটি।

সূর্যকে বকতে যাচ্ছি

আমার এই হন হন করে হাঁটা দেখে বুঝছ না ব্রাদার, আমি চলেছি সূর্যকে প্রবল বকাবকি করতে, চলিত বাংলায় তিরস্কার বলা হয় যাকে, ঘনঘোর শীতকাল, ডিসেম্বর মাস, অথচ দশ দিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই, জামাকাপড় বিছানাপত্তর বউদের গতর থেকে ভ্যাপসা ভাপসা গন্ধ ছাড়ছে, ক্রিসমাস উপলক্ষে যারা জলদাপাড়ায় বেড়াতে এসেছে, তারা কি ট্যুরিস্ট লজের ঘরে বসে সারাদিন আঙুল চুষবে, অথবা হুইস্কি আর পকোড়া পেঁদাবে, গন্ডারের খড়গের সঙ্গে সেলফি তোলার সৌভাগ্য কি হবে না তাদের, শিকেয় উঠবে নাকি পর্যটন শিল্প আমাদের, সমস্ত পৃথিবীতে যথাযথ আলোকসম্পাতের কাজ আমি একমাত্র ওকেই দিয়েছি, তবুও উত্তরবঙ্গের প্রতি সপ্তাহব্যাপী তার এই বঞ্চনার প্রকৃত কারণ কী, জানতে চাই আমি, সে কি বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা উগ্রপন্থীদের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছে, তার উত্তরাপন যদি খুশি করতে পারে আমাকে, আজ না হোক অন্তত কাল থেকে সে আবার পূর্ববৎ রোদ্দুরের প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন আমি ওকে ক্ষমা করে দেব, জামার পকেটে দুটো পাঁচশো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলে আসব, চাঁদকে বলিস তোকে যে রামের বোতল আর দেশি মুরগির মাংস রেঁধে দেয়।

সৌর

আজ রবিবার। চলে গেল আরও একটা শীতকাল। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম একটা আরামদায়ক কম্বলকে জড়িয়ে ধরে। নীল রঙের নরম কম্বলটিও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। অন্তত সকাল ন-টা দশটার আগে যে কোনোদিনই ছাড়তে চায়নি আমাকে। আমাদের মধ্যে কোনো কথা কখনো হয়নি। তবে পাশের বাড়ির থেকে টিভির শব্দ ভেসে এসেছিল। আজকে যেমন শোনা গেল কোকিলের, সবজি আর মাছওলার ডাক। এই শীতে বরাবরের মতোই আমি পান করলাম ওল্ড মংক রাম এবং পড়লাম কিছু বাংলা বই। তার মধ্যে দু-একটি কবিতার। শীতকালে আমি কোনো কবিতা লিখি না। মেঘলা দিনে কারো কথা আর মনে পড়ে না আমার। শীতকালে আমি কুয়াশা হয়ে কোনোমতে পড়ে থাকি পৃথিবীর কোণে। নেওয়া হয় না তোমার খবর। একটা নীল কম্বলের সঙ্গে শুয়ে থাকি আমি। শীত খুব শীত করে, তাই মোজাও খুলি না। দুঃস্বপ্নে দেখি বিপজ্জনক সব পথ আর অনেক পতন। ঢকঢক করে বোতলের জল খেয়ে দমদম বিড়ি ধরাই আমি। বসে থাকি। কাশি। ভাবি, শীতকাল কবে যাবে, কেটে গিয়ে, প্রথমে বসন্ত-পলাশ আর তারপর মহামান্য গ্রীষ্ম আসবে। আমিও যে সৌরজগতের মধ্যে আছি, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাবে।

Categories
2021-Utsob-Story

রিপন হালদার

আশ্চর্য ভ্রমণ

এই মাঠটা মনে হয় কিছু মানুষের অন্তহীন পায়াখানার স্থান। এর আগে যে-কয়বার ও এখানে এসেছিল প্রত্যেকবারই কিছু মানুষকে দেখেছে তাদের দীর্ঘ কালো প্রস্রাবদণ্ড মাটিতে ঠেকিয়ে পায়খানায় রত। প্রত্যেকের সামনে একটা করে ঘটি। আড়চোখে গুনে দেখা গেল আটজন। এবং প্রত্যেকের মাথা মাটির দিকে নোয়ানো। এই লাইনের পর কিছুটা জায়গা ফাঁকা। তারপর আবার একটা লাইন। এখানে যারা বসে আছে তারা আবার পরনের লুঙ্গি বা ধুতির মতো পোশাকটা উলটিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। যেন এর ফলে পৃথিবীর আর কেউ তাদের গোপন অঙ্গ দেখতে পারবে না! অন্য দিকে তাকানোর ভান করে গুনে দেখা গেল ছয়জন। আগে যতবার এখানে এসেছিল এদের এভাবেই দেখা গিয়েছিল। আজও অমল দেখতে পেল মানুষগুলোকে একই কাজে ব্যস্ত। প্রত্যেকের বসার ধরন একরকম। মাথার আকৃতি দেহের বিশেষ করে হাত পায়ের গঠন একইরকম দেখতে। সামান্য দূরত্ব রেখে লাইন দিয়ে কী অদ্ভুতভাবে মানুষগুলো উবু হয়ে বসে আছে। এবং প্রত্যেকেরই গায়ের রং কালো। কিন্তু কোনোবারই কাউকে উঠে যেতে দেখা যায়নি। মানুষগুলোকে চিরস্থায়ী ভাস্কর্যের মতো দেখতে লাগছে। মাটির রাস্তাটা পেরোতে পেরোতে অমল মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে ওইদিকে। ব্যাপারটা এমন যে মনে হয় সেই প্রথমবার দেখা মানুষগুলোই এখনও সেখানে বসে আছে। আগেও অমল গুনে দেখেছে আট যোগ ছয়জন বসা ছিল।

বটগাছটা কাছে এসে পড়ায় এতক্ষণে মনে বেশ খুশি জেগে উঠল। ঘন ছায়ায় এবার ও যতক্ষণ ইচ্ছা বসে থাকতে পারবে। প্রতি শনিবার স্কুল চার পিরিয়ডে ছুটি হয়ে গেলে অমল এখানে এসে বসে থাকে। এই মাঠে ওই পায়খানার লোকগুলো ছাড়া অমল আর কাউকে কখনো দেখেনি। লোকালয়ের পিছন দিকে অবস্থিত বলে অথবা আশেপাশে পাকা রাস্তা না থাকার জন্য হয়তো এখানে কারো পা পড়ে না। এই কারণে ওর জন্য এখানে অপার স্বাধীনতা। যতক্ষণ ইচ্ছা থাকা যায়। কেউ বারণ করার নেই। কোনো মানুষই আসে না এখানে, কে বারণ করবে! বটগাছের কোটরের মধ্যে এভাবে বসে থেকে রোদে ছেয়ে থাকা মাঠের তিন দিকের সীমাহীন শূন্যতা দেখতে পাওয়ার মধ্যে যে-হাহাকার মেশানো আনন্দ আছে তা অমল এই বয়সে সবটা বুঝতে না পারলেও হয়তো কিছুটা বুঝতে পারে। না হলে ও এখানে আসে কেন!

আজকের আবহাওয়া অন্যান্য দিনের মতো নয়। হঠাৎ আসা মেঘলা ধূসর আবহাওয়াটা মাঠের রূপ দিয়েছে পালটিয়ে। অথচ একটু আগেই রোদ ওর চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছিল। ঠান্ডা এক আমেজ প্রবাহিত হাওয়াকণার মধ্যে প্রবেশ করে ওর দেহের ত্বকে এখন মুগ্ধতা জাগাচ্ছে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর অমলের ইচ্ছা করল মাঠটাকে একটু ঘুরে দেখার। অন্য দিন ও শুধু এখানে এসে বসে থাকত। যেহেতু অন্যান্য দিনের মতো আজ রোদের তেজ অত জোরালো নয়, তাই ভাবল ঘোরাই যায়! সারা মাঠের উপরে ধূসর কালো মেঘের ছায়া জমছে ধীরে ধীরে। এক সপ্তাহ পর অমল আজ এতটা খোলা জায়াগা দেখতে পাচ্ছে। ওর বাবার ওখানে এতই ঘিঞ্জি বাড়িঘর যে আকাশ দেখা যায় না।

কোন দিকে আগে যাবে বুঝতে না পেরে চোখ বরাবর হাঁটতে শুরু করে দিল। এদিকটা এবড়োখেবড়ো মাটি। উঁচুনীচু ঢিলে ভরতি। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর এবার অমল দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল। এভাবে হাঁটার কোনো মানে হয়! অসাবধানে পা পড়লে মচকে যেতে পারে। কিন্তু মেঘলা আকাশের নীচে উদার মাঠের উপর দিয়ে একা একা এভাবে হাঁটার মধ্যে আনন্দও পাচ্ছে ও। মনের একাকিত্ব বাইরের একাকিত্বের সঙ্গে মিশে গিয়ে একধরনের বেদনা-মিশ্রিত আনন্দ তৈরি করছে।

বিরতির পর আবার শুরু করল হাঁটা। এবার বাঁ-দিক ধরল। যেদিকেই হাঁটে মাঠের অবস্থা একই। দিগন্ত অনেক দূরে! আবছা একটা দাগের মতো আকাশ আর মাটিকে কেটে রেখেছে।

এবার ডান দিকে ফিরল। এখানেও একরকম প্রকৃতি। যেদিকেই যাওয়া যায় কোনো পরিবর্তন নেই। শুধু যেদিক থেকে ও এসেছিল সেই দিকটা বাদে। সেদিকে গাছপালার অস্পষ্ট কালো ছায়া প্রাচীরের মতো আকাশের দিকে কিছুটা উঁচু হয়ে আছে। অমল হাঁটতে থাকল এবার দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। আনন্দ যেন ওর হাত-পা হয়ে ছুটছে। কোথায় যাচ্ছে তার যদি কোনো গন্তব্য না থাকে তবে যেদিক খুশি চলা যায় এবং চলাটাই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। সেভাবে ক্লান্তিও যখন কাউকে আক্রান্ত করেনি তখন তো আর পিছু হটার কারণ নেই।

এইসময় বাঁ-হাতে ধরে থাকা বইখাতাগুলো নিয়ে অমল একটু অসুবিধায় পড়ল। তাছাড়া হাতের ঘাম লেগে লেগে ওগুলোর ধরে থাকার দিকটা নরম হয়ে যাচ্ছে। অমলের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। জামার নীচের দিকের দুটো বোতাম খুলে কোমরের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে নিল বেল্টের মতো করে। তারপর বুকের দিক থেকে বইখাতাগুলো একটা একটা করে সেখানে দিল চালান করে। এবার পেটের সামনে ভারী কিছু থাকার থলথলে অনুভূতি নিয়ে শুরু করল হাঁটা। পদ্ধতিটা তেমন স্বস্তির না হলেও হাতে ধরে রাখার চেয়ে সুবিধাজনক মনে হল।

এই দিকে হাঁটতে গিয়ে অমল একটা বাড়তি সুবিধা পেল তা হল বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত হচ্ছে মাঝারি গতির হাওয়া। ফলে দেহে আরামের সঞ্চার হচ্ছে। কতটা এসেছে কিছু বোঝা গেল না। দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে সোজাসুজি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। মাঠের উপর ধূসর রঙের এবড়ো-খেবড়ো মাটির চাক ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। দৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে আসে বেশিক্ষণ তাকালে। তাও এই মুহূর্তে সামনে ক্ষীণ বৈচিত্র্যের আভাস দেখা যাচ্ছে মনে হল। কেমন যেন একটা অস্পষ্ট ধারণা হল অমলের, যে-জায়গাটায় ও এখন দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে সোজাসুজি একটা উঁচু ঢিবির মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। যদিও খুবই আবছা দৃশ্যটা। ওর দৃষ্টিভ্রম কী! এই বৈচিত্র্যটুকুতে অবশ্য ওর মন সতেজ আর কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে উঠেছে। নতুন উদ্যমে আবার ধেয়ে চলল গন্তব্যের অভিমুখে। সমস্যা হল যতই ও এগোচ্ছে গন্তব্য আর আসে না। হতোদ্যম না হয়ে এগিয়ে যাওয়াই মনস্থির করল। অদ্ভুত তো! মনে হচ্ছে ওর এগোনোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গন্তব্যও দূরে সরে সরে যাচ্ছে। অমল এবার দাঁড়িয়ে পড়ল। ও কি ভুল পথে যাচ্ছে! কোনো ভুলভুলাইয়ায় আক্রান্ত হল! বেলা এখন কত! মনে হয় মধ্য দুপুর। স্কুলের টিফিনে খাওয়া পাউরুটির টুকরোটা হজম হয়ে গেছে আগেই। এই অবস্থায় আরও এগোনো কি ঠিক হবে! ফিরতে দেরি হলে নতুন মা নিশ্চয় রাগ করবে। সেদিন তো কড়াভাবে বারণ করে দিয়েছিল যে, স্কুলের ছুটির পর যেন অন্য কোথাও না গিয়ে সোজা বাড়ি চলে যায়।

এইসব এলেবেলে ভাবনাগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে অমল এগিয়ে যাওয়াই সিদ্ধান্ত নিল। যেহেতু একটা গন্তব্যের সন্ধান পাওয়া গেছে, এতদূর এসে ফেরা যায় না। তার উপর একধরনের অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ ওকে দখল করে ফেলেছে। দ্রুত পা চালাল। চেষ্টা করল দ্বিগুণ বেগে হাঁটতে। অনেকক্ষণ হাঁটল গন্তব্যকে সামনে রেখে। হাঁটতে হাঁটতে এইবার ক্লান্তি যখন ওকে প্রায় পেড়ে ফেলেছে, চোখের বায়বীয় ধোঁয়াশার পর্দাটা ঘিরে ফেলেছে ওর চারদিকটা। হাঁটা তবু থামাল না।

অবশেষে ঢিবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠল ওর চোখের পর্দায়। দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিল কিছুক্ষণ। এবং শ্বাস-প্রশ্বাস যখন স্বাভাবিক পথে যাওয়া-আসা করছে হঠাৎ অনুভব করল পেটের ভারটা আর নেই। জামার গিঁট খোলা। এখন কী হবে! পিছনের দিকে মাথা ঘোরাল। পিছনে বিস্তৃত ধোঁয়া ধোঁয়া মাঠ। তারপর তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফেলে আসা পথটাকে ফালা ফালা করে খুঁজতে থাকল বইগুলো। অবশেষে বুঝতে পারল একই জায়গাতেই ও ঘুরেফিরে চলে এসেছে। এবং শূন্য হাতে। ঢিবিটার দিকে আর এগোবে কিনা মনস্থির করতে পারছে না। ক্লান্তি আর হতাশায় বসে পড়ল মাঠের মধ্যে। কান্নার দমক ওঠা বুকটাকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছে প্রাণপণে। কিন্তু অচেনা অজানার নিমন্ত্রণ কতক্ষণ সে উপেক্ষা করতে পারে, দেখাই যাক!

ততক্ষণে ওর পায়ের চঞ্চলতা মাঠে ঢলে পড়েছে। আবার শুরু করেছে হাঁটা। অবশ্যই সামনের দিকে। কিছুটা পথ এগিয়ে বোঝা গেল ঢিবি বলে এতক্ষণ যা ওর মনে হচ্ছিল আসলে তা বিরাট একটা টেবিলের মতো কিছু। মাটি বা পাথর দিয়ে তৈরি যে নয় তা অস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। আরও এগোতে থাকল অমল আবিষ্কারের মোহে। গতি এবার আগের থেকে দ্রুত। প্রায় কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পেল পদার্থটা স্বচ্ছমতো কিছু। ভালো করে তাকালে ভিতরের কিছুদূর পর্যন্ত যেন চোখ চলে যাবে। হয়তো চেষ্টা করলে ভিতরে কোনো মানুষও ঢুকে যেতে পারে। আজই ক্লাসে স্যার মালভূমি বিষয়ে পড়াচ্ছিলেন। জায়গাটা একদম সেইরকমই দেখাচ্ছে। তবে এটা স্বচ্ছ পদার্থ দিয়ে তৈরি। বরফ, ধোঁয়া, জল বা মেঘের মতো কোনো কিছু দিয়ে তৈরি হয়ে থাকতে পারে। ঠিক কী উপাদানে এটা তৈরি অমল বুঝে উঠতে পারছে না। ভয় মেশানো মুগ্ধভাব নিয়ে ও অনেকটা সময় ধরে ঐ দিকে তাকিয়ে আছে।

আর কাছে যাওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। আবার না গিয়েও পারা যাচ্ছে না। অন্য দিকে মনের মধ্যে বই হারানোর কষ্ট ওকে খুব বিব্রত করে রেখেছে। সত্যি বইগুলো কোথায় এমন উধাও হয়ে গেল! বইয়ের ভাবনা ভাবতে আর ওর ভালো লাগছে না। যা হবে দেখা যাবে। খুব ধীরে ধীরে ও এবার এগোচ্ছে এক পা দু-পা করে। ভয় ভয়ও করছে আবার বুকের মধ্যে। তবু সাহস আনার চেষ্টা করল। এভাবে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল আর একটু। হাত বাড়ালেই দেয়াল বা পর্দাটা ছোঁয়া যাবে এমন দূরত্বে এখন ও আছে।

অমলের চোখে এবার ভেসে উঠল চমৎকার একটা দৃশ্য। সেই স্বচ্ছতা ভেদ করে ফুটে উঠেছে একটা অবয়ব। সিনেমার পর্দায় ছবি ফুটে ওঠার মতো। ঠিক তাও না। কিছুটা আয়নার মতো। আবার অতি স্বচ্ছ আয়নাও না। আয়নায় জল লেগে থাকলে বা অল্প ধোঁয়াভরতি ঘরে দেয়ালজোড়া আয়না থাকলে যেমন দেখায় অনেকটা সেইরকম। অমল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ছবিটাকে। ছবির মধ্যে আবার মৃদু মৃদু ঢেউও খেলে যাচ্ছে। সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো আরাম এখানে। কেউ যেন একটা বিরাট সমুদ্রকে চারকোনা করে কেটে বসিয়ে রেখেছে মাঠের মধ্যিখানে। ঠান্ডা একটা ভাব চারপাশটায় ছেয়ে আছে। যদিও কোনো শব্দ নেই এখানে। এতক্ষণ আসার সময় মাঠে যে-হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছিল তাও এখন বন্ধ। অমল তাকিয়েই আছে মুগ্ধতা নিয়ে। ওর অঙ্গভঙ্গি চেহারা অবিকল ফুটে উঠেছে সেই পর্দায়।

এভাবে কতক্ষণ ও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ও মনে করতে পারছে না। খুবই আরামদায়ক আবহাওয়া। অনন্তকাল এখানে থেকে যেতে ইচ্ছা করছে অমলের। এখন ক-টা বাজে কাছে ঘড়ি না থাকার জন্য তা জানতেও পারছে না। বাড়ি ফেরার বাস কখন তাও ভুলে গেছে। স্বপ্নের কোনো দেশে হয়তো অমল চলে এসেছে। যেখানে বাস্তব জগতের কোনো স্মৃতিই আসে না।

ঠিক এইসময় অমল দেখল খুব ধীরে ধীরে একটা হাত বেরিয়ে এল সেই স্বচ্ছ আয়নার দেয়াল থেকে। অবিকল ওর হাতের মতো। রোগা শ্যামলা ধরনের। অবশ্যই হাতটা অমলেরই হওয়া উচিত। অমলও তাই ভাবছে। কিন্তু এখানে কিছুটা ব্যতিক্রম আছে। সেই হাতে ধরা একগুচ্ছ বই। বইগুলোর দিকে তাকিয়ে অমল বুঝতে পারল ওগুলো ওরই। রোবটের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে অমল নিয়েও নিল হাত বাড়িয়ে। ভালোভাবে সেই অস্বচ্ছ আয়নার দিকে তাকিয়ে ও নিজের মুখের ছবি ছাড়া আর কিছুই যদিও দেখতে পেল না। কিন্তু যে-হাতটা বেরিয়ে এসে বইগুলো অমলকে দিল সেটা ওর নিজেরই হাত বলে এখন ও নিশ্চিত হতে পারছে না। আবার ওর এও মনে হল বইসমেত হাতটা যেন ওর পেটের নাড়িভুঁড়ির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে আবার ফিরে গেল সেখানেই। এমনভাবেই দৃশ্যটা সেই আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছিল।

ফেরার পথটা আর সেরকম কষ্টদায়ক লাগল না অমলের। বাসে উঠে জায়গাও পেয়ে গেল জানলার কাছটাতে। কিন্তু বসতে ইচ্ছা করল না। শুধু মনের মধ্যে একটা জটিল ধাঁধা আরামদায়ক কষ্টের মতো বাসা করে থাকল।