Categories
amitava_smritikotha

রিমি দে

অমিতাভ মৈত্র: এক ঝোলাওয়ালা

অমিতাভ মৈত্রকে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণগোছের লেখা লিখছিলাম একটি পত্রিকার জন্য। লেখাটি শেষ করে একটু হালকা লাগছিল। ভাবলাম অমিতাভদাকে একটা ফোন করি। করলাম। ৮৯০৬২০… নম্বরে। রিং হয়ে গেল। কেউ রিসিভ করলেন না। এরকম আগেও হয়েছে। পার্থক্য একটাই আগে অমিতাভদা রিং ব্যাক করতেন। আজ সে শব্দহীন! ফাল্গুন মাস। খাঁ খাঁ করছে চারদিক। দখিন হাওয়া মৃদু। টবের ফুলের আলোতেও যেন বিষণ্ণতার চাহনি। বাড়িটাও ফাঁকা। আশ্চর্য ধূসর। কেউ যেন কিছু খুঁজছে। পাচ্ছে না! ‘ছায়া আঁকার খাতা’ পড়ে আছে। শূন্যতা এসে গ্রাস করে নিয়ে গেছে শুকনো পাতাভর্তি ঝোলাটা! জীবন্ত ছায়ারা অচেনা ছায়ার দেশে চলে গেছে।
জানি মৃত্যু এক অনিবার্য সত্যের নাম। তবু মানুষ সেই অনির্দিষ্ট বৈতরণীর দিকে তাকিয়ে থাকে অসহায়ভাবে। ভেবেছিলাম বৌদি বা অর্যমার সঙ্গে কথা হবে। অর্যমার মেয়ে কি দাদু দাদু বলে কাঁদছে! দাদু নাতনিকে খুব ভালোবাসতেন। প্রায়ই নাতনির ছবি পাঠাতেন। কথা বলতে চেয়েছিলাম! হল না।

চাকরির শেষদিকে এই নম্বরটা দিয়ে বলেছিলেন সেভ করে রাখতে। সেই থেকে নম্বরটি গুগলেই সেভ হয়ে আছে। ফোন হারালেও নম্বর হারায় না! এরকম প্রচুর নম্বর আমার সেলফোনে রয়েছে। আমি মাঝে মাঝে নম্বরগুলোতে রিং করি। বেশিরভাগ ফোন বেজে যায়। কেউ হয়তো সেই নম্বরটা সারেন্ডার করেন। কেউ-বা ব্যবহার করেন। যেমন কবি সমর চক্রবর্তীকে ফোন করলে কাবেরীদি রিসিভ করেন। দীর্ঘক্ষণ কথা হয়! আমার মনে হয় আমি সমরদার সঙ্গেই কথা বলছি। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়। বিকেল সন্ধে নিয়ে আসে। সমরদার ব্রাশ করা হয় না! এটা আমার একটা খেলা বলা যেতে পারে!

অমিতাভদার সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ কলকাতা বইমেলায়। সেতু কবিতাপাক্ষিক। প্রভাতদাই পরিচয় করিয়ে দেন। এখন প্রভাতদা নেই। তবু কবিতাপাক্ষিক হচ্ছে প্রভাতদারই আদর্শে। কোনো এক বছর কবিতাপাক্ষিকের বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয়েছিল বাঁকুড়ায়। জায়গাটির নাম ছাঁদাড়। মাদল, লাল মাটির তৈরি বাড়িটা। কবিতা আখড়া করার পরিকল্পনা ছিল প্রভাতদার। মাদলকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সে-বছর আমাকে কবিতাপাক্ষিক সম্মান দেওয়া হবে জানলাম। তো খুব আনন্দ। যাব বাঁকুড়া। কীভাবে যাব! প্রভাতদা বললেন কলকাতা চলে যেতে। তারপর একসঙ্গে বাঁকুড়া। সে অনেকটা সময়ের ব্যাপার। সেসময় শতাব্দী এক্সপ্রেস ছিল না যে টিকিট ঠিক পেয়ে যাব! তাছাড়া আকাশবাণী আর দূরদর্শনের কাজটাও তো করতে হয়। যাতায়াত অনুষ্ঠান নিয়ে দু-দিনের বেশি থাকা যাবে না। অগত্যা কষ্ট হলেও ঠিক হল বাসে যাব। বাড়ি থেকেও চিন্তা করছিল। প্রভাতদা ফোনে জানালেন, ‘অমিতাভ আসবে রিমি, তুমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করো।’ তখন সম্ভবত ঘাটালে ছিলেন। সঠিক মনে নেই। কথা হল। বাড়ি থেকেও নিশ্চিন্ত হয়ে আমাকে বাসে তুলে দিল। বাঁকুড়া পৌঁছোলাম। একটুও অপেক্ষা করতে হয়নি। অমিতাভদা এসে গেছিলেন বাসস্ট্যান্ডে। তারপর ওঁর গাড়ি চেপেই ছাঁদাড়। দেখি সবাই এসে গেছেন। শঙ্খ ঘোষ থেকে ইন্দ্রানী দত্ত পান্না। হই হই কাণ্ড। নাসেরদা, প্রভাতদা, বৌদি, গৌরাঙ্গদা এবং আরও অনেকেই আগের রাতে চলে এসেছিলেন। আমি সেই প্রথম লালমাটির গ্রাম দেখলাম। অনুষ্ঠান চলল। আমরা সেবারেই অনেকে মিলে মাদলে সমবায় কবিতা লিখেছিলাম। মাটির দোতলা বাড়ি দেখে বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়েছিলাম! সেই দোতলায় প্রভাতদার দুই বোনের সঙ্গে রাতে ছিলাম। কী যে স্বচ্ছ আনন্দে কবিতার ভেলায় গা ভাসিয়েছিলাম সে বলে বোঝানো সম্ভব নয়! অমিতাভদা রাতে নিজের কাজের জায়গায় ফিরে গেছিলেন। পরদিন আবার এসেছিলেন। এই লেখা লিখতে গিয়ে ফেলে আসা সময় ও ঘটনা ছবির মতো ভাসছে। কত কবি সম্পাদকের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। দু-দিন কবিতামহলে কাটানো হল মহানন্দে। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ রবিবার সন্ধেবেলা আমাকে অমিতাভদা বাসে তুলে দিলেন। তাতেই ক্ষান্ত হননি! বেশ ক-বার ফোন করে খবর নিয়েছেন। সোমবার ভোরে তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড। বাড়ি। বিকেলে অফিস। বাইরের মানুষেরা হয়তো এভাবেই কাছের হয়ে ওঠেন। পরিবারের হয়ে ওঠেন। আবার বাইরেরও থেকে যান! আসলে আমার মনে হয় সময় যেভাবে কথা বলতে চায়, কথাকেও সময়ের সুরের কাছে ঠিক সেভাবেই ধরা দিতে হয়, দূরত্ব এবং সম্ভ্রম বজায় রেখে! সেখানে ঘনিষ্ঠতা কোনো সমস্যা তৈরি করে না।

লেখালেখিতে অমিতাভ মৈত্রর অর্থ এবং অর্থহীনতা দুটোর প্রতিই বিশ্বাস এবং প্রশ্রয় ছিল। হেনরি, ম্যাডাম এম, ক্রিস্টোফারকে নানান ভঙ্গিমায় লালন করেছেন। একের মধ্যে ফুটেছে বহু স্বর। সিসিফাস ওঁর প্রিয় চরিত্র হলেও জিউসের মধ্যে নিজেকে অন্বেষণ করেছেন বহু আঙ্গিকে। পৌরাণিক চরিত্র হলেও সিসিফাস ও পাথরের প্রচুর ব্যাখ্যা। হোমার, কামু ছাড়াও যারা যেভাবে দেখেছেন প্রতিটি দ্যাখাকে নিজের লেখায় চোরাস্রোতের মতো নির্মোহ লালন করেছেন। প্রচুর পরিমাণে বিদেশি সাহিত্য শুধু পাঠ করতেন না, আত্মসাৎ করে ফেলতে পারতেন একবার পাঠেই। মিথ, ইতিহাস, সাহিত্য, লেখকদের জীবনী, চিত্র, চিত্রকরদের জীবনযাপন, কল্পনাশক্তি, অভিজ্ঞতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার সংমিশ্রণ ওঁর লেখাকে এক অদ্ভুত আশ্চর্যজনক জায়গায় নিয়ে যায়। কবিতা কিংবা গদ্য যাই হোক না কেন প্রকরণ এবং প্রক্রিয়াগত দিকে অবিচল থাকলেও, স্বভাবগত অস্থিরতার প্রভাব লেখায় পড়েছে। সেই কারণেই লেখায় একটি অনির্দেশের ইশারা থাকে! অমিতাভদার মর্মে মর্মে দান্তে এবং ডিভাইন কমেডি লেগে আছে। পদ্যতে ২০০৩-এ কবিতা দিয়ে লেখা শুরু হয়। ২০০৪-এ প্রচ্ছদ করলেন এবং একটি গদ্য লিখলেন। ওরকম গদ্য আগে পড়িনি, তাই খুব অবাক হয়েছিলাম পাঠ করে। গদ্যটির নাম ‘পতনশীল নায়ক’। ২০১২-তে কেমব্রিজ ইন্ডিয়া থেকে ‘পতনশীল নায়ক’ শিরোনামে প্রথম গদ্যের বই প্রকাশ পায়। ১১.০১.১৩ তারিখে বইটি উপহার পাই। অর্থাৎ সেদিন কলকাতায় বাংলা আকাদেমি পরিচালিত লিটল ম্যাগাজিন মেলা শুরু হয়েছিল। ২০০৪ থেকে ২০২১ নভেম্বর আর্তিসংখ্যা অবধি প্রতি সংখ্যাতেই গদ্য লিখেছেন। ২০১৫-তে ‘মা: মিথ কিংবা ডিমিথ’ ভাবনায় পদ্যর একটি সংখ্যা করেছিলাম। সেখানে ‘এক ধূসর অন্তহীন হাওয়া’ এই শিরোনামে মনকাঁপানো একটি গদ্য লিখেছিলেন। আশা করি গদ্যসংগ্রহে লেখাটি পাব। সেখানে অদ্ভুত এক মায়েদের মন্তাজ আঁকেন। শেষে ডি এইচ লরেন্সের Sorrow নামের কবিতাটি। এই গদ্যটি লেখা হয়েছিল কাফকা, কামু, The Outsider-এর নায়ক ম্যরসো এবং স্যামুয়েল বেকেটের মোলোয় উপন্যাসের মায়েদের নিয়ে। তারপর এসেছে বিমল করের ‘ভুবনেশ্বরী’’ উপন্যাসে পরিবারের পূর্ব নারীকে অলৌকিক মা বানিয়ে মিথ করে তোলা। মায়ের সঙ্গে সন্তানের আলোছায়ায় জড়িয়ে থাকা বিন্যাসের কোলাজ।

নাথিংনেসে অগাধ বিশ্বাস রেখেছেন অমিতাভ মৈত্র। নিজের জীবনের ক্ষেত্রেও যেন সামনে একটি শূন্য ঝোলানো। লিখেই চলেন লিখেই চলেন উদ্দেশ্যহীন প্রত্যাশাহীন! তবে প্রচুর গদ্য লিখবেন অবসরের পরে এরকম পরিকল্পনা ছিল। কর্মরত অবস্থায় যা লিখেছেন, তা-ই বা কম কীসের! একটা ভুল ধারণা হয়তো অনেকের আছে যে ওঁর লেখা তেমনভাবে পঠিত নয়! একজন মেধাবী লেখক হিসেবেই উনি পরিচিত। অনেকেই পড়েন কিন্তু চুপ থাকেন! তাতে অবশ্য লেখকের কিছু এসে যায় না! ২০০৫-এ পত্রলেখা থেকে ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ইদানীং লোকমুখে শোনা যায় অমিতাভ মৈত্র ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’ বইটিকে নাকি গুরুত্ব দিতে চাননি! তবে লেখাগুলি এবং পাণ্ডুলিপি যখন তৈরি হয় তখন একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন একথা নিজে বলেছেন সেই বিগত সময়কালে। তাহলে অপছন্দের কাব্যগ্রন্থ কীভাবে হয়! পিতার পাঁচ সন্তান। পিতা জীবনের সব স্তর পেরিয়ে বৃদ্ধ হলেন। পাঁচ সন্তান পাঁচ-রকম। দ্বিতীয় সন্তানের মধ্যে পিতার পছন্দের গুণাবলী না থাকলে তাকে কি তিনি অস্বীকার করতে পারেন? মলিন হয়ে আসা ফ্যামিলি গ্রুপ ফটো থেকে একজনের উপর গাঢ় নীল পেনের দাগ দিয়ে বুজিয়ে তাকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হলে তাতে পাঠকের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আমি ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’-কে অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কাব্যগ্রন্থটির লেখাগুলি পাঠ করলে পাঠক অনুভব করবেন কবিতাগুলির অনুরণন। লেখকের মতের বিরুদ্ধে কথা বলছি অথচ দেখুন লেখকবাউল কাঁধে গেরুয়া ঝোলা নিয়ে কোন অজানায় পাড়ি দিয়েছেন! পেছন ফিরে দেখছেন না একটিবারও! কী অদ্ভুত, না!

Categories
amitava_smritikotha

দেবাশিস সাহা

আন্তরিক, আন্তর্জাতিক অমিতাভদা ছিলেন আত্মার আত্মীয়

যখন অমিতাভ মৈত্র পড়লাম, জানলাম। তখন আমার গর্ব হল এবং আনন্দ হল। অমিতাভ মৈত্র একজন আন্তর্জাতিক মানের ও মাপের কবি ও গদ্যকার। আমি গর্বিত। এই কবির সঙ্গে এক শহরেই থাকি।

২০০২ সালে বহরমপুর আসার পর দু-চারটে সাহিত্য অনুষ্ঠানে আলাপ-পরিচয়। ঘনিষ্ঠতা শুরু কবি সুশীল ভৌমিক-এর বাড়িতে। সুশীলদা ও অমিতাভদার সম্পর্ক অনেক গাঢ় ও আন্তরিক ছিল। আমি দু-জনের কাছাকাছি থাকার সুবাদে টের পেয়েছিলাম। সেই কারণে দু-জনের কবিতার রহস্যময়তা ছিল যাপনের অংশ।

অমিতাভদা সরকারি আধিকারিক হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার ছোটো-বড়ো নানা শহরে চাকরি করেছেন। সেখানের কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক বলয়। অমিতাভদা ছিলেন ভীষণ আন্তরিক। অনুজ ও অগ্রজের বই কিনে সংগ্রহ করতেন,পড়তেন এবং মতামত দিতেন। আমার কবিতার বই, ‘দেখা শেখার ইস্কুল’ কিনে নিয়ে প্রতিটি কবিতার পাশে পেনসিল দিয়ে মন্তব্য, পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখে আমাকে উপহার দিলেন। আমি অবাক। চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে দেখছি এক ঋজু মেরুদণ্ড নিয়ে একজন ভালোবাসার মানুষ আমার কাঁধে হাতে দিয়ে এগিয়ে দিচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের সবুজ উঠোনের দিকে। বইটি খুলে দেখে আমি তাজ্জব। প্রতিটি পাতায় আমার কবিতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ যা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে।

২০১২। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেন। মাঝে মাঝে দেখা হত। দেখা হত কখনও প্রেসে, কখনও চায়ের দোকানে কখনও বা সাহিত্যের কোনো অনুষ্ঠানে। দেখা হলেই কথা হত, আডডা হত কবিতা নিয়ে। অমিতাভদা বলতেন, কবিতা লেখায় আত্মবিস্মৃত হতে হবে। নিজের অবস্থান, কাল-পাত্র সব দূরে সরিয়ে লিখতে হবে।

অমিতাভদার কবিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন মনে উঁকি দিত। জিজ্ঞেস করতাম। পিঠে একটা টোকা দিয়ে বলতেন, ও-সব ছাইপাঁশ লিখি, ওগুলো কি কবিতা হয়? তোমরা পড়ো?

নিজের কবিতায় অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, প্রশ্ন রেখে দিতেন। যেন নিজের দিকে আঙুল রেখে কোশ্চেনগুলো করতেন। হেনরি, ক্রিস্টোফার, ম্যাডাম এম নিজেরই অংশ। কবিতা যে অনুভূতির তা বারবার টের পেতাম। পাঠকের ভাবনার জন্য রেখে দিতেন এক সমুদ্র আকাশ। প্রচুর পরিমাণে আন্তর্জাতিক লেখকদের বইপত্র সংগ্রহ করতেন এবং পড়াশোনা করতেন। তার ফসল আমরা পেতাম অমিতাভদার গদ্য ও কবিতায়।

বই কেনা ও পড়া ছিল অমিতাভদার নেশা। আমাদের সম্পাদিত পত্রিকা ছাপাখানার গলির সঙ্গে অমিতাভদার সম্পর্ক ছিল একদম প্রথম থেকেই। স্টল থেকেই নিজে সংগ্রহ করতেন প্রতিটি সংখ্যা। মতামত দিয়ে আমাদের উৎসাহ দিতেন। ২০০৭ সালে ছাপাখানার গলির বিষয় ছিল, এই মুহূর্তে যে-বই পড়ছেন সেই বই নিয়েই লিখুন, স্বভাবতই অমিতাভদাকে বলতেই এককথায় রাজি।
সেই সময়ে উঠে আসছে এক ঝাঁক তরুণ কবি। তার মধ্যে অন্যতম অনুপম মুখোপাধ্যায়। অনুজদের লেখাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়তেন। সেই সংখ্যায় অনুপমের হাইওয়ে নিয়ে লিখলেন এক অসামান্য গদ্য। আমাদের কাগজ সমৃদ্ধ হল। পাঠক সমৃদ্ধ হল।

২০১৫ সালে নাটক সংখ্যায় অমিতাভদা আলোচনা করলেন, Samuel Beckett-এর Waiting for Godot. কী বলব! এক অসাধারণ আলোচনা পাতার পর পাতা জুড়ে। এই সমস্ত লেখা আরও পাঠকের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন।

পরের বছর কাব্যগ্রন্থ আলোচনা সংখ্যায় অমিতাভদা নিজেই নির্বাচন করলেন উল্লেখযোগ্য চারজন কবির চারটি কাব্যগ্রন্থ।
১. নির্বাচিত কবিতা প্রয়াস– অমিতাভ গুপ্ত
২. তাঁবু মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ– সুধীর দত্ত
৩. সম্মোহন পাঠের পিছনে– সমরেন্দ্র দাস
৪. নির্বাচিত কবিতা– নাসের হোসেন

নিজের সংগ্রহ থেকে নিজ উদ্যোগে বইগুলো আলোচনা করলেন। সেই আলোচনায় আমরা ঋদ্ধ হলাম।

Jose Saramago-র Cain উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করলেন আমাদের উপন্যাস আলোচনা সংখ্যায়। এই আলোচনা ভীষণ উচ্চমার্গের। আপামর পাঠকের জন্য অমিতাভ মৈত্র নয়। যে-পাঠক পড়াশোনা করে, অনুসন্ধিৎসু। তাঁদের জন্য অমিতাভদার আলোচনা যেন তৈরি হয়ে থাকে। এইসব আলোচনা সংকলিত হওয়া জরুরি। অমিতাভদা নিজে বই কিনে নিতেন অথচ দেখা হলেই নিজের প্রকাশিত বই লিখে দিতেন, ‘দেবাশিস আমার আত্মার অংশ।’

অমিতাভদা ছিলেন আমাদের আত্মার আত্মীয়। আজ আমরা আত্মীয়হীন, অভিভাবকহীন। এমন আন্তরিক, আন্তর্জাতিক মাপের, মানের মানুষ ও লেখককে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। অমিতাভদার সৃষ্টিকে সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। এই ব্রতে আমিও পাশে আছি।

Categories
amitava_smritikotha

অনুপম মুখোপাধ্যায়

অমিতাভদা ছিলেন বাংলা কবিতায় এক সংক্রামক ব্যাধি

আমি জীবনে প্রত্যক্ষভাবে একজন কবির সঙ্গেই মিশেছি। একজন কবির সঙ্গেই মুখোমুখি বসে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি। আড্ডা অর্থে পরচর্চা পরনিন্দা নয়। ‘আগন্তুক’ ছবির সেই ভূপর্যটকের ভাষায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের আড্ডা, কথোপকথন। তিনি কবি অমিতাভ মৈত্র। তিনি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ঘাটাল শহরে এসডিও হয়ে এসেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়, মাধ্যম ছিলেন ‘কবিতাপাক্ষিক’ পত্রিকার প্রাণপুরুষ প্রভাত চৌধুরী। আমি প্রভাত চৌধুরীর কাছে অনেক কারণেই কৃতজ্ঞ। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হল তিনি আমার সঙ্গে অমিতাভ মৈত্রের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময়টায় আমি সবেমাত্র কবিতা ছাপতে দেওয়া শুরু করেছি। শুধুমাত্র ‘কবিতাপাক্ষিক’-এই ছাপতে দিতাম। সেই সময়টায় আমার পায়ের তলায় কোনো মাটি ছিল না। সেই সময়টায় আমার শহরে এবং আমার জীবনে অমিতাভ মৈত্রের এসে পড়াটা দৈবপ্রেরিত ছিল বলে আমার মনে হয়।

রোজ সন্ধ্যায় আমাদের কথা হত। যদি না কোনো প্রশাসনিক কাজে উনি অনুপস্থিত থাকতেন। কখনও বাইরে থাকত গ্রীষ্মের গুমোট হাওয়া, কখনও শীতের তীক্ষ্ণ বাতাস, কখনও বর্ষার জলধারা। উনি থাকতেন শিলাবতী নদীর ধারে লম্বা লম্বা গাছে ঘেরা একটা ব্রিটিশ আমলের বাংলোয়। সেটার ভূতুড়ে হিসাবে খ্যাতি আছে। অমিতাভদা বলতেন রাত গভীর হলে ছাদ থেকে কাঁধের উপর কোমল পায়ের স্পর্শ নেমে আসে। অমিতাভদাকে একটা ধারালো ছুরির মতো মনে হত। স্পর্শ করলে হাত কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আশ্চর্য মেধাবী একজন মানুষ। এবং আশ্চর্যরকমের উৎসুক ও তৃষ্ণার্ত। ওঁকে দেখলে মনে হত কোনো এক জলের নেশায় ছটফট করছেন। সেই জল কবিতার হতে পারে। গদ্যের হতে পারে। কিন্তু সেই জল অবশ্যই খুব উঁচু ও দুর্গম কোনো পর্বতের চূড়া বা খুবই গহীন ও বিপজ্জনক উপত্যকার খাঁজে রাখা আছে। কোনো বাঙালির চোখে আমি অমন তৃষ্ণা দেখিনি।
অমিতাভদা যে-কবিতা লিখেছেন তার তুলনা বাংলা কবিতায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ওঁর কবিতার কোনো পূর্বপুরুষ কি আছেন? সুশীল ভৌমিক আর ভাস্কর চক্রবর্তীকে কি ওঁর কবিতার সূত্রে কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? ওঁদের কবিতার উত্তরাধিকার কি আছে অমিতাভদার লেখায়? সম্ভবত আছে। কিন্তু সেভাবেই আছে, যেভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের শরীরে আছে আমার বা আপনার জেনেটিক কোড। উনি এক একক উপস্থিতি বাংলা কবিতায়। এবং বাংলা গদ্যেও। গদ্য আর কবিতাকে কোথায় একই রাখবেন আর কোথায় আলাদা করবেন এই নিয়ে বাংলার চিন্তকরা যখন কাতর, কোথায় যে অমিতাভ মৈত্র মিলিয়ে দিয়ে গেলেন গদ্য আর কবিতাকে তাঁর অদ্ভুত লেখালেখিতে! যেন তিমিমাছ শ্বাস নিতে ভেসে উঠল, আর তার ফোয়ারায় আপনি দেখতে পেলেন কবিতার রামধনু। লেখার পৃথিবীতে গদ্য আর পদ্য যে একই ঘটনা, তার চরম উদাহরণ অমিতাভ মৈত্র।

এই সময়ে দাঁড়িয়ে অমিতাভ মৈত্র পুরোপুরি আন্তর্জাতিক লেখালেখি করেছেন। লেখার জায়গায় ওঁর নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ের তুলনা হয় না। ‘টোটেম ভোজ’ নামক কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতার অহংকার হয়ে থাকবে। শুধু কি তাই? ‘সিআরপিসি ভাষ্য’? ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’? ‘পিয়ানোর সামনে বিকেল’? ‘মৃতরেখা’? উনি আজীবন একটাই কবিতাকে যেন হাজারভাবে লিখেছেন, আর সেই হাজার কবিতার প্রত্যেকটা সত্য হয়ে আছে ওঁর ইচ্ছাকৃত হ্যালুসিনেশনে। বিভ্রমকে যে এত বড়ো শক্তি বানিয়ে নেওয়া যায়, অমিতাভ মৈত্র ছাড়া আর কে পেরেছেন বিশ্বের কবিতায়? আর কিছু অদ্ভুত গদ্য, যেগুলো ওঁর কবিতারই বিকল্প রূপ, যা কেবল উনিই লিখতে পারতেন। হয়ত আর কারও কবিতা নিয়েই কথা বলার সময় দস্তয়েভস্কি বা বর্হেস বা কাহলিল জিব্রানের নাম এসে পড়ে না। উনি অনায়াসে পারতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান নিয়ে কথা বলতে বলতেই সালভাদর দালির ছবির প্রসঙ্গে চলে যেতে। সম্পূর্ণ অ-সম্পর্কিত দুটো ব্যাপারকে মিলিয়ে দিয়ে কী যে আনন্দ পেতেন উনি! ওঁর গদ্যের মধ্যে এই খেলাটা দারুণভাবে আছে। আর আছে কোনোকিছুকে তার নির্দিষ্ট পরিচয় থেকে ছিনিয়ে আনার ম্যাজিক। একটা পেপারওয়েটকেও উনি নিছক একটা কাগজচাপা হিসাবে দেখে স্বস্তি পেতেন না, যতক্ষণ না সেটাকে একটা উল্কার টুকরো বানিয়ে দিচ্ছেন নিজের ভাষা দিয়ে।

আর আছেন অনেক কবি যাঁরা বিভিন্ন সময়ে ওঁর কবিতায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের সম্পর্কে কথা বলার সময় ওঁর চোখে দেখেছি করুণার ঘোর। তাঁরা কেউ কেউ নারী। একজন পুরুষের কাব্যভাষায় নারীদের আচ্ছন্ন হতে আমি কদাচিৎ দেখেছি। অমিতাভ মৈত্র সেটা ঘটাতে পেরেছিলেন। তাঁর ভাষার মধ্যে এক দুর্নিবার সেক্স অ্যাপিল আছে, কিছুটা আজগুবি ও হাস্যকর হলেও এই উক্তি আমি করতে চাই। আর হ্যাঁ, খুবই অপ্রিয় ভঙ্গিতে বলতে চাই, অমিতাভদা ছিলেন বাংলা কবিতায় এক সংক্রামক ব্যাধি। হ্যাঁ, ব্যাধি। অনেক কবিই ওঁর কবিতার ভাষায় আক্রান্ত হয়েছেন। ধ্বংস হয়েছেন। বেরোতে পারেননি। ওই ভাষাও বাংলা কবিতায় এক দুর্ঘটনা। বাংলা কবিতার জল-আলো-বাতাসের সঙ্গে তার লেনদেন একজন বিদেশির। বাংলা কবিতার ইতিহাসে আর ভূগোলে অমিতাভ মৈত্রর হয়তো কোনো আত্মীয় নেই। কিন্তু থেকে গেছে একটা আক্রান্ত কবিদের মিছিল। সৌভাগ্যক্রমে, হয়তো ওঁর খুব কাছাকাছি যাওয়ার ফলেই, আমি ভ্যাকসিনেটেড হয়ে গিয়েছিলাম।

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

অমিতজ্যোতি সেনগুপ্ত

একজন দক্ষ প্রশাসক এবং একজন রুচিশীল সাহিত্যিক

গত ২২-শে ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন অমিতাভ মৈত্র। সাহিত্য জগতের বিরাট ক্ষতি তো হলই, আমি হারালাম আমার এক বন্ধু ও প্রাক্তন সহকর্মীকে। একই সার্ভিসের সহকর্মী হওয়াতে, আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের প্রায় ১৭০০ আধিকারিকের ডব্লিউ বি সি এস (এক্সিকিউটিভ) ক্যাডারের সবার মধ্যেই একটা অদৃশ্য যোগাযোগ সবসময়ই থাকে। তাই ওঁর সাথে ২০০৭ সালে রায়গঞ্জে সাক্ষাৎ হওয়ার আগেই ওঁর বিষয়ে অনেক সংবাদই আমার জানা ছিল। ওঁর জলপাইগুড়ি এবং পরে ঘাটাল মহকুমার মহকুমাশাসক হিসেবে প্রশাসনিক দক্ষতা আমাদের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। বিশেষ করে ঘাটাল মহকুমার প্রচণ্ড বন্যা পরিস্থিতি উনি যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় সামলেছেন তাতে উনি রাজ্য সরকার এবং সার্ভিসের সম্পদ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন।

অমিতাভদার সরকারি কর্মজীবন আরম্ভ হয় ভূমি-সংস্কার দপ্তরের আধিকারিক পদে। ১৯৮৩ সালে রাজ্য সরকার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মরত আধিকারিকদের মধ্য থেকে ডব্লিউ বি সি এস (এক্সিকিউটিভ) অফিসার চয়ন করার জন্য একটি বিশেষ পরীক্ষা নেন এবং সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উনি সার্ভিসে যোগ দেন ১৯৮৬ সালে। প্রশাসনে ভূমি ও ভূমি-সংস্কার দপ্তরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আছে কারণ প্রত্যেক দপ্তরেরই উন্নয়নের স্বার্থে ভূমির প্রয়োজন। চাকরির শুরুতেই সেই দপ্তরের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজে নামায় ওঁর কর্মদক্ষতা সবসময়ই প্রশ্নাতীত ছিল।

অমিতাভ মৈত্রর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ২০০৭ সালে, আমি যখন উত্তর দিনাজপুর জেলা গ্রাম উন্নয়ন সেলের প্রকল্প নির্দেশক পদে যোগ দি। উনি তখন জেলা ভূমি ও ভূমি-সংস্কার আধিকারিক পদে আসীন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং ভূমি-সংক্রান্ত অনেক জটিল সমস্যার সমাধান অধস্তন পর্যায়ে সম্ভব না হওয়ায়, সেগুলো সমাধানের দায়িত্ব এই পদের ওপর বর্তায়। এছাড়াও ছিল অতি সংবেদনশীল ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়। অমিতাভদাকে দেখেছি খুব নিপুণভাবে আইনের বিশ্লেষণ করে এবং একই সঙ্গে যথাসম্ভব মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সব সমস্যাকেই গ্রহণযোগ্য সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে। এ-কথা সর্ববিদিত যে নিরপেক্ষ সরকারি সিদ্ধান্ত সবার পছন্দের না-ও হতে পারে। অনেক সময়ই বিভিন্ন ধরনের চাপ এসেছে সিদ্ধান্ত পাল্টাবার জন্য, কিন্তু ওঁর মতো একজন স্পষ্টবক্তা এবং ধীর স্থির আধিকারিকের পক্ষে ওইসব চাপকে নস্যাৎ করে দেওয়া একেবারেই কঠিন ছিল না। তা সত্ত্বেও ক্ষমতাশালীর আঘাত নেমে আসতে দেখেছি, দেখেছি ওদের নতজানু হয়ে ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমাশীল অমিতাভ মৈত্রর সব ভুলে পরিতাপীকে ক্ষমা করে দেওয়া। ওঁর চরিত্রের এই দিক ওঁর শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা ক্রমশই বর্ধমান রাখত।

এক বছরের কিছু বেশি উত্তর দিনাজপুরে থাকার পর আমি বদলি হলাম নদিয়ার জেলা ভূমি ও ভূমি-সংস্কার আধিকারিকের পদে। তার কিছুদিন পরেই অমিতাভ মৈত্রও নদিয়া চলে এলেন জেলা পরিষদের অতিরিক্ত নির্বাহী আধিকারিক হয়ে। আবার কিছুদিন এক জেলায় কাজ করলাম আমরা। রাজ্যের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরের অতিরিক্ত নির্বাহী আধিকারিককে কার্যত নির্বাহী আধিকারিকের সম্পূর্ণ দায়িত্বই সামলাতে হয় কারণ নির্বাহী আধিকারিক অর্থাৎ জেলাশাসকের ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যে জেলা পরিষদে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করা সম্ভব হয় না। একারণেই অতিরিক্ত নির্বাহী আধিকারিক পদের প্রণয়ন। এই ভূমিকায়ও সম্পূর্ণ সফল অমিতাভ মৈত্র। শাসক ও বিরোধী দলগুলোর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরকারি আইন বুঝিয়ে জেলাকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে ওঁর কোনো অসুবিধাই হয়নি। আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, স্পষ্টবক্তা এবং ধৈর্যশীল আধিকারিক হওয়াতে ওঁর কাজ উনি নিজেই খুব সহজ করে নিয়েছিলেন।

সময়ের প্রভাবে আমরা দু-জনেই জেলা থেকে বদলি হয়ে রাজ্য সরকারের মহাকরণের বিভিন্ন দপ্তরে যোগদান করলাম, প্রথমে উপসচিব এবং পরে যুগ্মসচিবের পদে। যুগ্মসচিব থাকাকালীনই অমিতাভ মৈত্র সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে সাহিত্যের প্রতি সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করলেন খুবই আনন্দের সাথে। উনি প্রায়ই বলতেন সরকারি আধিকারিকের সাহিত্যচর্চা হচ্ছে বিগ ব্রাদারের নজরদারিতে নিজেকে প্রকাশিত করা। লেখার সময় সতর্ক থাকতে হয় যা লিখছি তা ন্যায্য কথা হলেও কোনো সরকারি নিয়মকে আঘাত করছে না তো! আসল প্রতিভার প্রতিভাস হয় আধিকারিকের সঙ্গে বাধানিষেধরাও অবসর গ্রহণ করলে।

অমিতাভ মৈত্র সময়ের আগেই চলে গেলেন, কিন্তু ছাপ রেখে গেলেন একজন দক্ষ প্রশাসক এবং একজন রুচিশীল সাহিত্যিকের। ভালো থাকুন অমিতাভ মৈত্র।

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

কমলকুমার দত্ত

একটি বিস্ময়চিহ্ন

‘সেই আমিই জাহাজ, যার পায়ে কোথাও ছোট্ট আঘাত আছে/ নোঙর করা বারণ, তবু মাটি মাঝে মাঝেই ধরে ফেলে আমাকে/ তখন কর্পূর ছড়িয়ে এড়িয়ে যাই, আকাশে মুখ তুলে এড়িয়ে যাই/ নোঙর করা বারণ, কারণ পায়ে কোথাও ছোট্ট আঘাত আছে’

লেখার নাম ‘ আঘাত’। কোথাও ছোট্ট আঘাত আছে। এই আহত মানুষটার সঙ্গে কম করেও বাইশ-তেইশ বছর আগে পরিচয় হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল মানুষটা আহত। বাইশ-তেইশ বছর পরেও তা-ই মনে হয়।

প্রথম পরিচয়ের পর মাঝে মাঝে রাতে ফোন করতেন। তখন তিনি জীবিকাসূত্রে ঘাটালের এস-ডি-ও। বলতেন সেইসব দিনগুলির কথা যখন তাঁকে মৃত্যুপথযাত্রীদের জবানবন্দি নিতে হতো, মৃতদেহের কাটাছেঁড়ার সাক্ষ্য লিখে রাখতে হতো। আর বলতেন ভিনদেশি কবি, চিত্রকরদের কথা। শুনতে শুনতে মনে হতো মগ্নস্বরে যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন সেসব। আজ তাঁর লেখাগুলি যখন পড়ি তখন একই অনুভূতি হয়।

সামনাসামনি যখনই দেখা হয়েছে, মনে হতো মানুষটা লুকিয়ে পড়তে চাইছে। কথা বলছে, কিছু বলতে হয় তাই। ভদ্রতাবশত।

হ্যাঁ, আমাদের কাগজে, তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে, প্রায় প্রতি সংখ্যায় লেখা চাইলেই দিয়েছেন— কবিতা চাইলে কবিতা, গদ্য চাইলে গদ্য। দেওয়ার সময় প্রতিবার বলতেন, কিছু হয়নি, দেখুন ছাপবেন কি না। তাঁকে নিয়ে সংখ্যা করবো শুনে অবাক হয়ে বলেছিলেন— আমাকে নিয়ে! না না, ওসব করবেন না। অনেক বুঝিয়ে রাজি তো করালাম, তারপর দেখি সহযোগিতা করছেন না। অনেক কষ্টে সংখ্যাটা করা গিয়েছিল। সংখ্যাটি বেরনোর পর কিছুতেই পাঁচটা কপি দিতে সফল হইনি, জোর করে কিনে নিয়েছিলেন। ব্যস, ওই পর্যন্তই, তারপর সংখ্যাটা নিয়ে একটি কথাও বলেননি, কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেননি। না, ভুল বললাম, দু-তিনবার অপরাধীস্বরে জানতে চেয়েছিলেন যে বিক্রি থেকে খরচাটা উঠে এসেছে কি না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে কবিতার আলোচনা করি না বা পড়ি না। কবিতার কোনো আলোচনা সম্ভব বলেই বিশ্বাস করি (কবিতার কোনো আলোচনা সম্ভব বলেই বিশ্বাস করি) না। তবে অন্য কবির কবিতা নিয়ে অমিতাভ মৈত্রের লেখা আগ্রহ নিয়ে পড়ি। তিনি কখনো কবিতার ‘আলোচনা’ করেননি, আমি তাঁকে সেইসব কবিতার মধ্যে মগ্নচৈতন্যস্বরূপ দেখতে পাই। অন্য কবির একটা পাঁচ-সাত পংক্তির কবিতা কীভাবে তাঁর নিজের অস্তিত্বের অংশ হয়ে উঠছে তা দেখে বার বার শিহরিত, বিস্মিত হয়েছি। তিনি লিখেছেন, ‘কবিতায় প্রতিটি শব্দ দাঁত চেপে থমথম করে তার পাশের শব্দটির ছিটকে যাওযার চরম সময়টির জন্য। যিনি শব্দের এই বুনো আক্রমণাত্মক মুখ দেখেছেন তিনিই কবি, শব্দের মেডিসিনম্যান।… যখন কবি লিখছেন, ‘কিছু শব্দের এই দ্বিতীয় জীবন তখন তিনি টের পান। কবির নিজের দ্বিতীয় জীবন নেই’। আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘কবিতার শব্দকে হতে হবে আ্যলজাইমার রোগীর মতো আত্ম-অর্থ-বিস্মৃত’।

বাংলা কবিতার জগতে অমিতাভ মৈত্র এসে পড়েছেন মূর্তিমান উপদ্রবের মতো। তাঁকে অস্বীকার করা যায় না, তকে স্বীকার করলে বাংলা কবিতাক বড়ো একটা অংশকে ছেড়ে আসতে হয় ।

আমি মনে করি তকে গ্রহণ করতে হলে পাঠককে অনেক পাঠসংস্কার ত্যাগ করে এগিয়ে আসতে হবে, কেন না এই কবি আমাদের কাছে অনেকটা আগে এসে পড়েছেন। বাংলা কবিতার ইতিহাস বহুকাল পরে পরে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়।

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

প্রশান্ত গুহমজুমদার

কিছু কথা, কিছু অন্বেষণ

কিছু কথা ছিল। কিছু কাজও। কাজটার কথাই আগে বলি। তোর সদ্য প্রকাশিত প্রবন্ধের বইটা নিতে হত। আর আমার নতুন কবিতার বই শিখা আর তোকে। আর কিছু নতুন লেখা শোনার। শোনানোর। আর তোর করা স্কেচগুলো দেখার। শিখাকে একবার বলতে হত, আমাদের ঘরে আরও একবার আসার। আর নাতনির ছবি-সব দেখার। ও কি আমাদের সেই ছোট্ট জবার মতোই মিষ্টি হয়েছে? আর আমাদের নিজস্ব কথা? সে-ও তো বিস্তর। হবে কখনও? তুই তো আমাকে ব্লক করে দিলি! তা-ও বলছিস হবে! তাহলে হোক।

প্রদীপ। অমিতাভ মৈত্র। আমি প্রশান্ত। ৬৫ বছর আগে যোগাযোগ। দু-জনেরই ৬। আজ আমার ৭১+। তুই আচমকা চলে না গেলে তোরও তাই হত। হল না। সময় হতে দিল না। বেঁচে থাকতে থাকতে, কথা বলতে বলতে, মুখোশ পড়তে পড়তে, অভিনয় করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায়। হোমো স্যাপিয়েন্স-এর এমন হয়। আমারও হয়, হয়েছিল, হয়েছে। এই পৃথিবীতে থাকলে এমনটা আমার হতেই থাকবে। কিন্তু তোর সঙ্গেও কি তেমন আমার কখনও ঘটেছে? তবে কি আমরা, দু-জন যখন একলা, ঠিকঠাক মনিষ্যিই ছিলাম না! কিন্তু এখন কীভাবে এই ৬৫ বছর, আবাল্য বন্ধু হিসেবে, তোকে ফিরে দেখব! লেন্সের কায়দাটাই তো জানা নেই! তোর বদলে আমি গেলে, তোকেও হয়তো এমন লিখতে হত। কিন্তু এখন তোর কথা বলতে বসে আমার কথাই যদি বলে বসি! সে কি উচিত হবে? কোনো কালক্রমও হয়তো থাকবে না। যেমন, তুই আমার বাড়িতে আসার কিংবা তোর বাড়িতে আমার যাওয়ার। গেলেই মেসোমশাই বাইরের লাল ধাপিটায় বসে বসেই বলতেন, যাও, প্রদীপ উপরে আছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, তুই তো ছিলি আমারই একটা অংশ। অথবা আমি তোর। তাহলে! খুবই সঙ্কটের বিষয়। তাই বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম, তোর মেধার কথা, কলমের কথা, তুলির কথা, একজন মনস্ক অতুল মেধাসম্পন্ন পাঠকের কথা আমি বলবই না। এসব বিষয়ে বহু বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক, যোগ্য কবি, প্রতিষ্ঠিত শিল্পী রয়েছেন, তাঁরা বলবেন। সেটাই যথোচিত হবে, কিছু উজ্জ্বল কাজ হবে। এইসব বাদ দিয়ে কতটা কী বলতে পারব, জানি না। তবু, প্রদীপ আয়, দু-জনে মিলে যতটা পারি, পুরোনো দিনগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি।

তোর মনে আছে স্কুল থেকে ফিরে আমাদের বাড়িতে লোহার জালের ওপারে দাঁড়িয়ে সেই হরিণ, চিনে মুরগী, রাজহাঁস দেখার কথা? মনে আছে, না! থাকবেই তো। স্মৃতিশক্তি তোর বরাবরই প্রখর।

আচ্ছা তোর মনে আছে দুপুরে তোদের ছাদে বসে তোর লেখা ইংরেজি কবিতা শোনানোর কথা আর ইতিউতি মেয়ে দেখা? দুটোই ছিল আমাদের কাছে প্রবল বিস্ময়কর। কৈশোর তো সবে পেরিয়েছি! সেই তখন একটা ইংরেজি প্যারাগ্রাফ ঠিকঠাক লিখতে পারি না, আর তুই কিনা সেই ভাষায় কবিতা লিখছিস! সেসব তো আর রাখিসনি, তাই না? কেন! পিছনের বিরাট পুকুরটার মতোই সে-লেখা সব কোথায় হারিয়ে গেল! যেমন হারিয়ে গিয়েছে ‘শীতের প্রতি’ কবিতাটা। আমার এই লেখাটার কথা তুই বারবার বলতিস। কেন, কে জানে!

মহালয়ার ভোরবেলা ভাগীরথীর পাড়ে সূর্য উঠছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র থেমে গেছেন। মৃদু কুয়াশা ভেঙে ক্রমে ফর্সা হচ্ছে। আর আমরা দু-জন জল শুনছি, দেখছি। পিছনে কৃষ্ণনাথ কলেজ। আমাদের কলেজ। আমাদের সামান্য সামান্য দাড়ি-গোঁফ। কথা বলছি না কেউ। আমি বলছি না সেই চমৎকার নারীর কথা, তুইও সেই যুবতীর নয়। ঘোলা স্রোত দেখছিলাম কেবল। আরও কিছু কি?

আজ উল্টোপাল্টা কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে। ঐ রানিবাগানের মাঠ। ক্রিকেট। তোর ঐ লিকলিকে শরীর নিয়ে অনেকটা পাল্লা নিয়ে বাঁ-হাতে দুরন্ত ইন্সুইঙ্গার! কী করে করতিস রে! তবু করিমপুরে ঐ বল একবার মাঠের বাইরে পাঠিয়েছিলাম। পাওয়া যায়নি আর। ক্যাচ ধরতে গিয়ে দুই ফিল্ডারে ধাক্কা লেগে মাঠের বাইরে। আর আমাদের কী উদ্বেগ। ছেলেদুটো ভালো আছে তো!

ধোপঘাটির মাঠে সন্ধ্যা হচ্ছে। আমরা কয়েকজন। তুমুল মতান্তর। বাম-ডান-অতিবাম রাজনৈতিক কাজকম্ম নিয়ে। তুই কিন্তু চুপ। অনেক পরে একদিন বলেছিলি, এইসব পার্টির রাজনৈতিক কাজকম্ম তুই ঠিক বিশ্বাস করতে পারিস না। আমি হেসেছিলাম। খুব নির্বিবাদী মানুষ ছিলি তো। ঐসব খেয়োখেয়ি তোর অসহ্য মনে হত। একদিন রাত ফুরিয়ে আসছে। দেয়াললিখন শেষে ঘরে ফিরছি। তোর সঙ্গে দেখা। এত ভোরে তুই উঠতিস না। সেদিন তবু দেখা হল। বলেছিলি, বাড়ি যা। মাসিমা ভাবছেন হয়তো। আর কোনোদিন এমন যেন না দেখি। আমি ফিরে এসেছিলাম। আর কোনোদিন রাত জাগা হয়নি আমার। তোর মুখটা মনে পড়ে যেত।

সেদিন হঠাৎ সুশীলদার একটা চিঠি পেলাম। একজনের হাত দিয়ে। তারপর উনি কলকাতা না কোথায় যেন চলে গেছেন। বেশ কয়েক পাতার। ছোটো ছোটো হাতের লেখায় অনেক কথা। আমাকে খুব গালিয়েছেন। কয়েকটি কবিতা। কোনো পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে। পড়তে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। হঠাৎ দেখলাম, সেই ক্ষুদে ক্ষুদে লেখা-সব ঝকঝকে প্রিন্ট করা একটা চিঠি হয়ে গ্যাছে। বিদেশী কিছু কবিদের কথা আছে। পড়তে পড়তেই আমরা হাঁটছিলাম। সুশীলদার বাড়ি। উনি যাননি কোথাও। ওখানেই রাত্রে আমাদের দাওয়াত। তুই বলছিলি, নিজের লেখা নিয়ে সুশীলদা নিজেই খুব কনফিউজড্‌। আমি মাথা নেড়েছিলাম। যেমন মাথার উপরে একটা ছাদ নিয়ে ওঁর। আজীবন।

ছাড়িয়ে চলে এলাম। কবিতা আর ছবি নিয়ে তুই বলছিলি। সুনীল দাশ বলছিলি। কিন্তু এত গাড়ির শব্দ, কথা প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না। প্রস্তাব দিলি, চল উড়ে যাই। আমরা উড়তে থাকলাম। কবরখানা পেরিয়ে, পঞ্চাননতলা পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম। তুই তখন দালি আর বিনয় মজুমদারের কাজ নিয়ে বলছিলি। আমি ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত আর রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী। চাঁদ আকাশে ফেটে পড়ছিল। তোর উত্তেজিত চোখ আর তীক্ষ্ণ নাক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ম্যাডাম এম্‌-কে নিয়ে লেখা মুখে মুখে বলে যাচ্ছিলি তুই। তখনও সেসব প্রকাশিত নয়। কিন্তু অসাধারণ স্মৃতিশক্তি তোর। পাংচুয়েশন অবধি ঠিকঠাক। শরতের বাতাস আর অলৌকিক আলো তোকে ঘিরে আছে। আমরা কোথাও একটা সম্‌-এ নেমে আসছি। এবার তোর দালিকে নিয়ে মুগ্ধতা। শূন্যেই তুই একটা অভিজাত সিঁড়ি আর দালির বিশাল গোঁফজোড়া এঁকে ফেললি।

পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছি। তুই আর আমি। প্রায় এক শুঁড়িপথ দিয়ে হাঁটছি। মাথার উপরে টুপটাপ আর কী যেন, কী যেন! যেন এই পৃথিবীর কেউ নই আমরা আর। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা গুনগুন। কতটা পথ, জানা নেই। এক চন্দনকাঠের বোতামের অন্বেষণ কেবল। তবু সে-পথের মাঝে বিষণ্ণ একা বাইসন! আমাদের ঘোড়া নেই। কী ভীষণ ভাবাবরোহ! তুই পিছোচ্ছিস। আমিও। শেষ অবধি অন্ধকার। শেষ অবধি মৃত পাতার ভিতর থেকে তোকে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাইসন অন্য পথে। আমরা আরও এক বনের ভিতর। অর্কিড গাছে গাছে, অপেক্ষায়। গাভীর মতো না, গুরুতর মেঘ নেমে আসছে। স্বভাবেই অন্ধকার। সেই বোধ করি আমাদের প্রথম লৌকিক যাপন থেকে সরে যাওয়া। সত্তর কি এসেছে তখন!

প্রায় ভাঙাচোরা এক বাড়ির দোতলা। চিলেকোঠায় বসন্ত পূর্ণিমা এসেছে। সে সত্তরের মাঝামাঝি সময়। কাশিমবাজারের ঘরে ঘরে তখনও খুব শীত। আমাদের কিন্তু না। এক অষ্টাদশী যে তার সমস্ত সম্ভার নিয়ে গাইছে, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…! পাথরের মতো বসে আছি আমরা। কে আসবে! তাকে পরিচ্ছন্ন হতে হবে, প্রস্তুত হতে হবে! সে কি তোর জন্য, নাকি আমার! প্রবল এক টানাপোড়েন আর ঘোর নিয়ে ফিরেছিলাম আমরা। চাঁদ হেসে হেসে গড়িয়ে গড়িয়ে আমাদের প্রায়-কিশোর মাথা-বুক-পিঠ।

আমরা একটা যৌথ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছি। ‘প্রদীপের আলোয় প্রশান্ত’। পেপারব্যাক। ‘পান্ডুলিপি’ প্রকাশক। যেদিক দিয়ে খুশি, পড়া যায়। লেটার প্রেসে, তবু এতটুকু ভুল নেই! সে উত্তেজনা বোঝানো আমার কম্ম নয়।

বিসর্জনের রাত্রে বসে আছি ভাগীরথীর ধারে। বালি আর বাবলাবন। তখনও গঙ্গায় বালি। একটা, তারপর আরও একটা, ভেসে আসছে লাল-নীল প্রদীপ। কোন্‌ দক্ষিণ দুয়ার থেকে তারা আসছে! এরপর অজস্র। এরপর প্রতিমা। নৌকায়, নৌকায়। আমরা দেখছি লোকাচার, দেখছি প্রতিমার বিষণ্ণ মুখ, অশেষ বিশ্বাস, উৎসব আর ঢাকের বোল ‘আসছে বছর আবার হবে’।

এই-ই সব কিছু ছিল ষাট-সত্তরের আকাশে। সত্যিই ছিল! মাটিতে তো কেবল শোষণের, অপমানের নানান কায়দা ছলচাতুরি, চিরকুটে দুটো ভাতের সংস্থানের আশ্বাস, ঘৃণা, প্রতিবাদের মুখ আর দহনের গন্ধ, নির্বিশেষ রক্ত। আর লালদিঘি পেরিয়ে, স্কোয়ার ফিল্ড পাশে রেখে আমরা তখন চলে যেতে চাইছি সমান্তরাল দুটো রেলের দিকে, যেটা কোনো বাফারে গিয়ে শেষ হচ্ছে না। কোনো সীমান্ত চোখ পাকিয়ে থাকছে না। যেহেতু আমরাও ‘বাঁচতে চাই’।

মনে আছে তোর? কী করেই-বা থাকবে! এমন তো কিছু ঘটেইনি। কেবল এরকম ইচ্ছে করতাম আমরা। শহর, পারিপার্শ্বিক বেঁচে থাকা যখন আমাদের খুব ক্লান্ত করে দিত, আমাদের তখন এমন। পরে অবশ্য বিনয় মজুমদার নিয়ে চমৎকার কিছু শব্দ লিখেছিলি। আমি ভেবেছিলাম, ওরে ব্বাবা, এভাবেও তবে কবিতাকে ভাবা যায়।

তোকে এত বিশ্বাস করতাম কেন, বল তো! তোর মতামত আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রায় গাইডের। তুইও এটা বুঝতিস। বল, বুঝতিস না? আমার কথাও তুই শুনতিস। অরূপের সঙ্গে দিগন্ত, মিনি পত্রিকা রক্তপত্র। তুই সঙ্গে ছিলি। ইতিমধ্যে উৎপলদা ‘সময়’-এর আড্ডায় ডাকলেন। সেখানে তখন বহরমপুরের নক্ষত্র সমাবেশ। দিব্যেশদা (তোদের কী-রকম আত্মীয় হতেন), সুশীতদা, অরুণ ব্যানার্জি, মনীষী মোহন রায়, সুশীলদা, গোকুলেশ্বর ঘোষ, আরও অনেকে। কবিতা পড়া হচ্ছে, আলোচনা, মতামত, সে এক হইচই ব্যাপার। কত বাহবা! আমরা তখন কলেজ পেরিয়েছি। কত হবে! ১৯-২০। তুই কিন্তু সে-সময়েই কবিতাটা চমৎকার পড়তিস। গম্ভীর গলায়, ডান-হাতে কবিতার পাতা ধরে, বাঁ-হাতটা উঠিয়ে নামিয়ে।

বি টি পড়তে ভর্তি হলাম। তুই না। তুই কি সে-সময়ে টিউশনি করেছিলি! আমি করতাম। কারণ সে-সময়ে অভ্যন্তরীণ কলহে এবং আরও বহু হেতুতে আমাদের সবকিছু হয়ে গ্যাছে এইটুকু। গত্যন্তর ছিল না। বলেছিলি, অমুক পত্রিকায় কবিতা পাঠা। পাঠিয়েছি। বলেছিলি, ওই মেয়েটার কাছে আর যাবি না। যাইনি। বলেছিলাম, চল পম্পুর সঙ্গে চৌপর করি। সামান্য দ্বিধা ছিল, তবু এসেছিলি। বলেছিলি, বাবা রিটায়ার করবে। একটা হিল্লে হওয়া দরকার। সুতরাং নানান জায়গায় দরখাস্ত। সে-সময়েই চাকরির জন্য প্রিপারেশনের কথা বলেছিলাম। তুই শুনেছিলি। একসঙ্গে অঙ্ক শেখা, জেনারেল নলেজ, সংবিধান– কত কিছু। একদিন চাকরির পরীক্ষার এডমিট কার্ড। পেয়ে একসঙ্গেই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তাই তো দু-জনেই একসঙ্গে চাকরিতে। বলেছিলি, ইতি খুব ভালো মেয়ে। ওকে কখনও ঠকাস না। তারপর ৪৯ বছর তো হয়ে গেল। ইতির জন্যেই তো এখনও। আমার কথাও তুই শুনেছিলি। নানান বাধাবিপত্তি, সামাজিক টানাপোড়েন, শিখা আমাদের ঘরে এসে দুঃখ করত। তুইও। বলেছিলাম, শিখা তোকে ভালবাসে। তুই খুশি হয়েছিলি। শেষ অবধি ‘দুইটি হৃদয়ে একটি আসন’ ইত্যাদি।

তারপর তুই ক্রমশঃ অমিতাভ মৈত্র। নানান জায়গায়, নানান ভাবে। এই যে সিঁড়ি-সব, নিশ্চয়ই তুই ভুলে যাসনি। তাই বোধহয়, একদিন বলেছিলি, ‘এই ধুলো পায়ে ঘুরে বেড়ানোর দাগ তেমন কাজে আসে না হয়তো। হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, জলে মুছে যায়। তবু এই ঘুরে বেড়ানোর ভেতর দিয়েই কোথাও অনুভূতির এক গূঢ় পৃথিবী আস্তে আস্তে খুলে যেতে থাকে।’ তুই আত্মার আশ্রয় খুঁজেছিলি। তাই এক ‘নির্জনতম নিবিড়তম আনন্দ’-এর খোঁজ আমি পেয়ে যাই তোর থুড়ি অমিতাভ মৈত্র রচিত বহু কবিতা আর মুক্তগদ্যে। একইসাথে দেখি, ‘মানুষ সরে এসেছে আলো অন্ধকারময় সেই মায়া পৃথিবী থেকে’, ‘অনেক ভেতর পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানুষ যোগাযোগের ভাষা হারিয়ে, অস্তিত্বের নিঃস্বতার ধারণাটুকু নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে।’

এই কথা, এই প্রায় অপার্থিব স্মৃতিকথন সম্ভবত অধিকাংশই বাহুল্য বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। তথাপি স্পর্ধা করছি বলতে যে, তোর, আমার প্রদীপের, আমাদের অমিতাভ মৈত্রের অদ্যাবধি সৃষ্টিতে একদিন পাঠকের হৃদয় জেগে উঠবে; ভালোবাসায়, শ্লাঘায় একাত্ম হবেই।

আপাতত ভালো থাকিস। এখন তো আর শ্বাসকষ্টটা নেই? এখন আমার হচ্ছে। হবে, যতদিন না আবার…

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

উমাপদ কর

নির্বাণের কাছাকাছি অমিতাভ

“জলকে অনুরোধ করেছে তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য”— অমিতাভ মৈত্র

“পরস্পরকে হত্যা করে হেমন্তের মৌমাছিরা যা বলতে চায়
বরফের অভিশাপ সারাজীবন মাথায় নিয়ে
কোনও পাহাড় যা বলে
মুখভর্তি নকল দাঁত নিয়ে
চোখ নামিয়ে সেটাই আজ বলছে হেনরি—” (‘কৃত্রিম হেনরি’/ অংশ)

অমিতাভ মৈত্র (দ্বিতীয় এবং অদ্বিতীয়। যে-কেউ উপরোক্ত পংক্তিগুলি পড়ে বলে দেবেন। হ্যাঁ, এসব প্যারাডাইম শিফট করার পর উদ্ভাবন করা তাঁর এক নয়া ডিকশন, অমিতাভীয়। আলাদা করতে পারি না, হেনরি, অমিতাভ, বিস্মিত আমি আর এক্স-ওয়াই-জেডকে।

যন্ত্রণার চামড়া উঠিয়ে নিলে ত্বকের নীচে ঘুম ভেঙে যায়। ধূসর-সাদা। আরেকটু নীচে লোহিত কণিকার চলাচলের আভাস। বেদনাকে অপারেশন টেবিলে সার্জিক্যাল ছুরিতে চিরে দিলে খোলামুখ দু-ভাগ হয়ে সাদা ধবধবে। ভেতরের দেয়ালে বিন্দু বিন্দু ভেজা রক্তকণিকা। ভালোবাসায় ফোলানো ব্লাডারে কুঠার মারা হচ্ছে রোমশ হাতে। অথবা আঙুলডগা ব্লাডারটা ঘোরাচ্ছে ধীরে, পৃথিবী ঘোরানোর মতো। বার বার ব্যর্থ কুঠার একবার নিশ্চিত ব্লাডারটা দেবে ফাটিয়ে। আঙুলের নখ ঘূর্ণনে-ঘর্ষণে ফুটো করে দেবে। জেনে এসেছি, ভালোবাসা অপার, মৃত্যুহীন। কিন্তু এ-যে শেষবাতাস ছেড়ে নিঃসহায়। তাহলে ভালোবাসা কি…

এখান থেকেই এক বিপন্নতার শুরু আমার মধ্যে। মানে, আমি উমা, আমি অমিতাভ, আমি হেনরি বা আমি এক্স-ওয়াই-জেড। বিস্ময়ের সঙ্গে রহস্যকে নেড়েচেড়ে বিপন্ন বোধ করি। কোনোকিছুই গোটা নয়, ভাঙা-ভাঙা আর অগোছালো। আবার ক্যায়টিকও নয়। বিন্যাস আর অবিন্যাসের মধ্যে বিপন্নতা দুলতে দুলতে বিপন্নতর হয়ে ওঠে। বস্তুজগতের অভীপ্সাগুলোকে বাজিয়ে বিপন্ন বোধ করি। বিপরীতে এক কল্পপৃথিবী আছে আমাদের। হেনরি, অমিতাভ, এক্স-ওয়াই-জেডসহ আমার।

কল্পের সঙ্গে চলমানকে মেলাতে গিয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলে বিষণ্ণতা গ্রাস করত। আবার সবটা একদম মিলে গেলে উল্লসিত-জয়ী-তৃপ্ত আমরা হারিয়ে ফেলতাম বাহ্যজ্ঞান। তা হয় না। আশ্চর্যভাবে কিছুটা মেলে, আধো, আংশিক। স্পষ্ট, কাছে, ছোঁয়া যায়। আবার কোথায় উধাও। ধরা-অধরার মধ্যে পেন্ডুলাম আমরা। অভিসারী রশ্মিগুচ্ছ একবিন্দুতে মিলিত হওয়ার আগেই বিপন্নতার চূড়ান্তে নিয়ে অপসারী হয়ে যায়। হেনরি অমিতাভকে বলে— ‘দেখলে, দেখলে কাণ্ডখানা’? অমিতাভ এক্স-ওয়াই-জেডকে হেনরি বানায়। আমি, হেনরি ও অমিতাভ একই বিভবপ্রভেদের বৃত্তের মধ্যে বিপন্ন উজ্জ্বলতায় জ্বলতে থাকি।

আমার অস্তিত্বর ওপর আমারই চেতনার আলো ফেলে দেখি তার প্রতিফলিত ক্যারিশমা। অনস্তিত্ব সে কখনোই প্রতিষ্ঠা করেনি। কিন্তু আমি কি আছি? মানে আমি, অমিতাভ, হেনরি, এক্স-ওয়াই-জেড। পূর্ণতার বাসনায় অপূর্ণতা ঘুম হয়ে নামে। আমাদের কামনা রাগবি খেলতে নেমে, খেলে সাদামাঠা ফুটবল। আমাদের রাগ-দ্রোহ-দ্বেষ-অভিমান ঝংকার তুলতে গিয়েও বাজিয়ে ফেলে আলাপ।

দৃশ্যাতিদৃশ্যের সঙ্গে সবসময় কোনো সম্পৃক্ততা অনুভব করি না। সমমেলে বেজেও উঠি কোনো ফ্রেগ্র্যান্স অফ কালার-এ। অতলান্ত স্পর্শে। মজে যাই রসের ভিয়েনে। আবার হাসতে হাসতে আমারই সামনে গড়ে ওঠা কোনো মঞ্জিল ভেঙে পড়তে দিই। এ শুধুই আমি। আমি আছি বলেই নিত্যতার এই সূত্র, এই মহিমা। কিন্তু আমি না-থাকলেও এসবই থাকবে। এই গড়া-ভাঙা, এই হাসি হাসি মুখ অন্য কোনো আমি, সদ্গুণসমৃদ্ধ হেনরি, সাদাহাসি অন্য অমিতাভ, অজস্র এক্স-ওয়াই-জেড। আমি না থাকলেই সব অনিত্য নয় তাহলে? বিপন্নতা এ-সময়েই এক কাপ চা নিয়ে আমার মধ্যে বসে। হেনরি হাসে।

আমার মধ্যে সবসময়ই একটা ভয় কাজ করে। কীসের জন্য ভয়, নির্দিষ্ট নয়। কেন ভয়, নেই তার হদিশ। বিপন্নতার মধ্যে সারভাইভ্যালের একটা কৌশল আবিষ্কারে মগ্ন হই। সহ্যের সীমাভাঙা অন্ধকার! অলস মন্থর অন্ধকারকে আমি ভয়ই পাই। খুঁজি, আলো, অনেক আলো, যা আমার ভয়কে আশ্বস্ত করবে। আমি হেনরি হয়ে যাই, বা হেনরি ঢুকে পড়ে আমার মধ্যে।

অনন্তের মধ্যে খণ্ড হয়ে বাঁচি। ভালো-মন্দ সার-অসার তত্ত্বজ্ঞান সব বুঝি না। সাধারণ দ্যাখা। স্পষ্ট গতিশীল কোনো উচ্চারণ নেই। তবু চোখে ভেসে ওঠে সেই পাহাড় যে ‘সারাজীবন মাথায় বরফ নিয়ে’ অনন্তের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে। অভিশাপ না নিয়তি? দেখি, বিশালের বিপরীতে ক্ষুদ্র এক দেয়ালে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকা ততোধিক ক্ষুদ্র এক টিকটিকি। সে কি ফসিল হয়ে যাবে? নষ্ট হয়ে যাবে? আমাকে বলতে হয়, অভিশাপ অভিশাপ। বলতেই হয়, নষ্ট হয়ে যায়, নষ্ট নষ্ট। কিন্তু স্বাভাবিক প্রকৃত আমি পারি না। বলার আগে নকল দাঁত লাগিয়ে নিই মুখভর্তি। নিজের বিপন্নতা অপনোদনের জন্যই কি এই ছলনায় মেতে উঠি? জানি না, হেনরি জানে না, আমি নিশ্চিত অমিতাভও জানে না।
এসবই অতীতের বর্তমানের এবং ভবিষ্যতেরও। ছিলাম আছি থাকব। হেনরি ছিল আছে থাকবে। অমিতাভরাও। আমার চারপাশের অস্তিত্ব, ঘটার সম্ভাবনায় থাকা বহুবিধ ওয়েটিং লিস্ট, খোঁজা-দ্যাখা-অনুভব করা আর মিথস্ক্রিয়ায় ভরিয়ে তোলা চলতেই থাকবে। আমি, হেনরি বা অমিতাভরা ভাষ্য দিতে থাকব এসবের। তবে তা আনুপূর্বিক নয়। টানা নয়। মৌহূর্তিক। খণ্ড খণ্ড। কোলাজ কোলাজ। মহাকাব্যের অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সঞ্জয় উবাচ রণক্ষেত্রের ভাষ্য নয়। ওল্ড কিংবা নিউ টেস্টামেন্টের Complete Commentary নয়। এ জাগতিক পরিসরের কাব্যভাষ্য। ভাঙা, অনুবাদ-অযোগ্য, অপূর্ণ, আর জ্ঞান-তত্ত্বহীন। অমিতাভদের চেষ্টা এ-কারণে, যেন এতে বিপন্নতাবোধ লাঘব হয়। হেনরিকে আমি দেখেছি একই অধ্যবসায়ে। অমিতাভ হেনরির প্রতিচ্ছবি। এক্স-ওয়াই-জেডসম আমি, হেনরি, অমিতাভ কখন যেন একাত্ম ও এক আত্মা হয়ে যাই। আমেন, আমেন।

সমান্তরাল অমিতাভ

দ্বিতীয় অমিতাভর জীবনপ্রণালী প্রাগুক্ত অবস্থানের সমান্তরালে হাঁটে আমার দ্যাখা-শোনা-বোঝা ও অনুভবে—
ক) ভিড়ভাট্টায়, গতিময় যানবাহনে, কানে তালা লেগে যাওয়া শব্দে, অমিতাভদা রাস্তা পেরোতে ভয় পেত। হেজিটেট করত। অনেকসময় তাঁকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিয়েছি।
খ) যে-কোনো মঞ্চে উঠতে ইতস্তত করত। একটা সংকোচ। একটা ভয়জড়ানো অস্বস্তি। কাটিয়ে উঠলেই মাইকের সামনে ছোট্ট করে হলেও বলত ভালো। অন্তত চার-পাঁচবার আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। একই মঞ্চে হলে, অমিতাভদার নাম আগে উচ্চারিত হলেও বলে বসত— ‘এই উমাপদ, তুমি আগে চলো না!’
গ) আড্ডা থেকে একটা পালাই-পালাই ভাব তৈরি হয়েছিল। ফোনাফুনি করে একত্রিত হওয়ার চেষ্টায়, হয়তো এল, কিন্তু অনেক দেরিতে, সামান্য কিছু কথাবার্তার পরই, কিছু একটা দোহাই দিয়ে, পালিয়ে যেত। আমরা বুঝতে পারতাম। একমাত্র ব্যতিক্রম দেখেছি, ২০১৬-র অক্টোবরে আমার বাড়িতে অ্যারেঞ্জ করা দু-দিনের আড্ডায়। ফুরোতেই চায় না। অকপট অমিতাভ।
ঘ) বাড়িতে গিয়ে কথাবার্তার সময় খুব ছটফট করত, আর পরে হয়তো নিয়ে বেরিয়েই পড়ত সেটেলমেন্ট অফিসের সামনের চায়ের দোকানে।
ঙ) চোখের ছানিকাটা অপারেশনের কিছুদিন পরে কথায় কথায় বলেছিল— ‘আমার মনে হয়, সবারই একবার চোখের অপারেশন করানো ভালো। কী আলো, কত উজ্জ্বল, কী উদ্ভাস। প্রাণভরে একবার পৃথিবীটা দেখে নেওয়া যেতে পারে’।
চ) রাগতে দেখিনি সচরাচর। বরং গাম্ভীর্য চিরে বের করা হাসি, কিঞ্চিৎ শব্দসহ। সেই অমিতাভদাই একদিন রাতে ফোনে (আমি কলকাতায়) বেজায় ক্ষিপ্ত। ‘ভেবেছেটা কী? আমি নপুংসক! চিল্লাতে পারি না! আমার চুপচাপ থাকাকে দুর্বলতা ভাবলে ভুল করবে। জিন্দেগিতে আর এই ইতরটার ফোন ধরব না’। ইত্যাদি। কথায় কথায় জেনে নিলাম ব্যাপারটা। বহরমপুরের তথাকথিত এক তরুণ কবি, ফোনে নানারকম গালিগালাজ করেছে। বলেছে ‘ন্যাকা’।
ছ) পত্র-পত্রিকায় কোথাও কিছু (গদ্য বা কবিতা) পড়লে ফোন করে প্রশংসা করত। প্রশংসা করতে জানত মানুষটা। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছি, ফেসবুকে যেন কিছু-মিছু সাধারণ লেখাকেও একটু বেশিই প্রশংসা করে ফেলত। কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়নি কখনও।
জ) একটা ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করত। রেজারেকশন অফ অমিতাভ মৈত্র-র পরেও। তাঁরই মুখে— ‘এখনও যা লিখছি, সেটাও আমি জানি। যেটা লিখতে চাই, সেটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। কিন্তু এখান থেকে এখনও আমি বেরোতে পারব না। চাইছিও না। আমার আরও বছর চারেক লাগবে। তারপর আমি শেষবারের মতো একটা চেষ্টা করব। যদি কিছু করা যায়… যদি না-ই হয়, তবে সেটাও হবে গিয়ে আরেকবার Story of failure।’ (আড্ডা— ২০১৬)। জানি না এই প্রয়াস অমিতাভদা নিয়েছিল কিনা! প্রকাশিত কবিতায় আমি সেই ডিপার্চার দেখিনি। সবকিছু এত সময় মেপে হয় না যে, ডাক চলে এলে তো আরওই না।

অমিতাভর নির্বাণ-খোঁজ

দ্বিতীয় অমিতাভ যখন বলেছি, তাহলে প্রথম অমিতাভ একজন ছিল নিশ্চয়ই। ছিল তো বটেই। তাঁর সঙ্গেই আমার প্রথম আলাপ-পরিচয়-আড্ডা-ভালোবাসা-হৃদ্যতা। ১৯৭২। কলেজপড়ুয়া আমি ও জমিল সৈয়দ কবিতাপত্রিকা ‘শ্রাবস্তী’-তে মাতলাম। আমি স্রেফ হুজুগে। জমিলই সব, আমি সঙ্গে থাকি। কবিতাসংগ্রহের কাজে অমিতাভদার রানিবাগানের বাড়ি (তখন বেশ ছোটো বাড়ি, হলুদ রং)। ছোটোখাটো পাতলা-সাতলা হাসিমুখ অমিতাভদা। তারপর বাড়ির সেই ঘরে মাঝেমধ্যেই নানারকম কবিতালোচনা আর আড্ডা, এমনকি প্রেমিকার চিঠিপাঠও, অনেক দিন, চাকরি নিয়ে বহরমপুর ছাড়া পর্যন্ত। একটা হৃদ্যতা বুঝতে পারতাম। পরে হঠাৎই বহরমপুরে কখনও-সখনও দ্যাখা হওয়া, কিছু কথাবার্তা। ৭৯-তে আমিও বাড়ির বাইরে। যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন।

এই অমিতাভও কবিতা লিখত। প্রকাশ করত। প্রশান্তদা (গুহমজুমদার) আর সে ছিল হরিহর আত্মা। বলতাম— ‘মানিকজোড়’। ৮৪-৮৫ নাগাদ একটা কবিতার পত্রিকা ‘পাণ্ডুলিপি’ যৌথভাবে শুরু করেছিল। মাত্র তিনটে সংখ্যা। আমার কবিতা চেয়ে নিয়েছিল, অমিতাভদাই। “তারপর চাকরির দৌলতে সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাওয়া। ও পর্ব শেষ। লেখাটেখাও প্রায় বন্ধ। একদম Out of touch যাকে বলে। আমি তো ছিয়াশির পর থেকে লিখিইনি প্রায়। টুকটাক, সামান্য… বলার মতো কিছু নয়।” (আড্ডা— ২০১৬)

৮৬-র আগে কবিতা লেখালিখির একটা নমুনা—
“পানপাত্র ভেঙে যায়, সাথে ভাঙে সমূহ আড়াল
জল কি গড়িয়ে যায় তার মৃদু উষ্ণতা নিয়ে
সমর্পিত হতে কারো কাছে? যে রয়েছে দূরে কুয়াশায়
আজ তার মুখে আমি গোধূলির রহস্যকে লগ্ন হতে দেখি
যেন সে পাথর কোন, জল যার শ্বেত পরিত্রাণ—
পানপাত্র ভেঙে যায়, সাথে ভাঙে রাত্রির আড়াল
জল কি গড়িয়ে যায় তার মায়া বিষণ্ণতা নিয়ে
সমর্পিত হতে কারো কাছে?” (ভেঙে যায়/ ‘রৌরব’-এ প্রকাশিত)

প্যারাডাইম শিফটের কথা বলেছিলাম। একবার মিলিয়ে নিতে পারেন হে উৎসুক!

সমান্তরাল অমিতাভ

এই পর্বে (পরিচয় থেকে আটের দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত) আমার দ্যাখাশোনা অমিতাভদা—
ক) চায়ের দোকানে, রবীন্দ্রসদনে, বাড়িতে আড্ডা মারত, পরনিন্দা-পরচর্চা ছাড়া।
খ) আমার মতো নবীন কবিতাকারের কবিতা মুখস্থ বলে দিতে পারত।
গ) গল্পের মধ্যে মজা ও উইট ছড়িয়ে দিয়ে, নিজেও হেসে উঠত। প্রাণবন্ত।
ঘ) যত্রতত্র লেখা প্রকাশে দ্বিধা ছিল, নিজেকে নিয়ে সবসময়ই একটা সংশয় পোষণ করত।
ঙ) চাকরিতে মনোনিবেশ আর সেখান থেকেও লেখার রসদ আত্মস্থ করা।

ট্রানজিশন

যে-কোনো অপরিমেয় বাঁকে একটা ট্রানজিশন থাকে। অমিতাভদারও ছিল।
“শাক্যসিংহ বিষয়ক আমাদের গল্পের ভিতরে
ভেসে ওঠে ফাঁপা, গোল চাঁদ— আর
আমাদের ছোট বোন গলা মোচড়ানো শাদা হাঁস
কাপড়ে আড়াল করে প্রধান ফটক ধরে
ভোরবেলা বাড়ী ফিরে আসে।
ক্ষুধাকে সে বোধিজ্ঞান করে না এখন” (ক্ষুধা/ ‘রৌরব’ বারোবছর, জানুয়ারি-৮৮)

এর পরপরই ‘টোটেমভোজ’ সিরিজ। দ্বিতীয় এবং অদ্বিতীয় অমিতাভ। তাঁর মুখ থেকে— “আমি আবার যখন শুরু করব বলে ঠিক করলাম, তখন নিজেই ঠিক করলাম, এবার নিজের কবিতাটা লিখব।… এতদিন তো নিজের কবিতা লিখিনি। লিখেছি প্রেজেন্টেবল কবিতা, লোকে পড়েই ভালো বলবে, বেশ বেশ করবে। এটা ভুল ছিল, ভাবনায় মারাত্মক ভুল।… এবার ভেতরে ঢোকার কবিতা লিখব, আত্মস্থ করার কবিতা। ধ্যানের মতো জায়গা থেকে লেখা। মনে একটা ক্ষোভ… একটা যাকে বলে বিবমিষাও তৈরি হল। বুঝলাম, নিজের লেখা ভাঙা দরকার। তো সেখান থেকে নিজের কবিতার একদম পুরোনো ছাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হল। দেখাও হল এরই মধ্যে নানারকম, সামাজিক টানাপোড়েন, মানুষজন, চাকরির সুবাদে মরতে যাওয়া মানুষের, পোড়া মানুষের জবানবন্দী নিতে হত, ভয়ংকর, সব মিলিয়ে একটা নিজেকে মোটিভেট করা।… ভাবলাম, কিছুই তো পারি না, তাহলে নিজেকে একটু ভ্যাঙাই, নিজেকে নিয়ে একটু মজা করি। ‘টোটেমভোজ’, ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’ এসব থেকেই…” (আড্ডা ২০১৬)।

অফুরান স্মৃতি

বহরমপুর গেলে ভোরের দিকে হাঁটতে ভালো লাগে আমার। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে এক ভোরে এমনই হাঁটতে হাঁটতে, রানিবাগানের এক গলিতে। বাকিটা ফেসবুকে পোস্ট করা লেখা থেকে (২১/১১/২০২০) টুকরো টুকরো তুলে ধরি।

“তখনই চোখে ভেসে উঠল একটা রঙিন দো-তলা বাড়ির কোলাপসিবল গেটের পেছনে কাঠের বড়ো দরজার গায়ে যেন স্বর্ণাক্ষরে লেখা, ‘অমিতাভ মৈত্র’, নীচে, ‘শিখা মৈত্র’। পেয়ে গেছি। ভুলিনি। ঠিক চলে এসেছি। এই বাড়িতে সবমিলিয়ে কতবার-যে এসেছি, আজ তা আর গুণে বার করতে পারব না। কিন্তু আমার প্রথম দ্যাখা বাড়িটা এখন আমূল বদলে গেছে, স্বাভাবিক নিয়মেই। বছর কয়েক আগেও যখন এসেছিলাম, তখনও এতটা বদল দেখিনি।…“

১৯৯৬-এ বহরমপুর ফিরে যখন আবার নয়া উদ্যোগে ‘রৌরব’ করার প্ল্যান হচ্ছে, তখন একদিন অমিতাভদাকে ধরলাম রবীন্দ্রসদনে, রৌরবে কবিতা-বিষয়ক গদ্য লিখতে। প্রথমে না-না করলেও, আমার আর সমীরণের (ঘোষ) পীড়াপীড়িতে লিখল। পরপর কয়েকটা সংখ্যায় গদ্য। কবিতা ও মিউজিক, কবিতা ও স্বপ্ন আরও দু-একটা! এই অমিতাভদা একদম আলাদা অমিতাভদা। অসাধারণ গদ্য। সেসময়ও অমিতাভদার বাড়ি বেশ কয়েকবার গেছি।… “সুশীলদার স্মরণসভায় না থাকতে পারলেও, ‘স্মরণ’-এ লেখাতে পেরেছিলাম। সুশীলদার মৃত্যুর পর একবার দ্যাখা হলো সুশীলদার বাড়িতে। গিয়েছিলাম, অতনুদের (বন্দ্যোপাধ্যায়) এখন বাংলা কবিতা কাগজের ক্রোড়পত্র বৌদির হাতে তুলে দিতে। সেদিন স্ক্যয়ারফিল্ডে বসে জমাটি আড্ডা হয়েছিল।”… “বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলাম, ডেকে উঠি, ‘অমিতাভদা’! চকিতেই। না, ডাকিনি। ডাকিনি, যদি এই সকালে ঘুমজড়ানো অথচ তেজিগলায় ভেতর থেকে অমিতাভদা চিৎকার করে ওঠে, ‘কে রে অর্বাচীন! এই সকালে আমার নাতনির ঘুম ভাঙাস?’ বা বলে ওঠে— “দ্যাখ তো হেনরি! এই সক্কালে ‘চল্লিশ পা দূরে একজন গরম মানুষ’ মনে হচ্ছে!” আমি তো জানি অমিতাভদার ‘হেনরি’ আছে। যদি ‘হেনরি’ অমিতাভদার কথায়, ‘ভয় পেয়েই সে আরও জোরে জোরে কাচ মুছতে শুরু করে দেয়’ আর ‘চামচটাকে ছুঁড়ে দেয়’ (চুল্লির মধ্যে) আমার মাথায়! কোথায় দাঁড়াব তখন। না, ডাকিনি। অমিতাভদার অনেক বিকল্প, ‘ম্যাডাম’, ‘ক্রিস্টোফার’, ‘হেনরি’। অমিতাভদা চিনলেও এরা আমায় চিনবে না। ঢুকতে দেবে কেন বাড়িতে? উল্টে জিজ্ঞাসা করে বসবে, ‘পতন কথা’ থেকে একটা লাইন বলো দেখি! ঠিক আছে, ‘টোটেম ভোজ’ থেকে হাফ-লাইন, বেশ বেশ তাহলে ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’ থেকে কোয়ার্টার লাইন! ওরা হয়তো, ‘অমিতাভ মৈত্রর কবিতা সংগ্রহ’ পর্যন্ত দৌড় করাবে আমায়। ওঁরা জানে না আমায়! পাসওয়ার্ড তো চাইবেই। নিজে নিজেই হাসলাম। ঘুমোক দাদা, পরে হবেখন, কখনো।”

পরদিন ফেসবুকে পড়ে আমায় ফোন— “উমা তুমি লজ্জায় ফেলে দিলে আমাকে! তুমি ডাকলে না! এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলে! আশ্চর্য। বলো তো, তুমি কি আমাকে একটু পর করে দিলে না? আমি বিস্মিত হই তোমাদের ভালোবাসায়। তবে তুমি অন্যায় করেছ, না-ডেকে” ইত্যাদি।

ফেসবুকে লেখাটা শেষ করেছিলাম এইভাবে— “আমাদের সময়ের বড়ো (মেজর) কবি ও গদ্যকার অমিতাভ মৈত্র। প্রথার বাইরে, স্বতন্ত্র চিন্তা-চেতনা, বাকরীতি, ভাষা, আর পরিবেশনা। এগিয়ে থাকা এক শিল্পীমানুষ। আমার মতো ক্ষুদ্রের সঙ্গে তাঁর ৫১ বছরের পরিচয়, হৃদ্যতা, কথাবার্তা-আড্ডা হয়, আমার লেখালিখি নিয়ে অন্তত দু-বার কলম ধরে, এর চেয়ে শ্লাঘার বিষয় আর কিছু হতে পারে না! মাথা নুইয়ে প্রণাম জানিয়ে ঘরের পথ ধরলাম। আজ ঘরটা যেন অনেকটা দূর মনে হচ্ছে। বস্তুত বহুদূর কোথাও যেন একটা পৌঁছে গিয়েছিলাম। ঠিক স্ববশে নেই।”…

না, মৃত্যুদিন, দুপুরে অমিতাভদার বাড়ি থেকে বাবুয়া (অনুপম ভট্টাচার্য) ফোন করলেও অমিতাভদার মৃতমুখ আমি ফোটো কিংবা ভিডিওতে দেখতে চাইনি, যেমন চেয়েছিলাম নাসের-এর সময়। জানি না, কেন যে!

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

অর্যমা সিংহ মৈত্র

বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিলো বাবার সঙ্গে

অমিতাভ মৈত্র, আমার বাবা, বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিলো বাবার সঙ্গে, আমাকে ডাকতেন ‘মা জননী’ বলে। কোনোদিন কিছু চাইতে হয়নি বাবার কাছে। না চাইতেই আমার সব প্রয়োজন বুঝে আমার কাছে সেগুলি এনে হাজির করতেন। সারাজীবন চাকরিসূত্রে বাইরে বাইরে কাটিয়েছেন। প্রত্যেক শনি, রবিবার বাড়িতে আসতেন। সপ্তাহের ঐ দুটো দিন ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আনদের দিন। বাবা খুব ভালো ছবি আঁকতেন। আমার ছোটোবেলার আঁকার হাতেখড়ি বাবার কাছেই। বাবা ভীষন ভালো গান গাইতেন। তখন আমার বয়স ছয়/ সাত হবে। রাত্রিবেলা খাওয়া সেরে জ্যোৎস্না রাতে আমাকে আর মাকে নিয়ে ছাদে বসতেন চেয়ারে। আমরা বাবার কাছে গান শুনতে চাইলে ‘আজ জোৎস্নারাতে সবাই গেছে চলে’, ‘বড়ো আশা করে’, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’— এসব গানগুলো গাইতেন। আর আমিও ববার কাছে শুনে শুনে ঐ বয়সে গানগুলো মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। এত ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারকে প্রচুর সময় দিতেন। আমার পড়াশোনার শিক্ষকও ছিলেন বাবা। একটু যখন বড়ো হলাম, ইংরেজিতে যেকোনো চিঠি, অনুচ্ছেদ যেগুলো ভালো বুঝতে পারতাম না, বাবা লিখিয়ে দিতেন। এমনকী ফোন করে অনেকক্ষণ ধরে বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতেন। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে যখন পড়া শুরু করলাম, বাবা নাটকের এক একটা সিন মুখস্থ বলে যেতেন আমাকে বোঝানোর সময়। খুব অবাক হতাম এতদিন পরেও ম্যাকবেথের লাইনগুলো বাবার কীভাবে মুখস্থ আছে। ভাবতে খুব অবাক লাগে একজন মানুষ, যিনি উচ্চপদস্থ অফিসার হওয়ার সুবাদে সঙ্গে সিকিওরিটি নিয়ে গাড়িতে লাল আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়াছেন, বিভিন্ন জায়গায় রেড করে বেড়াচ্ছেন, সেই মানুষটাই আবার বাড়ির লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজো করছেন সব নিয়মনিষ্ঠা মেনে। সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ ছিল বাবার অসম্ভব সুন্দর। এবছরও নিজেই বাড়ির সরস্বতী পুজো করেছেন। ICU তে ভর্তি থাকাকালীন একদিন দেখা করতে গিয়েছি, বললেন পরের দিন একটা সাদা কাগজ আর পেন নিয়ে আসতে। কিছু লেখা মাথায় এসেছে, লিখে ফেলতে হবে ঝটপট। যেদিন রিলিজ পেলেন নার্সিংহোম থেকে, অর্থাৎ মঙ্গলবার, ২১.০২.২০২৩ বিকেলবেলা, বাড়িতে ঢোকামাত্র আমাকে বলেন “পড়ার ঘর থেকে আমার কিছু বই কাগজ আর টেন নিয়ে আয়। আমার প্রচুর কাজ বাকি আছে”। ভীষণ যেন একটা তাড়া কাজ শেষ করার। হাতে পেন নিয়ে চেষ্টা করলেন কিছু লেখার, তখন অক্সিজেন চলছে, শরীরে প্রচুর ক্লান্তি। পারলেন না লিখতে শত চেষ্টা করেও, আর লেখা হলো না। পরের দিন নিঃশব্দে চলে গেলেন আমাদের থেকে অনেক দূরে। তুমি যেখানেই থেকো খুব ভালো থেকো বাবা।

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

শিখা মৈত্র

আমার জীবনসঙ্গীর শেষ দিনগুলি

অমিতাভ মৈত্র, এই মানুষটিকে আমি আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলাম, খুব নম্র, বিনয়ী মানুষ ছিলেন। এত বড়ো পদে চাকরি করতেন, কিন্তু সব মানুষের সঙ্গে সমানভাবে মিশতেন, সবাইকে সম্মান করতেন। কখনো কোনোরকম অহংকার ছিল না ওনার মধ্যে। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর উনি লেখার প্রতি আরও বেশি সময় দিতেন। প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যেবেলায় ওনাকে দেখেছি নিয়ম করে বই, খাতা, কলম নিয়ে বসতেন, পড়াশোনা ও লেখালেখি করতেন। এমনকি যখন সবার খেতে বসতেন তখনও অন্য হাতে বই খুলে উনি কিছু পড়ছেন। কোনো লেখা শেষ হলে আমাকে সেটা পড়ে শোনাতেন, আর প্রথম বইটি উনি আমার হাতেই তুলে দিতেন। চাকরি সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। সব জায়গায় মানুষের কাছে প্রচুর ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছেন। উনি সি.ও.পি.ডির পেশেন্ট ছিলেন। কখনও কাউকে ওনার অসুখের কথা প্রকাশ করতেন না। আমরা জিজ্ঞাসা করলে সবসময় বলতেন, আমি ভালো আছি। উনি চলে যাওয়ার দশদিন আগে থেকে হঠাৎ একটু বেশিই শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন। ভাক্তার দেখানো হলে তিনি বলেন অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হবে চ্যানেল করে। বাঁহাতে চ্যানেল করে দিনে দুবার অ্যান্টিবায়োটিক চলছে, উনি সেই অবস্থায় রিলকে নিয়ে লেখাটা লিখছেন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কষ্ট হচ্ছে না তোমার? তৎক্ষণাৎ বললেন না, কোনো কষ্ট হচ্ছে না। শেষ লেখার প্রিন্ট করনোর জন্য উনি যেতে পারেননি, তাই ছেলেটি বাড়িতে এসে লেখা নিয়ে যায়। সেই প্রুফ দেখার জন্য নার্সিং হোম থেকে ২১ তারিখে ফিরেই আমাকে বললেন, তাড়াতাড়ি ফোন চার্জ দাও, আমার কিছু জরুরি মেসেজ করতে হবে। রাত্রি ৭:৩০ টা, কিছুক্ষণ মেসেজ দেখার পর উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন অর্থাৎ ২২ তারিখ সকাল থেকে আর কোনোভাবেই ভেকে ডেকে ওনার সাড়া পেলাম না, আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সবসময় বলতেন দুজনে একসাথে আরও অনেকদিন বাঁচবো আমরা, সেই কথা আর রাখতে পারলেন না।

Categories
2023-sharodiyo-sakkhatkar

শ্রীমতি গোপা কাঞ্জিলাল

সঠিকভাবে কন্ঠ চর্চা বা সঠিক স্বরস্থান সম্পর্কে ধারণা হলে তবেই গান সুন্দর স্বাভাবিক ভাবে গান কণ্ঠে ধারণ করা সম্ভব

আলাপচারিতায় অরূপ চক্রবর্তী

আমাদের সংগীতের আদি রূপ শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সংগীতের যে ধারা কয়েক শতক ধরে যা স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল বর্তমান সময়ে এসে সে তার কৌলিন্য হারিয়েছে। সারা ভারতবর্ষের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও একই চিত্র দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আজ থেকে কিছু বছর আগেও কলকাতা ও অন্যান্য জেলায় সারা বছরব্যাপী বিশেষ করে শীতের সময় জুড়ে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসতো এবং সেই অনুষ্ঠানে বাংলা তথা সারা ভারতের বিখ্যাত সব কণ্ঠশিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রশিল্পী উপস্থিত থাকতেন। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করতেন যে কলকাতা তথা পশ্চিমবাংলায় সমঝদার শ্রোতার আধিক্য অন্যান্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি। কাজেই বিভিন্ন ঘরানার শিল্পীরা মুখিয়ে থাকতেন এখানে সংগীত পরিবেশন করার জন্য।

কিন্তু উচ্চাঙ্গ সংগীতের সেই রস গ্রহণ করার মতো শ্রোতা আজকাল বিরল। বিভিন্ন যন্ত্রের উচ্চকিত ও অসংযমী প্রয়োগ ও তার সাথে গান গাওয়া— এখনকার প্রজন্মের মানুষের চিত্ত বিনোদনের অন্যতম অঙ্গ। উচ্চাঙ্গ সংগীত শিক্ষার জন্য যতটা সময় দেওয়া দরকার, সঠিকভাবে তানপুরায় সুর বেঁধে কন্ঠ চর্চার প্রয়োজন ও যোগ্য গুরুর অধীনে থেকে নিবিড় শিক্ষা ও অনুশীলন— তার সদিচ্ছা বা আগ্রহ এই সময়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব কম দেখা যায়।

আমরা তবুও প্রয়াস-এর পক্ষ থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীত ও নজরুলগীতি-র প্রথম সারির শিল্পী গোপা কাঞ্জিলাল-এর বারাসতের বাড়িতে গিয়েছিলাম তাঁর সংগীতজীবনের কিছু কথা শোনার জন্য। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে এই উপস্থাপনা।

আপনার সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি কখন শুরু হয়েছিল? বাড়িতে কেউ কী সংগীত চর্চা করতেন? তাঁদের আগ্রহের কারণে কী আপনার সংগীত জীবন শুরু হয়েছিল?

আমি তখন খুব ছোটো। আমাদের পাশের বাড়িতে একজন শিক্ষক আসতেন গান শেখাতে। তাঁর নাম শ্রী গৌর গোপাল কুণ্ডু। তিনি এলেই আমি তাঁদের বাড়ি চলে যেতাম গান শুনতে। আমার খুব ভালো লাগতো। তিনি চোখে দেখতে পেতেন না। একদিন আমি মায়ের কাছে বললাম যে আমি গান শিখতে চাই। মা বাবাকে আমার আগ্রহের কথা জানালেন। তারপর বাবা ওনার সঙ্গে কথা বলে আমার গান শেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই থেকে আমার গান শেখা শুরু হলো। এভাবেই কিছুদিন চললো। উনি সব ধরণের গান শেখাতেন যেটা বাবার পছন্দ ছিল না। বাবা পছন্দ করতেন উচ্চাঙ্গ সংগীত। নানা ভাবনা চিন্তার পরে একদিন বাবা আসাম রওনা দিলেন। উদ্দেশ্য আমার দাদুর (বাবার কাকা) কাছে আমার গান শেখার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। আমার দাদু ছিলেন লখনৌ-র ম্যরিস কলেজ অফ মিউজিক (বর্তমানে ভাতখণ্ডে কলেজ অফ মিউজিক) এর ছাত্র। তিনি গান শিখেছিলেন পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে ও পন্ডিত শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণ রতনজনকারের কাছে। পাহাড়ী সান্যাল, প্রশান্ত দাশগুপ্ত, রবীন্দ্রলাল রায় (বিদুষী মালবিকা কান্নন-এর বাবা) ও আমার দাদু এঁরা সবাই এক সাথে সংগীতের পাঠ নিয়েছেন। যাইহোক, বাবা কিন্তু আসাম গিয়ে দেখলেন দাদুর ঘর তালাবন্ধ। উনি বাইরে কোথাও গেছেন। আসলে উনি সংসারী মানুষ ছিলেন না। তখন বাবা ওনার উদ্দেশে একটা চিঠি লিখে রেখে আসেন।

 এর পরবর্তীতে কী হলো?

বাবা আসাম থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পরের ঘটনা। একদিন দেখি আমাদের বাড়ির সামনে একটা রিকশা এসে থামলো। রিকশা থেকে একজন অচেনা মানুষ নামলেন। তাঁর পরনে টকটকে লাল রঙের ধুতি ও জামা। ওনার সঙ্গে রয়েছে একটা ব্যাগ ও একটা তানপুরা। আমি তো এই রকম লাল রঙের পোষাক পরা মানুষ আগে দেখিনি। যথারীতি খুব ভয় পেয়ে গেলাম ও বাড়ির ভিতরে গিয়ে বললাম, তোমরা শিগগির এসো। দ্যাখো আমাদের বাড়িতে একটা কাপালিক এসেছে। আমার ঠাকুরমা তাড়াতাড়ি বাইরে এলেন ও বলে উঠলেন, কাপালিক কোথায়! এ তো আমাদের স্মরজিৎ! ওনার নাম স্মরজিৎ কাঞ্জিলাল। উনি সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন এবং উনি স্বামী সচ্চিদানন্দ নামে পরিচিত ছিলেন।

বেশ মজার ব্যাপার তো?

(হেসে উত্তর দিলেন) বাবা অফিস থেকে ফেরার পরে ওনাদের মধ্যে আমার গান শেখার বিষয়ে কথা হলো। সব শুনে উনি বললেন যে গান শেখানোর দায়িত্ব উনি নেবেন। কিন্তু হারমোনিয়াম কেন? বাক্সবন্দি গান বাজনা চলবে না। প্রথমেই উনি ও বাবা হারমোনিয়াম বিক্রি করে তানপুরা কিনে আনলেন। সেই প্রথম তানপুরা নামটা শুনলাম ও স্বচক্ষে দেখলাম। এর আগে আমি তানপুরার ত-ও জানতাম না। শুরু হলো তানপুরায় সরগম শিক্ষা। প্রথম প্রথম তানপুরায় গান গাইতে অসুবিধা হতো বৈকি! কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তানপুরায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। এভাবেই শিক্ষাগ্রহণ পর্ব চলছিল। কিন্তু দাদুর মন পড়েছিল সেই আসামে। উনি সেখানে ফেরার জন্য একটু অধীর হয়ে উঠছিলেন। হয়তো সেই কারণেই একদিন বাবাকে বললেন, আমাকে নিয়ে উনি বর্ধমান যেতে চান। সেইসময় পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশী বর্ধমান থাকতেন। আমাকে নিয়ে দাদু যোশী-জির বাড়ি গেলেন। সেদিন ওখানে উপস্থিত ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমার পরবর্তী সংগীতগুরু প্রশান্ত দাশগুপ্ত। ওখানে সবার সামনে আমাকে গান গাইতে হলো। তখন এতটাই ছোটো ছিলাম যে ঠিক না ভুল কী গিয়েছিলাম জানি না। তখন প্রশান্তবাবু দিল্লির নিবাস ছেড়ে কলকাতায় যতীন দাস রোডে বসবাস করছেন। দাদু প্রশান্তবাবুকে আমার সংগীত শিক্ষার দায়িত্ব দিলেন। সেই থেকে ওনার মৃত্যুকাল অবধি আমি ওনার কাছে সংগীতের পাঠ নিয়েছি। কয়েক বছর পরে আমি কলকাতার সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে যোগদান করলেও প্রশান্ত দাশগুপ্তের কাছে নিয়মিত গান শিখতে গিয়েছি। প্রশান্তবাবুর মৃত্যুর পরে আমি শ্যামচৌরাশি ঘরানার বিখ্যাত উস্তাদ সালামত আলি খাঁ সাহেবের ছাত্র শ্রদ্ধেয় শ্রী ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য মহাশয়ের কাছে তালিম নিয়েছি।

আপনি কি কখনো সংগীতের পরীক্ষা দিয়েছেন?

হ্যাঁ। আমি ১৯৭২সালে এলাহাবাদের প্রয়াগ সংগীত সমিতি-র সর্বভারতীয় ‘সংগীত প্রবীণ’ (এম মিউজ এর সমতুল্য) দিয়েছিলাম এবং সর্বভারতীয় স্তরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম।

এছাড়া অন্য কোনো পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন?

আমি ১৯৭৩ সালে আকাশবাণী আয়োজিত All india classical music competition এ অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানেও আমি সর্বভারতীয় স্তরে প্রথম স্থান লাভ করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেছিলাম।

এই প্রতিযোগিতার বিষয়ে একটু বিশদে বলবেন?

আকাশবাণী আয়োজিত এই প্রতিযোগিতা প্রতি বছর হতো। কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত এই দুই বিষয়েই। ভারতবর্ষের যেকোনো রাজ্যের থেকে প্রতিযোগীরা এতে অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রতিযোগীদের জন্য তাদের স্থানীয় আকাশবাণী কেন্দ্রে (গান বা বাজনা) রেকর্ডিং এর ব্যবস্থা থাকে। এই রেকর্ডেড পারফরম্যান্সগুলি দিল্লিতে পাঠানো হয়। ওখানে বিচারকদের নিয়ে একটা বোর্ড গঠিত হয়। রেকর্ডিং শুনে বিচারকেরা যোগ্যতা নির্ধারণ করেন।

আপনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি’ শ্রদ্ধেয় শ্রী ভি ভি গিরি মহাশয়ের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন?

না। সেবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমি একাই পুরস্কার লাভ করেছিলাম। তাই আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে একা আমাকে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে পুরস্কার গ্রহণের অনুমোদন দেয়নি। পরে আমার পুরস্কার আমি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে গ্রহণ করেছিলাম। শ্রদ্ধেয় সংগীত ব্যক্তিত্ব শ্রী রাইচাঁদ বড়াল মহাশয় সেই পুরস্কার আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু উনি পুরস্কারসহ আমার সাথে ছবি তুলতে রাজি হননি।

এই পুরস্কারের সূত্র ধরে নাকি আকাশবাণীতে গান গাইবার সুযোগ ঘটে? পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাকি আর অডিশন দেওয়ার প্রয়োজন হয় না?

না। এটা সঠিক নয়। পুরস্কারপ্রাপ্তদের তাঁদের রাজ্যের আকাশবাণী কেন্দ্র তিনটি প্রোগ্রাম করার সুযোগ দেয়। কিন্তু আকাশবাণীর গ্রেডেড আর্টিস্ট হতে গেলে তাঁকে অবশ্যই অডিশন দিতে হবে। তবে আমি এই সুযোগটা পাইনি। কারণ আমি প্রতিযোগিতার আগে অডিশন দিয়েছিলাম এবং প্রতিযোগিতার ফলাফল বেরোনোর আগেই আমি আকাশবাণীতে উচ্চাঙ্গ সংগীতে নির্বাচিত হয়েছিলাম।

সেই সময় তো আকাশবাণীতে বিখ্যাত রথী মহারথীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। এমন কোনো বিখ্যাত মানুষের কথা মনে পড়ে যাঁদের সঙ্গতের সঙ্গে আপনি গান গেয়েছিলেন?

হ্যাঁ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিখ্যাত তবলাবাদক উস্তাদ কেরামতুল্লা খাঁ ও পণ্ডিত শ্যামল বোসের সঙ্গে ও বিখ্যাত সারেঙ্গিবাদক উস্তাদ সাগিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের বাজনার সাথে গান গাওয়ার। (একটু হেসে বললেন) কেরামত খাঁ সাহেবের আফিম নেওয়ার অভ্যাস ছিল। উনি অনেকসময় বাজাতে বসে ঝিমোতেন। তখন পাশ থেকে অন্য কেউ ওনাকে জাগিয়ে দিতেন।

এর পরবর্তীতে পন্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সমীর চট্টোপাধ্যায়, গোবিন্দ বসু, আনন্দ গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর সাহা, দুলাল নট্ট, উস্তাদ সাব্বির খাঁ ও হারমোনিয়ামে পণ্ডিত সোহনলাল শর্মা সারেঙ্গিতে রোশন আলী প্রমুখের সাথে অনুষ্ঠান করেছি। আরো অনেকে আছেন, এই মুহুর্তে তাঁদের নাম মনে পড়ছে না।

১৯৭৭ সালে কলকাতায় আই টি সি সংগীত রিসার্চ একাডেমি স্থাপিত হয়। এঁদের একটা প্রয়াস ছিল প্রাচীন গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারা পুনরায় শুরু করার। এই উদ্দেশ্যে সারা ভারতের স্ব স্ব ক্ষেত্রে যাঁরা বিখ্যাত তেমন সব দিকপাল শিল্পীদের তাঁরা নিযুক্ত করেছিলেন গুরু রূপে। এবং স্কলার হিসাবে উপযুক্ত প্রার্থীদের নির্বাচন করা হচ্ছিল। আপনি কীভাবে এই সংস্থার সাথে যুক্ত হলেন? এর জন্য কি আপনাকে অডিশন দিতে হয়েছিল?

আমি সংগীত রিসার্চ একাডেমির বিষয়ে কিছু জানতাম না। আমাকে শ্রীমতি মালবিকা কান্নন স্মরজিৎ কাঞ্জিলালের নাতনি বলে চিনতেন ও স্নেহ করতেন কারণ আমার দাদু ও ওনার বাবা একই সাথে সংগীত শিক্ষা করেছেন। এছাড়া এ টি কান্নন সাহেবও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন আমাকে কান্নন ডেকে বললেন ওনাদের বকুলবাগান রোডের বাড়িতে যেতে হবে এবং গান শোনাতে হবে। কলকাতায় সংগীত রিসার্চ একাডেমি স্থাপিত হয়েছে। ওখানে কিছু স্কলার নিয়োগ করা হবে। আমি চাই তুমি ওখানে যোগদান করো। সেই কারণে আমার বাড়িতে গানের আসরে তুমি সবাইকে গান শোনাবে। তো সেইমতো ওনাদের বকুলবাগান রোডের বাড়িতে গিয়েছি। গান গাইতে বসে দেখি শ্রোতার আসনে রয়েছেন কিচলু সাহেব, উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ, উস্তাদ ইশতিয়াক হুসেন খাঁ, উস্তাদ লতাফৎ হুসেন খাঁ, বিদুষী হীরাবাঈ বরদেকার, দীপালি নাগ, পন্ডিত ভি জি যোগ ইত্যাদি সংগীত ব্যক্তিত্ব। যাই হোক, গানের শেষে কান্নন সাহেব সবার কাছে জানতে চাইলেন, এই মেয়েটির গান কেমন লাগলো? সবাই বললেন যে তাঁদের খুব ভালো লেগেছে। হীরাবাঈ বরদেকার বললেন, এই মেয়েটি join করলে আমি ওর দায়িত্ব নেবো। তখন মালবিকা কান্নন আমাকে বললেন, দ্যাখ! তোর গানের যে ধারা তার সাথে হীরাজির গানের ধারার অনেক তফাৎ। ওঁদের গায়ন শৈলী তোর স্যুট করবে না। তুই বরং ইশতিয়াক হুসেন খাঁ-র কাছে তালিম নে। ওদের রামপুর-সহস্বান ঘরানার গায়কীর সাথে তোদের ঘরের গায়কীর কিছুটা মিল আছে। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে যোগদান করবো? তখন এ টি কান্নন সাহেব বললেন, অবশ্যই যোগদান করবে। আমার সংগীত গুরু প্রশান্ত দাশগুপ্তও বললেন, যখন এ টি কান্নন বলছেন তখন তুমি ওখানে যোগদান করো।

আমি ইশতিয়াক হুসেন খাঁ সাহেবের তত্বাবধানে ওখানে শিক্ষা শুরু করলাম।

ওখানে সংগীত শিক্ষার ধারা কেমন ছিল? এক একজনকে আলাদা ভাবে শেখানো হতো? নাকি গ্রুপ করে শেখানো হতো?

ওখানে আমাদের ক্লাসের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকতো। সেই সময়ে আমাদের উস্তাদজির কাছে যেতে হতো এবং একাডেমিতে নিযুক্ত একজন তবলাবাদক কে নিয়ে যেতে হতো। অধিকাংশ সময় পন্ডিত আনন্দ গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন তবলা সঙ্গতে। না, গ্রুপে গান শেখানো হতো না। স্বর্গীয় পন্ডিত অরুণ ভাদুড়ী ও আমি – এই দুজন উস্তাদজির কাছে গান শিখতাম। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন শ্রী টি এন সিং। উনি বেনারসের মানুষ ছিলেন এবং খুবই সংগীত প্রিয় ছিলেন। কলকাতা রাজভবনে সেবার উস্তাদজির গানের আসর বসেছিল। উস্তাদজি অরুণবাবু ও আমাকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন গাইবার জন্য। তবে উস্তাদজি বেশিদিন কলকাতায় থাকেন নি। উনি চলে যাবার পরে উস্তাদ লতাফৎ হুসেন খাঁ আমাকে ডেকে নেন তালিম দেওয়ার জন্য। উনি আগ্রা-আত্রৌলি ঘরানার গায়ক ছিলেন। তবে আমার কাছে ওনার গায়ণশৈলী অতটা আকর্ষণীয় লাগতো না। ইশতিয়াক হুসেন খাঁ সাহেবের তুলনায় লতাফৎ হুসেন খাঁ-এর গানে মাধুর্য্য কম ছিল। আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আপ্পাজির (বিদূষী গিরিজা দেবী) মেয়ে আমাদের হিন্দি পড়া, লেখা ও কথা বলার ট্রেনিং দিতো।

সংগীত রিসার্চ একাডেমীতে নাকি প্রায়ই সংগীত সম্মেলন হতো? এ কথা কি সত্যি?

হ্যাঁ। শুধু বহিরাগত শিল্পীদের নয়, যাঁরা স্কলার রূপে যোগদান করেছিলেন তাঁদেরও প্রায়ই স্টেজ পারফরম্যান্স করতে হতো। একবার একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল যেটার ভাবনায় খুব অভিনবত্ব ছিল। এই অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনায় ছিলেন শ্রদ্ধেয় পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও বিদূষী দীপালি নাগ।

রাজ দরবারে গানের আসর বসেছে। সেখানে এক বাঈজি ও সভাগায়ক গান গাইছেন। রাজাও গান গাইছেন। রাজা হয়েছিলেন পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী ও ওনার স্ত্রী হয়েছিলেন রানী। তখন সদ্য ওনাদের বিয়ে হয়েছে। আমি হয়েছিলাম বাঈজি। অরুণ ভাদুড়ী সভাগায়ক। এছাড়াও বকুল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন গানে। আরো অনেকেই গান গেয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটি নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আলোচনা হয়েছিল।

আর একটা ঘটনা বলি। সেবারে জয়পুর-আত্রৌলী ঘরানার বিখ্যাত গায়িকা বিদূষী কিশোরী আমনকর এসেছেন সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে। আমরা যাঁরা স্কলার ছিলাম সবাই মিলে ওনার খিদমত করতাম। হাত পা টিপে দিতাম। উদ্দেশ্য একটাই। সামনে বসে ওনার গান শুনবো। উনি অত্যন্ত মুডি আর্টিস্ট ছিলেন। সহজে গান গাইতে চাইতেন না। তো সেবার উনি গান শোনাতে রাজি হয়েছিলেন। সারা কলকাতার বিখ্যাত সব মানুষ এসেছিলেন ওনার গান শুনতে। আমার মনে পড়ে সিনেমার জগতের শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ রায় ও অপর্ণা সেনও সেদিন এসেছিলেন।

একটা সময় আপনার ও লীনা মুখোপাধ্যায়ের যুগলবন্দি খেয়াল গানের কথা সবার মুখে মুখে শোনা যেত। এবিষয়ে কিছু বলুন। আপনাদের আগে আর কোনো মহিলা শিল্পীরা কি যুগলবন্দি খেয়াল গেয়েছেন?

হ্যাঁ। একটা সময়ে আমাদের যুগলবন্দি খেয়াল বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। যুগলবন্দি খেয়াল গাইবার প্রধান শর্ত হল দু-জনের মধ্যে বোঝাপড়া। দু-জন শিল্পীকেই বুঝতে হবে কোথায় ধরতে হবে, কোথায় ছাড়তে হবে। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখানোর জন্য যুগলবন্দি গানে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়া অনুচিত। এছাড়াও সময় বুঝে শিল্পীদের নিজেদের দক্ষতার জায়গা দেখানো যেতে পারে।

সেইসময় মিডিয়ার এমন রমরমা ব্যাপার ছিল না। সেক্ষেত্রে অন্য কেউ গেয়েছেন কিনা আমার সঠিক জানা নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গ ও বাইরে আমরা অনেক অনুষ্ঠান করেছি।

উচ্চাঙ্গ সংগীত নিয়ে আপনার কাছে অনেক কিছু শুনলাম। আপনার কাছে এত কথা রয়েছে যে আরো কয়েক ঘন্টা কেটে যাবে। কিন্তু আমাদের সময় তো নির্দিষ্ট করা আছে, তাই এবারে বরং আমরা নজরুলগীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করি। আপনি নজরুলগীতি-র প্রতি আকৃষ্ট হলেন কীভাবে?

আমার নজরুলগীতি শিক্ষার ব্যাপারে একটা মজার ঘটনা আছে। সেটা পরে বলছি।

আমি কিন্তু শুধুই উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছি ও তাই নিয়েই থাকতে ভালোবাসতাম। কিন্তু শুধুমাত্র উচ্চাঙ্গ সংগীত গাইলে তো চলবে না। আর অধিকাংশ নজরুলগীতি যেহেতু রাগভিত্তিক তাই আমার এই ধরণের গানের প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করতো। আমাদের বাড়ির কাছেই আমার এক দাদা থাকতো। সে ছিল নজরুলগীতির ভক্ত। ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া নজরুলগীতির রেকর্ড কিনে আনতো আর আমাকে খবর দিতো শুনতে যাওয়ার জন্য। আমি শুনে শুনে সেই গানগুলি কণ্ঠে ধারণ করার চেষ্টা করতাম। বারাসাতেই আমার এক বন্ধু ছিল – অনুপ রায়। ও ভালো তবলা বাজাতো এবং আমরা একসাথে গান বাজনা করতাম। ও যেত রাধাকান্ত নন্দীর তবলাবাদনকে অনুসরণ করার জন্য। আর আমি শুনতাম মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গায়কী। কারণ তখন নজরুলগীতির জগতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এক উজ্জ্বল নাম। ওনার কাকা শ্রী সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় ছিলেন কাজী সাহেবের শিষ্য এবং যতদিন কাজী সাহেব সুস্থ ছিলেন ততদিন অবধি উনি কাজী সাহেবের সাথে যুক্ত ছিলেন।

এর মধ্যে বারাসাত Toll Tax দফতর থেকে এক প্রভাতী সংগীতের আসরের আয়োজন করেছিলেন বারাসাতের বিজয়া সিনেমা হলে। সেখানে আমাকে গাইতে বলা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়-এর গান সাথে রাধাকান্ত নন্দী-র তবলাবাদন। আমি গান গাইছি এমন সময় ওনারা দু’জন হলে প্রবেশ করলেন এবং সামনের সারিতে বসে আমার গান শুনলেন। অনুষ্ঠান হয়ে যাবার পরে উদ্যোক্তাদের একজন এসে আমায় বললেন, আপনাকে গ্রীনরুমে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও রাধাকান্ত নন্দী ডাকছেন। শুনে আমি তো ভয়ে অস্থির। কী জানি, বোধহয় ভুলভাল গান গেয়েছি। তাই বোধহয় আমাকে ডাকছেন। তো গিয়ে আমি দুজনকে প্রণাম করলাম। দেখি মানবেন্দ্রবাবু হাসছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি শুধুই নজরুলগীতি গাই, নাকি অন্য গানও গেয়ে থাকি। আমি জানালাম আমি শুধুমাত্র উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখি ও গেয়ে থাকি। এইসব গান আমি আপনার রেকর্ড শুনে তোলার চেষ্টা করেছি। ওনাদের সাথে ছিলেন বারাসতেরই একজন মানুষ -অনন্ত চ্যাটার্জী। রাধাকান্ত নন্দী ওনাকে বললেন, এই মেয়েটাকে চেনো? উনি বললেন, নাম শুনেছি তবে চিনিনা। তখন রাধাকান্ত নন্দী বললেন, একটু খোঁজ নাও। দেখি এর জন্য কী করতে পারি।
এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমাদের বাড়ি একদিন হঠাৎ করে চলে এলেন রাধাকান্ত নন্দী সাথে ছিলেন নারায়ণ চৌধুরী ও অনন্ত চ্যাটার্জী। সবাইকে আবার গান শোনাতে হলো। এরপরে রাধুবাবু বাবাকে বললেন, আপনি কি মেয়েকে নজরুলগীতি শেখাতে চান? তাহলে আমি ওর গান শেখার ব্যবস্থা করে দেবো। বাবা বললেন, ও যদি শিখতে চায় তবে আমার আপত্তি থাকবে কেন?

এরপরে আমি নজরুলগীতি শেখা শুরু করি শ্রদ্ধেয় শ্রী বিমান মুখোপাধ্যায়-এর কাছে। পরবর্তীতে পন্ডিত শ্রী সুকুমার মিত্রের কাছে শিখেছি এবং উনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ওনার কাছে শিখেছি। এরপর আকাশবাণী কলকাতায় নজরুলগীতিতে অডিশন পাশ করলাম। সেই সূত্র ধরে দূরদর্শন এ অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেলাম। ১৯৭৮ সালে মেগাফোন কোম্পানি থেকে প্রথম নজরুলগীতির চারটে গানের একটা E.P. রেকর্ড বেরোলো। এরপরে পলিডোর কোম্পানি (পরবর্তীতে মিউজিক ইন্ডিয়া) থেকে আরো একটা E.P. রেকর্ড বের হয়। এর পরে ইনরেকো কোম্পানি থেকে দুটো লং প্লেয়িং রেকর্ড বের হয়। তাতেও আমার গান ছিল। এরপরে এলো ক্যাসেটের যুগ। প্রথম ক্যাসেটটি প্রকাশিত হয়েছিল মেগাফোন কোম্পানি থেকে ও পরেরটা কিরণ কোম্পানি থেকে। তখন থেকেই নজরুলগীতি-র নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমতে শুরু করেছিল। নজরুলগীতি-র সুর নিয়ে তখন থেকে একটা চাপান-উতোর শুরু হয়েছিল। এই শুদ্ধ সুর ও বিকৃত সুরের দোটানায় পড়ে আমি আর গান রেকর্ড করতে আগ্রহী হই নি।

নজরুলগীতি নিয়ে এই যে অভিযোগ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ নজরুলের গানের শুদ্ধতা নিয়ে যে কাজ করছেন সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?

অবশ্যই এটা খুব ভালো উদ্যোগ। একজন কবির গান ভিন্ন ভিন্ন সুরে কেন গাওয়া হবে? এ প্রশ্ন তো আমাদেরও? ওঁরা কাজী সাহেব সুস্থ থাকা অবস্থায় (অর্থাৎ ১৯৪২ সাল অবধি) রেকর্ড হওয়া বিভিন্ন গান সংগ্রহ করে সেই সব গানের স্বরলিপি করছেন এবং সাথে গানের শিল্পীর নাম, রেকর্ড নং ও কোন কোম্পানি থেকে কবে প্রকাশিত হয়েছিল সেইসব তথ্য উল্লেখ করছেন। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন মনে জাগে। কাজী সাহেবের জীবদ্দশায় আরো অনেক গান সৃষ্টি হয়েছিল যেগুলি রেকর্ড করা হয়নি। সেইসব গানের ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত হবে? বহু প্রবীণ শিল্পীরা সেসব গান পরবর্তীতে গেয়েছেন। যেমন শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র, শ্রী সুকুমার মিত্র, শ্রীমতি সুপ্রভা সরকার। এঁরা নিশ্চয় বিকৃত সুরে গান গান নি। কাজেই এই ব্যাপারে একটা মস্ত সমস্যা রয়েছে বলে আমি মনে করি।

এবারে একটা অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি দীর্ঘদিন ধরে গান শেখাচ্ছেন। আগের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে কোনো ফারাক চোখে পড়ছে কি?

অবশ্যই। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এখনকার প্রজন্ম অনেক বেশি কেরিয়ার সচেতন। তারা কেউ তানপুরার সাথে কন্ঠ চর্চায় আগ্রহী নয়। এমনকি ভালো করে পালটা বা অলংকার চর্চার আগেই গান শেখার জন্য ব্যগ্র। সঠিকভাবে কন্ঠ চর্চা বা সঠিক স্বরস্থান সম্পর্কে ধারণা হলে তবেই গান সুন্দর স্বাভাবিক ভাবে গান কণ্ঠে ধারণ করা সম্ভব— এই ধ্রুবসত্য বোঝানো খুব কঠিন। এছাড়াও উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখার ক্ষেত্রে অনেকেরই অনীহা রয়েছে।

গান শেখার ক্ষেত্রে কেন এমন অবস্থা? আপনার কী মনে হয়?

আমার মনে হয় এক্ষেত্রে টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো অনেকাংশে দায়ী। এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা ধারণা করে নিয়েছে রিয়েলিটি শো তে গান করতে পারলে যেন মোক্ষ লাভ করা হয়ে হবে। ওখানে গান গাইতে গেলেও যে শিক্ষার প্রয়োজন সেটা বুঝতে চায় না। আর এখন তো ইউ টিউব সবার সংগীতগুরুর ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে।

আপনি কি তবে আগামী দিনের গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী নন?

একেবারেই নয়। অন্ততঃ উচ্চাঙ্গ সংগীতের ক্ষেত্রে। উচ্চাঙ্গ সংগীত হলো আসল ভিত্তি যার উপর নির্ভর করে সংগীতের পরবর্তী ধাপগুলিতে আরোহণ করা যায়। যদি ভিত নড়বড়ে হয়, তার উপরে কি প্রাসাদ নির্মাণ সম্ভব? বাংলা গানেরও সেই অবস্থা! আসলে রুচি এখন নিম্নগামী। বিগত দশ/পনেরো বছরে এমন কোনো গান সৃষ্টি হয়েছে কি যা আরো পঞ্চাশ বছর পরে মানুষ শুনবেন? এখন নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মতো গানেরও তেমন অবস্থা হয়েছে। কিছুদিন পরেই সেটা বাতিলের দলে চলে যাচ্ছে। শাশ্বত বলে আর কিছু থাকছে না।